- ব্যবসায়ীদের
সুবিধা দিয়ে দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ
- বাজেট পাসের ৭০
দিনের মাথায় ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা
- পোশাক
রপ্তানিকারকদের উৎসে ও করপোরেট কর কমল
- নগদ সহায়তা পেল
আরও ৯ খাত
- রাজস্ব আদায় কমবে,
লাভ বাড়বে ব্যবসায়ীদের।
নির্বাচনের বছরে
ব্যবসায়ীদের আরও বেশি সুবিধা দেওয়া হলো। করে যেমন ছাড় দেওয়া হলো, তেমনি নগদ সহায়তাও বেড়েছে। তৈরি পোশাক
রপ্তানিকারকদের উৎসে কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের করপোরেট করও কমানো হয়েছে। এর
ফলে পোশাকমালিকদের লভ্যাংশ আরও বাড়বে।
দেশের বৃহত্তম
রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি করলে দশমিক ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে। আগে
ছিল দশমিক ৭ শতাংশ। আর করপোরেট করহার ১৫ থেকে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে
রপ্তানিমুখী খাতে নগদ সহায়তা দেওয়ার পরিধিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুরোনো খাতগুলোর
পাশাপাশি আরও ৯টি নতুন খাতের রপ্তানিকারকেরা এখন থেকে নগদ সহায়তা পাবেন। নগদ
সহায়তার রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ওষুধ, মোটরসাইকেল, সিরামিকপণ্যের বড়
খাত আছে।
বাজেট পাসের ঠিক
৭০ দিনের মাথায় সরকার ব্যবসায়ীদের বিশেষ এই সুবিধা দিল। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের
(এনবিআর) রাজস্ব আদায় কমবে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী লবিংয়ের কারণেই এই সুবিধা
আদায় করতে পেরেছেন। অর্থবছরের মাঝে এভাবে সুবিধা দিলে বাজেট প্রক্রিয়া বিঘ্নিত
হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গতকাল সোমবার একই
দিনে ব্যবসায়ীদের এ ধরনের সুবিধা দিয়ে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পৃথক
প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এখন থেকে তৈরি পোশাক খাতসহ সব
খাতকেই (পাটপণ্য ছাড়া) রপ্তানিকালে দশমিক ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে। গত ১
জুলাই থেকে এই হার কার্যকর করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। দেশ থেকে যত পণ্য রপ্তানি
হয়, এর ৮৩ শতাংশের বেশি হয়
তৈরি পোশাক। প্রতিটি রপ্তানি চালান বন্দর দিয়ে জাহাজীকরণের আগেই উৎসে কর কেটে রাখা
হয়। জাহাজীকরণের আগপর্যন্ত রপ্তানি মূল্যের ওপর বা এফওবি মূল্যের উৎসে কর আরোপ করা
হয়। এ ছাড়া নিট ও ওভেন পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের বার্ষিক আয়ের ওপর আগের চেয়ে
কম, অর্থাৎ ১২ শতাংশ হারে
করপোরেট কর দিতে হবে। আর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সবুজ কারখানা হলে ওই মালিককে ১০
শতাংশ হারে কর দিলেই হবে। দুটি সুবিধাই আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত থাকবে।
সফল বিজিএমইএ
কয়েক বছর ধরেই
তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকদের উৎসে কর দিতে হচ্ছে। এনবিআরে আয়কর
অধ্যাদেশে তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর ১ শতাংশ। কিন্তু তিন বছর ধরে প্রতিবছর
প্রজ্ঞাপন দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকের উৎসে কর দশমিক ৭ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা
হতো। ওই সুবিধার মেয়াদ এক বছর করে, অর্থাৎ জুলাই
থেকে জুন মাস পর্যন্ত এই সুবিধা দেওয়া হতো। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সভায় একাধিকবার বলেছেন, এবার তৈরি পোশাক খাত আর বাড়তি কোনো সুবিধা পাবে
না। তিনি কথামতো বাজেটে তা করেছেনও। বাজেটে তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর কমানো হয়নি।
বরং বার্ষিক করপোরেট করহার বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ এবং সবুজ কারখানা হলে ১২ শতাংশ
নির্ধারণ করা হয়।
এ বিষয়ে এনবিআরের
সদস্য (করনীতি) কানন কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটের পর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে যখন ১
শতাংশ উৎসে কর হয়ে গেল, তখন পোশাক
রপ্তানিকারকদের কাছে তা বোঝা হয়ে গেল। তখন তাঁরা কর কমানোর দাবিটি আরও জোরালোভাবে
করতে থাকেন। যেহেতু তাঁরা দেশের প্রধান রপ্তানিকারক, সে জন্য তাঁদের কিছুটা কর-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
তিনি মনে করেন, এতে অল্প কিছু
রাজস্ব কমতে পারে। তবে নতুন নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে মোট রপ্তানির
পরিমাণ বৃদ্ধির সুযোগও আছে। তখন কর কমানোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
গত জুন মাসে চলতি
অর্থবছরের বাজেটের পর প্রতিক্রিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ও উৎপাদকদের সংগঠন
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, ‘সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলে করপোরেট কর ও
উৎসে কর কমিয়ে আনব।’
অর্থমন্ত্রী কথা
রাখতে না পারলেও বিজিএমইএ সভাপতি নিজেদের দাবি আদায় করতে পেরেছেন। বাজেট ঘোষণার
তিন মাস পর এনবিআর তৈরি পোশাক খাতের উৎসে কর ও করপোরেট কর কমিয়ে দিল।
চলতি অর্থবছরে ৩
হাজার ২৬৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা কর
আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। উৎসে কর কমানোর ফলে এই খাতে কর আদায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা
কমে যেতে পারে।
পোশাক রপ্তানিতে
উৎসে কর গতবারের চেয়ে কমানো হলেও খুশি নন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান।
গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে
ভারতের রুপি, তুরস্কের লিরা ও
চীনের ইউয়ানের দাম কমছে। অন্যদিকে আমাদের ব্যবসার খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শিগগিরই
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বাড়বে। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা রাখতে ও শিল্পকে
টিকিয়ে রাখতে হলে পাঁচ বছরের জন্য কোনো ধরনের কর থাকা উচিত নয়।’
নগদ সহায়তা পাবে
নতুন ৯ খাত
রপ্তানির বিপরীতে
নগদ সহায়তার তালিকায় আরও নয়টি খাতকে যুক্ত করল সরকার। গতকাল সোমবার জারি করা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন করে ওষুধ, মোটরসাইকেল,
রাসায়নিক পণ্য (ক্লোরিন,
হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড,
কস্টিক সোডা ও হাইড্রোজেন
পার-অক্সাইড), রেজার ও রেজার
ব্লেডস, সিরামিকপণ্য এখন
থেকে নগদ সহায়তা পাবে।
সামগ্রিক বিষয়ে
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক
আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই তৈরি
পোশাক খাতের নেতারা সরকারের উচ্চপর্যায়ে লবিং করে দাবি আদায় করে থাকেন। এটা
সাধারণত বাজেট প্রক্রিয়ার মধ্যেই হয়। তবে এবার তা বাজেট প্রক্রিয়ায় না হয়ে জাতীয়
নির্বাচনের প্রাক্কালে করা হলো। নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের সদিচ্ছা
প্রকাশের কৌশলও হতে পারে। এবার ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের উদারতা একটু বেশি মনে
হচ্ছে। এভাবে নীতি পরিবর্তন করা ঠিক নয়। এটি বাজেট প্রক্রিয়াকে হীনম্মন্য করে
তোলে। ব্যক্তির ক্ষমতা প্রকাশ পায়।
Courtesy: Prothom Alo Sep 11, 2018