আবু সালেহ সায়াদাত
দুর্বিষহ যানজট, লাগামহীন বাসা ভাড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গণপরিবহন সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনে জটিলতা, বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, ভেজাল খাবার- সব মিলিয়ে রাজধানীবাসীকে প্রতিদিনই দুর্ভোগ, দুর্দশা আর বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। এসব সমস্যা রাজধানীবাসীর সুখ প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে। হতাশ হতে হতে এখন অনেকেই বিষণ্নতায় ভুগছেন। সার্বিক বিবেচনায় ভালো নেই রাজধানীর মানুষ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের অধিবেশনে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, রাজধানীর বাসিন্দাদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ধনী-গরিবের আয়ের বিপুল বৈষম্য প্রভাব ফেলছে রাজধানীবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর। রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত।
২০১৯ সালের জুন-জুলাইয়ে রাজধানীতে বাস করা ১২ হাজার ৪৬৮ জন মানুষের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ঢাকার ১৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অর্থনৈতিক কারণে তাদের অনেকে বস্তিতে থাকেন। অনেকের বসবাসের সংস্থান নেই। এছাড়া নগরীর যানজট, বাতাসের মান, বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ আরও কিছু সমস্যার কারণে রাজধানীতে বাস করা মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যান্ত্রিক শহরে বাস করায় জীবনযাত্রাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবছে। পারস্পরিক সুখ-দুঃখে কেউ কাউকে তেমন পাশে পায় না। একটা সময় মানুষ একাকিত্ব অনুভব করে হতাশ হচ্ছে। পাশাপাশি অল্পতেই ধৈর্যহারা এবং মেজাজ আরও খিটখিটে হচ্ছে। সামান্য কথায় একে অপরের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে।
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ইমরান আলী একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। যানজটের কারণে মিরপুর থেকে পল্টন মোড়ে তার অফিসে আসতে প্রতিদিন প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা সময় লাগে। অফিস শেষে ফেরার সময়ও একই অবস্থা। ইমরান আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিদিন এত দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকে অফিসে পৌঁছানোর পর একটুতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, কোনো কাজ ভালো করে করতে পারি না। মনে হয়, সবার মেজাজ সব সময় চড়া থাকছে, কেউ কিছু বললেই ক্ষেপে উঠছে।’
রাজধানীর মানুষ কেন এত খিটখিটে মেজাজের হচ্ছে, কেনই-বা তাদের মনোবৈকল্য বাড়ছে- এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বসবাসের অযোগ্য এবং বায়ুদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, সামাজিক নিরাপত্তা- সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি বিষয় এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে মানুষ মানসিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ভালো নেই।
তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় একটি সাধারণ বাহনে গন্তব্যে যেতে ১০ মিনিট সময় লাগার কথা কিন্তু এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা লাগছে। তখন মানুষের মধ্য এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। এ চাপ তার শরীরের মধ্যে কতগুলো হরমন (রাসায়নিক পদার্থ) নিঃসরণ করে যেটি তার হৃদপিণ্ড, নাড়ির গতি ও ব্লাড পেসার বাড়িয়ে দেয়। হার্ট, ফুসফুস, শরীরের সামগ্রিক অবস্থার ওপর এক ধরনের নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি হয়। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ ভালো থাকতে পারে না। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, সামগ্রিক দূষণ ক্যান্সারের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। খাদ্যে ভেজালসহ অন্যান্য কারণে কিডনি নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। একই সঙ্গে বায়ু ও পরিবেশ দূষণ, সামাজিক অনিরাপত্তা মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি করছে। যেটা তাকে প্রতিনিয়ত দহন করছে। বসবাসের অনুপযোগী এ শহরে আসলে কেউ ভালো থাকতে পারছে না।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ
সম্প্রতি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৯ সালে আগের বছরের তুলনায় দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। বৃদ্ধির এ হার আগের বছরের চেয়ে বেশি।
রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্য ব্যবহার সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এ হিসাব করেছে। এ হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয়বহির্ভূত।
বেতনের সিংহ ভাগই যাচ্ছে বাসা ভাড়ায়
জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। ভাড়া বাসার এমন চাহিদা দেখে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়ির মালিকরা ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। জানুয়ারি এলেই ভাড়া বৃদ্ধির খড়গ নামে ভাড়াটিয়াদের ওপর। যে কারণে তাদের বেতনের সিংহ ভাগই চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া দিতে।
অন্যদিকে ক্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে উচ্চবিত্তের বাড়ি ভাড়া কিছুটা কমলেও নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়ায় বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বস্তিঘরের ভাড়া। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮.১৮ শতাংশ, বস্তির ঘর ভাড়া বেড়েছে ৯.৭৪ এবং মেস রুমের ভাড়া ৭.৯১ শতাংশ বেড়েছে।
উন্নয়নের ভোগান্তি
এমনিতেই বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় বার বার উঠে আসছে রাজধানী ঢাকার নাম। তার ওপর উন্নয়ন কাজে বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলায় পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলছে। রোদ থাকলে ধুলা আর একটু বৃষ্টি হলেই কাদা। মাঝেমধ্যে দেখা দেয় জলাবদ্ধতাও। যানজট, ধুলা দূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর জনদুর্ভোগ যেন চরমে পৌঁছেছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন- পবা এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বর্তমান যানজটের কারণে প্রতিদিন ঢাকায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ফলে বছরে যে ক্ষতি হয়, অংকের হিসাবে তা প্রায় হাজার কোটি টাকা। এ শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলছে।
এক জরিপ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পবা বলছে, নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় পাবলিক পরিবহনের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার, ২০০৮ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় আট হাজারে। নানা সমস্যার কারণে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা মাত্র তিন হাজারে উন্নীত হয়। অন্যদিকে ২০১০ সালে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৪৯৫ যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ৫৫-তে। দিন দিন যেমন প্রাইভেট কারের সংখ্যা বাড়ছে তেমনি পাবলিক বাস হ্রাসের হারটিও খুব উদ্বেগজনক।
ঢাকায় যাতায়াত ও গণপরিবহন
দিনে অন্তত ছয় লাখ মানুষ নানা প্রয়োজনে আসছেন রাজধানীতে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। তাই দিনে অন্তত ২১ লাখ পরিবহন ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু যানজটের কারণে ২১ লাখের তিনভাগের একভাগও ট্রিপ হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতি তিন হাজার যাত্রীর যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র একটি। এছাড়া অটোরিকশাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অচল। গণপরিবহন সংকটের বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।
তিনটি রুটে পরিচালিত জাইকার এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় পাবলিক বাসে প্রতিদিন প্রায় ১৯ লাখ যাত্রী চলাচল করে। ঢাকার তিনটি করিডোরে পাবলিক বাসের যাতায়াতের জন্য গড়ে ৭৭ মিনিট করে সময় লাগে। যার ২৪ শতাংশ বাসের জন্য অপেক্ষা, ৪৪ শতাংশ বাসে ওঠা-নামা ও বাস পরিবর্তন এবং ৩২ শতাংশ সময় বাসে চলন্ত অবস্থায় ব্যয় হয়।
পবার মতে, ঢাকা মহানগরীতে যানজট হ্রাসে গণপরিবহনের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে অপেক্ষার সময়, বাসে ওঠা-নামা ও বাস পরিবর্তনের সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি বাসের পৃথক লেন করা গেলে যাতায়াতের সময় অনেক কমবে।
৭৬ ভাগ সড়ক ৬ শতাংশ মানুষের দখলে
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলকারী ৬ শতাংশ মানুষ ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক দখল করে আছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট সড়কের ৬০-৬৫ ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। গণপরিবহনের দখলে থাকে ৬-৮ শতাংশ। সড়কের বাঁকি অংশ বিভিন্নভাবে অবৈধ দখল ও পার্কিংয়ের দখলে থাকে।
এছাড়া পবা বলছে, রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের মোট আয়তনের ৯ শতাংশ সড়ক, যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ ফুটপাত। এক হাজার ২৮৬ কিলোমিটার রাস্তার ৬১ কিলোমিটার প্রাইমারি, ১০৮ কিলোমিটার সেকেন্ডারি, ২২১ কিলোমিটার কানেক্টর, ৫৭৩ কিলোমিটার লোকাল ও বাকিটা সংকীর্ণ। পুরো শহরের মধ্যে ১০৭ কিলোমিটার প্রশস্ততা ২৪ মিটারের বেশি। ফুটপাতের প্রশস্ততা যেটি মাত্র ৪৫ কিলোমিটার, একটা পর্যায় পর্যন্ত যা সেবা দিতে উপযুক্ত ছিল।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকা সিটি করপোরেশনে ৮২১ দশমিক ৬১ কিলোমিটার (৬৪ শতাংশ) রাস্তার প্রশস্ততা ৪ দশমিক ৭৫ মিটার বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি। ফুটপাতের প্রশস্ততা অনুযায়ী এটি মাত্র ৬১৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার (৪৮ শতাংশ)। অন্য ৪৬৪ কিলোমিটার (৩৬ শতাংশ) সড়কে জরুরি গাড়ি যেমন- অ্যাম্বুলেন্স বা অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না।
এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, যানজট, শব্দ ও বায়ু দূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি দিন দিন চরমে পৌঁছেছে। সবমিলিয়ে এ শহরের মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। এখানে কেউ ভালো নেই। মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি আর মেনে নেয়া যায় না। এসব থেকে রাজধানীবাসীকের রক্ষা করতে সম্মিলিত পরিকল্পনা মাফিক উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
- কার্টসি - জাগো নিউজ/ জানুয়ারি ২২, ২০২০