জাকারিয়া চৌধুরী
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত চুক্তিতে যে দাসখত দিয়ে আসেন - তার ভিত্তিতেই ২০১২ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দু’টি কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সরকার। এ লক্ষ্যে ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত ভাবে স্বাক্ষরিত হয় ২০১৩ সালের ২০শে এপ্রিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও হাসিনা সরকার এ ব্যাপারে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে গতানুগতিক ধারায়। কিন্তু বাদ সাধে কিছু বাম দল। যখন তেল, গ্যাস, বন্দর রক্ষা কমিটি এর বিরুদ্ধে লং মার্চ শুরু করে তার দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ৪ঠা অক্টোবর রাত ১০টায় তড়িঘড়ি করে জানানো হয়, এই প্রকল্পের উদ্বোধন হবে পরের দিন অর্থাৎ ৫ই অক্টোবর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সামান্য একটা পুল, কালভার্ট কিংবা ছোটখাটো একটা সেতুর উদ্বোধনের জন্যও লটবহর নিয়ে গাড়ি ছোটান সেখানে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হয় অনেকটাই সাদামাটা ভাবে, নীরবে আর গোপনে। ৫ই অক্টোবর সকাল ১১টায় হাসিনা-মনমোহন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাই হ্যালো মার্কা একটা উদ্বোধনী ঘণ্টি বাজিয়েই সম্পন্ন করেন ব্যাপারটার আনুষ্ঠানিকতা।
যে কোনও বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষার মরিয়া চেষ্টাই সাধারণ মানুষকে
সন্দিগ্ধ করে তোলে। তারা ভাবতে বাধ্য হয় যে,
ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
তাছাড়া এটি সত্যি সত্যিই যদি পরিবেশ-বান্ধব হতো তাহলে তো শেখ হাসিনা ও তাঁর পোষা সাঙ্গপাঙ্গরা
লাউড স্পিকার নিয়ে নেমে পড়তো রাস্তায় রাস্তায় ।
কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণের ক্ষত তৈরি করে বলেই বনভূমি ও জনবসতি এলাকার ১৫-২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এটি নির্মাণের অনুমোদন দেয় না দুনিয়ার কোনও রাষ্ট্র। অথচ ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে এটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। আরও ব্যাপার হচ্ছে, যে কোনও ধরনের কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা খোদ ভারতেই আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার এই ভারতের হাতেই মজুত আছে অন্তত নয় কোটি টন নিম্নমানের অবিক্রীত কয়লা। আজকের বিশ্ব বাজার যেহেতু কয়লা বিমুখ, সেহেতু অচল অব্যবহৃত এসব কয়লা যে কোনও মূল্যে বিক্রি করাই এখন ভারতের উদ্দেশ্য।
আরেকটা ব্যাপারে অবশ্য অনেকেই শঙ্কিত। তা হলো, এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে বনজ ও জলজ সকল প্রাণী পশ্চিমে মানে সুন্দরবনের ভারতীয়
অংশে মাইগ্রেট করবে। ফলে বিশ্ব হেরিটেজ সুন্দরবনের একক দাবিদার হয়ে উঠবে তখন ভারত।
পাঠক, আপনারাই এখন বিচার করুন, ১৯৭২ সালের ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট অনুযায়ী খোদ ভারতেই যেখানে কয়লা ভিত্তিক
তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না, এই প্রকল্পে সেই ভারতই কিন্তু বাংলাদেশের
পক্ষে নিরবিচ্ছিন্ন ওকালতি করে যাচ্ছে। আর ভারতের সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে একই গানের
কোরাসে যোগ দিয়েছে এদেশের মীরজাফরের দল,
যারা শুধুমাত্র ক্ষমতায়
থাকার আশায় যে কাউকে, যে কোন প্রতিষ্ঠানকে এমনকি পুরো দেশের
বুকে ছুরি মারতেও দ্বিধা করবে না কখনও।
এই প্রাণঘাতী তথাকথিত যৌথ প্রকল্পের প্রারম্ভিক ব্যয় ধরা হয়েছে
২১০ কোটি ডলার। এই বিপুল পরিমাণ টাকার ৭০ শতাংশ নেয়া হবে ব্যাংক থেকে চড়া সুদে আবার
সেইসব ব্যাংকের নিকট জিম্মাদার হিসেবে একক দায়বদ্ধতা থাকবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের। বাকি
৩০ শতাংশের ১৫ ভাগ বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশ,
বাকি ১৫ ভাগ ভারতীয়
কোম্পানির। প্রকল্পের জমি দেবে বাংলাদেশ,
লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে
হবে বাংলাদেশকেই অথচ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষে এর পুরো পরিচালনা চুক্তি মোতাবেক
চলে যাবে ভারতীয় বেনিয়াদের হাতে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ চড়া মূল্যে কিনতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ
এবং লাভের ৫০ শতাংশ পাবে ভারত। অথচ বিদ্যুতের উৎপাদন এবং বিপণনের শেষে লাভ যদি হয় ১০০
টাকা, সেখান থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা, কয়লা ক্রয়, পরিবহন সহ নানা রকম মেনটেইনেন্স খাতে তারা ব্যয় করবে
কমপক্ষে ৮০ টাকা। স্থিতি থাকা ২০ টাকার ১০ টাকা বাংলাদেশের আর বাকি ১০ টাকা হবে ভারতের।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সকল যন্ত্রপাতি কিনে আনতে হবে ভারত থেকে, প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে নিম্ন মানের ভারতীয় কয়লা। চুক্তির সারকথা মোটামুটি এ রকমই।
বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে হয়ে যাওয়া চুক্তি, সমঝোতার এইসব করুণ দশা দেখে ভারতীয় এক নাগরিক আক্ষেপ করে বলেছেন,‘ক্ষমতায় থাকার জন্য তো দেখি সব কিছুই ভারতকে দিয়ে দিচ্ছেন হাসিনা! তোমাদের মধ্যে
কি প্রতিবাদ করার কেউ নেই? একজনও দেশপ্রেমিক নেই? তোমরা তাকে বাধা দিচ্ছো না কেন?’
শুধুমাত্র রামপাল প্রকল্প চালু হলে আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের
কি কি মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে একবারও ভেবে দেখেছেন কখনো ?
দেখুন -
১। সুন্দরবনের স্বাভাবিক ইকো সিস্টেম শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্প
তৈরির জন্য অবাধে গাছপালা বনজঙ্গল কেটে সাফ করতে হবে।
২। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ইত্যাদির পাশাপাশি বাড়বে পুরো
অঞ্চলের তাপমাত্রা। ফলে বৃষ্টিপাত কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে এমনকি এসিড বৃষ্টি হওয়াও
অসম্ভব কিছু নয়।
৩। সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফরমের কার্বন প্রভৃতির অবাধ ছড়িয়ে
পড়া, যে কোনও প্রাণীর জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৪। পুরো সুন্দরবনের পরিবেশ দ্রুত ধ্বংস হতে থাকবে। সুন্দরবন
হয়ে পড়বে বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ মরূদ্যান।
প্রিয় পাঠক, এবার শুনি আজকালের কথা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজের একটি বিশেষ বিমানে চেপে সুইজারল্যান্ড সফরে যান ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক
ফোরাম-এ যোগ দিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই সম্ভবত একমাত্র সরকার প্রধান যিনি
নিজ দেশের বিমানে না উঠে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মানচিত্রকে নিচে নামিয়ে আনলেন। যা-ই
হোক, এসব কথা আজকের বিষয়বস্তু নয়। তিনি তাঁর স্বভাবমতোই
প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় লটবহর নিয়ে ঘোরেন। এটা তাঁর নতুন অভ্যাস নয়। সেই ১৯৯৬ সাল থেকেই
দেখে আসছি তাঁর এমন কান্ড কারখানা। টাকা কার,
খরচ করেন কে ?
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যোগ দিয়ে প্রথমেই তিনি যে ধাক্কাটি
খেলেন তা হচ্ছে, বিশ্ব পরিবেশবাদীরা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন
- সুন্দরবন ধ্বংস করে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত তিনি কিভাবে
নিলেন? আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না
দিয়ে উল্টো তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন - তাঁরা যেন নিজেরা বাংলাদেশে এসে দেখে যান তাঁদের
প্রশ্নের যৌক্তিকতা কতটুকু। তিনি জানালেন,
এই প্রকল্পে সুন্দরবনের
কোনও ক্ষতি হবে না।
কিন্তু বিশ্ব পরিবেশবাদীরা কি এতই বোকা যে, তাঁরা কোনও প্রকার তত্ত্ব, তথ্য ও সমীক্ষা ছাড়াই শেখ হাসিনার মুখোমুখি হয়েছেন? এই যে, চালাকি করে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ছলে তাঁদেরকে বাংলাদেশ ঘুরে যেতে বলা - এর মানে কি? তিনি তো নিশ্চিতভাবেই জানেন, তাঁদের কেউই বাংলাদেশে আসবেন না। এটা তো স্বাভাবিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর নয়, এর মাধ্যমে তিনি কি বিশ্বনেতাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করলেন নাকি নিজে অন্য কোনও পরিচয় নিয়ে দেশে ফিরলেন?
তবে আর যা-ই করুন না কেন, দেশে ফিরে তিনি
তাঁর বহু বার উল্লিখিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাই উল্লেখ করে আগের টার্গেটেই তীর ছুড়ে
দিলেন। বললেন, ইউনুস টাকা খাইয়ে ওদের দিয়ে কথা বলিয়েছে। আরে বাবা
ইউনুস যদি টাকা খাইয়ে আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরকে দিয়ে কথা বলিয়ে ফেলতে
পারেন তবে আপনি কেন হাসান মাহমুদ কিংবা হানিফকে দিয়ে টাকা খাইয়ে আল গোরের মুখে বিটুমিন
ঢেলে দিলেন না? রাষ্ট্রের একজন সিভিল নাগরিক যদি কাউকে টাকা খাওয়াতে
পারে তবে এটা কি কোনও ভাবে অসম্ভব আপনার জন্য? একই অনুষ্ঠানে
আল গোর বলেন-
গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সৌর শক্তির প্যানেল স্থাপনকারী দেশ ছিল। কিন্তু এখন সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল সুন্দরবনের পরিবেশ দূষণকারী একটি নতুন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। হাজার হাজার মানুষ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।
এসবের জবাব প্রধানমন্ত্রী সেখানে না দিয়ে গণভবনে দেখা করতে আসা
নেতাকর্মীদের বলেন, ‘ইউনুস সাহেবদের অনেক টাকা, টাকা খরচ করে তারা এসব বানাইছে।’
এখন মূল কথা হচ্ছে,
তাঁদের পাল্টাপাল্টি
এসব ব্লেম গেমের বলি হবে কে? সুন্দরবন, বাংলাদেশ নাকি জনগণ? নাকি সবাই?
সুন্দরবন রক্ষার জন্য কি আমাদেরকে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে? প্রাণিকুল এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষার যুদ্ধে যদি এদেশের মানুষ একবার প্রাণ দিতে
শিখে ফেলে তবে বাংলাদেশের সব বাধা কেটে যাবে এক নিমেষেই। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় হয়তো
স্বর্ণাক্ষরে কোনও কোনও বীর বাংলাদেশীর নাম শোভা পাবে - যাঁরা প্রকৃতিকে স্বাভাবিক
গতিতে চলমান রাখার আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন। আর এ অর্জন যদি সত্যিই সম্ভব হয় তবে বাংলাদেশের
শত্রুদের জন্য তা হবে এক চরম শিক্ষা।