আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। পিলখানা হত্যার দশম বছর। বিদ্রোহের নামে ২০০৯ সালের এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে বিডিআর’র (বর্তমান বিজিবি) তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও ছিলেন। উচ্ছৃঙ্খল কিছু জওয়ান তৎকালীন ডিজির স্ত্রীসহ সামরিক-বেসামরিক আরো ১৭ জন মানুষকে হত্যা করে। বিপথগামী জওয়ানরা সেদিন যে তাণ্ডব চালায় আজও তা মানুষের মনে রক্ত ঝরায়। মানুষ এখনো সেই তাণ্ডব ভুলতে পারেনি।
শুধু হত্যাই নয়, অফিসারদের স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনকে আটকে রেখে যে নির্মম নির্যাতন চালায় উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা; তা মনে উঠলে মানুষ এখনো শিউরে ওঠে। কর্মকর্তাদের বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়ে ছাই করে দেয় উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা। লুটপাট করা হয় কর্মকর্তাদের সম্পদ। সেনা কর্মকর্তাদের শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যন্ত হয়নি ঘাতকরা। আলামত নষ্ট করতে প্রথমে তাদের লাশগুলো পুড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। ব্যর্থ হয়ে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়। ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেয়।
যা ঘটেছিল সেদিন
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন পিলখানায়। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মাঝে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিল। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহি মইন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্য কর্মকর্তারা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সাথে সাথে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের দাবি-দাওয়া শুনবেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়। একপর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। জওয়ানরা কর্মকর্তাদের যাকে যেভাবে পেয়েছে তাকে সেভাবে হত্যা করেছে। অনেকে ভেতরেই কোথাও গোপন স্থানে অবস্থান নেন। সেসব স্থান থেকে তাদেরকে খুঁজে খুঁেজ বের করে হত্যা করা হয়। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে বিডিআর জওয়ানরা।
এসবই করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙে অস্ত্র এবং ম্যাগাজিন ভেঙে গুলি তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতঙ্কে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি। বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ড মাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন তৎকালীন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মাইকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআরের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এর পরও তারা অস্ত্র সমর্পণ ও বন্দীদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুনের সাথে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করে। কিন্তু পর দিনও থেমে থেমে গুলির শব্দ আসতে থাকে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্র সমর্পণ করেছে।
এ দিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ উদ্ধার। একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৫টি লাশ। এভাবে উদ্ধার হয় ৫৭ সেনাকর্মকর্তা ও সামরিক-বেসামরিকসহ মোট ৭৪ জনের লাশ।
বিচারকাজ
নৃশংস এই ঘটনার পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা দায়ের হয়। মামলায় অভিযুক্ত অনেকেই ইতোমধ্যে সাজাভোগ করে বেরিয়ে গেছে। ঘটনার ব্যাপারে নিউ মার্কেট থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দু’টি মামলা হয়। হত্যা মামলায় নি¤œ আদালতে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছাড়াও আরো ৪২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আসামিরা এ ব্যাপারে আপিল করেন উচ্চ আদালতে। পরে গত বছরের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেয়া হয়। নি¤œ আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকাবস্থায় দু’জনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ জন আসামি। নি¤œ আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যে আপিল করেছিল, তার মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়া সাত বছর করে চারজনকে কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রাখা হয়। এ মামলার সাড়ে ৮০০ আসামির মধ্যে আরো ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন জজ আদালত। এর মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড, আটজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড, চারজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ২৯ জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট।
- নয়াদিগন্ত/ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯।