- ভারতের চেয়ে ১২ গুণ বেশি দামে ইভিএম
- বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম পড়ছে আড়াই লাখ টাকা
- ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা
- ইসির মোট ব্যয় হবে ৮ হাজার,আরো বাড়তে পারে
- ইভিএম তৈরির জন্য কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি
- কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিত
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য আরও ২ লাখ নতুন ইভিএম ক্রয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রকল্পের আওতায় কেনা হবে নতুন ২ লাখ ইভিএম। প্রতিটি ইভিএম মেশিনের দাম হবে প্রায় আড়াই লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া ইভিএম সংরক্ষণে প্রকল্পের অধীনে ১০ অঞ্চলে ৬০-৬৫ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যারহাউস নির্মাণ; ১০০০ থেকে ১২০০ জন জনবল নিয়োগ; গাড়ি ক্রয়, ইভিএম পরিচালনায় ২ থেকে আড়াই লাখ দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ ও দেশব্যাপী ইভিএমের ব্যাপক প্রচারণার জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এ প্রকল্পে। ৮ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পের খসড়া নির্বাচন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন অনুমোদন করলে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সময়ে প্রতিটি ইভিএম কেনা হয়েছিল ২ হাজার ৩৮৭ ডলারে। তখন ডলারের মূল্য ৮৪ টাকা হিসেবে একটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ)।
এ ছাড়া একটি ইভিএম ইউনিটের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছিল আরও ২৫ হাজার টাকার। সব মিলে তখন একটি ইভিএমের মূল্য ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি। এবারও প্রতিটি ইউনিটের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হচ্ছে ২ হাজার ৩৮৭ ডলার। এক্ষেত্রে ডলারের মূল্য ৯৫-৯৬ টাকা হিসাবে প্রতি ইউনিটের মূল্য হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৫ টাকা অথবা ২ লাখ ২৯ হাজার ১৫২ টাকা। আর প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন হবে আরও প্রায় ২৫ হাজার টাকার। এর বাইরে প্রতি ইউনিটের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাট-ট্যাক্স। সব মিলে একটি ইভিএম মেশিন তথা প্রতিটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য আড়াই লাখ টাকার বেশি হতে পারে।
ইভিএমের নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ইভিএম ক্রয়ে খরচ হবে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ-ভবন নির্মাণ, জনবল নিয়োগ, গাড়ি ক্রয় ও দেশব্যাপী ইভিএমের ক্যাম্পেইন, ইভিএম পরিচালনায় দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ হবে আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সব মিলে এ প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় কমতে ও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন, ইসি সচিবালয় থেকে একটি ডিপিপি প্রস্তুত করতে বলেছে। আমরা প্রস্তুত করছি। ইভিএমের ইউনিট মূল্য আগেরটাই থাকছে। তবে তার সঙ্গে ডলারের মূল্য বেড়েছে সেটা এবং ভ্যাট-ট্যাক্স অ্যাড হবে। সব মিলে অল্প কিছু মূল্য বাড়বে।
প্রকল্পে কী কী থাকছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ইসি সচিবালয় যাতে নিজস্ব জনবল ও ক্যাপাসিটিতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ, ইভিএম সংরক্ষণ করতে পারে সে বিষয়গুলো থাকছে। এ জন্য জনবল প্রয়োজন, ওয়্যারহাউস প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, আগের দেড় লাখ এবং নতুন প্রকল্পে কেনা হবে ২ লাখ, সব মিলে সাড়ে ৩ লাখ ইভিএম হবে ইসির হাতে, তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য ১০ অঞ্চলে ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের প্রাথমিক চিন্তা রয়েছে। একটি ওয়্যারহাউসে ৪০-৪৫ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করা যাবে, সেরকম নকশা করা হচ্ছে। এ জন্য গাড়িও প্রয়োজন হবে। তবে কত গাড়ি প্রয়োজন হবে তা পরে নির্ধারণ হবে।
সম্ভাব্য ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার তার চেয়ে কিছু টাকা বাড়বে। ইউনিট মূল্য নির্ধারণে বাজার কমিটি কাজ করছে। বিগত প্রকল্পে ইউনিট (প্রতিটি ইভিএম) মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। এটাকে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও ২ লাখ ইভিএম কিনতে হবে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদে মোট সাধারণ আসন রয়েছে ৩০০টি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়েছিল।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে, যা দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলেও আরও ২ লাখ ইভিএম ক্রয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আগামী বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে আগামী বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তফসিল ঘোষণা হতে পারে।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে দেশে ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। এ প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ করতে প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একটি ইভিএম প্রয়োজন হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বিবেচনায় রেখে প্রতি কেন্দ্রের জন্য মোট কক্ষের অর্ধেকসংখ্যক ইভিএম অতিরিক্ত সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দেশে ভোটার বাড়ছে এবং পাঁচ বছরে প্রায় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোটার বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যাও বাড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে।
