মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
পেশাগত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জনসচেতনতা হচ্ছে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চালিকা শক্তি। সে জন্য নৈতিকতাসম্পন্ন সাংবাদিকতা করতে গেলে তথ্যের মুক্ত আদান-প্রদানে হতে হয় নির্ভুল, স্বচ্ছ ও যথোপযুক্ত। তাই নৈতিক সাংবাদিক মাত্রই কর্মে হন শুদ্ধ ও সত্যশীল। কেননা তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হয়, তিনি সতর্ক, সাহসী ও দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে সত্য অন্বেষণে সংবাদ পরিবেশন করেন; ঔদ্ধত্য বা খামখেয়ালিতে কাউকে অহেতুক অপরাধী প্রতিপন্নের অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন; জনগণের সেবার ব্রতে সংবাদ ও প্রচারণার পার্থক্য বুঝে বিনা স্বার্থে স্বতন্ত্র অবস্থানে অবিচল থাকেন এবং সর্বোপরি জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় নিজেকে সদা স্বচ্ছ রাখেন। এই চারটি বিশেষ গুণাবলিই হচ্ছে নৈতিক সাংবাদিকতার মানদন্ড। সেটাই সাংবাদিকতায় শেখানো হয়।
এখন সেই শিক্ষায় যেন গুড়েবালি! সত্য হয়েছে সত্যোত্তর। অর্থাৎ ‘ট্রুথ ইজ পোস্টট্রুথ’। বিশ্বে ২০১৬ সাল তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেননা কদর্য রাজনীতি ও সংযোগ স্থাপনের বিপ্লবে মিথ্যার প্রসারতা, ভুল ধারণা দেওয়া বা বোঝানো ও সন্দিগ্ধ প্রবণতা এক বিশেষমাত্রায় উচ্চকিত হয়েছে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্যুতি বা ‘ব্রেক্সিট’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয়, এ দুটো ঘটনাই সেই সত্যকে সত্যোত্তর করেছে। অর্থাৎ ধারণাতীত বিষয়কে বাস্তবসম্মত করেছে।
এতে ‘নৈতিক সাংবাদিকতা’ বিবর্জিত প্রেক্ষাপটে একটি ভুয়া সংবাদে রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘সন্ত্রাসী দল’ প্রতিপন্ন! শুধু গণমাধ্যমের সংবাদ প্রচারণায় নয়, বরং ওই সংবাদ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এমনকি বিভিন্ন টিভি ‘টকশো’র উপজীব্য হয়েছে। যে ব্যক্তিটি ওই সংবাদের উৎস হয়েছেন তার পরিচয় কী? কী তার নৈতিক অবস্থান? ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে তার ‘দাসত্বের’ ইতিবৃত্তটি প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এই টরন্টোয় ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুন নাগাদ তার পরিবেশিত অন্তত দুটি মিথ্যা বা ভুয়া সংবাদ পরিবেশনার যথোপযুক্ত প্রমাণাদি আমার সংগ্রহে রয়েছে। সর্বশেষটি কানাডার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল লিবারেল পার্টির সংসদ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেই আমি তাকে ই-মেইলে নোটিস দিয়েছি। তা পেয়েই ফোনে জানান, সংশোধন করবেন; কিন্তু করেননি।
তেমনি ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে বিএনপিকে প্রতিপন্নে ‘জুডিশিয়াল রিভিউ’ বিষয়টি ওই সংবাদ পরিবেশকের কাছে ছিল বোধগম্যহীন! কেননা ‘রিভিউ’ যে পুনর্বিবেচনা, সেটি ছাড়াই প্রত্যাখ্যাত রায়ে বর্ণিত কার্যকরণ ‘সন্ত্রাসী দল’ লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে, যা দায়িত্বহীনভাবেই অন্যরা সংবাদ পরিবেশনায় লুফে নিয়েছে। তাতে সংবাদের ‘সিক্স-সিগমা’ বা ‘ফাইভ ডব্লিউ ওয়ান এইচ’ বা প্রকৃত তথ্য উন্মোচনগত বিষয়াবলির মাঝে ‘ওয়ান এইচ’টি ছিল নিরুপায় উদাও!
সাধারণ মাত্রই বুঝবেন, যে ‘তথাকথিত’ শরণার্থী মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী কানাডায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে নিজের দল বিএনপি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিপূরণে সশস্ত্র সংগ্রাম ও সহিংসতা করে থাকে’, এমনকি ‘অস্ত্রেশস্ত্রে যুদ্ধংদেহী হয়। তারা হাতবোমা, পিস্তল ও বড় তরবারি ব্যবহার করে। তারা হরতাল বা মিছিল চলাকালীন সরকার পক্ষের লোকদের উপর আক্রমণ করে’- এমন স্বীকারোক্তিমূলক বর্ণনায় তার কানাডায় অভিবাসন হতে পারে? বলাবাহুল্য, ওই ‘বেসিস অব ক্লেইম’-এর ভিত্তিতে সম্পূরক বিশ্লেষণে প্রথমে উচ্চপদস্থ একজন অভিবাসন কর্মকর্তা তার স্থায়ী অভিবাসনের আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেন, যা আবার শেষটায় ফেডারেল কোর্টে রিভিউর আবেদন করলে একই কারণে বহাল রাখা হয়। বিচারক হেনরি এস ব্রাউন ৩৩ পৃষ্ঠা সংবলিত ওই রায়ে সম্পূরক কার্যকারণ বিশ্লেষণ সাপেক্ষে মাত্র দুই লাইনের রায়ে লিখেন: ‘দিস কোর্টস জাজমেন্ট ইজ দ্যাট দ্য অ্যাপ্লিকেশন ফর জুডিশিয়াল রিভিউ ইজ ডিস্মিসড্, নো কোয়েশ্চেন ইজ সার্টিফাইড অ্যান্ড দেয়ার ইজ নো অর্ডার অ্যাজ টু কস্টস’। অর্থাৎ এই কোর্টের রায়টি হচ্ছে আবেদনকারীর আইনি পুনর্বিবেচনাটি বাতিল করা হলো, কোনো প্রশ্ন সত্যায়ন করা হয়নি এবং খরচ প্রদানেরও কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে যারা শরণার্থীর ‘বেসিস অব ক্লেইম’-এর উল্লেখ ছাড়াই কোর্টের রায়ে কার্যকরণে বিবৃত সম্পূরক বিশ্লেষণ থেকে বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ প্রতিপন্নের মতো বিভ্রান্তি ছড়ান, তারা নৈতিক সাংবাদিকতার মানদন্ডে কতটা ‘সত্যকে সত্যোত্তর’ করেন; বিষয়টি ভাবনার বৈ কি!