Search

Sunday, June 6, 2021

‘ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব’

-------------------------------------- 
আবিদ হাসান/বাংলাট্রিবিউন
 -------------------------------------- 
ইকবাল হোসেন শ্যামল
সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল

দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের চর্চা ও ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের কী ভূমিকা ছিল? ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ছাত্র সংগঠনগুলো জোরালো ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার যখন স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়েছে বা দেখাতে চেয়েছে, অগণতান্ত্রিকভাবে জনমতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্র সংগঠনগুলো ওই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১/১১-এ ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও ছাত্র সংগঠনগুলো কথা বলছে। 

 বাংলা ট্রিবিউন: আগামীর ৫০ বছর কেমন আশা করেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের যে মূল আকাঙ্ক্ষা তথা গণতন্ত্র- তা আমরা পাইনি। গণতন্ত্রের যে মূল উপকরণ-জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, জনগণের ভোটাধিকার, সেই অধিকার এই সরকার খর্ব করেছে। ৫০ বছরেও আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রত্যক্ষ ভোট, তা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা আশা করি, দেশের জনগণের ভোটের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করবো, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবো। 

বাংলা ট্রিবিউন: ক্যাম্পাসে রাজনীতির সংস্কৃতির পরিবর্তন আসছে কি? কী পরিবর্তন দেখছেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব। আমি মনে করি শুধু ক্লাসরুমে শিক্ষকের লেকচারে শিক্ষাটা সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। ছাত্র রাজনীতিকে আমি সামাজিক কার্যক্রম বলতে চাই। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান যতটা আশা করি তার সিংহভাগই অনুপস্থিত। ক্যাম্পাস মুক্তচিন্তার জায়গা হবে, স্বাধীনভাবে আমি আমার মত প্রকাশ করবো। বর্তমানে ক্যাম্পাসে সেই পরিবেশ নেই। রাজনীতি সংস্কৃতির পরিবর্তন আসেনি। আশির দশকেও ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সহাবস্থানের রাজনীতি করেছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিন্নমতের কোনও সংগঠনকে আমরা লালন করতে পারি না, ধারণ করতে পারি না। 

বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কেমন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটা 'খয়ের খা' প্রশাসন। এই প্রশাসন সরকারের অনুগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষ আচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। আমাদের সুন্দর ক্যাম্পাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই আস্থা রাখতে হবে। সেই আস্থার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেই। রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ
বিনির্মাণ করতে পারছে না। 



বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দিলো, এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি কোন দিকে? ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তির জন্যই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। শত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্দেশ্যের অনেকটাই পূরণ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই রচিত। তবে বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা হতাশ। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক নিচে। রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও নামছে। যখন সকল মতের জন্য ক্যাম্পাস হবে তখন শিক্ষার পরিবেশেরও উন্নতি হবে। 

বাংলা ট্রিবিউন : এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সহাবস্থান আছে? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাড়া সকল সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম খুবই সীমিত। ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্বাচন দীর্ঘদিন হচ্ছে না। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যদের কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে সহাবস্থান আছে। এটাকে সহাবস্থান বলা যাবে না। কারণ প্রতিনিয়তই তারা আমাদের ওপর হামলা করছে। আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

বাংলা ট্রিবিউন : হলগুলোতে ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্য রয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ, এ বিষয়ে কী বলবেন? 
 ইকবাল হোসেন শ্যামল : এর সঙ্গে আমিও একমত। ভিন্নমতের কাউকেই স্থান দেওয়া হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের বাইরে গেলে কাউকেই হলে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলা ট্রিবিউন : ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা আছে? ইকবাল হোসেন শ্যামল: ভিন্নমত থাকবেই। আমরা ভিন্নমতকে সম্মান করি। আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। বর্তমানে কিছু কিছু সংগঠনের মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা কমেছে। তারা অন্য মত কিছুতেই সহ্য করছে না। এটা আশঙ্কার জায়গা। এটা অবশ্যই শিক্ষার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।


Wednesday, June 2, 2021

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর অর্থনীতি

------------------------------------------

—  ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

------------------------------------------

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম

একমূখী রাষ্ট্রীয়করণ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ভারসাম্যপূর্ণ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

জিয়াউর রহমান সরকার সমাজতান্ত্রিক মেরুকরণকৃত একমুখী নীতি কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনীতি, শিল্পনীতিতে  গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতিপদ্ধতির মাঝামাঝি একটা মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। এসময় গুরুত্বপূর্ন প্রায়  সকল নাগরিক সেবাকে সরকারি খাতে রেখেই বেসরকারি শিল্প বিকাশের পথে হাঁটা হয়। 

দ্রুত দেশের আর্থ-সামাজিকউন্নয়নের জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় করেছেন তিনটি উৎপাদন মূখী অর্থনৈতিক ধারা। এক — কৃষির সবুজ বিপ্লব। দুই — গণশিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান। তিন — শিল্প উৎপাদন। এসময় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দুটি শ্রমবাজার তৈরি হয় বাংলাদেশে। এক — তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার। দুই —  মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমবাজার। এর বাইরেও আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ  উদ্যোগ ছিল যা হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা। তিনটি অর্থনৈতিক ধারা এবং দুটি শ্রম বাজার পরবর্তিকালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু বংলাদেশ একটি বাজারমুখি রাষ্ট্র এবং যার সূচনা জিয়াউর রহমানের শাসনকালেই, তাই অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, মূলত এই সময়কালে সূচিত পরিবর্তন গুলোর ভিত্তিতেই পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ ও গতিপথ আবর্তিত হয়েছে।  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তিনটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, প্রবাসী শ্রমবাজার এবং তৈরি পোশাক শিল্প। এই তিনটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এই সময়েই সূচিত হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালে ক্ষুধার তাড়নায় নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত স্রোতের মত নগরে বিশেষ করে ঢাকায় ছুটেছেন,যাঁদের অনেকেই পরে গ্রামে ফিরে যাননি। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষিতে সেচের সমস্যা ও অযান্ত্রিক শ্রমের প্রাচুর্য ছিল বলে সেখানে কৃষির কাজে অধিকতর সংখ্যায় শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, ফলে বাংলদেশের গ্রামে গ্রামে ছদ্মবেকারত্বের প্রাচুর্যছিল। শ্রমঘনীভবনের দুর্ভিক্ষকালীন ধারা এবং আগে থেকেই বিরাজমান কৃষির ছদ্মবেকারত্ব —  এই দুটি ধারা জিয়াউর রহমানের আমলে শ্রমবাজারে রূপান্তর ঘটে। এসময় গণচীন পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন সহায়তায় তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ নতুন এক শ্রমবাজারের পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমের আরেকটি নতুন বাজার গড়ে উঠে। পাশাপাশি অলস ভাতার পরিবর্তে কাজের বিনিময়ে অলস শ্রমকে উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত করায়, খাল খনন করে সেচের সুবিধা তৈরির ফলে কৃষিতে ও সবুজবিল্পব আসে। ফলে দেশে প্রায়োগিক পূঁজি ও মানবপূঁজি উভয়ের বহুবিধবিকাশ শুরু হয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত বিকশের পথ ও তৈরিহয়।

ফলস্বরূপ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মাঝের ও শেষ এই দুটি অর্থবছরে (১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮০-৮১) বাংলাদেশ সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  বাংলাদেশের মাথাপিছু স্থূল দেশজ উৎপাদন গড়ে ৪.৫২% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, যা নব্বই দশকের আগের সময়ে গড় হিসেবে সর্বোচ্চ।















ছক —  জিয়াউর রহমান ও আবদুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার। তথ্যসূত্র —  বিশ্বব্যাংক।   

বিবিধ কারণে জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শুরুর সময়কাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অবকাঠামোগত পুরোপুরি পুনর্ঘটিত হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ,  ১৯৭৫ সালের বাকশাল ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন জনিত বড় বড় দুর্ভাগ্যজনক অস্থিরতাগুলো বাংলাদেশের অর্থনিতিকে ভুগিয়েছে। দেশে সার্বিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

বহুমুখী বাস্তবধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। এ সময়ে খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে, গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক  কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়া সরকারের। জিয়াউর রহমান সরাসরিই কৃষি সমবায় এবং সমবায় বাঁধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মসূচী দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এসবের পাশাপাশি মৌলিক সেবা খাতকে সরকারি আয়ত্বে রেখে পশ্চিম ইউরোপীয় ধারার এক ধরণের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতের উৎসাহিত করা হয়েছে, এই বিকাশ সাধনে ব্যাংক ঋণ কর্মসুচীও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষিতে খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

নিন্মে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য দিক গুলোর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে। 

স্থিতিশীলতা — 

১। গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন। 

২। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৩।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান চরম বিশৃঙ্খল দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।‍ সশস্ত্র বাহিনীতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।  সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সম্পন্ন হয়েছিলেন। 

৪। বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ প্রতিষ্ঠা। 

কৃষি — 

পানির পাম্প চালিয়ে কৃষকদের উৎসাহ
দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
১। আবাদী জমি তিন গুণ করার উদ্যোগ নিয়ে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন ছিল এই সময়ের একটা বড় উদ্যোগ।

২। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানির পর্যায়ে উন্নীতকরণের উদ্যোগ।

৩। দারিদ্র্য বিমোচনে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডলকে এগিয়ে নেয়া। 

৪। কাজের বিনিময়ে খাদ্য/কাবিখা, কাজের বিনিময়ে নগদ মজুরীর মত মেধাবী ধারনা দিয়ে সারফেইসে স্বাদু পানির রিজার্ভ বৃদ্ধি করে আবাদী জমি বাড়াতে খাল খননকে একটি সফল কৃষি বিপ্লবে রূপ দেয়া।  

শিল্প — 


১। নতুন ধারার বেসরকারি শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ। কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিকাশ করে দেশে টেলিফোন সেট উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে পাকশি কাগজ কলে দৈনিক ৩০ টন করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়, যা দেশে পাটখড়ি থেকে কাগজ উৎপাদনের প্রথম উদাহরণ।

২। যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।

৩। তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মত নব ধারার বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।

৪। জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানির দ্বার উন্মোচন।

৫। ১৯৭৬ সালে প্রথম ৬০০০ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু। হয়

৬। শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।

৭। ১৯৭৯ তে বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানীযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প (বস্ত্র শিল্প) প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা। এর আগে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৩০ জন কর্মী-উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়দক্ষিণ কোরিয়াতে ট্রেনিং পাঠানো হয়।আশির দশকের শেষ দিকের একটি জরীপে দেখা যায়, এই ১৩০ জন্যের অধিকাংশেরই নিজস্ব তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা ছিল। তবে অভিযোগ আছে, শিল্প ঋণ প্রণোদনা পাওয়া একটা ক্ষুদ্র অংশ ঋণ খেলাপি হয়েছেন এবং শিল্প ঋণের খেলাপি সংস্কৃতি তৈরি করেছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে  পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অপধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  

৮। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণকার্যক্রম শুরু করে (অধ্যাদেশ পাশহয় ১৯৮৩ সালে)।

৯। ১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

শিক্ষা — 

১। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দানেরউদ্যোগ।

২। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়তৈরি।

৩। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ইংরেজী, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা। 

৪। শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা, শিশু মনোবিকাশে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়। 

৫। টেক্সটাইলকলেজপ্রতিষ্ঠাযাবর্তমানেবাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)। 

৬। সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সরকারি কর্ম কমিশন সংস্কার করে বিসিএস এ ১৪ টি বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিস চালু করেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

স্বাস্থ্য — 

১। ২৭, ৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।

২। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৩। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এর পুনঃ সূচনা। (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (স্যাটো) কলেরা গবেষণা পরীক্ষাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার (সিআরএল) খুব দ্রুত ডায়রিয়া রোগ গবেষণায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও ফান্ড জনিত কারণে উল্লেখযোগ্য এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে কলেরা গবেষণা গবেষণাগার (সিআরএল) কে আইসিডিডিআর’বি নামে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসময় বক্ষব্যাধী/টিবি হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালের পরিসর বড় করা হয়,হার্টফাউন্ডেশান, ক্যান্সার হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। জাতীয় শিশু টিকাদান কর্মসূচী চালু করেন।   

৪। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ন। বাংলাদেশের জরূরী ভিত্ততে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া নিয়ে মার্কিন তারবার্তায় (জানুয়ারী ১৯ ১৯৭৬, সিআইএ টেলিগ্রাম নাম্বার ০৩২৫/০৯৫০Z) সিনেটর ম্যাক গভার্নের সাথে আলাপের প্রসঙ্গে বলা হয় যে- “তারা (জিয়া) এটি বুঝতে পারছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আটকাতে না পারলে অন্য সেক্টর গুলোতেও তারা সফল হবেনা। তিনি (জিয়া) আরো জানিয়েছেন যে তারা তাদের সেরা এবং সবচেয়ে কার্যক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন সাত্তার’কে জনসংখ্যা বিষয়ক কার্যক্রমের সচিব নিযুক্ত করেছেন এবং আশা করছেন যে এটা ফলপ্রসু হবে। তারা আরো বেশী সংখ্যক এবং বেশী দক্ষ লোকবল নিয়োগ করবে এবং আরো বেশী সংখ্যক নারীকে এটার সাথে জড়িত করবে।”   

জিয়াউর রহমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম বড় একটা কারণ সেসময়ের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে বিশেষ কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতার জেরে অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক দুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার তিনটি মূল দিক ছিল। এক —  একচেটিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের সাম্যাবস্থা তৈরি। দুই —  মুসলিম বিশ্বের কাছ থেক স্বীকৃতি আদায় করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক শ্রমবাজার তৈরি হয়। তিন— চীনের সাথে সুস্পম্পর্ক স্থাপন যার মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্য বিভাগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ নামে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়।  

জিয়াউর রহমান প্রাচ্যের পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্ক গুলোতে সমাজতান্ত্রিক বাঁকজনিত কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৈত্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা এই আমলে রচিত হয়, এক্ষেত্রে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সত্তরদশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের অবরোধের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানীতেল প্রাপ্তির দাবী করেন যা বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পু্নর্গঠনের কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশি ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তার উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। তাই গঙ্গার পানি চুক্তি বিষয়ে জাতিসংঘে যাবার প্রেক্ষিতে কিছুটা টেনশন তৈরি হলেও জিয়াউর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।‍

জিয়াউর রহমানের কর্মসুচী গুলোর একটা ভিন্ন মাত্রা হচ্ছে, এখানে অলস ভাতা এবং অলস সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দকে কর্ম নির্ভর বা উৎপাদনমুখী করা হয়েছে (কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাল কাটার বিনিময়ে মজুরি, উপবৃত্তি)। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভাতা ও বরাদ্দের কৌশলে উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপনা করা হয়েছে। এতে যুদ্ধ পরবর্তি দেশের কর্মচাঞ্চল্য ফরে এসেছে। অভ্যন্তীণ উৎপাদন কৌশলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য মূখী পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগীতার ফ্রেইমোয়ার্ক তৈরি করে জিয়াউর রহমান দেশের অর্থনীতি সংহতকরণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।


  • লেখক ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা। 'বাংলাদেশঃ অর্থনীতির ৫০ বছর' এবং 'চতুর্থ
    শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখক। পরিবেশ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। 


Tuesday, June 1, 2021

সততার এক কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান

--------------------------------------

ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান

--------------------------------------




বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লিখিত ‘পিতা ও শিক্ষক’ শিরোনামে একটি লেখায় তিনি লিখেছেন- ১৯৭৬ সালের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা দুই ভাই স্কুলে যাচ্ছিলাম। আমরা বের হয়েছি সাতটায়। বাবাও বের হয়েছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি যাচ্ছেন অফিসে। আমরা দু’ভাই গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাবা তাঁর গাড়িতে উঠলেন। তাঁর গাড়ি আমাদের গাড়ির আগে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনের গাড়িটির ব্রেকলাইট জ্বলে উঠল। বাসার গেইট দিয়ে বেরোবার আগেই জোর গলায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিলেন বাবা। সে দৌঁড়ে গেল বাবার গাড়ির দিকে। আমরা দু’ভাই গাড়িতেই বসে রইলাম। ড্রাইভার যখন ফিরে এলো চেহারা দেখে মনে হলো যেন বাঘের খাঁচা থেকে বের হয়েছে সে। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? উত্তরে ড্রাইভার বলল, “স্যার বলেছেন আপনাদের এই বেলা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গিয়ে পিএসের কাছে রিপোর্ট করতে। এখন থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হবে। কারণ, ছোট গাড়িতে তেল কম খরচ হয়। আর এই গাড়ির চাকা খুলে রেখে দিতে হবে। যাতে করে কেউ এ গাড়ি চালাতে না পারে।” উল্লেখ্য, ওই গাড়িটি ছিল সরকারি বড় গাড়ি। গাড়িটি চালাতে তুলনামূলক তেলও খরচ হতো একটু বেশি। এই হলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এ ধরনের হাজারো ঘটনা আছে তাঁকে নিয়ে।

বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সচরাচর যে ধরনের জীবন-যাপন করেন সেই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের সহজ-সরল জীবন ছিল কিংবদন্তিতুল্য। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। জিয়াউর রহমানের সততা নিয়ে তাঁর বিরোধি মহলের অনেকে বক্রোক্তি করেন। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সার্কিটহাউজে তাঁর ব্যক্তিগত যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় সে সম্পর্কে সেসময়ের বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা লিখেছেন- “জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নি¤œলিখিত জিনিসগুলি পাওয়া যায়: একটি পুরাতন চামড়ার সুটকেস। তাহা এত পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ‘ইকোলাক’ জাতীয় ব্রীফকেস, গায়ের আধছেঁড়া গেঞ্জি, ২/৩টি সাফারী শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়িয়াছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাঁহার বিছানার পার্শ্বেই পড়িয়াছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।” (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)। আমার একটি প্রশ্ন? দৈনিক ইত্তেফাক কি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা?

জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আজকের এই লেখার অবতারনা এজন্য যে, আকাশ সমান জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে তাঁর বিরোধমহল কিছু কিছু বিরূপ মন্তব্য করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে যারা ভালোবাসেন তাদের মধ্যে অনেকেই সেসব নিন্দা মন্দের সঠিক উত্তর দিতে পারেন না। বিশেষ করে টকশোগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় বিএনপি পন্থি বক্তাগণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন তাঁর প্রতিপক্ষের দিকে। তখন আমার ভীষণ কষ্ট হয়। শুধুমাত্র ইতিহাস না জানার কারণে তাঁরা সেসবের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। যেমন একটি অভিযোগ এরকম- জিয়াউর রহমান একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট”। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাঁর বিরোধিপক্ষ এই উক্তিটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেন। এই কথাটির পুর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত “একজন জিয়া” বইটিতে। সেখানে লেখক লিখেছেন- কথায় কথায় আমি জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করলাম- যদ্দুর মনে পড়ে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন-“আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট”। এর পর প্রায়ই আপনি কথাটা বলছেন। আপনার এই কথা নিয়ে নানা মহলে নানা গুঞ্জন ও প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। কিন্তু দেশের লোকজনকে আপনি যদ্দুর মনে হয় এই কথাটির তেমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেন নি। কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকলেন জিয়াউর রহমান। তারপর বললেন- ‘দু’এক কথায় যদি ব্যাখ্যা চান, তাহলে এভাবে মোটামুটি বলা যায়. -আমি বলেছি গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। এদেশে অনেক সাইনবোর্ডসর্বস্ব, বিবৃতিসর্বস্ব, শহরকেন্দ্রিক পেশাদার রাজনীতিবিদ রয়েছেন। এদের চেহারা আর চালচলন কাজকারবার আমি বুঝে ফেলেছি। রাজনীতি করতে অসুবিধা হবে তাঁদের। তাঁদের মতো সবার জন্যেই-আই হ্যাভ মেড পলিটিক্স ডিফিকাল্ট। তারপর বললেন-‘দুঃখ কি জানেন, নেতারা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনাদের ‘বিচিত্রা’-র এক সাংবাদিককে আমি একবার এসব কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম-আমাদের বাংলাদেশের কোনো নেতাই ‘ইন টোটো’ নেতা নন। অর্থাৎ কোনো নেতাই সম্পূর্ণ নন। তাঁরা কথা জানেন, সে সব কথা বলেন এবং সাজিয়েগুছিয়ে বেশী করেই বলেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, এসব কথা তাঁরা বেশী বলেন ড্রইং রুমে বসে সন্ধ্যার পর। তাঁদের লোকজন বিবৃতি নিয়ে আপনাদের পত্রিকার অফিসে অফিসে ধাওয়া করেন। এঁরা আসলে কাজ করেন না। আবার এমন অনেকে আছেন যাঁদের কাজ করার আগ্রহ আছে। কিন্তু সংগঠন নেই বলে তাঁরা পারেন না। আমি এই কাজ-পাগল অথচ অচেনা নেতাদের কাজে লাগাতে চাই।”

তিনি যে শুধু কাজ পাগল অচেনা নেতাদের-ই কাজে লাগাতে চেয়েছেন তা-ই শুধু নয়। তিনি সবসময় চাইতেন জ্ঞানীগুণী, মেধাবী তরুন ও যোগ্য নেতারা দেশের জন্য কাজ করুক। জিয়াউর রহমান তাঁর উপদেষ্টা মন্ডলীতে যোগ্যতার দিকদিয়ে তৎকালিন দেশের কিছু তারকাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ অন্যতম। অন্যদিকে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ও ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা প্রমুখগণ তো ছিলই। ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদাকে তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য করেছিলেন। তখন নাজমুল হুদার বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর। এতো অল্প বয়সে বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দলের এমন নীতিনির্ধারনি পর্যায়ে গিয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে গিয়েছিলেন। তিঁনি লন্ডনে বেশ ক’জন বাংলাদেশি তরুণ পেশাজীবীকেও সাক্ষাৎ দেন। তাদের দেশে ফিরে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিঁনি তাদের কাছে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কথা এবং একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য তুলে ধরেন। তাদের কয়েকজনকে দেশে ফিরে বিএনপিতে যোগ দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন।

দ্বিতীয় আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে জিয়াউর রহমান একবার হিজবুল বাহার নামক একটি জাহাজে করে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের নিয়েগিয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরে নৌবিহারে। সে বিষয়টি নিয়েও অনেকে তীর্ষক মন্তব্য করেন। কিন্তু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেন তাদের নৌবিহারে নিয়েগিয়েছিলেন বিরোধি মহল কিন্তু সেটা বিস্তারিত কখনো বলেনা। কারণ সেটা খুলে বললে তাদের নিজেদের দুর্বলতার থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বছর দু’য়েক আগে প্রয়াত কবি আল মাহমুদ। তিনি ‘তৃষিত জলধি’ নামক তার একটি লেখায় তুলে ধরেছেন সেদিনের সেই ঘটনা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মুল বক্তব্যটি অনেক বড় সেজন্য শুধু বক্তব্যের চুম্বক অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হল। এই বক্তব্যটি শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন কেন জিয়াউর রহমান সেইসব মেধাবী ছাত্রদের সেদিন নৌবিহারে নিয়েগিয়েছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে সেদিন জিয়াউর রহমান মেধাবী সে সব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙ্গা থেকে উত্তাল বে অফ বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র  হলো অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। এখানে এলে মানুষের হৃদয় একই সঙ্গে উদার ও উদ্দাম সাহসী হয়ে ওঠো অন্তত উঠতে বাধ্য। আমি কি ঠিক বলিনি? তোমার, আমার, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সংকীর্ণতা ও কূপমন্ডুকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মতো উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে। আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলবো তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। হঠাৎ বঙ্গোপসাগরের কথা মনে পড়ল। এই উপসাগরেই রয়েছে দশ কোটি মানুষের উদর পূর্তির জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভূমি ভেঙে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ-যা আগামী দু’তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই ভেসে উঠবে; যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দেবে। আমাদের ভিটাভাঙা পলি যেখানেই জমুক-তা তালপট্টি কিংবা নিঝুম দ্বীপ, এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্র-তরঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না। মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ যথেষ্ট সাহসী নই বলে শত্রুরা, পররাজ্য-লোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতামাতার সর্বশেষ আশার প্রাণকণা, যাদের ওপর ভরসা করে আছে সারা দেশ, সারা জাতি। তোমরাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ-নিঃশ্বাস।’ তাহলে এবার নিশ্চয়ই পাঠকবৃন্দ বুঝতে পেরেছেন বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা সেদিনকার সেই তালপট্টি কিংবা নিঝুমদ্বিপ রক্ষার জন্যই জিয়াউর রহমান সেই নৌবিহারের আয়োজন করেছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় এ সময়ের একজন প্রখ্যাত লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ২০১৬ সালে ‘বিএনপি সময় অসময়’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে লেখক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি সুবিচার করেননি। আরেকটু সচেতন ও নিষ্ঠাবান হলে আমার ধারণা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ বিষয়গুলো তুলে আনতে পারতেন তিনি। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকারকে উদ্ধৃত করে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন- “জিয়া বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। তারপর সেটি দেখে বক্তৃতা দিতেন। তিনি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুঁড়তেন। মোখলেসুর রহমানের সাক্ষাৎকার গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বইতে এভাবে তুলে ধরেছেন- এসব দেখেটেখে যাদু একদিন আমাকে (মোখলেসুর রহমান) বললো যে, এ রকম হলে কী করে তাঁকে আমি চালিয়ে নেব? আমি বললাম- দেখো জিয়া বক্তব্য দিতে পারেন না ঠিক আছে। তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে কী করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করো। জবাবে যাদু বললেন, হাঁটতে পারেন এক নাগাড়ে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। আমি বললাম এইতো পাওয়া গেল সবচেয়ে ভালো একটা উপায়, তুমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পাড়াগাঁয়ে হাঁটাও। ... গাঁও গেরামের রাস্তা দিয়ে যাবে আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? প্রেসিডেন্ট দেশের মিলিটারী লিডার, তিনি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কানাকানচি দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন আর লোকজনের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর করছেন, তাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।

লেখকের এই কথাগুলো যে কতটা সত্যের অপলাপ তা কিন্তু জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে কোন একটি ভালো বই পড়লেই জানা যায়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা জিয়াউর রহমান ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর এক মামীর কাছে ঐ সময়ে লেখা একটি চিঠিতে। জিয়াউর রহমানের মামা রুহুল আমিনের সৌজন্যে প্রাপ্ত বাংলায় লেখা ঐ চিঠির একটি ফটোকপি হুবহু দেয়া আছে হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত ‘একজন জিয়া’ নামক গ্রন্থটির ৮৫ নম্বর পৃষ্ঠায়। যে কেউ চাইলে সেটা দেখে নিতে পারেন। চিঠিটি জিয়াউর রহমান তাঁর মামীকে লিখেছিলেন ১/৪৯ জেকব লাইন, করাচী থেকে। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানে বসেও কখনো উর্দুতে কথা বলতেন না। কেউ তাঁর সঙ্গে উর্দুতে কথা বললে তিঁনি ইংরেজিতে জবাব দিতেন। আমরা যে বাঙালি এ ব্যাপারে তিঁনি ছিলেন খুবই সচেতন। আমরা যে বাঙালি এ ব্যাপারে তিঁনি খুবই সচেতন ছিলেন। (প্রেসিডেন্ট জিয়া, মাহফুজ উল্লাহ, পৃষ্ঠা-২৪)। তাছাড়া এসময় ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিঁনি। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২১)। আর এই যে হাঁটার অভ্যাস, এটা জিয়াউর রহমান রপ্ত করেছিলেন সেনাবাহিনীতে থাকাকালিন। অন্যদিকে ভাষানী গ্রামগঞ্জে হেঁটে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান নিশ্চয়ই ভাষানীর সেই কর্মকান্ড দ্বারা প্রানিত হয়েছিলেন। লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলেন বলেও খেদোক্তি করেছেন অথচ লেখক একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতেন পৃথিবীর বহুদেশের বহু জগৎবিখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। নেপলিয়ন বোনাপার্ট, উইনেষ্টন চার্চিল, চার্লস দ্য গল এঁরা সবাই আর্মি থেকে আগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসী দেশের ত্রাণকর্তা চার্লস দ্য গল একসময় ব্রীগেডিয়ার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে থিওডর রুজভেল্ট, আইজেন আওয়ার এরকম প্রায় আমেরিকার অর্ধেক রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় লেগেছি হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের আপামর মানুষের মনজয় করে নিয়েছিলেন। অনেকের হয়তো সে কারণে গাত্রদাহ হয় কিন্তু তাতে করার কিছু নেই। 

সম্প্রতিকালে ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিক রোজিনার উপর নীপিড়ন নির্যাতনের কারণেই একটি বিষয় মাথায় এলো যা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। জিয়াউর রহমান ছিলেন অসম্ভব পত্রিকা ও সাংবাদিক বান্ধব একজন মানুষ। তিঁনি ইনভেষ্টিগেটিভ রিপোর্টকে সবসময় উৎসাহিত করতেন। সে বিষয়টি জানাযায় জিয়ার আমলের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন যিনি পরবর্তীকালে দৈনিক ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন তার একটি লেখায়। ‘বিশ্ব নেতাদের চোখে জিয়া’ শিরোনামে আলমগীর মহিউদ্দিন লিখেছেন- “টাইমসে তখন অনেক ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ছাপা হতো। চাল সিন্ডিকেটসহ নানান খবর। এর মধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক একটি বড় ফাইল নিয়ে এসে হাজির। তিনি পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, সাফদার সাহেবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু একটি কমিটি করেছিলেন ঢাকা-আরিচা রোডের বিশাল দুর্নীতি তদন্তের জন্য। কিন্তু তার ইন্তেকাল হওয়ায় বোধহয় এ তদন্তের ভাটা পড়েছে। আপনাদের লেখায় দেখি কাজ হচ্ছে। এ রিপোর্টটা যদি করতেন। সে কাজের ভার দেয়া হলো আমাদের আর এক রিপোর্টার খন্দকার মুনিরুল আলমকে। তিনি বহু পরিশ্রম করে সম্ভবত পাঁচ পার্টে একটি রিপোর্ট তৈরি করলেন। প্রথা অনুযায়ী আমরা সম্পাদকের নেতৃত্বে রিপোর্টটা আলোচনা করার সময় সম্পাদক বললেন, আগামীকাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আছে। দিন রিপোর্টগুলো নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করবো। আমরা খুশিই হলাম। প্রায় দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরও সম্পাদক রিপোর্টটা নিয়ে কোনো কথা বলছেন না বলে জিজ্ঞাসা করলাম এর ভাগ্যটা জানতে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া রিপোর্টটা ছাপতে মানা করে দিয়েছেন। কষ্ট লাগলো। কারণ এক সাক্ষাতে জিয়া তাঁর চোখ-কান হিসেবে সাংবাদিকদের আখ্যায়িত করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ পর আমার এক পার্টিতে দেখা। আমি সুযোগ নিয়ে বললাম, স্যার, আপনি আমাদের আপনার চোখ-কান বলে আখ্যা দিয়েছেন; অথচ ঢাকা-আরিচা রাস্তার দুর্নীতির খবর ছাপতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনাদের সম্পাদক বলেছিলেন এমন একটা রিপোর্টের কথা। তাকে তো ছাপতে বলেছি এবং কথা দিয়েছিলাম অ্যাকশন নেবো। কই আপনারাই তো ছাপলেন না। ছাপুন না।

রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেন অনুসন্ধান করতে। আমাদের রিপোর্টের উল্লিখিত নথি দেখে সম্ভবত ১৮ জন সম্পর্কে কাগজপত্র পাওয়া যায়। তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করেন জিয়া। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৮৬-৮৭)। এই ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় কী ধরনের মানুষ ছিলেন জিয়া। এছাড়া বর্তমান জাতীয় প্রেস ক্লাবও জিয়াউর রহমানেরই অবদান। প্রিন্স করিম আগা খান জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণে ব্যয় বহন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রেস ক্লাবের নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। 


 ফেব্রুয়ারি ১৭, ১৯৭৯, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রেসক্লাব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন 


তিনি বলেছিলেন, নিজেই প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করবেন। সে হিসেবে ১৯৭৭ সালে তিনি ১৮ তোপখানা রোডে বর্তমান জায়গাটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অনুকূলে বরাদ্দ দেন। সেই সঙ্গে জমি দাম পরিশোধের জন্য ২৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা প্রেস ক্লাবকে অনুমোদন দেন। জমির দলিলে খরচাদিও মওকুফ করে দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং নতুন ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবকে দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা অনুদান। (প্রাগুক্ত-১৩১)।  শুধু প্রেসক্লাব নয় এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান গড়তে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিঁনি শিশু হাসপাতালটি তৈরির সময় ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৫০ লক্ষ টাকা। ১৯৭৮ সালে ৫০ লক্ষ টাকা মানে এসময়ের কম করে হলেও ১০০ কোটি টাকার সমান। জিয়াউর রহমানের ৫০ লক্ষ টাকা প্রদানের ঘটনাটি আমি ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের সামনে বসে শুনেছিলাম বলে সেটা পাঠকবৃন্দের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার লোভটা সংবরণ করতে পারছি না। সেটা ওয়ান এলিভেনের কথা। দু’নেত্রিই তখন জেলে। তাদের পক্ষে লড়বার মতো কোন আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে এগিয়ে এলেন ব্যারিষ্টার রফিকুল হক। তিনি প্রথমে শেখ হাসিনার মামলা হাতে নিলেন। আশার আলো জ্বলে উঠল আমাদের মনেও। একদিন আমার চাচা (আব্বার বন্ধু) এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে ব্যারিষ্টার নাসিরুদ্দিন অসীম, ব্যারিষ্টার কায়সার কামাল ও আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ফাইলপত্র নিয়ে হাজির হলাম ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের দরবারে। উনারা আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন মূলত বেগম জিয়ার ফাইলপত্রগুলো ক্যারি করার জন্য। যা হোক, ব্যারিষ্টার রফিকুল হক জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার ভূয়সি প্রশংসা করলেন এবং বেগম জিয়ার পক্ষে মামলা লড়ার জন্য সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন উপরে, দোতলায়। আমরা তো বসেই আছি। উনি আর দোতলা থেকে নামেন না। কিছু সময় পরে ক্লার্ক মারফত খবর পাঠালেন উনি টাকা ছাড়া মামলা লড়বেন না। আমরা কেউ-ই সঙ্গে করে টাকা নিয়ে যাইনি। শিমুল বিশ্বাস দ্রুত ছুটে বেড়িয়ে গেলেন। আমাদের বললেন- তোমরা বস। আধাঘণ্টা পরে শিমুল বিশ্বাস ফিরে এলেন সঙ্গে দু’লক্ষ টাকা নিয়ে। সেই টাকা পাঠানো হলো তারপর তিনি দোতলা থেকে নামলেন। আমার প্রাণপ্রতিম বন্ধু ও চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ব্যারিষ্টার মীর হেলালও তখন জেলে। হেলালের জন্যও আমাকে যেতে হতো ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের চেম্বারে। সবমিলিয়ে আমি ৭/৮ বার গিয়েছিলাম রফিকুল হকের চেম্বারে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে একদিন জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন- অনেক ভালোমানুষ ও রাষ্ট্রনয়াক ছিলেন জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়ানের পর জিয়াউর রহমান একদিন ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন- আপনি তো শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমার সঙ্গে কি কাজ করবেন? রফিকুল হক বললেন- আমি তো আসলে একজন দর্জি। আমাকে যে যা বলবে আমি সেটাই তৈরি করে দেব। বঙ্গবন্ধু মুজিব কোর্ট চেয়েছিলেন তাকে মুজিব কোর্ট বানিয়ে দিয়েছি। আপনি যদি সাফারি চান আমি সাফারি বানিয়ে দেব। পকেট যদি দুটোর বদলে চারটা চান চারটা পকেট বানিয়ে দেব। জিয়াউর রহমান বললেন- আপনাকে ফি কত দিতে হবে। রফিকুল হক বললেন- দেশের কাজে আমি কোন ফি নেব না। জিয়াউর রহমান বললেন- ফি ছাড়া কাউকে দিয়ে আমি কোন কাজ করাই না। রফিকুল হক বললেন- আচ্ছা সে দেখা যাবে। ব্যাংকিং খাতের বহুকাজ জিয়াউর রহমান করালেন রফিকুল হককে দিয়ে। কাজ শেষে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন বলুন কত দিতে হবে আপনাকে। রফিকুল হক বললেন- আমাকে কিছু দিতে হবে না। তবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আমার শিশু হাসপাতালের জন্য কিছু অনুদান দিন। জিয়াউর রহমান তাকে ৫০ লক্ষ টাকা দিলেন। বেগম জিয়া ও আমার বন্ধু হেলালের মামলার জন্য আমি রফিকুল হকের চেম্বারে মোট ৭/৮ বার গিয়েছিলাম। শেখ হাসিনার মামলার জন্য তখন শুধু আমি বর্তমানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসকে শুধু ওনার চেম্বারে বসে থাকতে দেখেছি। আজ হয়তো আকাশ বাতাস সবই আওয়ামীলীগ। কিন্তু তখন শেখ হাসিনার মামলার জন্য তাপস ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। 

সবশেষে বলব জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি রাজনৈতিক দর্শন তিঁনি একটি বৈপ্লবিক চেতনা। তিঁনি একটি প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি ইতিহাস। তিঁনি যে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর জাজ্বল্যমান প্রমান তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আপামর জনসাধারণের যে ঢল নেমেছিল ১৯৮১ সালের ২ জুন। ২০ লক্ষ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন তাঁর শবানুগমনে। এটা একটি ইতিহাস। এই উপমহাদেশে কারো মৃত্যুতেই এমন মানুষের ঢল নামেনি। শুধু মহাত্মাগান্ধির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে হয়েছিল ২০ লক্ষ মানুষ। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ৫০ কোটি আর বাংলাদেশে মাত্র ১০ কোটি। নেহেরু যখন ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন তার শেষকৃত্যে মানুষ হয়েছিল ১৫ লক্ষ। আর রবীন্দ্রনাথের ৫ লক্ষ। এতেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষের কি পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। লেখাটি শেষ করবো ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের একটি স্মৃতিচারণ দিয়ে। তিঁনি লিখেছেন- জিয়াউর রহমান সিকিউরিটির নির্দেশিত পথে না চলে, সোজা গ্রামের মধ্যে চলে যেতেন। সাধারণ মানুষকে তাদের সুখ-দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। তাঁর কুষ্টিয়ার হাটার প্রোগ্রামের বছর দুই পর ওই এলাকায় আমাকে আবার একবার যেতে হয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো যে বাড়িটির ওপর দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন, তারা তাকে মনে রেখেছে কি না! সে বিষয়টা একটু জানা দরকার। গিয়ে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। সে বাড়ির যতোটুকু এলাকার ওপর তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন এবং যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন, তা বাশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে স্মৃতি হিসেবে। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৮৫)। এই হচ্ছে জিয়াউর রহমানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, যা কেউ কোনদিন কেড়ে নিতে পারবে না। 

  • লেখক গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী 

         barristershaifur@yahoo.com 


জিয়ার গণমাধ্যম নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি

---------------------------

এম আবদুল্লাহ

---------------------------


সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও স্বাধীনতা হরণের উপর্যুপরি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে তার গণমাধ্যম নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনার দাবি রাখে। জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ব্যক্তিগত আগ্রহেই তিনি এ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের শক্তি, ক্ষমতা ও গুরুত্ব তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নে গণমাধ্যম ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে প্রথমবারের মতো তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তখনই তিনি গণমাধ্যমের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সাম্যক ধারণা নেন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুদূরপ্রসারি উন্নয়নের চিন্তা তার মাথায় আসে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার কারণে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য কী ভূমিকা রেখেছেন তা জানার আগে জানা দরকার তার দায়িত্বগ্রহণের আগে দেশে সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থা কেমন ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। আর বাকশালী শাসন নিষ্কণ্টক করার জন্য একই বছরের ১৬ জুন দেশে চারটি ছাড়া সব দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। সরকারি প্রচারপত্র হিসেবে রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় চারটি সংবাদপত্র রাখা হয়। দেশে তখন সব বেসরকারি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সহস্রাধিক সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী বেকারত্বের অভিশাপে নিমজ্জিত হন। জবরদস্তিমূলকভাবে তখন সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীকে বাকশালে যোগদানে বাধ্য করা হয়।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভাবনীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পাদপীঠে উঠে আসেন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পরই সাংবাদিকদের লেখার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করেন তিনি। জিয়াউর রহমান যখন বন্ধ করে দেয়া সব সংবাদপত্র চালুর ব্যবস্থা করেন তখন প্রবীণ সাংবাদিক ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘পাখা ভারী হয়ে গেছে, এত দিনের দলননীতির পর মুক্ত পাখা মেলে উড়তে কষ্ট হচ্ছে সাংবাদিকদের।’ নির্মল সেনের এ অনুভূতি প্রমাণ করে স্বাধীনতার পর কার্যত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ই প্রথম সাংবাদিকরা স্বাধীনতার স্বাদ পান।

দেশের উন্নয়নে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনুধাবন করেছিলেন বলেই শহীদ জিয়া সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে আপনারা জনমত গড়ে তুলুন, যা অবশ্যই সংগঠিত ও ব্যবহৃত হবে জাতীয় উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য। সবাইকে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, কেবল অনৈক্যের কারণে এ দেশ সুদীর্ঘ ২০০ বছর বিদেশী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষিত হয়েছে। কাজেই জাতীয় ঐক্যই কেবল আমাদের জীবনে আনতে পারে শক্তি, অগ্রগতি ও সুখ-শান্তি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এ আমাদের এক অবশ্য কর্তব্য। আমাদের বর্তমান উৎসর্গিত হোক ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য।’ (বিচিত্রা, ২৪ মার্চ ১৯৭৮ সংখ্যা)

প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশ্বাস করতে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে তাতে দেশ, জাতি ও সরকার সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল-প্রশাসনযন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত ও গণমুখী করতে হলে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ১৯৮৭ সালের ৩০ নভেম্বর রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে জিয়াউর রহমান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমি দু-একটি কথা বলা দরকার মনে করছি। যারা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের অনুরোধ করব তারা যেন দেশের অসংখ্য পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠাগুলোতে একবার চোখ বুলান। স্বাধীনতাকে প্রায় দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন কয়েকজন। তবু তারা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন বিনা বাধায়। শুধু তাই নয়, এদের অনেকেই পরোক্ষভাবে নানা রকম সরকারি সহায়তা দাবি করছেন এবং পাচ্ছেনও। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় সম্পূর্ণ বিশ্বাসী এবং সাংবাদিকদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ আস্থাশীল। সাংবাদিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য এবং সাংবাদিকতার যথার্থ বিকাশ ও উন্নতির জন্য আমরা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’ (দৈনিক বাংলা, ১ ডিসেম্বর ১৯৭৮)

জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব কালাকানুন শিথিল করে দেশের সব জায়গা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা সরকারের দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি রাজশাহী থেকে ‘দৈনিক বার্তা’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকা ঘিরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। বহু সাংবাদিকের কর্মসংস্থান হয়।

শিশু-কিশোরদের নিয়ে গভীর ভাবনা ছিল শহীদ জিয়ার। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সমাজসচেতন করে গড়ে তুলতে ‘কিশোর বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন তিনি। পত্রিকাটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালের গোড়ায় তিনি ‘গণতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। পাশাপাশি দৈনিক জনপদও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জনপদ প্রকাশনায় আর্থিক অস্বচ্ছতা দেখা দিলে একই বছরের মধ্যভাগে রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক দেশ’। পত্রিকাটির নামকরণ করেন খোদ জিয়াউর রহমান। তিনি ইচ্ছা করলে নিজ মালিকানায় পত্রিকাটি প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি, ত্রুটি তুলে ধরার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। আবার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ত্বরিত ব্যবস্থা নিতেন তিনি।

ডিক্লারেশনের শর্ত শিথিল করার কারণে সে সময় ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয়, জেলা এমনকি থানা পর্যায় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। এসব পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টননীতিও শিথিল করেন। বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বণ্টন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। একই সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বাকি ৪০ ভাগ মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সারা দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।

১৯৭২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) তৎকালীন সরকারের কাছে যে কয়েকটি মূল দাবি উত্থাপন করেছিল তার অন্যতম ছিল সাংবাদিকদের জন্য নতুন বেতন বোর্ড গঠন, প্রেস কমিশন গঠন এবং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল। পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে সাংবাদিকদের জন্য একটি বেতন বোর্ড গঠিত হয়। পরে আর কোনো সরকার নতুন বেতন বোর্ড গঠনের দাবিতে কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে একটি বেতন বোর্ড গঠিত হলেও তা ছিল অকার্যকর। রাষ্ট্রপতি জিয়া সংবাদপত্রসেবীদের বেতনভাতা নির্ধারণে ওয়েজ বোর্ড গঠন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বেতন বোর্ড পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ১৯৭৭ সালের পয়লা মে ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঘোষিত বেতন স্কেল বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইমপ্লিমেন্টেশন সেলও গঠন করে দেন। তিনি সাংবাদিক, মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করেন প্রেস কনসালটেটিভ কমিটি। এ কমিটির কাজ ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়গুলো দূর করা।

কথায় কথায় সাংবাদিকদের যাতে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে জেলে পুরতে না পারে সেজন্য জিয়াউর রহমান প্রেস কাউন্সিল গঠন করেন। সাংবাদিকদের আরেকটি দাবি ছিল প্রেস কমিশন গঠন। তিনি প্রেস কমিশন গঠনেরও উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে পদ্ধতিগত কার্যক্রম চলতে থাকে। বিভিন্ন জটিলতায় কমিশন গঠনের কাজ ধীরগতিতে চলছিল। সে কারণে জীবিত অবস্থায় প্রেস কমিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে একটি প্রেস কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট পেশ করার কথা ছিল। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আতাউর রহমান খান। সেই প্রেস কমিশনের রিপোর্ট আজো প্রকাশিত হয়নি।

রাষ্ট্রপতি জিয়া বুঝেছিলেন, মানসম্মত নির্মোহ সাংবাদিকতার জন্য সুশিক্ষিত সাংবাদিক প্রয়োজন। সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়ন ও তাদের সুষ্ঠুভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) প্রতিষ্ঠা করেন নিজে উদ্যোগী হয়ে। পেশায় বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মাধ্যমে এমনকি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে তিনি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালে ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নগরজীবনে আবাসন সঙ্কটে সাংবাদিকরা ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। স্বল্প আয়ের সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তিনি মিরপুরে ২২ বিঘা জমি সাংবাদিক সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ করেছিলেন। দেড় শতাধিক সাংবাদিকের সেখানে আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল।

সাংবাদিকদের মান মর্যাদার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া ছিলেন খুবই সচেতন। ১৯৭৬ সালে তোপখানা রোডে পুরনো লাল বিল্ডিংয়ে প্রেস ক্লাব ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের তোড়জোড় চলছিল। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ব্যবসায়ী প্রিন্স করিম আগা খান প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। ক্লাব ভবনের ভিত্তি স্থাপন করতে এসে জিয়াউর রহমান বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। সাংবাদিক নেতাদের ডেকে তিনি বলেন, প্রেস ক্লাব হচ্ছে একটি জাতীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এর উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের উন্নয়ন, সাংবাদিকতার প্রসার। অতএব, বিদেশী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অর্থানুকূল্যে এ প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মিত হওয়া উচিত নয়। তা হলে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা নির্মিত হবে আমাদের নিজস্ব টাকায়। তিনি জানালেন, প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের সব ব্যয়ভার গ্রহণ করবে সরকার। অচিরেই সরকারের খরচে নির্মিত হবে বর্তমান প্রেস ক্লাব ভবন। প্রেস ক্লাবে ঢুকতেই চোখে পড়বে জিয়ার নামাঙ্কিত ফলক। শুধু ভিত্তিস্থাপন ও অর্থানুকূল্য দিয়েই বসে থাকেননি। তিনি প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতিও পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ করেন। পরে বাস্তবে জিয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেস ক্লাব হয়ে ওঠে ‘গণতন্ত্র স্কোয়ার’।

প্রসঙ্গত, প্রেস ক্লাবের বর্তমান জায়গাটি ১৯৭৪ সালে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। প্রেস ক্লাবের জন্য শেখ মুজিব সরকার মাত্র এক বিঘা জায়গা বরাদ্দ করেছিলেন শিল্পকলা একাডেমির পাশে। এ সিদ্ধান্তে সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। কারণ বর্তমান প্রেস ক্লাবের স্থানটি ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন সরকার সাংবাদিকদের দিয়েছিল। বর্তমান জায়গাটি ফিরিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি জিয়া।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচার চালু করে টিভি মিডিয়ায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময়ই এ নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচারের সূচনা করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দ্বিতীয় চ্যানেলটিও চালু হয়। তখন এই চ্যানেলে প্রভাতি অনুষ্ঠান চালু করেন। সার্বিক বিবেচনায় সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র শিল্পে অবদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

  • লেখক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। 


Monday, May 31, 2021

নারীর ক্ষমতায়নে শহীদ জিয়ার অবদান

-----------------------------------------------------------

অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাঃ শামীম ও 

আশরাফুল ইসলাম খান আনিক

-----------------------------------------------------------


একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাফল্যগাঁথা এক দুই কলামে লেখা সম্ভব না, তাই আজকে এ লেখায় নারী উন্নয়নে, নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মহৎ এ নেতার অবদানের কথা স্মরণ করছি বিন¤্র শ্রদ্ধায়। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের নারী সমাজকে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানের পথ প্রথম দেখিয়েছিলেন যিনি তিনি হলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এদেশের নারীদের আজ যতটুকু অগ্রগতি, যতটুকু প্রাপ্তি তার সিংহভাগ যার অবদান তিনি জিয়াউর রহমান।

নারীর ক্ষমতায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নারী তার নিজের অবস্থান বা আপেক্ষিক সামাজিক আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই সর্বপ্রথম নারীদের আপন শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা অর্জনের মধ্য দিয়ে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মহান এ নেতার সূদুর প্রসারী চিন্তা ও পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন হয়েছিল বিধায় নারী সমাজ আজ এর সুফলতা উপভোগ করছে। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার স্বার্থে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অথনৈতির্ক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই নারীদের সামগ্রিক উন্নতির উপর বিশেষ জোর দেন। শুধু জিয়াউর রহমান নন, তার উত্তরসূরী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াও পরবর্তীতে তার তিন (৩) মেয়াদে তাৎপর্যপূণঅবদান রেখেছেন।

মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় চালু

‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’- জাতীয় কবির এই অমর বাণীর প্রতি বিশ্বাস রেখেই জিয়াউর রহমান নারীদের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই শহীদ প্রেসিডেন্ট

জিয়াউর রহমান প্রথমবারের মতন দেশে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের একক দায়িত্ব দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। মন্ত্রণালয় শিশুদের লালন পালনের ইস্যু সমূহের দিকেও নজর দেয়। গঠিত হয় শিশুদের স্কুল বহির্ভূত বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তাদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। নারী সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় মহিলা সংস্থা। পরবর্তীতে শহীদ জিয়ার আমলেই মহিলা সংস্থার অধীনে মহিলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পুুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ

বাংলাদেশে পুলিশও আনসার বাহিনীতে নারীদের প্রথমবারের মত নিয়োগ দেন শহীদ জিয়া। তিনি অনুধাবন করেছিলেন ক্রমবধমার্ন অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে ও নারীর ক্ষমতায়নে প্রশাসনের মূল ধারাতে নারীদের অংশগ্রহণ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজকে সেনাবাহিনীতে নারীরা যোগ দিচ্ছে। শুধু ডাক্তার বা নার্সহিসেবে নয়, সরাসরি যোদ্ধা হিসেবে, গোলন্দাজ বা কমিউনিকেশন ইউনিটে অফিসার হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত ১৯৮০ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া নিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ পুুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ শুরু হয়। বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। নসারআ বাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দলেও নারীদের অন্তর্ভূক্ত করা হয় শহীদ জিয়ার নির্দেশেই।

দেশ পরিচালনায় নারীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করণ

নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি করার জন্য এবং মহিলাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার লক্ষ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মহিলা দল গঠন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সর্বপ্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূত ও মহিলা অডিটর জেনারেল নিয়োগ করেন। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০-এ উন্নীত করেন। মহিলাদের জন্য চাকুরির ক্ষেত্রে নন-

গেজেটেড পদে ১৫ শতাংশ এবং গেজেটেড পদে ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারন করেন। শহীদ জিয়ার মন্ত্রীসভায় মহিলা মন্ত্রী ছিলেন একাধিক।

নারী কর্মক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসার

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে সরকারি চাকুরিতে নারীদের জন্যকোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার প্রথম ঘোষণা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত রাখার বিধান করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনিই সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালের ৩ই নভেম্বর সরকারি চাকুরিতে মেয়েদের প্রবেশের বয়স সীমা ২৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করেন। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন বাড়াতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয় সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিল- সরাকারি প্রথমিক বিদ্যালয়সমূহে ৫০৮ জন নারী সহাকারী শিক্ষক নিয়োগ এবং ৫০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের জন্য বর্ধিত সংখ্যায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক তৈরি, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই) গুলোতে ১০-২৫ শয্যার নারী হোস্টেল নির্মান এবং নারী প্রশিক্ষণার্থীদের বইভাতা প্রদান। নারীদের কর্মসংস্থান পরিস্থিতির উন্নতির উপর জোর দেওয়ার ফলে ১৯৭৬ সালে সারাদেশে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা দাড়ায় ২ কোটি ২৪ লাখ, যা ১৯৭৪ সালে ছিল ১ কোটি ৯২ লাখ।

খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহন

নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে আরো একটি মাইলফলক হচ্ছে বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল খেলাতে আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। মূলতঃ তাঁর সময় থেকেই

মেয়েদের আন্তঃস্কুল ফুটবল টুনামের্ন্ট চালু হয়।

যৌতুক বিরোধীআইন প্রনয়ণ

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে প্রথম যৌতুক বিরোধী আইন পাশ করা হয়। সমাজে নারীদের নিরাপত্তা এবং সামাজিক অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর দেশে যৌতুক বিরোধী আইন পাশ করা হয়।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, একাত্তরে সদ্য স্বাধীন দেশ ও পচাত্তরে বাকশাল থেকে মুক্ত বিধ্বস্ত একটা জনপদকে বিশ্বের মানচিত্রে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতোনারীদের অংশগ্রহন। আর এই উপলব্ধি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন বিধায় আজকের বাংলাদেশে সরকারের সর্বোচ্চ পদ থেকে শ্রমজীবীদের কাতারে সর্বত্র, এমনকি সমাজের সর্বস্তরে মেয়েদের নির্ভীক পদচারণা নিশ্চিত হয়েছে। একেই বলে নেতৃত্বের কারিশমা এবং দূরদর্শীতা। পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানচিত্র যতদিন থাকবে ততদিন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম। তিনি মরেও আমাদের মাঝে অমর।


বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবদান

--------------------------------------------

অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি

--------------------------------------------


স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে শক্ত ভীত রচনা করে গেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষিক্ত হয়েই তিনি অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে কৃষির আধুনিকায়ন ও উন্ন্য়নকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারা থেকে দেশকে উৎপাদন ও উন্নয়নের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহনকালীণ সময়ে এদেশের অর্র্থনীতি ছিল লুটেরাদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিধ্বস্ত ও ভঙ্গুর। তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অত্যন্ত সাহসী, বাস্তব ভিত্তিক উন্নয়নমূলক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহন করেন- যা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ন । জিয়ার গৃহীত নীতি  পরিকল্পনা  ও কর্মসূচি কিভাবে দেশের কৃষি উন্নয়ন ও  আধুনিকায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে তা খুব সংক্ষেপে বিশ্লেষন করছি।

জাতীয় বীজ অধ্যাদেশ (Seed Ordinance) প্রণয়ন

সকল ফসলের মূল ও প্রধান উপকরণ হল বীজ।  ভাল বীজ মানে ভাল ফসল- রাষ্ট্রপতি জিয়া একজন বিজ্ঞানীর মতই এ কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন । তাই ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে বীজ অধ্যাদেশ  প্রণয়নের মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী কর্মসূচী হাতে নেন । বীজ অধ্যাদেশ এর  মূল লক্ষ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে কিভাবে খাদ্য ঘাটতি ও দারিদ্র্য দূর করা যায়। ফসলের মূল উপাদান বীজকে মানসম্পন্ন অবস্থায় কিভাবে কৃষকের দোর গোড়ায় পৌঁছানো যায় সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্য বীজ অধ্যাদেশ  প্রণয়ন  করা হয়। বীজ অধ্যাদেশ   প্রণয়নের মাধ্যমে বীজ আমদানী, বীজ উৎপাদন থেকে শুরু করে বীজের বাজারজাতকরণ ও বিতরণের প্রতিটি পর্যায়ে ব্যক্তিখাতকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন ফলে ব্যক্তিখাতে বীজ শিল্পের উন্নয়নের সূচনা হয়। বীজ অধ্যাদেশ এর উল্লেখ যোগ্য বৈশিষ্ট্য হল- কৃষকরা বাজার থেকে বীজ কিনে যেন প্রতারিত না হয় তার ব্যবস্থা অর্থাৎ কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষন করা। বীজ অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষকের মানসম্মত ভাল বীজ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বীজ শিল্প একটি বিকশিত ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং কৃষকের চাহিদা মেটাতে সরকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতও সমান ভাবে কাজ করছে । প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রনীত সেই বীজ অধ্যাদেশই আজ বে-সরকারী খাতে বাংলাদেশের বীজ শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে একটি মাইল ফলক হিসেবে কাজ করছে।

কৃষি সংস্কার কর্মসূচী

প্রেসিডেন্ট জিয়া কৃষির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য কৃষকের হাতে উন্নতি প্রযুক্তি দ্রুত পৌঁছানো এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃষিতে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহন করেন । তিনি কৃষি উপকরন বিতরন ব্যবস্থা সংস্কার,  কৃষি উপকরন ব্যবসা উদারীকরন নীতি প্রনয়ন করেন । বীজের পরে ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরন হল- রাসায়নিক সার, সেচ ও সেচ যন্ত্র (এল,এল,পি, স্যালো টিউবওয়েল, ডিপ টিউবওয়েল), আধুনিক চাষ যন্ত্র (পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, রিপার, হার্ভেস্টার) ইত্যাদি । পূর্বে এ সকল উপকরন সংগ্রহ ও বিতরন বা সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো সরকারী প্রতিষ্ঠান যথা- পানি উন্নয়ন বোর্ড,  বি,এ,ডি,সি ও বি,কে,বির (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক) মাধ্যমে। এই সংস্কার কর্মসূচি গ্রহনের মাধ্যমে জিয়া ক্ষুদ্র সেচ যন্ত্র, চাষ যন্ত্র, এবং সার বিতরন ব্যাবস্থায় আমুল পরিবর্তন নিয়ে আসেন । তিনি এই সংস্কার কর্মসুচির মাধ্যমে বেসরকারী খাতকে উৎসাহিত করে কৃষি উপকরন ব্যবসা  এবং উপকরন সরবরাহ ব্যবস্থায় সংযুক্ত করেন যেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা এর সুফল পায়। এই সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সারা দেশে কৃষকদের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ধান উৎপাদন ৭৪-৭৫ সালে ১১.১১ মিলিয়ন টন থেকে ১৯৮০-৮১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দŧাড়ায় ১৩.৬৬ মিলিয়ন টন। বর্তমানে কৃষকরা এই সংস্কার কর্মসুচির সুফল ভোগ করছে। (সুত্র ঃ বিবিএস, ২০১৮) 

খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য শস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করন কর্মসূচী

দেশের দরিদ্র জনগোষ্টীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যের  আপদকালীন মজুদ গড়ে তোলার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। এ কারনে তিনি নতুন খাদ্য গুদাম তৈরীর উদ্যোগ গ্রহন করেন যেন অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল গুদামজাত করে আপদকালীন মজুদ গড়ে তোলা যায় এবং প্রয়োজনের সময় খাদ্য বিতরন ব্যবস্থার (Public food distribution system)  মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ করে  দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।  কৃষদের শস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে তিনি ভাল দামে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান চাল ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহন করেন। জিয়ার শাসনামলে (৮০-৮১) অর্থ বছরে ধান/চাল সংগ্রহ অভিযানে রেকর্ড পরিমান (১.০৩ মিলিয়ন টন)  চাল সংগ্রহ করা হয় (শাহাব উদ্দিন ও ইসলাম, ১৯৯১)। তাঁর শাসনামলেই ধানের বাম্পার ফলনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রথম চাল রপ্তানি করা হয়। 

