Search

Thursday, February 20, 2020

খালেদা জিয়ার জামিন কোন পথে

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


এক-এগারোর বিশেষ সরকারের সময় দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই প্রধান নেত্রীর নামেই মামলা হয়েছিল। জেলে যেতে হয়েছিল দুজনকেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে ৫টি ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নামে ১৫টি মামলা হয়ে ছিল তখন। সেই বিশেষ সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে যে বিশেষ নির্বাচনটি হয়েছিল তাতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন থেকেই বাড়তে থাকে খালেদা জিয়ার নামে মামলার সংখ্যা। ৫ মামলা বেড়ে হয়ে যায় ৩৬টি। আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে থাকা ১৫টি মামলা খারিজ হয়ে যায় বা বাদী প্রত্যাহার করে নেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমর্থকদের সরলীকরণ বক্তব্য, শেখ হাসিনার মামলাগুলো আদালতের মাধ্যমে আইনানুগভাবে ফয়সালা হয়েছে।

তাদের কাছে এবং দেশাবাসীর কাছে যদি আরও দুটি সরল প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, তবে তার উত্তর কী হতে পারে? এক. এক-এগারো সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করেছিল তার সবগুলোই মিথ্যা, অপরদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল তার সবগুলোই ঠিক ছিল? দুই. ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এসে যদি বিএনপি আসত আর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলেও কী দুই নেত্রীর মামলার পরিণতি এখন যা হয়েছে তাই হতো? মানে প্রধানমন্ত্রী হলেও খালেদা জিয়ার এখনকার মতোই সাজা, জেল, পছন্দমতো সেন্টারে চিকিৎসা না পাওয়া- এগুলোই ঘটত? আর শেখ হাসিনার নামে থাকা সব মামলা ‘আইনানুগ ভাবেই’ খারিজ হয়ে যেত অথবা বাদীরা নিজ উদ্যোগে মামলা তুলে নিতেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্যেই নিহীত আছে বাংলাদেশের আদালতের প্রতি জনমানুষের আস্থার মানদন্ড। এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে আদালতের রায়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাও বেরিয়ে আসবে এই প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই। এইবার উত্তরগুলো সৎভাবে দিয়ে নিজের বিবেকের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। তারপর বলুন, খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার কি না? একদেশে এক আইন সবার বেলায় একভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও জামিন পেতে পারেন, মন্ত্রী থাকতে পারেন। সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিএনপি নেতা অধুনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য তৈরি করা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর জামিন পেতে পারেন। জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে আমৃত্যু জামিন ভোগ করে যেতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়া বারবার আবেদন করেও জামিন পান না। এই যে এক আইনে বিচারের দুই ফল, সেটাই অনেকের মনে এই ধারণা দেয় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন বিশেষ কারণে সুতোর টানে আটকে আছে। আর তার পেছনে আছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও অনেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও খালেদা জিয়া সে অধিকারটুকুও পান না।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে আছে অনেক প্রশ্ন। সে মামলার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সেক্রেটারি সাংবাদিক মারুফ কামাল খান লিখেছেন, এই যে এত হেনস্তা যে মামলাটি নিয়ে সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কখনো কোনো ধরনের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তিনি এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ট্রাস্টি কিছুই নন।

ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন জামানায় দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এ মামলাটি দায়ের করে। মামলায় প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্ট দেন। তিনি আদালতে তার সাক্ষ্যেও সে কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে অধিকতর তদন্তের নামে দুদকের আরেকজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই কর্মকর্তা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন। কুয়েত থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থে গঠিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের প্রাথমিক মূলধন ছিল ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫শ টাকা। এই টাকা থেকে বগুড়ায় এতিমখানা স্থাপনের জন্য প্রায় পৌনে তিন একরের বেশি জমি কেনার পর বাকি সমুদয় টাকা ট্রাস্টের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকে সুদের হার বেশি হওয়ায় ট্রাস্টের টাকা বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমি কেনার পরেও সুদাসলে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার টাকারও বেশি।

তারপরেও খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। প্রথমে পাঁচ বছর। পরে তা বেড়ে দশ বছর হয়েছে। আগেই বলেছি, এর থেকে বড় সাজা নিয়েও অনেকের জামিন পাওয়ার নজির আছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বেলায় ভিন্ন ফয়সালা। কেন এমনটা হচ্ছে সে প্রশ্নই জেগেছে মানুষের মনে।

খালেদা জিয়া কে, তা নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথমত তিনি এই দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবীণ নারী। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনপ্রিয়তম শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী যিনি জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। দেশের অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রধান। এই দেশেরই সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান, সেক্টর কমান্ডার ও একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। তিনি আজ বন্দি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ। তারপরও তিনি কেন জামিন পান না? তিনি কি জামিন পেলে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন? তিনি এই মামলাকে প্রভাবিত করতে পারেন? খালেদা জিয়া যে তেমন ব্যক্তি নন এটা সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তাকে জামিন দিতে অসুবিধা কোথায়, সে প্রশ্নটি এখন দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার এই সব পরিচয়ের কোনোই মূল্য নেই আদালতের কাছে। জামিনের জন্য এর কোনো উপাদানই আমলযোগ্য নয়। কিন্তু আইন বিষয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করা সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান দুদিন আগেই প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘বিদ্যমান আইন বলছে, নারী, বিশেষ করে তিনি যদি প্রবীণ নাগরিক হন এবং তার স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তিনি জামিন পেতে বিশেষ বিবেচনার হকদার।’ 

তাহলে কেন প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে? এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খালেদা জিয়ার যে সাহসী ভূমিকা রয়েছে সেটাও কয়জন নেত্রীর আছে? খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে কি না আর মিললে তা কী পদ্ধতিতে ঘটবে সেটাই এখন দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তারা চান খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করুন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মাত্রা ও জনআকাক্সক্ষা বিবেচনায় যদি মুক্তি দিতেই হয়, সে ক্ষেত্রেও সরকার যেন দেখাতে পারে যে তাদের অনুকম্পা নিয়ে, তাদের সঙ্গে আপোস করেই জামিন নিতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ খালেদা জিয়া আর আপোসহীন নন, তিনি আপোসকামী নেত্রী।

অনেকেই মনে করেন, তার জন্য কাল হয়েছে অপরাজিত জনপ্রিয় ও ‘আপোসহীন নেত্রী’ অভিধাটি। খালেদা জিয়া ‘আপোসহীন নেত্রী’ উপাধি নিয়ে থাকবেন সেটা মেনে নেওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হতেই পারে। তাই তারা চান, খালেদা জিয়া যেন প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করেন। যাতে তারা বলতে পারেন যে ‘আপোসহীন নেত্রী’ তো আপোস করলেন। তাই বিএনপির একটা অংশ প্যারোলে মুক্তি চাওয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদেরও মনে রাখা দরকার, খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাটাও জরুরি। তাকে সাজা দিয়ে যদি আটকে রেখে, চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তবে যে কোনো কৌশল অবলম্বন করে সে ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলে তাতে আপোসহীন চরিত্র ক্ষুণ্ণ হয়ে যাবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। প্যারোলে মুক্তি তো এর আগেও নিয়েছেন দুই নেত্রীই। সুতরাং প্যারোল বা আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসা করানো হলো সেটা বড় বিষয় নয়। বরং শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। প্যারোলে মুক্তির আবেদনের পর এই সরকার সেটা নিয়ে আবার কোনো নাটক ফেঁদে বসবে কিনা সেটাই বা কে জানে। শেষ পর্যন্ত প্যারোলেও মুক্তি হবে নাকি খালেদা জিয়াকে জেলেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।        

  • লেখক- চিকিৎসক ও কলামিস্ট
  • কার্টসি - দেশ রূপান্তর/ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০

No comments:

Post a Comment