Search

Tuesday, December 30, 2025

খালেদা জিয়া: গৃহবধূ থেকে এক দৃঢ়চেতা নেত্রী

 

খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবধূ। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সাত মাস পর এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের কম সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। প্রায় ৪৩ বছর তাঁর রাজনৈতিক জীবন।

গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী নেত্রী। তিনি বিপদে-দুর্যোগে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। আর শেষ জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন জাতির ‘ঐক্যের প্রতীক’।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে নিহত হন। নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রে বিএনপি পড়ে যায় অথই সাগরে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। খালেদা জিয়া প্রথমে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর শেষে চেয়ারপারসন হন। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশের নিচে। শুরু হয় নতুন নেতৃত্বে বিএনপির পথচলা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মূলত স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন খালেদা জিয়াকে একটি শক্ত ভিত্তি ও ব্যক্তিত্ব গড়ে দেয়। পরবর্তী সময় তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে সমর্থ হন।

আন্দোলন-সংগ্রাম, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, শেষ জীবনে এসে তিনি দল-মতনির্বিশেষে সবার কাছে সম্মান ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ৭ আগস্ট রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির এক সমাবেশে খালেদা জিয়া একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও বক্তব্য দেন। গণ-অভ্যুত্থানে তরুণদের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসুন, ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’

আপসহীন নেত্রী
১৯৮২ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৩ সালে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নামেন খালেদা জিয়া। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭–দলীয় ঐক্যজোট। রাজনৈতিক গবেষকেরা বলছেন, মূলত তাঁর নেতৃত্বই এরশাদের পতনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলনে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’র পরিচিতি পান।

’৯০-এর গণ-আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়া দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। পরে আরও দুবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন খালেদা জিয়ার মাধ্যমেই হয়েছিল।
এ বিষয়ে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘খালেদা’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাস্তবিক অর্থে তিনি ছিলেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এই কৃতিত্ব কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’

গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে এভাবে জায়গা করে নেওয়া, মুসলিমপ্রধান একটি দেশে একজন নারীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টিকে একটু ভিন্ন চোখে মূল্যায়ন করেছেন প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। ‘বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’ বইয়ের ভূমিকায় মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) এমন একটি সময়ে স্বকীয় রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছেন, যখন পুরুষশাসিত সমাজের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।’

ঐক্য ও সমঝোতা

দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে এসেছেন এমন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, তাঁর চরিত্রের বড় একটি দিক হলো তিনি পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। নিজে কম বলতেন, শুনতেন বেশি। তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিক ছিল বৃহত্তর স্বার্থে অন্য রাজনৈতিক দল-মতের সঙ্গে সমঝোতার প্রচেষ্টা। দেখা গেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার চর্চায় তিনি দলীয় আদর্শের বিপরীতে গিয়ে কারও কারও সঙ্গে ‘সন্ধি’ করেছেন। সমঝোতা করে একসঙ্গে চলেছেন রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতরে কিংবা বাইরে থেকে।

আন্দোলন-সংগ্রামে খালেদা জিয়াকে আপসহীন ভূমিকায় দেখা গেলেও রাজনীতিতে ‘সংলাপ-সমঝোতার’ চিন্তাকে তিনি কখনো একেবারে নাকচ করে দেননি। প্রয়োজনে তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারতেন। যেমন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়। এর সঙ্গে প্রথমে একমত ছিল না বিএনপি। পরবর্তী সময় জনদাবি মেনে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করেন।

খালেদা জিয়ার সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক ও গবেষকেরা বলছেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ, পরবর্তী সময় জেল-জুলুম-নিগ্রহ, শেষ সময়ে অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সম্মান—সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন, যা তাঁকে ‘ঐক্যের প্রতীক’ করে তুলেছিল। আর রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র বিনির্মাণ, জনপ্রত্যাশা পূরণ, প্রশাসনে সফল নেতৃত্ব, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, বৈদেশিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া ছিলেন একজন পরিস্থিতিবোদ্ধা নেতা। তিনি প্রয়োজন হলে নিজের ক্ষমতাকেও সীমাবদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
‘বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লিখেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন ব্যক্তি নন, নিজ কর্মগুণে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। হয়ে উঠেছেন জীবন–ইতিহাস। তবে বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে গবেষণালব্ধ আলোচনা কমই হয়েছে।’

জোটের রাজনীতি

বাংলাদেশে জোটভিত্তিক গণ-আন্দোলনের রাজনীতির যে প্রচলন, তার সফল পরিণতি হয় ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮–দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭–দলীয় জোট ও বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে ৫–দলীয় জোট রাজপথে সমন্বিত ভূমিকা পালন করে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৭–দলীয় ঐক্যজোটের নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ’৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি হেরে যায়। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে নিয়ে ৪–দলীয় জোট গঠন করেন খালেদা জিয়া। একপর্যায়ে এই জোট থেকে এরশাদের জাতীয় পার্টি বের হয়ে যায়। তবে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ জোটে থেকে যায়। এই জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু এই জোট সরকারের বিদায় সুখকর ছিল না।

নানা ঘটনাপ্রবাহে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। বিএনপি বিরোধী দলে বসে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে ৪–দলীয় জোট ১৮-দলীয় জোট হয়। পরে তা ২০–দলীয় জোটে রূপ নেয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হওয়ার আগপর্যন্ত খালেদা জিয়া এই জোটের নেতৃত্ব দেন।

দেশের স্বার্থে সমমনা বা বিপরীত মতাদর্শের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে কার্পণ্য ছিল না খালেদা জিয়ার। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৭–দলীয়, ৪–দলীয়, পরবর্তী সময় ২০–দলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন, যা দেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে আছে।

এ বিষয়ে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘খালেদা’ গ্রন্থে লিখেছেন, গৃহবধূ থেকে তিনি (খালেদা জিয়া) পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতার চর্চায় তিনি আদর্শের বিপরীতে গিয়ে কারও কারও সঙ্গে সন্ধি করেছেন।
১৯৯৪-৯৫ সালে নির্বাচনকালীন সংকটের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন খালেদা জিয়া। ২০০৬ সালে নির্বাচন কমিশন সংস্কার নিয়ে প্রধান দুই দলের বৈঠক হয়। ২০১৩ সালে জাতীয় সংকটের সময় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় দুই দলের সংলাপে বিএনপি অংশ নেয়। যদিও এসব প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি। তবু এগুলো খালেদা জিয়ার ‘সমঝোতামুখী’ রাজনৈতিক অবস্থানের প্রমাণ বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।

চরম সংকটেও অটল

খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের ওপর বড় ঝড় আসে ২০০৭ সালের এক-এগারোর পর। সে সময় সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় বিএনপিকে ভাঙার, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নানা চেষ্টা করা হয়।

এমন একটি পটভূমিতে ২০০৭ সালে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল যে খালেদা জিয়া দেশত্যাগ করবেন, সৌদি আরবে যাবেন। এর আগে ৮ মার্চ তারেক রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি মুষড়ে পড়েন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে গা ঢাকা দেন। ২২ এপ্রিল রাতে বিএনপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার আ স ম হান্নান শাহ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে খালেদা জিয়া সৌদি আরবে যাবে না। তিনি যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত, তবু দেশ ছাড়বেন না।

পরে খালেদা জিয়া নিজেই বলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নাই, এটাই (বাংলাদেশ) আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু। কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।’
সেনা–সমর্থিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ একটি দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন আরাফাত রহমান কোকো। একই দিন গ্রেপ্তার করা হয় খালেদা জিয়াকে। পরে তারেক রহমানকে লন্ডনে আর আরাফাত রহমানকে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকাকালে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি রাজি হননি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই বাড়িতে তিনি ২৮ বছর ধরে বসবাস করছিলেন। খালেদা জিয়া ওঠেন গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য়। ২০১৩ সালে তুমুল আন্দোলন দানা বাঁধলে এই বাসার সামনে রাস্তার ওপরে ব্যারিকেড দিয়ে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ২০১৫ সালে আবার আন্দোলন দানা বাঁধলে খালেদা জিয়াকে গুলশানের কার্যালয়ের সামনের সড়কে ১৪টি ট্রাক ও ভ্যান দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল।
এই ঘটনাগুলো খালেদা জিয়ার জীবনে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান মারা যান। তখন খালেদা জিয়া তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ।

তবু চরম সংকটের সময়েও খালেদা জিয়া আস্থা রেখেছিলেন দেশবাসীর ওপর। ওই সময় ঘটনাগুলোর উল্লেখ করে খালেদা জিয়া এক আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কম বয়সে স্বামী (জিয়াউর রহমান) হারিয়েছি। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে [তৈয়বা (মজুমদার) বেগম] হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি একটি সন্তান (আরাফাত রহমান) হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান (তারেক রহমান) নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে দূরদেশে এখনো চিকিৎসাধীন। আমার এই স্বজনহীন জীবনেও দেশবাসীই আমার স্বজন।’
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘হাসিনা সরকারের আমলে খালেদা জিয়া অনেকবার জনবিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হয়েছেন। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি ধৈর্য হারাননি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল তার। এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

রাজনৈতিক কর্মীরা বলছেন, খালেদা জিয়ার চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর আপসহীন ভাবমূর্তি। তাঁকে কখনো আপস করতে দেখা যায়নি। রাজনীতিতে তিনি একটি মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছেন।

লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘খালেদা’ গ্রন্থে খালেদা জিয়া সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একজনের রাজনীতির সাফল্য প্রধানত নির্ভর করে ওই ব্যক্তি তার চূড়ায় উঠতে পেরেছেন কি না। কিন্তু ক্ষমতার কাঠামোর চূড়ায় তিনি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এটা তাঁর গুণ বলা যেতে পারে। রূপ আর গুণের এই রাজজোটক পৃথিবীতে খুব কম আছে। রূপ কথায় আছে অনেক।...তিনি অবশ্যই একজন সফল রাজনীতিবিদ।’

বিভেদ নয়, বিশ্বাস করি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের রাজনীতিতে




২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, খালেদা জিয়া তখন বিরোধীদলীয় নেতা, ওই সময় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিভেদ-বিভ্রান্তির রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁর বিশ্বাস উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের রাজনীতিতে। সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালের মার্চে। রাজপথে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পর রাষ্ট্রক্ষমতায়ও আসীন হওয়া খালেদা জিয়াকে বুঝতে সেই সাক্ষাৎকার প্রাসঙ্গিক এখনো। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রয়াণে সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


মতিউর রহমান: আপনারা বলেন না কেন যে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চাই, শান্তিপূর্ণ জমায়েত চাই। বোমা, ভাঙচুর, সন্ত্রাস—যেগুলো মানুষের ক্ষতি করে, সেগুলো আপনারা করবেন না।


খালেদা জিয়া : আমরা সব সময় বলেছি যে আমাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, ৭ নভেম্বর (১৯৯৯ সালে, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়) আমাদের যে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হয়েছিল, তাতে হামলা চালানো হলো, বোমা-টিয়ারগ্যাস মারা হলো। তারপর সচিবালয়ের সামনে আমরা বলেই দিয়েছিলাম যে আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেব। শান্তিপূর্ণভাবেই সেখানে সমাবেশ হচ্ছিল। দলের নেত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় দলের কোনো নেতা-কর্মী নিশ্চয়ই চাইবে না যে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাক, নেত্রীর বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাক বা নেত্রী বক্তব্য দিতে না পারুন। আমি বক্তব্য দেওয়ার সময় ছাদের ওপর থেকে বোমা, গুলি, টিয়ারগ্যাস মারা হলো। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপরও সরকার আক্রমণ শুরু করল।


আমরা যে গণমিছিল করেছিলাম, বলা হচ্ছে, সেই গণমিছিল থেকে জনকণ্ঠ অফিসে হামলা করা হয়েছে। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছি। কখনোই কোনো পত্রিকা অফিসে হামলা করা হবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না এবং আমরা তা করিওনি। বিশাল গণমিছিল দেখে সরকার ভীত হয়ে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।


গত ১৩ ফেব্রুয়ারি (২০০০ সালের) চার দল, সাত দলসহ পেশাজীবীদের নিয়ে যে গণমিছিল হলো, সেটিও ছিল বিশাল, তার ওপরও সরকার পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে। আমাদের কর্মসূচি যতই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হোক না কেন, তার ওপরই সরকার এখন আঘাত হানছে, হামলা করছে।



মতিউর রহমান: আমি আবার আপনাদের ঐক্যের কথায় ফিরে যাই। এই ঐক্য নিয়ে কিন্তু আপনার দলের নেতৃত্ব এবং কর্মী-সদস্যদের মধ্যেই হতাশা ও প্রশ্ন আছে। স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতা-কর্মীদের এই ঐক্যের ব্যাপারে অসন্তোষ আছে।


খালেদা জিয়া: আপনি যে কথাটা বলছেন, সেটা সঠিক নয়। পত্রপত্রিকায় এসব কথা লেখা হচ্ছে। কারণ, আমরা যখন যা কিছুই করি না কেন, সবার আগে চিন্তা করি দল নিয়ে। আন্দোলন বলেন, নির্বাচন বলেন, যেকোনো কর্মসূচিতেই আগে দলকে সম্পৃক্ত করতে হয়। আজ দেশের যে অবস্থা, তাতে সকলেই বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করছে। কিন্তু আমরা মনে করি, আন্দোলনকে সত্যিকারভাবে জোরদার করতে হলে এবং যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যেতে হলে ঐক্যটা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। সে জন্য যার যার অবস্থানে থেকে আন্দোলন না করে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার জন্য ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। পার্টিতে সকলে আলোচনা করেই আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজেই এ কথাটা সঠিক নয় যে এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে বা তাঁরা ব্যাপারটি পছন্দ করেননি বা ক্ষুব্ধ।


মতিউর রহমান: মানুষ তো এটা দেখে যে আপনি এরশাদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন। এখন কত মিটিং-মিছিল করছেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে আপনি একসময় কত বক্তৃতা দিয়েছেন। আপনি তাঁকে হত্যাকারী বলেছেন, তাঁকে পাঁচ বছর জেলে আটকে রেখেছেন। আবার তাঁর সঙ্গেই এখন ঐক্য করলেন?


খালেদা জিয়া: কথা হলো, কখন আমি ঐক্য করেছি। তারা এখন বিরোধী দল। আমরা কথাগুলো আজ বলছি। সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। সংসদে আমাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন হওয়ার পথে, মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই, দেশে সন্ত্রাস বিরাজ করছে। দেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় তারা সকলে আন্দোলন করছে, একটা অবস্থান নিয়েছে। তারাও সংসদে আছে। বিরোধী দলের নেত্রী কথাটা বলা হলে সংসদের বিরোধী দল হিসেবে তারাও নিশ্চয়ই এসে পড়ে। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তো আমার একটা ভূমিকা রয়েছে, একটা দায়িত্ব রয়েছে। সে জন্যই এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও জোরদার করার জন্য তারা যদি আমাদের সঙ্গে আসতে চায় এবং আমরা যেসব ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছি তারাও যদি সেসব নিয়ে আন্দোলন করতে চায়, তাহলে তাদের সঙ্গে রাখা আমরা প্রয়োজন মনে করেছি।


মতিউর রহমান: একই কৌশল তো আওয়ামী লীগও নিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। আপনারাও অনেক সমালোচনা করেছেন। এখন কী বলবেন?


খালেদা জিয়া: আমাদের সময় আর তাদের সময়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের সময় যে ইস্যুগুলো এসেছে, সে ইস্যুগুলো তখন ছিল না। আমাদের সময় দেশের উন্নয়ন হচ্ছিল, দেশের অর্থনীতি ভালো ছিল, দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া হচ্ছিল। শিক্ষার ওপর আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলাম। বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। আমাদের সময় স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করেছিলাম, আইনশৃঙ্খলা ভালো ছিল, নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা হয়েছিল, উৎপাদন বাড়ছিল, বাড়ছিল রাজস্ব আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো ছিল; মোট কথা দেশের সবকিছু সুন্দর ছিল। বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য কোনো ইস্যু না পেয়ে আওয়ামী লীগ তখন শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে মাঠে নামল। সে জন্যই বর্তমান অবস্থা আর তখনকার অবস্থা এক নয়।


মতিউর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো আপনি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলেন।


খালেদা জিয়া: মেনেছি, যেহেতু আমরা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাই, যেহেতু উন্নয়নের যে ধারা আমরা শুরু করেছি, যেভাবে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি, তা আমরা ব্যাহত বা বিনষ্ট হয়ে যেতে দিতে চাইনি। কিন্তু আমরা বলেছি, সেটি হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। তারা বলেছিল হুট করে দিয়ে দিতে। আমরা বলেছি, সেটা তো সংবিধানে নেই, আমরা সেটা করতে পারি না। এ জন্য তাদের বলেছি, সংসদে আসুন, আলোচনা করুন। আলোচনার মাধ্যমে সময়মতো সে জিনিসটা হবে। কিন্তু তারা হঠাৎ সংসদ থেকে চলে গেলেন। একসময় সংসদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন, যে জন্য সেটা করা যায়নি। আমরা আমাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই সেটা করেছি এবং আমরা সংবিধানকে সংশোধন করেই সেটা করেছি।


মতিউর রহমান: জামায়াতের সঙ্গেও আপনাদের আগে সমঝোতা ছিল, মাঝে ছিল না। আবার তাদের সঙ্গে ঐক্য করলেন। আপনিই কিন্তু তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বলে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন।


খালেদা জিয়া: জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই জাতীয় সংসদে আসে। তখন তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা এবং একটা যোগাযোগ ছিল। আওয়ামী লীগ তখন ছিল বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল এবং সে সম্পর্ক আমরা চেয়েছি। আমরা একত্রে সংবিধান সংশোধন করেছি। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা এত দিন আন্দোলন করেছি, সংগ্রাম করেছি, তা আরো শক্তিশালী করার জন্য আমরা সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি।


মতিউর রহমান: আওয়ামী লীগও বলত, যারা সংসদের ভেতরে, তাদের নিয়ে ঐক্য করেছিল। তারপরও আপনারা অনেক সমালোচনা করেছিলেন।


খালেদা জিয়া: আওয়ামী লীগ সংসদে তাদের নিয়ে যে ঐক্য করেছিল, তার তো কোনো ইস্যু ছিল না। তাদের ইস্যু ছিল বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে এবং ক্ষমতায় যেতে হবে। সে জন্যই তারা জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্য করেছিল।


মতিউর রহমান: দেশে বিএনপির একটা শক্তিশালী অবস্থান আছে। এই ঐক্য না করে আপনারা একক থাকলে এবং একটা মধ্যপন্থী দল হিসেবে দাঁড়ালে তো আপনারা আরও এগোতে পারতেন—এটা কি আপনার মনে হয় কখনো? আপনি যেটা আশির দশকে করতেন, একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমঞ্চে যাননি, আবার অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও ঐক্য করেননি, এক প্ল্যাটফর্মে যাননি, এককভাবে আন্দোলন করেছেন বা চলেছেন। বিএনপি একটা মধ্যপন্থী দল হিসেবে থাকতে পারলে কি সেটা দলের ভালো হতো না?

খালেদা জিয়া: বিএনপি কিন্তু নিজের অবস্থানেই আছে। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সরিনি। আমি আগেই বলেছি যে আমরা এককভাবেই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আমরা আন্দোলন শুরু করার পর তারাও তাদের অবস্থান থেকে আন্দোলন শুরু করল। আমরা দেখলাম, আমাদের ইস্যুগুলো নিয়েই তারা সকলে আন্দোলন করছে এবং জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। তারা বলছে, আমরা বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে আপনার সঙ্গে এক হয়ে আন্দোলন করতে চাই। আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন হচ্ছে, বিভিন্ন দল আন্দোলন করছে, দেশের মানুষও সেটি চায়, আন্দোলনই যখন হচ্ছে, তখন সে আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ হলে সফলতা আরও তাড়াতাড়ি আসবে এবং আন্দোলনের গতি আরও বাড়বে।


মতিউর রহমান: আশির দশকের মতো যুগপৎ আন্দোলন করতে পারতেন।

খালেদা জিয়া: হ্যাঁ, যুগপৎ আন্দোলন হতে পারত। আমরা তো সেভাবে শুরু করতে করতেই আজ এ পর্যায়ে এসেছি।


মতিউর রহমান: প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হরতাল নিয়ে আপনিও অনেক কথা বলেছেন। আমাদের মনে আছে, বিরোধী নেত্রী হিসেবেও চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক আলোচনায় আপনি বলেছেন, সরকার যদি বলে যে তারা বিরোধী দলে গেলে হরতাল করবে না, তাহলে আমরাও তা বিবেচনা করব। পরে প্রধানমন্ত্রীও সম্পাদকদের সামনে বলেছেন, ‘ঠিক আছে, আমরা বিরোধী দলে গেলে হরতাল করব না।’ তখন আপনি বললেন যে না, এটা হবে না। লোকে মনে করল, যেকোনো উপায়ে সরকারের উৎখাতই আপনার লক্ষ্য।

খালেদা জিয়া: আমি সব সময় বলেছি। আমি যখন সরকারে ছিলাম তখনো হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আমি বিরোধী দলে থেকে হরতাল করছি। তারপরও আমি বলছি, হরতাল করাটা দেশের জন্য, অন্ততপক্ষে দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক নয়। আমরা হরতাল করতে চাই না। কিন্তু আমরা কখন হরতাল করছি? যখন নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলো পালন করতে পারছি না। আমি একসময় বলেছিলাম, কিন্তু সরকার সে সময় সাড়া দেয়নি। আমিই প্রথম গার্মেন্টস শিল্পকে হরতালের আওতার বাইরে রাখা শুরু করেছি। আমাদের সময় আওয়ামী লীগ যখন হরতাল করেছে, তখন গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের কাছে গিয়েছিল অন্তত গার্মেন্টস শিল্পকে হরতালের আওতার বাইরে রাখার জন্য। তারা সেটাও করেনি, কিন্তু আমি করেছি। এখন তারা চাপে পড়ে বলতে বাধ্য হচ্ছে, হরতাল করব না। তাদের বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তারা অতীতে বহু কথাই বলেছে কিন্তু কোনোটাই রাখেনি।


মতিউর রহমান: সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথই কি এখন নেই? এই যে বিভেদ, সংঘাত-এর থেকে বের হয়ে আসার কোনো চেষ্টা কি হতে পারে না? বাইরের কেউ সে চেষ্টা করতে পারেন কি না? এ সম্পর্কে আপনার কোনো প্রস্তাব আছে? যেমন ধরুন, আপনি যদি বলেন, ঠিক আছে, সুশীল সমাজ এটা করতে পারে, বা বুদ্ধিজীবীরা এটা করতে পারেন, এমন কিছু আছে কি না যা করা যায়, বা কোনো পথ আছে কি না যেটা খুঁজে দেখা যায়?

খালেদা জিয়া: সমস্যা তো সৃষ্টি করেছে সরকার। যে সমস্যাগুলো হয়েছে, যার জন্য আমাদের মধ্যে এত দূরত্ব বেড়েছে, সেই দূরত্ব কমিয়ে আনার দায়িত্ব তো সরকারে যে আছে তারই। সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু সরকার সে উদ্যোগ নিচ্ছে না এবং তাতে তাদের কোনো আগ্রহও নেই। সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না আগ্রহ প্রকাশ করবে, ততক্ষণ যিনিই উদ্যোগ নিন না কেন, তা কার্যকর হবে না।


মতিউর রহমান: বিরোধী দলেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে। বিরোধী দলকে কিছু বললেই বলা হয়, সরকার কিছু করল না। আপনারা তো একটা উদ্যোগ নিতে পারেন?

খালেদা জিয়া: আমরা তো উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যার জন্য দুই দফা চুক্তি হলো। সেই চুক্তিটা তো রক্ষা করা হলো না। উদ্যোগ নিয়েছিলাম বলেই তো আপনারা নতুন কর্মসূচি দেখেছেন, যা আগে কেউ করেনি, আমরা রোডমার্চ শুরু করেছিলাম। সরকার দায়িত্বহীনভাবে যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল।

আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা সেখানে যাব। যত দিন না খোলে, তত দিন আমরা ওখানে অবস্থান করব। আমরা বললাম, উত্তরাঞ্চল অচল হয়ে যাবে এবং চট্টগ্রামসহ এ অঞ্চল অচল হয়ে যাবে। তখন সরকার দেখল যে এটা বোধহয় সঠিক হবে না। বাধ্য হয়ে তারা বলল, ‘ঠিক আছে, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়, সে নিয়ে আলোচনা করি।’


উদ্যোগী না হলে তো আমরা যেতাম না। শান্তি চাই বলেই আমরা আলোচনা করেছি। আপনারা দেখেছেন, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমরা যমুনা সেতু পার হয়েছি। এরপর কী হলো, তা আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে বিবৃতি দিলেন, কোনো দায়িত্বশীল নেতা বা মন্ত্রী কি তা দিতে পারে?


মতিউর রহমান: আপনারা গঙ্গার পানিচুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করছেন এবং অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে, কিছু সমস্যা থাকলেও পানি আসছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ ও হতাহতের দৃশ্যাবলি তো বন্ধ হয়েছে।

খালেদা জিয়া: ফারাক্কার সমস্যা কিন্তু এখনই শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফারাক্কা চালু করার ব্যাপারে সম্মতি দেওয়ার পর থেকেই সমস্যাটি শুরু হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেই ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করতে হবে। শহীদ জিয়াউর রহমানের সময়ই দুই দেশের মধ্যে প্রথম একটি সম্মানজনক চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তিটিতে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যা যা থাকা দরকার, তাতে সেসব ছিল। আমরা বলেছিলাম গঙ্গার পানিবণ্টন হবে। সেই গঙ্গার পানি তখন বণ্টন হয়েছিল। সে চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর এরশাদের সময় ফারাক্কা সমস্যার আর কোনো চুক্তি হয়নি।

আমাদের সরকারের সময় এসেও অনেক চেষ্টা করেছি, অনেক আলোচনা করেছি। আপনারা তা দেখেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিনিধিদল ভারতে গেছে। আমি নিজে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসেছি। আমাদের আলোচনার প্রথম এজেন্ডাই ছিল পানিচুক্তি। পানি পাওয়ার জন্য আমরা বহু কিছুই করেছি, আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সে জিনিসটি পাইনি বলে আমাদের সঙ্গে চুক্তি হয়নি। কিন্তু পানি যে আসেনি, তা নয়। তখনো পানি আসছিল। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর কিন্তু সত্যিকার অর্থে তারা গঙ্গার পানিচুক্তি করেনি। যে চুক্তিটি হয়েছে, সেটি ফারাক্কা থেকে পানিচুক্তি হয়েছে। সে চুক্তিটিতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি।


আমরা জানি, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলাপ-আলোচনার পর সরকার-সরকার চুক্তি হয়। চুক্তির মধ্যে কিছু ক্লজ থাকতে হয়, শহীদ জিয়ার সময় যেগুলো হয়েছিল। যেমন আমরা বলেছিলাম গ্যারান্টি ক্লজ থাকবে; দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে যেকোনো সময় যেকোনো সমস্যা হতে পারে, সে জন্য সেখানে সালিসি ব্যবস্থার কথা আমরা রেখেছিলাম। আরও বিভিন্ন বিষয় থাকবে। কিন্তু এই চুক্তিতে সেগুলোর কোনোটিই নেই। এ চুক্তির সবকিছু গেছে ভারতের পক্ষে, সবকিছু ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভারত ইচ্ছা হলে আমাদের পানি দেবে, ইচ্ছা না হলে দেবে না। এখন কিন্তু আসলে আমরা পানি পাচ্ছি না বা পানি আসছে না। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়তই দেখছি, যে পানি আমাদের দেওয়ার কথা ছিল, সে পানি তারা দিচ্ছে না। ফলে নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, সেচের প্রকল্প বন্ধ হয়েছে, ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বাড়ছে, আর্সেনিক সমস্যা দেখা দিয়েছে—এমন নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সরকার তো নিজেই স্বীকার করছে যে চুক্তি অনুযায়ী পানি আমরা পাচ্ছি না। তা ছাড়া সমস্যা হলে যে দুই দেশের বসার কথা বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু ভারত বসে না। তারা সময় দিচ্ছে না। বাংলাদেশ চেষ্টা করেও ভারতকে বসাতে পারছে না।


মতিউর রহমান: আপনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সার্কের চেয়ারপারসনও ছিলেন। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নিয়ে আপনি অনেক কথা বললেন। ভারত একটা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ। এই ভৌগোলিক অবস্থান তো আমরা পরিবর্তন করতে পারব না। তাদের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান করতে হবে, আমাদের স্বার্থও দেখতে হবে, আমাদের দাবিও তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। কিন্তু অনেক সময় আপনার কিংবা আপনাদের দলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তীব্র ভারতবিরোধিতা লক্ষ করা যায়। এটা কি আপনার দলের জন্য সহায়ক? ভবিষ্যতে আপনি সরকারে গেলে এই অবস্থান রেখে কীভাবে চলবেন?

খালেদা জিয়া: আমরা তো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা ছোট হতে পারি। কিন্তু আমাদের একটা আত্মমর্যাদাবোধ রয়েছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাস করতে চাই। সে জন্য আমরা সকলের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। একটা বড় দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সমস্যাগুলো হবে, তা সমমর্যাদার ভিত্তিতে নিরসন করার জন্য আমরা কাজ করতে চাই। কিন্তু বড় দেশ বলে ভারত যা বলবে তা আমাদের মেনে নিতে হবে বা তারা জোর করে আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে, এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। যখন তারা বড় দেশ হিসেবে আমাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কিংবা আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করে, একটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হিসেবে সে অন্যায়গুলোর কথা তখন বাধ্য হয়ে আমাদের বলতে হয়। সেগুলো বলার কারণে যদি আমাদের ভারতবিরোধী মনে করেন, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।

মতিউর রহমান: প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) শেখ হাসিনা প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিএনপি ভারত-সমর্থিত দল, এটা আপনারা খুঁজে দেখতে পারেন। আবার আপনার কিংবা আপনার দলের বিরুদ্ধে একটা প্রচার আছে যে আসলে আপনারা পাকিস্তান-সমর্থিত দল।

খালেদা জিয়া: বিএনপি বাংলাদেশের জনগণ-সমর্থিত দল। বিএনপি সব সময় দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেই কাজ করছে। আমরা কারও পক্ষে-বিপক্ষে নই। আমি আগেও বলেছি, আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। শহীদ জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারও পক্ষে কিংবা কারও পকেটে থাকার জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বসবাস করার জন্য।

আমরা কারও পক্ষে না। পাকিস্তানের পক্ষেও না, ভারতের পক্ষেও না। আমরা বাংলাদেশের পক্ষে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে। বাংলাদেশের স্বার্থ, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, বাংলাদেশের উন্নয়নই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।


মতিউর রহমান: আপনাদের বিরুদ্ধে একটা বিরাট প্রচারণা হলো আপনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৈরি দল এবং সরকারে থেকে আপনাদের দল গঠন করা হয়েছে?

খালেদা জিয়া: এটা কে বলে? যারা আমাদের বিপক্ষে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে এই প্রচারণাটি চালায়। বিএনপি জনগণের দল। বাংলাদেশের জনগণকে নিয়েই দলটি গঠন করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যেমন ন্যাপ থেকেও অনেকেই এতে এসেছেন। ন্যাপ অত্যন্ত পুরোনো একটি দল, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেব একসময় এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ দেশের মানুষের স্বাধীন অধিকার এবং এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারবে এমন এক ব্যক্তি জিয়াউর রহমানকে দেশের মানুষ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করল, তখন মাওলানা ভাসানী তাঁর জীবনের শেষ সময়ে তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁকে দোয়া দিয়েছিলেন এবং তাঁর নেতা-কর্মীদেরও শহীদ জিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীদের নিয়েই বিএনপি গঠিত হয়েছে।

বিএনপি একটি রাজনীতি, একটি দর্শন দিয়েছিল, যেটা অতীতে কেউ দিতে পারেনি। সেটি হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি, পাহাড়ি, এ দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সকলে এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে আছেন। সকল ধর্মের মানুষ এখানে থাকতে পারবেন, তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবেন। এর মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে থাকবে আমার সংস্কৃতি এবং যেখানে আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্য থেকে আমরা রাজনীতি পরিচালনা করতে পারব। এখন কেউ বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আর আমরা বলি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এখানেই আমাদের রাজনীতি সার্থক।


বাংলাদেশের জনগণও বাংলায় কথা বলছে, আবার পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বাংলায় কথা বলে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং এ দেশের জাতি, ধর্ম, গোত্র—সকলকে সম্পৃক্ত করে একটা পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি পাচ্ছি। এ জন্যই বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং সকলে বিএনপির এ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছে। পাশাপাশি একটি আদর্শভিত্তিক কর্মসূচিও আমরা দিয়েছি, তাতে দেশ গঠন ও উন্নয়ন কর্মসূচিভিত্তিক ১৯ দফা কর্মসূচি আছে। এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশের জনগণ রয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে লোকেরা এসেছেন। আমার দলে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী রয়েছেন। এ রকম দর্শন ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতি এর আগে কেউ দিতে পারেনি বলে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকে, যারা একসময় বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টের দল বলে। আর এই ক্যান্টনমেন্ট বাংলাদেশের সীমার মধ্যেই অবস্থিত, বাংলাদেশের তো বাইরে নয়।


মতিউর রহমান: আমরা দেখি যে আপনার দল চলে আপনার একক সিদ্ধান্তে। গঠনতন্ত্রেও আপনাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে দলকে এককেন্দ্রিক করে রাখা হয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চা যে আপনার দলের মধ্যেই নেই, এটাও একটা বড় প্রশ্ন।

খালেদা জিয়া: আমাদের গঠনতন্ত্র লিখিতভাবে এককেন্দ্রিক হতে পারে, কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের মতামত নিয়ে, তাঁদের সম্পৃক্ত করেই আমরা সবকিছু করি। আমাদের গঠনতন্ত্র মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটা স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে, সেখানে আমাদের সদস্যদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নিই। প্রয়োজনে স্ট্যান্ডিং কমিটির সিদ্ধান্তও আমরা আরও বৃহত্তর পরিসরে, যেমন দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা এবং আরও যাঁদের নিলে সঠিক সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে বলে মনে করি, সেখানে তাঁদের সবার সঙ্গে আলোচনা করি। এমনকি অনেক সময় স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং নির্বাহী কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অনেককে আমরা আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানাই এবং তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।

মতিউর রহমান: আপনার সামনে কি অন্যেরা ভিন্নমত জানাতে পারেন বা আপনি যেটা বলছেন বা চিন্তা করছেন, সেটার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন? এমন কি হয় যে আপনার মতের বিরুদ্ধে তাঁরা তর্ক-বিতর্ক করছেন?

খালেদা জিয়া: আমাদের এখানে সবাই যার যার মতামত প্রকাশ করেন এবং সর্বসম্মতভাবে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আলোচনা হয়েছে, ভিন্নমত হয়েছে, তর্কবিতর্ক হয়েছে, এ কথাগুলো কিন্তু আপনারা পত্রপত্রিকাতেও তুলে ধরেন।

বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের বিরোধ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছিল আলোচিত বিষয়। তাঁদের একসঙ্গে খুব কমই দেখা গেছে  

বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের বিরোধ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছিল আলোচিত বিষয়। তাঁদের একসঙ্গে খুব কমই দেখা গেছেফাইল ছবি: ইউসুফ সা’দ

মতিউর রহমান: দেশের দুই প্রধান নেত্রীর একজন আপনি বিরোধীদলীয় নেত্রী, আরেকজন প্রধানমন্ত্রী। আপনারা দুজনই দুটি বড় ট্র্যাজিক ঘটনার শিকার। দুজনের মধ্যে কি পারস্পরিক সহানুভূতি-সহমর্মিতা থাকতে বা আসতে পারে না, যেখানে আপনারা দুজনে এক হতে পারেন? আপনারা পরস্পরের দিকে একটু তাকালেন কি না, একটু হাসলেন কি না, একটু কথা বললেন কি না, এটা দেখার জন্য কিন্তু দেশ আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

খালেদা জিয়া: বিরোধী দলে থাকার সময়েও আমরাই নিজেদের পক্ষ থেকে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে প্রথমেই আমি ৩২ নম্বর গিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের জন্য আমরা মহাখালীতে ওয়াজেদ সাহেবের (শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়া) বাসায় গিয়েছিলাম। আমাদের পক্ষ থেকে এ রকম প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। সরকারে যাওয়ার পরও আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই; সুন্দর একটা রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পরিবেশ তৈরি করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে জন্য আমি তাদের ইফতার পার্টিতে গিয়েছি। পরে তাঁর মেয়ের বিয়েতেও গিয়েছিলাম। আপনারা হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, সেখানে আমার সঙ্গে সাধারণ সৌজন্যমূলক আচরণটুকু পর্যন্ত করা হয়নি। আমি কে সেটা ব্যাপার নয়, দেশের জনগণের নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও ব্যবহারটুকু পর্যন্ত আমি তাঁর কাছ থেকে পাইনি। সেখান থেকেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে।

মতিউর রহমান: তারপরও একজন মানুষ বা একজন নারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আপনার কোনো সহানুভূতি নেই?

খালেদা জিয়া: সেই জন্যই আপনারা লক্ষ করে থাকবেন, আমি কিন্তু তাঁকে লক্ষ্য করে কোনো সময় ব্যক্তিগত আক্রমণ করি না। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করবেন, সংসদে বা সংসদের বাইরে কোনো সুযোগ পেলেই তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে আক্রমণ করে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেন। কিন্তু লক্ষ করবেন, আমি কোনো সময় তাঁকে লক্ষ্য করে বা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথাবার্তা বলি না। তাঁর পিতা বা তাঁর পরিবার সম্পর্কে কখনো কোনো আমি কথা বলিনি। আমি মনে করি, এসব বলা ঠিক নয়।

মতিউর রহমান: দেশের মধ্যে এই যে বিদ্বেষ, এই যে সংঘাত, এই যে বিভক্তি—যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, আমি তো মনে করি, এর থেকে বের হওয়ার আশু কোনো পথ নেই। এ রকমই কি চলবে? আপনারা কোনো চেষ্টা, কোনো উদ্যোগ নেবেন না? আওয়ামী লীগ-বিএনপি এসব বাদ দিয়ে একটু চিন্তা করুন। এভাবে তো দেশ চলতে পারে না।

খালেদা জিয়া: আমি সব সময় বলেছি, বিভেদ-বিভ্রান্তির রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না, আমি বিশ্বাস করি উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের রাজনীতিতে। সে প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা এবং জোরদার করার জন্য আমাদের পক্ষে কিছু করার থাকলে আমি সেটি করতে প্রস্তুত রয়েছি। কিন্তু সেটি এক পক্ষ করলেই তো হবে না। সরকারে থাকাকালে সেই প্রচেষ্টা আমরা চালিয়েছিলাম। বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ তখন কোনো সহযোগিতা করেনি বলে আমরা সেই কাজগুলো করতে পারিনি। একতরফা চেষ্টা করলে সেটা সম্ভব নয়। এখন সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। ফলে বিভেদ-বিভ্রান্তি দূর করতে এবং যে সমস্যাগুলো তারা সৃষ্টি করছে, সেগুলো নিরসন করতে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে এলে আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা তারা পাবে।