শায়রুল কবির খান
পুঁজিবাদী সভ্যতার নিয়ম অনুসারে পুষ্ট হতে থাকা শহরগুলোর নিষ্ঠুর, নির্দয় আক্রমণে গ্রামগুলোর অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়েছে। কুটিরশিল্পের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা ভেঙে পড়া ঘরের তলায় দম আটকানো মানুষের অবস্থা যেমন, বর্তমান অর্থনীতিতে কৃষকদের অবস্থাও ঠিক সে রকম। পক্ষান্তরে কৃষকদের যে অংশ শহরে এসে রিকশা চালায়, কলকারখানায় মজুরি করে, অফিসের পিয়ন-দারোয়ান অথবা ছোটখাটো কাজের ব্যবস্থা করে, তারা নিজেদের স্ব-গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে মনে মনে ভাগ্যবান মনে করে। বেঁচে থাকার জন্য তারা শহরের ধনিক-শ্রেণির কাছ থেকে ছিটেফোঁটা যা পায়, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অল্প। তবু তা তুলনামূলকভাবে কৃষকদের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেণিগুলোর বিন্যাস বিচার করে দেখলে কোন শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত-বঞ্চিত, তা বিচার করে দেখার জন্য কষ্ট করে গবেষণা প্রয়োজন হবে না।
এখন কথা হলো—গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে যেখানে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে শ্রেণিটি বঞ্চিত ও নির্যাতিত, সেই সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন সাধনেই তো একটি সমাজের প্রধান লক্ষ্য।
আমি মনে করি শ্রমিক শ্রেণি পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত, সামাজিক বিপ্লব সম্ভব নয়। আগে শিল্পায়িত হবে, শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বাড়বে, তারা সত্যিকার সর্বহারায় পরিণত হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার সুযোগ আসবে, তারপর সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু হবে, এটা একটা কষ্ট কল্পনা।
ধরে নিলাম আগামী কয়েক বছরেও কোনও রকমের কার্যকর শিল্পায়ন হলো না, রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র চলমান থাকলো, তাহলে পরিবর্তনের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিতে হবে, এভাবে সুযোগের আশায় থেকে থেকে একশ’ বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে, কোনও দিন সংগঠিতভাবে পরিবর্তন সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী এবং উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর লেজুড়ে পরিণত হচ্ছে।
এরকম পরিস্থিতিতে যখন কৃষকদের মধ্যে তীব্র অভাববোধ তৈরি হবে, শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমের ন্যায্যতার চেতনা জাগ্রত হবে, নালিশ থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার স্পৃহা থাকবে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে এখানে একটি বিশেষ শ্রেণি নেতৃত্ব দিতে পারে কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষ না চাইলে কিছুতেই সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না।
আগামী দিনের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংগঠনটি শ্রেণিসংগ্রাম ভিত্তিতে একটা সামাজিক গুণগত পরিবর্তন সাধনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করবে, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে বর্তমান সমাজ কাঠামোতে প্রকৃত বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত করা, কোন শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি সর্বহারা, সে বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে উপলব্ধি করা। যদি কৃষকশ্রেণি হয়ে থাকে তাহলে এই কৃষকশ্রেণিকে দিয়েই সামাজিক পরিবর্তনের কর্মসূচি রচনা করতে হবে, তাতে করে রাজনীতির চরিত্রের গুণ এবং কৌশলের আমূল পরিবর্তন দরকার হবে। এযাবৎকাল রাজনৈতিক আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ছিল যে শ্রেণিটি, তাকে স্বজ্ঞানে এবং সচেতনতায় ধীরে ধীরে সমন্বয় করে নতুন কেন্দ্রিক সহায়ক শ্রেণিগোষ্ঠীর ওপর অর্পণ করতে হবে। এই শ্রেণিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃত সর্বহারা কারা, কাদের জন্য সামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন, কারা সমাজের এই পালাবদলে লাভবান হবে, তাদের বুঝিয়ে একটি গুণগত পরিবর্তনে বিশ্বাসী করে তুলতে হবে। গতানুগতিক রাজনীতিতে আছে দাম্ভিকতা, মিথ্যাচার, শঠতা এবং পোশাকী প্রচার। এ ধারার রাজনীতি দিয়ে গুণগত পরিবর্তন আনা যাবে না।
আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাছে শহীদ জিয়ার রাজনীতির প্রজ্ঞার প্রয়োজন সর্বাধিক। বর্তমানে ফ্যাসিবাদী মনোভঙ্গির স্থলে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য চিন্তা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহারে বলতে চাই, বাংলাদেশের কৃষকদের দুর্দশার আজ আর অন্ত নেই। তারা ঘরহারা, জমিহারা, সংস্থানহারা রুটি-রুজির কঠিন পরিস্থিতিতে। তারা এ অবস্থার নিশ্চয়ই পরিবর্তন চায়। কৃষকদের জীবনমান অবস্থার পরিবর্তন না হলে গোটা সমাজের পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এই কৃষকদের আকাঙ্ক্ষা ত্বরান্বিত করার জন্য সে অনুসারে প্রয়োজনীয় সকল কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।