Search

Monday, February 28, 2022

ভাটির দেশে পানি, গ্যাস,বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের দামে নৈরাজ্য এবং জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন!

— 

প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খান

খান মো.মনোয়ারুল ইসলাম

 

নদীমাতৃক বাংলাদেশ হলো ভাটির দেশ। ঐতিহাসিকভাবে ভাটি অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে সপ্তদশ শতকে। ভাটির বারো ভূঁইয়ারা মোগল আধিপত্যের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। ভাটি অঞ্চলে শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে মোগল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ঈসা খাঁ  ও মুসা খানের নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়ারা। বারো ভূঁইয়াদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে সুবাদার ইসলাম খানের সুনিপুণ রণ কৌশলে ১৬১০ সালে। ১৬০৯ সালে রাজমহল থেকে সুবাদার ইসলাম খানের মোঘল বাহিনী ভাটির বারো ভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যে যে অভিযান পরিচালনা করেন সেটি সমাপ্ত হয় ১৬১০ সালে ঢাকা জয়ের মাধ্যমে। মোঘল বাহিনী ঢাকা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে একে রাজধানী ঘোষণা করে। রাজধানী ঢাকার যাত্রা তখনই। ঐতিহাসিক আব্দুল করিম ভাটির সীমানা নির্দেশ করেছেন-পশ্চিমে ইছামতি, দক্ষিণে গঙ্গা নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, উত্তর-পূর্ব সিলেটের বানিয়াচং, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এই বৃহৎ নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সিলেটের নিয়ে গঠিত। বিস্ময়করভাবে সপ্তদশ শতকের ভাটি অঞ্চলের পুরোটা নিয়েই বিংশ শতকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

ভাটি অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নদীগুলো জালের মত বিস্তার করে আছে সমগ্র ভূখণ্ডকে। পানির সহজলভ্যতাই এ পাললিক ভূখণ্ডকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই একবিংশ শতকে এসেও পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের চাইতেও প্রকৃতির অপার মহিমায় পানির সহজলভ্যতা এখানকার কৃষি অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনকে করেছে অনন্য।

পানির মূল্য বৃদ্ধিতে নৈরাজ্য




পানির সহজলভ্যতা বাংলাদেশে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনে স্বস্তির অনুষঙ্গ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো পানি এখন নাগরিক জীবনে আতঙ্কিত অনুষঙ্গ । ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিগত ১৩ বছরে ১৪বার পানির দাম বাড়িয়েছে । করোণা মহামারীর মধ্যেও ঢাকা ওয়াসা দুই বছরে পানির দাম বাড়িয়েছে ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ৫ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির পরে বিস্ময়করভাবে করোণা মহামারীর মধ্যে ১লা এপ্রিল ২০২০ পানির দাম ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন, ১৯৯৬(২২এর২ ধারা) অনুযায়ী প্রতিবছর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর বিধান থাকলেও করোণা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে আবার আগামী পহেলা জুলাই থেকে আরেক দফা পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা  হয়েছে।

পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রায় ই যুক্তি দেখান পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় খুঁজে পান না বলেই দাম বাড়াতে হয়। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা সরবরাহকৃত পানির ৬৫ শতাংশ গভীর নলকূপ ভূগর্ভস্থ বাকি ৩৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পরিশোধন করা। অর্থাৎ মোট পানির বেশিরভাগ অংশই পরিশোধন এর প্রয়োজন হয় না । আবার নগরবাসী ওয়াসার কাছ থেকে যে পানি পায় সেটি প্রায় ক্ষেত্রেই পান উপযোগী নয । টিআইবির তথ্য অনুসারে ঢাকা শহরে ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। এতে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়। এছাড়া খরচ সমন্বয়ের জন্য দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয় সেটিও জনগনকে ধোকা দেওয়া বৈ আর কিছুই নয়। ঢাকা ওয়াসার ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা তথ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ১৫৯২ কোটি টাকা। এতে পানির বিল ১২০১ কোটি টাকা বাকিটা সুয়ারেজ বিল বাবদ আয়। ট্যাক্সসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওয়াসার লাভ হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বছর শেষে ওয়াসার সঞ্চিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯২ কোটি টাকা। সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লাভে থাকার পরও পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জনগণের প্রতি চরম অবিচার ।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমানে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান এর বেতন ভাতা মাসে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তাকসিম এ খান এর বেতন-ভাতা বেড়েছে ৪২১ শতাংশ ! অথচ ঢাকা ওয়াসার এমডি পদটিতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দেয়া হলে বছরে অন্তত ৭০ লক্ষ টাকার সাশ্রয় হত। ঢাকা ওয়াসার এমডির বিগত বছরগুলোতে অর্জনটা কি? একই পদে ১৩ বছর দায়িত্ব পালনে জনগণ সুফল তো পাইনি বরং চৌদ্দবার পানির বর্ধিত দাম চুকিয়েছে ! অথচ কানাডার মতো দেশে বিগত ২০ বছরে পানির দাম এক টাকাও বৃদ্ধি পায়নি!

 

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য: যে তুঘলকীকাণ্ডের শেষ নেই!

ভাটির দেশে পানির মূল্যের নৈরাজ্য সম্পর্কে বলা হলো, এবার সেবা খাতের আরও দুটি বড় অনুষঙ্গ -গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিষয়ে আসা যাক। পানির মতই দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে । আরো একদফা দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী মার্চ মাসে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উপরে গণশুনানির ঘোষণা এসেছে, এরপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়েও শুনানি হবে। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্য কাহিনী কি?

