রুমীন ফারহানা
অদ্ভুত হলেও সত্য আমার জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি মুভি দেখেছি প্লেনে বসে। বাসায় মুভি দেখার সরঞ্জাম নাই আর হলেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। হাতে গোনা এক দুইবার ছাড়া আমার বেশির ভাগ ভ্রমণই সরাসরি কাজ সংক্রান্ত এবং সেগুলো আমাকে একাই সারতে হয়। ভ্রমণগুলো দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং অসুস্থ মা'কে একা রেখে যাওয়ার চিন্তায় কষ্টকরতো বটেই। যেকোনও যাত্রা তা সে সড়ক বা আকাশ যে পথেই হোক না কেন ঘুম যেহেতু হয় না তাই সময় কাটাবার সবচেয়ে ভালো উপায় আমার কাছে মুভি দেখা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও সবরকম চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়। এবারই প্রথম প্লেনে বসে লিখছি আমি। কষ্ট, যন্ত্রণা, বিরক্তি আর অসহায়বোধ থেকে এই লেখা। শারীরিক কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা আর অনেকখানি অপমান, অবসাদ মিশে আছে এই লেখায়।
গত দুই বছর থেকেই আমার বিদেশ ভ্রমণের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে অজানা কোনও বড় শক্তির। অলিখিত, অজানা বলছি কারণ কোনও আদালতের আদেশ বা প্রশাসনের কোনও কারণ দর্শানো চিঠি আমার হাতে নেই যাতে বলতে পারি ঠিক এই কারণে, এই অফিস কর্তৃক আমার বিদেশ যেতে বাঁধা আছে। বেশ কয়েকবার বিমানবন্দর থেকে ফিরেও আসতে হয়েছে আমাকে। আবার কোনও কোনও সময় প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে হঠাৎ জানানো হয়েছে অজানা শক্তি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে এবং দৌড়ে প্লেন ধরেছি আমি। খুবই রহস্যে ঘেরা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনায় মোড়া আমার গত দুই বছরের বিদেশ যাত্রাগুলো। ৫০-৫০ চান্স নিয়ে প্রতিবার যাত্রা করি আমি। এই অনিশ্চয়তার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে না গেলে এটা বোঝানো কঠিন। সহজ করে বললে বেশ একটা ইঁদুর-বেড়াল খেলা খেলা ভাব আছে পুরো বিষয়টির মধ্যে। যদিও বেড়ালের জন্য যা খেলা, ইঁদুরের জন্য অনেক সময়ই তা সাক্ষাৎ মৃত্যু।
খেলা বলছি ঠিকই কিন্তু এটি আসলে খেলা নয়। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়ানোর ১/২ মিনিটের মাথায়ই আমাকে জানানো হয় কী জানি (!) সমস্যা হচ্ছে তাই আমাকে ওসির রুমে যেতে হবে। সেখানে আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাস নিয়ে নেওয়া হয় আর ইমিগ্রেশন পুলিশ ঘেরা একটা ঘরে অপরাধির মতো একা বসে অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে থাকি আমি। দেবে নাকি দেবে না? দিলে কী ঠিকঠাক প্লেন ধরতে পারবো আমি নাকি সময় স্বল্পতার কারণে মিস হবে? আমার লাগেজ যা আগেই চেকইন হয়ে গেছে তার কী গতি হবে? অফ লোড করবে তো তারা? লাগেজ কি অক্ষত পাবো? একবার এমনও হয়েছে যে এয়ারলায়েন্স তার কাউন্টার থেকেই বিদায় করেছে আমায় এই বলে যে ওপরের নির্দেশ আছে বোর্ডিং পাস ইস্যু না করার জন্য। ওসির রুমের দরজা আর এয়ারলায়েন্সের কাউন্টারে শাটল কর্কের মতো ছুটেছি আমি টানা ৩ ঘণ্টা। কোনও কাজ হয়নি। এমনকি সেবার ওসির দেখা পর্যন্ত পাইনি। কী অপরাধে এই সাজা তাও জানা হয়নি। আদালতের দারস্থ হয়েছি বেশ কয়েকবার এবং আদালতের পাকা নির্দেশ নিয়েই যাত্রা করছি কিছুদিন যাবত। আদালতের পাকা নির্দেশ পাওয়ার পর লাভ হয়েছে এটুকুই যে তারা আমার যাত্রা বন্ধ করতে পারেনি আর কিন্তু অত্যাচার চালিয়ে গেছে আগের মতই।
এবার আমার ফ্লাইট ছিল সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে দোহা হয়ে লন্ডন। মোটামুটি দীর্ঘ পথ। এই যাত্রায় সকাল ছয়টায় এয়ারপোর্ট গেলেই চলে, কিন্তু আমি গেছি ভোর ৪ টায়। ওই যে ইঁদুর বেড়াল খেলতে হবে। পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাসের সাথে উচ্চআদালতের নির্দেশও পুলিশকে জমা দিয়েছি আমি। দীর্ঘ ক্লান্তিকর অপেক্ষা। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তারপরও নো ক্লিয়ারেন্স। ক্ষুধা, নির্ঘুম রাত সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত আমি। এবার বসিয়ে রেখেছে অন্য একটা ঘরে, যথারীতি সব ডকুমেন্ট তাদের হাতে। ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢুকলাম বড় সাহেবের ঘরে, অনেকটা অনুমতি ছাড়াই। কনটেম্প অব কোর্টের কথা স্মরন করাতেই কাজ দ্রুত হলো। ফ্লাইট ধরলাম আমি। প্রতিবারই তো এই একই অপমান আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাই আমি, তাহলে আজ এত খারাপ লাগলো কেন?
লেখাটির ঠিক এই পর্যায় আমি দোহার খুব কাছাকাছি, এখনই ল্যান্ড করবে প্লেন। ৩ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। হঠাৎ কানে আসল কাতার এয়ারওয়েজ বলছে ‘... travel is a right for all... হাসছি আমি। না ভ্রমণ সকলের অধিকার না। এখনও কিছু কিছু বর্বর রাষ্ট্র আছে যেখানে স্বৈরশাসকেরা শাসন করে। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ সাদা মাইক্রোবাসে করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মানুষ, দু’একজন অতি ভাগ্যবান ফিরে আসে ঠিকই কিন্তু কিছুই মনে থাকে না তাদের, গলিত লাশ ভাসে পুকুরে, ডোবায়, ভয়ে ঢাকা চারপাশে ফিসফিস করে কথা বলে মানুষ, ৫৭ ধারা তাকে তাড়া করে ফেরে, বিকৃত বর্বর হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিবেচনায় পার পেয়ে যায়, সীমান্তে প্রতিদিন বন্ধুর ছোড়া গুলিতে লাশ পড়ে, এখানে জীবন শুধুই একটা সংখ্যা মাত্র। উন্নয়নের গল্প শোনায় শাসক, ঠিক যেমন রূপকথার গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি শুনতাম ছেলেবেলায়। এখানে ৪ হাজার কোটি টাকা তুচ্ছ হয়ে যায় আর আয়োজন করে পাপকর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ১ লাখ টাকার ওপর। এখানে মানুষ পানিতে মরে, আগুনে পোড়ে, চাপা পড়ে পাহাড় ধসে। চাপাতির কোপ আর বন্দুকের নল এখানে চলে সমান গতিতে। এখানে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালিত হয় আর তনুকে খেয়ে যায় ভালুকে। এখানে জন্ম নেওয়ার আগেই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। জাতির সবচেয়ে বড় গৌরবের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জাতিকে বিভাজনে। এখানে ইতিহাস লেখা হয় আইন আর আদালত দ্বারা। মিথ্যাচার এখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ।
গত দুই বছর থেকেই আমার বিদেশ ভ্রমণের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে অজানা কোনও বড় শক্তির। অলিখিত, অজানা বলছি কারণ কোনও আদালতের আদেশ বা প্রশাসনের কোনও কারণ দর্শানো চিঠি আমার হাতে নেই যাতে বলতে পারি ঠিক এই কারণে, এই অফিস কর্তৃক আমার বিদেশ যেতে বাঁধা আছে। বেশ কয়েকবার বিমানবন্দর থেকে ফিরেও আসতে হয়েছে আমাকে। আবার কোনও কোনও সময় প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে হঠাৎ জানানো হয়েছে অজানা শক্তি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে এবং দৌড়ে প্লেন ধরেছি আমি। খুবই রহস্যে ঘেরা, চাঞ্চল্য আর উত্তেজনায় মোড়া আমার গত দুই বছরের বিদেশ যাত্রাগুলো। ৫০-৫০ চান্স নিয়ে প্রতিবার যাত্রা করি আমি। এই অনিশ্চয়তার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে না গেলে এটা বোঝানো কঠিন। সহজ করে বললে বেশ একটা ইঁদুর-বেড়াল খেলা খেলা ভাব আছে পুরো বিষয়টির মধ্যে। যদিও বেড়ালের জন্য যা খেলা, ইঁদুরের জন্য অনেক সময়ই তা সাক্ষাৎ মৃত্যু।
খেলা বলছি ঠিকই কিন্তু এটি আসলে খেলা নয়। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়ানোর ১/২ মিনিটের মাথায়ই আমাকে জানানো হয় কী জানি (!) সমস্যা হচ্ছে তাই আমাকে ওসির রুমে যেতে হবে। সেখানে আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাস নিয়ে নেওয়া হয় আর ইমিগ্রেশন পুলিশ ঘেরা একটা ঘরে অপরাধির মতো একা বসে অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে থাকি আমি। দেবে নাকি দেবে না? দিলে কী ঠিকঠাক প্লেন ধরতে পারবো আমি নাকি সময় স্বল্পতার কারণে মিস হবে? আমার লাগেজ যা আগেই চেকইন হয়ে গেছে তার কী গতি হবে? অফ লোড করবে তো তারা? লাগেজ কি অক্ষত পাবো? একবার এমনও হয়েছে যে এয়ারলায়েন্স তার কাউন্টার থেকেই বিদায় করেছে আমায় এই বলে যে ওপরের নির্দেশ আছে বোর্ডিং পাস ইস্যু না করার জন্য। ওসির রুমের দরজা আর এয়ারলায়েন্সের কাউন্টারে শাটল কর্কের মতো ছুটেছি আমি টানা ৩ ঘণ্টা। কোনও কাজ হয়নি। এমনকি সেবার ওসির দেখা পর্যন্ত পাইনি। কী অপরাধে এই সাজা তাও জানা হয়নি। আদালতের দারস্থ হয়েছি বেশ কয়েকবার এবং আদালতের পাকা নির্দেশ নিয়েই যাত্রা করছি কিছুদিন যাবত। আদালতের পাকা নির্দেশ পাওয়ার পর লাভ হয়েছে এটুকুই যে তারা আমার যাত্রা বন্ধ করতে পারেনি আর কিন্তু অত্যাচার চালিয়ে গেছে আগের মতই।
এবার আমার ফ্লাইট ছিল সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে। ঢাকা থেকে দোহা হয়ে লন্ডন। মোটামুটি দীর্ঘ পথ। এই যাত্রায় সকাল ছয়টায় এয়ারপোর্ট গেলেই চলে, কিন্তু আমি গেছি ভোর ৪ টায়। ওই যে ইঁদুর বেড়াল খেলতে হবে। পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিংপাসের সাথে উচ্চআদালতের নির্দেশও পুলিশকে জমা দিয়েছি আমি। দীর্ঘ ক্লান্তিকর অপেক্ষা। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তারপরও নো ক্লিয়ারেন্স। ক্ষুধা, নির্ঘুম রাত সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত আমি। এবার বসিয়ে রেখেছে অন্য একটা ঘরে, যথারীতি সব ডকুমেন্ট তাদের হাতে। ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢুকলাম বড় সাহেবের ঘরে, অনেকটা অনুমতি ছাড়াই। কনটেম্প অব কোর্টের কথা স্মরন করাতেই কাজ দ্রুত হলো। ফ্লাইট ধরলাম আমি। প্রতিবারই তো এই একই অপমান আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাই আমি, তাহলে আজ এত খারাপ লাগলো কেন?
লেখাটির ঠিক এই পর্যায় আমি দোহার খুব কাছাকাছি, এখনই ল্যান্ড করবে প্লেন। ৩ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। হঠাৎ কানে আসল কাতার এয়ারওয়েজ বলছে ‘... travel is a right for all... হাসছি আমি। না ভ্রমণ সকলের অধিকার না। এখনও কিছু কিছু বর্বর রাষ্ট্র আছে যেখানে স্বৈরশাসকেরা শাসন করে। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ সাদা মাইক্রোবাসে করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মানুষ, দু’একজন অতি ভাগ্যবান ফিরে আসে ঠিকই কিন্তু কিছুই মনে থাকে না তাদের, গলিত লাশ ভাসে পুকুরে, ডোবায়, ভয়ে ঢাকা চারপাশে ফিসফিস করে কথা বলে মানুষ, ৫৭ ধারা তাকে তাড়া করে ফেরে, বিকৃত বর্বর হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বিবেচনায় পার পেয়ে যায়, সীমান্তে প্রতিদিন বন্ধুর ছোড়া গুলিতে লাশ পড়ে, এখানে জীবন শুধুই একটা সংখ্যা মাত্র। উন্নয়নের গল্প শোনায় শাসক, ঠিক যেমন রূপকথার গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি শুনতাম ছেলেবেলায়। এখানে ৪ হাজার কোটি টাকা তুচ্ছ হয়ে যায় আর আয়োজন করে পাপকর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ১ লাখ টাকার ওপর। এখানে মানুষ পানিতে মরে, আগুনে পোড়ে, চাপা পড়ে পাহাড় ধসে। চাপাতির কোপ আর বন্দুকের নল এখানে চলে সমান গতিতে। এখানে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালিত হয় আর তনুকে খেয়ে যায় ভালুকে। এখানে জন্ম নেওয়ার আগেই শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। জাতির সবচেয়ে বড় গৌরবের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জাতিকে বিভাজনে। এখানে ইতিহাস লেখা হয় আইন আর আদালত দ্বারা। মিথ্যাচার এখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ।
এমন এক দেশে বাস করে ভ্রমণকে আমি অধিকার বলি কী করে? সংবিধান দিয়েছে আমাকে সেই অধিকার কিন্তু এমন কত অধিকারইতো আছে সংবিধান জুড়ে। সংবিধানতো দেশের মালিকানাই তুলে দেয় আমাদের হাতে। তাই কি হয়? কাজির গরু কেতাবেই থাকে, তাকে বাস্তব জীবনে আশা করবার মতো বেকুবি করে কে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমি অনিশ্চয়তায় আটকে থাকি, জানতেও পারি না কী পাপের এই সাজা। যে সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেখানে বেঁচে থাকাটাই অনেক বড় পাওয়া, বাকি সবটুকুই বিলাসিতা।
লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি
উৎসঃ বাংলাট্রিবিউন