খাল খনন কর্মসূচী

ষাট এর দশকের কৃষিতে যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয় তার গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হল সেচ । এই সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সহজলভ্য এবং টেকসই করার জন্য তিনি একটি যুগান্তকারী কমসূচী গ্রহণ করেন। শহীদ জিয়ার এই জনপ্রিয় কর্মসূচী হল খাল খনন কর্মসূচী। শুকনো মৌসুমে কৃষক যেন নদীনালা ও খালের পানি দিয়ে তার জমিতে প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা করে ফসলের নিবীড়তা বাড়িয়ে এবং বর্ষা মৌসুমে ফসলকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করতে পারে- এই মূল লক্ষ্য নিয়ে তিনি খাল খনন কর্মসূচী গ্রহণ করেন। সমগ্র দেশে সে¦চ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে এই খাল খনন কর্মসূচীতে জনগণের সাথে তিনি নিজেও অনেক জায়গায় অংশ নিয়েছেন। কোদাল হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া খাল কাটছেন এ ছবি এখনও মানুষের দৃশ্যপটে ভেসে আছে। দেড় বছরে সারা দেশে ১৫০০ এর বেশী খাল খনন ও পূনঃর্খনন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই বৈপ্লবীক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই খাদ্য উৎপাদনে স¦য়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবহার নিয়ে তিনি একজন বিজ্ঞানীর মত চিন্তা করতেন। ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেটিও ছিল জিয়ার খাল খনন কর্মসূচীর অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে কৃষি ব্যবস্থায় সেচের জন্য যে পানি ব্যবহার করা হয় তার ৮১% এর বেশী আসে ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে, আর প্রায় ১৯% আসে নদীনালা, খাল-বিল ও বৃষ্টির পানি থেকে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর আমাদের দেশে অনেক নিচে নেমে গেছে এবং অনেক স্থানেই Shallow Tube Well  দিয়ে পানি উত্তোলন করা যায় না, Deep Tube Well দিয়ে মাটির অনেক গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত আহরণের ফলে বাংলাদেশের বিশাল এলাকার পানি ও মাটিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যতে সেচের পানির অভাবে কৃষি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। জিয়ার খাল খনন কর্মসূচী ছিল এদেশের কৃষকের জন্য বড় আশির্বাদ। 

 শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচী

দেশের মানুষ তথা দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠির খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে উনি বিশেষ কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। শস্য সংগ্রহের সময় শস্যের দাম সাধারণতঃ কম থাকে আবার একই শস্য কিছু দিন পরে বেশী দামে কৃষককে কিনে খেতে হয়। কৃষক যেন শস্য সংগ্রহের সময় তার ফসল বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচির আওতায় কৃষকরা উৎপাদিত খাদ্য শস্য গুদামে মজুদ রেখে স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহন করতে পারে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য।  আবার মৌসুম শেষে বেশী দামে গুদাম জাত কৃত শস্য বিক্রি করে কৃষক তার ঋণ শোধ করতে পারে-  এতে কৃষকরা আর্থিক ভাবে লাভবান হয়। 

বিশেষ  কৃষি ঋণ কর্মসূচী (Special Agricultural Credit Program- SACP)

উচ্চ ফলনশীল প্রযুক্তি অধিক পুজি নির্ভর যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে বিনিযোগ করা কঠিন। সেজন্য কৃষকদের অধিক সুদে অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস হতে মূলধন সংগ্রহ করতে হতো । কৃষকদেরকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচী প্রনয়ণ করেন যা বাংলাদেশের কৃষি ঋণ প্রবাহে নতুনমাত্রা যোগ করে। এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল কোন ধরনের জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যেন সহজেই কৃষিকাজের জন্য ঋণ সুবিধা পায়  এবং দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে ।

গ্রামীণ অর্থনীতি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে পল্লী বিদ্যুতায়ন কর্মসূচী

আধুনিক বিশ্বে  বিদ্যুতকে উন্নয়ন ও সভ্যতার একটি বড় নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বা REB প্রতিষ্ঠা করেন যার দায়িত্ব হল গ্রাম অঞ্চলকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা। এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্য হল- বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামীন এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সম্প্রসারনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি করা যেন পল্লী এলাকার জনগণের জীবনমানের উন্নতি হয়। বৈদেশিক মুদ্রায় ডিজেল আমদানী করে সেচ পাম্প না চলিয়ে বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিলে সেচ খরচ কমে যায়। বর্তমানে পল্লী বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে ৯৮% গ্রাম এবং ৫.০৮ মিলিয়ন কৃষি পরিবার বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। বাংলাদেশে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এর প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়ন তৃতীয় বিশ্বের জন্য অন্যতম একটি সফল ঘটনা। 

আত্মকর্মসংস্থান, ব্যক্তিগত উদ্যেক্তা তৈরী এবং বেকার সমস্যা সমাধানে যুব উন্নয়ন কর্মসুচী

দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুব সমাজকে যেন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায় তার জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়া গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী হাতে নেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রনালয়  প্রতিষ্ঠা ও ১৯৮১ সালে যুব উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান লক্ষ্য বেকার যুবসমাজকে হাস মুরগী, গরু ছাগল লালন পালনের উন্নত কলা কৌশল, দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য গাভী পালন, ডোবা, পুকুর, জলাশয়ে মৎস্য চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে আতœকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দারিদ্র বিমোচন তথা দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। বর্তমানে দেশের আনাচে কানাচে দুগ্ধ খামার, পোল্ট্রি খামার, মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে যেখানে বেকার যুবকরা কাজ করছে, দেশের ক্রমবর্দ্ধমান জনগোষ্ঠির পুষ্টির চাহিদা মেটাতে অবদান রাখছে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার গৃহিত এই কর্মসূচি দেশে আতœকর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যাক্তিগত উদ্যোক্তা তৈরী ও বেকার সমস্যা সমাধানের মধ্যে দিয়ে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে চলেছে।

বিসিআইসি (Bangladesh Chemical Industries Corporation) প্রতিষ্ঠা ও সার কারখানা নির্মাণ 

বাংলাদেশের তিনটি সেক্টর কর্পোরেশনকে একিভূত করে তিনি ১৯৭৬ সালে বিসিআইসি  প্রতিষ্ঠা করেন । বাংলাদেশের সার কারখানা, কাগজ কারখানা-এর অন্তর্ভুক্ত। কৃষি বিপ্লবের ফলে দেশে সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য জিয়াউর রহমান নতুন সার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮১ সালে তিনি আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন। আরও কয়েকটি সার কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন যা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

চিনি শিল্পের উন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়ন

দেশে চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি ও উপজাত ভিত্তিক পন্য উৎপাদন করা এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের চিনি শিল্পকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য গুরুত্বপূর্ন নীতিমালা গ্রহন করেন। ১ জুলাই ১৯৭৬ সালে বাংলাদশে সুগার মলিস্ করপোরশেন ও বাংলাদশে ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রজি করপোরশেনকে একীভূত করে বাংলাদশে সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রজি করপোরশেন গঠন করেন।

কৃষি গবেষণায় গুরুত্ব ও স্বায়ত্বশাসন

ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অনান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নতুন শাখা, বিভাগ ও কেন্দ্র খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেন। তিনি গমের আমদানী নির্ভরতা কমেিয় দেশেই গমের উৎপান বৃদ্ধির লক্ষে গম গবেষণার উপর গুরত্ব প্রদান করেন। জিয়ার সাশন আমলে ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে নশিপুর, দিনাজপুরে গম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।  বাংলাদেশে বহুফসল নিয়ে গবেষণা করে এ রকম একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, যেটি গাজীপুরে অবস্থিত। এটি পূর্বে Agriculture Directorate (Research & Education) এর অধীনে ছিল। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৬ সালে Presidential Order No. LXII-এর বলে Bangladesh Agricultural Research Institute হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ, স্বতন্ত্র গবেষণা, বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, দেশের বিভিন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশ অঞ্চলে খাপ খাওয়ানো উপযোগী জাত ও প্রযুক্তি উদভাবন ও উন্ন্য়ন, কৃষক প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ম্যানডেট নিয়ে এই স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে স¦ায়ত্বশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি কৃষির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে চলছে। 

জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্তি ছিল একটি সময়োচিত দৃঢ় পদক্ষেপ। তাঁর গৃহিত কর্মসূচী ও নীতিমালার সুফল মাত্র দুবছরের মধ্যেই দেশের মানুষ পেতে শুরু করে- যা দেশের সবুজ বিপ্লবকে ত্বরানিত করেছে। তাঁর উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ পরিণত হয় খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে। তলা বিহীন ঝুড়ি খ্যাত দেশ এই রাখাল প্রেসিডেন্টের যাদুর হাতের স্পর্শে পরিণত হয় স্বনির্ভর বাংলাদেশে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিকদের মধ্যে তিনিই অগ্রদূত যিনি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, পায়ে হেঁটে ছুটে বেড়িয়েছেন কখনও লাঙ্গল হাতে, কখনও কাস্তে হাতে আবার কখনও কোদাল হাতে। রাখাল প্রেসিডেন্ট জিয়া কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের সাথে কথা বলেছেন, সমস্যা জেনেছেন, কৃষকের সাথে কাজে অংশ নিয়েছেন, কৃষকদের অনুপ্রাণিত ও জাগ্রত করেছেন।  অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ ও দূরদর্শী এই রাষ্ট্রনায়কের ডাকে জনগন সাড়া দিয়েছিল ব্যপকভাবে। এ দেশের জনগণ তাঁকে প্রচন্ড ভালবাসত তার প্রমাণ আমরা পাই, ওনাকে সমাধিস্থ করার দিনে লক্ষ লক্ষ জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদন ও উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে, রাষ্ট্রপতি জিয়া যে ভিত এবং সোপান রচনা করেছেন সেকারনে তিনি  দেশের কৃষক, কৃষিবিদ এবং আপমর জনগণের কাছে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন ।

  • লেখক শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ  এবং যুগ্ন আহবায়ক, এগ্রিকালচারিষ্ট আ্যসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এ্যাব)। 

 


স্বাস্থ্য খাতে জিয়াউর রহমান ও বিএনপির অবদান

--------------------------------------------------------------------------------------

ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ও ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম

--------------------------------------------------------------------------------------