ইসির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের জন্য সাড়ে ৩ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রথম সংসদ অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ প্রথম অধিবেশন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। সে হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদের মেয়াদ রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের নব্বই দিনের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
কেনা সম্ভব না হলে ইভিএমে ভোট ৭০-৮০ আসনে : নতুন প্রকল্পের অধীনে যথাসময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা সম্ভব্য না হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেছেন, সচিবালয় যথাসময়ে ইভিএম দিতে পারলে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। না হলে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে। গতকাল নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের আজকের(৫ সেপ্টেম্বর ২০২২) পত্রিকায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
.....এর আগে ২০১৮ সালে ৮ নভেম্বর প্রথম আলো প্রথম দফায় ইভিএম কেনার সময় এর অযৌক্তিক মুল্য নির্ধারণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল "ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম"।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।অথচ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা।
ইভিএম তৈরির জন্য কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি। সেই কমিটিরই সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়,ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনছে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি ইভিএম কিনতে খরচ করবে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য যে ইভিএম তৈরি করেছিল, তার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০-২২ হাজার টাকা। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকলেও দামের বিশাল পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ভারতের নির্বাচন কমিশন ওই দেশের লোকসভা, রাজ্যসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য নতুন মডেলের ইভিএমের দাম নির্ধারণ করেছে ১৭ হাজার রুপি। প্রতি রুপি ১ টাকা ২৫ পয়সা হিসেবে ধরে বাংলাদেশি টাকায় ভারতের ইভিএমের দাম পড়ে ২১ হাজার ২৫০ টাকা। সেই হিসাবে ১১ গুণ বেশি খরচ করে ইভিএম কিনছে বাংলাদেশ। তবে ইসি দাবি করছে, গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের ইভিএমের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম পড়ছে।
এদিকে এই ইভিএম তৈরির ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটির সুপারিশও পুরোপুরি আমলে নেয়নি ইসি। ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য কমিটি ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) সুবিধা রাখার পরামর্শ দিলেও তা রাখা হয়নি। এতে ভোট পুনর্গণনার বিষয় এলে ইসিকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।
২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ইসি। সংসদে আরপিও সংশোধনী পাস হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় ইসি।
নতুন ইভিএম কেনার জন্য ইসির ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ওই প্রকল্পে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট প্রকল্পে ব্যয়ের ৯২ শতাংশ। আগামী ছয় বছরে তিন পর্যায়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকল্পের দলিল বলছে ভিন্ন কথা। শুধু চলতি অর্থবছরেই ১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি টাকা চলতি অর্থবছরে খরচ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্প দলিলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইভিএমের দাম ২ থেকে ৩ হাজার ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের ইভিএম
ইভিএম নির্মাণ করে এমন কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সাধারণত ভোটার ও প্রার্থীসংখ্যা, ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভোট গণনা, সার্ভার-সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের স্পেসিফিকেশনের ওপর ইভিএমের দাম নির্ভর করে।
ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রপ্রতি ভোটারের সংখ্যা প্রায় একই রকম। ভোটারদের শিক্ষার হার ও সচেতনতা প্রায় একই পর্যায়ের। দামের এত পার্থক্য থাকলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ইভিএমের পার্থক্য খুব বেশি নয়। বাংলাদেশের ইভিএমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বা হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। ভারতের ইভিএমে এই সুবিধা নেই। তবে ভারতের ইভিএমে ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে সেই সুবিধা নেই।
