Search

Monday, October 7, 2019

অসামান্য বালিশ ও ক্যাসিনো কেস

কাজী জেসিন


কাজী জেসিন
পুরোটাই লুটপাটের টাকায় জুয়াখেলা। ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো চলে আসছে বছর বছর ধরে। সাধারণ মানুষ কেউ কিছুই জানে না। কিন্তু, কিছু মানুষ না জানলে তো ক্যাসিনো ক্লাবগুলো তার গ্রাহক পেতো না, কোটি কোটি টাকা আয় হতো না, মজুদ হতো না ভরি ভরি সোনা। ক্যাসিনো থেকে সর্বস্ব হারিয়ে কেঁদে বের হয়ে যাওয়া মানুষের চোখের জল আশেপাশের মানুষ দেখেছে। তবু রাষ্ট্রের নজরে আসেনি। রাষ্ট্রতো অন্ধ না। রাষ্ট্রের চোখ আছে।

যে রাষ্ট্র ডিজিটাল তার তো চোখ, নাক, কান আরও সুতীক্ষ্ণ। যখন তখন সে রাষ্ট্র নামের কারিগর যার-তার ফোনে আড়ি পাততে পারে,  যখন খুশি যে কারো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারে। ডিজিটাল রাষ্ট্র বলে কথা। কিন্তু এই রাষ্ট্র গত দশ-বারো বছরে কোথায় কিভাবে ক্যাসিনো চলেছে তা দেখতে পায়নি। তাহলে এখন দেখতে পেলো যে! কী অদ্ভুত!

সাধারণ মানুষ বিগত বছরগুলোতে দেখে এসেছে কিভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার বাণিজ্য নিজেদের আয়ত্তে নিতে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কখনও কখনও হানাহানি, মারামারি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগের টেন্ডার নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষ, হত্যা বাংলাদেশের মানুষের সামনে একটা অতি পরিচিত চিত্র। সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠন সংবিধান লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির মহাউল্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশানস কনভেনশান এগেইন্সট করাপশান (টঘঈঅঈ) এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দূর্নীতি নির্মূলের জন্য ’ফৌজদারী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়া ও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এই কনভেনশানে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ও জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে বার বার উল্লেখ করেছে দুর্নীতি নির্মূলের কথা, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এক অস্বাভাবিক দুর্নীতির খেলা, যেখানে সরকারি কাজের টেন্ডারে বালিশের মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার নয় শত সাতান্ন টাকা, তিরিশটি বিছানার চাদর আনতে ট্রাক ভাড়া তিরিশ হাজার টাকা। 

কী অসামান্য বালিশ! কী অসামান্য চাদর! শুধু বালিশের মূল্যই নয়, আমরা দেখেছি সড়ক নির্মাণেও অনান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যয় কয়েকগুণ। উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৩ কিলোমিটার রেলপথের ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৩ কোটি টাকা। চট্রগ্রামের দোহাজারি থেকে বান্দরবনের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে গড় ব্যয় ১২ কোটি টাকা। চীনে সিঙ্গেল রেলপথ নির্মাণে গড় কিলোমিটার ব্যয় ১২ কোটি ৫০ লাখ ও ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয়৭৫ কোটি টাকা। 

বিশ্বব্যাংকের গবেষণাপত্রের তথ্যমতে, উন্নয়নশীল দেশে সড়ক নির্মাণের খরচ বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার থেকে সড়কের দূরত্ব, দরপত্রের প্রতিযোগিতা না হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, সংঘাত ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতি। দুর্নীতির মহোৎসব বাংলাদেশে নতুন কিছু না। বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মূলত উলটা, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছে।

যে দেশে ৪৭.১% মানুষ দারিদ্রসীমা এবং ২৪.৬% মানুষ চরম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে, যে দেশে এখনও মানুষ খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে সেই দেশে সরকারদলের একজন মাঝারি সারির নেতার ঘরে পাওয়া যায় প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশত কোটি টাকার এফডিআর। তিনি শুধু ক্ষমতা দেখিয়ে টেন্ডার সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই অর্থ উপার্জন করেন নি, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চালিয়ে এসেছেন ক্যাসিনো বাণিজ্য। এর আগে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যুবলীগের আরেক নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে আটক করা হয়। নানান তালবাহানার পর অবশেষে গত রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেফতার করেছে বলে বলা হচ্ছে ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সদ্য বহিষ্কৃত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি আরমানকে। প্রশাসন কি হঠাৎ করেই ক্যাসিনো আবিষ্কার করেছে? নিশ্চয়ই তা নয়। 

বছরের পর বছর ধরে যেখানে ক্লাবগুলোতে চলছে ক্যাসিনো, যেখানে মানুষ খেলতে যাচ্ছে, বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছে, যেখানে এই দৃশ্য আশপাশের সাধারণ মানুষ সকলেই দেখছে, প্রশাসনের চোখে পড়েনি একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্যাসিনো খেলতে যে সরঞ্জাম লাগে তা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। কাস্টমস এর নাকের ডগা দিয়ে এই সব অবৈধ খেলার সরঞ্জাম কি করে দেশে ঢুকলো এর জবাব কে দেবে? আজ বা্‌ংলাদেশ যে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে সেখান থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হলে এর মূলে যেতে হবে।

বিভিন্ন সময় সরকারদলের ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানাবিধ ফৌজদারী অপরাধে জড়ালে ও সরকার শুধু ক্ষোভ প্রকাশ আর বিব্রতই বোধ করেছে। দু্‌’একটা ঘটনা ছাড়া মানুষ চাঁদাবাজ, টেন্ডারসন্ত্রাস, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিচার হতে দেখেনি। দরপত্র ছিনিয়ে নিয়ে ঠিকাদারকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ মানুষ হয়ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয় কিন্তু আর অবাক হয় না। ছাত্রলীগ, যুবলীগের টেন্ডারসন্ত্রাস থেকে রক্ষা পায়নি এমন কি সাধারণ মানুষও। মনে পড়ে রাব্বির কথা। ২০১৩সালের ১৯ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই গ্রপের গোলাগুলিতে পাশের গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের ১০ বছরের শিশু রাব্বি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এমনকি নিজদলের নেতাকর্মীদের হীন স্বার্থে খুনের ঘটনা বারবার জাতীয় দৈনিকগুলোর খবর হয়েছে। আইনের শাসন জারি থাকলে,  প্রশাসন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে,  বলাবাহুল্য সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গায়ে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজের তকমা লাগতো না।

কিন্তু প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হলে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। বর্তমান সরকার পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সাধারণ মানুষকে তাদের সাংবিধানিক ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতায় আছে। কোনো দল যখন মানুষের ভোটের উপর আস্থা রাখতে না পারে, তখন ক্ষমতায় আসার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় প্রশাসনের অনৈতিক, অসাংবিধানিক সহযোগিতা, পেশীশক্তি এবং জাল ভোটের উপর। জালভোটের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকার সাধরণত: আটকে যায় অনাকাঙ্খিত সব নির্ভরতার জালে। তখন সেই সরকার জনগনকে তুষ্ট না করে তুষ্ট করতে বাধ্য হয় নানারকম পেশীশক্তিকে। আইনের শাসনহীনতার এক অশুভ দুষ্টজালে আটকে যায় সরকার। বাংলাদেশ সরকার এমন উদাহরণ থেকে ব্যতিক্রম নয়। সুষ্টু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগনের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই রুল অব ল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না তবু একটি নির্বাচিত সরকারই নিয়মতান্ত্রিক শাসনের প্রথম শর্ত। সুতরাং দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে, জনগনের কাছেই সরকারকে ফিরতেই হবে। জনগনের ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিমান স্বনির্ভর সরকারই পারবে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে।

একের পর এক দুর্নীতির কালিমা সরকারকে এমনভাবে কালিমাময় করেছে, প্রশাসন যখন ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো অভিযান চালাচ্ছে তখন, সারাদেশে গুঞ্জন চলছে কেন হঠাৎ এই অভিযান। প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ শাসক দলের ভিতরেই অভিযান চালাবে এটা যেন অবিশ্বাস্য, অথচ অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, এটাই জনমানুষের সবসময় কাম্য। সরকার সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকবে, একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করবে এটাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। অথচ সোশ্যাল নেটওর্য়াক খুললেই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নানান জল্পনা-কল্পনা। 

এই নিয়ে বিবিসি রিপোর্ট করেছে,’শেখ হাসিনা কেন হঠাৎ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ সজাগ হলেন। উল্লেখ্য ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ শব্দযুগলকে এই রিপোর্টে কোড করা হয়েছে অর্থাৎ এই অভিযানকে বিবিসি হয়তো এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বলতে নারাজ। কারণ কী হতে পারে এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিবিসি আমাদের জানাচ্ছে এই অভিযানের পেছনে দল এবং সরকারকে রক্ষার কোন চেষ্টা থাকতে পারে। ‘অপরাধে জড়িতদের সতর্ক করা হয়েছিলো ’উল্লেখ করে বিবিসি জানাচ্ছে, ”শেখ হাসিনা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে অভিযান চালানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন।’’

অর্থাৎ সরকার একরকম বাধ্য হয়ে একটানা তৃতীয় মেয়াদে এসে কতিপয় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাও আবার ব্যাবস্থা গ্রহনের আগে অপরাধীদের সর্তক করা হয়েছিলো। সরকার যে এই অভিযানেও কতোটা ইতস্তত তা অনুমান করা যায় ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত সম্রাটকে গ্রেফতারে টালবাহানা দেখে। শুধুমাত্র এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান নয়, সরকারকে তার ভাবমূতি উজ্জ্বল করতে চাইলে রাষ্ট্রের বিভিন্নস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, অপকর্ম রোধ করতে হবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে গিয়ে মানুষকে তার হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জনমানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার মধ্য দিয়েই শুধুমাত্র একটি সরকার জনপ্রিয় থাকতে পারে। কোনো চাপের মুখে নয় সরকার সংবিধান মেনে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করুক, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুক, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করুক, এটাই সাধারণ মানুষের কাম্য। ক্লাবে ক্যাসিনো চলেছে, বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে যেন কোন ক্যাসিনো না চলে, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যখন এতদিন পর দেখতে পেলো অসাংবিধানিকভাবে চলে আসা এই ক্যাসিনো বাণিজ্য, তখন এই চোখ খোলা থাকুক, সকল অপরাধই রাষ্ট্রের চোখে ধরা পড়ুক। কারণ, অন্ধ হলেই বন্ধ হবে না প্রলয়।

