-----------------------------------------------------------------
— অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান
----------------------------------------------------------------
বাঙালির মন মায়াজালে আবদ্ধ। এরা প্রভু কীর্তনে কিংবা ভিন্নমত দমনে ভেদাভেদ করে না; হোক রাষ্ট্রীয় কিংবা বিশ্বজগতের মালিক; অতি দুর্বল ভিন্নমত পোষণকারী কিংবা স্বয়ং ইবলিশ শয়তান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঝি-মাল্লা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী- সবাই এই কর্মযজ্ঞে মিলে-মিশে একাকার। আহমেদ ছফার ভাষায়, "এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক প্রোপাগান্ডা লিটারেচারের সংগে পুঁথিসাহিত্যের একটি সমধর্মিতা আবিষ্কার করা খুব দুরুহ কর্ম নয় (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)। সংগত কারণে আমার পক্ষে এই জাতির ইতিহাস চর্চার পরিচিত মসৃণ পথের বিপরীতে গিয়ে হঠাৎ করে ইতিহাসমনষ্ক হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। এই অক্ষমতা মাথায় রেখেই যা কিছু দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা সমর্থিত, অথচ কম আলোচিত কিংবা উপেক্ষিত এমন কয়েকটি বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে রণাঙ্গণের জিয়া ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রবর্তনে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান-এর সাফল্য মূল্যায়নের চেষ্টা করবো।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে বীরত্বগাঁথা ও রাজনীতিবিদ হিসেবে চরিত্র বিনির্মাণ করতে হলে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা ও থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ ও স্বরূপ, পঁচাত্তরের পরের দিশেহারা রাজনীতির প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান ও এর সঠিক উপলব্ধি ও সবিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলো, এই কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। রাজনৈতিক বিভাজন তখনও ছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ফেরত এসে যুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়হীনতার ছিলো। অন্যদিকে থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব ছিলো প্রায় দৃশ্যমান। (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০০৭ পৃ: ১৫)।
ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই ভিন্নতা রাজনৈতিক মোড় নেয়, জন্ম ও বিকাশ লাভ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি গঠনে বলতে গেলে জিয়াউর রহমান এককভাবেই কৃতিত্বের দাবিদার। সাধারণত এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের মাঠে, গোলটেবিল আলোচনায় কিংবা ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। সেই বিবেচনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি'র জন্ম এবং জনপ্রিয়তা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক দল গঠন ও প্রতিষ্ঠা লাভের বিবেচনায় ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এর পেছনে যে বিষয়গুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা মূলতঃ ব্যক্তি জিয়া'র ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।
পেশাদারিত্ব তাঁর চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান একটি দিক। সৈনিক জিয়া'র ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন 'আলফা কোম্পানির' কমান্ডার হিসেবে 'খেমকারান' রণাঙ্গনের বেদীয়ান-এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পেশাদারিত্বের কৃতিত্ব হিসেবে তাঁর কোম্পানির সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে মেজর জিয়া ঢাকায় পোস্টিংয়ের সুবাদে দেশে ফিরে এলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পার না হতেই পরিস্থিতি বিষ্ফোরোন্মুখ হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হয় ২৫ মার্চের কালো রাত। বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশু সন্তানকে চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই মেজর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
শ্বাসরুদ্ধকর এই অবস্থার অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে; লাখো মা-বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মেজর জিয়ার সংগে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিলেও বেগম জিয়া দুই অবুঝ শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে বুকে আগলে রেখে আত্মগোপন ও বন্দিদশায় যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ও আতংকে দিন অতিবাহিত করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন তাঁর মূল্য রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় কেনো অংশে কম নয়।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়া'র ভূমিকা নিয়ে তাঁর কঠোর সমালোচকরাও নিন্দার কোনো আলামত বা উপকরণ খুঁজে পাননি। জিয়া'র স্বাধীনতার ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উজ্জীবীত ও উদ্দীপ্ত হয়ে তাঁদের লেখায় জিয়া'র প্রশংসা করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (আমার একাত্তর), ভারতীয় কূটনীতিক জে. এন. দীক্ষিত, ট্রেভর ফিসলক ও ডেভিড লুডেন (মাহফুজউল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ, এডর্ন পাবলিকেশন; ২০১৬)। জিয়াই হলেন বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযুাদ্ধা রণাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যার ছবি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম মিউজিয়ামে অমর কীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা আছে।
