— কাদির কল্লোল
সংসদের মেয়াদের শেষ বছরে এসেও ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৎপরতা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে আলোচনায় এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচন। সেখানে বিএনপির দলছুট প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতাতে আওয়ামী লীগ কার্যত একতরফা নির্বাচনের সব চেষ্টা চালাচ্ছে বলা যায়। উকিল সাত্তারের একতরফা জয় নিশ্চিত করতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নন, এমন যে কজন প্রার্থী মাঠে টিকে রয়েছেন, তাঁদের সমর্থকেরাও গ্রেপ্তারের আতঙ্কে আত্মগোপনে যাওয়ায় ওই প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ওই নির্বাচনী এলাকায় একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া ছয়টি আসনে এখন উপনির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি এই উপনির্বাচনে অংশ নেয়নি।
ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এরপরও আসনগুলোতে ক্ষমতাসীন দল–সমর্থিত এবং দলের নিজের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোটে নেমেছেন যাঁরা, তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের অনেককে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং অনেকে গ্রেপ্তারের আতঙ্কে মাঠছাড়া হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী যে নির্বাচনে নেই, সেই উপনির্বাচনেও যখন ভোটে অংশ নেওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাঠছাড়া করা হচ্ছে, তখন ক্ষমতাসীন দলের এই কৌশল নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে একতরফা নির্বাচন করার সব চেষ্টাই দৃশ্যমান। সেখানে বিএনপির দলছুট প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতাতে আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। দলটির তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের শুরুতেই প্রার্থিতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির দুবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন এবং তাঁকেও সরকারের বিভিন্ন দিক থেকে চাপ দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আরেকজন প্রার্থী স্থানীয় বিএনপির সাবেক নেতা আবু আসিফ আহমেদ নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর নির্বাচন পরিচালনার প্রধান শাফায়াত সুমন এবং নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব থাকা মুসা মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে কয়েক দিন আগে। বাকি যে দুজন প্রার্থী এখনো ভোটের মাঠে রয়েছেন, তাঁরাও অভিযোগ করেছেন, তাঁদেরও কর্মী-সমর্থকদের অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে মাঠছাড়া হয়েছেন এবং এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা এজেন্ট নিয়োগের লোক পাচ্ছেন না। ক্ষমতাসীনেরা সেখানে কার্যত একতরফা ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
আওয়ামী লীগ যে আসনগুলোতে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে, সেই আসনগুলো থেকেও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরাই ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করার অভিযোগ তুলেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের সাবেক জেলা সভাপতি সামিউল হক দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছেন। তাঁর ১৫টি নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং ৩টিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দিয়ে কোনো প্রতিকার না পওয়ায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের এই বিদ্রোহী প্রার্থীর অভিযোগ তাঁর দলের বিরুদ্ধেই।
বগুড়া-৬ সদর আসনেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে আওয়ামী লীগের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন আসনে একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টার যে চিত্র বা নানা অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে, সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে উকিল সাত্তারের সমর্থনে ক্ষমতাসীন দল সব ধরনের ’মেকানিজম’ ব্যবহারের বিষয়গুলো অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘটছে। কিন্তু সেখানে নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকাই রাখছে না বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অন্য আসনগুলোতেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে অভিযোগ, প্রশ্ন বা আলোচনা-সমালোচনা, যা–ই হোক না কেন, সমর্থিত এবং নিজেদের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে বিরোধীদের মাঠছাড়া করে ক্ষমতাসীন দল একতরফা ভোটের চেষ্টায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বিরোধীদের মাঠ থেকে বিদায় করা হবে কি না? এখন উপনির্বাচনে সেই মহড়া দেওয়া হচ্ছে কি না?
— প্রথম আলো/ জানুয়ারি ৩১, ২০২৩