  • — লেখক সাংবাাদিক ও উপস্থাপক
  • কার্টসি — মানবজমিন/ অক্টোবর ৭, ২০১৯

Sunday, October 6, 2019

আমরা আইনহীন সমাজের দিকে যাচ্ছি — ড. শাহদীন মালিক

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আমরা ক্রমে একটি আইনহীন সমাজের দিকে এগোচ্ছি। যেখানে কোনো আইন নেই, আমাদের নিরাপত্তাবোধ থাকবে না, অন্যায়-অপরাধ হলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে না। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘জোরপূর্বক গুম বিষয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা ও জাতিসংঘের সুপারিশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। শাহদীন মালিক বলেন, ক্যাসিনো ব্যবসা পুলিশের নাকের ডগায় হচ্ছে অথচ পুলিশ বলছে তারা জানে না! চারদিকে দুর্নীতি হচ্ছে।

এসব পচন শুরু হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম দিয়ে। এক্ষেত্রে বড় উদ্বেগ হচ্ছে এর আগে যেসব দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম হয়েছে তাদের থেকে আমরাও আমাদের ভবিষ্যতের চিত্র দেখতে পাই। সে সমাজ আমাদের কারো কাম্য নয়। তিনি বলেন, সমাজে অবশ্যই অপরাধ আছে, অনিয়ম আছে, বিশৃঙ্খলা রয়েছে। তবে কোনো সমাজই আইনের বাইরে গিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

অনেক দেশই মূর্খের মতো এটা ভেবেছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমাদের দেশেও একটা ভাবনা এসেছে যে, দু’চারশ মানুষকে গুলি করে হত্যা করলেই মাদক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ এর আগে কোনো দেশ এ পথে অপরাধ দমন করতে পারেনি। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ। তিনি আরও বলেন, আমাদের উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে আমরা টোটালি ল’ লেস সোসাইটির দিকে এগোচ্ছি। প্রতিফলন কি সেটা যারা সরকার চালাচ্ছে তারা দেখে কি-না জানি না, তবে আমি তো দেখি। যারা সরকার চালান তারা কি সব চোখ বুজে থাকেন এমন প্রশ্ন রেখে শাহদীন মালিক বলেন, যেসব দেশে আশির দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম শুরু হয়েছিল সেসব দেশে কী হয়েছিলে সেগুলো তারা দেখেন না কেন? ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে জনগণ আমেরিকায় চলে আসা।

হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা, নিকারাগুয়ে এসব দেশ থেকে হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক আমেরিকায় আসতে চাইছে, আর ট্রাম্প তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছে। আশির দশকে এসব দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল এরই ফল হচ্ছে এগুলো। তিনি বলেন, এ লোকগুলো আমেরিকায় আসছে কেন? তাদের সবারই এক কথা অনেকটা আমাদের রোহিঙ্গাদের মতো। তাদের দেশে তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই, তারা সম্পূর্ণ অসহায়, সাংঘাতিক ধরণের অপরাধ হচ্ছে, তারপরও সরকার তাদের কোনো সাহায্য করে না। জানে বাঁচতে তারা আমেরিকায় যাচ্ছে। এ সমস্যাটা সত্তর দশকে চিলিতে দেখা দিয়েছিল। কোনো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম শুরু হয় এর পরিণতি যে কি হয়, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলো। তিনি বলেন, আশির দশকে সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলোর লোকজনও বলেছিল, সেসব দেশের বিচারব্যবস্থা কিছু হয় না, কিছু ত্বরিত বিচার হলে তথা অপরাধীকে সরিয়ে দিলে অপরাধ দূর হয়ে যাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে কোনো সমাজ এ পথে গিয়ে অপরাধ দূর করতে পারেনি। বরং সেক্ষেত্রে পুরো সমাজটাই অপরাধপ্রবণ হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুমের অপরাধের দায় সরকারের। বেশির ভাগ গুম যদি সরকার না করে থাকে তাহলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা র?্যাব-পুলিশের নাম বলে কেন? কেন গুমের ঘটনায় মামলা নেয়া হয় না? মামলা নিলেও গড়িমসি কেন, অগ্রগতি হয় না কেন? যাঁরা ফিরে আসেন তারা মুখে তালা দেন কেন? তিনি বলেন, দেশে আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র অনেক কিছুই গুম হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত আলোচনা সব অরণ্যে রোদন। যাদের এসব ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা সেই সরকার কোনো সাড়া দিচ্ছে না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীপক্ষের আহ্বায়ক শিরিন হক।

  • কার্টসিঃ মানবজমিন/৬ অক্টোবর ২০১৯

আড়ালে তিস্তা, উল্টো ভারত পেল ফেনী নদীর পানি

পানি শূন্য তিস্তা নদী

নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোনো আলোচনা হয়নি। দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ২০১১ সালের একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোর কথা শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দিলেও অতীতের অজুহাত দেখিয়ে দায় সেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। বরং উল্টো এখন ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানীয় হিসেবে সরবরাহে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

শনিবার নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।

২০১৭ সালের পর এই প্রথম নয়াদিল্লি সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটিই প্রথম ভারত সফর।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাধার মুখে অতীতে বেশ কয়েকবার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সমঝোতা কিংবা চুক্তি সই হয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের সরকার একটি অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল। এই চুক্তির বাস্তবায়ন জানার জন্য বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।


জবাবে নরেন্দ্র মোদি বলেন, তিস্তা চুক্তি যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা যায়; সে লক্ষ্যে বিজেপি সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের কর্তৃপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কেউই। বরং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা তিস্তার বিকল্প হিসেবে অন্য নদীর পানি নিয়ে আলোচনা কিংবা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও সেসব প্রস্তাবও আলোর মুখ দেখেনি।

দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা ছাড়াও আরো ছয়টি অভিন্ন নদী মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমারের পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে শিগগিরই একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়াই কয়েক বছর ধরে ফেনী নদী থেকে ভারত পানি উত্তোলন করছে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে সীমান্তের জিরো লাইনে পাম্প বসিয়ে নদীটি থেকে পানি উত্তোলন করছে নয়াদিল্লি। পানি উত্তোলন না করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সেই ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামো তৈরি করতে যৌথ কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এখন এই ফেনী নদী থেকেই ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নিয়ে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরের জনগণের জন্য সরবরাহে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।

তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আড়ালে থাকলেও দুই দেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাতটি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক একটি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তিস্তার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে এ কাঠামো অনুস্মরণ করা হতে পারে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি আছে শুধু গঙ্গা নিয়ে। সেই গঙ্গা চুক্তিতে ন্যায্যতা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা ভারতের অথচ কোনো কোনো বছর মাত্র দেড় হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে পাঁচ দশক ধরে। সর্বশেষ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিতে রাজি হলেও তিস্তার পথে এখন বাধা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসেছে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও এখনো প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভারতের শক্তিশালী সমর্থনের ব্যাপারে অনেকে আশাপ্রকাশ করলেও আপাতত তাতেও হতাশ হতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির দেয়া যৌথ বিবৃতিতে এবার রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করা হয়নি। বিবৃতিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে আরো প্রচেষ্টা দরকার বলে উভয় দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে ভারত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কাজে সহায়তা করার লক্ষ্যে রাখাইনে ইতোমধ্যে আড়াইশ ঘর তৈরি করেছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের আসাম প্রদেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকা (এনআরসি) করায় সেখানকার ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছেন; যাদের অনেকেই বাংলাদেশি বলে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন। এমনকি এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোরও হুমকি এসেছে প্রায়ই।

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রায় এক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের ফাঁকে একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই বৈঠকে এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু শনিবার নয়াদিল্লিতে বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে তাতে এনআরসি শব্দটিরও উল্লেখ নেই।

  • কার্টসিঃ জাগোনিউজ/ রোববার, ০৬ অক্টোবর ২০১৯

ক্ষতিকর প্রকল্প বাংলাদেশে সুবিধা ভারতের

সুলতানা কামাল
সুন্দরবনকে রক্ষা, নৈতিক, জাতীয় ও সাংবিধানিক দায়িত্ব উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, স্বাধীনতার আগে সকল সুযোগ-সুবিধা যেত পশ্চিম পাকিস্তানে আর শোষণ হতো পূর্ব পাকিস্তান। যত ক্ষতিকর প্রকল্প হতো পূর্ব পাকিস্তানে। তেমনি বাংলাদেশে যত ক্ষতিকর প্রকল্প তা যৌথভাবে করছে ভারত। সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও নিয়ে যাবে ভারত। এই জায়গায় মনে হয় চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। ‘ইউনেস্কোর ৪৩তম সভার সকল সুপারিশ বাস্তবায়ন, সুন্দরবনের পাশে রামপালসহ সকল শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধ ও সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন’ করার দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি।

কমিটির আহবায়ক সুলতানা কামাল বলেন, রামপালের প্রকল্প নির্মাতা ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি তাদের নিজ দেশ ভারতে সকল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থগিত করেছে। তারা তাদের কার্বন তৈরির দায় কমাতে চায়।
তারা গুজরাটে বিশ্বের বৃহত্তম সৌর শক্তি পার্ক স্থাপনের জন্য ২৫ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা কয়েকটি রাজ্যের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্ধদিবস বন্ধ রাখার কথাও জানিয়েছে। অথচ ওই একই প্রতিষ্ঠান প্রবল গণআপত্তির মুখেও বাংলাদেশে কয়লা বিদ্যুৎ তৈরিতে পিছপা হচ্ছে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণ।

