Search

Monday, July 29, 2024

১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক



বর্ষীয়ান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী বদরুদ্দীন উমর রাজনীতি ও গবেষণায় সম্পৃক্ত রয়েছেন ৫৩ বছর ধরে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে শতাধিক বই রয়েছে তার। দেশের চলমান ছাত্র আন্দোলন ও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন 


চলমান ছাত্র আন্দোলন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।


উন্নয়নের কথা বলে অপকীর্তি ঠেকানো যায় না। মানুষের প্রতি জুলুমের বিষয়টিই শেষ পর্যন্ত সামনে এসেছে। বর্তমান আন্দোলনকে বুঝতে হলে অতীতে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানগুলো বুঝতে হবে। এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি অভ্যুত্থান হয়েছে। শুরুর অভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। 


বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক ও বৃহৎ গণ-অভ্যুত্থান আমরা দেখছি। এ গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃত চরিত্র, কারণ এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে— এটি বোঝার জন্য এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সেদিকে তাকাতে হবে। সেটি ছাড়া এ গণ-অভ্যুত্থানকে বোঝার উপায় নেই। এখানে একটি কথা বলা দরকার, অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ অঞ্চলে ১৯৫২ সালে আমরা প্রথম গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম।


এই প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫২ সালের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন সরাসরি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের শুরুর দিকের এ সময়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয়। দেখা যায়, বায়ান্নর আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকার পতন হয়। শুধু যে সরকারের পতন হয়েছিল তা-ই নয়; মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল তাতে সামরিক সরকার টিকে থাকলেও আইয়ুব খানের সরকার উচ্ছেদ হয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৭১ সালে জানুয়ারি কিংবা এর আগেই ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে সরকার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর সক্ষম ছিল না। তখন প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্র শাসন পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর যুদ্ধ আরম্ভ হয়; সেই যুদ্ধের ফলে সরকার নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়েছিল। এতই শক্তিশালী ছিল তখনকার অভ্যুত্থান এবং জনগণের আন্দোলন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এ আন্দোলন কিন্তু দেশব্যাপী বিশাল আন্দোলন ছিল না। সে সময় আমি লিখেছিলাম—এটি একটি নাগরিক অভ্যুত্থান। কারণ গ্রামাঞ্চলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন ছিল ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরকেন্দ্রিক। সেই নাগরিক বুর্জোয়ার অভ্যুত্থানের ফলে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দেখা গেছে, আগের চারটি অভ্যুত্থানের পরই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালের গণ-অভ্যুত্থান পরিণতি লাভ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রই উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। 


বর্তমানে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, এর ফলে চারদিকে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে এ সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এ গণ-অভ্যুত্থান যত ব্যাপক হয়েছে এর আগে কোনো অভ্যুত্থান এত ব্যাপক কখনো হয়নি। ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে তো বটেই সমগ্র গ্রামাঞ্চলে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে সরকার ছাত্রদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করেছে এতে এ আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ যে যার পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। এ কথা বলা দরকার, ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তা আর কোটার আন্দোলন হিসেবে দেখলেই চলবে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগ যে তাণ্ডব, নির্যাতন এবং নানাভাবে জুলুম চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ ছিল। এ ক্ষোভের একটি ভূমিকাও ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে পড়েছে। এটিকে শুধু কোটা আন্দোলন, শুধু চাকরির আন্দোলন হিসেবেই দেখলে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া ছিল কোটা আন্দোলনে। সরকারি আক্রমণের কারণে এই কোটা আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটি অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং ব্যাপকভাবে সারা দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে। 


শুধু ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের কারণে জনগণ এ অভ্যুত্থানে নেমেছে এমন নয়। সারা দেশে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবকিছুর দাম বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। সরকার জনগণের মতপ্রকাশের ওপর, বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। সংবাদপত্রগুলোয় সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যায় না। এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। তাদের ধারণা, এ সরকার যত দিন থাকবে তত দিন পর্যন্ত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, দেশের টাকা পাচার, সরকারের প্রজেক্ট থেকে টাকা চুরি, এসব বন্ধ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কাজেই অভ্যুত্থান এখন হয়েছে। 


এ অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এত দিনেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। এখন পর্যন্ত তারা কারফিউ দিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট বন্ধ ও সীমিত রাখার মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায়, তারা এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কোটা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের তারা নতুন করে ধরপাকড় করছে। তাদের জোরপূর্বক গ্রেফতার করে তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এর পরিণতি যে কি দাঁড়াবে! নতুনভাবে চারদিকে আন্দোলন শুরু হয় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়। চারদিকে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এটা যে শুধু দেশেই হচ্ছে তা নয়। সারা দুনিয়ায়; শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, বুদ্ধিজীবীরা, লেখকরা এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং এ হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ঢাকায় ১৪টি দেশের কূটনৈতিক মিশন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বরাতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু আসলে কত লোক যে মারা গেছে তার কোনো হিসাব নেই। হতে পারে শুধু হাসপাতালের তথ্য দিয়ে হিসাব করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাদের তো হাসপাতালে আনা হয়নি। কত লোক মারা গেছে তার হিসাব আসলে নেই। এই যে বেহিসেব হত্যাকাণ্ড, এর বিরুদ্ধে জনগণ চারদিকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ কথা বলা যায় না যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে আছে এতে নতুনভাবে আবার একটা আন্দোলন; আরেকটা ধাক্কা আসার সম্ভাবনা পুরোপুরিই রয়েছে। এ ধাক্কায় সরকারের অবস্থা কী হবে সেটি ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।

 



আপনি ঊনসত্তর সালের গণ-অভ্যুত্থান দেখেছেন। এর সঙ্গে এবারের আন্দোলনকে কীভাবে তুলনা করবেন?


ঊনসত্তর সালের আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের সাদৃশ্য রয়েছে। সেটি হলো, আইয়ুব খান ১০ বছর পাকিস্তান শাসন করেছিল। ১০ বছর পর ‘‌ডিকেড অব ডেভেলপমেন্ট’ বলে চারদিকে খুব উৎসব শুরু হয়েছিল। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে এবং এ সরকারের পরিবর্তন চেয়েছে। দেখা গেল, উন্নয়নের কথা বললেও আইয়ুব খানের আমলে যে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। উপরন্তু উন্নয়ন সত্ত্বেও শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ একটি পর্যায়ে এসেছিল। সেখানে উন্নয়নের কথা মানুষ চিন্তা করেনি, বরং তাদের ওপর কত নির্যাতন হয়েছে সেটি চিন্তা করেছে। কারণ আইয়ুব খানের উন্নয়ন জণগণের কাজে আসেনি। এ উন্নয়নের ফলে শাসক শ্রেণীর লোকজনই সুবিধা পেয়েছিল। বর্তমান সরকারও গলা ফাটিয়ে উন্নয়নের কথাই বলে যাচ্ছে। দেখা যাবে যে বড় বড় এ প্রকল্পে আইয়ুব খানের আমলে যা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। এ রকম বড় প্রকল্পগুলোয় আইয়ুব খানের আমলে সে রকমভাবে চুরি হয়নি। এখন বড় বড় প্রকল্প মানে বড় বড় চুরি। লাখ লাখ কোটি টাকা এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। এর থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন, সরকারি আমলা ও সুবিধাভোগী লোকজন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এভাবে লুটপাট করে তারা যে অবস্থা তৈরি করেছে দেশে তাতে উন্নয়নের ফল জনগণের কাছে পৌঁছেনি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে মানুষের আয়-মজুরি সেভাবে বাড়েনি। কাজেই তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মানুষ আগে যে তিনবেলা খেত, তারা এখন দুই বেলা-এক বেলা খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে। মাছ-মাংস যেভাবে খেত সেভাবে এখন আর পারছে না। খাবার জিনিসও কমে গেছে। 


একের পর এক সরকারি কর্তাব্যক্তির হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির রিপোর্টের প্রভাবও জনগণের মধ্যে পড়েছে। বড় বড় অবকাঠামো সাধারণ মানুষের কতটুকু উপকারে এসেছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে দেশের মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খান যেমন উন্নয়নের কথা বলে পার পায়নি; বর্তমান এ সরকারও উন্নয়নের কথা বলে পার পাবে বলে মনে হয় না।  


সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?


আওয়ামী লীগ এখন বেকায়দায় পড়ে দোষ কার ঘাড়ে চাপাবে এটি ভেবে অস্থির আছে। এক্ষেত্রে তো তারা বিএনপি-জামায়াত ছাড়া আর কিছু দেখে না। তারা বাংলাদেশের জনগণকে দেখে না। জনগণ যে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এ চিন্তা তাদের নেই। এ চিন্তা করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কিন্তু এ কথা বলে পার পাওয়ার উপায় তাদের নেই। এজন্যই তারা বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করছে। এটি ঠিক যে বিএনপি-জামায়াত এ আন্দোলনে কিছুটা অংশগ্রহণ করেছে। এতে দোষের কিছু নেই। এমন একটি অভ্যুত্থান-আন্দোলন হলে জামায়াত বা বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে? আমরা মনে করি, এ দল দুটির যতটা অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল ততটা অংশগ্রহণ তারা মোটেই করেনি। নিজেদের দেউলিয়াপনার কারণে বিএনপি ও জামায়াত সেভাবে নামেনি। নামা দরকার ছিল তাদের। কিন্তু তাদের সেই ক্ষমতা নেই। এখন আওয়ামী লীগ যে তাদের দোষারোপ করছে, এতে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো বিএনপি-জামায়াতেরই লাভ হচ্ছে। যে কাজ তারা করেনি সেই কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জামায়াত ও বিএনপিকে তারা গৌরবান্বিতই করছে। এর ফলে তাদের শক্তিই বাড়াচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের চরম মূর্খতা ও দেউলিয়াপনার কারণ। ওবায়দুল কাদের তাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের রাস্তায় নামার যে ডাক দিয়েছিলেন সেটি অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা তার ডাকে সাড়া দেননি। কেউই রাস্তায় নামেননি। এ কথা তিনিই বিবৃতি দিয়ে বলেছেন। এদিকে অংশগ্রহণ করেনি বলে ঢাকার কিছু কিছু ওয়ার্ডের কমিটি বাদ করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেরাই দলের পক্ষে দাঁড়ায়নি। সরকারের পক্ষে আছে শুধু পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আর্মি। 


আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় না নামার পেছনে কারণ কী হতে পারে?


তারা নামেনি এজন্য যে ওপরের সারির নেতারা অবস্থা না বুঝলেও নিচের সারির কর্মীরা অবস্থা বুঝতে পারছেন। সাধারণ কর্মী ও নিচের স্তরের কর্মীরা আওয়ামী লীগের দুর্বলতা কোথায় তা ধরতে পারছেন। সেজন্য আওয়ামী লীগ নেতারা যে নীতি অনুসরণ করছেন এটিতে যাওয়ার তাদের কোনো উৎসাহ নেই। তারা দেখছেন যে এটি করলে জনগণ তাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সব জায়গায় তারা মার খাওয়ার ভয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের কী হবে বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে সাধারণ কর্মীরা ভয় করছেন তাদের ওপর বিপদ নেমে আসবে। 


চলমান আন্দোলন নিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?


দেখা যাচ্ছে যে এ আন্দোলনে ভারত একেবারে চুপচাপ আছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ আন্দোলনে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলেছেন। কিন্তু ভারত সরকার একেবারে চুপ করে আছে। তার কারণ বর্তমান ক্ষমতাশীল দল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তবে পশ্চিমারা নানাভাবে সমালোচনা করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এমনকি ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও সে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করেছেন।


বণিক বার্তা/ সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর

জুলাই ২৯, ২০২৪। 

Tuesday, July 2, 2024

রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, কেরানিও শতকোটি টাকার মালিক!



স্বাস্থ্যখাত

রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতি। এখন চারদিকে শুধুই দুর্নীতির খবর। কোটি টাকা না, শত কোটি, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন তারা তা নিয়ে খুব বেশি অনুসন্ধানের কথা শোনা যায় না। আগে যেখানে এক কোটি টাকার কথা শুনলেও অনেকে চমকে উঠছেন, এখন সেখানে হাজার কোটি টাকার খবরেও কেউ অনুসন্ধান করছে না। সর্বশেষ নজরে এলো হোমিও প্যাথি ডাক্তার ডা. দিলিপ রায়ের দুর্নীতির খবর। কিভাবে তিনি এত টাকার মালিক হলেন সেটার অনুসন্ধান জরুরী। 


সাবেক এক মন্ত্রীর প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্যখাতে ঠিকাদার মিঠুর উত্থান হয়েছে। দেশের বাইরে তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি এবং অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে নিউজ করতে গিয়ে হুমকিতে পড়তে হয়েছে সাংবাদিকদেরও। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও অনেক কর্মকর্তা তাকে প্রটেকশন দিয়েছেন। এরপর এলো ড্রাইভার মালেকের শত শত কোটি টাকার সম্পদের কথা। সাবেক একজন মহাপরিচালকের ড্রাইভার হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটাসহ সব সেক্টরেই তার হাত ছিল। একজন ড্রাইভার কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন। এর পর এলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (পরিচালক) এডুকেশনে বিভাগে কেরানি আফজালের কাহিনী। কানাডায় তার বাড়ি আছে। কেরানি কিভাবে এত বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হলেন সেটাও এখনো অজানা। 


দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘এসব দুর্নীতিবাজদের মূল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান হল সচিবালয়। সচিবালয় থেকে এগুলো বন্ধ করা না গেলে এদের কখনই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’ ঠিক তাই হচ্ছে। স্বাস্থ্যের মতো সব জায়গায় দুর্নীতির বিশাল নেটওয়ার্ক। সবাই মিলেই গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। যে দুর্নীতির ভাগ পায় সবাই। ফলে এখন মন্ত্রণালয়ও কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। গত নির্বাচনের আগে আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুই শতাধিক ব্যক্তির দুর্নীতির তালিকা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে তারা এখন আরও বেশি বেপরোয়া। 


দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার জহিরুল হক বলেন, ‘আমরা নিজেরাও অনুসন্ধান করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি কারোর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় খবর এলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। কাউকে ছাড় দেবো না।’


অথচ স্বাস্থ্য খাতে যাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া কথা সেই চিকিৎসকরাই বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন হাসপাতালে অনেক শিক্ষকের পদ শূন্য। ছাত্ররা সুশিক্ষা থেকে বঞ্জিত হচ্ছে। শিক্ষকদের পদোন্নতি হচ্ছে না। মেধাবীরাও আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। একজন চিকিৎসকের চাকরি নেওয়ার পর অধ্যাপক হতে আর চাকরির বয়স থাকে না। দলবাজ না হলে পদোন্নতিও হয় না। পুরো স্বাস্থ্য খাতে যেন অশনি সংকেত। চিকিৎসকরাও কাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। জুনিয়রদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন অনেকে। ফলে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে দুর্নীতি দেখার কেউ নেই। সুযোগ সুবিধা না পেলে কেন তারা এই পেশায় থাকবেন? ফলে সামনের দিনে চিকিৎসা সেক্টরে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হতে পারে।


বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, ‘আসলে দুর্নীতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে। যারা দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। অনেক বড় কর্মকর্তাও এর সঙ্গেও জড়িত। সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে না আনা গেলে বা পেছনে যারা আছে তাদের খুঁজে বের করে জবাবদিহিতায় আনতে না পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।’  


সর্বশেষ দুর্নীতির তথ্য সামনে এসে ডা. দিলীপ কুমার রায়ের। পনের বছরের ব্যবধানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায়। রাজনীতির জাদুর ছোঁয়ায় তিনি হোমিও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথী বোর্ডের চেয়ারম্যানও। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত দিলীপ কুমার রায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে হোমিও বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেও গড়েছেন রেকর্ড।


বোর্ডে দুর্নীতি হালাল করতে নীতিকে পাল্টে অনিয়মকেও তার ব্যক্তিগত নিয়মে পরিণত করেছেন। চা-পোষা হোমিও চিকিৎসক সেই দিলীপ কুমার এখন রাজনীতিতে বড় নেতা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড, ইটভাটা, খাদ্য ও ওষুধের এক্সেসরিজের ব্যবসায়ীও। ফরিদপুরের বোয়ালমারী এলাকার ধোপা পরিবারের সন্তান দিলীপ কুমার এখন প্রতিষ্ঠিত এক স্বর্ণ ও হিরা ব্যবসায়ীর নাম। কারখানা গড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন খাদ্য, ওষুধ ও ওষুধের এক্সেসরিজ খাতেও। অথচ ৮০-এর দশকে হোমিওপ্যাথী মেডিকেল কলেজে ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। পাশাপাশি হাঁটতেন রাজনৈতিক এক নেতার অনুসারী হয়ে। এরপর দিলীপ কুমারের উত্থান যত না আকাশচুম্বী ততই রহস্যে ঘেরা।


অথচ ২০১৫ সালের ৩০ জুন ডা. দিলীপ কুমার রায়কে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধান করেন দুদকের উপ-পরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম। তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দিলীপ কুমার রায়কে অব্যাহতি দেয় কমিশন।


ইত্তেফাক/ জুন ১০, ২০২৪

Monday, July 1, 2024

তিস্তা মহাপরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং করণীয়

মো:নিজাম উদ্দিন 



এক.
তিস্তার ভিক্টিম কারা?
উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলার দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকার সাথে গভীর ভাবে যুক্ত তিস্তা নদী।হিমালয় থেকে সিকিম এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে ডুকেছে।তিস্তার পানি যেন উত্তরাঞ্চলের প্রাণ। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মার্ণ করে পানি আটকে দেয়!ফলে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ হারায় তিস্তা!সেচ মৌসুমে তিস্তায় পানির অভাবে কৃত্রিম মরু করণ চলে আর বর্ষায় অস্বাভাবিক বন্যা, সময়ে অসময়ে বন্যাই এখন তিস্তা পাড়ের মানুষের নিয়তি। তিস্তার স্বাভাবিক যে পানি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। ফলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনের এক অভিশাপ এখন তিস্তা। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা ।যার জন্য একমাত্র দায়ী আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। 

২০১১ সালে মনমোহন সিংহ সরকার বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির কাছাকাছি চলে গেলেও সেই চুক্তিটি আজও হয়নি।বলা হয় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাধার কথা!এক যুগ পেড়িয়ে গেছে।যা দেওয়ার সব দেওয়াও হয়েছে শুধু বাংলাদেশ তার তিস্তার পানির ন্যা্য্য হিস্যা পায়নি!পাচ্ছে না।ফলে তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষ পানি সংকটের ভিক্টিম।

দুই.
তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?
প্রতিবেশীর সাথে পানিবণ্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়।যার নাম তিস্তা মহাপরিকল্পনা।অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি হলে কিন্তু এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা করার প্রয়োজনই পড়তো না। এই তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে কেন্দ্র করেই এখন ভা র ত, চীন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুলপাড় চলছে!খুব সহজ করে বললে তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প । তিস্তা নদীর খনন, নদী শাসন,গভীরতা বাড়ানো,প্রস্থ কমানো,নৌ বন্দর নির্মাণ,তিস্তাকে কেন্দ্র করে উজানে সেচ মৌসুমে পানির জন্য বৃহৎ জলাধার নির্মাণ এবং নদীর দুই পাড়ে সেটেলাইট সিটি নির্মাণ।তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রায় ১৭১ বর্গ কিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব এবং নদীর গভীরতা বাড়বে পাঁচ থেকে দশ মিটার পর্যন্ত।  তিস্তা মহাপরিকল্পনা যা চীন করতে যাচ্ছে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে রংপুর বিভাগের তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। কিন্তু প্রকল্পটি নিয়ে এখন ব্যাপক রাজনীতি হচ্ছে। জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির খুব মুখ রোচক গল্প হয়েছে এখন এই তিস্তা। গল্প এখানেই থেমে নেই। চলুন, আরেকটু আগাই!

তিন.
তিস্তায় ভারতের রাজনীতিটা কী?
২০২২ সালে চীনা রাষ্ট্রদূত তিস্তা মহাপরিকল্পনাটি স্বশরীরে পরিদর্শন করতে গেলে ভারতও আড়মোড়া দিয়ে জাগে। চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরিক্ষা নিরীক্ষা চালায় এবং একটি রিপোর্ট তৈরি করে। এখন ভারত বলছে এই প্রকল্পে তারাও সহযোগীতা করতে আগ্রহী।অথচ জীবিত তিস্তাকে মেরে ফেলার জন্য দায়ী তারাই।সংবাদ বেরুচ্ছে -China, India in tug of war over Teesta project in Bangladesh. অর্থাৎ তিস্তা নিয়ে চীন -ভারতের টানাটানি! চীন একশো কোটি ডলার ব্যয়ের এই মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক সমীক্ষা করেছে। বাংলাদেশ চীনের কাছে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও সাহায্যেও চেয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চীন বলেছিল দ্রুত কাজ শুরু হবে কিন্তু ভারতের বাঁধায় সব আটকে আছে। সরকারও ভা র তকে ক্ষেপাতে চাচ্ছে না।কারণ ক্ষমতার রাজনীতি! কারণ এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি!পানি এখন ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে! বিশেষজ্ঞরা বলছেন -তিস্তার সমাধান না হলে বাংলাদেশ যেন ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়টি পুনঃ বিবেচনা করে! 

ভারত কেন চীনের তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরোধিতা করছে? এর তুমুল বিশ্লেষণ হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নীতি।এই প্রকল্পে চীনের আগ্রহের কারণ তাদের মেগা প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশকে যুক্ত করছে।বাংলাদেশ -চীন-ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত এই অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে চীন তাদের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে যুক্ত করতে চায়।চীন তার বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।তিস্তা মহাপরিকল্পনা তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভকেই প্রমোট করে যা কোনো ভাবেই ভা র ত করতে দিতে চায়না। 

চার.
তিস্তায় চীনের রাজনীতিটা কী?
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের যুক্ত হওয়ার মানে হচ্ছে চীনের অবস্থান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত স্পর্শ কাতর জায়গা শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের খুব কাছাকাছি চলে আসা।শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স  রাজ্য গুলোর সাথে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভা র ত চায়না তার এমন একটি স্পর্শ কাতর জায়গার কাছাকাছি চলে আসুক চীন! তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত হওয়া মানে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির সাথে তার বন্ধন দৃঢ় হওয়া। তিস্তা মহাপরিকল্পনা যেহেতু ভারতের তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি না করার ফলে হচ্ছে তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন যুক্ত থাকলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী চীনপন্থী কমিউনিটি গড়ে উঠতে পারে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা চীনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে ভা রত বিরোধিতা আরো চরম পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ভারত এই কাজটা হতে দিতে চায় না। ফলে সে নিজেই তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ায় প্রস্তাব নিয়ে আসছে।অর্থাৎ চীনের প্রস্তাব নিজের স্বার্থে ভা র ত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ,নাগরিক সমাজের এখন উচিত ভা র তের ভন্ডামির মুখোশটা খুলে দেওয়া, প্রশ্ন তোলা যে-ভাই তুমি আমার তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিটা আগে করে দাও,তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে হবে না! 

পাঁচ.
তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের করণীয়? 
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব হাস্যকর।বিষয়টা এমন- একটা নদীকে মেরে পুকুর বানিয়ে দেওয়ার মতো,কাউকে খুন করে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো!জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকলে আজ তিস্তা  মহাপরিকল্পনাকে চীন ভারতের সামনে একটা বড় বার্গেনিং টুল হিসাবে ব্যবহার করতে পারতো,দু দেশের কাছ থেকেই বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারতো।কিন্তু এইটা এখন সম্ভব কী?কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের যে যে রাজনীতি তাই ভূরাজনীতি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক ভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাবে। কারণ এই মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া চীন ভারত উভয়ের জন্যই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
 
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই আগামী দিনের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা মাথায় রেখে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনকে যুক্ত করা উচিৎ। বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন টেকানোর এটা একটা অগ্রীম কৌশল হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ কি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে সে পথে হাঁটবে?

লেখক: মো:নিজাম উদ্দিন 
সহ-সভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