Search

Monday, September 9, 2019

ব্যাংক নয়, তবে কি আস্থার জায়গা সিন্দুক?

রুমিন ফারহানা


অক্টোবর ২০১৮, একটি খবর নজর কাড়ল পুরো বিশ্বের। বিশ্ববিখ্যাত গাড়ি উৎপাদক টয়োটা বিনাশর্তে সারা বিশ্ব থেকে ফেরত নিল তাদের উৎপাদিত একটি বিশেষ মডেলের ২৪ লাখ গাড়ি। সমস্যা কী ছিল? এ ২৪ লাখ গাড়ির গ্রাহক কি টয়োটাকে বলেছিল গাড়ি ফেরত নিতে? একদম না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই গাড়ির ত্রুটি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে ২৪ লাখ বিক্রি হওয়া গাড়ি বিনা বাক্যব্যয়ে ফেরত নেয় টয়োটা।

কারণ একটাই, এ ধরনের ত্রুটি তার ব্যবসার যে মূল পুঁজি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস সেই জায়গাটিতে আঘাত হানে। মানুষের বিশ্বাসের প্রতি এ শ্রদ্ধাবোধই তৈরি করে একেকটি ব্র্যান্ড। যে কারণে একটি পণ্যের অসংখ্য উৎপাদনকারী থাকার পরও দেখা যায়, মানুষ একই জিনিস কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে একটি বিশেষ উৎপাদকের কাছ থেকে কিনছে। এর নাম ব্র্যান্ড ইমেইজ, যা তৈরি হয় দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম আর সততায়।

প্রতিটি ব্যবসায় আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও নানা ধরনের পুঁজি। কিন্তু ব্যাংক এমন একটি ব্যবসা যার ভিত্তি মানুষের বিশ্বাস। সেই জায়গা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে যে কোনো ব্যাংক রাতারাতি ধসে পড়তে বাধ্য। কোনো এক সকালে একটি ব্যাংকের বেশিরভাগ গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে যদি তাদের সম্পূর্ণ আমানত তুলে ফেলতে যান, তাহলে দুর্বল ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম, সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংকটিও দেউলিয়া হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ঠিক এমনই এক অবস্থার মুখোমুখি।

ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারেই শীর্ষে, এমনকি বিশ্বেও শীর্ষ পর্যায়ে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যখন সারা বিশ্বে এ হার নিম্নমুখী; যা ২০১৭ সালে ৩.৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ শেষে এ হার ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশে ঠেকেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী কিছু দেশের খেলাপি ঋণের হার নেপাল ১.৭ শতাংশ, ভিয়েতনাম ০.৯ শতাংশ, শ্রীলংকা ৩.৪ শতাংশ, পাকিস্তান ৮.২ শতাংশ, ভারত ৯.৩ শতাংশ।

দেশের সব অর্থনীতিবিদ তো বটেই, সরকারসমর্থক অর্থনীতিবিদরাও ব্যাংকের লুটপাটকে এ দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিছুদিন আগে পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে অবলোপনকৃত ঋণ বাদেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে; কিন্তু এটাও সঠিক অঙ্ক নয়। অর্থনীতির প্রখ্যাত একজন আওয়ামীপন্থী অধ্যাপক আমাদের জানান অবলোপনকৃত ঋণ এবং আরও কিছু ঋণ যেগুলো আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে না, সেগুলো হিসাব করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত তিন লাখ কোটি টাকা।

অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুবিধা দেয়া হয়েছিল এবং সুদ ধার্য করা হয়েছিল মাত্র ৯ শতাংশ যা ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য। অথচ ভালো ঋণগ্রহীতাদের জন্য সুদের হার এর দেড় থেকে দুইগুণ। সরকারের এ সিদ্ধান্ত হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জড হলে প্রাথমিকভাবে তা স্থগিত করা হয়। পরিতাপের বিষয় হল, সেই স্থগিতাদেশ চেম্বার আদালতে গেলে সেখানে তা স্থগিত করা হয় এবং দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ৩ সেপ্টেম্বর ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

খেলাপিদের এ ধরনের সুবিধা আমরা অতীতেও লক্ষ করেছি। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পোদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করা হয়। যেসব শিল্প গ্রুপের ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং যেসব শিল্প গ্রুপের এক হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের এক শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিল্পগুলোর লোকসান কাটিয়ে ওঠা। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে আয়-উপার্জনের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সুবিধা নিয়ে ওই সময় ১১টি শিল্প গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। এর ফলে ওই সময় রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে যায়। কিন্তু পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়ে এসব শিল্প গ্রুপ ঋণ নবায়ন করলেও পরে ওইসব খেলাপি ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করেনি। উপরন্তু যে পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করেছিল, তার কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বড় গ্রুপগুলোর অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকা এবং পরপর তিন মেয়াদ অর্থাৎ ৯ বছর পদে থাকা ব্যাংকের এ বিপর্যয় তৈরি করার জন্য কাজ করেছে। এছাড়াও তিন মাস যদি কোনো ঋণখেলাপি থাকে তাহলে তাকে খেলাপি ঋণ বলা হবে। এটিই বিশ্বের নিয়ম। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে তিন মাস নয়, নয় মাস যদি খেলাপি থাকে তাহলে সেটা খেলাপি ঋণ হবে। এর মাধ্যমে সরকার কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের অনুপাত কম দেখাতে পারবে।