তিনি বলেন, আমি ভারতবিরোধী কোনো কথা বলছি না। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় ভারত যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াতো তাহলে আমরা মুক্তিযুদ্ধটা যেভাবে শেষ করতে পেরেছি সেভাবে হয়তো শেষ করতে পারতাম না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেটা স্মরণ করি, সেজন্য অবশ্যই ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞও। কিন্তু আজকে বাংলাদেশকে একটা বাজারে কিংবা তাদের শিল্প কারখানার জায়গা বানিয়ে নিজেরা সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে নেবে, এ বিষয়ে আমাদের এখন চিন্তাভাবনা করতে হবে।

তিনি বলেন, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কষ্ট হলেও বলছি, সবচেয়ে সস্তা শ্রমের দেশ বাংলাদেশ। এখানে বিনিয়োগে সবচেয়ে ভালো পরিবেশ রয়েছে। অর্থাৎ আমরা সব দিয়ে দিতে পারি। যেনতেনভাবে মানুষকে তাদের জায়গা-জমি থেকে উৎখাত করে রামপালের মতো পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বিভিন্ন জায়গায় করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইউনেস্কোর ৪৩তম সভা আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের দুরাবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এর আগে ৪১তম সভায় (২০১৭) বেশ কিছু নেতিবাচক কিন্তু সঠিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিল ইউনেস্কো। বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল সেসব বিষয়ে করণীয় সকল কাজ সম্পন্ন করে এবারের অর্থাৎ গত জুনের ৪৩তম সভায় প্রতিবেদন জমা দেয়া। কিন্তু বাকুর সভায় বাংলাদেশের কৃত কাজের প্রতিবেদনে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেনি। কারণ ২০১৭ সালের কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য কমিটি আবার জোর তাগাদা দিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের পর্যবেক্ষণ দল সরেজমিন সুন্দরবন দেখতে আসবে। আর বাংলাদেশকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে আবার প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। যা ৪৪তম সভায় মূল্যায়িত হবে। কিন্তু সভা বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্মে সন্তুষ্ট না হলে ‘সুন্দরবন বিপদাপন্ন ঐতিহ্য’ তালিকায় চলে আসতে পারে। যা হবে জনগণের ও দেশের জন্য অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, দুঃখজনক, লজ্জাকর ও অপমানজনক।

তিনি বলেন দেশের মানুষ রামপালসহ সকল ক্ষতিকর প্রকল্প সম্পূর্ণ বাতিল চায়। সরকারের উচিত অবিলম্বে সব বন্ধ করে দেয়া।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে, অবিলম্বে সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুল জুড়ে পরিকল্পিত সকল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে বিকল্প জ্বালানীর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা। সুন্দরবনের বাফার জোন, কোর জোন ও বনের নিকটবর্তী সকল কল কারখানা, এলপিজি কারখানা বন্ধ করা। লাল ক্যাটাগরির শিল্পকে কলমের খোঁচায় সবুজ করণের অবৈজ্ঞানিক, অসৎ ও বেআইনি কাজ বন্ধ করা।

ইউনেস্কোর সকল দিকনির্দেশনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত কর। সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষার কার্যসীমা নির্ধারণ করা এবং সমীক্ষার সকল স্তরে নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আব্দুল মতিন এবং ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী ও বাপার যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


  • কার্টসিঃ মানবজমিন/৬ অক্টোবর ২০১৯ 

Tuesday, October 1, 2019

গণতন্ত্রে ঐকমত্য চাই

এমাজউদ্দীন আহমদ
গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছেই। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের হাল-হকিকত সম্পর্কে উদ্বেগেরও শেষ নেই। গণতন্ত্রের প্রকৃত সংজ্ঞাসূত্র মোতাবেক বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান কি-না, এ নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র অনেক পুরনো এবং আদর্শ হিসেবে মানবসভ্যতার মতোই প্রাচীন। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, আদিম সমাজে বিদ্যমান ছিল এক ধরনের সমতাভিত্তিক সমবণ্টনকেন্দ্রিক ব্যবস্থা। বিদ্যমান ছিল গ্রুপ বা গোত্রের সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা আর ছিল সাম্য-সহমর্মিতা-সমবেদনাকেন্দ্রিক সাম্য। রবার্ট ডালের কথায়, আদিমকাল থেকেই শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সমাজের মানুষ ভেবেছেন। তাদের রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান, সামগ্রিকভাবে তারা সার্বভৌম এবং তাদের রয়েছে নিজেদের শাসন করার উপযোগী সক্ষমতার সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান। সমাজ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হলে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা জটিল হয়ে উঠলে শাসনব্যবস্থায় স্তর ও পর্যায় সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে কিছু দক্ষ ব্যক্তির প্রভাব স্বীকৃত হয় বটে; কিন্তু সাধারণ মানুষের চাহিদা কোনোক্রমে উপেক্ষিত হয়নি। সবাই মিলে শাসন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেছেন। এভাবে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের উত্থান ঘটে খ্রিষ্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে। তখন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোতে একটু একটু করে এ ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়। গ্রিস থেকে রোমে এর বিস্তৃতি ঘটে।

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখি, গ্রিসের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পদদলিত ও সব নগররাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্বজয়ের অভিযান শুরু করেছিলেন একজন খ্যাতনামা গ্রিক দিজ্ঞ্বিজয়ী এবং তিনি আলেকজান্ডার। শুধু গ্রিস কেন, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে রোমান ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয় হুন, শক ইত্যাদি বর্বর জাতির বিজয় অভিযানে। রোম দখল করে তাদের সংস্কৃতিচর্চা ও গণতন্ত্র দেখে কোনো কোনো নেতা অট্টহাসি দিয়ে বলেছিলেন, এখন আর এসব আবর্জনার কোনো প্রয়োজন নেই। কুঠারাঘাতে রোমের বহু নাট্যশালা তারা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে গ্রিক ও রোমানদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিশেষ করে স্বশাসনের প্রতি মানুষের যে সহজাত দুর্বলতা, তা তো চিরঞ্জীব। তার তো মৃত্যু নেই। হঠাৎ তখনকার সভ্য দুনিয়া অবলোকন করলেন, ঊষর মরু অঞ্চলের খেজুর বীথির পাশে এক গ্রামীণ পরিবেশে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসরেব লোকালয় মদিনা নাম ধারণ করে নতুনভাবে, একেবারে নতুন আঙ্গিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করে ফেলেছে; তাও ওই এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির রাষ্ট্র গঠনের এক চুক্তির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, তারা একটি সুলিখিত সংবিধান রচনাও করেছেন। এ সংবিধান 'মদিনা সনদ' নামে খ্যাত। নেতৃত্বে ছিলেন মক্কায় জন্মগ্রহণকারী ইসলামের রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বিশ্বের সর্বত্র তখন রাজরাজড়ার শাসন। সম্রাট ও ধর্মযাজক-পোপের আধিপত্য। বিশ্বময় সাহারা মরুভূমির মধ্যে মদিনা রাষ্ট্র যেন ছোট্ট এক মরূদ্যান। এ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে উলেল্গখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল- শাসনকারীদের ন্যায়ানুগ কর্মকাণ্ড, তাদের স্বচ্ছ নীতিমালা এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি। চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট মদিনা রাষ্ট্রের সনদ হয়ে ওঠে বিশ্বে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। সাম্য, শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব হয় এর স্লোগান। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাংলাদেশের রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে কতটা আদর্শিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি!

সবসময় বলা হয়েছে, গণতন্ত্র একান্তভাবে পাশ্চাত্যের এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন গবেষক-সমালোচকদের সুচিন্তিত অভিমত ও বিশ্লেষণের ফলেই গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয়েছে। এ বিবরণ সঠিক নয়, নয় পরিপূর্ণ। ২০০০ সালে প্রকাশিত 'দি গ্লোবাল অ্যাডভান্স অব ডেমোক্রেসি' গ্রন্থে আদেল সাফটি সত্যই বলেছেন, 'আলোকিত যুগের ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উৎস যে মূল্যবোধ, তা বিশ্লেষণে সর্বপ্রথমে লেখনী ধারণ করেননি। তাদের বহু আগেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুসলিম দার্শনিকরা। প্রকৃত প্রস্তাবে জন লক এবং রুশোর বহু আগে আলফারাবি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিরূপে স্বাধীনতা, সাম্য ও জনগণের সম্মতি সম্পর্কে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।'

দীর্ঘদিন ধরে এ প্রক্রিয়ার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমাজকে নতুনভাবে সুসজ্জিত করে। এ প্রক্রিয়ার অনুধাবনে একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় নিউজিল্যান্ডে। অস্ট্রেলিয়ায় তা স্বীকার করা হয় ১৯০২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে ও ব্রিটেনে ১৯২৮ সালে। যে ফ্রান্সে শাসনব্যবস্থাকে ওলটপালট করে বিপল্গবের জন্ম হয়েছে ১৭৮৯ সালে, সেই ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন ১৯৪৭ সালে। ইউরোপের সবচেয়ে স্থিতিশীল, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নত এবং সৃজনশীলতায় অগ্রগামী রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৯৭১ সালে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছরে। এদিক থেকে বলা যায়, রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র প্রাচীনতম বটে; গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিন্তু সাম্প্রতিককালের, এক অর্থে বিশ শতকের।

ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই সময়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা সর্বাধিক। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বিশ্বের সমগ্র জনসমষ্টির ৬৫ শতাংশ এখন বাস করছেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনে। পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে আরব বিশ্বের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো পাশ্চাত্য রেনেসাঁ ও রিফরমেশন আন্দোলনের ফলে যেভাবে এনলাইটেনমেন্ট যুগে বা আলোকিত যুগে পা ফেলে এবং বিভিন্ন বিপল্গবের পরে যেভাবে গণঅধিকার সম্পর্কে সচকিত হয়ে ওঠে, মুসলিম বিশ্বে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তেমন প্রভাবশালী হয়ে ওঠেনি। মধ্যযুগ অতিক্রম করে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সরোবরে যেভাবে অবগাহনের সুযোগ লাভ করে, মুসলিম বিশ্বে তেমন সুযোগ আসেনি। এ ছাড়া উনিশ শতকের শিল্পবিপল্গব যেভাবে ইউরোপে নতুন সমাজের পত্তন করে, আরব বিশ্বে তাও ছিল অনুপস্থিত। শিল্পবিপল্গবের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাণিজ্যের বহুমুখী নেটওয়ার্ক তৈরি হয় দেশে-বিদেশে। বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয় নতুনভাবে। নব নব প্রযুক্তি আবিস্কারের ফলে সমাজে বৈপল্গবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। শ্রমিক শ্রেণি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। জন্মলাভ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিল্পপতি, বড় বড় ব্যবসায়ী উৎপাদকদের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়। আরব বিশ্বে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

এটি অবশ্য সত্য, তখনকার শাসনব্যবস্থাগুলোর প্রকৃতি ছিল ভিন্ন এবং আধুনিককালের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থেকে তা ছিল হাজার যোজন দূরের। ওই সব শাসনব্যবস্থা বিভিন্নভাবে ছিল সীমিত, অপরিণত, অনেকটা প্রাথমিক পর্যায়ের। গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে সমগ্র বিশ্বে সৃষ্টি হয় সামন্তবাদী এক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের। গণতন্ত্রের চেতনা দলিত-মথিত করে সামন্ত প্রভুরা খণ্ডছিন্ন জনপদে প্রতিষ্ঠা করে তাদের ব্যক্তিগত আধিপত্য এবং সেই আধিপত্যের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি হয় গণতান্ত্রিক চেতনা। ইউরোপব্যাপী এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক ইতিহাসে এ সময়কাল মধ্যযুগ বলে পরিচিত। একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সামন্তপ্রভু ও আরও পরে রাজন্যবর্গের সঙ্গে পোপদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দ্বন্দ্ব ও দীর্ঘকালীন পরিসরে রাজতন্ত্রের প্রচণ্ড দাপট এবং তাদের পারস্পরিক সংঘাতের ফলে গণতন্ত্রের ধারণা সমাজ জীবন থেকে হয় নির্বাসিত। এ অবস্থা অব্যাহত থাকে দীর্ঘদিন। দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিকতার ঘন অন্ধকার থেকে অবশেষে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো এবং কার্যক্রম সুস্পষ্ট হতে থাকে আঠারো শতকের ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় সংঘটিত কিছু গণভিত্তিক আন্দোলন ও বিপল্গবের মাধ্যমে।

এর দুর্দম তরঙ্গ সমগ্র ইউরোপকে আন্দোলিত করতে থাকে কয়েক শতাব্দী ধরে এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করে ইউরোপের শিল্পকলা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। মানবতার বিজয় ছিল এর প্রধান স্লোগান। প্রত্যেকের মনে আত্মবিশ্বাসের সূত্রকে সুদৃঢ় করা ছিল এর লক্ষ্য। সীমাহীন সম্ভাবনার অধিকারী যে মানুষ, তার স্বীকৃতি ছিল এর মৌল সুর। পাশ্চাত্যে মানুষ আবেগের পরিবর্তে যুক্তির প্রাধান্য স্বীকার করেন। ব্যক্তি-আধিপত্যের পরিবর্তে আইনের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আইনে যে তাদেরই স্বার্থ প্রতিফলিত হতে হবে, তা শাসকদের মানতে বাধ্য করেন। তাদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া শাসক যে তাদের ওপর কোনো কর আরোপ করতে পারবেন না, তা শাসককে মানতে বাধ্য করেন। সর্বোপরি, তাদের সম্মতির ভিত্তিতে যে সরকার গঠিত হবে এবং তাদের সম্মতিসাপেক্ষে সরকার অব্যাহত থাকবে, তা সরকারকে স্বীকার করতে বাধ্য হন। এভাবে পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের শিকড় জনসমাজে গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরোপিত, গণতন্ত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা-সূত্র মোতাবেক প্রকৃত গণতন্ত্র নয়; এই বক্তব্য অমূলক নয়। আমাদের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের চালচিত্র কেমন! স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স প্রায় পাঁচ দশক ছুঁই ছুঁই। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষায় রয়েছে গণতন্ত্র এবং এই গণতন্ত্রের জন্য তাদের ত্যাগ কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের গণতন্ত্রকে এখনও আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে শাসক মহল হৈচৈ করলেও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের অবস্থা ভালো নয়। এখানে সর্বাংশে গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত নয়। রাজনীতির মাঠ নয় সমতল। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এখনও এখানে সোনার হরিণ। গণতন্ত্র মানে তো শুধু নির্বাচন নয়। আর নির্বাচনের নামে এখানে বিগত কয়েক বছর ধরে যা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যহানিই শুধু ঘটায়নি, কঠিন প্রশ্নের মুখেও ফেলে দিয়েছে। গণতন্ত্রে ঐকমত্য চাই। চাই পরমতসহিষুষ্ণতা। চাই সবার সমান অধিকার। কিন্তু এর কোনোটি এখানে অবাধ নয়। এমতাবস্থায় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ যেন দুই বিপরীত মেরুতে।

  • লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
  • কার্টসিঃ সমকাল / অক্টোবর ১, ২০১৯। 

NEW MILLIONAIRE PLAYGROUNDS: WHERE THE NEXT GENERATION OF THE SUPER RICH ARE COMING FROM

BY BRENDAN COLE /Newsweek/10/2/18 

The data from Wealth-X puts Bangladesh as home of the fastest growing number of wealthy people.



Rising asset values and robust corporate earnings have made Asia the region with the fastest growing number of mega-rich people, according to new figures looking at wealth gains over the last five years.

The United States continues to be the place with the most ultra-high-net-worth individuals (UHNWI), which is defined by someone who has $30 million or more. There are around 80,000 people with that level of wealth in the United States, which is more than the total of the next five countries combined, Japan, China, Germany, Canada and France.

But statistics ilustrated by Statista also show that between 2012 and 2017, Bangladesh has emerged as the country with the fasting growing numbers of so-called UHNWIs. Its ultra-rich club has grown by 17.3 percent, more than twice North America's growth rate of 8.1 percent.

Over the same period, China's number of mega rich increased by 13.4 percent. In Vietnam, it was 12.7 percent. There was also double-digit growth of the super rich in Kenya at 11.7 percent, and India at 10.7 percent.

The combined riches of Asia's ultra wealthy is now $8.365 trillion, and its proportion of global wealthy rose from 18 percent to 27 percent, closing in on the world's second wealthiest region, Europe (28 percent).

The report by Wealth-X, released in September, said the overall worth of the world's richest population increased by over 16 percent to $31 trillion in 2017, which was "buoyed by a synchronized upturn in the world economy, rising asset markets, and robust corporate earnings."

It said this increase was "a testament to the auspicious economic climate, the ultra wealthy population and its total net worth increased in all seven major regions, contrasting with the diverse performances seen a year earlier."

Its World Ultra Wealthy Report 2018 also stated that there are around 35,000 ultra wealthy women, an increase of 13.7 percent since 2012.

Hong Kong now has the largest number of UHNWIs, while New York posted the weakest growth among the top 10 cities. The report predicted that Asia would continue to be the hub of growth.

Dhaka, the capital of Bangladesh, has emerged as having the fasting growing number of mega-wealthy individuals. ISTOCK


"The global UHNW population is forecast to rise to 360,390 people by 2022, an increase of almost 105,000 compared with 2017. The level of UHNW wealth is projected to increase to $44.3 trillion, implying an additional $12.8 trillion of newly created wealth over the next five years," the report said.

Vincent White, managing director of the Wealth-X Institute, told CNBC: "Asia recorded the highest growth in UHNW (ultra high net worth) population accompanied by a disproportionate rise in combined wealth of over one quarter. In the forecast through to 2022 we expect to see a continuation of this growth, closing the gap with the Americas and EMEA."

A report by DBS Bank predicted that Asia's middle class will expand threefold over the next decade, from 525 million people to 1.74 billion. This would make Asia home to half the world's middle class population by 2020.

  • Link https://bit.ly/2o3jXM6

সরকার ক্যাসিনোতে কোন শুদ্ধি খুঁজছে

কামাল আহমেদ

সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বদলে শুধু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান হলেই কি দুর্নীতির অবসান ঘটে যাবে?



কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে একের পর এক বড় বড় দুর্নীতির খবর ফাঁস হচ্ছিল। রূপপুরের বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশের দাম জানার পর যখন তা পারমাণবিক বালিশ হিসেবে পরিচিতি পেল, তখন দুর্নীতির দায় চাপাতে বলা হলো ক্রয়কর্তা বিএনপির ছাত্রসংগঠন করতেন। কিন্তু ফরিদপুরের হাসপাতালের পর্দা, বান্দরবানের ঘরের চালের টিন, মেডিকেল কলেজের বইয়ের মতো একের পর এক সরকারি ক্রয়ের যেসব বিবরণ ছাপা হয়েছে, সেগুলোর শিরোনাম এক নিবন্ধে ধরানো সম্ভব নয়। সরকারের ভেতরে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় বিএনপির কর্মীর আকাল দেখা দেওয়ায় ওই অজুহাতও আর চলছিল না। কিছুদিন পরপর ছোট-মাঝারি-বড়-অতিশয় বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার খবর শোনা যায়, তাতে দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণের চেহারা বুঝতে আর কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। পুলিশের ডিআইজি, কারা অধিদপ্তরের ডিআইজি, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তার কোটি কোটি টাকার সম্পদের বিবরণগুলোর কথাও–বা ভুলি কী করে। পাশাপাশি, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশের ওসির মতো দায়িত্বশীল কর্মকর্তার যৌন অপরাধের খবরগুলোতে প্রতিশ্রুত ‘সুশাসনের’ কী দুর্গতিই না প্রকাশ পাচ্ছিল। 

দিন দশেক ধরে সেই আলোচনায় ছেদ ঘটিয়েছে ক্যাসিনো-বার-স্পাবিরোধী অভিযান। প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে এখন ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান কেন? সরকারের তরফে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি। অজুহাত এসেছে দুটো, প্রথমত: অন্যান্য সব খারাপ কাজের মতো এটিও বিএনপির আমলেই শুরু হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত: গ্রেপ্তারকৃতরা অধিকাংশই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী, তাঁরা আগে বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একসময় অনুপ্রবেশকারীদের কাউয়া বলতেন, কিন্তু বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে, এসব কাউয়া দলের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এখন অবশ্য তাঁদের কাউয়া না বলে ডাকা হচ্ছে হাইব্রিড। 

গণমাধ্যমে এখন প্রতিদিন কথিত ক্যাসিনোওয়ালাদের যেসব কাহিনি উঠে আসছে, সেগুলোতে এক যুগ আগের সেনাসমর্থিত সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কিছুটা মিল দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা সন্দেহভাজন ক্যাসিনোওয়ালারা কথিত যেসব স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, তা কোনো রকমে যাচাই-বাছাই ছাড়া ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। তবে ক্যাসিনোওয়ালারা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক কোন কোন নেতাকে নিয়মিত উপঢৌকন পাঠাতেন বা বখরা দিতেন, সেই নামগুলো রহস্যের আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। ওই রহস্যের পর্দা কোনো দিন সরবে বলেও মনে হয় না। দলীয় অন্তঃকলহ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে এক পক্ষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার খেলায় নেমেছে, এমন জল্পনা সত্য হলে অবশ্য নেপথ্যচারী পৃষ্ঠপোষকদের দু-চারজনের নাম গায়েবি সূত্র থেকে গণমাধ্যমে এলেও আসতে পারে। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোট ২৮ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকের পর জুয়া এবং ক্যাসিনোর প্রসার ঘটার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতার নিন্দা করেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই খবরে অবশ্য কর্তৃপক্ষ কে বা কারা তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ১৪ দলের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন সমন্বয়কারী আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের হাসানুল হক ইনু। 

তাঁরা তিনজনই সরকারের আগের মেয়াদে অর্থাৎ গত বছর পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। একটি রাষ্ট্রে সরকারের চেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ আর কে থাকতে পারে? সাবেক এই তিন মন্ত্রী যদি তা ব্যাখ্যা করে বলতেন, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে দোষী ব্যক্তিদের চিনতে সুবিধা হতো। রাজধানীর কথিত অন্ধকার জগতের কায়কারবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো তাঁদেরও ১০ বছরে নজরে পড়েনি, এ রকম অজুহাত দেওয়ার আগে তাঁদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা উচিত ছিল। 

ছাত্রলীগের এক সভায় প্রশাসনে নিজেদের লোক দিয়ে ২০১৪-এর একতরফা নির্বাচন সফল করার কথা বলেছিলেন যিনি, সেই এইচ টি ইমাম এবং সরকারের প্রচারমন্ত্রী বলেছেন, দেশে জুয়া এবং ক্যাসিনোর শুরু জিয়ার আমলে। প্রচারমন্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন যে লন্ডনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কাছে নিয়মিত ক্যাসিনোর টাকা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়ার ১৩ বছর পরও বিএনপির চালু করা ক্যাসিনোগুলো তাঁদের চোখে পড়েনি? নাকি ১১ বছর ধরে তাঁদের সরকার বিএনপি দমনে এতই ব্যস্ত ছিল যে অন্য কোনো কিছুতে তাঁরা নজর দেওয়ার ফুরসত পাননি? 

সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বদলে শুধু কয়েকজন ঠিকাদার আটক হলেই কি দুর্নীতির অবসান ঘটে যাবে? ব্যাংকের টাকা নয়ছয়, শেয়ারবাজারের লুটপাট, জমি দখল, নদী দখল, কমিশন–বাণিজ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলীয় উপাচার্যদের বেশুমার কেনাকাটা এবং কাগুজে উন্নয়ন প্রকল্প—এগুলোর বিষয়ে কোনো নড়াচড়া নেই কেন? অভিযানটিকে অনেকে ক্ষমতাসীন দলে শুদ্ধি অভিযান বলেও অভিহিত করেছেন। ছাত্রলীগের দুজন শীর্ষ নেতাকে অপসারণ এবং যুবলীগের কয়েকজন মেঠো নেতার ধরপাকড়ই এই ধারণার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়িতে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার খবর প্রকাশের পরই এই অভিযান শুরু হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে অভিযানে ক্ষমতাসীন বলয়ের বড় মাপের আর কেউ আটক হননি। কমিশন দাবি করায় দুজন ছাত্রনেতা ছাত্রলীগের পদ হারালেও চাঁদাবাজির অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও হয়নি। 

এখন পর্যন্ত অভিযানের ধরন দেখে মনে হয় যে এর লক্ষ্য হচ্ছে যুবলীগ। অথচ নানা ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধের অভিযোগ দলটির অন্য অনেক নেতার বিরুদ্ধেই রয়েছে। যেমন বলা যায়, মাদক কারবারের অভিযোগের শীর্ষে থাকা কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ বদির কথা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সরকারের গোপন নথিতেই আটকে আছে। কোনো মামলা বা বিচারের পথে এগোয়নি। নানা রকম অভিযোগের কারণে তাঁর মতো আরও কয়েক ডজন নেতার সংসদে ফেরার সুযোগ না হলেও তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলার খবর পাওয়া যায় না। সুতরাং একে শুদ্ধি অভিযান বলা বিভ্রান্তি সৃষ্টিরই নামান্তর। 

চলমান অভিযানে আটক ব্যক্তিদের ধনসম্পদে নাটকীয় সমৃদ্ধিকে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বা ব্যতিক্রম হিসেবে তুলে ধরার একটা চেষ্টা আছে। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে মন্ত্রী-সাংসদদের পেশ করা হলফনামায় ঘোষিত সম্পদের হিসাবগুলোর কথা এত দ্রুত সবার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ‘মন্ত্রী হয়ে আয় বেড়েছে, বাড়বাড়ন্ত সম্পদেও’ শিরোনামের খবরে যে মাত্র আটজন মন্ত্রীর হলফনামার বিশ্লেষণ ছিল, তাঁদের কয়েকজন বর্তমান মন্ত্রিসভাতেও আছেন। ওই হিসাবে একজনের সম্পদ পাঁচ বছরে দশ গুণ বাড়ার তথ্য ছিল। ২০১৩ আর ২০১৮-এর হলফনামার তুলনামূলক বিশ্লেষণে সাংসদদের কারও কারও সম্পদ যে হারে স্ফীত হয়েছে বলে দেখা গেছে, তাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয় (‘৫ বছরে গুলশান-উত্তরায় চারটি ফ্ল্যাট, বাড়ির মালিক’, কিংবা ‘১০ বছরে অস্থাবর সম্পদ ৪৫ গুণ বেড়েছে’ শিরোনামের সংবাদ)। সাংসদদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কতজন ব্যাংক-ইনস্যুরেন্স-বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়েছেন, তার নির্ভরযোগ্য তালিকা পাওয়া দুষ্কর। এগুলো দুর্নীতির ফসল কি না, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এই ফুলেফেঁপে ওঠার ব্যাখ্যা প্রকাশ করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের কাছ থেকে সেই জবাবদিহি আদায়ের কাজটি যেসব প্রতিষ্ঠানের, বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান—সেগুলোর কার্যকারিতা কতটা ধ্বংস করা হয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। 

বর্তমান অভিযানে লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে পুলিশের চেয়ে র‍্যাবের প্রাধান্য এবং অপেক্ষাকৃত বেশি সাফল্য। এমনও দেখা গেছে, পুলিশ যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে পরে র‍্যাব গিয়ে সাফল্য দাবি করেছে। অভিযান শুরুর দিন দশেক পর ২৮ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে র‍্যাবকে। স্বভাবতই এমন প্রশ্নও উঠেছে যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতনের জন্য দেশের বাইরে, বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে ব্যাপকভাবে নিন্দিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই শাখাটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে এই সিদ্ধান্ত কি না? 