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুসারে স্বাস্থ্য মানে কেবল চিকিৎসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নয়, বরং স্বাস্থ্যকে একটি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে একটি পরিপূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করা। এ অবস্থানটির সূত্রপাত হয় ১৯৭১ সালে, হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের বিশ্ববিখ্যাত রাজনৈতিক দর্শনের অধ্যাপক জন রল্সের ’সামাজিক ন্যায়বিচার’ ধারণার উন্মেষ থেকে। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন--এসব বিষয়কে জনমানুষের মুক্তির শর্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। প্রণিধানযোগ্য যে, সেই সত্তরের দশকে ’সামাজিক ন্যায়বিচার’ শব্দটি একটি অ্যাকাডেমিক জার্গন হিসেবে তখনো বিশ^ব্যাপী পরিচিতি বা প্রতিষ্ঠা পায়নি। বর্তমানকালে জেরেমি করবিনের ব্রিটিশ লেবার পার্টি, বার্নি স্যান্ডার্স প্রভাবিত মার্কিন ডেমোক্র্যাটগণ এবং গোটা ইউরোপ বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশগুলোতে নব্য বামপন্থিগণ যেভাবে ’সামাজিক ন্যায়বিচারে’র ধারণাকে তাদের পার্টির মূলমন্ত্র বানিয়েছে, সেই সোভিয়েত-শঙ্কিত বিশ্বে তা তখনও ঘটে ওঠেনি। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, ইউরোপ আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আধুনিক চিন্তার অভিঘাত তখনো লেগে উঠতে পারেনি, সেটাই ঘটেছিল দক্ষিণ এশিয়ার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ বাংলাদেশে। আর তা ঘটেছিল এক অসাধারণ প্রজ্ঞাবান, বিশ্ব রাজনৈতিক-দর্শন সচেতন, গণমুখী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে।

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ’সামাজিক ন্যায়বিচার’ অভিধার সংযোজনকে কোন কাকতালীয় ঘটনা কিম্বা অপরিকল্পিত বাগাড়ম্বর ভাবার কোন কারণ নেই। আমরা জানি, বাংলাদেশের তৎকালীন তো বটেই, সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের তুলনায়ও শহীদ জিয়া ছিলেন উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাগ্রসর চিন্তা চেতনার অধিকারী। তাঁর পড়াশোনা এবং জ্ঞানের পরিধিও ছিল ব্যাপক। ইংরেজিতে তুখোড় এ রাষ্ট্রনায়ক আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বেস্ট সেলার গ্রন্থ জন রল্সের ’এ থিওরি অফ জাস্টিস’ পড়ে প্রভাবিত হয়ে তাঁর সময়ের তুলনায় বহু আগেই যে এমন একটি ধারণার সংযোজন বাংলাদেশের সংবিধানে ঘটাবেন, তা অসম্ভব মনে হয় না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে অভূতপূর্ব সংস্কার তিনি সাধণ করেছিলেন, তা থেকে তাঁর এমন অগ্রগামী চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশ^ব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় স্বাস্থ্য খাতে। কারণ, ১৯৭৮ সালের আলমা আতা ঘোষণার (যা ’প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ তথা ’২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল--একটু বয়সী পাঠকদের মনে থাকবে) আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ছিল মূলতঃ পয়সাওলা মানুষদের ক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো, ঠিক অধিকার নয়। সেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার প্রবর্তনের ফলে স্বাস্থ্য পেল গণমানুষের অধিকারের মর্যাদা। গৌরবের বিষয়, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকালীন বাংলাদেশ ছিল আলমা আতা ঘোষণার অন্যতম স্বাক্ষরকারী এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল মডেল। তাঁর এবং পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার সময়কালে নেওয়া স¦াস্থ্যখাতের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে জনগণের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ২০০০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পল্লীর জনগণ যেন সুচিকিৎসা পায় সেজন্য তিনি চীনের  ‘বেয়ারফুট ডক্টর’দের আদলে পল্লী চিকিৎসক ব্যবস্থা প্রবর্তণ করেন। ফলে মাত্র এক বছরেই প্রশিক্ষণ পান ২৭ হাজার পল্লী চিকিৎসক। তাঁর প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া ও এ সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নে আজকের বিশ্বখ্যাত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ও হাসপাতাল (National Institute of Cancer Research and Hospital, NICRH)  প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আগ্রহ ও ঐকান্তিক ইচ্ছায় বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ডায়রিয়া চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য গবেষণায় অনন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর-বি। এটি কলেরা হাসপাতাল নামেও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। এছাড়া জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম (NIPSOM: National Institute of Preventive and Social Medicine) এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ইপিআই (EPI: Expanded Program on Immunization) প্রতিষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাতেই। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ইপিআই থেকে বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সী সকল শিশুদের বহুল সংμামক রোগ যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, হাম, পোলিও-মায়েলাইটিস এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোগের টিকা দেওয়া শুরু হয়।

শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন যে, আলমা আতা ঘোষণার আলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা (PHC)  বাস্তবায়নের মূল লক্ষ্য হলো গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণের ধারনাটির প্রবর্তন এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে তৎকালীন থানা ডিসপেন্সারিসমূহকে আধুনিক থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শহীদ জিয়া। ছয়টি উপজেলায় তিনি পরীক্ষামূলকভাবে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার পাইলট প্রজেক্ট উদ্বোধন করেন, যার হাত ধরেই বাংলাদেশ আজকে বিশে^র মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবকাঠামোগত নেটওয়ার্ক থাকার গর্ব করে। ১৯৭৭ এবং ১৯৭৯ সালে ডিরেক্টরেট অফ নার্সিং সার্ভিসের রিμুটমেন্ট রুলস বা নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে ডিরেক্টরেট অফ নার্সিং সার্ভিসেস প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি শহীদ জিয়া নার্সদের উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কলেজ অব নার্সিং যা তাঁর দূরদর্শীতার পরিচয় বহন করে। ভালো চিকিৎসক গড়ার পাশাপাশি ভালো নার্স তৈরির জন্য তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০টি নার্সিং ট্রেনিং সেন্টার। এছাড়া মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিংয়ের জন্য ১৪টি মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং সেন্টার (MATS)  প্রতিষ্ঠা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশপ্রেমিক জিয়া।

এছাড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, পিজি হাসপাতালের সি-ব্লক, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (National Institute of Population Research and Training, NIPORT), হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটসহ চিকিৎসকদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিএমএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার গঠন মহান নেতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আরেক কীর্তি। উক্ত ক্যাডার গঠনের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসকবৃন্দকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত এবং সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত করেন। স্বাস্থ্য পরিচালকের (ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস) পদকে স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের (ডিরেক্টর জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেস) পদে উনড়বীতকরণ জিয়াউর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা দুঃখজনকভাবে আজ আর বেশি মানুষ জানেনা বা উল্লেখ করেনা। স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও তাঁর শাসনামলে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা ৩১ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়, নতুন জেলা শহরে শয্যাসংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ এবং পুরানো জেলা শহরের হাসপাতাল ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উনড়বীত করা হয় তার শাসনামলেই। বহু সংখ্যক হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করা হয়। এক বছরের কম বয়সী শতকরা ৮৫ ভাগ শিশুকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। তাছাড়া ১৯৯২ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজসহ পাঁচটি নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৩ সালে ইপিআই থেকে মা ও শিশুদের হেপাটাইটিস রোগের টিকা দেওয়া শুরু হয়। সরকারি পদক্ষেপের কারণে দেশের শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় সেই সময়ে।

উল্লেখ্য, চিকিৎসকদের চাকরিতে নিয়োগদানের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩২ বছরে উন্নীত করে বিএনপি সরকার। এছাড়াও স্বাস্থ্য জনসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রথম হিউম্যান রিসোর্স স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করা হয় বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালে, ২০০৩ সালে। এর বদৌলতে স্বাস্থ্য সেবাপ্রদাকারীদের দায়বদ্ধতা, কর্মদক্ষতা, নিয়োগ, জনসম্পদ তথ্য ব্যবস্থাপনা (হিউম্যান রিসোর্স ইনফরমেশন সিস্টেম) ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার রাস্তা খুলে যায়। ২০০৬ সালে ঢাকা ডিক্লিয়ারেশনের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় অঞ্চলে স্বাস্থ্য জনসম্পদ উনড়বয়নের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। একই সময়ে (২০০৬ সালে) বিএসসি নার্সিংয়ের জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিএসসি নার্সদের চাকরি ও পেশাগত বিকাশের রাস্তা, যা দীর্ঘদিন আটকে ছিল, তা খুলে যায়। এর বাইরেও বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের শাসন আমলে গৃহীত ইমার্জেন্সি অবস্টেট্রিক কেয়ার (ইওসি) প্রজেক্ট প্রসূতি নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ও মৃত্যুরোধে রাখে অনবদ্য অবদান। ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রজেক্ট (বিআইএনপি) পুষ্টির ক্ষেত্রেও রাখে অনুরূপ অবদান। তাঁর পরবর্তী শাসনামলে (২০০১ থেকে ২০০৬ সাল) ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অফ চাইল্ডহুড ইল্নেস (আইএমসিআই) শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উনড়বয়ন এবং শিশুমৃত্যু হ্রাসের জন্য বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হয়। এছাড়া মাতৃ ও শিশু শিশুমৃত্যু হার হ্রাসের জন্য ডিমান্ড সাইড ফাইন্যান্সিং স্কিমও বেগম খালেদা জিয়ার উভয় শাসনকালে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। দেশের মানুষ যেখানে স¦াস্থ্য ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খায়, এই স্কিমের মাধ্যমে সেবাকেন্দ্রে আসা নারীদেরকে উল্টো প্রণোদনামূলক অর্থ প্রদান করা হয় যাতে তারা উন্নত সেবা নিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আসতে আগ্রহী। তাঁর শাসনআমলগুলোতেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি দরদ দিয়ে ভূমিকা রেখেছে বিএনপি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রায় প্রত্যেকটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক বিএনপির অবদান। আমরা দেখেছি সেই আলমা আতা ঘোষণার আলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রণয়ন থেকে শুরু করে, ইপিআই, ইওসি, বিআইএনপি, আইএমসিআই পর্যন্ত যতগুলো আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য নীতিমালা রয়েছে, তার প্রায় প্রত্যেকটিই বিএনপির কোন না কোন শাসনামলে প্রণীত। আজকে বাংলাদেশ স্বল্প ব্যয়ে উনড়বত স্বাস্থ্য (Good health at low cost), প্রাথমি স্বাস্থ্য সেবা, ভ্যাক্সিন হিরো ইত্যাদি নানা অর্জন নিয়ে বিশে^র দরবারে গর্ব করে। এই সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সামাজিক ন্যয়বিচার ভিত্তিক নীতিগত অবস্থানের কারণে। এ দলটি কেবল জাতীয় সংবিধানে সামাজিক ন্যয়বিচারের অভিধাটি যুক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তা স্বাস্থ্য খাতে বাস্তবায়ন করেও দেখিয়ে দিয়েছে, বিএনপি কেবল কথায় নয়, বরং কাজে বিশ্বাসী।