সিপিডির মতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রাক্কলনে সরকারের ত্রুটি থাকায় বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে চাহিদার বিরাট পার্থক্য তৈরী হয়েছে । ফলে চাহিদা না থাকায় সরকার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে না কিন্তু ভাড়ার টাকা ঠিকই দিতে হচ্ছে গত এক দশকে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ সরকারের খরচ হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা । কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে। পিডিবির সূত্র থেকে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শুধুমাত্র ভাড়া বছরে প্রায় ৯০ কোটি টাকা। এই টাকাটা সরকারকে গুনতে হবে কোনো বিদ্যুৎ না কিনেই। আবার, ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিতে না পারায় মাসে সরকারকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৩০ কোটি টাকা। এইযে ভাড়াটা পরিশোধ করতে হচ্ছে এটি কিন্তু প্রতিবছর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিক্স ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ পিডিবির খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।

বিদ্যুৎ খাতের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ  সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুৎ সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য রাতারাতি টেন্ডার বিহীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে । কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রমগুলোকে নজিরবিহীন দায়মুক্তির ব্যবস্থাও করে সরকার। সমালোচকরা বলেন “সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে লুটপাটের ব্যবস্থা করা”হয় বিদ্যুৎ খাতে। এই কুইক রেন্টালের দায় এখনো বিদ্যুৎ খাত বহন করছে। স্বল্প মেয়াদের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনো ৯২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এমন ১২টি স্বল্পমেয়াদী বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে। যেগুলোকে বসিয়ে রেখে সরকার শুধু ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ পর্যন্ত কিনছে না। এমন তুঘলকিকাণ্ড আধুনিক বিশ্বে কোথাও দেখা যাবে কি?

বিদ্যুৎ এর মতই গ্যাস খাতে নৈরাজ্য অবর্ণনীয়। দেশে গত এক যুগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জোর না দিয়ে বিগত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতিরিক্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। পেট্রোবাংলার হিসাব মতে এ বছর মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৩ শতাংশ দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে।এর জন্য পেট্রোবাংলার খরচ হবে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। আর বাকি ২৭ শতাংশ গ্যাস আসবে আমদানি থেকে যার জন্য খরচ হবে ৪৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা । চড়া দামে এলএনজি আমদানিতে সরকারের অতি আগ্রহ প্রকট ভাবে লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় ২০১৯ সাল থেকে দেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ টন করে এলএনজি সরবরাহ করছে ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। ২০২০ সালে এ সরবরাহ আরো ১০ লাখ টন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানিটি। ওই সময়ে প্রস্তাবিত দর ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ৭ থেকে ১০ ডলার করে। বিষয়টি নিয়ে পেট্রোবাংলা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ নিশ্চিতের পরিবর্তে স্পর্ট থেকেই তাৎক্ষণিক মূল্যে এলএনজি সংগ্রহের পথ বেছে নেয় পেট্রোবাংলা। এটির ভয়াবহ ফলাফল প্রত্যক্ষ করছে দেশ। এই ফেব্রুয়ারিতেই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া থেকে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি ক্রয় করার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে আরো বেশি দামে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। ওই সময়ে ভিটল এশিয়া থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্টে এলএনজি আমদানি করেছিল পেট্রোবাংলা ।

ওমান ট্রেডিং অর্গানাইজেশন (ওটিআই) এর প্রস্তাব যথাসময়ে গ্রহণ করা হলে এলএনজি সংগ্রহে স্পট মার্কেটের উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যেত। ইতিমধ্যে করোনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন সংকট স্পট মার্কেটকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এটাতে বোধহয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুব বেশি চিন্তিত নন কারণ তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন তাই স্পট মার্কেট থেকে অতি উচ্চ মূল্যে এলএনজি ক্রয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন।

পিডিবি ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সব প্রতিষ্ঠান মুনাফায় আছে।ঘাটতি মোকাবেলায় প্রতিবছর ভর্তুকি পাচ্ছে পিডিবি। এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকেও ভর্তুকি দেয় সরকার। বিদ্যুৎখাতে ডিপিডিসির গত অর্থবছরের নিট মুনাফা ১০৮ কোটি টাকা। ডেসকোর নিট মুনাফা ৭৩ কোটি টাকা। পল্লী বিদ্যুতের নিট মুনাফা ২০ কোটি টাকা। ওজোপাডিকো নিট মুনাফা ২৪ কোটি টাকা। নেসকোর মুনাফা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। গ্যাস খাতে পেট্রোবাংলা গত অর্থবছরে মুনাফা করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। তিতাস মুনাফা করেছে ৩৪৬ কোটি টাকা। বাখরাবাদ ১২৬ কোটি, জালালাবাদ ২১৮ কোটি, কর্ণফুলী ৩৫১ কোটি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ৬ কোটি এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মুনাফা ৫৯ কোটি টাকা। এরকম মুনাফার রমরমা অবস্থা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয় কার স্বার্থে? জনগণের স্বার্থে নয় নিশ্চয়ই। এটা পরিষ্কার, সরকারি সেবা খাত সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো শোষণের পথ বেছে নিয়েছে।

 

নিত্যপণ্যের দামে বল্গাহীন গতি



পানি,গ্যাস, বিদ্যুতের মতো সেবা খাতে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের যে পথ বেছে নিয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে ।২০০৯ সালে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি এখন প্রতারণায় রূপ নিয়েছে। সরকারের অদক্ষতা ও অবহেলায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বল্গাহীন গতিতে। চাল,ডাল,তেল,আটা-ময়দা,মুরগি,ডিম সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অধিকাংশ সময়ে অযৌক্তিকভাবে বেড়ে চলেছে। আরো বেড়েছে রান্নার গ্যাস, সাবান ও টুথ পেস্টের মতো নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য ও। সব মিলিয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে এমন একটি সময় যখন বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস, পিপিআরসি ও সানেম) বলছে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশ এ পরিণত হয়েছে।

সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসেবে ২০১৯ সালে ৫ লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল ৪৬৫-৫১০ যা ২০২২ সালে বেড়ে ৭৪০-৭৮০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে তুলনায় এখন মোটা চালের দাম সাড়ে৩১, চিনি ১৯, মসুর ডাল ৩০, গুড়া দুধের দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

এবারের ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম কমেনি, সব ধরনের সবজির দাম ছিল বাড়তি। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের ভূমিকা ছিল নির্বিকার। সরকারিভাবে কম দামে চাল, ডাল, তেল, চিনি বিক্রির কার্যক্রমের পরিসর চাহিদার তুলনায় সীমিত রাখা হয়েছে। অথচ সরকারের চালসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের সামনে সীমিত এর মানুষের ভিড় সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন টিসিবির পণ্য কিনতে ভালো পোশাক পরা লোকের সমাগম বেড়েছে। বিগত এক বছরে সরকার চাল ও তেলের দাম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বাজারে জোর গুজব রয়েছে এসব সিন্ডিকেটের পেছনে ক্ষমতাসীন দলের লোক জড়িত বলে এসব সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সরকার নির্বিকার।

বিগত এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর জন্য মার্চ মাসে গণশুনানি হবে। বিগত এক দশকে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে খুচরা দাম ৯০ শতাংশ বেড়েছে। এখন নতুন করে পাইকারি পর্যায়ে আরো ৬৪ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ৬৬ থেকে ৭৯ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। বিগত এক দশকে জ্বালানি তেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বেড়েছে ৪৪ থেকে ৮০ টাকা।

আমরা উপরে তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি সেবা খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত সব বিদ্যুৎ, তেল ,গ্যাস কোম্পানি প্রতিবছরই মুনাফা করছে । প্রায় সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মতে, করোনা মহামারীতে সাধারণ জনগণের প্রকৃত আয় কমেছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তারপরও সরকার সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর। সরকার এখানে নিপীড়কের ভূমিকায়। সরকারের এমন শোষকের ভূমিকা দেখলে খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও লজ্জা পেত!

