স্টিভ সিমা
মিয়ানমারে নৃশংসতার শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে চলমান এক মানবিক সংকট। এই সংকট নিয়ে লড়াই করার কারণে বাংলাদেশের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন ও অন্যান্য দেশ এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা দেশের ভেতর ক্রমবর্ধমান অকার্যকর গণতন্ত্রের দিকে নজর দিচ্ছে কমই। বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশ।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণতন্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়েছে। নির্বাচনের পথে প্রবেশ করেছে এ দেশ। নতুন মেরুকৃত বহুদলীয় প্রতিযোগিতা ও একদলীয় শাসনের মধ্যে এই নির্বাচন হতে পারে একটি ‘টিপিং পয়েন্ট’। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের দিকে যেমন নজর দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, ঠিক তেমনইভাবে বাংলাদেশের অবনমনশীল গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিষয়েও চাপ দেয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট দিয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অব্যাহতভাবে কঠোর থেকে কঠোরতর রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন। মিডিয়ার ওপর আক্রমণ চালিয়ে, বিচার বিভাগে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের জেলে ঢুকানোর মতো নিষ্পেষণমূলক পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ এমন অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে। ২০১৩-২০১৪র নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক আকারে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং এই সহিংসতায় অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক এই বৈরিতার ফলে নির্বাচনে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতাকে খর্ব করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। একে রাজনৈতিক বলে দাবি করছে বিএনপি। দেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযোগ্য। সেই হিসেবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখাও হতে পারে। এর ফলে ২০১৯ সালের জানুয়ারির আগেই যে নির্বাচন হওয়ার কথা তা বর্জন করতে পারে বিএনপি, যেমনটা তারা পাঁচ বছর আগে করেছিল।
এর বাইরেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রে আরো অনেক চাপ রয়েছে। এগুলো হলো দুর্নীতি, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, জনসংখ্যাতত্ত্ব, পরিবেশগত বিপর্যয় ও ইসলামপন্থি উগ্রবাদ। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত এক জনমত জরিপ অনুযায়ী, দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশিরা।
দেশটির নাগরিকরা অভিযোগ করছেন যে, সেখানে উচ্চ মাত্রায় বেকারত্ব, পণ্যমূল্য বৃদ্ধিসহ আরো নানা রকম অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারা বলছেন, ঘুষ ও অন্যান্য দুর্নীতির কারণে চাকরি পাওয়া, আইনের শাসন পাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া, শিক্ষা ও সরকারি অন্যন্য পণ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত।
উপরন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রয়েছে নাজুক অবস্থায়। বিশেষ করে বাংলাদেশি নারীরা বসবাস করছেন যৌন হয়রানির এক আশঙ্কা নিয়ে, যার বিচার পাওয়া দুরূহ। নাগরিকদের মূল ক্ষোভ রয়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে। নিজ দেশের গণতন্ত্রের মান, রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রকে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
আসন্ন নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য, অধিকতর কার্যকর, দায়িত্বশীল হওয়া, প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ও বিরোধী দল হওয়ার জন্য একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারে। এটা করতে হলে দলগুলোকে তাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র তাদের সহায়তা করতে পারে। ডেমোক্রেসি অ্যাসিসট্যান্ট হলো একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক উদ্যোগ। এখান থেকে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা অন্য নতুন গণতন্ত্রপন্থিদের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরতদের জন্য সহায়তা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এমন কিছু সংগঠনের মধ্যে অন্যতম হলো আইআরআই। তারা বছরের পর বছর গণতান্ত্রিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এই উদ্যোগগুলো একবার এখানে দেখে নেয়া যেতে পারে। যেমন:
ফলপ্রসূ রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা: ২০১৭ সালে আইআরআই এর চালানো এক জরিপ অনুযায়ী, শতকরা ৬৬ ভাগ বাংলাদেশি চান আওয়ামী লীগ অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা গড়ে তোলার জন্য বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ আয়োজন করতে থাকে আইআরআই। সেখানে রাজনৈতিক মূল বিষয় ও নিরাপত্তামূলক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দলের সিনিয়র পর্যায়ের নেতারা এমন বৈঠককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সমর্থন করেছিলেন।
পক্ষপাতহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুবকদের সংযুক্ত করুন: আগামী বছরে আইআরআই তরুণ, যুবকদের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপমূলক কর্মসূচি বিস্তৃত করবে। এক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেমিনার আয়োজন করবে। সেখানে পক্ষপাতহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও গঠনমূলক ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা হবে। যুবকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে।
নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের সততায় সমর্থন: গত নির্বাচনগুলোর সময়ে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক, প্রশিক্ষক, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের সমর্থনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষণে নির্বাচনে প্রতারণা বা সহিংসতার বিষয়ে ধরা পড়ে।
নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সক্ষমতা বাড়ানো: অতীতে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করেছে আইআরআই। তাদেরকে শক্তিশালী করা হয়েছে নজরদারি করতে। জনগণকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও নির্বাচনে দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে: একটি অকার্যকর অথবা দলীয় নিরাপত্তা খাত এবং নির্বাচন কমিশন নির্বাচন নিয়ে আস্থাকে খর্ব করতে পারেন। নির্বাচনী সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারেন আন্তর্জাতিক অ্যাক্টররা। প্রশিক্ষিণ দিতে পারেন। সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন।
সর্বোতভাবে দেশের অবনমনশীল গণতন্ত্রকে মেরামত করতে পারেন বাংলাদেশিরা নিজেরাই। নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে শুধু আন্তর্জাতিক দাতারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারেন না। কিন্তু যদি যথাযথভাবে টার্গেট করা হয় এবং অর্থায়ন হয় তাহলে তারা নাগরিক, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুরুতর ইস্যু নিয়ে বিতর্কের আয়োজন করতে পারে, যা দেশের ওপর প্রভাব ফেলবে। এটা হবে অগ্রগতিমূলক।
(বাংলাদেশ অ্যান্ড শ্রীলঙ্কা অ্যান্ড জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড-এর আবাসিক প্রোগ্রাম পরিচালক স্টিভ সিমা। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক প্রিন্সিপাল গবেষকও তিনি। গতকাল অনলাইন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন-এ প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)
- Courtesy: Manabzamin /June 06, 2018