Search

Wednesday, February 10, 2021

মাফিয়াতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পদক ছিনতাই

— মারুফ কামাল খান

 

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অমর ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের এ জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের স্রষ্টা। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এ ভূখণ্ডকে হানাদার শত্রুবাহিনীর কবলমুক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে উপহার দিয়েছিলেন। তারা এ দেশ মুক্ত করেছিলেন বলেই রাজনীতিকেরা এর শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারাই এ রাষ্ট্রের সব পদ-পদবি ও ক্ষমতার স্রষ্টা। এ রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল না হলে এসবের কিছুই থাকতো না।

জিয়াউর রহমান স্বকণ্ঠে সদর্পে এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে বিপ্লবে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে উন্নীত করেন। তিনি কেবল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম কণ্ঠস্বরই নন, প্রথম মুক্তিযোদ্ধাও। তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারই কেবল নন, তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক রূপে স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ব্রিগেড ফোর্সের একটির অধিনায়ক ছিলেন। 

রাষ্ট্রের স্রষ্টারা এই রাষ্ট্রের আইন-আদালত, সংবিধান, ক্ষমতাকাঠামো, সব প্রথা-প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি বা অন্য কোনো কিছুরই অনুকম্পানির্ভর নন। তারাই এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এনে দিয়েছে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা নির্ভর ও কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ থাকার কথা ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরউত্তম 

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের দুর্বিনীত নব্য শাসকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তা সেজে বসেন। এমনকি তারা নিজেদেরকে সমগ্র জাতির উর্ধ্বে এবং জাতির চেয়েও বড় ভাবতে থাকেন। তারা প্রচার করতে থাকেন, এই দেশ ও স্বাধীনতা নাকি তাদেরই দয়ার দান। প্রকৃত জাতীয় বীরদের আড়াল করে মেকি বীরপূজা শুরু করা হয়। তারাই কৃতিত্বারোপ ও হরেক রকমের সার্টিফিকেট বিতরণের মালিক সেজে বসেন। তাদেরই হঠকারি তত্ত্বে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অনেক  বড়ো হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির আকৃতি। সেই রাজনৈতিক হঠকারিতার বিবরণ তুলে ধরে তখন সংবাদপত্রে 'সিক্সটি-ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটর্স' শিরোনামে আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা উপেক্ষার পাশাপাশি তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজনও সৃষ্টি করা হয়।

এসবের ফলাফল শুভ হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই রাজনৈতিক ধারা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে রক্তাক্ত এক বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে এর পরিবর্তন ঘটে। সেই পরিবর্তন আসে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিদ্রোহী অংশের হাত দিয়েই। সেই নির্মম অভিজ্ঞতা জাতিকে বিভাজনের বদলে ঐক্যবদ্ধ করার, সংহতি গড়ে তোলার অনিবার্য বাস্তবতা, প্রয়োজনীয়তা ও শিক্ষাকে সামনে তুলে ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান সব চেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছিলেন সময়ের এই দাবিকে। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেন্দ্রে স্থাপন করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব-বিভাজনের রক্তাক্ত সব ক্ষত নিরাময় এবং জাতীয় সংহতি ও সমঝোতার মহাসড়ককে চলার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

জিয়াউর রহমানের আগে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও সেই জাতীয় ঐক্যের পথে নানা পদক্ষেপে এগুবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তার ব্যক্তিগত অনুপস্থিতিজনিত দুর্বলতা এবং যুদ্ধোত্তর জাতীয় পুনর্গঠনে নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাস তাকে এ ক্ষেত্রে সফল হতে দেয়নি। মুজিবোত্তর কালে জিয়াউর রহমান এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেন।

আজ বাংলাদেশকে আবার ইতিহাসের কানাগলিতে ঠেলে দেয়ার জন্য মূর্খতাপ্রসূত এক হঠকারি অন্ধ রাজনীতির ধারা প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় চরিত্র হারিয়েছে। এটি আজ আর কোনো রাষ্ট্র নয়, প্রজাতন্ত্র নয়, পরবাহুনির্ভর এক মাফিয়াতন্ত্র মাত্র। অধঃপতিত এই পদ্ধতিতে নীতি, আদর্শ, প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতা নয়, হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতাই এখন এর চলার পথ নির্ধারক। পদ-পদবি-ক্ষমতা লোভী স্তাবকের দল বিশেষ কাউকে তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে এখন পরিণাম-পরিণতির চিন্তা না করেই যা-খুশি তাই করে যাচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অর্জিত বীরত্বসূচক 'বীরউত্তম' পদক ছিনতাই করার সিদ্ধান্তের কথা জানা গেলো। মাফিয়াতন্ত্র সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় পদক ছিনিয়ে নেয়ার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতির কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ এসব পদকে ভূষিত করে আমাদের রাষ্ট্রই সম্মানিত হয়েছিল। এটা বুঝবার মতন ন্যূনতম যোগ্যতা ও শিক্ষা যাদের নেই তারাই নতুন করে কলঙ্কের এই ক্ষতচিহ্ন অঙ্কন করতে যাচ্ছে। গর্ত থেকে মুখ বের করে হুতোমপ্যাঁচা ভাবছে, সে সূর্যের প্রখর দীপ্তিকে আটকে দিতে সক্ষম। হিংসায় জর্জরিত এই অতিক্ষুদ্ররা বুঝতেও পারছে না যে, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতাই প্রদর্শন করেছে। ঘৃণা-বিভাজনের এই বিষবৃক্ষ রোপণের ফলাফল কী হবে তা আগামী দিন বলবে।


লেখক সাংবাদিক।  

No comments:

Post a Comment