Search

Saturday, August 12, 2017

ছয় মাসেই উল্টো কথা

আলী রীয়াজ
আলী রীয়াজ
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এই বিষয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা দরকার। এর মধ্যে সরকারের আইনি ভাষ্য দেওয়ার দায়িত্ব আইনমন্ত্রীর, বিশেষ করে যেহেতু এই বিষয়ে সরকার আপিল আবেদন করেছিল, যা খারিজ হয়ে গেছে এবং যার ফলে সংসদে পাস করা একটি সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য আইনমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবারই কথা। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের নয় দিন পরে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সংবাদ সম্মেলনের আগেই আমরা সরকারের ক্ষুব্ধ অবস্থানের কিছু উদাহরণ পেয়েছি।

রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের যে সাময়িক অস্বস্তি ও নীরবতা ছিল, তা অর্থমন্ত্রীর কথার মধ্য দিয়ে অবসিত হয়; মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উষ্মাও আর অবিদিত নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে ‘জনমত গড়ে তোলার’ কথা বলার পর মন্ত্রীদের জন্য এই নিয়ে মন্তব্যের আর কোনো বাধা থাকেনি এবং তাঁরা তার সদ্ব্যবহারে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই একজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।

এতৎসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কেননা প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য বিচারপতি হক সংবাদ সম্মেলন করতে দেরি করেননি, এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের আগেই তাঁর এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই রায় এবং প্রধান বিচারপতি বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেগুলোর ভিত্তি এবং নৈতিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ এই কারণে যে তিনি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং তা লাভজনক পদ বলেই বিবেচিত (কামাল আহমেদ, ‘যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!’ প্রথম আলো ১০ আগস্ট ২০১৭)। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যকে কেবল আইনি ব্যাখ্যা বলে বিবেচনা না করে রাজনৈতিক অবস্থান বলেই বিবেচনা করব, কেননা তাঁর এসব বক্তব্য রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা রাজনীতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরিত্রের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক


তদুপরি তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য, যা জুন মাসে সংসদে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় এবং ১ আগস্টের পরে জনসমক্ষে দেওয়া মন্তব্যের মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি, তার প্রতিধ্বনি শুনতে কষ্ট হয় না। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার যেসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তার একটি হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও দেশে কোনো জনপ্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই কথাগুলো নতুন নয়, কেননা গবেষকেরা ও সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই তা বলে আসছেন, জীবনযাপনেও তা বোধগম্য; এই রায় এই বক্তব্যের নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করেছে। বিচারপতি খায়রুল হকের আইন কমিশনের প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সম্মেলন সেই কথা আবার প্রমাণ করেছে এবং ৯ আগস্ট আমরা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছি বললে অতিরঞ্জন হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে বিচারপতি হকের অতীতে দেওয়া রায়, অবস্থান এবং বক্তব্যের যে বিরোধ রয়েছে, সেটা কোনো অবস্থাতেই আমরা অবহেলা করতে পারি না। বিশেষ করে আদালতের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিভাজন সম্পর্কে তিনি এই বছরের গোড়াতেও যে কথা বলেছেন, তার একটি বড় রকমের পার্থক্য আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের বিস্মৃত হবার উপায় নেই যে সুপ্রিম কোর্টের যে বিভক্ত রায় দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের অবসান ঘটিয়েছিল এবং একই সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজ করেছিল, সেই আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক; সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই ব্যবস্থা বাতিলের যে রায়, সেখানে তিনজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১১ মে ২০১১)। এই রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপতি হক অবসরে যান।

এই রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি যে অনুধাবন করতে পারেননি তা নয়, তাঁকে এই বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরিরা শুনানির সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, যা রায়ের পূর্ণাঙ্গ ভাষ্যেই আছে, অর্থাৎ বিচারপতি হক সেটা জানতেন এবং এই বিষয় রায়ে উল্লেখের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রায়ের সম্পূর্ণ ভাষ্যের জন্য ১৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে—সেপ্টেম্বর ২০১২ সাল পর্যন্ত। আর ইতিমধ্যে ৩০ জুন ২০১১ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশের সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে দেশের উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনার অসংগতিপূর্ণ এবং তার পরিপন্থী। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হক রায়ের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার ফাঁকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি যে পঞ্চদশ সংশোধনীটি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু বা স্পিরিটের বিরুদ্ধে। যদিও ক্ষমতাসীন দল বারবার ওই রায়কেই ব্যবহার করেছে এই সংশোধনীর বৈধতার জন্য। ক্ষমতাসীন দল যখন এই রায়ের স্পিরিট উপেক্ষা করেছে, সেই সময়ে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিছুই বলেননি। উপরন্তু ২০১২ সালে দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁর লেখা রায়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অমীমাংসিত মতবিরোধ রয়েছে, তার সমাধান নিহিত আছে এবং এতে সংকটও কেটে যাবে (দৈনিক মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২)। অবশ্যই সংকট কাটেনি, আর সেই সমাধান কী, তার কোনো ব্যাখ্যা পাঁচ বছর পরেও আমরা পাইনি, কিন্তু একটি সর্বসম্মত রায়কে ‘অগণতান্ত্রিক’ ও ‘অপরিপক্ব’ বলে বর্ণনা করার জন্য তিনি দেরি করেননি।

বিচারপতি হকের বক্তব্য যে বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে এই ধারণাই দেয় যে সংসদের করা আইন বা বিধান বাতিল করার ক্ষেত্রে আদালতকে নির্দিষ্ট সীমানা মেনে চলতে হবে যে বিচারকেরা কতটুকু পারবেন। অথচ বিচারপতি হক এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেই আইন arbitrary হলো কি না, despotic হলো কি না, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু বিচারকগণের ওপর ন্যস্ত, যাঁরা জনপ্রতিনিধি নন। এ কারণে আমরা (ইংল্যান্ডে) Dr. Bonham (১৬১০) এর মামলায় দেখতে পাই যে প্রধান বিচারপতি Sir Edward Coke বলেছেন যে Rule against bias দ্বারা কলুষিত কোনো আইনের বৈধতা থাকতে পারে না। অবশ্য তখনো Bill of Rights (১৬৮৯) আসেনি, যা King in Parliament–কে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে। এখানেই আইনের শাসনকে অর্থবহ করে মহিমান্বিত করার দায় ও দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত’ (বিডিনিউজ২৪, ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭; http://opinion. bdnews24.com/bangla/archives/45207)। শুধু তা-ই নয়, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে
‘যদি নির্বাহী বিভাগ অবৈধ আদেশ দেয়, আদালত তা সংশোধন করতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করে, তাও সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করতে পারে।’

আমরা নিশ্চয়ই তাঁর এই সাক্ষাৎকারের এ বক্তব্য অনুধাবন করতে পারি যে ‘কখনও এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মর্মবস্তু কি তাই নয়? আগের সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রেও কি একই ধারণাই কাজ করেনি? আজকে বিচারপতি হক কেন তবে রাজনীতিবিদদের ভাষায় এই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হলেন, সেটা যে কাউকেই কেবল বিস্মিত করবে না, অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেবে।

এটা আমরা লক্ষ করি, বিচারপতি হকের তুলনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং অনেক অরাজনীতিবিদসুলভ। তিনি যে একথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে ‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে’, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর দলের অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয়। আশা করি তাঁরা সেটি লক্ষ করবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সবকিছুর সঙ্গেই আমি একমত। ৯৬ অনুচ্ছেদ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা সরকার আদালতে উপস্থাপন করেছিল কিন্তু তা যে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, সেটা এই রায়েই স্পষ্ট। এখন তার পুনরুক্তি এতে নতুন কিছু যোগ করেনি। আইনমন্ত্রী যে ‘আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ’ একপাঞ্জ করার আবেদন করবে বলে মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলেই বিবেচিত হতে পারে। কেননা তা একদিকে এক নতুন ধারা তৈরি করবে কি না, এবং প্রশ্ন উঠবে প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে যাঁরা একমত হয়েছেন, তাঁদের কোন অংশ গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোন অংশ হবে না?

তা ছাড়া আইনমন্ত্রী ৭০ অনুচ্ছেদবিষয়ক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা-ও কতটা বাস্তবোচিত, সেটা বিবেচনা করা দরকার। কেননা, বিচারপতি খায়রুল হকও সেই প্রসঙ্গে বলেছেন। এই রায়ের প্রধান বিষয় ৯৬ অনুচ্ছেদ হলেও তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ৭০ অনুচ্ছেদ, এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও বিষয়, ফলে এ নিয়ে আলোচনা করা খুব জরুরি।

  • আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
        উৎসঃ prothom-alo.com

Thursday, August 10, 2017

যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়!