ব্যাংকের রেগুলেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্রমাগত নিষ্ক্রিয় করে ফেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এবং বিএবি ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন নজিরবিহীনভাবে বিএবি’র সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আড়াই শতাংশ কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো, এক শতাংশ সিআরআর কমানোসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের অনুমোদনের খবর পত্রিকায় আসে। ব্যাংক মালিকরা নানা সুবিধা নেয়ার পর ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেয়া আর ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ায় অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের চক্করে পড়ে ১৩টি ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রভিশন রাখার অবস্থায় নেই।

এর মধ্যে একটা মজার খবর নজর কাড়ল আমাদের। ঋণখেলাপিদের পরে এবার জালিয়াতি করে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতকারীদেরও বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এ তালিকায় প্রথমেই এসেছে বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের নাম। সরকার এ ব্যবসায়ী গ্রুপকে এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে, যদিও এ সুবিধা শুধু অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য থাকার কথা ছিল, জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্তদের জন্য নয়।

ব্যাংক শুধু ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক অতি ধনীদের আমানত সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকে না, বরং হাজার টাকার মালিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এমনকি দরিদ্র মানুষেরও আমানত রক্ষা করে। অতি ধনীরা বরং সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা সুইজারল্যান্ডে নিভৃতে-নিরাপদে লোকচক্ষুর আড়ালে টাকা রাখতে পারে। যার প্রমাণ আমরা দেখি গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির রিপোর্টে, যেটি বলছে বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে গড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু গরিবের সেই সুযোগ নেই।

খেলাপি ঋণের নানা কুফলের মধ্যে অন্যতম হল তারল্য সংকট যা সরাসরি বেসরকারি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেয়া হবে। এ ধরনের ৬৮টি সংস্থার ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা যখন আবারও উন্নয়নের নামে তুলে নেয়া হবে তখন অনেক ব্যাংকই তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে।

ঋণখেলাপিবান্ধব সরকারের নানা পদক্ষেপের ভুক্তভোগী হয় দেশের সাধারণ মানুষ এবং সৎব্যবসায়ী। ব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে ডুবতে বসেছে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, নন ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন্স (এনবিএফআই)। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টিই কোনো না কোনোভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এদের মধ্যে ১২টিকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের খবর আমাদের সামনে এসেছে। এর মানে আমানতকারীদের দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে না, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের প্রাপ্য শোধ করবে, যা একটি অতি দীর্ঘ এবং ভীষণ অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। এ প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন স্পষ্ট করেছে সরকার ভবিষ্যতেও একই সমস্যায় পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও সম্ভবত একই পদক্ষেপ নেবে। এর মানে লাল তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীরা ভবিষ্যতে ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্ত তার কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের স্থায়ী আমানতকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, কারণ এটি ঝুঁকিহীন। কিন্তু এটাও এখন এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে, আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবে কিনা সেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেই তাদের আমানত তুলে নিয়ে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন শেয়ারবাজারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে একের পর এক বড় দরপতন হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কারসাজি ছাড়া বাজারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে না।

ব্যাংক, এনবিএফআই, শেয়ারবাজার, বীমা সব ধ্বংসের পর সাধারণ মানুষের আর সিন্দুক ছাড়া উপায় থাকবে না। বছরের পর বছর দেশের আর্থিক খাতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে একটা ভয়ংকর ধস অনিবার্য। এ মুহূর্তেও যদি শক্তহাতে এর হাল ধরা হয়, তাহলেও ক্ষতি কিছু কমিয়ে আনা যাবে; কিন্তু এর সম্পূর্ণ নিরাময় অসম্ভব। এর প্রধান ভুক্তভোগী হবে দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের শ্রম আর ঘামে তৈরি হয় দেশের অর্থনীতি।

  •  লেখক অ্যাডভোকেট, সুপ্রিমকোর্ট, সংসদ সদস্য। 

সূত্র — যুগান্তর/সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯।   লিঙ্ক — http://bit.ly/2lZIsIW

No comments:

Post a Comment