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। সেই মুক্তির স্বপ্নতেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে মানুষ এমন এক সময়ে যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিগত এক যুগেরও বেশি সময় মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ভোটাধিকার নাই বলে অথবা সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনা বলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সরকারকে বিচলিত করে না। সেবা খাত সংশ্লিষ্ট সবগুলো সেক্টরে দাম বাড়ানোতে সরকারের ‘দ্বীধাহীনতা’য় জনগণের ‘মুক্তি’র স্বপ্ন প্রলম্বিতই থেকে যাচ্ছে ।


Monday, February 14, 2022

কী মধু জার্মান চাদরে?

— মুহম্মদ মাহাথির  



খবর প্রকাশিত হয়েছে চলতি ফেব্রুয়ারিতেই রাষ্ট্রের তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা ও আইজিপির স্টাফ অফিসার এসপি মোহাম্মদ মাসুদ আলম জার্মানি যাচ্ছেন পুলিশের জন্য বিছানার চাদর ও বালিশের কাভারের রং নির্ধারণ করতে।  

যেসব বেডশিট ও বালিশের কাভার কেনা হচ্ছে সেগুলোর দাম ত্রিশ কোটি টাকা। 

সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর সচেতন দেশবাসীর মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। 

বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির সাথে করোনাভাইরাস মহামারির ফলে দেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ক্ষুদ্রতম অংশটি বাদে সংখাগরিষ্ঠ জনগণ সীমাহীন কষ্টে আছেন।  ডিসেম্বর ১৭, ২০২১, দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে দেশের ৫ কোটি ২ লাখ মানুষ। যে দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উচ্চমূল্যে দিশেহারা, কর্মসংস্থানের অভাবে হাহাকার করছেন, সেই দেশের পুলিশের জন্য জার্মানি থেকে বিছানা চাদর ও বালিশের কাভার কেনার যুক্তিকতা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

পোশাকশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশেই বিশ্বমানের বিছানা চাদর ও বালিশের কাভার তৈরি হচ্ছে যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাহলে জার্মানি থেকে এসব পণ্য কেনা কি বিলাসিতা নয়? 

জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আকাশচুম্বি নিত্যপণ্যের দামের কষাঘাতে কুপোকাত গরিব শ্রেণির মানুষ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ চলে এসেছেন গরিব শ্রেণির কাতারে। ভর্তুকি দেয়া দামে চাল-ডাল-আটা-চিনি-তেল কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন অগণিত মানুষ। অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা মানুষের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশির হচ্ছে গণমাধ্যমে। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএস-এর সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়র অধীন স্নাতকোত্তীর্ণ ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন। বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত যুবক সমাজ। ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২, দেশরূপান্তরে বলা হয়েছে, , ৩১ হাজার ৮৭৪ জন বিসিএস উত্তীর্ণের চাকরি মিলেনি!  নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। 

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২, সমকালে ‘সরকারের কম্বলে শীত যায় না গরিবের’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণকৃত কম্বল প্রথম ধোয়ার পরেই আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। ৭০০ টাকার কম্বল বরাদ্ধ থাকলেও দেয়া হয়েছে ১৫০ টাকার কম্বল। সর্বস্তরে দুর্নীতির ভয়াল থাবা মানুষের ভোগান্তিকে বাড়িয়ে চলেছে।  

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১, আরটিভি’র এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় দেশে পুরুষদের মধ্যে ২২ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন। একইসঙ্গে এক চতুর্থাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং অর্ধেকেরও বেশি প্রবীণ পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে আছেন।

সম্প্রতি বগুড়ার মো. আলমগীর কবির নামে এক উচ্চ শিক্ষিত তরুণ 'শুধুমাত্র দু'বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই' বলে দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন সাটান যার মাধ্যমে সারাদেশের সার্বিক করুণ অবস্থাই উঠে এসেছে। 

প্রায়শই দেখা যাচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ও অগুরুত্বপূর্ণ সফরে দলবেধে সরকারি চাকরিজীবীরা বিদেশ ভ্রমণ করছেন। কিন্তু এসব ব্যয়বহুল সফরের টাকাটা কিন্তু আসে মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে ভ্যাট, ট্যাক্স ও নানা উপায়ে আদায় করা টাকা থেকে। এসব বিলাসবহুল সফর বাদ দিয়ে এই টাকা জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যয় করাই দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতার পরিচয়।  

এ যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তখন কেনো জার্মানি থেকে এসব পণ্য আনতে হবে? তারপর খোদ সরকারই বলছে দেশেই পর্যাপ্ত ভালোমানের বিছানা চাদর আর বালিশ কাভার তৈরি হচ্ছে।

তাহলে কার কী স্বার্থ এতে লুকিয়ে আছে?  কী মজা জার্মান চাদরে, বালিশ কাভারে?  


Thursday, February 10, 2022

নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরকান্ডের কি তদন্ত হবে!



গত কয়েকটি সংসদ অধিবেশনের প্রায় প্রতিটিতেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন উত্থাপিত হয়েছে। দেশের সব জেলায় কমপক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সরকারের লক্ষ্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য কারা হবেন, কারা পাঠদানে নিযুক্ত হবেন, গবেষণায় কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হবে, সেসব বিষয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। মেগা প্রকল্পের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মুখ্য উদ্দেশ্য বলেই মনে হয়।

গত কয়েক বছরে শিক্ষার মান যেখানে নেমেছে, আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে আমাদের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবস্থান, দেশে তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের যা পরিসংখ্যান, তাতে এটা স্পষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রসার যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ কিছু লুটপাট আর দলীয় লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। প্রতিটি আইনই তড়িঘড়ি করে পাস করা, যেখানে বিরোধী দলের ক্ষীণ কণ্ঠ খুব বেশি শোনা যায়নি, ব্রুট মেজরটির সংসদে আইনগুলো নিয়ে আলোচনারও খুব একটা সুযোগ ছিল না।

তেমনই একটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয়’। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছের লোকদের দুর্নীতির খবরে গণমাধ্যম পূর্ণ হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকার ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়ার পর মাঠপর্যায়ে জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৩ সদস্যের কমিটি করে দেয়। সেই কমিটি নির্ধারিত মৌজার জমি বেচাকেনার দলিল পর্যালোচনা করে ১৩৯টি দলিল পায় ‘অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে’ (২০ গুণ বেশি দামে) রেজিস্ট্রি করা। এসব দলিল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরুর পর। ওইসব দাগের বাইরে একই মৌজায় একই সময়ে সম্পাদিত ৪০টির বেশি জমি কেনাবেচার দলিল পাওয়া গেছে, যার মূল্য সরকারি মৌজা দরের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যে জায়গাটি ঠিক করা হয়েছে, কেবল ওইসব দাগের জমির দলিলে অস্বাভাবিক দাম দেখানো হয়েছে। আর ওইসব জমি কিনেছেন শিক্ষামন্ত্রীর আপন বড় ভাইসহ তার কাছের লোকজন।

দেশের বিরোধী দলের উত্থাপিত কোনো অভিযোগ মানেই সরকারের দৃষ্টিতে ‘নির্লজ্জ মিথ্যাচার’। এমনকি দেশের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ায় প্রকাশিত সমালোচনামূলক সংবাদকেও পাত্তা না দেওয়ারও প্রবণতা আছে সরকারের। তা ছাড়া যেকোনো কিছুতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজা সরকারের পুরনো স্বভাব। মজার ব্যাপার হচ্ছে এবারকার এই দুর্নীতির ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর দেগেছে শিক্ষামন্ত্রীর নিজ দলের লোকজন।

চাঁদপুর-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমান দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত অনলাইন পোর্টালে রীতিমতো কলাম লিখে এই দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন। ‘অনৈতিহাসিক : চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য’ শীর্ষক কলামে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক দিন থেকেই প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চাবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানান গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয়শ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছিল অবাধে। এর পেছনে যেহেতু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তার ভাই-বেরাদর জড়িত তাই কেউ মুখ খুলছিল না।’

শিক্ষামন্ত্রীর নিজ জেলা চাঁদপুর আওয়ামী লীগের সভাপতিও একটি অনলাইন চ্যানেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় একেবারে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছেন, এই দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর আপন বড় ভাই, মামাতো ভাই এবং তার সবচেয়ে কাছের রাজনৈতিক কর্মীরা জড়িত। আওয়ামী লীগের সভাপতি জানান, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ে এই অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি দাবি করেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা সেই রিপোর্ট তার সংগ্রহে আছে।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যথারীতি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো এসব অভিযোগ এসেছে তার নিজ দলের ভেতর থেকে। একই রকম ঘটনা আমরা দেখেছি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়।

কিছুদিন আগে শেষ হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বরাবরের মতোই সেখানকার দুই প্রভাবশালী পরিবারের দুই সন্তান শামীম ওসমান এবং সেলিনা হায়াৎ আইভীর ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছিল। এবারের নির্বাচনেও বরাবরের মতো শামীম ওসমানকে ‘গডফাদার’ তকমা দিয়ে তীব্র আক্রমণ করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এই শব্দটি ব্যবহার নিয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখান জনাব ওসমান। এর জন্য আইভীকে পরবর্তীকালে সাংবাদিকদের কাছে এই শব্দটি ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। বলাই বাহুল্য, তিনি তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, আইভী যদি সঠিক হন, তাহলে নারায়ণগঞ্জের একটি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন দল দফায় দফায় একজন ‘গডফাদার’কে মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানিয়ে যাচ্ছে। আবার এই অভিযোগ যদি সত্য না হয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের একজন খুবই পরিচিত নেতা এবং সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ এক মিথ্যা অভিযোগ করেছেন আইভী। এখানে ঘটনা যেটাই সত্য হোক না কেন সেটাই আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর সত্য প্রকাশ করে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে হয় ক্ষমতাসীন দলকে ‘গডফাদার’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে কিংবা মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে আইভীর বিরুদ্ধে।

দুটি সাম্প্রতিকতম ঘটনার উদাহরণ দিলাম মাত্র। কিন্তু নিজ দলের এক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে অন্য নেতার এই ধরনের অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। গত কয়েক বছরের পত্রিকার পাতা উল্টালে উদাহরণ পাওয়া যাবে ভূরি ভূরি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ঘটনার কোনো তদন্ত হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা একটি খবরের কারণে ব্রিটেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে আছে। ২০২০ সালের মে মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনার লকডাউন ভেঙে তার সরকারি বাসভবনে পার্টির আয়োজন করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এভাবে আইন ভাঙার খবর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে সে দেশের রাজনীতিতে। তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে বেশ জোরেশোরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিরোধী দল, সাধারণ নাগরিক তো বটেই তার নিজ দলের অনেক সংসদ সদস্যও তার পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এ মুহূর্তে জনসনের সেই ঘটনাটির তদন্ত করছে লন্ডন পুলিশ। এই তদন্ত প্রভাব ফেলবে জনসনের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা না থাকার ওপর।

কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি নয়, কভিডের সময় লকডাউন ভাঙার মতো (বাংলাদেশের বিচারে অতি তুচ্ছ বিষয়) একটি ঘটনার তদন্ত হচ্ছে ইংল্যান্ডে, যার জেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পরিস্থিতিতে পড়েছেন একজন প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী। আমি মূর্খ নই, নই ইতিহাসবোধহীনও। তাই বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এমনকি কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও এমন কিছু ঘটার দূরতম প্রত্যাশাও আমি করি না। কিন্তু এই বাংলাদেশে আর্থিক কেলেঙ্কারি কিংবা মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের বিচার, এমনকি তদন্তও হবে না? তাও আবার যে অভিযোগ কোনো মিডিয়া বা বিরোধী দল নয়, করেছে একই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।