কামাল আহমেদ


আমরা এখন বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বাস করছি, কথাটি বলেছেন একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করে বাতিল করায় অপ্রত্যাশিতভাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসব কথা বলেছেন। তাঁর পাশে ছিলেন আরেকজন সাবেক বিচারপতি। তাঁদের এই অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ধারণা হতে পারে যে তাঁরাই বরং অবসরজীবন থেকে রাজনীতির জগতে পা রাখার চেষ্টাকে জোরদার করছেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের সমালোচনার কাজটি আইন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি না, সেই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। আইন কমিশন আইন, ১৯৯৬-এর ৬ নম্বর ধারায় কমিশনের কার্যাবলির যে তালিকা দেওয়া আছে, তাতে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা অন্তর্ভুক্ত নেই।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে নাগরিক হিসেবে মতপ্রকাশের অধিকারের কথা অবশ্য তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের একটি লাভজনক পদে আসীন এবং সেই দপ্তরের স্থাপনা এবং সুবিধা ব্যবহার করে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁর নিজের ঘোষিত রায়েই অবশ্য বলা আছে যে অবসর গ্রহণের পর বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারেন না। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কমিশনের আরেকজন সদস্য সাবেক বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির এবং কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিমকেও পাশে রেখেছিলেন। বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ রাখার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ’প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীর দায়বদ্ধতা আছে, কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধতা আছে।’ আইন কমিশনের চাকরির কারণে সংসদের কাছে জবাবদিহি করায় তাঁর অভ্যস্ত হয়ে ওঠাটা প্রশংসনীয়। তবে বিচারপতিদেরও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে, এমন দাবি করার আগে তিনি তাঁর নিজের লেখা রায়গুলো একবার পড়ে নিলে ভালো করতেন।
 
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন ও সেই আমলে জারি করা সামরিক আইন, আদেশ ও বিধানগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। কিন্তু পরে প্রধান বিচারপতি হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার কারণে বিতর্কিতও হয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে তিনি যে মামলায় পঞ্চম সংশোধনীকে বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন, সেই সময়ও ওই বেঞ্চে তাঁর সহযোগী বিচারপতি ছিলেন এ টি এম ফজলে কবির। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র, যা আইনগতভাবে গঠিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়, কোনো ব্যক্তি দ্বারা নয় (Bangladesh is a Sovereign Democratic Republic, governed by the Government of laws and not of men.)
পরের বাক্যেই তিনি লিখেছিলেন যে বাংলাদেশের সংবিধান সার্বভৌমত্বকে ধারণ করে এবং এটিই দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইন, কাজ এবং কার্যধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তিনি আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ উল্লেখ করে বলেন যে এগুলো সংবিধানের সৃষ্টি এবং সংবিধানের বিধানগুলোই এগুলোর সম্পর্কের বন্ধন। আইনসভা আইন করে, নির্বাহী বিভাগ তা প্রয়োগ করে এবং বিচার বিভাগ সেগুলোর সংবিধানসম্মত হওয়া নিশ্চিত করে।
 
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বর্তমান আপিল বিভাগও বলেছেন সার্বভৌমত্বের ধারক হচ্ছে সংবিধান। সংসদ সার্বভৌম নয়, সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা সংসদের নেই। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির সামরিক শাসনের সময়ে সংশোধিত সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের পরিবর্তনকে মার্জনা করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৯৫ অনুচ্ছেদ, যাতে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ওপর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না যে তখন তাঁর আশা ছিল যে একদিন প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ তাঁর আসবে এবং তখন বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে দর্শকের সারিতে নেমে যেতে বাধ্য হতে চাননি।
 
সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন, জাতীয়তা ও নাগরিকত্বের মতো বিষয়গুলোতেও সামরিক শাসনামলে জারি করা সংশোধনীগুলো তিনি মার্জনা করে বৈধতা দিয়েছিলেন। অথচ এখন তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই হলো প্রথম মামলা, যেখানে আদি সংবিধানের বিধানকে বাদ দিয়ে “মার্শাল ল প্রভিশনস”কে গ্রহণ করা হয়েছে।’ শত্রু সম্পত্তি হিসেবে মুন সিনেমা হলের মালিকানা অধিগ্রহণ এবং তার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন সরকারি আদেশের বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলার রায়ে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার জন্য তিনি তখন প্রশংসিত হলেও সামরিক শাসনের যেসব অংশকে তিনি বৈধতা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলোর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কি না, এখন সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে তাঁর আগের অবস্থানের সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনীর প্রতিক্রিয়ার অমিলই বেশি। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বিস্তৃত।
 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা রয়েছে। বিশেষত অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৫ মাস পর তিনি ওই রায়টি লিখেছিলেন। অথচ তাঁর বিশদ রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যাতে তাঁর রায়ের অন্তত একটি নির্দেশনা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছিল। তিনি অবসরে যাওয়ার আগে তাঁর রায়টি দিয়ে গেলে ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করা সম্ভব হতো না বলেই অনেকের বিশ্বাস। তাঁর রায়টিতে সাতজনের বেঞ্চের তিনজন ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল ঘোষিত রায় এবং লিখিত রায়ের আদেশের মধ্যে ফারাক দেখা দেওয়ায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের বিষয়টিকেই অনেকের মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল ও অস্থির করে তুলেছে।

এই পটভূমিতে ষোড়শ সংশোধনীর রায়-সম্পর্কিত বিতর্কে বিচারপতি খায়রুল হকের মন্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে আরও কিছুটা উত্তাপ যোগ করেছে, সন্দেহ নেই। আদালতের রায় বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির এ যেন আরও একটি অবসর-উত্তর রায়। কিন্তু এতে যে দেশে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে, সে কথা বলা যাচ্ছে না।
- প্রথম আলো 

ষোড়শ সংশোধনী রায় - কেন ক্ষমতাসীনদের এতো ক্ষোভ?



সি আর আবরার

 

গত ৯ জুলাই জাতীয় সংসদের সদস্যরা সর্বোচ্চ আদালতের ওপর তুমুল আক্রমণ চালিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনী খারিজ করে দেওয়া ২০১৬ সালের হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে তারা তিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ওই সংশোধনীতে অসদাচরণ এবং অক্ষমতাজনিত কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরকে অপসারণে পার্লামেন্টকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।

এর আগে ক্ষমতাসীন দলের রথী-মহারথীরা ওই বিষয়ে তৈরি হয়ে আসার জন্য সিনিয়র এমপিদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। মিত্র দলের নেতাদেরও এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছিল। তারা দ্বিধাহীন চিত্তে তাদের মনের ‘ঝাল’ ঝেড়েছেন। তারা রায়কে ‘অবৈধ’ ও ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে নিন্দা করতে তাদের ‘ক্ষোভ’ উগরে দিয়েছেন। তাদের বিষোদগারে, এটা কারো কারো মনে হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়টি ‘১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী।’ জনৈক প্রভাবশালী এমপি তার সহকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘শত্রুদের সাথে শত্রু র মতোই আচরণ করতে হবে, প্রয়োজন হলে তাদেরকে ঠান্ডা করে দিতে হবে।’ বিচারকদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘রায়ের মাধ্যমে তাদের অভিশংসন থামানো যাবে না।’ তিনি ‘নিজেদের ভুল সংশোধনের জন্য’ বিচারকদের পরামর্শও দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের এক মিত্র দলের নেতা ‘বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পেয়ে একে ‘সংসদের সার্বভৌমত্বে’ হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমপিরা তাদের অবস্থানে ছিলেন দ্ব্যর্থহীন। তারা জোর গলায় বলেন, খারিজ করা সংশোধনীটি ছিল ‘১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ ধারা পুনঃবহালের’ লক্ষ্যে একটি অপরিহার্য প্রয়াস, তারা ‘সংবিধানের মৌলিক চরিত্র লঙ্ঘন করতে পারেন না।’ ক্ষমতাসীন জোটের আরেক নেতা বিচারপতিদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই পার্লামেন্টেই তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে, ‘মাত্র কয়েক দিন আগে’ তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

