রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে ইদানীং সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার এবং সবারই এতে অংশ নেয়া প্রয়োজন। আলোচনাটি খুবই জরুরি। এ আলোচনা বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, একই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জবাবদিহিতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টেকসই ও শক্তিশালী করা দরকার। সেজন্য ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে হওয়া আলোচনাটি অত্যাবশ্যক।
এ আলোচনা যেভাবে এগোচ্ছে, তা আসলে কতটুকু ব্যাংক ব্যবস্থার সত্যিকার পরিবর্তনের জন্য এবং কতটুকু নিছকই আলোচনার খাতিরে হচ্ছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ ব্যক্তি বলছেন যে, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা বিরাজমান সংকটময় পরিস্থিতির কারণ নিরূপণে নির্দিষ্ট নয়। রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ প্রদানের বিষয়টি এ দেশে পুরনো ব্যাপার। খেলাপি ঋণের বিষয়টিও বাংলাদেশে নতুন নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, উন্নয়ন-বিশেষায়িত ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সবসময় খেলাপি বা মন্দ ঋণ ছিল। খেলাপি ও মন্দ ঋণের সঙ্গে রাজনৈতিক আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা সবসময়ই বিরাজমান; তবে প্রশ্ন হলো— এখন কি শুধু রাজনৈতিক নির্দেশিত ঋণ অনুমোদনের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, না এর সঙ্গে এমন এক পরিস্থিতি যোগ হয়েছে, যার কারণে আগের চেয়ে এখন খেলাপি ঋণ বেশি হারে বাড়ছে? মূলত এ মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যক। এবং এ প্রশ্নের উত্তর মিললে সংকট নিরসনের পন্থাও বাতলানো সহজতর হতে পারে।
২. ব্যাংক ব্যবস্থায় কেন খেলাপি ঋণ হয়, এ বিষয়ে কতগুলো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়। এর মধ্যে একটি ব্যাখ্যা যারা কেতাবি অর্থনীতিবিদ, তারা হাজির করেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তথ্যভিত্তিক অর্থশাস্ত্রে (ইনফরমেশন ইকোনমিকস) আলোচিত হওয়া নৈতিক বিপত্তি ও প্রতিকূল নির্বাচন— এ দুটি ধারণার নিরিখে আলোচ্য ব্যাখ্যাটি হাজির করা হয়। এ ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হলো, ব্যাংক ঠিকভাবে গ্রাহক নির্বাচন করতে পারছে না। সেজন্য গ্রাহক যথাযথভাবে কার্যক্ষমতা দেখাতে পারছেন না। ব্যাংকের কৌশলে ভুল আছে। কাজেই ঋণ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মূলত পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী দুই দল লোক এ ধরনের বিশ্লেষণ হাজির করেন। তারা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় আনা গেলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিসংখ্যক লোক পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবে না। কাজেই আলোচ্য সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। এ দুটি ব্যাখ্যার কতক অংশ ঠিক বটে, কিন্তু কোনোভাবেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সহায়ক নয়। তাহলে এমন কী হলো, যার জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অন্য সময় ও অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার?
বিষয়টি বুঝতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌল সূচক পর্যালোচনা করা যাক। মোটাদাগে সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাতের বিস্তৃতি বেড়েছে। সেক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ নির্ণায়কমূলক সূচক। দেখা যাবে যে, ১৯৯১ সালের পর থেকে জিডিপি যেমন বাড়ছিল, তেমনি একই হারে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশও বাড়ছিল। জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২০১১-১২ সালে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০১২-১৩ সালে ২১ দশমিক ৭৫, ২০১৩-১৪ সালে ২২ দশমিক শূন্য ৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ হয়েছে। অর্থাত্ ২০১২-১৩ সাল থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের অংশ হ্রাস পেয়েছে বা স্থবির হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। তা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর পর থেকেই বেশি হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। অর্থাত্ মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপি। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ জিডিপির ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপি স্থির মূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মোট ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। পার্শ্ববর্তী ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। আর তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫৪ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার)। অর্থাত্ ভারতের জিডিপির ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। তাই পুনরায় মূলধনের নামে এ ব্যাংকগুলোকে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা জোগান দিতে হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছে।
অল্প অর্থ জমা দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে। ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও দিন দিন ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। আগে সাধারণত খেলাপি হলে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে বড় ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বড় অংকের ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এ সুবিধার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি অংকের ঋণ পুনর্গঠন করা গেছে। নীতিমালা অনুসারে মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠন সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হবে ছয় বছরের জন্য। ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হবে ২ শতাংশ হারে। আর ১ হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি পরিমাণ ঋণের জন্য এককালীন জমা দিতে হবে ১ শতাংশ হারে। পরিসংখ্যান বলছে, পুনর্গঠন সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশই কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এরই মধ্যে পুনর্গঠন সুবিধা পাওয়া অর্ধেকই নতুন করে খেলাপি হয়েছেন। এ সুযোগের কারণে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে দেয়া ঋণের বিপুলাংশ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের অংশ হ্রাস পাওয়া শুরু করল এবং তা স্থবিরতায় দাঁড়িয়েছে; খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তাই কী কারণে ঘটল? এর দুর্বোধ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর একটি ব্যাখ্যাই যে, বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এর সঙ্গে পুঁজি পাচারের বিষয়টি মেলালে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সহজতর হয়। পরিষ্কারভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন (বিনিয়োগ স্থবির হওয়া) এবং রাজনৈতিক কারণে আস্থাহীনতা।
সাম্প্রতিক সময়ের হিসাব, বিশেষ করে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বা অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ক্রমাগত এর পরিমাণ বাড়ছে। তার অভ্যন্তরীণ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না কিন্তু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে (এমএমটুএইচ) বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুইস ব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব একই কথা বলছে। তার মানে যখন আস্থাহীনতা থাকে তখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুঁজির পাচার ঘটে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ে; অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি হয় না এবং ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণও নিতে চান না। অর্থাত্ দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে ঋণযোগ্য টাকা (তারল্য বা অলস টাকা) বেড়ে যাওয়ার সংকটও দৃশ্যমান হয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, এখানে আস্থাহীনতাই মূল কারণ। আস্থাহীনতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা থাকায় ব্যাংক ব্যবস্থার এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তখন লুটপাটও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় প্রকল্প খরচও। এসবই দৃশ্যমান।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যক্তিমালিকানায় আনা হলে এ সমস্যার উত্তরণ ঘটত কিনা। নিশ্চয়ই ঘটত না। কারণ আর্থিক খাতের সংস্কারে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিখাতে ব্যাংক বাড়লে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হার কমে যাবে। কিন্তু সুদের হার প্রতিযোগিতার জন্য কমছে না; বরং এটি না কমার অন্যতম কারণ— খেলাপি ঋণের পরিমাণ। অর্থাত্ খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলে সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং বেশি রাখতে হয়। ব্যাংকের ব্যয় আরো বেড়ে যায়। এ কারণেও সুদের হার কাঙ্ক্ষিত হারে কমছে না। কাজেই প্রতিযোগিতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংকটাপন্নতাই সুদের হার বেশি হওয়ার মূল কারণ। ব্যক্তিখাতের ব্যাংকগুলোয়ও রাজনৈতিক কায়দায় পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হচ্ছে। ব্যাংক স্থাপনে যেমন রাজনৈতিক লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়মনীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অসুস্থ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
আস্থাহীনতার সঙ্গে আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারও একেবারেই আলোচনা হচ্ছে না। নিঃসন্দেহে ব্যাংক একটি কোম্পানি। কিন্তু তা যেকোনো সাধারণ কোম্পানির মতো নয়। সাধারণ কোম্পানিতে পুঁজির জোগান উদ্যোক্তারা ও শেয়ারহোল্ডাররা দিয়ে থাকেন। শুধু কার্যকরী পুঁজি (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম। এখানে উদ্যোক্তা বা শেয়ারহোল্ডাররা যে পরিমাণ ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে, তাতে তাদের অংশ খুবই কম। আমানতকারীরা অধিকাংশ অর্থের জোগান দেন। তার মানে ব্যাংকের মালিকানা যার হাতেই থাকুক না কেন, এটি আসলে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। মূলত সেজন্য রেগুলেশনের ধরন ভিন্নতার দাবি রাখে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, রেগুলেশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বিদ্যমান। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারেনি। যদিও গণমাধ্যম ব্যাংক ব্যবস্থার বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি উপস্থাপন করছে, এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এখনো জনমনে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি যে, ব্যাংক আর ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি আমানতকারীর প্রতিষ্ঠান। কাজেই আমানতের খেয়ানত করার অধিকার কারো নেই। এবং সেজন্য যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন দরকার, তা দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এখনো ব্যক্তিখাতে ব্যাংকগুলো ছেড়ে দিলে খেলাপি ঋণ ও সুদের হার কমে যাবে— এ ধরনের ভ্রান্ত তত্ত্বের মধ্যে জীবনযাপন করছেন।
৩. আলোচনাটা হওয়া দরকার দুটি ক্ষেত্রে। এক. কীভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি জোগানো যায়, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ হতে পারে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হতে পারে। অর্থাত্ বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক ব্যবস্থায় সুযোগ, সুবিধা ও সেবা কীভাবে বাড়ানো যায় এবং সুদের হার কীভাবে কমানো যায়। দুই. ব্যাংকের প্রডাক্টে বৈচিত্র্য কীভাবে আনা যায়। এ খাতের প্রডাক্টের ক্ষেত্রে কোনো সৃজনশীলতা দেখা যায় না, বরং উল্টো কীভাবে গ্রাহককে আরো বেশি মাত্রায় শোষণ করা যায়, তার বিস্তর অভিযোগ লক্ষণীয়। অর্থাত্ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাংক হলো একটি ইঞ্জিনের মতো এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে কীভাবে উৎপাদনকে সহায়তা করা যাবে, তা-ই ব্যাংক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি। আরেকটি ব্যর্থতা হলো, ব্যাংককে আমানতকারীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিরুত্সাহ। মোটাদাগে বলতে গেলে, ব্যাংক ব্যবস্থায় আজকের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আস্থার অভাব থেকে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
সন্দেহ নেই, রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। কীভাবে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, সে রাজনৈতিক প্রশ্ন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা দরকার। জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের ব্যবস্থাই আস্থার সংকট ও অনিশ্চতয়তা দূরীভূত করতে পারে। এটা প্রথম পর্যায়ের কাজ। দ্বিতীয় পর্যায়ে রেগুলেশনের ক্ষেত্রে সৃজনশীল চিন্তার প্রয়োজন, তা পোষ্য ও মুখস্থ বিদ্যায় হবে না। তৃতীয় পর্যায়ের কাজ, যা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, ব্যাংকের কিন্তু সব গ্রাহক বড় নন, ক্ষুদ্র গ্রাহকই বেশি। এবং ব্যাংক বিভিন্ন সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জনমানুষ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।