লেখক — ব্যরিস্টার রুমিন ফারহানা 
আইনজীবী, সংসদ সদস্য ও বিএনপিদলীয় হুইপ।
দেশ রূপান্তর/ফেব্রুয়ারি ১০,২০২২

Thursday, February 3, 2022

বিচারের প্রতি যদি অনাস্থা হয়

ইকতেদার আহমেদ


ভারতের সাহারা গ্রপ অব কোম্পানিসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক সুব্রত রায়

একজন মানুষ তার মনের ভাব কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারে আবার কলমের দ্বারা কাগজে লিপিবদ্ধ করেও ব্যক্ত করতে পারে। কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত ভাবের স্থায়িত্ব ক্ষণকাল। অপর দিকে কলম দ্বারা কাগজে লিপিবদ্ধ ভাবের স্থায়িত্ব দীর্ঘকাল। কলম দ্বারা লেখনীর কাজে যে দ্রব্যটি ব্যবহৃত হয় তা হলো কালি। কালি একটি রাসায়নিক পদার্থ। লেখনীতে আজকাল আগের মতো তরল কালির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখন সর্বত্র বলপয়েন্ট কলমের ব্যবহার। কালি শেষ হয়ে গেলে বলপয়েন্ট কলমের আর কার্যকারিতা থাকে না। তরল কালির কলমে কালি শেষ হওয়ার পর আবার কালি ভরার সুযোগ থাকায়, নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এ কলম কার্যকারিতা হারায় না।

বর্তমানে আমাদের চতুর্পাশে প্রাত্যহিক যা কিছু ঘটে তা আমরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে অতিদ্রুত জানতে পারি। উভয় মিডিয়ায় তথ্য উপস্থাপনে কালির ব্যবহার অপরিহার্য, যদিও তা আর আগের মতো তরল কালি নয়। একজন মানুষের কুকীর্তি কালির দ্বারা প্রকাশের কারণে তিনি নিন্দিত আবার একজন মানুষের সুকীর্তি কালির দ্বারা প্রকাশের কারণে তিনি নন্দিত। নিন্দিত আর নন্দিতের দোলাচলে সমাজ বহমান।

কালি যে শুধু লেখনীর মাধ্যমে কলঙ্কিত বা উদ্ভাসিত করে তা নয়; কালির আরো অভিনব ব্যবহার আছে। আর এ অভিনব ব্যবহার দেখা গেল একদা ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টে। ভারতের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগে আটক এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) ব্যবসায়ী সাহারাসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক সুব্রত রায়কে মামলা শুনানি সংশ্লেষে সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে আনা হলে অকস্মাৎ মনোজ শর্মা নামক জনৈক আইনজীবী পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় তার মুখে এক দোয়াত তরল কালি নিক্ষেপ করলে সম্পূর্ণ মুখায়ব কালি দ্বারা লেপ্টে যায়। ভারতের মধ্য প্রদেশের ঐতিহাসিক স্থান গোয়ালিহর থেকে আগত সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী ইতঃপূর্বে কমনয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি মামলায় অভিযুক্ত কংগ্রেস সংসদ সদস্য সুরেশ কালমাদিকে জুতা ছুড়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

ভারতের শীর্ষ বিচারালয়ের একজন আইনজীবী পরপর দু’টি ঘটনায় আইনকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে কেন নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের আগেই অন্যায়ের প্রতিবিধানে সচেষ্ট হলেন এ প্রশ্নে বিচারাঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্য হতে যে তথ্য পাওয়া যায় তা খুবই হতাশাজনক। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী অর্থের শক্তির কাছে আজ ন্যায়, নীতিকথা, বিচার সব কিছুই পদদলিত। আর এ আশঙ্কা থেকেই বিচারে কী হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা না-করে মনোজ শর্মার এ অভিনব প্রতিবাদ।

সুব্রত রায় ভারতের সাহারা গ্রপ অব কোম্পানিসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। সাহারা গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বিমান পরিবহন, আবাসন, পোশাক পণ্যসহ নানাবিধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সুব্রত রায় হতদরিদ্র পরিবার থেকে আগত এবং অতি সাধারণ অবস্থা থেকে ফুলেফেঁপে তার ব্যবসা আজ ভারতজুড়ে বিস্তৃত। সুব্রত রায়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে যে ব্যবসাটি প্রধান অর্থের জোগান দিয়েছে তা হলো এমএলএম ব্যবসা। এ ব্যবসাটি থেকে লাভের প্রলোভনে পড়ে ভারতের লাখো-কোটি সাধারণ মানুষ যখন নিজেদের সঞ্চিত অর্থের সবটুকু প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দিলো তখন জানা গেল অভিনব উপায়ে প্রতারণা ও ফটকাবাজির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের নানাবিধ কলাকৌশল।

এ ধরনের এমএলএম ব্যবসার সাথে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও কমবেশি অবহিত এবং ভারতের সাধারণ মানুষের মতো তারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আজ সর্বস্বান্ত। আমাদের দেশের যেসব এমএলএম ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় এনে বিচারে সম্মুখীনের আয়োজন চলছে তাদের নেতৃস্থানীয়রা কারাবন্দী হলেও অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও ভিআইপি মর্যাদায় পিজি হাসপাতালে প্রিজন সেলে দিব্যি আরাম-আয়েশের সাথেই দিনাতিপাত করছেন।

সুব্রত রায় পুলিশ কর্তৃক আটক হলেও একজন সাধারণ আসামিকে আটকাবস্থায় যেভাবে কারা অভ্যন্তরে থাকতে হয় এবং আদালতে হাজিরা সংশ্লেষে প্রিজন ভ্যানে করে জেলখানা থেকে আদালতে আনা-নেয়া করা হয় তার ক্ষেত্রে এখনো সেটি ঘটেনি। তাই অনেকে বলেন, ভারতের আইনও সুব্রত রায়ের কাছে অসহায়। আটকাবস্থায় তাকে রাখা হয়েছে ভিআইপি রেস্ট হাউজে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়ার সময় রাত্রিযাপনের প্রয়োজন দেখা দিলে তাকে রাখা হয় পাঁচতারকা হোটেলে। তার পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির বহর। যদিও আটককালীন আবাসন ও পরিবহন সংক্রান্ত ব্যয় সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠান বহন করছে; কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভারতের সাধারণ জনগণের প্রশ্ন সাধারণ অপরাধী এবং সুব্রত রায়ের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সমরূপ নয় কেন? আর সমরূপ না হয়ে থাকলে তাতে কি ভারতের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত আইনের দৃষ্টিতে সমান- এ মৌল নীতিটির লঙ্ঘন হচ্ছে না?

সুব্রত রায় বছরকয়েক আগে এক লাখ কোটি রুপি বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে আগমন পরবর্তী সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন তার মাতুলালয় রাজধানী শহরে ঢাকার নিকটবর্তী মুন্সীগঞ্জ জেলায় এবং সে কারণে তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। বিনিয়োগ প্রস্তাব উপস্থাপনকালীন তিনি সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন ঢাকা শহরের সন্নিকটে তাকে যেন এক লাখ একর ভূমি আবাসন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণে এখানে ভূমির তীব্র সঙ্কট এবং সরকার সুব্রত রায়কে ভূমি অধিগ্রহণ করে দিতে সম্মত হলেও এক লাখ একর ভূমি সংস্থান যে দুরূহ তা খুব সহজেই বোধগম্য।

এখানে প্রাসঙ্গিক যে, আবাসনশিল্প খাতে আমাদের আবাসন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং বিগত ৩০ বছর ধরে তারা রাজধানী ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে তাদের কর্মপরিধি বিস্তৃত করে নান্দনিক বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক, বাণিজ্যিক ও বিপণিবিতান নির্মাণে সফলতা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের আবাসনশিল্প উদ্যোক্তারা বলতে গেলে সক্ষমতার বিচারে শতভাগ সফল। সুব্রত রায় আমাদের আবাসনশিল্প খাতে যে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছেন তার চেয়ে আকর্ষণীয় প্রস্তাব দেয়ার যোগ্যতা আমাদের আবাসনশিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো রাখে। তাই দেখা গেল সুব্রত রায় প্রস্তাব দেয়া পরবর্তী আমাদের আবাসনশিল্প খাতের মালিকদের পক্ষ থেকেও সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল; তাকে যদি একান্তই বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে এমন সব খাতের ক্ষেত্রে দেয়া হোক যেসব খাতে আমরা পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর। সুব্রত রায় কেন বাংলাদেশে এসে এমন একটি খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করলেন, যে খাতে আমরা শুধু দেশেই সক্ষম নই বরং এ সক্ষমতাকে পুুঁজি করে বিদেশেও নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের যোগ্যতা রাখি।

সুব্রত রায়ের বিনিয়োগ প্রস্তাবের ব্যাপারে আমাদের দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী এবং আমাদের সংবাদকর্মীরা সজাগ থাকার কারণে সরকারের অভ্যন্তরে যে ক্ষুদ্র মহলটি তাকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে চেয়েছিল তারা সফল হতে পারেনি; কিন্তু এ ধরনের একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী কী করে আমাদের দেশে এসে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর সাক্ষাৎ পেলেন এবং সাক্ষাৎ দেয়ার পেছেনে কারা কলকাঠি নেড়েছেন তাদের মুখোশ জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়া উচিত। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির পুত্র সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি এ বিষয়টিও দেশবাসীর জানা প্রয়োজন।

ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতার কথা আলোচনায় এলে যে খেলাটির নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তা হলো ক্রিকেট। ক্রিকেটে আমাদের খেলোয়াড়রা বিভিন্ন সময়ে দেশের জন্য দুর্লভ সম্মান বয়ে এনেছেন; কিন্তু আজ আমাদের দেশের জনগণ অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত এ কথা ভেবে যে, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ভারতের বিতর্কিত এমএলএম ব্যবসায়ী সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠান সাহারার নামসংবলিত জার্সি পরিধান করে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সুব্রত রায়ের ব্যাপারে ভারতের সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আগেই ভাবা উচিত ছিল আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল ভিনদেশী একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের নামসংবলিত জার্সি পরিধান করবে নাকি দেশী বা বিদেশী নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানের নামসংবলিত জার্সি পরিধান করবে?

উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠানের নামসংবলিত জার্সি পরিধান করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন অনেক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের নামসংবলিত জার্সি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পরিধান করলে তারা গর্ববোধ করবে; কিন্তু তাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে কেন ভারতের বিতর্কিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে এ সুযোগটি দেয়া হয়েছিল তা ভেবে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।

চূড়ান্ত বিচারে সুব্রত রায়ের কী হবে, ভারতের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা সে দেশের মানুষের অজানা। কিন্তু আইনজীবী মনোজ শর্মা সুব্রত রায়ের মুখায়ব কালির কালিমায় আবৃত্ত করে অন্যায়ের প্রতিবিধানে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা অন্যায়কে মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন ভারত ও ভারতের পাশের রাষ্ট্রগুলোর এমন লাখো-কোটি মানুষের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্তটি যাদের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে তাদের জন্য আশা উদ্দীপক। আর তাই প্রতারণা ও ফটকাবাজির শিকারে সর্বস্বান্ত হয়ে হতাশার অতল গহ্বরে নিমগ্ন কেউ যদি আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে আমাদের দেশে অনুরূপ ঘটনা ঘটায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু কি আছে?