এর ব্যতিক্রমও আছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থে (রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ১৯৭৪, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা) স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং জিয়া'র অবদানের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। এতে অবাক হবারও তেমন কিছু নেই। কারণে চরিত্র বিনির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই।
অতি সম্প্রতি বাংলা ইনসাইডার অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সৈয়দ বোরহান কবীরের 'জিয়ার' ওপর একটি লেখা আমার নজরে এসেছে। লেখাটা পড়ে একই রকম অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম হল। তিনি লিখেছেন,"উগ্রবাম ও উগ্র ডানকে তিনি (জিয়া) ক্ষমতার ঘাটে জল খাইয়েছিল। ফলে তার উগ্রবাদী একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাযায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ (সৈয়দ বোরহান কবীর, জিয়ার রাজনীতির পাপ ও পরিণতি, বাংলা ইনসাইডার, ২৯ মে,২০২১) । দৃষ্টিগোচর হলে সাধারনত তার লেখা পড়ি। তিনি অনলাইন পোর্টালটির প্রধান সম্পাদক ও 'পরিপ্রেক্ষিত' এর নির্বাহী পরিচালক ।একটি দায়িত্বশীল পদে আছেন, ভালো লিখেন। আমরা পাঠকরা এই ধরনের লেখকদের প্রবন্ধ পাঠ করে দোষারোপের সস্তা কুতর্কের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাসের সঠিক পাঠ গ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকি। সৈয়দ বোরহান কবীরের সঙ্গে আমি একমত যে, প্রশংসাকে পূজায় পর্যবসিত করা আকাঙ্ক্ষিত, তাই পরিত্যাজ্য। বিভিন্ন গ্রন্থ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যেরভিত্তিতে জেনেছি জিয়ার জানাযায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের অন্যতম প্রধান অন্য দুজন হলেন মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গণমাধ্যম সূত্রেই আমরা অবগত হয়েছি, তাদের শেষকৃত্যে ধারণাতীত সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় কি ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিনা। তবে ভারতবর্ষের জনগণ তথা বাঙালির মনস্তত্ত্বের বিচারে বলা যায়, জীবিত অবস্থায় যত বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কই থাকুক না কেন, মৃত ব্যক্তির জন্য চোখে আবেগের অশ্রু বিসর্জন দেয়া আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। তাই আমজনতার মত আমার বিশ্বাস, জিয়ার জানাযা কিংবা গান্ধীজী ও কবিগুরুর শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীরা মৃত ব্যক্তিদের কল্যাণ কামনার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু সৈয়দ বোরহান কবিরের দাবি জিয়ার ক্ষেত্রে এদের অধিকাংশই হলেন জিয়ার মাধ্যমে সুবিধাভোগী উগ্র বামপন্থী ও উগ্র ডানপন্থীদের সমাবেশ। জানাযায় তারা জিয়ার পরজাগতিক কল্যাণ কামনার জন্য অংশগ্রহণ করেননি, বরং সমবেত হয়েছেন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করার নীলনকশা বাস্তবায়নে অংশ হিসেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাধারণত সুবিধাবাদীরা কায়েমি স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাজা বাদশাদের জীবদ্দশায় প্রাসাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে, তাদের জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে শামিল হয় না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ঘুরঘুর করা সুবিধাবাদী মানুষগুলো কিভাবে কেটে পড়েছিল গোটা জাতি তা লক্ষ্য করেছে। ৩২ নাম্বার বাড়িতে ৩২ ঘণ্টা তার ক্ষত বিক্ষত দেহ পড়েছিল। সুবিধাভোগীরা জানাজায় অংশগ্রহণ করা দূরে থাক , নেতার লাশটি পর্যন্ত দেখতে যায়নি। বরং তারা কি করেছে সৈয়দ বোরহানসহ গোটা জাতি অবগত আছেন।জনাব বোরহান, আমার ধারণা জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে যারা যায়, তারা দুধের মাছি নন, দুঃখের সাথী। তাই জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের উগ্রপন্থি কিংবা বিশেষ কোন পন্থী হিসেবে মূল্যায়ন করা কতটা অনুমাননির্ভর আর কতটা যুক্তিনির্ভর তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। হতে পারে জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ব্যক্তির অংশগ্রহণ ছিল মঙ্গল কামনার জন্য নয়, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা পালন মাত্র। তাই জিয়ার জানাযায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষের অভিপ্রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য স্বজ্ঞাপ্রসূত নয় (counterintuitive) বলেই প্রতীয়মান হয়। যাইহোক, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক জনাব বোরহানের এই দাবির যথার্থতা মূল্যায়ন এর উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই, ইতিহাসমনস্ক গবেষকরা এই দাবির যথার্থতা হয়তো একদিন মূল্যায়ন করবেন। সেদিন আমজনতা পাঠকের মত সৈয়দ বোরহান নিজেই হয়তো ইতিহাস মনস্ক কোন লেখকের উক্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখা কোন প্রবন্ধ পাঠ করে অনুধাবন করবেন যে, 'জিয়া-সমালোচনাকে' তিনি কিভাবে 'কুৎসায়' পরিণত করেছেন। হয়তো কোন একদিন তিনি নিজেই তার রচিত এই প্রবন্ধের পরিমার্জিত বয়ান জনপ্রিয় কোন একটি দৈনিকে ছাপবেন। অন্য পাঠকদের মত আমিও সেদিন আশা করি বিভ্রান্তি মুক্ত হব।]
যাই হোক, প্রসংগে ফেরা যাক। পরাজিত হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা তাঁকে অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। তিনি হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাননি। ১৯৭৪ সালে তাঁর নিজের লেখা 'একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে এর আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। অবশ্য গুটিকয়েক দালাল ছাড়া আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখত, অবহেলা করত, অসম্মান করত। দক্ষ ও যোগ্য বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের ভাগ্যে জুটত না কোনো স্বীকৃতি বা পারিতোষিক। জুটত শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা ... ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগনাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল ..." (রহমান, মেজর জেনারেল জিয়াউর (১৯৭৪), 'একটি জাতির জন্ম', বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যা, ২৬ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা)।
অন্তরে পুষে রাখা স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৬ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার আব্দুর রশিদ জাঞ্জুয়াকে প্রতিহত করেন। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যের রাতে জিয়া চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামীলীগ নেতাদের জানাতে বলেন যে, ইস্ট বেঙ্গলের অষ্টম ব্যটেলিয়ান বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া যে তাঁর সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, সেটা তাঁর সহকর্মীরা সমর্থন করেন এবং পরে ২৭ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-৪৬)।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়া'র রণকৌশল প্রয়োগের বিষয়টি খুব একটা বাধামুক্ত ছিলো না। চিহ্নিত শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা জিয়াসহ রণাঙ্গনের অনেক যোদ্ধার উৎসাহ উদ্দীপনাকে স্তীমিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। পদ ও বয়সের কারণে তাঁর নিযুক্তি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিলো। কিন্তু তিনি সবার সংগে মানিয়ে নিতে পারেননি। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান তাঁর শুভ দৃষ্টিবঞ্চিত ছিলেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করা কর্মকর্তাদের উপর। বীরত্বসূচক পদক বিতরণের সময় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পদকবঞ্চিত হন জিয়া'র অধীনে যুদ্ধ করা অধিকাংশ কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেই এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় 'খয়রাতি বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন (কর্নেল শাফায়াত জামিল, ২০০৯, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ৫৪)।
প্রসংগত উল্লেখ্য, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে 'জেড ফোর্স' নামক বিগ্রেড তৈরি করা হয়েছে। জুন ৭১-এ তৈরি এই 'জেড ফোর্স'ই হলো সর্বপ্রথম ব্রিগেড। পরে কে এম সফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফ তাঁদের অধীনে আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার জন্য এম এ জি ওসমানী'র ওপর চাপ অব্যাহত রাখেন। আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার মতো নিয়মিত সেনা তখন না থাকলেও এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় তিনি ৩০ আগস্ট সফিউল্লাহর অধীনে 'এস ফোর্স' এবং ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদ মোশাররফের অধীনে 'কে ফোর্স' নামে আলাদা দু'টি ব্রিগেড তৈরি করেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ- ৪৮)।
রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জিয়াকেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। এটি সন্দেহাতীতভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক ঘটে তখনই, যখন দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে জিয়া ও সফিউল্লাহ একই ব্যাচে কমিশন পেলেও ক্রম অনুযায়ী জিয়া'র নাম উপরে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সফিউল্লাহকে ৩ বছরের জন্য সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ নিয়োগ করা হয়। বৈষম্যের বঞ্চনার দহন এখানেই শেষ নয়। সফিউল্লাহকে প্রথম তিন বছরের মেয়াদ শেষে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো তিন বছর মেয়াদে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় (নূরুল ইসলাম চৌধুরী, '১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে', ভোরের কাগজ, ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট, ১৯৯৪)।
ইতিহাসের এই বিবরণ পাঠে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়: কর্মজীবনের শুরু থেকেই রণাঙ্গনে ভূমিকা রাখার জন্য পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পুরষ্কারে ভূষিত জিয়াউর রহমানের সংগে এম এ জি ওসমানী'র এই শীতল সম্পর্কের কারণ কী? কেনই বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রচলিত জ্যেষ্ঠতার নিয়ম লঙ্ঘন কওে, মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় অবদান রাখার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তম জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার পদবঞ্চিত করা হলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার যথাযথ ব্যক্তিরা হলেন ইতিহাসের গবেষকগণ। সেই কারণে আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে অতি সাধারণীকরণের ঝুঁকি অনুভব করে, তা থেকে বিরত থাকাই সংগত মনে করছি।
পেশাদার একজন সামরিক কর্মকর্তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদে যাওয়ার বিষয়টি তাঁর অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এটি মোহ বা লোভের বিষয় নয়। অধিকার বঞ্চিত হয়েও প্রতিশোধের পথ বেছে না নিয়ে তিনি বছরের পর বছর (অন্তত সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে সফিউল্লাহ'র ৩+৩=৬ বছর মেয়াদে) ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা (ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্যু পাল্টা ক্যু-তে বিশেষভাবে খ্যাত একটি বাহিনী)। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দিতে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়। পেশার প্রতি একনিষ্ঠ জিয়া বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার প্রস্তাব বিনয়ের সংগে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত খুরশিদ উদ্দিন আহম্মেদ-এর সহায়তায় দেশ থেকে বিতাড়িত হবার দুর্ভাগ্যবরণ করা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন (হামিদ, লে. কর্নেল (অব.) এম এ (২০১৩), তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ- ১২-১৩)।
১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পেছনে জিয়াউর রহমানকে অনেকেই অনুমান-নির্ভর মূল্যায়ন করে থাকেন। দু'টি ঘটনা উল্লেখ করে বলা যায়, পটপরিবর্তনের কর্মকান্ডে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলো না মর্মে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
(১) প্রথম ঘটনাটি হলো, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পরে ঐ বিষয়ে অবহিত করার পরও জিয়া'র মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার কোনো ধরনের লক্ষণ কিংবা আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি বরং অতি সংক্ষেপে বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষেই তিনি মত প্রকাশ করেন (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ১০৩)।
(২) দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হবার পর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, সাফায়াত জামিল জিয়া'র কক্ষে বসে আছেন। এমন সময় সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এবং সরকারি আদেশে দিল্লিতে অবস্থানরত মেজর জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের কক্ষে প্রবেশ করেন। এরশাদকে দেখে জিয়াউর রহমান রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,'আপনি অনুমতি ছাড়া কেন দেশে ফিরে এসেছেন?' জবাবে এরশাদ বলেন, 'আমার স্ত্রীর জন্য গৃহভৃত্য নিতে এসেছি। ততোধিক রেগে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, 'আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এ ধরনের লাগামহীন আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে' (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), পৃ- ১২০-১২১)'। একইসংগে তিনি এরশাদকে বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেন এবং পরের ফ্লাইটেই দিল্লি যেতে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অমান্য করে ঐ রাতে এরশাদ বঙ্গভবনে যান এবং অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সংগে বৈঠক করেন (প্রাগুপ্ত)।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশংকাজনকভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই আদেশে বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সংগে জড়িত কারও বিচার করা যাবে না (মহিউদ্দিন আহমদ, ২০১৭, পৃ-৬৪)। অধিকন্তু কর্নেল সাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী, তার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও খোন্দকার মোশতাক অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত মেজর রশীদ, ফারুক ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন (সাফায়াত জামিল, ২০০৯, পৃ-৭)। এই ঘটনা প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সংগে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অভ্যুত্থানকারীরা ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে সংঘটিত করলো? অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো তৎকালীন সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক মনস্তত্ত্ব। স্পষ্ট ভাষায় বললে, তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রতি অবহেলা ও ভারতীয় আধিপত্যের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯৭৪ সালে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করার বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না' (মাসক্যারেনহাস, অ্যান্থনি, ২০০২), বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, A Legacy of Blood-এর ভাষান্তর, অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ-৩৮-৩৯)। এর বিপরীতে তিনি রক্ষীবাহিনী নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেন; প্রথমে পুলিশের এটি সহায়ক বাহিনী হলেও পরে এই বাহিনীকে ক্ষমতা দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারতো এবং অনেকেই মনে করেন তাদের ব্যবহার করা হতো আওয়ামী লীগের সমালোচকদের বিরুদ্ধে (প্রাগুক্ত)। এর সংগে যুক্ত হয় বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যা ব্যপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের আস্থাভাজন তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ এ ধরনের পদক্ষেপ সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে বিধায় তাঁকে অবহিত করার তাগিদ বোধ করেন। এ ব্যাপারে ভোরের কাগজের (তৎকালীন) সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সফিউল্লাহ বলেছেন,
স্যার, 'সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। হঠাৎ করে এক পার্টিতে কেন যাচ্ছেন?' তিনি বললেন, 'সফিউল্লাহ, তুমি বুঝবে না ... আমার ওপর বিশ্বাস রাখো' ( ভোরের কাগজ, ১৫ ও ১৬ আগস্ট, ১৯৯৩)।
সফিউল্লাহ এক্ষেত্রে আরও মন্তব্য করেন, 'মনে হয় এসব কিছুর পরও যদি রক্ষিবাহিনী সামনে না আসতো, সেনাবাহিনী সেগুলো মেনে নিতো (প্রাগুক্ত)। সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব অগ্রহণযোগ্য ছিলো মর্মে মন্তব্য করেছিলো আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত মিত্র বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। তাদের মূল্যায়নে বলা হয়- 'আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্ম ও ভিত্তি তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার মতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে... পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে তেমন বৈরীসুলভ দৃষ্টি গ্রহণ করা খুবই ক্ষতিকর হবে (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৯, 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আমাদের পার্টির ভূমিকা ও করণীয়', কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত, পৃ-১৪-১৫)'।
১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী ও আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের নিজস্ব বয়ানের (জনগণ এ বিষয়ের উপর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্টই অবগত হয়েছেন) পাশাপাশি উপরোল্লিখিত ঘটনাবলী বিশ্লেষণের আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ৭৫-এর পট পরিবর্তনের সংগে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁকে দায়ী করা বক্তব্য কিংবা লেখনি ভ্রান্ত অনুমাননির্ভর, অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
৩) ৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ছিলো একটি সময়ের দাবি। সংকট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, ক্যু ও পাল্টা ক্যু-এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহী-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কীভাবে দেশ পরিচালনা গুরুদায়িত্ব প্রদান করেছেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।
জিয়া'র দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কী হবে, এর একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গেছে। জিয়া প্রতিশোধ পরায়ন ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও শত্রু চিহ্নিত করে নির্মূল করার পথে না হেঁটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে জিয়া সর্বস্তরের জ্ঞানী-গুনী মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায়ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট এই দল গঠন করা হয়। সাধারণত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে এ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এটি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের মস্তিষ্কজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ। সংগত কারণে অনেকের মধ্যে সংসয় ছিলো, এটি কি রাজনৈতিক দল নাকি একটি 'প্রবণতা'। কিন্তু সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবেই স্থায়িত্ব অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহণযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে দেশ শাসন করেছে।
এই দলের গ্রহণযোগ্যতা তথা জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি কারণ হলো- ১) জাতীয়তাবাদী দলের দার্শনিক ভিত্তি, ২) জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ৩) কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ।
বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় 'বাঙালি' হিসেবে ধার্য করা হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারণায় পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কী তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে 'বাঙালি' পরিভাষাটি ব্যবহার করি, তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ (যেমন-আদিবাসীগণ) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এটি আমাদের জাতিসত্বার একটি খন্ডিত পরিচয় তুলে ধরে। জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে 'বাঙালির' স্থলে 'বাংলাদেশী' পরিভাষা ব্যবহার করা প্রস্তাব করেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের তাত্ত্বিক বিচ্যুতি দূর করার লক্ষ্যে কালক্ষেপণ না করে তিনি ফরমান জারি করে একে আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থিত করেন। এর পক্ষে তার যুক্তি হলো-
