মহিউদ্দিন খান মোহন / নয়া দিগন্ত
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নূরুর হত্যাকাণ্ড এখন দেশের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। রাতে পুলিশের পরিচয়ে হাতকড়া পরিয়ে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পরদিন সকালে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ফলে জনমনে এখন এ প্রশ্ন জোরালোভাবেই দেখা দিয়েছে যে, দেশে কারো কোনো নিরাপত্তা আছে কি না। একটি দেশের যেকোনো নাগরিকের যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রহণ এবং তদনুযায়ী কর্মতৎপরতা চালানোর অধিকার রয়েছে। আমাদের সংবিধান সে অধিকার প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে। পাশাপাশি একজন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তাদের। এটাও সংবিধান নির্দেশিত বিষয়। ফলে একজন নাগরিককে রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর পরিচয়ে রাতের অন্ধকারে তুলে নেয়া হবে, আর কয়েক ঘণ্টা পরে তার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যাবে এটা কারো পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গত ২৯ মার্চ বুধবার রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের চন্দনপুরা পশ্চিম গলির বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক নিজেদেরকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নূরুল আলম নূরুকে তুলে নিয়ে যায়। অভিযানকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রাউজান থানার নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জাবেদ মিয়া ছিল বলে জানিয়েছেন নিহত নূরুর ভাগ্নে। পরদিন সকালে নূরুর লাশ পাওয়া যায় তার গ্রামের বাড়ি থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাউজানের কোয়াপাড়া গ্রামের খেলারঘাটের পশ্চিম পাশে সওদাগরপাড়া এলাকায়। স্থানীয় লোকজন হাত-পা ও মুখ বাঁধা লাশটি দেখে পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ আসতে দেরি করে। বিকেল ৪টার পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে যায়।
এ দিকে নোয়াপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ জাবেদ মিয়া পত্রিকাকে বলেছেন - ‘আমি রাতে শহরে কোনো অভিযানে ছিলাম না। রাউজান থানার ওসির সঙ্গে থানার কাগতিয়া এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছিলাম।’ অন্য দিকে রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ বলেছেন- ‘রাউজান থানার টিম নগরীতে বুধবার রাতে অভিযান চালায়নি। ওই রাতে কাগতিয়া এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছিলাম আমরা।’ (কালের কণ্ঠ ৩১, মার্চ ২০১৭)। এ দিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, রাউজান থানা পুলিশ ওই রাতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে, এমন কোনো বার্তা জেলা পুলিশের কার্যালয়ে নেই’।
নুরুল আলম নূরুর দাফন সম্পন্ন হওয়ার আগেই আরেকটি নৃশংস ঘটনার খবর আসে সিলেট থেকে। সেখানে একদল দুর্বৃত্ত কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রদল নেতা হাসান ডনকে। তাকে শাসক দলের ক্যাডাররা হত্যা করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। দু’টি ঘটনা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সংঘটিত হওয়ার কারণে দেশব্যাপী এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের দু’জন নেতার এক দিনের ব্যবধানে নিহত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে এ কারণে যে, একটি হত্যাকাণ্ডের হোতারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর পরিচয় দিয়েছে। অন্যটি সরকারি দলের ছাত্রকর্মীরা সংঘটিত করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাসীন সরকার এভাবে বিরোধী দল নির্মূলের বিশেষ কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কি না। অবশ্য এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি জোরালো অভিযোগ ওঠার পরও পুলিশ নূরু হত্যার বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি। বরং পুলিশের আচরণে একরকম ‘ঢাক গুড়, গুড়’ ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। নূরুল আলম নূরুর লাশ পাওয়ার খবর সকালেই রাউজান পুলিশকে জানানো হলেও তারা সঙ্গে সঙ্গে কেন অকুস্থলে গেল না এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সারা দিন পার করে বিকেল ৪টার পরে কেন তারা ঘটনাস্থলে গেল? তাহলে কি ওই দীর্ঘ সময়ে ‘নূরুল আলম নূরু’র হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো গল্পের প্লট বানানোর পরিকল্পনা চলেছিল? জনমনে উত্থিত এ প্রশ্নের জবাব হয়তো পাওয়া যাবে না ; তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশ যে একটা কিছু লুকাতে চাচ্ছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নূরুল আলম নূরুকে হত্যা করা হয়েছে। আর তা করা হয়েছে অত্যন্ত নির্মম উপায়ে। হাত-পা মুখ বেঁধে তাকে মারা হয়েছে। তার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাসা থেকে তুলে নেয়ার পর নূরুর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তারপর তাকে হত্যা করা হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নূরুকে যখন ওরা তুলে নিয়ে যায়, তখন তার স্ত্রী তাদের সঙ্গে থানায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে সঙ্গে নেয়া হয়নি। কেন তাকে থানায় যেতে দেয়া হলো না? সাধারণ আসামিকে ধরে নিয়ে গেলে স্বজনেরা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সঙ্গে থানায় যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেন নূরুর স্ত্রীকে থানায় যেতে নিষেধ করা হলো এটা একটা রহস্য। পরদিন সকালে স্বজনেরা রাউজান থানায় গিয়ে নূরুর সন্ধান করলে থানা থেকে জানানো হয় সে থানায় নেই।
দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না - এটা বলা বোধ করি অসঙ্গত হবে না। অস্থিরতা বিরাজ করছে সর্বত্র। এক দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী আস্তানার সন্ধান লাভ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন চলছে। নিহত হচ্ছে পুরুষ, নারী ও শিশু। অন্য দিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে কোনোভাবেই স্বীকার করা যাবে না। সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপির পক্ষ থেকে নূরু হত্যার বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। প্রেস ব্রিফিং করা হয়েছে। তাতে সরকারের দমননীতির নিন্দা জানানো হয়েছে এবং সরকার বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকাতে চায় এমন অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি বিরাজমান বাস্তবতায় অসঙ্গত বলা যাবে না, বরং পেশিশক্তির ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে দমন করে রাজনীতির একচ্ছত্রাধিপতি হওয়ার একটা উদগ্র বাসনা সরকারকে পেয়ে বসেছে বলেই মনে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন যে, এখন যেমন ঝোপঝাড়, জঙ্গল, সড়ক-মহাসড়কের ধারে কিংবা খাল-নদীর তীরে বিরোধীদলীয় কর্মীদের লাশ মাঝে মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে, তেমন অবস্থা ছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও। তখন বিশেষ বাহিনী যদি কাউকে ধরে নিয়ে যেত, তাহলে তার অক্ষত দেহে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা ছিল অবসম্ভব ব্যাপার। সে সময় সারা দেশে কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীর খুনের অভিযোগ রয়েছে। আর সে অভিযোগ উত্থাপনকারী দলটির নেতা এখন বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী!
রাউজান থানা পুলিশ বলেছে, নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নূরুর বিরুদ্ধে ওই থানায় দু’টি হত্যা ও একটি বিস্ফোরকসহ চারটি মামলা রয়েছে। নূরু যেহেতু রাজনীতি করত, সেহেতু তার বিরুদ্ধে মামলা থাকা স্বাভাবিক। তবে, এ ধরনের মামলা থাকাটা একজন মানুষকে হত্যা করার যৌক্তিক কারণ বা কৈফিয়ত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সে যদি হত্যা মামলার আসামি হয়েই থাকে, তাহলে আরো আগেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে বিচারের সম্মুখীন করা হলো না কেন? পুলিশ অবশ্য এখনো নূরু হত্যার কথা স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করেনি। যদি পুলিশ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে না থাকে, তাহলে তো তাদের দায়িত্ব খুনিচক্রকে দ্রুত খুঁজে বের করা। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কর্মকর্তারা এমন কি স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলে থাকেন - ‘খুনিদের দ্রুত খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে’। কিন্তু ছাত্রনেতা নূরু হত্যার পর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তেমন কোনো হুঙ্কার দেননি। কেন, নূরু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন বলে? রাজনীতি করা, কোনো একটি সরকারের বিরোধিতা করা একজন নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার। আর বেঁচে থাকাও তার অধিকার। তাহলে নূরু কেন বাঁচতে পারলেন না? রাষ্ট্র কি এর দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে?
- লেখক : মিডিয়া কর্মী