- রাকিব আহমেদ ও বখতিয়ার আহমদ দুজনই জনপ্রতিনিধি।
- আড়ালে চলে রাকিব ও বখতিয়ারের ইয়াবা ব্যবসা।
- রাকিব ইউপি সদস্য হওয়ার আগে দুবার গ্রেপ্তার হন।
- বখতিয়ার ইউপি সদস্য হওয়ার পরও একবার গ্রেপ্তার হন।
- জামিনে বেরিয়ে এসে দুজন ফের ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন।
কক্সবাজার থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইয়াবা সরবরাহ করেন তাঁরা দুজন। রয়েছে নিজস্ব বিতরণকারী। গাড়িতে করে এদের দিয়ে চাহিদামতো ইয়াবা পৌঁছে দেন ক্রেতাদের কাছে। দুজনেই জনপ্রতিনিধি। এরই আড়ালে চলে তাদের ইয়াবা ব্যবসা।
ইয়াবা ব্যবসায়ী দুজন হলেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রাকিব আহমেদ এবং উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদ। বখতিয়ার পালংখালি ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আর রাকিবের কোনো পদবি না থাকলেও স্থানীয় সাংসদের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এরই মধ্যে ইয়াবা সরবরাহে ব্যবহৃত তাঁদের দুটি গাড়ি আটক করেছে। উদ্ধার করেছে তাঁদের মালিকানাধীন দুই লক্ষাধিক ইয়াবা।
এলাকাবাসী জানান, ২০০৮ সালের দিকেও রাকিব রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসকের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। ইয়াবা ব্যবসা করে তিনি রাতারাতি বড়লোক বনে যান। ২০১৬ সালে বিপুল অর্থকড়ি খরচ কেরে ইউপি সদস্য নির্বাচনে অংশ নেন। আর বখতিয়ার একসময় উখিয়ার রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাকে বিভিন্ন জিনিসপত্র জোগান দিতেন। রাকিব ইউপি সদস্য হওয়ার আগে দুবার ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হন। বখতিয়ার ইউপি সদস্য হওয়ার পরও একবার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে তাঁরা আবারও এই ব্যবসা শুরু করেন।
জানতে চাইলে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সরোয়ার বিন কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানতে পেরেছেন এই দুই ইউপি সদস্য এখন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা দুজনে একত্রে ব্যবসা করেন। তাঁরা নিয়মিতই রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় ইয়াবা পাঠান বলে তাঁদের কাছে তথ্য আছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি-ব্লকের ১৫০ নম্বর সড়কের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেন র্যাব-১-এর সদস্যরা। ওই বাসার গ্যারেজে রাখা সাদা রঙের একটি হাইএস গাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আরও এক লাখ ইয়াবা। এই ঘটনার এক মাস পর গত ২৫ মার্চ উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে একটি কালো মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ ১৫-৬৬৫২) আটক করা হয়। তল্লাশি চালিয়ে ওই গাড়ি থেকে প্রায় ৭৪ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এই দুই ঘটনায় গ্রেপ্তার নয়জন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, গাড়ি এবং ইয়াবার মালিক রাকিব ও বখতিয়ার। তাঁরা চালান নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন ক্রেতাদের সরবরাহ করার জন্য।
উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ওসি মো. মাকসুদ আলম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বখতিয়ার মাদকের মামলায় এখন কারাগারে আছেন। আর রাকিব আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট নন। হোয়াইক্কং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে ফাঁসানোর জন্য এসব অভিযোগ এনেছে।
বসুন্ধরায় ছিল ‘ট্রানজিট ও ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট’
ঢাকায় রাকিব ও বখতিয়ারের ইয়াবার ব্যবসা দেখতেন সিরাজুল ইসলাম ওরফে রুবেল নামে এক ব্যক্তি। খুলনার দৌলতপুরে তিনি একসময় দোকানে দোকানে গেঞ্জি বিক্রি করতেন। পরে রাকিব ও বখতিয়ারের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। তাঁর মূল কাজ ছিল ইয়াবার চালান কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা। বিনিময়ে প্রতি চালানের জন্য তিনি ৪০ হাজার টাকা করে পেতেন।
বসুন্ধরার বাসাটি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় যে মামলা করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়ানোর জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বসুন্ধরার বাসাটি ভাড়া নেন সিরাজুল ইসলাম। প্রতি মাসে বাসা ভাড়া ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করতেন রাকিব ও বখতিয়ার।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সিরাজুল ও অন্যরা জানিয়েছেন বসুন্ধরার এ বাসাটি ছিল মূলত এই চক্রের ‘ট্রানজিট ও ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট’। টেকনাফ থেকে ইয়াবা আসার পর ঢাকা, নরসিংদী ও দোহার এলাকায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিতরণের জন্য এই ফ্ল্যাটে রাখা হতো। আর রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি ও উত্তরার এলাকার ব্যবসায়ীরা সরাসরি ওই ফ্ল্যাট থেকেই ইয়াবা সংগ্রহ করতেন। চালানের একটি অংশ রাকিবের মাইক্রোবাসে করেই খুলনা, যশোর ও বেনাপোল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হতো।
গাড়িতে ছিল ইয়াবার ‘গোপন চেম্বার’
রাকিব ও বখতিয়ারের আটক মাইক্রোবাস দুটোতেই ইয়াবা বহনের জন্য বিশেষ কুঠুরি তৈরি করা হয়েছিল। বসুন্ধরার বাসা থেকে যে গাড়িটি আটক করা হয়েছিল সেটির সিটের নিচের ফ্লোর কেটে বানানো হয়েছিল প্রকোষ্ঠটি। সেখানেই ছোট ছোট নীল রঙের ৫০০টি পলিব্যাগে রাখা ছিল ইয়াবাগুলো। আবদুল্লাহপুর থেকে যে গাড়িটি আটক করা হয় সেটিতেও একই রকম প্রকোষ্ঠ ছিল।
গাড়িতে ইয়াবার চালান
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার চারজনের একজন মফিজুল ইসলাম ওরফে কুট্টি। টেকনাফ থেকে গাড়ি চালিয়ে বসুন্ধরার বাসায় ইয়াবার চালানসহ গাড়িটি চালিয়ে আসেন তিনি। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মফিজুল।
মফিজুল জানিয়েছেন, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজুল তাঁকে ফোন দিয়ে ঢাকায় বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন রনি নামে সিরাজুলের এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজারে যান। পরদিন সকালে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের দিকে যান তাঁরা দুজন। সেখানকার একটি পেট্রলপাম্পে রাকিব ও বখতিয়ারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা তাঁকে পেট্রলপাম্পে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যান। কিছুক্ষণ পর গাড়িটি নিয়ে আসেন। রাকিব ও বখতিয়ার তাঁকে গাড়িটি ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। পরদিন তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন।
র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মফিজকে রেখে রাকিবেরা যখন গাড়িটি নিয়ে যান তখনই গাড়িতে ইয়াবার চালান ঢোকানো হয়। গাড়িটি ঢাকায় আনার পর এক ব্যক্তি এলে তাঁকে গাড়ির চাবি দিয়ে দিতে মফিজুলকে বলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার আগেই অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ও গাড়ি আটক করা হয়।
জানতে চাইলে টেকনাফের র্যাব-৭-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, র্যাব-১-এর হাতে চালান দুটি ধরা পড়ার পরই তাঁরা বখতিয়ার ও রাকিবের বিস্তৃত সিন্ডিকেটের কথা জানতে পারেন। তাঁদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সময়মতো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- Courtesy: Prothom Alo/ May 25, 2018