বাংলাদেশের ইভিএমে তিনটি অংশ আছে। এগুলো হলো কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যালট ইউনিট ও ডিসপ্লে ইউনিট। ভোটারের নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে আঙুলের ছাপ দেওয়া সঙ্গে সঙ্গে ডিসপ্লেতে ওই ভোটার ছবিসহ যাবতীয় তথ্য চলে আসবে। ব্যাটারির মাধ্যমে ইভিএম চলবে। চার্জ থাকবে ৪৮ ঘণ্টা। ইভিএমের সঙ্গে বাইরের কোনো ইন্টারনেট বা এ ধরনের কোনো সংযোগ থাকবে না। ফলে এটি হ্যাক করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্প দলিলে বলা হয়েছে, ইভিএমের ওয়ারেন্টি ১০ বছর নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, আগামী নভেম্বর মাস থেকে ১৬ লাখ ইভিএম কেনা শুরু করবে ভারতের নির্বাচন কমিশন। নতুন মডেলের ওই ইভিএমে কন্ট্রোল ইউনিট ও ব্যালট ইউনিট—এই দুটি ইউনিট আছে। সর্বোচ্চ ৩৮৪ জন প্রার্থী থাকলেও এই ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে। একটি ইভিএমে সর্বোচ্চ দুই হাজার ভোট নেওয়া যাবে। এই ইভিএম ব্যাটারিতে চলবে। ভারতের ইভিএমে ভোট দেওয়ার কক্ষেই একটি স্বচ্ছ বাক্স থাকে। ভোটার ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইভিএম থেকে একটি কাগজে ছাপা হয়ে স্বচ্ছ বাক্সে পড়বে। মূলত ভোটাধিকারের দলিল বা ব্যালট হিসেবে এটি কাজ করবে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ হিসেবে এটি রাখা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যেসব ইভিএম ব্যবহার করেছিল, সেগুলোর দাম ছিল ৮ হাজার ৬৭০ রুপি করে।
ইভিএম প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম নির্ভর করে যন্ত্রাংশের মান ও ‘কনফিগারেশনের’ ওপর। তাঁরা সবচেয়ে মানসম্পন্ন ইভিএম তৈরি করছেন, যাতে ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যায়। ইভিএমের দাম বেশি পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএমের দাম প্রায় চার হাজার ডলার। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাঁরা তুলনা করে দেখেছেন, বাংলাদেশের ইভিএমের দাম তুলনামূলক কম পড়ছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে নতুন ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। ইতিমধ্যে চীন ও হংকং থেকে ইভিএমের মূল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আনার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিএমটিএফ। সাধারণ ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তবে আমদানির প্রক্রিয়া ভিন্ন বলে ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ইভিএম আমদানির জন্য এ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিতে হয়েছে।
এর আগে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বাংলাদেশে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে। ওই ইভিএম তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েটের তৈরি ইভিএমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি ইভিএমে হয়েছিল। ওই ইভিএমে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করার ব্যবস্থা ছিল না। ভিভিপিএটি সুবিধাও ছিল না।
ওই ইভিএম তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের জন্য বুয়েট ১ হাজার ১০০টি ইভিএম তৈরি করেছিল। প্রতিটি ইভিএমের খরচ পড়েছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। বৃহৎ আকারে উৎপাদনে গেলে খরচ আরও কমে যেত। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভিভিপিএটি সুবিধা যুক্ত করে ৪০-৫০ হাজার টাকার মধ্যে ইভিএম তৈরি করা সম্ভব। তিনি বলেন, বৈশিষ্ট্যের কারণে ইভিএমের দামের তুলনা করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ধরা হলে তা একটু অস্বাভাবিকই।
কমিটির সুপারিশ মানা হয়নি
ইভিএম কেনার প্রকল্প প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, ইভিএম তৈরির জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নমুনা ইভিএম তৈরি করেছে। তবে ইসির এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নতুন ইভিএম পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ইসি। ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর তাদের প্রথম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে নতুন ইভিএমের নমুনা দেখানো হয়। বৈঠকে জানানো হয়, নতুন ইভিএম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন অধ্যাপকের পরামর্শে পোল্যান্ডের একদল কারিগরি সদস্যের সহায়তায় তৈরি করা হয়। ওই বৈঠকে নতুন যন্ত্রে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি কমিটির আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আবারও পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে বলা হয়, ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইভিএমের সঙ্গে পেপার অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে ভোট দেওয়াসংক্রান্ত তথ্যের হার্ড কপি ভোট প্রদান শেষে সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু নতুন যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোতে এই সুবিধা নেই।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটি পেপার ট্রেইলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু উপকমিটি দেখেছে, পেপার ট্রেইল যুক্ত করে অনেকে ঝামেলায় পড়েছে। ভারতে ১৫-১৮ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করতে হয়েছে পেপার ট্রেইলে সমস্যার কারণে। পেপার ট্রেইল মূলত ভোটারের মানসিক শান্তির জন্য যুক্ত করা হয়। এই ইভিএমে ভোটার যে মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য ঠিক করবেন, সে মার্কা স্ক্রিনজুড়ে বড় হয়ে ভেসে উঠবে। এটি ইলেকট্রনিক্যালি করা হয়েছে পেপারে না যাওয়ার জন্য।
জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে—এই বক্তব্য আংশিক সত্য। তিনি কমিটির দুটি বৈঠকে অংশ নেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, মেশিন ঠিক আছে। কিন্তু মেশিনের সঙ্গে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে হবে। ভিভিপিএটি ছাড়া মেশিন গ্রহণযোগ্য হবে না।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কারিগরি কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করে ইসি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। একটি সাব-কমিটি বৈঠক করে কারগরি কমিটির ওই সুপারিশ বাদ দিয়েছে। সুতরাং এখানে আমার নাম ব্যবহার করা ইসির ঠিক হচ্ছে না।