Search

Thursday, January 3, 2019

একটি বিতর্কিত নির্বাচন ও বাংলাদেশি রাজনীতির বিপজ্জনক নবযুগ

মানবজমিন ডেস্ক 
(সিএনএন- প্রকাশিত নিবন্ধের ভাবানুবাদ। নিবন্ধটি লিখেছেন মাইকেল কুগেলম্যান।

চট্টগ্রামে ভোটের আগে ব্যালট বাক্স ভরা পেলেন বিবিসি'র সাংবাদিক





নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে গত ৩০শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের সরকার পুনঃনির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মতে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট ৩০০ আসনের মধ্যে বিস্ময়করভাবে ২৮৮টি আসনে জিতেছে। প্রত্যাশিতভাবেই বিরোধী দলগুলো ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।

তিক্ত সহিংসতাপূর্ণ পক্ষপাতের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিমধ্যেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিতর্কিত নির্বাচনের ফল সে রাজনীতিকে নতুন আরেকটি বিপজ্জনক যুগে ঠেলে দিতে পারে। বিরোধীদের ক্ষোভ দেখানোর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ কয়েক বছর ধরেই বিরোধীদের দুর্বল করে দেয়ার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের দমন-পীড়নের অন্যতম উপায় হলো ঢালাও গ্রেপ্তার
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কয়েকজন শীর্ষ বিরোধী নেতা জেলে রয়েছেন। এতে দুর্বল হয়ে পড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন তার আগের সত্তার প্রতিচ্ছায়ায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্মম রাজনৈতিক দমন-পীড়ন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ধারণাকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করেছে।

এসব দমন-পীড়নকে অগ্রাহ্য করে বিএনপি নতুন জোটকে নিয়ে প্রচারণা চালায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এটা ভাবা কঠিন যে, সন্দেহজনকভাবে ভারসাম্যহীন একটি নির্বাচনী ফল নিয়ে বিরোধী দল চুপ করে বসে থাকবে। আওয়ামী লীগের বিস্ময়কর বিজয় নিয়ে বিরেীধদলসহ অন্য সমালোচকরা বলছেন, এটাইলেকশননা, বরং এটাসিলেকশন আর যারা সরকারের কঠোর আইন কৌশলকে সমর্থন করেন, তারা সাফাই গাইছেন যে, এটা ধর্মীয় কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের বিজয়। এতে অবদান রেখেছে দেশের আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি। যদিও আওয়ামী লীগ তাদের ভোটব্যাংক বৃদ্ধি করার জন্য ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধেছে। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম অন্যতম। এটি দেশের সবচেয় বড় ইসলামী সংগঠন

প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরা সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা খারাপ মানবাধিকার রেকর্ডকে এড়িয়ে চলতে চান। কেননা তারা মনে করেন, দল তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর যোগান দিচ্ছে। আর এটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধরনের মানুষরা সরকারের কর্তৃত্ববাদী নীতিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। 

আয়ের অসমতাসহ কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনক হওয়ার পরেও তা শক্তিশালী জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিচে চাপা পড়েছে। আর এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কর্মকা-ের সমালোচনা দলটির সাধারণ সমর্থকদেরকে প্রভাবিত করে না। 

এটা বলা যায় না যে, আওয়ামী লীগ ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে কারচুপি করেনি। বিপরীতে, এটা বিশ্বাস করা যায় না যে, কোনো দল পার্লামেন্টে ৯৫ শতাংশেরও বেশি আসন পেতে পারে। তা যত জনপ্রিয়তাই থাকুক না কেন। বরং লক্ষণীয় বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনসমর্থন আছে। ভোট পাওয়ার জন্য বা সংকটের সময়ে দলটি এর ওপর নির্ভর করতে পারে।

এদিকে, বিরোধীদের নতুন নির্বাচনের দাবি প্রত্যাশিতভাবেই নির্বাচন কমিশন প্রত্যাখ্যান করেছে। বাস্তবে, অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানানো ছাড়া বিরোধীদের হাতে ক্ষোভ প্রকাশের উপায় খুবই কম। বিএনপি এর মিত্রদের রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রতিবাদের সামর্থ্যরে অভাব রয়েছে। যা তাদের দুর্বল অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছে। বিরোধীজোটের খুব কম সংখ্যক নেতাই ক্ষমতাসীন দলের এমন একতরফা বিজয় প্রত্যাশা করেছেন। বিরোধীদের মধ্যকার এই ক্ষোভ থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা সহিংসও হয়ে উঠতে পারে। ধরনের বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা উস্কে দিতে পারে।

প্রশ্নবিদ্ধভাবে ক্ষমতাসীন দল আরো পাঁচবছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ এখন একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার খুব নিকটে রয়েছে। ভবিষ্যতে  শক্তিশালী ক্ষমতাসীন দল গুরুত্বহীন বিরোধীদলের মধ্যে যে কোনো ধরনের সহাবস্থান কল্পনা করা খুবই কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে কোনো সমঝোতার পরিবেশও তৈরি হয় না।

অবস্থায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট। একদিকে, জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে উন্নয়ন জোরদার করতে বাংলাদেশ তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে, নির্বাচনী বিজয়ে উজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখতে পারে। যতদিন পর্যন্ত দলটি মনে না করবে যে, তাদের এই দমন-পীড়ন বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, বিনিয়োগকারীদের বাধাগ্রস্ত করছে, ততদিন দলটি তাদের এই কর্মকা- চালিয়ে যাবে। বিরোধীরা দুর্বল অবস্থায় যতটুকু সম্ভব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে। ক্রমবর্ধমান এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ জামায়াতে ইসলামীর মতো কট্টরপন্থি দলগুলোকে উগ্রপন্থার দিকে উস্কে দিতে পারে।

আরো ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের তরুণরা আশঙ্কাজনকভাবে গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে। যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সামনে সহিংস উদ্বেগের দিন অপেক্ষায় রয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলি, ভাঙচুর

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আওয়ামী লীগের দুই অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগ ছাত্রলীগের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সময়অ তাদের মধ্যে কয়েক রাউন্ড গুলি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের কাছে সংঘর্ষ হয়। শাহবাগ থানা সূত্রে জানা যায়, বাজারের কাছে একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাইনবোর্ড লাগানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধে।

একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মীদের ধাওয়া দেয়। পরে তারা পালিয়ে যায়।
শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান বলেনছাত্রলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ঘটনার কিছুক্ষণ পরই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায় 
Courtesy: Prothom Alo Jan 03, 3029

আটক সাংবাদিককে মুক্তি দিন

ডিজিটাল আইনে মামলা


বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়ের পরে যখন সাংবাদিক সমাজ স্মরণে আনছিল যে, ডিজিটাল আইন বাতিলে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তখনই খুলনা থেকে প্রথম খবর এল সাংবাদিক গ্রেপ্তারের। খুলনা- (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনের নির্বাচনের ফলাফলের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়েছে। একটি তথ্যগত গরমিলবিষয়ক রিপোর্ট নিয়ে যেভাবে জেলা, উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগ ডিজিটাল আইনে মামলা, গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ল, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন
যে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তঁারা হচ্ছেন অনলাইন নিউজ পোর্টালবাংলা ট্রিবিউন ইংরেজি দৈনিকঢাকা ট্রিবিউনেরখুলনা প্রতিনিধি হেদায়েত হোসেন মোল্লা এবং খুলনা প্রেসক্লাবের নবনির্বাচিত সহসভাপতি, ন্যাশনাল রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মানবজমিন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মো. রাশিদুল ইসলাম। রিটার্নিং কর্মকর্তার বরাতে একই তথ্য অন্তত চারটি সংবাদমাধ্যমে (সময় টিভিবাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলা ট্রিবিউন  মানবজমিন) পরিবেশিত হলো, অথচ সাংবাদিকেরাই ভুল করেছেন অনুমান করে তঁাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার রিমান্ডের মতো ঘটনা ঘটে গেল। হেদায়েত হোসেন আটক হওয়ার পর তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে আর রাশিদুল ইসলাম এখন আত্মগোপনে আছেন

যুক্তির নিরিখেই আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, সাংবাদিকেরা ভ্রান্ত ছিলেন, সেটা অনুমানসিদ্ধ বিষয় হলে কেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ভুল করে থাকতে পারেন, সেটা অনুমানসিদ্ধ বিষয় হবে না? বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা শুরুতে যে তথ্য দিয়েছিলেন, তা প্রচার করা হয়েছে। সেই তথ্য যদি ভুল হয়ে থাকে তবে তা প্রচারের দায়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হবে কেন? আর কোনো তথ্যগত গরমিলবিষয়ক রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি এভাবে আইন তারনিজস্ব পথেচলতে শুরু করে, তাহলে তো যেকোনো সংবাদমাধ্যমের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে যে, তথ্যগত ভুল হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রথমে প্রতিবাদ জানান। এটা আত্মপক্ষ সমর্থন দেওয়ার সর্বজন স্বীকৃত সুযোগ।

ডিজিটাল আইন সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগ না করার যে প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছিলাম, সে বিষয়ে আমরা ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করি। এই ধারায় যদি ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ চলতে থাকে, তাহলে ইতিপূর্বে যে কারণে সমগ্র সাংবাদিক সমাজ মানববন্ধনে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল, তা সত্যে পরিণত হবে। আর সে ক্ষেত্রে স্বাধীন সাংবাদিকতা অধিকতর হুমকির মুখে থাকবে এই ঘটনা ডিজিটাল আইন বাতিলের দাবিকে আরও যৌক্তিক করে তুলল। আমরা আবারও এই আইন বাতিলের দাবি জানাই। একই সঙ্গে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার আটক সাংবাদিকের মুক্তি দাবি করছি। 
Courtesy: Prothom Alo Jan 03, 2019