ড. মাহবুব উল্লাহ্ |
আজ ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৮ সালের এই দিনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন।
এ উপলক্ষে তিনি ২ ঘণ্টাব্যাপী এক সংবাদ সম্মেলনে নবগঠিত দল সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে এ নবগঠিত দলে যোগদানের আহ্বান জানান।
তার দলের প্রধান লক্ষ্যগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সুসংহত করা হবে, জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতি গড়ে উঠবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে; প্রগতি অর্জন, স্বনির্ভরতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে।
জিয়া নবগঠিত দলটির আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার বক্তব্য পেশ করছিলেন। তিনি জানান, দলটির ১১ সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী কমিটি, সংসদীয় বোর্ড এবং গ্রাম পর্যায় থেকে গড়ে ওঠা দলটির একটি ইলেকট্রোরাল কলেজ থাকবে। এর আগে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয় অর্জন করেন। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নেতারা অংশগ্রহণ করেন।
জিয়া বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত কোন কোন দল নবগঠিত দলে একাত্ম হবে তা পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। উল্লেখ্য, কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে সক্রিয়ভাবে শামিল হলেও নবগঠিত দল বিএনপিতে যোগদান করেনি।
কাজী জাফর আহমদ জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেছিলেন এবং তার অধীনে প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে না পারলেও পার্টির অভ্যন্তরে সংগ্রামের নীতির ভিত্তিতে ওই দলেই থেকে গিয়েছিলেন জীবনের শেষ কয়েকটি বছরের আগ পর্যন্ত। তিনি এরশাদের দল থেকে বের হয়ে এসে তার নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তরুণ বয়সে বাম রাজনীতির লড়াকু এই সৈনিক শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় তার বক্তব্য ছিল, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে বিএনপিতে যোগ না দেয়া ছিল তার জীবনের একটি বড় রাজনৈতিক ভুল। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টভুক্ত দলগুলো ছিল আওয়ামী লীগবিরোধী। ১৯৭২-৭৫ পর্যায়ে তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনেক রাজনৈতিক দলই আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সে সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) আওয়ামী লীগবিরোধী ছিল।
বস্তুত তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছিল ঘোরতর আওয়ামী লীগবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে। জিয়া তার নতুন দলে আওয়ামী - বাকশালবিরোধীদের সমবেত করতে চাইলেও জাসদের সেখানে কোনো ঠাঁই ছিল না।
কারণ ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তারা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে পরস্পরের বৈরী এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। জিয়ার নবগঠিত দলে মূলত আওয়ামী লীগবিরোধীরাই সমবেত হয়েছিল।
এদের একটি বড় অংশ এসেছিল মশিউর রহমান জাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে। এ দলটি ছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ। ভাসানীপন্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ব্যক্তিগতভাবে অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদল হিসেবে অনেকেই বিএনপিতে যোগদান করে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও মুসলিম লীগেরও কেউ কেউ ছিলেন।
জিয়া মনে করতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের থাবা থেকে মুক্ত নয়। কাজেই এ আগ্রাসী শক্তিবিরোধী সবাইকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব হয়ে পড়বে। জিয়া ছিলেন একজন সৎ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের অন্তস্তলে আসন পাওয়া একজন জাতীয় বীর। এ কারণেই সম্প্রসারণবাদীরা জিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। একটি ভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিকের সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সেরকম আয়োজনই করেছিল। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যে ভারতের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন ঘটে। ইন্দিরা গান্ধীর পরিবর্তে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি যখন জানতে পারলেন, জিয়া হত্যার একটি প্রকল্প কার্যকর হতে চলেছে, তিনি তখনই এটি স্থগিত করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলে পুরনো প্রকল্পটি আবার চাঙ্গা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এরই পরিণতিতে ১৯৮১-র ৩০ মে রাতে জিয়া সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী অফিসারদের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নৃশংসভাবে নিহত হন। জিয়ার মৃত্যুর পর ঢাকায় শেরে বাংলানগরে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এমন বিশাল জনসমুদ্রে অতীতে কিংবা পরবর্তীকালে কোনো রাষ্ট্রপতিকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে কিনা সন্দেহ।
প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার |
জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে বিএনপি থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। কিন্তু তার শাসন স্বল্পকাল স্থায়ী হয়। ’৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নানা কলাকৌশল করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন। এ পর্যায়ে বিএনপির অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জিয়াপত্নী বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। বলা যায়, তখন থেকে ক্রন্দসি বিধবা থেকে জাতীয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
শুরুতে বেগম জিয়া খুব ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন না। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগল, ততই তিনি একজন পরিপক্ব নেত্রী হিসেবে তৈরি হলেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ হল তার ক্যারিশমা। তিনি কোথাও দাঁড়ালে মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপক জনসমাগম হয়। তিনি ৯ বছরব্যাপী এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করে আপসহীন নেত্রীর মর্যাদা অর্জন করেন। এ সময় অনেক সুবিধাবাদী নেতা দল ছেড়ে গেলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব গুণের ফলে দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি।
জেনারেল এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া তার দলের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হন এবং সরকার গঠন করেন। ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ পর্বে বিএনপি দুই দুইবার পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে। মাঝখানে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপিকে কার্যত অংশগ্রহণহীন নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। মাত্র দেড় মাসেরও কম সময় ক্ষমতায় থেকে বিএনপি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজন করে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ সুগম করে দেয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কঠোর আন্দোলন করছিল।
বিএনপির বিরুদ্ধে অন্যদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একটি বড় অভিযোগ হল, এটি সেনা ছাউনিতে গড়ে ওঠা একটি দল। এ সমালোচনায় সত্যতা আছে।
কিন্তু যখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করে কার্যত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অবসান ঘটানো হয়েছিল তখন কোথাও না কোথাও থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজন ছিল।
একটি দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজনৈতিক শূন্যতা থাকতে পারে না। জিয়া রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুভ সূচনা ঘটান। এর ফলে আওয়ামী লীগও নবজীবন লাভ করে। অবশ্য দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনীতি করার সুযোগ পায়, যা আজ অবধি চালু আছে। জিয়া সরকারের বড় সাফল্য ছিল দেশে পোশাকশিল্প গড়ে তোলা এবং বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা।আজও বাংলাদেশের অর্থনীতি এ দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়া |
বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সাফল্য হল খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে ছেলেশিশু এবং মেয়েশিশুদের ব্যাপকভাবে স্কুলমুখী করা। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীও তার শাসনামলে বিস্তৃত হয়। দেশে বেশ কিছু নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে সড়ক যোগাযোগকে উন্নত করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই ২০০৫ সালের পোশাকশিল্প খাতে এমএফএ ফেজ অডিটের চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা হয়। এর ফলে পোশাকশিল্পে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়।
তার শাসনামলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থাকলেও এখনকার মতো আর্থিক খাত বিধ্বংসী খেলাপি ঋণের সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেনি। দেশে আর্থিক শৃঙ্খলা তুলনামূলকভাবে মজবুত ছিল। তবে এ কথাও সত্য, উপর তলার কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এক-এগারোর অবৈধ সেনাশাসিত সরকারের সময় থেকে বিএনপির ওপর যেভাবে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো শুরু হয় তা আজ অবধি অব্যাহত আছে।
অত্যাচার, নির্যাতন ও গুম-খুনে দলটি ম্রিয়মাণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সাল থেকে বিএনপি নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে যে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে তা কতটুকু সঠিক বা বেঠিক ছিল দলটিকে সে মূল্যায়নের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। অতীতের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করেই ভবিষ্যতের পথে এগোতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে জিয়া প্রবর্তিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রাজনীতির রূপরেখা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।
দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবি সংবলিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে পারলেই বিএনপি বিদ্যমান সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। বিএনপির জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনীতি, সঠিক পন্থা এবং সুদৃঢ় সংগঠন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
কার্টসি — যুগান্তর/ রোববার, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৯।
লিঙ্ক — http://bit.ly/2UnNVqo
No comments:
Post a Comment