রাজনীতির সংকট প্রকট হলে শাসনব্যবস্থায় তার যে একটা সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়ে, তা মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। আর শাসনব্যবস্থার সংকটকালে দুর্নীতি এবং নানা ধরনের অপরাধ দমনে চটকদার অভিযান চালানোর নজির প্রায় প্রতি দশকেই রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম সরকারের আমলে কালোবাজারি-মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান, জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসন জারির সময়ে এবং এক–এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলোর কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে অপারেশন ক্লিন হার্টও ছিল বহুল আলোচিত। ক্লিন হার্টের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা। এটি ছাড়া অন্যগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই ধরপাকড়ে যাঁরা আটক হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই কিছুদিন পর সদর্পে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। প্রয়োজনে কেউ দল বদল করেছেন, নয়তো অন্য কোনোভাবে রফা করে নিয়েছেন। মাশুল দিয়েছেন হাতে গোনা দু-চারজন। তবে সাময়িক কালের জন্য জন-আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে এবং কিছুটা হাততালিও মিলেছে। কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক সংকটের মূলে ছিল গণতন্ত্রের সংকোচন। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার না ঘটলে সুশাসন ফিরবে, এমন ভাবনা অবাস্তব। 

  • লেখক সাংবাদিক। 
  • কার্টসি  প্রথম আলো/ অক্টোবর ১, ২০১৯। 


Saturday, September 28, 2019

রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খালেদা জিয়া জেলে

বিশেষ সাক্ষাৎকারে খন্দকার মাহবুব হোসেন



বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর জেলে আছেন। তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের কথা বলছেন আইনজীবীরা। বলছেন, রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারলে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন না। এই প্রেক্ষাপটে কোন পথে খালেদা জিয়া মুক্ত হতে পারেন তা নিয়ে নয়া দিগন্তকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আর এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

তিনি বলেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি- এই সরকারের দুর্নীতি, জুলুমবাজি জনমনে যেভাবে বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একসময় হয়তো একটি গণবিস্ফোরণ ঘটবে। সেখানে হয়তো আমাদের নেতার কোনো প্রয়োজন হবে না। স্বাভাবিকভাবে মানুষ জেগে উঠবে এবং বর্তমান স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

নয়া দিগন্ত : আপনি বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য। আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ ওনার জামিনের ব্যাপারে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আপনি এ কথাও বলেছেন যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওনার মুক্তির পথ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কারণ আমরা জানি, পাঁচ বছর, সাত বছর সাজা হলে যদি উচ্চ আদালতে আপিল করা হয় সাথে সাথে তার জামিন দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে জামিন দেয়া হয়নি। আমাদের আইনে এরকম বিধান রয়েছে, যদি কোনো বয়স্ক ও অসুস্থ মহিলা থাকেন তবে তার জামিনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ আবেদন থাকে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে, সাত বছরের সাজায় তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে বলতে গেলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হয়নি। আমি এখনো মনে করি বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জেলে রাখা হয়েছে। যে পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা না হবে তত দিন পর্যন্ত আইন অঙ্গন থেকে তাকে জামিনে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজপথ উত্তপ্ত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনানুগভাবে কিভাবে মানুষ রাজপথে আন্দোলন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আইনানুগভাবে তো রাজপথ উত্তপ্ত হবে না। আমরা আইনানুগভাবে যদি যাই তখন তো বাধা আসে। আমি বলতে চাই- একটি দেশ এভাবে একটি অবৈধ সরকারের অধীনে দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরে হত্যা-গুম, দুর্নীতির যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে হয়তোবা একসময় একটি সাহসী নেতৃত্বের আবির্ভাব হবে এবং সেই সাহসী নেতৃত্বের পেছনে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়বেন। দেশ উদ্ধার হবে, গণতন্ত্র কায়েম হবে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬টি মামলা আছে, যার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার জামিন আবেদনটি আপিল বিভাগে আছে এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওনার জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করার পর আরেকটি বেঞ্চ ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সামনে আপনাদের আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : আমরা অবশ্যই আইনের বিধান মোতাবেক চেষ্টা করব। কিন্তু বিচারিক আদালতে যে ধরনের বিচার পাওয়া উচিত ছিল আমরা সেই ধরনের বিচার পেয়েছি কি না সেখানে আমাদের দ্বিমত রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর কারাভ্যন্তরে আছেন এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের বাইরে আছেন। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্ব সঙ্কটে অসুবিধায় পড়ছে কি না? আপনার মতামত কী?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : এটাকে অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বিএনপিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দুর্বলতা রয়েছে। আরেকটা বিষয় দেখতে হবে- যারা এখন আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন, তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। সে কারণেও কিছুটা মানসিকভাবে দুর্বলতা তাদের রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে সাহস করে কিছু বলা তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়। তাই এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অবশ্যই একটি সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। আর সাহসী ভূমিকা যদি তারা নিতে সক্ষম না হন তবে তাদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা আছে বলে আমি মনে করি না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি একটি বিশাল দল, সারা দেশে আপনাদের লাখ লাখ কর্মী রয়েছেন। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনারা আইনজীবীরা তাদের কতটুকু সহায়তা দিতে পারছেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমাদের বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে আছেন এবং যারা বাইরে আছেন তাদের অনেককে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। যারা জামিনে আছেন তাদের একটি সময় মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এই কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা সত্য যে, আমাদের নেত্রী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। এই ক্ষেত্রে আমরা মনে করি তার মুক্তি সম্ভব, দেশে যদি একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষ যেন ভোট দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমরা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছি তারা ব্যর্থ হচ্ছি। এবং যত দিন পর্যন্ত আমরা এ থেকে উদ্ধার না পাব তত দিন পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যে আমরা বিশেষ কিছু আশা করতে পারি না।

নয়া দিগন্ত : সরকার এককভাবে সবকিছু করছে অর্থাৎ একক নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিরোধী দল বলতে বিএনপিকে বুঝায়। সরকারের এই একক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যকর কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনার মনে হয়?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, পারছে না। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। না পারারও একটা কারণ রয়েছে। যে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামের কোনোরকম পদক্ষেপ নিলেই বিশেষ করে গ্রামপর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আপনারা ঢাকা শহরে দেখছেন কোনোরকম পুলিশের অনুমোদন ছাড়া আমরা কোনো মিটিং-মিছিল করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে আমি এখনো বিশ্বাস করি এক সময় একটি সফল নেতৃত্ব আসবে। বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে অনেক সময় এ দেশের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণে আমাদের কিছুটা দুর্বল নেতৃত্ব রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : আইন অঙ্গনে আপনি দীর্ঘদিন আছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে আপনার আইন পেশায় প্র্যাকটিস শুরু। এই পেশায় যখন এসেছেন তখন যা দেখেছেন আর বর্তমানে যা দেখছেন এর মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : এই সুদীর্ঘ ৫০ বছর আইন অঙ্গনে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। আমরা যখন প্রথম বারে এসেছিলাম তখন আমরা দেখেছি, বিচারক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করেন এবং আইন মাফিক বিচার করেন। সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত প্রভাব থাকত না। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখতে পাচ্ছি- আইন অঙ্গনেও বিভিন্নভাবে বিচার ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। মানুষ এ কথা মনে করেন। তাই একটি কথা মনে রাখতে হবে- বিচার বিভাগ হলো জনগণের শেষ আশ্রয় স্থল। এই আশ্রয় স্থলটি যাতে কোনো মতে, কোনোভাবে কলঙ্কিত না হয়। প্রভাবমুক্ত থাকে সেটা আমাদের সবাইকে দেখতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান যে অবস্থা তার অবশ্যই পরিবর্তন হতে হবে।

নয়া দিগন্ত : একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাই। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিলেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় এখন কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে?


খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখুন, বাকশাল হওয়ার আগে আমাদের প্রথম সংবিধানে ছিল- নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ বিশেষ করে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংসদের। পরবর্তী সময়ে বাকশাল হয়, এটা এককভাবে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ রাষ্ট্রপতির আওতায় নেয়া হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে নিজে রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই ক্ষমতা খর্ব করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনুযায়ী বিচারকদের যদি অপসারণ করতে হয়, তিনজন সদস্য থাকবেন- প্রধান বিচারপতি এবং তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতি। পঞ্চম সংশোধনীতে সেটাকে বহাল রাখা হয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি না থাকে তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বক্ষেত্রে নেয়া হয় সে ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস রয়েছে যে, বিচারকদেরও রাজনৈতিক আক্রোশে তাদের সরিয়ে দেয়া হতে পারে। এজন্য পার্লামেন্টের কাছে এটি না দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনো বহাল আছে। আরেকটা বড় বিষয় হলো আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে দল থেকে একজন সংসদ নির্বাচিত হবেন তাকে অবশ্যই সে দলকে সমর্থন দিতে হবে যেকোনো ভাবে। তার ফলে দেখা যাচ্ছে, যদি কোনো সরকারি দল বিচারকের অপসারণ করতে চায় সে ব্যাপারে তাদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংসদে নাই। সরকার যেটি চাবে তাদের সেই মতামতের ভিত্তিতে ভোট দিতে হবে। এখনো তিনজন বিচারকের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেটাও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতায় করা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
  • কার্টসি ঃ নয়াদিগন্ত/ সেপ্টেম্বর ২৮,  ২০১৯ । 

Friday, September 27, 2019

বাংলাদেশে গণতন্ত্র



এমাজউদ্দীন আহমদ 

অধ্যাপক মুনরোর (William Bennett Munro) কথায়, 'সুসভ্য মানুষ ধর্মীয় অনুপ্রেরণা লাভ করেছে প্রাচ্যদেশ থেকে, অক্ষর পেয়েছে ইজিপ্ট থেকে, অ্যালজেব্রা পেয়েছে মুরদের কাছ থেকে, ভাস্কর্য লাভ করেছে গ্রিকদের কাছ থেকে, আইন পেয়েছে রোমানদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য সে প্রধানত ঋণী ইংলিশ মডেলের কাছে।' ব্রিটিশ সংবিধান হলো সব সংবিধানের জননী। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সব পার্লামেন্টের জন্মদাত্রী। এর ভিত্তিতেই কালে কালে সংগঠিত হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র বা পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি ব্রিটিশ মডেলের। গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ ব্যবস্থার অনুকরণেই। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে ধারণ করেই। তারপরও কেন সংসদীয় ব্যবস্থা এ দেশে প্রাণবন্ত হচ্ছে না? কেন এ দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে? এসব প্রশ্ন জনগণের মনে প্রতিনিয়ত আলোড়ন তোলে; আন্দোলিত করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মনকে। এসব প্রশ্নের উত্তর সবার কাছে সহজলভ্য হওয়া দরকার। সবার জানা দরকার।



আজকের বাংলাদেশে ব্রিটিশ মডেলে নির্বাচিত সংসদ থাকার কথা। রয়েছে ব্রিটিশ পদ্ধতির মন্ত্রিপরিষদ। রানী নেই বসে শীর্ষস্থানে, কিন্তু রয়েছেন রাষ্ট্রপতি, শাসনতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে। রয়েছে রাজনৈতিক দল। ব্রিটিশ মডেলের বহুদলীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল রয়েছে শাসন কাজ পরিচালনার দায়িত্বে। সংখ্যালঘু দল বিরোধিতায়। ছায়া কেবিনেট গঠিত হয়নি বটে, কিন্তু বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ কেবিনেট সদস্যদের প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করছেন। গণতন্ত্রের কাঠামো রয়েছে, নেই শুধু এর সুষ্ঠু কার্যকারিতা।

গণতন্ত্রের সুষ্ঠু কার্যকারিতা নেই কেন? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। নেই এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য জবাব। ইতিহাস এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল নয়। শুধু এটুকু বলা যায়, ইতিহাস নয়, বরং এ ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিতে পারে সমাজবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান বা পলিটিক্যাল ইকোনমি। বাংলাদেশে সংসদ রয়েছে, নেই শুধু সংসদীয় সংস্কৃতি। মন্ত্রিপরিষদ আছে, নেই মন্ত্রিপরিষদীয় দায়িত্বশীলতার একবিন্দু। যতটুকু রাজনৈতিক দল আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে দলীয় জিঘাংসা, দলীয় প্রতিহিংসা। সরকার রয়েছে। রয়েছে বিরোধী দলও। কিন্তু একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়; রয়েছে বৈরিতার ডালা সাজিয়ে, শত্রুতার হিংস্র দন্তনখরসমেত। রাষ্ট্রপতি শুধু অলঙ্কার। ব্রিটেনে অনেকে এখনও বিশ্বাস করে, যতক্ষণ রানী বাকিংহাম প্রাসাদে রয়েছেন; জনগণ ততক্ষণ ঘুমায় নিশ্চিন্তে। বঙ্গভবনের কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এখনও তা প্রযোজ্য হয়নি।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বৃহৎ জনসমষ্টির শাসন-প্রশাসনের কলাকৌশলে মাত্র দুটি জাতি বিশিষ্ট অবদান রেখেছে। প্রাচীন বিশ্বে রোমান জাতি; আধুনিককালে ব্রিটিশরা। রোমানদের সুবিস্তৃত শাসনব্যবস্থার রীতিনীতি ও বিধিবিধান প্রাচীন বিশ্বের প্রায় সর্বত্র গভীর স্বাক্ষর রেখেছিল। সভ্য দুনিয়ায় রোমান সরকার ব্যবস্থা তাই গণ্য হয়েছিল নিত্য, শাশ্বত, স্থায়ী ব্যবস্থারূপে। আধুনিক বিশ্বে ব্রিটিশ মডেল অনেকটা বিশ্বজনীন। দুইয়ের মধ্যে মিল শুধু এইখানে। কার্যকারিতার ক্ষেত্রে তফাত কিন্তু আকাশ-পাতাল। অনেকটা আলো-অন্ধকারের মতো।

রোমান ব্যবস্থা গণইচ্ছার মুকুট পরে জয়যাত্রার সূচনা করে। শেষ করে অবশ্য পরম পরাক্রমশালী বিজয়ীর দুর্বিনীত একাধিপত্যের পদতলে। অন্যদিকে ব্রিটিশ ব্যবস্থা শুরু হয় ক্ষমতাদর্পী, স্বেচ্ছাচারী রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে। এর সমাপ্তি ঘটে সার্বভৌম গণইচ্ছার পদতলে আত্মনিবেদন করে। আধুনিককালের চিন্তাচেতনা ধারণ করে, প্রতি বাঁকে জনগণের রায়ের সঙ্গে নিজেকে সঙ্গতিপূর্ণ করে ব্রিটিশ ব্যবস্থা কালোত্তীর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্রের চেতনা গ্রিক প্রতিভার অনবদ্য সৃষ্টি। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র কিন্তু ব্রিটিশদেরই শ্রেষ্ঠতম অবদান। 'জনগণের বাণী ভগবানেরই বাণী'- এ নীতির বাস্তবায়ন তাদের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।

শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত এ দুই ঐতিহাসিক ধারার প্রতিফলন বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সমাজে দেখা গেছে। এমনকি একই সমাজে বিভিন্ন সময়েও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল গণতন্ত্রকে মাথায় নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অনলকুণ্থেকে স্বাধীনতা এবং রক্তরঞ্জিত পতাকা তুলে এনে; আত্মত্যাগ ও আত্মদানের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগের শত মশাল জ্বালিয়ে। অনেকটা রোমানদের মতো গণতন্ত্রের চেতনাকে শানিত করে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু অথবা অপমৃত্যু ঘটে। তাও মাত্র তিন বছরের মধ্যে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ সংবিধান দ্বিতীয় সংশোধন আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল শিথিল হয়। মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান আসে। বিনা বিচারে আটকের ব্যবস্থা হয়। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয় বাংলাদেশে। একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। সংবাদপত্রের মুখ-চোখ-কান বন্ধ হয়। বিরোধিতার সব বাতায়ন রুদ্ধ হয়। রোমান শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে লেগেছিল কয়েকশ' বছর। বাংলাদেশে তা এলো মাত্র সাড়ে তিন কি চার বছরে, প্রবল প্রতাপ বিজয়ীর পদতলে।

অন্যদিকে তাকালেও দেখা যাবে, ব্রিটিশ পদ্ধতি পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় চার-পাঁচশ' বছরে। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা থেকে যার যাত্রা শুরু, ১৬৮৮-এর গৌরবময় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার স্থিতিশীল অবস্থা। পরবর্তী পর্যায়ে তা ব্রিটেনেই সীমিত থাকেনি। বিশ্বময় হয়েছে প্রচারিত, প্রবর্তিত এবং নন্দিত। বাংলাদেশে এ চক্রের আবর্তনে সময় লাগে মাত্র ক'বছর। প্রথমে একদলীয় ব্যবস্থার অবসান এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন। গণতন্ত্রের চলার প্রক্রিয়া যে নির্বাচন, তার প্রতিষ্ঠা। মৌলিক অধিকারের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন। দু'দশকের মধ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, ১৯৯১ সালে। সংসদকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পুনঃস্থাপন। সরকারি ও বিরোধী দলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্তকরণ। এ সবকিছুই মাত্র দু'দশকের মধ্যে। ব্রিটিশ ব্যবস্থার মতো রাজাধিরাজের পদতল থেকে গণইচ্ছার সিংহাসনে।

শাসনব্যবস্থার এ নাটকে বারবার পটপরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত নয়। নয় প্রয়োজনীয়। তার পরও তা হয় কেন? কেন হয়, তার বিস্তৃত জবাব রয়েছে। কীভাবে এর গতিপথ রোধ করা যায়, তারও পথনির্দেশ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জন স্টুয়ার্ট মিলের কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি কোনো জাতির অনুরাগ থাকতে পারে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কোনো সমাজে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয় যদি ওই জাতি ঔদাসীন্য বা অসতর্ক বা কাপুরুষোচিত আচরণ বা গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবে অধিকার সংরক্ষণের অযোগ্য হয়ে ওঠে। আক্রান্ত হলে সংগ্রামে লিপ্ত না হলে, শাসনব্যবস্থার বাইরের চাকচিক্যে বিভ্রান্ত হলে কিংবা সাময়িকভাবে উৎসাহ হারিয়ে ফেললে, ভীত-সন্ত্রস্ত হলে অথবা কোনো ব্যক্তির প্রতি তিনি যত বড় এবং মহান নেতাই হোক না কেন, অনুরাগের আতিশয্যে মুগ্ধ হয়ে সব অধিকার তার পায়ে সঁপে দিলে, ওই জাতি স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের অযোগ্য হয়ে ওঠে।'

স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় বাংলাদেশের সচেতন জনগণের জন্য আজকে জন স্টুয়ার্ট মিলের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হতে পারে শুধু গণতান্ত্রিক কাঠামোয়। প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় গণতন্ত্রে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পায় এ ব্যবস্থায়। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ লাভ করে গণতন্ত্রে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণে জনগণের যে ভূমিকা, নেতৃত্বের ভূমিকা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নেতানেত্রীদের এ কথা স্মরণে রাখা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ১৮০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, 'আমরা সবাই রিপাবলিকান-ফেডারেলিস্ট। আমাদের মধ্যে এখনও যদি কেউ থেকে থাকেন যিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভেঙে দিতে চান বা রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক রূপকে পাল্টে দিতে চান, তাহলেও তিনি পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী হবেন। কেননা, ভ্রান্ত অভিমতকে শোধরাতে হবে শুধু যুক্তি দিয়ে।' তিনি আরও বলেন, 'ত্রুটিপূর্ণ বিচার-বুদ্ধির জন্য আমি ভুল করতে পারি। যখন সঠিক পথে থাকব, তখনও সার্বিক চিত্র চোখের সামনে না পেয়ে আমাকে ভ্রান্ত বলে সমালোচনা করতে পারেন কেউ কেউ। আমার ভুল শুধরে দেওয়ার আহ্বান জানাই।'

ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ফেডারেলিস্ট ওই দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। বিজয়ী হয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন, আমরা সবাই রিপাবলিকান, আমরা সবাই ফেডারেলিস্ট। পারবেন কি আমাদের নেতানেত্রীরা বলতে- 'সবাই আমরা আওয়ামীপন্থি, সবাই আমরা বিএনপিপন্থি, সবাই আমরা বাংলাদেশি'। মহৎপ্রাণ নেতৃত্বের অগ্নিস্পর্শে বিভেদের সব কালিমা মুছে যায়। মুছে যায় বলেই জেফারসনের মতো নেতা সবাইকে আহ্বান করতে পারেন এক প্রাণ এক মন নিয়ে সম্মিলিত হতে। ফলে গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বিশাল সৌধ। আর আমরা? আমাদের নেতানেত্রীরা দয়া করে স্মরণ করুন গণতন্ত্রের প্রবক্তা ওইসব দিকপালের কিছু অমৃত বাণী। গণতন্ত্রের ঝুপড়ি বানানোর ক্ষমতাও কি নেই আমাদের? সরল মনে কল্যাণকর জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পারেন না তেমনি উদাত্ত আহ্বানে সবার মনকে স্পর্শ করতে? এটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

