Search

Sunday, August 31, 2025

বিএনপি: রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান



জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলনের কথা সবার নিশ্চয়ই জানা। ইঁদুরের উৎপাত থেকে শহরটির মানুষকে মুক্তি দিতে যেখানে একজন বাঁশিওয়ালার আবির্ভাব ঘটেছিল।

যিনি তার বাঁশির মোহিনী শক্তিতে সকল ইঁদুর সাগরে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার বাঁশির সুর এতোটাই যাদুকরী ছিল। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলকেও মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কেননা রাজনৈতিক দল গণমানুষের মুখপাত্র। আর কোনো দল যখন গণমানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে, একই নীতি ও আদর্শে মোহমুগ্ধ করতে সক্ষম হয় তখন সে দলটি হয়ে ওঠে অনেক দেহের একটি প্রাণ। সে হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বললে অত্যুক্তি হয় না।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের দীর্ঘ লড়াই আর সীমাহীন ত্যাগ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করেছে। জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে গেছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। কেবল বাংলাদেশই নয় পৃথিবীর ইতিহাসে তার সরকারের এমন পলায়ন বিরল। আওয়ামী লীগের এই পলায়ন তাদের কৃতকর্মকে জনতার সামনে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছে। দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের।

অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছিল এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে তাদের প্রাণপ্রিয় দলকে। যেই বিএনপির যাত্রা শুরু হয়েছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সেনা ব্যারাকে সৃষ্টি হলেও দলটি শুরু থেকেই ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায়। এখানে সকল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্নিবেশ ঘটেছিল খুব অল্প সময়েই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, “বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনানায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। ”

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিল বীরোচিত, যা তাকে তার পেশাগত পরিমণ্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।

১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।

১৯ দফা ছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিল তার সেই ১৯ দফায়।

বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।
এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া। ”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক আয়োজন শুরু হয়। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্র বিএনপিকে ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা করেছে।

বিএনপিকে নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রাখে বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিল এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরও পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে বিএনপিতে। গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে যেই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই দলটি আজ পৌঁছে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি কানায় কানায়। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাই এই দলটির দায় ও দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কারণে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক গবেষণা করছেন। দলীয় কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসার এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির সুচিন্তিত প্রতিশ্রুতি এদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। সেদিন খুবই সন্নিকটে যেদিন বাংলাদেশ ফিরে যাবে তার গণতান্ত্রিক আবহে। যার নেতৃত্ব দেবে শহীদ জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে দলটির জন্য থাকল অফুরন্ত শুভকামনা।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি
সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল

বিএনপি’র প্রতিষ্ঠা ও আজকের রাজনীতি

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল





১৯৭১ সালে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে আমাদের। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে পারেনি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। মেজর জিয়া যখন স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন নিজেকে এবং তাঁর পরিবারকে চরম বিপদের ঝুঁকিতে ফেলে; তখন আওয়ামী নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ আর পলায়নে ব্যস্ত। কেউবা বিমানে পাকিস্তানের পথে, কেউবা মেহেরপুরের গন্তব্যে আর তরুণ নেতৃত্ব বুড়িগঙ্গার ওপারে মোস্তফা মহসিন মন্টু’র বাসায় বেতারে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা শুনছেন। অন্য দিকে সারাদেশে নিরস্ত্র মানুষের লাশের স্তূপ জমছে- দেশের সকল প্রান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে। সংগঠিত হয়ে এদেশের মুক্তিকামী তরুণেরা গেরিলা যুদ্ধের পাল্টা চোরাগোপ্তা আক্রমণ নিয়ে মাঠে আসতে আসতে মে-জুন অব্দি গড়িয়েছে, যদিও সেই তরুণদের মাঝে আওয়ামী বা ছাত্রলীগ-যুবলীগ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ছিল নিছকই অপচেষ্টা। তারা তখন জেনারেল উবান-এর ‘ডিম তত্ত্ব’ বাস্তবায়নে নৈনিতাল- দেরাদুনের নাতিশীতোষ্ণ পাহাড়ে মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণরত। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে যুদ্ধ করেছে দেশের সাধারণ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এরাই। তারপরেও সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র স্বাধীনতার আকর্ষণে দেশের মানুষের অবিশ্বাস্য ঐক্য সম্ভব করেছে ডিসেম্বরের বিজয়। যদিও এ দেশের মাটিতে জন্ম নেয়া একদল সকল সুযোগ থাকার পরেও মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে স্বাধীনতা বিরোধী আর রাজাকার-আলবদর হওয়ার কালিমা মেনে নিয়েছে স্বেচ্ছায়।

