— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
'আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে' - ছোটবেলার পরীক্ষার মতো যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই কথাগুলো কে, কাকে, কোন প্রসঙ্গে বলেছিল, তাহলে প্রায় সকলেই এর সঠিক উত্তর দিয়ে দিতে পারবেন। বরাবরের মতই এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সেটা হালে পানি পাচ্ছে না খুব একটা, মানুষ নিজ কানে অডিওতে শুনেছে এবং একেবারে মূল ধারার মিডিয়ায় সংবাদটি দেখেছে।
একজন তথাকথিত আইন প্রণেতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ওসিকে এই কথাগুলো বলছেন, এটুকু জানিয়ে এই কথাগুলো ন্যূনতম গণতন্ত্র আছে এমন কোন দেশের মানুষকে শোনানো হলে তাদের কাছে অকল্পনীয় লাগবে। তারা ভাববে রাষ্ট্রের ২ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এমন আলাপ করতে পারে?
পুরো কথোপকথনটি যারা শুনেছেন তারা কেউ কেউ বলতে পারেন সংসদ ওসিকে থানায় কিংবা ইটের ভাটায় বোমা মেরে মামলার কথা বলেছেন কিন্তু ওসি তো সেই ব্যাপারে অন্তত সেই সময়ে রাজি হননি। কিন্তু আমরা কেউ কি এভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখছি যে একজন ওসিকে এইরকম কথা বলা যায় সেটা এমপির কেন মনে হল? কেন তিনি মনে করেন থানায় থাকতে হবে এসব করতে হবে?
গত এক যুগে এই রকম অসংখ্য মিথ্যা মামলা সাজিয়ে এই দেশের বিরোধী দলকে দমন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা হয়েছে। সেই চেষ্টায় বিভিন্ন থানার কর্মরত কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কিংবা অন্য কোনো নেতার ফরমায়েশ মত মামলা সাজিয়েছেন। প্রভাবশালীদের দেয়া মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর কারাগারে থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া মানুষের প্রচুর খবর নিয়মিতই আসে আমাদের সামনে। অলক্ষ্যে থেকে যায় আরো অনেকে যারা দুর্ভাগা।
যশোরের কেশবপুরের সাইফুল্লাহ 'সৌভাগ্যবান'। এই ফাঁস হওয়া অডিও হয়তো তাকে বাঁচিয়ে দেবে। কিংবা হয়তো দেবে না। সাইফুল্লাহকে থামিয়ে দেবার জন্য হয়ত আবিষ্কার করা হবে নতুন কোন পথ। কারণ থানার ওসির চোখেও সাইফুল্লাহ ভালো কোনো মানুষ নয়; এমপি চাকলাদার সাইফুল্লাহ পরিচয় জানতে চাওয়ার জবাবে ওসি বলেন - 'স্যার ওই ইটভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, বেলায় যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার'।
আসলেই তাই, বর্তমান বাংলাদেশের সরকারি দলের বাইরে গিয়ে এই দেশের জনগণ এবং রাষ্ট্রের পক্ষে যে কারো দাঁড়ানো মানেই তাদের চোখে খারাপ হওয়া। গত এক যুগের ক্ষমতায় থাকার পথে বিশেষ করে ২০১৪ সালের পরের ৭ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ দেশের প্রশাসনের কাছে এই ন্যারেটিভ তৈরি করেছে।
আলোচিত কথোপকথনে আরো বেশি উল্লেখযোগ্য বিষয় এসেছে ওসির একটা তথ্যের জবাবে এমপি চাকলাদার যা বলেন তাতে। ইটভাটার বিরুদ্ধে সাইফুল্লাহর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা প্রসঙ্গে যখন ওসি এমপিকে জানান তখন তার জবাব -
'আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই'?
একজন আইনপ্রণেতা দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করে। এই রাষ্ট্রের 'সেপারেশন অব পাওয়ার' কে ধ্বংস করে সবকিছুকে শাসন বিভাগের সাথে একত্রে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বিচার বিভাগের প্রতি এরকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা অবধারিতই ছিল। আমরা স্মরণ করব এই সরকারের আমলেই বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে একজন প্রধান বিচারপতিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে সেই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল উচ্চ আদালতকে একেবারে ধ্বংস করে যাচ্ছে তাই যেন করা যায় সেটা নিশ্চিত করতে। হ্যাঁ, সরকার খুব ভালোভাবেই সফল তাতে।
উচ্চ আদালত নিয়ে বক্তব্যের শেষ বাক্যে বারবার 'খেলা'র কথা বলছিলেন চাকলাদার। খেলা শব্দটি এখন আওয়ামী লীগের অনেকের মুখ থেকে শোনা যায়। ভাস্কর্য ইস্যুতে খেলাফত মজলিসের মামুনুল হকের সাথে যখন সরকারি দলের সংঘাত চলছিল তখন আরেক এমপি মুজিবর রহমান নিক্সন চৌধুরী বারবার তাদের সাথে খেলতে আসার কথা বলছিলেন মামুনুল হককে। কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র সদস্য হলেও তুমি চিরকাল আওয়ামী লীগ করেছেন এবং এখন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মাঝেমাঝেই খেলার কথা বলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই দেশকে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করছে ক্ষমতাসীন সরকারটি।
জনাব নিক্সনেরই একটা অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছিল কিছুদিন আগে, যেখানে তিনি ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকারকে ‘দাঁতভাঙা জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন এবং চরভদ্রাসনের ইউএনওর ফোনে ফোন করে গালিগালাজ করেছেন ভাঙা উপজেলার এসিল্যান্ডকে।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ফরিদপুর জেলা শাখা গতকাল রোববার সভা করে এই ঘটনার প্রতিকার চেয়েছিল। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এই ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘটনায় আলোচিত এই এমপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, নেবার কথাও না। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ব্যবস্থা নেয়া হবে না শাহীন চাকলাদার এর বিরুদ্ধেও।
এবার আসা যাক আরেক 'আওয়ামী' এমপি পাপুল কাণ্ডে। আমি জানি পাপুলকে আওয়ামী এমপি বলায় কেউ কেউ আপত্তি করবেন কারণ কুয়েতে মানব পাচারের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি পাপুল কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র এমপি। আসলেই কি তাই?
গত নির্বাচনে পাপুলের আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি; সেই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই আসনে জাতীয় পার্টির প্রতিদ্বন্দিতা করেনি সেই প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কয়েকজন বড় নেতা দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিককে বলেছিলেন - আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বেইলি রোডের বাসায় একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জাপার প্রতিনিধির কাছে লক্ষ্মীপুর–২ আসন শহিদ ইসলামকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন এইচ টি ইমাম। এ কারণে জাপা আসনটি ধরে রাখেনি।
সেই রিপোর্টেই জানা যায়, পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনাকমিটি থেকে চিঠি দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলামের পক্ষে কাজ করার জন্য দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের পক্ষে চিঠিটি পাঠান নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী সেলিম মাহমুদ।
শুধুমাত্র টাকা ছিটিয়ে একজন মানুষ নিজের এবং তার স্ত্রীকে এমপি বানাতে পারেন তার এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে থাকবে নেই পাপুল। পাপুল এর টাকার জোর থেমে থাকেনি তিনি কুয়েতে আটক হবার পরও। তিনি যখন আটক হন তখনও জাতীয় সংসদ থেকে বলা হয়েছে তার আটক এর ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। এখন তার চার বছর সাজা পাবার পারও তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল না করে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
বছরের পর বছর এই দেশের গরীব মানুষকে নিয়ে নোংরা ব্যবসা করেছে পাপুল। দেশের মানুষকে কুয়েতে নিয়ে গিয়ে বীভৎস অত্যাচার-নির্যাতন করে অতি তুচ্ছ বেতন দিয়ে বা না দিয়ে কাজ করিয়েছে। এই দেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়নি এই দেশের সরকার। শুধুমাত্র টাকা আর ক্ষমতা থাকলেই যে কেউ যে কোনো কিছু করে পার পেয়ে যেতে পারে এই দেশে।
একটার পর একটা নির্বাচন বাদ দিয়ে ক্ষমতায় থাকা এই দেশ থেকে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও বিলীন করে দিয়েছে - এটা এখন এক মাফিতন্ত্র। সেই মাফিয়াতন্ত্রের তথাকথিত সংসদে সংসদ সদস্যের মুখোশ পড়ে মাফিয়ারাই তো বিচরণ করার কথা; হচ্ছেও সেটা।
মুখোশের সমস্যাই হলো সেটা মাঝে মাঝে খসে পড়ে। সম্প্রতি যেমন পড়েছে এই কলামে আলোচিত এই তিন জনের। আগেও খসেছে কারো কারো, অচিরেই খসে পড়বে আরো অনেকের। তাদের চেহারা দেখাই সার, এই মাফিয়াতন্ত্র ভেঙে দেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার চিন্তা একেবারেই আকাশ-কুসুম কল্পনা।
লেখক — রাজনীতিবিদ, আইনজীবী।
No comments:
Post a Comment