বেগম খালেদা জিয়ার জীবন থেকে জরুরি অবস্থা যেন ফুরাচ্ছেই না। জরুরি অবস্থার সময় একবার জেলে গেলেন, দ্বিতীয়বার গেলেন ৫ জানুয়ারির সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আমলে, ২০১৮ সালে। মামলাটাও আবার সেই জরুরি আমলেই করা। কিন্তু ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরের আটকের চাইতে এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। সেবার দেশের প্রধান দুই নেত্রীই বন্দী হয়েছিলেন, এখন খালেদা জিয়া একাই দণ্ড ভোগ করছেন। নাজিমুদ্দিন রোডের নির্জন কারাগারের নিঃসঙ্গ দণ্ডিত এখন একজনই।
জরুরি অবস্থার সময়ের রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রথমে শিথিল ও পরে বাতিল হলেও তার সুফল বিএনপির ঘরে আসেনি। ২০০৯ সাল থেকে মহাজোট সরকার বিএনপিকে যেভাবে হামলা-গ্রেপ্তার-নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাতে বিএনপি যেন এখনো ‘জরুরি অবস্থা’র মধ্যেই আটকে আছে। সেবার খালেদা জিয়াকে কারাগারে কাটাতে হয়েছিল ৩৭২ দিন। এবার তা কত হবে তার দিনগণনা শুরু হয়েছে কেবল।
শুধু খালেদা জিয়া বা বিএনপির হাজারো নেতা–কর্মীই নয়, দলটির সমর্থকদের জীবনেও এটা এক জরুরি অবস্থার মতোই। স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাঁরা করতে পারছেন না, জেল-জুলুম-হুলিয়ার খাঁড়া তাঁদের জীবনের ওপর। একেকটি ঘটনা ঘটে আর কয়েক শ বা হাজার বিএনপি কর্মী আটক হন। খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের ঘটনায়ও প্রায় পাঁচ হাজার নেতা–কর্মী আটক হয়েছেন। যদি দেশের অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষও দলটির সমর্থক হন, তাহলে বলতে হবে বিপুলসংখ্যক মানুষের রাজনৈতিক অধিকার জরুরি অবস্থার সময়ের মতোই খর্ব হচ্ছে। কার্যত না হলেও মানসিকভাবে তাঁরা এখনো জরুরি অবস্থার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন।
তাঁরাই কি শুধু আলাদা করে ভুক্তভোগী? যেকোনো প্রতিবাদই এখন হুমকিতে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথমে ৫৭ ধারা, তারপর ৩২ ধারার পর সাংবাদিক নিপীড়নের আইন বানানো ও বিভিন্নভাবে হুমকিতে রাখার ঘটনা বলে দেয়, রাজনীতি, সমাবেশ এবং মতপ্রকাশের অধিকার সবার জন্য খোলা নেই। যঁারাই বাধা পাবেন, ভয় পাবেন, স্বাধীন নাগরিকের জীবন পাবেন না, তাঁরাই ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার জ্বালা বর্তমানেও বোধ করবেন।
বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা নতুনও নয়, হয়তো শেষও নয়। সাংবিধানিক ধারা-উপধারায় লিখিত সংজ্ঞা দিয়ে একে বোঝা যাবে না। বরং সেসব সংজ্ঞাকে একটু প্রসারিত করে নিলে দেখা যায়, এক স্থায়ী জরুরি অবস্থাই যেন বাংলাদেশের জন্ম থেকে বিরাজ করছে। কেবল রাজনৈতিক দুর্যোগই নয়, সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের বড় অংশের জীবন সর্বদাই ‘বিপদের সম্মুখীন’। আর জনগণের অজুহাতই হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের প্রধান সরকারি যুক্তি।
সংবিধানের ১৪১ গ(১) উপধারা অনুসারে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির সময় বলা হয়েছিল, ‘...দেশে এখন এক জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন।’ একজন বিদেশি কূটনীতিক সে সময় দাবি করেছিলেন, ‘আমাদের উন্নয়নকাজের স্বার্থ রক্ষায় এটাই ছিল একমাত্র পথ’ (Restoring Democracy in Bangladesh, Asia Report, ICG, 28 Apr 2008)। অনেকে তা মেনেও নিয়েছিলেন। বর্তমানেও বিরোধী পক্ষকে দমনের পক্ষে সেই উন্নয়নের যুক্তিও কেউ কেউ মানতে রাজি।