পরিতাপের বিষয় হলো, এমপি মহোদয়েরা কোর্টের রায় এবং ১০ অ্যামিকাস কিউরির (তাদের ৯ জনই সংশোধনীটি বাতিল করার সুপারিশ করেছেন) পর্যবেক্ষনের মধ্যে তাদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেননি । তারা প্রধান বিচারপতি এবং দুই অ্যামিকাস কিউরি- ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামের অনভিপ্রেত সমালোচনা করেন। একজন উর্ধ্বতন মন্ত্রী দাবি করেন, রায়ে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানকে তার আদর্শ বিবেচনা করেন। ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামকে ‘সুযোগসন্ধানী,’ ‘বিবেকবর্জিত,’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দুই অ্যামিকাস কিউরির একজনের শ্বশুর যে ‘পাকিস্তানের নাগরিক’ এবং অপরজনের ‘জামাতা যে ইহুদি’ সেটা জোর দিয়ে বলতে কোনো কসুর করা হয়নি!

যারা এই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসন বিকশিত হওয়ার জন্য দশকের পর দশক ধরে সংগ্রাম করেছেন, তাদের জন্য ওই সন্ধ্যার কার্যক্রমটি ছিল বিশেষভাবে হৃদয়বিদারক। তাদের যুক্তি যে কেবল সংসদীয় শিষ্টাচারের বরখেলাপ এবং রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের বিশেষ করে বিচার বিভাগ ও আইন পরিষদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির মূলনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, সেইসাথে তারা ছিলেন ভ্রান্ত ও স্বার্থন্বেষকও।

এমপিরা দাবি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার কাজটি ছিল ‘অবৈধ’ ও ‘অসাংবিধানিক’ এবং ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ পরিকল্পনা বানচাল করা। ২০১০ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট আরো তিনটি সাংবিধানিক সংশোধনী- পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ- বাতিল করেছে। বিশ্লেষকেরা উল্লেখ করেছেন, আওয়ামী লীগ পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ক রায়কে ‘মাইলফলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল এবং সপ্তম সংশোধনী বিষয়ক রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল। ফলে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, আওয়ামী লীগ এমপিরা যদি ওইসব রায়কে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বিবেচনা না করেন, তবে তারা ষোড়শ সংশোধনীর ব্যাপারে এমনটা কেন করছেন?

তাদের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিটিও শূন্যগর্ভ মনে হয়। ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা যদি ১৯৭২-এর সংবিধানের মূল্যবোধ ও কার্যকারিতার বিষয়টি এত প্রবলভাবেই অনুভব করে থাকেন, তবে তারা সেটাকেই কেন অবিকলভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য সংসদে বিল কেন আনছেন না? দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এ ধরনের উদ্যোগ যে সফল হবে, তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।

ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করেনি এবং এর ফলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃত্ব-বহির্ভূত কাজ করেছে বলে এমপিদের জোরালো দাবি হালে পানি পায় না। স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলেই অনুধাবন করা যায়, বিচার বিভাগ থেকে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে পার্লামেন্টের কাছে সমর্পণ করার মানে হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা এবং সেইসূত্রে সংবিধানের মূল কাঠামোকে দুর্বল করা।

     সংসদে ৯ জুলাইয়ের বক্তৃতাবাজির তোড়ে আরেকটি বিষয় পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে গেছে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান থেকে পার্লামেন্টের বিচারপতিদের অপসারণের বহুল আলোচিত ব্যবস্থাটি উচ্ছেদ ও বাতিল করাটা প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারেরই কর্ম। তারাই ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটা করেছিলেন।

সংসদে ৯ জুলাইয়ের বক্তব্যের সারমর্ম প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, এমপিরা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে আছেন কিনা। জবাব দ্ব্যর্থহীনভাবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ৯৪(৪)-এ সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি তাদের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে স্বাধীন থাকবেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম বলেছেন, ‘নির্বাহী সরকার বা সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না। কার্যপ্রণালীতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি কার্যক্রম নিয়ে থাকা কোনো প্রশ্ন, প্রস্তাব উত্থাপনযোগ্য নয়’ (ধারা ৫৩, ৫৪ ও ১৩৩)। তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘সংসদ সদস্যরা সংসদে যে কথাই বলুন না কেন, ধারা ৭৮-এর আলোকে থাকা দায়মুক্তির সুবিধাটি নিয়ে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে- এমন কোনো বিবৃতি বা মন্তব্য করতে পারবেন না’ (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, ঢাকা : মল্লিক ব্রাদার্স, ২০১২)।

এটাও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, কার্যপ্রণালীতে ব্যক্তিগত ধরনের কোনো অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এমপিদের। ফলে এটা খুবই সম্ভব যে, অ্যামিকাস কিউরি প্রশ্নে অরুচিকর মন্তব্য করে এমপিরা তাদের প্রণীত কার্যপ্রণালী বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

সম্মানিত এমপিরা জোর দিয়ে বলেছেন, কেবল পাকিস্তানেই বিচারপতিদের অপসারণে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ রয়েছে। তারা বলেন, বেশির ভাগ দেশেই এই ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে দেওয়া আছে। এ ধরনের দাবির পক্ষে প্রমাণের ওপর আলোকপাত করা যাক। ২০১৫ সালে কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘কমপেনডিয়াম অব অ্যানালাইসিস অব বেস্ট প্রাকটিস অন দি অ্যাপয়েন্টমেন্ট, টেনিউর অব রিমোভাল অব জাজেজ আন্ডার কমনওয়েলথ প্রিন্সিপালস’-এ বলা হয়েছে, কমনওয়েলথভুক্ত ৪৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে সংসদীয় অপসারণ ব্যবস্থা (৩৪.৩%), ৩০টির মতো দেশে নির্বাহী ও আইনপরিষদ থেকে আলাদা একটি সংস্থা (৬২.৫%) রয়েছে। বাকি দুটি দেশে রয়েছে মিশ্রব্যবস্থা (৩.২%)।

     কমনওয়েলথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ সংসদীয় অপসারণব্যবস্থায় কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্ত, তথ্যানুসন্ধান এবং মূল্যায়নে স্বাধীন, বহিরাগত সংস্থার  সম্পৃক্ত করার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সম্মানিত এমপিরা আমলে নিতে পারতেন, যে ১৬টি দেশ সংসদীয় অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাদের ১২টিই তথ্য তদন্তের দায়িত্বটি আইনপ্রণেতাদের ওপর রাখেনি। তারা এর বদলে আইন পরিষদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা একটি সংস্থার ওপর এ  দায়িত্বটি দিয়েছে। কেবল শ্রীলঙ্কা, নাউরু ও সামোয়োর অনুসরণ করে বিচারক অপসারণে একচ্ছত্র পার্লামেন্টারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে বাংলাদেশ।

সমীক্ষায় সতর্কতা উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, সংসদীয় অপসারণ পদ্ধতি ‘প্রয়োগ করা হলে মারাত্মক সাংবিধানিক সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।’ এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই কক্ষবিশিষ্ট পদ্ধতিই অনেকটা নিরাপদ। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা বর্তমানে সম্ভব নয়।

এক সিনিয়র মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, একজন অ্যামিকাস কিউরি ভারতে বিচারক অপসারণের ব্যবস্থা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি এমন ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন যে, মনে হতে পারে, দেশটিতে এখনো সংসদের অপসারণের পুরনো পদ্ধতি চালু আছে। বাস্তবে ভারত, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশ বিচারপতি অপসারণে পার্লামেন্টকে দেওয়া ক্ষমতা হ্রাস করে সরকারি প্রভাবমুক্ত একটি ব্যবস্থার ওপর ন্যস্ত করেছে। সংবিধানের ৭০ ধারায় আবদ্ধ আমাদের এমপিদের নতুন বাস্তবতার প্রতি যথাযথ নজর দেওয়ার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আইন প্রণয়ন বিভাগের অস্বস্তিকর প্রতিক্রিয়া এবং বিচারপতি অপসারণ প্রশ্নে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের প্রায় সার্বজনীনভাবে বহাল থাকার ভ্রান্ত দাবি এই দেশের গণতন্ত্রের জন্য কলাণকর নয়। আশা করা যেতে পারে, যুক্তিই জয়ী হবে এবং রাষ্ট্রের সব অঙ্গ ক্ষমতা বিভাজনের মৌলিক ধারণা এবং আইনের শাসনের প্রতি যথাযথভাবে শ্রদ্ধাশীল থাকবে।

  • সি আর আবরার - শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎসঃ amaderbudhbar.com