 


  • লেখক সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। Email: iktederahmed@yahoo.com



জিয়াউর রহমান হচ্ছেন গণতন্ত্র ও উন্নয়নের প্রতীক

মো. মিজানুর রহমান




১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন জিয়াউর রহমান এবং এই বছরেই কমান্ডো ট্রেনিং লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান। তিনি একজন দক্ষ প্যারাট্রুপার ছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে ডিএফআই অর্থাৎ সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ-এ কয়েক মাস চাকরি করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতযুদ্ধ শুরু হলে জিয়াউর রহমান খেমকারান রণাঙ্গনের বেদিয়ান-এ যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এর একটি ব্যাটালিয়ান কোম্পানি আলফা কোম্পানির কমান্ডার এর দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি একজন তেজী, বুদ্ধিমান, বীর হিসেবে যুদ্ধে জয়লাভ করে পাকসেনা বাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্বসূচক পদক লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাকটর হিসেবে নিয়োগ পান এবং একই বছরে পশ্চিম পাকিস্তান স্টাফ কোয়াটার কলেজে কমান্ডো কোর্সে যোগ দেন। অতঃপর ১৯৬৯ সালে এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনীতে মেজর পদ-এ পদোন্নতি পেয়ে জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যোগদান করেন এবং একই বছরে এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম জার্মানিতে যান। সেখানে কয়েকমাস ব্রিটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ফিরে আসেন এবং তাঁকে সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। নিযুক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে।

এরপর ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে আমাদের ভূখণ্ডের সর্বজনীন মানুষের জীবনে নেমে আসে পাকহানাদার বাহিনীর ভয়ঙ্কর আক্রমণ । সেই আঁধারের মাঝে অকস্মাৎ আলোর ঝড় হয়ে উদ্ভাসিত হন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি দিশাহারা-নেতৃত্বহীন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বদ্বীপে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ জয়ের  অভিজ্ঞতায় শানিত হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত স্থাপন করেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ‘We Revolt’ ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। পরর দিন তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রেডিয়ো স্টেশন স্থাপন করে রেডিয়ো মাধ্যমের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে এক ও এগারো নম্বর সেক্টরে তিনি কমান্ডার হিসেবে দুধর্ষ যুদ্ধ করেন। এরপর সাতই জুলাই থেকে জেডফোর্স এর কমান্ডার হিসেবে অসংখ্য যুদ্ধ পরিকল্পণা ও বাস্তবায়ন করেন। যুদ্ধে বিজয় হলে তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জিয়াউর রহমানকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয় এবং দেশ স্বাধীনের পর কুমিল্লায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। অতঃপর ১৯৭২ সালে জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিতে ‘বিগ্রেডিয়ার’ এবং পরে একই বছরে ‘মেজর জেনারেল’ হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন।

সে সময় তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী-এমপি, নেতাকর্মীদের দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে আসে এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা থেকে সরে এসে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে তাদের নিজ দলসহ সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে এবং তাদের অনুগত চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। সেইসাথে ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ১১৭ (ক) আর্টিকেল সংশোধনপূর্বক দেশে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করে এবং বাকশাল এর মাধ্যমে দেশ শাসন কায়েম করে। এরপর নেমে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহতা এবং আগস্টের ২৫ তারিখে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। শেখ মুজিব পরবর্তী দেশ শাসনে অস্থিতিশীলতা দেখা যায় এবং জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এরপর সাতই নভেম্বরে বিপ্লবের মাধ্যমে সিপাহি-জনতা খালেদ মোশাররফ নেতৃত্বাধীনদের পরাভূত করে জিয়াউর রহমানকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে এবং তাকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৭৬ সালে ২৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর কাছ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র ও উন্নয়নে একের পর এক ভিত গড়ে দিয়েছেন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি, রাজনীতি, অর্থনীতি, আর্ন্তজাতিক এমন কোন সেক্টর নেই যে, অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে জিয়াউর রহমান এর হাত লাগে নি। 

জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ক।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার চল্লিশ দিন পর জিয়াউর রহমান স্বাধীন দেশে প্রথম ‘হ্যাঁ-না’ ভোট  করেন- যা ছিল গণতন্ত্রের বীজ বপন এবং ৯৯% হ্যাঁ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হন।

রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের রেখে যাওয়া রাষ্ট্র-যেখানে মানুষের অধিকার, মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত, গণতন্ত্র নির্বাসিত, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও শান্তিশৃঙ্খলাহীন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র এর প্রবর্তন করেন অর্থাৎ গণতন্ত্রের ভিত গড়েন এবং নতুন যুগোপযোগী রাজনীতির সূচনা করেন। যার ফলে আওয়ামী লীগও আবার নতুনভাবে আওয়ামী রাজনীতি করার সুযোগ পায়।

১৯৭৮ সালে ৩ জুন প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন।

১৯৭৮ সালে পহেলা সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি গঠন করেন-যার মূল চেতনা ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। তিনি বাংলাদেশের বাঙালি-অবাঙালি, সাঁওতাল, চাকমা, মুণিপুরী, খাসিয়া প্রভৃতি জাতি-উপজাতির জনগোষ্ঠীকে ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত এর সব কিছুর ঊর্র্ধ্বে সকল নাগরিকের প্রথম রাষ্ট্রীয় পরিচয় ‘বাংলাদেশী’ পরিচয়কে তুলে ধরেন এবং  মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা  ও প্রত্যাশাকে সম্মান করে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেন যেখানে আমাদের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় অক্ষুন্ন থাকে।

তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্থাৎ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেন। তিনি ‘বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট’ ও সাংবাদিকতা ঘটিত অভিযোগ নিষ্পন্নের জন্য ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’ প্রথম গঠন করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই প্রথম জাতীয় প্রেসক্লাব এর ভিত্তি স্থাপন করেন এবং মিরপুরে সাংবাদিকদের জন্য বাইশ বিঘা জমি বরাদ্দ দেন।

তিনি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব আনায়নের লক্ষে স্বল্পমুল্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং ‘খাল কাটা ও পুনঃখনন’ কর্মসূচি চালু করেন। খামারে বিদ্যুতায়ন ও সার বিতরণ এর ব্যবস্থা করেন। যার ফলে এক ফসলি জমি দুই ফসল বা তিন ফসল এর জমি হয়ে ওঠে। সেই সাথে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে প্রথম খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করে খাদ্য রপ্তানি পর্যায়ে উন্নীতকরণ করেন। 

তিনি পাটশিল্প, টেক্সটাইল মিল, কাগজ মিল, সার কারখানা, চিনিকল প্রভৃতি নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নেন। কলকারখানায় তিন শিফ্ট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করেন এবং এ ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য ঢাকার মতিঝিলে বহুতল শিল্পভবন স্থাপন করেন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূর হয়।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অল্প সময়ে চল্লিশ লক্ষ মানুষকে অক্ষরদান করে গণশিক্ষার বিপ্লব ঘটান। দেশ গঠন ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর-বিএনসিসি গঠন করেন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সময়োপোযোগী করতে সিলেবাসে সায়েন্স, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করেন। অস্ত্রের ভয়-ভীতি, খুন, হল-দখল, সেশনজট, লাঞ্ছনা প্রভৃতির বিপরীতে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এনে মেধা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চা এবং বিকাশের নতুন যুগের সূচনা করেন।