সঙ্গে সঙ্গে আগামী দিনগুলোকে অর্থপূর্ণ করতে হলে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে রাষ্ট্রকৃত্যকদের সম্পর্কে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত হতে হবে জনগণের কাছে। সরকারকে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। একদলীয় ব্যবস্থার প্রতি মোহগ্রস্ত হলে গণতন্ত্রের শিকড়টা নড়বড়ে হয়ে যাবে। 


  • লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী 
  • সূত্র — সমকাল/সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯  
  • লিঙ্ক —   http://bit.ly/2nDQKXW 


Saturday, September 21, 2019

এক হাতে কাপড় সামলাই, অন্য হাতের আঙুল চুষি

ফারুক ওয়াসিফ




কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আর কেউ আঙুল চোষে। চিকিৎসকেরা বলেন, নখসুদ্ধ আঙুল পরিষ্কার থাকলে ওটা চোষা যেতেই পারে। শিশুর বেলায় ওটা বদভ্যাস হলেও বড়দের জন্য অসহায়ত্ব। যখন কারও করার কিছু থাকে না, তখন আঙুল চোষায় লজ্জা থাকলেও অপরাধ হয় না।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় আঙুলের নখে কালির দাগ না লাগাতে পারায় অনেকে আঙুল চুষেছিলেন। এ জন্য কেউ কোটি কোটি ভোটারকে দোষারোপ করেননি। একটু বদনাম হয় আরকি। যাঁরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স টানাটানি করে হাতে দাগ লাগিয়েছিলেন, তাঁদের অন্তত আঙুল চোষার বদনাম দেওয়া যায় না। চুষলে বরং ঝামেলাই হতো। ময়লা আঙুল চোষা বারণ। সেটা তাঁরা করবেনই–বা কেন? চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, আঙুল চোষে কিংকর্তব্যবিমূঢ়েরা। যে শিশু ভয় পায়, নিরানন্দ লাগে যার, সে আঙুল চোষে। আবার উত্তেজিত হলে আঙুল চুষলে মন শান্ত হয়। আঙুল চোষার ফজিলত বাংলাদেশিদের চেয়ে আর কে বেশি জানে?

প্রকাশ্যে নারীকে গণপিটুনিতে যখন মেরে ফেলা হলো, তখন দর্শকেরা আঙুল চুষেছিল। যখন বরগুনায় রিফাত শরীফকে কোপানো হচ্ছিল, তখনো চারপাশে আঙুল চোষায় সিদ্ধহস্তদের আমরা ভিডিওতে দেখেছি। তাদের মধ্যে আমার–আপনার মতো মানুষও ছিল। যখন সব আমরা আমরাই করে থাকি, তখন আর লজ্জার কী থাকতে পারে! যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীর মাজায় হাতুড়িনৃত্য চলছিল, দর্শকদের কারও হাত তখন এগিয়ে এসে তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কারণ, হাতের একটি আঙুল মুখে পোরা ছিল। একটি আঙুল, কেবল একটি আঙুল মুখে পুরে রেখে দেখুন আর কিছু করতে পারেন কি না?

যেমন আমরা পারিনি, আমাদের তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান সাহেবও পারেননি। তাঁর এবং তাঁর মতো অনেক দায়িত্বশীলের চোখের সামনে ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা হ্যাক করে প্রায় হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেল; তাঁরা কিছু করতে পারেননি। সম্ভবত তাঁরা তখন আঙুল চুষছিলেন। সেই চোষা এমনই চোষা যে ঘটনাটির ২৮ দিন পরও তিনি মুখ খুলতে পারেননি। কারণ, মুখে আঙুল পোরা ছিল। ফলে কেউ কিছু জানতেও পারেনি।

এক গৃহস্থ ঘুমের মধ্যে মুখে আঙুল পুরে রাখতেন। ছোটবেলার অভ্যাস। এক রাতে যখন তাঁর ঘরে চুরি হচ্ছে, তখন ঘুম ভাঙলেও তিনি আওয়াজ করতে পারেননি। আওয়াজ করতে হলে মুখ থেকে আঙুল বের করতে হয় যে! মুখে ঠেসে ধরা আঙুল চুপ করানোর প্রতীক। আর আঙুল চোষা হলো স্বেচ্ছা নীরবতার প্রতীক।

ডেঙ্গু মহামারিতে সারা দেশে দুই শর বেশি মানুষের মৃত্যু হলো, আরও হচ্ছে। আগেভাগে খবরও ছিল। তবু আঙুল চোষাজনিত বিকলতায় সংশ্লিষ্টরা কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। খেলাপি ঋণে ব্যাংক–আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার মুখে, লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার, কারও আঙুল উঁচু হয়ে বলল না, ‘খবরদার!’

আমরা দেখেছি, সঠিক মানুষের সঠিক তর্জনী সঠিক সময় উঁচু হলে কী হয়? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিশ্ব দেখেছে, একটি স্বাধীন ও সাহসী আঙুলের নির্দেশ কত শক্তিশালী হতে পারে। মিয়ানমার এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী পাঠিয়ে দিল, গণহত্যা চালাল সীমান্ত ঘেঁষে। মানবতার ভয়াবহ ধ্বংসের রিয়েলিটি শো দেখেও কেউ বলল না, ‘আমাদের দেশ তোমাদের নিষ্ঠুরতার শিকারদের ফেলার জায়গা না, খবরদার!’

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন শ্রমিকের লাশ আসছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি লাশ। যেসব নারীর ঘর হইতে আঙিনা বাহির ছিল, তাঁরাও আশায় বুক বেঁধে মধ্যপ্রাচ্যে যান। রক্তাক্ত–নির্যাতিত হয়ে তাঁরা ফিরে আসছেন। আমাদের যুবকেরা ইউরোপে যেতে সমুদ্রে ডুবে মরছেন। মুখে আঙুল পুরে আমরা টেলিভিশনে দেখে গিয়েছি; কিচ্ছু করতে পারিনি।

যুবলীগের নেতা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে সংগঠনের চেয়ারম্যান গোসসা করেছেন। বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের লোকেরা কি এত দিন আঙুল চুষেছেন? তাঁরা কি এসব জানতেন না? কথা সত্য, যাঁদের করার কিছু থাকে, তাঁরা সাধারণত আঙুল চোষেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয় অন্য কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তাই আঙুল চোষার অভিযোগ অন্তত তাঁদের বিরুদ্ধে করা যায় না। স্বয়ং চেয়ারম্যানও সময় পাননি তাঁর অনুসারীদের খোঁজ রাখতে। টেলিভিশনে যেভাবে তাঁদের ব্যস্ততা, সফর, বক্তৃতা ইত্যাদির সচিত্র বিবরণ দেখে মনে হয় না আঙুল চোষার সময় তাঁরা পান। সেই সময় আমাদের আছে, আমরা যারা আমজনতা।

এখন যখন ক্ষমতার এক আঙুল আরেক আঙুলকে দোষারোপ করছে, তখন জনগণ হিসেবে আমরা বিভ্রান্ত হই। বেদিশা লাগে। ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে সাংবাদিকদের ক্যামেরার হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে চমকে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। এই অবসরে চোষণলিপ্ত মুখ থেকে ছাড়া পায় আঙুল। সেই আঙুলে মাথা চুলকাই। বুঝতে পারি না কলির কোন কালে এসে পড়লাম রে বাবা! সবাই হঠাৎ ফ্রুটিকা খেল নাকি? এত সত্য সত্য কথা বলছে কেন সবাই? আমরা উত্তেজিত হই। উত্তেজনাবশত আবার মুখে আঙুল পুরে দিই এবং চুষতে চুষতে দেখি, বড় মাছ ছোট ছোট মাছকে ধাওয়া করছে। এক উপাচার্য চিরকুট দিয়ে ছাত্র ভর্তি করছেন, আরেকজন কোটি টাকার সেলামি দিচ্ছেন, আরেকজন আবার ৩৪০ দিনের চাকরিতে ২৫০ দিন ক্যাম্পাসেই যাননি।

একটা গল্প মনে পড়ে যায়।

প্রথম শ্রেণির ছাত্র ভোলারামের আঙুল চোষার রোগ। মা–বাবা হোমিও, অ্যালো, টোটকা, কবিরাজি সব সেরে হয়রান। কিছুতেই ভোলার মুখ থেকে আঙুল বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যায় না। ভোলার এক মামা ছিলেন। সব দেখে তিনি সহজ বুদ্ধি দিলেন। বললেন, ‘দাও ওর প্যান্টগুলো আচ্ছা ঢিলা করে।’

এরপর হলো কী। পরলেই প্যান্ট কোমর থেকে যে–ই না খসে পড়ে, অমনি ভোলা দুই হাত দিয়ে প্যান্ট ধরে রাখে তুলে। এমনি করেই বেচারা দৌড়াদৌড়ি করে, খেলাধুলা করে, স্কুলে যায়। বাবা–মা, স্কুলের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব—সবাই বেজায় খুশি। সবাই শিখল, প্যান্ট খসে গিয়ে নাঙ্গা হওয়ার ভয় না পেলে কেউ আঙুল চোষা বন্ধ করে না।

যে জাতি আঙুল চোষার নেশায় আসক্ত, তাদের ভোলারামের মতো পরনের কাপড় খসে পড়লেও আঙুল চোষা আর বন্ধ হবে না। সমস্যা হলো, খেলারামরা মাঠের দখল নিয়ে নিলে ভোলারামরা আঙুল না চুষে আর কী করতে পারে? আমাদের অবস্থা হয়েছে, এক হাতে কাপড় সামলাই তো আরেক হাতের আঙুল চুষি।

  • লেখক সাংবাদিক।
  • কার্টসি —  প্রথম আলো/ সেপ্টেম্বর ২১,২০১৯