'বিশেষ করে ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটেছে। 'রেজিয়াল' বা জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসংগে সর্বপ্রথমেই এসে যায়। আরব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।...এর পর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান এই ধ্যান-ধারনা থেকেই উৎসারিত। এ কারণেই আওয়ামী লীগাররা বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলিম লীগ, আইডিএল এবং জামায়াতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা।...সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে 'পলিটিক্স অব এক্সপ্লয়টেশন' পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে একটি নতুন জাতীয়তাবাদ।... তাই আমরা বলি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।... বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয় তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। ...প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটি স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্নই হলো [সেই জাতির] দর্শন। এই দর্শন দিয়েই [চর্চার মাধ্যমেই] বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে' ('বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ', জিয়াউর রহমান, www.bnpbangladesh.org)।
জিয়াউর রহমানের মতে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সার্বজনীন ও অবৈষম্যমূলক। এটি কেবল ধারণাগত বিষয় নয় বরং দেশপ্রেমের চেতনাস্নাত একটি প্রণোদনা; যা সকল নাগরিককে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সমান গুরুত্বের সংগে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮১ সালে মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের বক্তব্যে তা-ই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন,
"এটা আমাদের দেশ, আমাদের ভূমি, ... এখন সুযোগ এসেছে ... চাষাবাদ করি এবং এর উৎপাদনশীলতা বাড়াই, শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যfদার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। ... আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে ... কোনো বিদেশীবাদ নয় (Franda, Marcus (1981) Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism, Economic and political weakly, Vol. XVI, No-10-11-12, 1981; quoted in Hossain) p-63।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ এই রাষ্ট্র দর্শনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে প্রান্তিক আদিবাসীরাও গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতি পায়, জিম্মি থাকে না আহমদ শরীফের ডায়েরি, ভাব-বুব্দুদ, পৃ-৬৪)। তবে তিনি জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করেননি। তাঁর মতে এর ফলে পূর্ণ নাগরিক হিসেবে মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণ বৈষম্যের শিকার হবেন (প্রাগুক্ত)।
আমার মতে, দু'টি কারণে আহমদ শরীফের শেষের মন্তব্যটি পূনঃবিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, জিয়া প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী দলের নীতিমালা অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রতি আস্থা রেখে দলের সমর্থক, কর্মী, কিংবা নেতৃত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের জন্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বরং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত এই দল অমুসলিম বাংলাদেশী নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের আইনগত ভিত্তি রচনা করেছেন। যার রূপকার জিয়াউর রহমান নিজেই। দ্বিতীয়ত,'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ আবার প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। জিয়া সাংবিধানিকভাবে দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেননি। যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদারনৈতিক চেতনা দ্বারা সুরক্ষিত। জিয়াউর রহমান সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযুক্ত করার মাধ্যমে মূলতঃ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন অমুসলিম নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় সমুন্নত রেখেছেন, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার প্রতি আন্তরিক সমর্থনের নিদর্শন হিসেবে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করেছেন।
তাঁর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও নির্মোহ অকপট ভাবনার অতুলনীয় পন্ডিত আহমদ ছফা'র একটি উক্তিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছফা বলেন 'ইসলামের সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের সংগে যোগহীন রাজনীতির কোনো ভবিষ্যত এ দেশে নেই (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)'। নিরোধ বরণ চৌধুরী ১৯৬৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় পাঁচ পর্বে মুদ্রিত 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' নামক প্রবন্ধে এ ধরনের একটি সমন্বয় ধর্মী অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রদর্শনের উন্মেষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সংগত কারণে বলা যায়, এই জাতির জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে আওয়ামী লীগের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার তুলনায় জিয়া'র রাষ্ট্রদর্শন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রায়োগিক। এ প্রসংগে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-
আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ওই ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতার সংগে কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ-উত্তর সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার সংগে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। এর ফলে জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক প্রবণতার জন্ম হয়। বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিলো নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে 'জয় বাংলা' স্লোগান তার কার্যকারিতা সম্পন্ন করেছিলো। আওয়ামী লীগ এরপর পুরনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মনে করতে শুরু করে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশদ্রোহ। একাত্তরের পর আওয়ামী লীগও বিরোধীদের সমালোচনার মধ্যে সবসময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে থাকে। সরকার-বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহ একাকার করে ফেলে। এখান থেকেই শুরু রাজনৈতিক সংকটের। এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্য কারণ হলো- জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। এই ভাবমূর্তি তৈরির পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যতীক্রমহীনভাবে সদগুণাবলীর চর্চা। এ বিষয়ে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটি শেষ করতে চাই। কাফি খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর প্রেস সচিব। যিনি এক সময় 'ভয়েস অব আমেরিকার' সংবাদ পাঠক ছিলেন। খুব কাছ থেকে তিনি জিয়াউর রহমানকে দেখেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী,
'আত্মীয় স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তাঁর বাসায় আসার সাহস পায়নি। তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সফরসংগী হিসেবে। তা-ও সব সফরে নয়।... তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন (সৈয়দ আবদাল আহমেদ-এর নেওয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, www.bnpbangladesh.org)।
একই ধরনের মূল্যায়ন করেছেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তনি বলেন 'রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর মতো স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমুক্ত এতো কঠোর রাষ্ট্রনায়ক আমি আগে কখনও দেখিনি (ভাসানীমঞ্চ, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন)'।
এই দলের গ্রহণযোগ্যতার পেছনে তৃতীয় কারণ হলো- কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। বিষয়টি যথাযথভাবে ব্যাখ্যার জন্য বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। যা একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার দাবি রাখে (এ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার কাজ এগিয়ে চলেছে)।
যে কথা বলে শেষ করতে চাই, তাহলো- জিয়া'র জাতীয়তাবাদী দর্শনের মর্মকথা হলো, কেবল ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের মতাদর্শের সঠিক উপলব্ধি ও এর বাস্তবায়ন। এই লক্ষ্য অর্জনে জিয়া'র উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূমিকা রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রয়োজন জিয়া'র গুণাবলীতে অনুপ্রাণিত ও আলোকিত নেতা-কর্মী ও সমর্থক। গ্রিক দার্শনিক ও মানবজাতির একজন শিক্ষক হিসেবে খ্যাত মনীষী অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, নৈতিকভাবে আলোকিত সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য প্রয়োজন সদগুণচর্চা, যা নৈতিকভাবে অনুকরণযোগ্য নেতৃস্থানীয় পূর্বসূরীদের অনুসরণ করে করতে হয়। যেমন- সততা, মহত্ব, সাহস, বন্ধুত্ব ইত্যাদি সদগুণচর্চার ক্ষেত্রে সেসব আলোকিত পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতে হবে, যারা শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ চর্চায় অটল ছিলেন। ইতিহাস ও সাহিত্য এই উদাহরণ সৃষ্টিকারী আলোকিত মানুষদের কর্মকাণ্ড ধারণ করে; সংগতকারণেই সদগুণচর্চার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাস ও সাহিত্য নির্ভরশীলতা রয়েছে। ইতিহাস ও সাহিত্য মানবজাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতির আধার (Store House of Cultural Memory)। তাই এই জাতির ইতিহাস মনষ্ক হওয়া অতি জরুরি। তাহলেই কেবল অনুকরণযোগ্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী রাজনৈতিক অভিভাবকের সঠিক সন্ধান পাওয়া যাবে। পেলেই চলবে না, প্রয়োজন সবাই সেই অনুযায়ী জীবন আচরণে অভ্যস্ত হওয়া। দল-মত নির্বিশেষে সকলের জন্যই আত্মজিজ্ঞাসার এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে চাইলে সবাইকে এই আত্মজিজ্ঞাসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে এবং এক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শন উপলব্ধি, চর্চা ও বাস্তবায়নের সংগে যেসব নেতা-কর্মী ও সমর্থক জড়িত, তাদের জন্য আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান স্বয়ং এক্ষেত্রে অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
- লেখক শিক্ষক দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়