ডিসেম্বরে বিজয়ের মুহূর্তে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঐক্যকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলো আওয়ামী নেতৃত্ব। তারা উড়ে এসে হঠাৎই স্বাধীনতার একমাত্র দাবীদার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালেন। বিজয়ের শুরুতেই এলো বিভক্তি। এমন স্বাধীনতা চাইনি বলে আওয়ামী লীগেরই একাংশ বিভক্তিতে গড়লো ‘জাসদ’। আব্দুর রব আর শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে- আওয়ামী লীগের তথাকথিত ‘মাস্টার মাইন্ড’ সিরাজুল আলম খান নতুনভাবে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হয়ে আবির্ভূত হলেন এই বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহীদের পক্ষে। 

অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা হবার দূর্লভ  সুযোগ হারালেন শেখ মুজিব। একবার রাষ্ট্রপতি, আরেকবার প্রধানমন্ত্রী, তারপর আবারও রাষ্ট্রপতি পদের সাথে যুক্ত হতে থাকলো তার নাম। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন এক চরম নৈরাজ্যের অভয়ারণ্য, দেশের মানুষ পাকিস্তানিদের ফুটন্ত কড়াই থেকে আওয়ামী লীগের জ্বলন্ত আগুনে পতিত হলো। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, অভাব আর দুর্ভিক্ষ, রাস্তায় রাস্তায় অনাহারে মৃতদের লাশের স্তূপ। জনতাকে স্তব্ধ করতে মাঠে নামলো কুখ্যাত ‘রক্ষী বাহিনী’ নামের এক আতঙ্ক। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অসহিষ্ণু সরকার কোনো প্রতিবাদই সহ্য করতে পারছিল না, ভিয়েতনামে যুদ্ধ অবসানের দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলিতে নিহত হলো দু’জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে জাসদের মিছিল পরিণত হলো লাশের মিছিলে। অরাজকতার কফিনে শেষ পেরেক হয়ে এলো ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে এক দলীয় ‘বাকশাল’। নিষিদ্ধ হলো সকল রাজনৈতিক দল, কন্ঠরোধ হলো সংবাদপত্রের, বিনা জবাবদিহিতায় সংসদের মেয়াদ বেড়ে গেল পাঁচ বছর। অবশ্য এর আগে ’৭৩-এ সংসদ নির্বাচনে ব্যালট চুরির মহোৎসব দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দেশবাসীর। 

এলো আগস্ট ১৯৭৫, সপরিবারে নিহত হলেন শেখ মুজিব, ক্ষমতায় এলো তারই বিশ্বস্ত সহযোগী খন্দকার মুশতাক, সংসদের স্পিকার মালেক উকিল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন- “দেশ ফেরাউন মুক্ত হয়েছে”। ইতিহাস আসলেই বড় নির্মম। 

আগস্ট পরবর্তীতে বিশৃংখল সেনাবাহিনীতে তখন অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল নিত্য সঙ্গী। দেশপ্রেমিক সাধারণ সৈনিক এমন অরাজকতার মাঝে ঘটালো এক অভাবনীয়  বিপ্লব। ৭ নভেম্বরে সংঘটিত হলো- ঐতিহাসিক সিপাহী জনতার বিপ্লব। রাষ্ট্রের পাদ-প্রদীপে আবারও এলেন জিয়াউর রহমান জাতির মুক্তির দূত হয়ে। দায়িত্ব পালনের সংক্ষিপ্ত সময়ের মাঝেই ঘটালেন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। দুর্ভিক্ষের বাংলাদেশ পরিণত হলো- খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে, মুক্ত হল অবরুদ্ধ সংবাদপত্র, অবারিত হলো রাজনৈতিক চর্চা। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল- এমন একটি রাজনৈতিক দলের যাঁরা যার আদর্শে হবে উদার মধ্যপন্থী, দৃঢ় থাকবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, মর্যাদা দেবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে, ঐক্যবদ্ধ করবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সকল মানুষকে, মর্যাদা দেবে নারীদের, কর্মসংস্থান করবে যুবকদের, সমমর্যাদার সম্পর্ক থাকবে সকল রাষ্ট্রের সাথে, অগ্রাধিকার পাবে যোগ্যতা আর দেশপ্রেম, শূন্য সহনশীলতা থাকবে অনিয়ম আর দুর্নীতির প্রশ্নে। জিয়া জণ-প্রত্যাশাকে অসম্মান করেননি, গড়েছেন তাদেরই প্রত্যাশার রাজনৈতিক দল “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি”। ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরায় ঐতিহাসিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী দল হিসেবে। যে দল সকল মতাদর্শের মানুষকে ধারণ করতে পারে। তিনি শুধু বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেননি, একই সাথে শেখ মুজিবের হাতে মৃত আওয়ামী লীগেরও পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তারপর ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বিএনপি’র নেতৃত্বে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, সকল ক্ষেত্রেই এসেছে অপ্রত্যাশিত সাফল্য, প্রবর্তিত হয়েছে স্বাধীনতা-একুশে পদক। নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, তারপরেও মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র দাবীদার হয়ে ওঠেনি। যেমনভাবে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করেও বিএনপি এ দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে ব্লাক মেইলিং-এর সস্তা পথে হাঁটেনি। জিয়া শহীদের মর্যাদায় প্রয়াত হয়েছেন, জনগণ তাকে অন্তিম বিদায় জানিয়েছে সর্ববৃহৎ জানাযার মাধ্যমে ।

পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া দলের দায়িত্ব নিয়েছেন এক কঠিন সময়ে- দলকে করেছেন সুসংহত, স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন সম্মুখ নেতৃত্বে, আপোষহীন ইমেজে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, সকল আসনেই বিজয়ী হবার এক অনন্য রেকর্ড গড়েছেন, শিকার হয়েছেন এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের, কারাবরণ করেছেন মিথ্যা মামলায়, নির্জন কারাগারে আক্রান্ত হয়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তারপরেও পরম সহিষ্ণুতা আর সংযম তাকে আজ দেশনেত্রীর চাইতেও উচ্চতর আসনে বসিয়েছে। আজ তিনি কোন দলের নন, আজ তিনি এই দেশের সবচাইতে সম্মানিত ব্যক্তি। সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে দেশের মানুষের বিশ্বাস আর আস্থার অভিভাবক।

কারারুদ্ধ হবার পর বিএনপি’র শীর্ষ দায়িত্বে আসেন জনাব তারেক রহমান, এক-এগারোর ষড়যন্ত্রকারীদের রোষানলে নির্যাতনের তীব্রতায় প্রায় পঙ্গুত্বকে জয় করে আট হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও দলকে পরিচালিত করেছেন পরম দক্ষতায়। যার ফলশ্রুতিতে গত সতের বছরের নির্যাতন, হত্যা, গুম, জেল-জুলুম, মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়েও লক্ষ কোটি নেতা-কর্মী সমর্থকেরা পরিচয় দিয়েছেন এক অবিশ্বাস্য ঐক্য আর আনুগত্যের। শত নির্যাতনেও তারা ছিলেন- অনড়, একজনও আদর্শচ্যুত হয়ে দলত্যাগ করেননি, সতের বছর ধরে উত্তপ্ত প্রতিবাদের লাভা মহা-বিস্ফোরণে উদগিরিত হয়েছে চব্বিশের আগস্টে, এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ।

আজ আমরা এক নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে দেশের মালিকানা দেশের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেবার অপার সম্ভাবনার অপেক্ষায়, ফেব্রুয়ারি ২০২৬ অপেক্ষমান জাতির সামনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই প্রত্যাশার মেঘমুক্ত নীল আকাশে ভীতির মেঘের ইতস্তত আনাগোনা শংকিত করছে দেশের মানুষকে। অর্থহীন পি.আর পদ্ধতির অবাস্তব দাবী তুলে জামায়াতে ইসলামী যেমন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ করছে, ঠিক তেমনি আরেক পক্ষ অপ্রয়োজনীয় গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলে গণতন্ত্রের পথযাত্রাকে অনিশ্চিত করার প্রেক্ষাপট রচনা করছে। সাধারণ মানুষ এসবের কোনটাই পছন্দ করছে না। 

গত কয়েক মাস ধরে ঐক্যমত কমিশনের এতো দীর্ঘ আলোচনার পর এমন বিভক্তি সাধারণ মানুষকে শুধু বিরক্তই করছে মাত্র। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে এমন বিভক্তি কেনো মেনে নেবে সাধারণ মানুষ? তাদের চাওয়া একটাই, দেশের মালিকানা সাধারণ মানুষের কাছে ফেরত দিতে হবে, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচিত করতে চায়, কারণ তারা জানে দীর্ঘ মেয়াদের অনির্বাচিত সরকার যে-কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সম্মানজনক নয়, তারা এটাও জানে আগামী ফেব্রুয়ারিতে গণতন্ত্রে উত্তরণ কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে আবারও অনিশ্চিত সময়ের জন্য এদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদের বন্দীতে অবরুদ্ধ  হবে।

এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর বোধোদয় অপরিহার্য। গুটিকয়েক উচ্চাভিলাসী প্রজ্ঞাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হঠকারিতায় দেশের ১৮ কোটি মানুষ আবারো কারারুদ্ধ আর বাকরুদ্ধ হবেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি কেনো মেনে নেবে সাধারণ মানুষ?

তারা কি এই সরল সত্যটা বোঝেন না যে, পলাতক স্বৈরাচার এখনো পরাজয় মেনে নেয়নি, এখনো অনুতপ্ত নয় তারা, দেশের মধ্যে থাকা তাদের অবিবেচক আর অন্ধ অনুসারীরা এখনো সুযোগের সন্ধানে। তারা কি বোঝেন না যে- পি.আর পদ্ধতির নামের এই বিভক্তি আর গণ-পরিষদের দাবিতে বিপরীত অবস্থানের অনৈক্যের সুরে পাশের দেশে লুকিয়ে থাকা স্বৈরাচারের মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে!  তারা কি বোঝেন না ভিপি নূর রক্তাক্ত হলে কিংবা যমুনামুখী ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রদের মিছিল অবরুদ্ধ হলে সেই হাসি অকর্ন বিস্তৃত হয়। তারা কি বোঝেন না এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন আস্ফালন করে বলে, ফেব্রুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করা হবে, তারা যখন নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান- তখন স্বৈরাচারের হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হয়? 

প্রবাদ আছে ‘নিজের নাক কেটেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার’। আপনারা নিজেদের নাক কাটুন সমস্যা নেই, কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার গণতন্ত্রে উত্তরণের সুবর্ণ সুযোগ আগামীর নির্বাচনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করুন, দয়া করে গনতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রা ভঙ্গ করবেন না। একজন চিকিৎসকের ভুলে একজন রোগীর মৃত্যু হতে পারে, একজন প্রকৌশলীর ভুলে একাধিক মানুষের প্রাণ যেতে পারে, একজন পাইলটের ভুলে শত মানুষের মৃত্যু হতে পারে কিন্তু  একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভুলে ১৮ কোটি মানুষের অধিকারের মৃত্যু হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রের ভবিষ্যৎ কতো দীর্ঘ সময় মহাকাশের কালো গহ্বরের আড়ালে অন্তরীণ হয়ে থাকবে, সেটা হঠকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেটা দূর্বোধ্য নয়। আর তেমন হলে ইতিহাস তাদের কি পরিনতি নির্ধারণ করবে সেটা ইতিহাসের জন্য তোলা থাক কিন্তু জনগনের শিক্ষা কেমন হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য দিকে রাজনৈতিক দল গুলোর সামনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে এক মহিমান্বিত গনতান্ত্রিক উত্তরণে মহানায়ক হবার দূর্লভ সুযোগ। এখন  সিদ্ধান্ত আপনাদেরই নিতে হবে,  আগামীতে তারা মহানায়ক হিসাবে নন্দিত হবেন, নাকি আস্তাকুঁড়ের আবর্জনায় নিন্দিত হবেন।

লেখক : অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল

Monday, August 11, 2025

আরাফাত রহমান কোকো: এক নিভৃতচারী অমর ক্রীড়াশিল্পী

 



আরাফাত রহমান কোকো। পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। বাবার কর্মস্থল কুমিল্লায়। জন্মের পরপরই আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধে চলে যান বাবা। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। একটি স্বাধীন দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধকালে মা ও বড়ভাই তারেক রহমানের সাথে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তার শৈশবের আখ্যান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তার জীবনের অন্যতম বড় ট্রাজেডি হলেও সেগুলো বিস্মৃতি হয়ে যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি বন্দিত্ব কিংবা মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ ও দেশের মানুষ তার একান্তই আপন। একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন আর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তাইতো নিভৃতচারী কোকো বেছে নিয়েছিলেন ক্রিড়া জগতকে। একজন রাজপুত্র, যিনি কিনা চাইলেই ক্ষমতার ভেতর থেকে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাষ্ট্র সংস্কারের পথ। দেশের ক্রিড়াঙ্গণকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রীড়াশিল্পীর মতো। 

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জীবনটা ছিলো বৈচিত্রময়। তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে যখন মুক্তি পান তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের সময় তার বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন এবং আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনো তিনি মাত্র ছয় বছরের শিশু! এমনকী ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন তখন আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ১১ বছরের কিশোর! এই অল্প সময়ের মধ্যে কোকোর জীবনে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই বিয়োগান্তক। যার তার মনোজগতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। যদিও তিনি এসবের কিছুই সেভাবে কখনোই প্রকাশ করেনি। 

অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ই জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান ঘটে।

আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচার বিমুখ। কোকো ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালীন ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে কাজ করে স্থাপন করেন অনন্য নজির।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কোকো ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মতো বিনয়! এ ধরনের বিনয় তার পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ্য করা যায়।

যেমন ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারতো। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন তিনি। কিন্তু কোকো তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমুলে বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। তিনি কখনো তার অধিকারের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাই পারফরমেন্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির পাইপলাইনের সূচনা হয় তার হাত দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপ লাইন তৈরি হয়েছিল এই ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। যার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।

আবহাওয়াজনিত কারনে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এইসময় অলস বসে থাকতেন। এই সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নেন কোকো। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এছাড়া ক্ষমতা থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন। 

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকেরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।

২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর ক্যারিশম্যাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও একদিনে পনেরটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন, নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক। 

এক এগারোর পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তার ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। 


গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহ’র মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন। একজন প্রচার বিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিলো। পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিলো বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সকল ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এই অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান