আলী রীয়াজ
আলী রীয়াজ |
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এই বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা দরকার। এর মধ্যে সরকারের আইনি ভাষ্য দেওয়ার দায়িত্ব আইনমন্ত্রীর, বিশেষ করে যেহেতু এই বিষয়ে সরকার আপিল আবেদন করেছিল, যা খারিজ হয়ে গেছে এবং যার ফলে সংসদে পাস করা একটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আইনমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবারই কথা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের নয় দিন পরে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনের আগেই আমরা সরকারের ক্ষুব্ধ অবস্থানের কিছু উদাহরণ পেয়েছি।
রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের যে সাময়িক অস্বস্তি ও নীরবতা ছিল, তা অর্থমন্ত্রীর কথার মধ্য দিয়ে অবসিত হয়; মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উষ্মাও আর অবিদিত নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে ‘জনমত গড়ে তোলার’ কথা বলার পর মন্ত্রীদের জন্য এই নিয়ে মন্তব্যের আর কোনো বাধা থাকেনি এবং তাঁরা তার সদ্ব্যবহারে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।
এতৎসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কেননা প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য বিচারপতি হক সংবাদ সম্মেলন করতে দেরি করেননি, এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আগেই তাঁর এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই রায় এবং প্রধান বিচারপতি বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলোর ভিত্তি এবং নৈতিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ এই কারণে যে তিনি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং তা লাভজনক পদ বলেই বিবেচিত (কামাল আহমেদ, ‘যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!’ প্রথম আলো ১০ আগস্ট ২০১৭)। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যকে কেবল আইনি ব্যাখ্যা বলে বিবেচনা না করে রাজনৈতিক অবস্থান বলেই বিবেচনা করব, কেননা তাঁর এসব বক্তব্য রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা রাজনীতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্রের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে।
তদুপরি তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য, যা জুন মাসে সংসদে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় এবং ১ আগস্টের পরে জনসমক্ষে দেওয়া মন্তব্যের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি, তার প্রতিধ্বনি শুনতে কষ্ট হয় না। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার যেসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তার একটি হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও দেশে কোনো জনপ্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই কথাগুলো নতুন নয়, কেননা গবেষকেরা ও সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই তা বলে আসছেন, জীবনযাপনেও তা বোধগম্য; এই রায় এই বক্তব্যের নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলন সেই কথা আবার প্রমাণ করেছে এবং ৯ আগস্ট আমরা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি বললে অতিরঞ্জন হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিচারপতি হকের অতীতে দেওয়া রায়, অবস্থান এবং বক্তব্যের যে বিরোধ রয়েছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই আমরা অবহেলা করতে পারি না। বিশেষ করে আদালতের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিভাজন সম্পর্কে তিনি এই বছরের গোড়াতেও যে কথা বলেছেন, তার একটি বড় রকমের পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের বিস্মৃত হবার উপায় নেই যে সুপ্রিম কোর্টের যে বিভক্ত রায় দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের অবসান ঘটিয়েছিল এবং একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজ করেছিল, সেই আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক; সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই ব্যবস্থা বাতিলের যে রায়, সেখানে তিনজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১১ মে ২০১১)। এই রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি হক অবসরে যান।
এই রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে অনুধাবন করতে পারেননি তা নয়, তাঁকে এই বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা শুনানির সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যা রায়ের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যেই আছে, অর্থাৎ বিচারপতি হক সেটা জানতেন এবং এই বিষয় রায়ে উল্লেখের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রায়ের সম্পূর্ণ ভাষ্যের জন্য ১৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে—সেপ্টেম্বর ২০১২ সাল পর্যন্ত। আর ইতিমধ্যে ৩০ জুন ২০১১ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশের সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে দেশের উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনার অসংগতিপূর্ণ এবং তার পরিপন্থী। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হক রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার ফাঁকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি যে পঞ্চদশ সংশোধনীটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু বা স্পিরিটের বিরুদ্ধে। যদিও ক্ষমতাসীন দল বারবার ওই রায়কেই ব্যবহার করেছে এই সংশোধনীর বৈধতার জন্য। ক্ষমতাসীন দল যখন এই রায়ের স্পিরিট উপেক্ষা করেছে, সেই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিছুই বলেননি। উপরন্তু ২০১২ সালে দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁর লেখা রায়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অমীমাংসিত মতবিরোধ রয়েছে, তার সমাধান নিহিত আছে এবং এতে সংকটও কেটে যাবে (দৈনিক মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২)। অবশ্যই সংকট কাটেনি, আর সেই সমাধান কী, তার কোনো ব্যাখ্যা পাঁচ বছর পরেও আমরা পাইনি, কিন্তু একটি সর্বসম্মত রায়কে ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘অপরিপক্ব’ বলে বর্ণনা করার জন্য তিনি দেরি করেননি।
বিচারপতি হকের বক্তব্য যে বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে এই ধারণাই দেয় যে সংসদের করা আইন বা বিধান বাতিল করার ক্ষেত্রে আদালতকে নির্দিষ্ট সীমানা মেনে চলতে হবে যে বিচারকেরা কতটুকু পারবেন। অথচ বিচারপতি হক এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেই আইন arbitrary হলো কি না, despotic হলো কি না, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু বিচারকগণের ওপর ন্যস্ত, যাঁরা জনপ্রতিনিধি নন। এ কারণে আমরা (ইংল্যান্ডে) Dr. Bonham (১৬১০) এর মামলায় দেখতে পাই যে প্রধান বিচারপতি Sir Edward Coke বলেছেন যে Rule against bias দ্বারা কলুষিত কোনো আইনের বৈধতা থাকতে পারে না। অবশ্য তখনো Bill of Rights (১৬৮৯) আসেনি, যা King in Parliament–কে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে। এখানেই আইনের শাসনকে অর্থবহ করে মহিমান্বিত করার দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত’ (বিডিনিউজ২৪, ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭; http://opinion. bdnews24.com/bangla/archives/45207)। শুধু তা-ই নয়, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে
‘যদি নির্বাহী বিভাগ অবৈধ আদেশ দেয়, আদালত তা সংশোধন করতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করে, তাও সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।’
আমরা নিশ্চয়ই তাঁর এই সাক্ষাৎকারের এ বক্তব্য অনুধাবন করতে পারি যে ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু কি তাই নয়? আগের সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রেও কি একই ধারণাই কাজ করেনি? আজকে বিচারপতি হক কেন তবে রাজনীতিবিদদের ভাষায় এই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হলেন, সেটা যে কাউকেই কেবল বিস্মিত করবে না, অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেবে।
এটা আমরা লক্ষ করি, বিচারপতি হকের তুলনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং অনেক অরাজনীতিবিদসুলভ। তিনি যে একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে ‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে’, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর দলের অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয়। আশা করি তাঁরা সেটি লক্ষ করবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সবকিছুর সঙ্গেই আমি একমত। ৯৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা সরকার আদালতে উপস্থাপন করেছিল কিন্তু তা যে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, সেটা এই রায়েই স্পষ্ট। এখন তার পুনরুক্তি এতে নতুন কিছু যোগ করেনি। আইনমন্ত্রী যে ‘আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ’ একপাঞ্জ করার আবেদন করবে বলে মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলেই বিবেচিত হতে পারে। কেননা তা একদিকে এক নতুন ধারা তৈরি করবে কি না, এবং প্রশ্ন উঠবে প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে যাঁরা একমত হয়েছেন, তাঁদের কোন অংশ গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোন অংশ হবে না?
তা ছাড়া আইনমন্ত্রী ৭০ অনুচ্ছেদবিষয়ক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা-ও কতটা বাস্তবোচিত, সেটা বিবেচনা করা দরকার। কেননা, বিচারপতি খায়রুল হকও সেই প্রসঙ্গে বলেছেন। এই রায়ের প্রধান বিষয় ৯৬ অনুচ্ছেদ হলেও তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ৭০ অনুচ্ছেদ, এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও বিষয়, ফলে এ নিয়ে আলোচনা করা খুব জরুরি।
- আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
উৎসঃ prothom-alo.com