যাহোক, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারির কারণ হিসেবে যে অভ্যন্তরীণ গোলযোগকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, বারবার সেই গোলযোগের ঝুঁকির মধ্যেই তো বাংলাদেশ পড়ছে! ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরের বড় একটা সময় সেই গোলযোগ চলেছিল। এখনো জাতীয় নির্বাচনের দিকে যত এগোচ্ছে বাংলাদেশ, ততই সে রকম গোলযোগের ভয় পাকছে।
বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং অন্যদের অনেকেই প্রায় বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষিত হওয়ায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বশীলতার সংস্কৃতির বড় রকমের ধাক্কা খায়। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার যুক্তি দেওয়া হলেও কার্যত এটা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার ধারাবাহিকতা। এভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র উপায় হলো বলপ্রয়োগ। যেকোনো জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্র প্রধানত আইনের শাসনের বদলে বলপ্রয়োগের হাতিয়ারের ওপরই বেশি নির্ভরশীল থাকে।
গণতন্ত্রে বলপ্রয়োগের হাতটা আইনের দস্তানায় ঢাকা থাকে, পর্দার আড়ালে থাকে; সামনে থাকে আলোচনা-সমঝোতার হাত। নির্বাচন এ রকম এক সমঝোতা, যেখানে বিনা বলপ্রয়োগে ক্ষমতার পালাবদল হবে, সরকারের নবায়ন হবে। যার সমর্থন বেশি তাকে বলপ্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় না। কিন্তু যে শাসন সমর্থনের চাইতে দাপটের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তাকে বলে সমর্থনহীন দাপট (ডমিন্যান্স উইদাউট হেজিমনি)। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা এ রকম মান্যতাহীন (হেজিমনিহীন) দাপটের (ডমিন্যান্স) শাসনেই ছিলাম।
প্রশ্ন হলো সমঝোতার সুযোগ যখন দুই পক্ষেরই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন আবারও কি আমরা বলপ্রয়োগের খেলায় প্রবেশ করলাম? দৃশ্যত, বিএনপি সরকারের নতুন পর্যায়ের বলপ্রয়োগকে এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই মোকাবিলার কৌশল নিয়েছে। গণহারে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের মধ্যে এই ‘শান্তি’ আসলে কতটা টেকসই হবে? যে নামেই ডাকি গোলাপ সুবাস ছড়াবেই, যে নামেই ডাকি গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন লাগবেই। আর তার জন্য চাই এমন পরিবেশ, যাতে কারও পিঠই একেবারে দেয়ালে গিয়ে না ঠেকে। নড়াচড়ার কিছুটা জায়গা, আলোচনার কিছুটা পরিবেশ লাগবেই।
শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নয়, রাষ্ট্রের সবগুলো স্তম্ভের মধ্যে এমন গণতান্ত্রিক লেনদেন ও আলোচনা আপনা–আপনি হবে না। যখন সবাই বুঝবেন যে মীমাংসা করে নেওয়াই মঙ্গলজনক, তখনই সেটা হবে। বিগত জরুরি অবস্থার শেষ সময়ে আমরা দেখেছি অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক পক্ষ দেশে ও বিদেশে আলোচনায় বসেছিলেন। সেই সমঝোতার ফল ছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন। সেই সমঝোতার ফল যদি ভালো হয়, আবার কেন সে রকম কিছু হতে পারবে না?
দুই নেত্রীর জেলে থাকার অবস্থাতেই কিন্তু সেই সমঝোতা হতে পেরেছিল। সুতরাং, খালেদা জিয়া অন্তরীণ বা জেলে থাকা অবস্থাতেও তাঁর বা তাঁর দলের সঙ্গে আলোচনার পথ বন্ধ করা ঠিক হবে না।
- Courtesy: ProthomAlo Feb 21, 2018