বিদেশ থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী সাধারণত সাংবাদিকদের সঙ্গে বসেন। এবার ইতালি থেকে ফিরেও তাই করেছেন। অন্য দেশে এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধানদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেন সাংবাদিকেরা। আমাদের সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন কম। তাঁরা বরং কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর প্রিয় বিষয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করেন, কখনো তাঁর প্রশংসায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
তবে সমস্যা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সম্মেলনে উপস্থিত অনেকের মতো উৎসাহিত বা নির্ভার থাকতে পারেননি দেশের মানুষজন; বিশেষ করে এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখেছেন। আমার প্রিয় মানুষ আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রীর তো বটেই, সরকারেরও।
আমার এই লেখা অবশ্য অন্য একটি বিষয় নিয়ে। সেটি আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক। আমি বিশ্বাস করি, কোনো সরকারের মধ্যে যদি এই অহমিকা ঢুকে যায় যে যতই অজনপ্রিয় হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না, তাহলে সেই সরকার ব্যাংক লুট, প্রশ্নপত্র ফাঁস, যানজট, গুম-খুন-কোনো কিছুরই পরোয়া করবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষমতা হারানো এবং অপকর্মের জন্য বিচারের ভয় থাকে। তখন সরকার কিছুটা হলেও জনগণকে না চটানোর চেষ্টা করে।
এ রকম একটি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অবশ্যই বিএনপির অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিচার ও শাস্তির মধ্য দিয়ে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সরকারের কিছু করার নেই।
তবে সমস্যা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সম্মেলনে উপস্থিত অনেকের মতো উৎসাহিত বা নির্ভার থাকতে পারেননি দেশের মানুষজন; বিশেষ করে এবার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখেছেন। আমার প্রিয় মানুষ আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রীর তো বটেই, সরকারেরও।
আমার এই লেখা অবশ্য অন্য একটি বিষয় নিয়ে। সেটি আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক। আমি বিশ্বাস করি, কোনো সরকারের মধ্যে যদি এই অহমিকা ঢুকে যায় যে যতই অজনপ্রিয় হোক, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না, তাহলে সেই সরকার ব্যাংক লুট, প্রশ্নপত্র ফাঁস, যানজট, গুম-খুন-কোনো কিছুরই পরোয়া করবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষমতা হারানো এবং অপকর্মের জন্য বিচারের ভয় থাকে। তখন সরকার কিছুটা হলেও জনগণকে না চটানোর চেষ্টা করে।
এ রকম একটি নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অবশ্যই বিএনপির অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিচার ও শাস্তির মধ্য দিয়ে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে না গেলে সরকারের কিছু করার নেই।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মনে হয় এ রকম: রায়টা তো আমি দিইনি। রায় দিয়েছেন আদালত। আর মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার দুদক। তিনি এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে তাঁর সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে চলা বিচারটি হয়েছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে। এই বিচারের কারণে ভবিষ্যতে একতরফা নির্বাচন হলে এতে তাঁর সরকারের কোনো দায় নেই। তিনি হয়তো চাইছেন বিষয়টি এভাবেই দেখুক সবাই।
২.
বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার হলে কখনো তা বিশ্বাস করেন না এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ। পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশে তো নয়ই; এমনকি তুলনামূলকভাবে অনেকাংশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থার দেশ ভারতেও এটি হয় না। বিচারিক আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বা মামলার দীর্ঘস্থায়ী কালিমা ললাটে নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘটনাও এসব অঞ্চলে ঘটেছে বেশ কয়েকবার। কারণ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বিচার এসব দেশে কতটা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য করা হয়, কতটা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য, তা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ থেকে যায়।খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পরও তা-ই হয়েছে। বিএনপি ও তার সঙ্গীরা এসব প্রশ্ন তুলছে। তুলছে এমনকি রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগঘেঁষা বাম দলগুলোও। খালেদা জিয়ার রায়ের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ ও বাম মোর্চার যুক্ত বিবৃতি এর প্রমাণ। বিবৃতিতে তারা রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে সব দুর্নীতিবাজের শাস্তি চেয়েছে। তারা বলেছে: ‘জনসম্মতিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী শাসন, ক্ষমতার প্রবল দাপট, বিপুল লুটপাটের অভিযোগ ইত্যাদির কোনো সুরাহা না করে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের অতি উৎসাহের কারণে দেশবাসীর মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।’
দেশবাসীর মধ্যে সত্যি সত্যি এমন ধারণা থাকতে পারে। থাকলে তাদের দোষও দেওয়া যাবে না। আমাদের সবার মনে থাকার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টসহ আরও কতগুলো দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হয়েছিল আরও বেশি। তিনি ক্ষমতায় আসার পর প্রধানত বাদীপক্ষের (যেমন দুদক) দুর্বলতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো উচ্চ আদালতে একের পর এক খারিজ হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে বাদী কর্তৃক মামলা প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা বেড়েছে, কোনো কোনো দুর্নীতি মামলার নতুন বা অধিকতর তদন্ত হয়েছে।
সমস্যা এখানেই। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেমন হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বয়ং তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তকারীরা ও আইনজীবীরা একই মাত্রার স্বাধীনতা ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেছেন-এটি বিশ্বাস করা খুবই মুশকিল যে কারও পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, সরকারের সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিদের (লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের) বিরুদ্ধেও দুদককে আমরা লেশমাত্র ভূমিকা পালন করতে দেখি না, যা দেখেছি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তাদের অতি উত্সাহী কর্মকাণ্ডে।
দুদক বা পুলিশ যে-ই করুক, মামলার তদন্ত আর সরকারি আইনজীবীদের আইনি লড়াই মামলার ভাগ্য গড়ে দেয় অনেকাংশে। বাকি থাকেন আদালত। এটি ঠিক যে এ দেশে বহুবার আদালত তাঁর স্বাধীন সত্তা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে এখন তা আর কতটা করা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলার রায়কে কেন্দ্র করে মাত্র কয়েক মাস আগে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি দেশ ও চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। গত বছর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি মামলা চলাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের লোকজন নানা বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিচারিক আদালতের রায় তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে মেলেনি বলে সেই বিচারককে তিরস্কৃত হতে হয়েছিল, রায় দেওয়ার পর তাঁকেও দেশত্যাগ করতে হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটি রাজনৈতিকভাবে আরও স্পর্শকাতর। এই মামলা চলাকালীন বহুবার ‘খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন’ এই বক্তব্য দিয়ে সরকারের লোকজন তাঁদের পছন্দের বা প্রত্যাশিত রায় কী তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার মামলায় বিচারিক আদালত কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এমন এক প্রেক্ষাপট আপিল আদালতের স্বাধীনতার জন্যও অনুকূল নয়।
৩.
খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের কপি মাত্র তাঁর আইনজীবীরা হাতে পেয়েছেন। ইতিমধ্যে এই রায়ের কিছু দিক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠছে। উচ্চ আদালতে আপিলের সময় এই রায়ের আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে।এই আপিল নিষ্পত্তিতে খালেদা জিয়ার সাজা নিশ্চিত হতে পারে, আবার তিনি খালাসও পেতে পারেন। আপিল নিষ্পত্তির আগেই তিনি জামিন লাভ করতে পারেন এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগও পেতে পারেন। সিদ্ধান্তগুলো যা-ই হোক না কেন, খালেদা জিয়ার মামলায় আপিল প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে সুবিচার হয়েছে-এটি মানুষের কাছে প্রতিভাত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, ন্যায়বিচারের দর্শন হচ্ছে ন্যায়বিচার শুধু করলে হবে না, এটি যে ন্যায়বিচার হয়েছে তা দৃশ্যমান ও সন্দেহাতীতভাবে দেখানোর প্রয়োজনও রয়েছে।
খালেদা জিয়ার বিচারের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন আরও বেশি মামলাটির রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। এই বিচার যদি শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধই থাকে, তাহলে বিএনপির অন্য নেতাদেরও প্রশ্নবিদ্ধভাবে নির্বাচনের আগে সাজা দেওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এ ধরনের আশঙ্কা না থাকলে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের কথা নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- Courtesy: Prothom Alo/22-02-2018