এমাজউদ্দীন আহমদ
এমাজউদ্দীন আহমদ |
টানা তৃতীয়বার বর্তমান সরকার এ মেয়াদে তাদের এক বছর পূর্ণ করল। সরকারের এক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে হতাশার অনেক চিত্রই ভেসে ওঠে। তাদের তরফে বলা হয়ে থাকে তারা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পর সরকার গঠিত হলো এই সরকারকে প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক সরকার বলার অবকাশ কতটা রয়েছে তা প্রশ্নের বিষয়। গণতান্ত্রিক সরকার কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছু অপরিহার্য শর্ত রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারছে না। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি, সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করাটা গণতন্ত্রের অন্যতম জরুরি শর্ত। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দরকার, যা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের এখানে অনিশ্চিত। গণতান্ত্রিক রাজনীতি বলতে যা বুঝি তাও গত এক বছরে আরও প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছে। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা- এই জরুরি বিষয়গুলোও প্রশ্নবিদ্ধ।
বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর এই সরকারের শাসনামলে স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তরের যে নির্বাচন হলো তাও অস্বচ্ছ। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্লানি পরবর্তী ধাপে স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনের মাধ্যমে আরও গভীর করেছে। ক্ষমতাসীন মহল বলেছিল তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গ চাপা তো পড়েছেই, একই সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পথ আরও সংকুচিত হয়েছে। গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েছে। সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের যে উল্লেখ রয়েছে এর ব্যত্যয় ঘটে চলেছে। গণতন্ত্রের আকাশে অনেক নক্ষত্র থাকবে, এটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি কী বলে?
আইনের শাসনের কথা সরকার জোর দিয়ে বারবার উচ্চারণ করলেও বাস্তবতার সঙ্গে এরও অনেক ফারাক। মানুষের নিরাপত্তা নেই। বিগত এক বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে দ্বিগুণ সংঘটিত হয়েছে। নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও কম ঘটেনি। এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি কথার কথা হয়েই আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে 'বালিশকাণ্ড', ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অর্থ লোপাটসহ বিভিন্ন সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতিরও কোনো দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার সরকার করতে পারেনি। এগুলো খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। ঘটনা আরও অনেক আছে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই স্বস্তির নয়। ব্যাংক খাত চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রেও সরকারের সফলতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, এমন অনেক কিছু দফায় দফায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নিত্যপণ্য পেঁয়াজ নিয়ে যে তুঘলকিকাণ্ড ঘটল তা বিস্ময়ের। অসাধু ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়ে গেল। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের চিত্রও অনুজ্জ্বল। ছাত্রলীগের বিপথগামীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরু ও তার অনুসারীরা বারবার আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা সুস্থ সমাজের চিত্র নয়।
দেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের শিকার। শত শত কোটি টাকা লোপাট করে অনেকেই আরাম-আয়াশে জীবনযাপন করছেন, কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সামান্য ত্রুটি পাহাড়সম করে তোলা হলো। গত বছরে সরকারের আগ্রাসী মনোভাবের আরও প্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। দেশের উন্নয়ন একেবারে হয়নি কিংবা অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি- এ কথা বলব না। কিন্তু কোনো উন্নয়ন-অগ্রগতিই টেকসই কিংবা স্থায়িত্ব পাবে না যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণতা না পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নই গণতান্ত্রিক সরকার, রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থার চূড়ান্ত বিচার্য বিষয় নয়- এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। সমাজে বৈষম্য যে বেড়েছে তাও তো অস্বীকার করা যাবে না। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা অগ্রগতি কি নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে রইল না?
বাঙালি জাতির অহংকার মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নাম ঢুকে গেল রাজাকারের তালিকায়। এর চেয়ে বড় মর্মবেদনা আর কী হতে পারে! এই অবমাননা কি মেনে নেওয়া যায়? এই সরকারের এক বছর পূর্তির প্রাক্কালে এত বড় অপকাণ্ড যাদের কারণে ঘটল তাদের বিরুদ্ধে কেন আজও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল অপরিহার্য। জাতীয় সংসদে এখন যারা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছেন প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংজ্ঞাসূত্র মোতাবেক তাদেরকে বিরোধী দল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার অবকাশ কতটা আছে- এও জরুরি প্রশ্ন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। গত এক বছরে তা বেড়েছে, কমেনি। এমতাবস্থায় সরকারের এক বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করতে গেলে হতাশার কথাই বলতে হবে। অসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জিইয়ে থাকলে এর ফল দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হওয়ার কথা নয়।
জনঅধিকারই গণতন্ত্র। শুধু সরকার দাবি করলেই কি আমরা সমস্বরে বলতে পারব - বিগত এক বছরে গণতন্ত্রের পথ মৃসণ হয়েছে? বরং বলা যায়, এই পথ আরও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবনের যেসব শর্ত রয়েছে যেসব ক্রমেই ভেঙে পড়ছে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে। যদি 'আমার' কিংবা 'আমিত্ব'র দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো না যায় তাহলে আগামী দিনে রাজনীতি আরও শ্রীহীন হবে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এমনটি তো আমাদের কাম্য নয়।
- লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- কার্টসি — সমকাল/ জানুয়ারি ৭, ২০২০
No comments:
Post a Comment