আমাদের বুধবার প্রতিবেদন
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গত মে মাসে ‘ইল্লিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০৫-১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে। এবারের প্রতিবেদনে রয়েছে ২০০৫-২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থ পাচারে ভারতের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার (প্রায় ৭২,৮৭২ কোটি টাকা) পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে- যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানিসম্পদ খাতের মোট উন্নয়ন বাজেটের সমান। এছাড়া, ২০০৫-২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে (৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার)- যা ছিল সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর পর্যন্ত। অর্থ পাচারে দেশগুলোর তালিকায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯টি দেশের মধ্যে ছিল ২৬তম। আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপনসহ নানা পদ্ধতির মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। অথচ কেবল অর্থ পাচার ঠেকাতে পারলেই মূসক খাতের আয় নিয়ে আদৌ কোনো দুশ্চিন্তা করতে হতো না এনবিআরকে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়েই বাংলাদেশে ৩টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব হতো। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬-তে দেখা যায়; ২০১৫ সালে সেদেশে বাংলাদেশীদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা বেড়েছে ১৯ শতাংশ। বর্তমানে যেখানে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর আগেই বলা হয়েছে যে, মে মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয় ১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
আমাদের দেশটি বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে;নানা স্বপ্নও দেখানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের মতে, অচিরেই দেশটি মধ্যম আয়ের দেশের বলয়ে ঢুকে যাবে। ফলে অর্থপাচারের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের আমলে না নেওয়ার কোনো কারণ দেখি না। এর আগেও অনেকবার বিষয়টি সামনে এসেছে, কিন্তু সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা অর্থপাচার রোধে খুব যে একটা তৎপরতা দেখিয়েছে, তেমনটি মনে করা যায় না। এর প্রমাণ তো প্রতিবেদনের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। বাংলাদেশের জন্য অর্থপাচারের ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও, সংশ্লিষ্টদের রয়েছে অনিবার্য নির্লিপ্ততা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয় যে, দেশ থেকে অর্থপাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনা আদৌ রোধ করা যাবে কি না?
প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং অর্থাৎ আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে এবং রফতানির সময় আন্ডার ইনভয়েসিং অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে আমদানি রফতানি করছেন। এ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিষয়টি যেহেতু বারবার আলোচনায় উঠে আসছে, তাহলে তা প্রতিরোধে কেন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। পণ্যের আমদানি-রফতানির জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলই ব্যবহার করতে হয়। অর্থপাচারের এই দায় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অস্বীকার করতে পারে না।
অন্যদিকে, ‘সেকেন্ড হোম’ এর কথাটিও বহুল আলোচিত। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী মোটা অংকের বিনিয়োগ করে শিল্পপতিরা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে নিচ্ছেন। বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের সুবিধা নেওয়া, কানাডায় বেগমপাড়া তৈরি, বেশকিছু ব্যবসায়ীর সিঙ্গাপুর, হংকং-এ অফিস বানানোর তথ্য সত্য বলেই এখন ধরে নেয়া যায়।
২০১৫ সালে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য সরকারের ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশ ৩য় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ; যেখানে ৩ সহস্রাধিক বাংলাদেশি প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নগদ ৫ লাখ রিঙ্গিত (১ কোটি ২৫ লাখ টাকা) দেশটিতে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত যে কোন দেশে নাগরিকদের বিদেশে টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে, যেখানে গত ১০ বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত রয়েছে, সেই সব দেশের আবাসিক ভবন, জমি ক্রয়, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে অনেকে অফশোর ব্যাংকিং, বিদেশী কনসালটেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন।
বিশ্বজুড়ে আলোড়নকারী টাকা পাচারের কেলেঙ্কারি ফাঁস করা ‘পানামা পেপার্স’ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২৭টি ব্যাংক হিসাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে।
গত ১০ বছরের অর্থপাচারের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব বছর দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশি ছিল, সেসব বছরে অর্থপাচার বেড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার সময় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আগের ৯ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয়েছে। ওই বছরটিতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার অনেক বেড়ে যায়। বছরটিতে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর আগের অন্যান্য বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে ৩৩৫ কোটি ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৮ কোটি ডলার, ২০০৭ সালে ৪১০ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৬১৩ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৫৪১ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ থেকে দিন দিন অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
এটাও জানা যায়, দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও এর বিপরীতে মামলা হচ্ছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকার, যা মোট পাচারকৃত অর্থের ৩ শতাংশ। বাকি প্রায় ৯৭ শতাংশ বা ৪৩ হাজার কোটি টাকার কোনো রেকর্ড থাকছে না। এ অর্থ হিসাবের মধ্যে আসছে না। পাচার হওয়া অর্থের একটা বড় অংশ জমা আছে সুইস ব্যাংকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন ধরে যখন বাংলাদেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ ঘটছে না, তখনো পাচার হচ্ছে অর্থ। অথচ এই অর্থ যদি পাচার না হয়ে বিনিয়োগে আসত তাহলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতো, উৎপাদন ও রফতানি বাড়তো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। সব মিলে অর্থনীতি ও উন্নয়নে বড় রকমের অগ্রগতি হতো।
সাধারণত দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থসহ অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ পাচার হয়ে যায়। এটা ঠিক, দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তার অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ পরিবেশেরও অভাব আছে। অর্থপাচার হওয়ার এ দু’টিই বড় কারণ। এর আগে অপ্রদর্শিত অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। দুদক ও বিভিন্ন সংস্থার ভয়ে অনেকেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখাননি। দুর্নীতি বা অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন কোনো দেশেই সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও দেখা গেছে অনেক দেশ এ অর্থ অবাধে ও বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে এবং তাতে ওইসব দেশ লাভবান হয়েছে।
বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) পরিচালিত ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়। ২০১৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০-৮০ শতাংশ কালোটাকা। জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) এর তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। পাচারকৃত এ অর্থ দেশের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর দুই-তৃতীয়াংশ।
উৎস - amaderbudhbar.com