তিনি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ২৭, ৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিযোগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করেন। তিনিই ডায়াবেটিক হাসপাতাল স্থাপনে উৎসাহ প্রদান ও মহাখালীতে কলেরা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বন্ধ করতে ও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী-ভিডিপি গঠন করেন।

তিনি একেবারে গ্রামীণ পর্যায়ের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ব্যবস্থা’ প্রবর্তন করেন।

দেশে উৎপাদন ও সমৃদ্ধি আনায়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে হাজার হাজার মাইল রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন।

দেশের জাতীয় আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্প। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই প্রথম এই তৈরি পোশাকশিল্পকে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই  প্রথম ১৯৭৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে ৮, ৫০০ জনের কর্মসংস্থানের মধ্যে দিয়ে বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির যাত্রা শুরু করেন।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ায় তিনিই ‘নদী গবেষণা ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনিই প্রথম সরকারি সহায়তায় ট্রলার কিনে সমুদ্রে মাছ ধরা ও তা বিদেশে রপ্তানি করার ব্যবস্থা করেন। ফলে আজকে এই ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। 

তিনিই প্রথম গ্রামীণ ও শহর অঞ্চলের নিম্ন আয়ের ও নিঃস্ব মানুষের জন্য বিনা জামানতে সরকারি  ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন।

দেশের উৎপাদন ও উন্নয়নে তিনিই তাঁত ও ক্ষদ্র কুটির শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।

দেশের উন্নয়নে যুবকরা যেন ভূমিকা রাখতে পারে এবং বিপথে না যায় তাই তিনিই প্রথম যুবকদের কার্যপোযোগী প্রশিক্ষণ ও যুগোপযোগী উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ গঠন করেন। 

দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাই তাদেরকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত করতে তিনিই প্রথম ‘মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করেন এবং জাতীয় আসনে নারী আসন বৃদ্ধি ও চাকরিতে নারী কোটা বৃদ্ধি তারই অবদান।

রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্ব-স্ব ধর্ম নির্বিঘ্নে পালনের জন্য তিনিই প্রথম ‘ধর্ম মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। বহু ধর্মীয় মুল্যবোধের নিদর্শনস্বরূপ তিনি চিন থেকে অতীশ দ্বীপঙ্কর ও শ্রীজ্ঞানের দেহভস্ম বাংলাদেশে আনেন এবং একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। 

দেশকে আধুনিকায়নে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনে  তিনিই প্রথম ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়’ সৃষ্টি করেন। 

তাঁর সময়ে দেশে প্রথম বিটিভি’তে রঙিন ট্রান্সমিশন প্রচার চালু হয় এবং এফডিসিতে ক্যালার ল্যাব স্থাপন করা হয়। নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে এবং অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রীয় অনুদানে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করার বিষয়টি জিয়াউর রহমানই প্রথম চালু করেন। গাজীপুরে এফডিসি স্থাপনের জন্য তিনিই প্রথম জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। দেশীয় সংস্কৃতিকে আর্ন্তজাতিক পরিম-লে তুলে ধরার জন্য তিনিই শিল্পি, সাহিত্যিক, কবিদের বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তিনিই শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ ও বিনোদনের জন্য সত্তর দশকের শেষের দিকে ‘শিশু পার্ক’ স্থাপন করেন। শিশুদের প্রতিভা বিকাশ ও প্রশিক্ষণের জন্য ‘শিশু একাডেমি’ এবং নিজস্ব সংস্কৃতিতে শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘নতুন কুড়ি’ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেন।

১৯৭৯ সালে তিনিই একুশে বইমেলাকে বাংলা একাডেমির দ্বায়িত্বে নিয়ে আসেন এবং সে সময় থেকেই একুশে বইমেলা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে।

স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান জিয়াউর রহমানই চালু করেন। 

জিয়াউর রহমানই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিজ হাতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং ১৯৭৬ সালে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করেন। কবি মারা গেলে তার মরদেহ কাঁধে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে দাফন করেন এবং নিজে লাশ নিয়ে কবরে নামেন। এছাড়াও ফার্মগেট থেকে শাহবাগ কবির মাজার পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসে তিনিই এই রোডের নামকরণ করেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ’।

তিনিই বিশ্ববিখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে বাংলাদেশে আনেন এবং সন্মানজনক ‘নাগরিকত্ব’ প্রদান করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর অবদানের ফলে জাতিসংঘের সদস্যলাভের মাত্র চার বছর পর অর্থাৎ বাংলাদেশের মাত্র ৭ বছর বয়সে জাপানকে হারিয়ে ‘নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ’ লাভ করে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর কল্যাণে ‘তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটি’তে  বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি হয়।

দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষে তিনিই সর্বপ্রথম ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

এছাড়াও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সমবায়ের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন, শক্তিশালী স্বশস্ত্র বাহিনী গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশ ও পৃষ্ঠপোষকতাদানে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি যথার্থভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা এনেছিলেন এবং উন্নয়নস্বরূপ ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সার্বিক উন্নয়নে যে ‘ঊনিশ দফা’ পেশ করেছিলেন যা এদেশের গণমানুষের মুক্তির সনদ, দেশে আজ অবধি যতো উন্নয়ন বা উন্নতিই হোক না কেন তা আজো মনেহয় সেই “১৯ দফা’রই বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্রপতি শহিদ  জিয়াউর রহমানই একটি আধুনিক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ গঠন করেছিলেন। শিল্পায়ন, শিক্ষাঙ্গন, উৎপাদন- প্রায় সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান সফলতার স্বাক্ষর রেখে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে একটি সম্ভাবনাময় উদীয়মান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নবজন্ম রূপায়ন করেছিলেন এবং উন্নয়নকামী এ দেশকে সার্বিক উন্নয়নের রাজপথে পরিচালিত করতে পেরেছিলেন। অতএব এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, দেশ গঠনে-রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান- গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ভিত গড়ে দিয়েছেন।

                                                   

  • লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট।