Search

Monday, February 3, 2020

আস্থা ফেরাতে পারেনি ইভিএম

মসিউর রহমান খান

ভোটার উপস্থিতি কম

মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নারীদের গোপন কক্ষে এক পুরুষ সদস্য ঢুকে জোর করে ভোট দেন। ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাজিদ হোসেন

ঢাকার দুই সিটি ভোটের ফল ঘোষণার পর জয়-পরাজয়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে। কেউ কেউ এ জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারকে দায়ী করছেন। এ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কমতি ছিল না।

নির্বাচনের দিন বড় ধরনের কোনো গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি। তবে নির্বাচন কতটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে- তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্নেষণ। ভোটের সব ধরনের অনিয়ম দূর করতে ইভিএম ব্যবহারের কথা জানিয়েছিলেন ইসির শীর্ষ কর্তারা। তবে ফল ঘোষণায় যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে ইভিএম তাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দুই সিটির দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় গতকাল সাংবাদিকদের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথের গোপন কক্ষে বহিরাগতের উপস্থিতি  ইভিএমের সাফল্য অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধাদান, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা ও হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগেও প্রশাসনের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে ইসির ওপর জনগণের আস্থাহীনতা এই ভোটের পরও একই অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্নেষকরা। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি হরতালসহ নানা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

এদিকে, প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ভোট পড়েছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর বলেছেন, এর কারণ জানতে গবেষণা করতে হবে। গতকাল রোববার নির্বাচন ভবনে ভোটের ফল নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতির হার উত্তরে ২৫ দশমিক ৩০ ভাগ ও দক্ষিণে ২৯ দশমিক ০০২ ভাগ। গড়ে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ। তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতির এ হারে ইসি অসন্তুষ্ট নয়, তবে আরও ভোট পড়লে তারা খুশি হতেন। তাদের ধারণা ছিল, ৫০ ভাগের মতো ভোট পড়বে।

ইসির কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটের সব অনিয়ম দূর করার পাশাপাশি দ্রুত ফল প্রকাশের কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু সনাতনী ব্যালটে ভোট গণনার তুলনায় ইভিএমে কম সময় লাগেনি। এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম বলেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটিই এই দেরির কারণ। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন শনিবার রাতে ফল ঘোষণার সময়ই বলেছিলেন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে ফল প্রকাশে দেরি হয়েছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইভিএমে এবার উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ কাগজের ব্যালটে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দুই সিটিতে ভোট পড়েছিল ৪৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে দুপুরের পরপরই অধিকাংশ মেয়র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবারে কম ভোট পড়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের আস্থাহীনতা কাজ করছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, অনাস্থার কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি, এটা তার মনে হচ্ছে না। জনগণ ছুটি পেয়েছে, অনেকে ছুটি উপভোগ করেছে। কেউ কেউ ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ছয় আসনে ভোটের হার ছিল ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ একদিনে হয়নি বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইভিএম-ভীতি, নিজের ভোট নিজে দিতে না পারা, কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা, সহিংসতা, ইসির নিষ্ফ্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণে ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ হচ্ছেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার ছাড়াই ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের আনিসুল হক টেবিল ঘড়ি মার্কায় পেয়েছিলেন চার লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট; তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তাবিথ আউয়াল বাস মার্কায় পান তিন লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। শতকরা ভোট পড়েছিল ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওই সময় মোট ভোটার ছিল ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯০০। এবার দলীয় প্রতীকের ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন চার লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। নিকটতম বিএনপির তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। ভোট পড়ার হার ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। মোট ভোটার ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। গতবারের তুলনায় এবার ১২ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাননি। আতিকুল ভোট পেয়েছেন ৫৯ শতাংশ আর তাবিথ ৩৫ শতাংশ। তারা মোট ভোটারের পর্যায়ক্রমে ১৫ শতাংশ এবং ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

অন্যদিকে ২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৭৮ জন। এখানে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ইলিশ মাছ প্রতীকে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীক নিয়ে ভোট পান দুই লাখ ৯৪ হাজার ২৯১টি। ভোট পড়েছিল ৪৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি বছর ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ ভোটারের মধ্যে ইভিএমের ভোটে আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস পেয়েছেন চার লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইশরাক হোসেন পেয়েছেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট। ভোট পড়েছে শতকরা ২৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। দক্ষিণে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাননি। তাপস শতকরা ৬০ শতাংশ আর ইশরাক ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। মোট ভোটারের মধ্যে তারা পেয়েছেন ১৭ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ ভোট।

ইভিএমে অনুষ্ঠিত রংপুর-৩ এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে দেখা গেছে, ভোট দেওয়ার হার খুবই কম। গত বছরের ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রংপুর-৩ আসনে ভোট পড়ে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইভিএমে অনুষ্ঠিত এই আসনে ভোট পড়েছিল ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোট পড়ে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একইভাবে গত ১৩ জানুয়ারি চাঁদপুরের হাইমচর পৌরসভার নির্বাচনে ভোট পড়ে ৪০ শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়। ব্যালটের সনাতন পদ্ধতিতে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ। আর ইভিএমের ছয় আসনে ভোটের হার ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভোটারদের আস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনার ও সরকার ভোটারদের কোনোভাইে বিশ্বাস স্থাপন করাতে পারছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে গণতন্ত্র শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোট দিতে পারেনি- এমন অভিযোগ রয়েছে। ওই নির্বাচনে নিজের ভোট দিতে না পারায় ভোটাররা ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব এর পরের সব নির্বাচনে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে যত যাই বলা হোক না কেন, নির্বাচনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাস্তবতা হলো, ভোটাররা যখন দেখেন তাদের ভোট আগেই হয়ে যায়, তখন তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ আর পায় না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা যেমন ছিল, তেমন ইভিএম ভীতিও কাজ করেছে। তিনি বলেন, ভোটাররা মনে করছেন, তাদের ভোটে কোনো পরিবর্তন ঘটে না; যা হওয়ার তাই হবে। তাই তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা মনে করেন, কেন্দ্রে ভোটার আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করা। ভোটারদের কেন্দ্রে আনার প্রধান কাজ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের।

  • কার্টসি - সমকাল/ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 

No comments:

Post a Comment