Search

Monday, September 5, 2022

৮ হাজার কোটি টাকার ইভিএম কার স্বার্থে?

  • ভারতের চেয়ে ১২ গুণ বেশি দামে ইভিএম
  • বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম পড়ছে আড়াই লাখ টাকা
  • ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা
  • ইসির মোট ব্যয় হবে ৮ হাজার,আরো বাড়তে পারে 
  • ইভিএম তৈরির জন্য  কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি
  • কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিত



আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য আরও ২ লাখ নতুন ইভিএম ক্রয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রকল্পের আওতায় কেনা হবে নতুন ২ লাখ ইভিএম। প্রতিটি ইভিএম মেশিনের দাম হবে প্রায় আড়াই লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া ইভিএম সংরক্ষণে প্রকল্পের অধীনে ১০ অঞ্চলে ৬০-৬৫ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যারহাউস নির্মাণ; ১০০০ থেকে ১২০০ জন জনবল নিয়োগ; গাড়ি ক্রয়, ইভিএম পরিচালনায় ২ থেকে আড়াই লাখ দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ ও দেশব্যাপী ইভিএমের ব্যাপক প্রচারণার জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এ প্রকল্পে। ৮ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পের খসড়া নির্বাচন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন অনুমোদন করলে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

  

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সময়ে প্রতিটি ইভিএম কেনা হয়েছিল ২ হাজার ৩৮৭ ডলারে। তখন ডলারের মূল্য ৮৪ টাকা হিসেবে একটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ)। 


এ ছাড়া একটি ইভিএম ইউনিটের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছিল আরও ২৫ হাজার টাকার। সব মিলে তখন একটি ইভিএমের মূল্য ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি। এবারও প্রতিটি ইউনিটের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হচ্ছে ২ হাজার ৩৮৭ ডলার। এক্ষেত্রে ডলারের মূল্য ৯৫-৯৬ টাকা হিসাবে প্রতি ইউনিটের মূল্য হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৫ টাকা অথবা ২ লাখ ২৯ হাজার ১৫২ টাকা। আর প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন হবে আরও প্রায় ২৫ হাজার টাকার। এর বাইরে প্রতি ইউনিটের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাট-ট্যাক্স। সব মিলে একটি ইভিএম মেশিন তথা প্রতিটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য আড়াই লাখ টাকার বেশি হতে পারে। 


ইভিএমের নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ইভিএম ক্রয়ে খরচ হবে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ-ভবন নির্মাণ, জনবল নিয়োগ, গাড়ি ক্রয় ও দেশব্যাপী ইভিএমের ক্যাম্পেইন, ইভিএম পরিচালনায় দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ হবে আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সব মিলে এ প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় কমতে ও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 


ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন, ইসি সচিবালয় থেকে একটি ডিপিপি প্রস্তুত করতে বলেছে। আমরা প্রস্তুত করছি। ইভিএমের ইউনিট মূল্য আগেরটাই থাকছে। তবে তার সঙ্গে ডলারের মূল্য বেড়েছে সেটা এবং ভ্যাট-ট্যাক্স অ্যাড হবে। সব মিলে অল্প কিছু মূল্য বাড়বে।  


প্রকল্পে কী কী থাকছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ইসি সচিবালয় যাতে নিজস্ব জনবল ও ক্যাপাসিটিতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ, ইভিএম সংরক্ষণ করতে পারে সে বিষয়গুলো থাকছে। এ জন্য জনবল প্রয়োজন, ওয়্যারহাউস প্রয়োজন হবে। 


তিনি বলেন, আগের দেড় লাখ এবং নতুন প্রকল্পে কেনা হবে ২ লাখ, সব মিলে সাড়ে ৩ লাখ ইভিএম হবে ইসির হাতে, তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য ১০ অঞ্চলে ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের প্রাথমিক চিন্তা রয়েছে। একটি ওয়্যারহাউসে ৪০-৪৫ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করা যাবে, সেরকম নকশা করা হচ্ছে। এ জন্য গাড়িও প্রয়োজন হবে। তবে কত গাড়ি প্রয়োজন হবে তা পরে নির্ধারণ হবে। 


সম্ভাব্য ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার তার চেয়ে কিছু টাকা বাড়বে। ইউনিট মূল্য নির্ধারণে বাজার কমিটি কাজ করছে। বিগত প্রকল্পে ইউনিট (প্রতিটি ইভিএম) মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। এটাকে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও ২ লাখ ইভিএম কিনতে হবে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদে মোট সাধারণ আসন রয়েছে ৩০০টি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়েছিল। 


বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে, যা দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলেও আরও ২ লাখ ইভিএম ক্রয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আগামী বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে আগামী বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তফসিল ঘোষণা হতে পারে। 


ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে দেশে ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। এ প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ করতে প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একটি ইভিএম প্রয়োজন হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বিবেচনায় রেখে প্রতি কেন্দ্রের জন্য মোট কক্ষের অর্ধেকসংখ্যক ইভিএম অতিরিক্ত সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দেশে ভোটার বাড়ছে এবং পাঁচ বছরে প্রায় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোটার বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যাও বাড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে। 


ইসির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের জন্য সাড়ে ৩ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রথম সংসদ অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ প্রথম অধিবেশন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। সে হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদের মেয়াদ রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের নব্বই দিনের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।


কেনা সম্ভব না হলে ইভিএমে ভোট ৭০-৮০ আসনে : নতুন প্রকল্পের অধীনে যথাসময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা সম্ভব্য না হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেছেন, সচিবালয় যথাসময়ে ইভিএম দিতে পারলে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। না হলে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে। গতকাল নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।


বাংলাদেশ প্রতিদিনের  আজকের(৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)  পত্রিকায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।  


.....এর আগে ২০১৮ সালে ৮ নভেম্বর প্রথম আলো প্রথম দফায় ইভিএম কেনার সময় এর অযৌক্তিক মুল্য নির্ধারণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল "ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম"।


ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।অথচ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা।


ইভিএম তৈরির জন্য কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি। সেই কমিটিরই সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নেওয়া হয়নি।


প্রতিবেদনে বলা হয়,ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনছে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি ইভিএম কিনতে খরচ করবে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য যে ইভিএম তৈরি করেছিল, তার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০-২২ হাজার টাকা। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকলেও দামের বিশাল পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।


ভারতের নির্বাচন কমিশন ওই দেশের লোকসভা, রাজ্যসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য নতুন মডেলের ইভিএমের দাম নির্ধারণ করেছে ১৭ হাজার রুপি। প্রতি রুপি ১ টাকা ২৫ পয়সা হিসেবে ধরে বাংলাদেশি টাকায় ভারতের ইভিএমের দাম পড়ে ২১ হাজার ২৫০ টাকা। সেই হিসাবে ১১ গুণ বেশি খরচ করে ইভিএম কিনছে বাংলাদেশ। তবে ইসি দাবি করছে, গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের ইভিএমের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম পড়ছে।


এদিকে এই ইভিএম তৈরির ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটির সুপারিশও পুরোপুরি আমলে নেয়নি ইসি। ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য কমিটি ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) সুবিধা রাখার পরামর্শ দিলেও তা রাখা হয়নি। এতে ভোট পুনর্গণনার বিষয় এলে ইসিকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।


২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ইসি। সংসদে আরপিও সংশোধনী পাস হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় ইসি।


নতুন ইভিএম কেনার জন্য ইসির ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ওই প্রকল্পে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট প্রকল্পে ব্যয়ের ৯২ শতাংশ। আগামী ছয় বছরে তিন পর্যায়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকল্পের দলিল বলছে ভিন্ন কথা। শুধু চলতি অর্থবছরেই ১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি টাকা চলতি অর্থবছরে খরচ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্প দলিলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইভিএমের দাম ২ থেকে ৩ হাজার ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


ভারত ও বাংলাদেশের ইভিএম

ইভিএম নির্মাণ করে এমন কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সাধারণত ভোটার ও প্রার্থীসংখ্যা, ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভোট গণনা, সার্ভার-সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের স্পেসিফিকেশনের ওপর ইভিএমের দাম নির্ভর করে।


ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রপ্রতি ভোটারের সংখ্যা প্রায় একই রকম। ভোটারদের শিক্ষার হার ও সচেতনতা প্রায় একই পর্যায়ের। দামের এত পার্থক্য থাকলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ইভিএমের পার্থক্য খুব বেশি নয়। বাংলাদেশের ইভিএমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বা হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। ভারতের ইভিএমে এই সুবিধা নেই। তবে ভারতের ইভিএমে ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে সেই সুবিধা নেই।


বাংলাদেশের ইভিএমে তিনটি অংশ আছে। এগুলো হলো কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যালট ইউনিট ও ডিসপ্লে ইউনিট। ভোটারের নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে আঙুলের ছাপ দেওয়া সঙ্গে সঙ্গে ডিসপ্লেতে ওই ভোটার ছবিসহ যাবতীয় তথ্য চলে আসবে। ব্যাটারির মাধ্যমে ইভিএম চলবে। চার্জ থাকবে ৪৮ ঘণ্টা। ইভিএমের সঙ্গে বাইরের কোনো ইন্টারনেট বা এ ধরনের কোনো সংযোগ থাকবে না। ফলে এটি হ্যাক করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্প দলিলে বলা হয়েছে, ইভিএমের ওয়ারেন্টি ১০ বছর নিশ্চিত করতে হবে।


ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, আগামী নভেম্বর মাস থেকে ১৬ লাখ ইভিএম কেনা শুরু করবে ভারতের নির্বাচন কমিশন। নতুন মডেলের ওই ইভিএমে কন্ট্রোল ইউনিট ও ব্যালট ইউনিট—এই দুটি ইউনিট আছে। সর্বোচ্চ ৩৮৪ জন প্রার্থী থাকলেও এই ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে। একটি ইভিএমে সর্বোচ্চ দুই হাজার ভোট নেওয়া যাবে। এই ইভিএম ব্যাটারিতে চলবে। ভারতের ইভিএমে ভোট দেওয়ার কক্ষেই একটি স্বচ্ছ বাক্স থাকে। ভোটার ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইভিএম থেকে একটি কাগজে ছাপা হয়ে স্বচ্ছ বাক্সে পড়বে। মূলত ভোটাধিকারের দলিল বা ব্যালট হিসেবে এটি কাজ করবে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ হিসেবে এটি রাখা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যেসব ইভিএম ব্যবহার করেছিল, সেগুলোর দাম ছিল ৮ হাজার ৬৭০ রুপি করে।


ইভিএম প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম নির্ভর করে যন্ত্রাংশের মান ও ‘কনফিগারেশনের’ ওপর। তাঁরা সবচেয়ে মানসম্পন্ন ইভিএম তৈরি করছেন, যাতে ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যায়। ইভিএমের দাম বেশি পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএমের দাম প্রায় চার হাজার ডলার। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাঁরা তুলনা করে দেখেছেন, বাংলাদেশের ইভিএমের দাম তুলনামূলক কম পড়ছে।


বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে নতুন ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। ইতিমধ্যে চীন ও হংকং থেকে ইভিএমের মূল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আনার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিএমটিএফ। সাধারণ ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তবে আমদানির প্রক্রিয়া ভিন্ন বলে ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ইভিএম আমদানির জন্য এ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিতে হয়েছে।


এর আগে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বাংলাদেশে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে। ওই ইভিএম তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েটের তৈরি ইভিএমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি ইভিএমে হয়েছিল। ওই ইভিএমে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করার ব্যবস্থা ছিল না। ভিভিপিএটি সুবিধাও ছিল না।


ওই ইভিএম তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের জন্য বুয়েট ১ হাজার ১০০টি ইভিএম তৈরি করেছিল। প্রতিটি ইভিএমের খরচ পড়েছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। বৃহৎ আকারে উৎপাদনে গেলে খরচ আরও কমে যেত। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভিভিপিএটি সুবিধা যুক্ত করে ৪০-৫০ হাজার টাকার মধ্যে ইভিএম তৈরি করা সম্ভব। তিনি বলেন, বৈশিষ্ট্যের কারণে ইভিএমের দামের তুলনা করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ধরা হলে তা একটু অস্বাভাবিকই।


কমিটির সুপারিশ মানা হয়নি

ইভিএম কেনার প্রকল্প প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, ইভিএম তৈরির জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নমুনা ইভিএম তৈরি করেছে। তবে ইসির এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়।


নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নতুন ইভিএম পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ইসি। ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর তাদের প্রথম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে নতুন ইভিএমের নমুনা দেখানো হয়। বৈঠকে জানানো হয়, নতুন ইভিএম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন অধ্যাপকের পরামর্শে পোল্যান্ডের একদল কারিগরি সদস্যের সহায়তায় তৈরি করা হয়। ওই বৈঠকে নতুন যন্ত্রে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি কমিটির আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আবারও পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে বলা হয়, ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইভিএমের সঙ্গে পেপার অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে ভোট দেওয়াসংক্রান্ত তথ্যের হার্ড কপি ভোট প্রদান শেষে সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু নতুন যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোতে এই সুবিধা নেই।


এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটি পেপার ট্রেইলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু উপকমিটি দেখেছে, পেপার ট্রেইল যুক্ত করে অনেকে ঝামেলায় পড়েছে। ভারতে ১৫-১৮ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করতে হয়েছে পেপার ট্রেইলে সমস্যার কারণে। পেপার ট্রেইল মূলত ভোটারের মানসিক শান্তির জন্য যুক্ত করা হয়। এই ইভিএমে ভোটার যে মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য ঠিক করবেন, সে মার্কা স্ক্রিনজুড়ে বড় হয়ে ভেসে উঠবে। এটি ইলেকট্রনিক্যালি করা হয়েছে পেপারে না যাওয়ার জন্য।


জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে—এই বক্তব্য আংশিক সত্য। তিনি কমিটির দুটি বৈঠকে অংশ নেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, মেশিন ঠিক আছে। কিন্তু মেশিনের সঙ্গে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে হবে। ভিভিপিএটি ছাড়া মেশিন গ্রহণযোগ্য হবে না।


জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কারিগরি কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করে ইসি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। একটি সাব-কমিটি বৈঠক করে কারগরি কমিটির ওই সুপারিশ বাদ দিয়েছে। সুতরাং এখানে আমার নাম ব্যবহার করা ইসির ঠিক হচ্ছে না।

Saturday, September 3, 2022

বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি — ৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ


কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটি ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া নামে পরিচিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।


এই অর্থ দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে।

এই বোঝা হালকা করতে সরকারকে যেমন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তেমনি বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত টাকাটা গ্রাহকদের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।


বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি কেন্দ্রকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।


এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতেও থাকছে ক্যাপাসিটি চার্জ।    


বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের করা ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন বা কেনা না হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট হারে অর্থ (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করতে হবে। এই ৯০ হাজার কোটি টাকা সেই অর্থ, যা কম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই পেয়েছে।


জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ধারণা ছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোবে, তাতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেভাবে বিদ্যুিভত্তিক উৎপাদন বা শিল্প-কারখানা হয়নি। তাই এখন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তা না হলে, অতিরিক্ত দামের বিদ্যুতের কারণে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।   


জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তেলভিত্তিক কিছু কেন্দ্র আছে, যেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না, অথবা সারা বছরে অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সেগুলোকে শতকোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এমন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।


ম. তামিম বলেন, মূলত বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রিজার্ভ রাখতে হয়। এই কেন্দ্রগুলো যখন বসে থাকবে, তখন শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে। তবে রিজার্ভে রাখার বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করে রাখতে হবে, যাতে কোনোভাবেই অতিরিক্ত না হয়।


গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া। যদি কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে না রাখা হয়, তাহলে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উঠে গেলে সেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কে দেবে? পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য বাকি সময় অলস বসে থাকার জন্য যে চার্জ দেওয়া হয় তা-ই ক্যাপাসিটি চার্জ।


এলএনজিভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রও ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে

বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে টাকা ব্যয়ের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের এক হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) আরো তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটি নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে।


চলতি বছরের অক্টোবরে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা। বাকিটির উৎপাদনের সময় আগামী বছরের মার্চ নাগাদ শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে।


খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ব্যাপক বেড়েছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে পিডিবিকে।


এই বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলএনজি কোথা থেকে আসবে, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এলএনজির অভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘এটা একটা মারাত্মক ভয়ের ব্যাপার। সামনে এই কেন্দ্রগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এলএনজি না দিতে পারলে একসময় এমন হতে পারে, দেশের বিভিন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে এগুলোকে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ করতে হতে পারে। গ্যাসসংকটে এখনই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ’


পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনও কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলএনজিভিত্তিক এই তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে গ্যাসসংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমন সংকট যে চলে আসবে, তা তো আগে জানার উপায় ছিল না। তবে এই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে আসতে দেশীয় কূপগুলো থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়তে পারে। ’


পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র : দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ৪,৫০০ কোটি টাকা

এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় এখন কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। কেন্দ্রটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলেও গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।


পিডিবি সূত্রে জানা যায়, পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ চলতি বছরের ডিসেম্বরেও শেষ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই কেন্দ্র থেকে পুরো বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াই আরো ছয় মাসের বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে।


জানতে চাইলে ম. তামিম বলেন, সঞ্চালন লাইনের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ আনা যাচ্ছে না। কয়েক মাস পর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও উৎপাদনে আসবে। রামপালের বিদ্যুৎও একই সঞ্চালন লাইন দিয়ে আসবে। তাই এই সঞ্চালন লাইন যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে করা না যায় তাহলে পায়রার মতো রামপালকেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।


রেন্টাল, কুইক রেন্টালের ‘স্বল্প মেয়াদ’ দীর্ঘ হচ্ছে

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় অতি দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের তাত্ক্ষণিক পরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুরু করে। এরপর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। সেই আপৎকালীন ‘স্বল্প মেয়াদ’ আজও শেষ হয়নি। অর্থনীতির ওপর বোঝা তৈরি করার পরও বারবার বাড়ানো হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ।


বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। বাকি আটটিকে আগের নিয়মে ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে।


জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের। এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো তা আমি বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরো কয়েকটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে বলে মনে হয়। ’


তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দাবি করেন, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল এখন আর নেই। এখন যেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে না।


বিদ্যুৎ আমদানিতেও ক্যাপাসিটি চার্জ

ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।


বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপের নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী মাসের শেষ দিকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ইউনিটের ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও সাবস্টেশন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে ৪০০ মেগাওয়াট দেশে আনা হতে পারে। চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে আদানি গ্রুপকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা দিতে হবে।


জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে।


শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের চাহিদাই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের জন্য করা হয়নি। ব্যবসা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে সরকারের টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।


  • সূত্র - কালের কণ্ঠ / সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ 

Tuesday, August 30, 2022

তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান

দ্যা ডেইলি স্টার/ আগস্ট ৩০, ২০২২



'আমাদের প্রিয় মানুষটি কেমন আছেন? তিনি কি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন? তাকে কি নির্যাতন করা হয়? তিনি কি... বেঁচে আছেন?'

এসব প্রশ্ন 'গুম'র শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের তাড়া করে। কারণ, তারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আশা নিয়ে সপ্তাহ, মাস ও বছর কাটান।

বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫২২ জন 'গুম' হয়েছেন বলে জানিয়েছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।

'গুম' থেকে মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি ফেরার পর জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে থাকেন। তারা কোথায় ছিলেন বা কে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রকাশ করেন না।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) গত মার্চের সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া 'গুমের' ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, 'গুম' হওয়া ৩০ শতাংশ ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের কেউই এ বিষয়ে কথা বলেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে 'গুম' থেকে ফিরে আসা ৫ জন তাদের প্রিয়জনদের প্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

যদিও পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে প্রতিটি অলি-গলিতে খুঁজেছিলেন, তবুও সেই ব্যক্তিদের দাবি, তারা রাজধানীর ভেতরেই ছিলেন।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের ভাষ্য, ঢাকায় কমপক্ষে ২টি কেন্দ্র আছে যেখানে 'গুম' হওয়া ব্যক্তিদের রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এর একটি নিরাপত্তা বাহিনী ও অন্যটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিচালনা করে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলাতে আরও একটি কেন্দ্র আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের দাবি, কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি অবৈধ এক কারাগার। জনগণের টাকায় আইনশৃঙ্খলা ও দেশকে রক্ষার নামে এসব কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।

সূত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে দ্য ডেইলি স্টারে ইউনিটগুলোর নাম প্রকাশ করা হলো না।

বেঁচে থাকা ২ জনের বর্ণনা একটি অপরটির সঙ্গে মিলে যায় এবং একটি কেন্দ্রের দিকে নির্দেশ করে। ধরি কেন্দ্রটি 'উ'।

বেঁচে থাকা অপর ৩ জনের বর্ণনা দ্বিতীয় একটি কেন্দ্রের নির্দেশ করে। ধরি সেটি হচ্ছে 'ক'।

তাদেরকে ২ মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। তাদের আটকে রাখা হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে।

বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ৪ জনকে রাজনৈতিক কারণে এবং তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল। অপর একজন, যাকে 'ক' কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল, তুলে নেওয়া হয়েছিল ভুল পরিচয়ে।

তাদের সবাইকে ঢাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যা সিজিএসের গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়—যেখানে দেখা গেছে যে এক-তৃতীয়াংশ গুমের ঘটনা ঘটেছে শুধু রাজধানীতে।

বর্ণনায় 'উ' কেন্দ্রে ভুক্তভোগীরা কঠোর ও অমানবিক জীবনযাপন এবং নির্যাতনমূলক জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলেছেন। 'ক' কেন্দ্রের ভুক্তভোগীরা বন্দিদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে এমন একটি কারাগারের বর্ণনা দিয়েছেন।

উভয়ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্জন কারাবাসে, নির্বিচারে ও বেআইনিভাবে অন্তহীন সময়ের জন্য আটকে রাখার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বন্দি জানেন না যে তিনি মুক্তি পাবেন, নাকি এখানেই তার জীবন শেষ হবে।

কেন্দ্র 'উ' এ বন্দিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তাদেরকে প্রায় আড়াই ফুট প্রস্থ, ৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৫ ফুট উচ্চতার কক্ষে বন্দি রাখা হয়েছিল। 'এমনভাবে কেউ শুয়েও থাকতে পারবে না বা দাঁড়ায়েও থাকতে পারবে না। সেখানে সব সময় আধা বসা ও আধা শোয়া অবস্থায় থাকতে হবে।' কক্ষের ৩ দিকে কংক্রিটের দেয়াল এবং ১ দিকে কারাগারের দরজা ছিল।



বন্দিদের মধ্যে ১ জনকে দক্ষিণের একটি জেলায় স্থানান্তরের আগে ৪ মাস সেখানে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে একই কেন্দ্রের মধ্যে একটি বড় সেলে স্থানান্তরের আগে আরেক বন্দিকে সেখানে এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে রাখা হয়েছিল।

উভয় বন্দিই 'উ' কেন্দ্রে থাকাকালীন পুরো সময় চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিলেন বলে জানান।

একজন বন্দি বলেন, 'খুব অন্ধকার ছিল, কিন্তু তারপরও আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকেরই চোখ বাঁধা ছিল। সেলটি ২ তলা মাটির নিচে ছিল। তারা সেখানে অন্তর্বাস ছাড়া বাকি সব জামা-কাপড় খুলে ফেলে। একটি লুঙ্গি দেয়। লুঙ্গিটি অনেক পরে, বিবস্ত্র করার অনেক ঘণ্টা পরে দিয়েছিল।'

গুম: ‘নিখোঁজ’র পর ‘আটক’ ও জীবন থেকে হারানো কয়েকটি দিন

Read more

সেখানে একজন প্রহরী তাদের অবস্থা দেখে দয়া করে গোপনে রাতে তাদের হাতকড়া খুলে দিতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের বন্দিত্বের পুরো সময়কালে হাত পিছনে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা ছিল। শুধুমাত্র খাওয়া ও টয়লেটে যাওয়ার সময় খুলে দেওয়া হতো।'

'উ' কেন্দ্রে ৩ মাসের কম সময় বন্দি থাকা একজন বলেন, 'একজন চাচা ছিলেন, প্রবীণ প্রহরী; তিনি কয়েক ঘণ্টার জন্য মধ্যরাতের পর আমাদের হাত খুলে দিতেন। তখন আমরা চোখ খুলতে পারতাম। আমি বন্দি থাকাকালীন ৩ রাতে তাকে পেয়েছিলাম।'

তিনি জানান, 'উ' কেন্দ্রে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে একটি বড় সেলে স্থানান্তর করা হয়। 'আমি ধাতবের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় সেলে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি বড় ঘর ছিল, কিন্তু সেটি ছিল অত্যন্ত গরম এবং সেখানে প্রচুর মশা ছিল। সেখানে স্ট্যান্ডফ্যান ছিল, কিন্তু সেটা মাঝে মাঝে চালু করা হতো। তারা জানতো ঠিক কতক্ষণ সেটি চালালে আমরা বেঁচে থাকতে পারব।'

তিনি আরও বলেন, 'মেঝেটি ভাঙা সিমেন্টের ছিল এবং আমাদেরকে মেঝেতে বিছানা ছাড়াই ঘুমাতে হতো। আমাকে এক বোতল পানি দেওয়া হয়েছিল এবং সেটিকেই আমি বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম। রাতে মেঝে যে এত ঠাণ্ডা হতে পারে…'

৬ মাসের কম সময় কেন্দ্রে থাকা আরেক বন্দি বলেন, 'যতদিন আমি ওই কেন্দ্রে ছিলাম, আমাকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রটি সম্ভবত ৩ তলা মাটির নিচে ছিল।'

তিনি জানান, এটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কারণ যখন তাকে অন্য কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তখন তারা তাকে ৩ তলায় উঠতে বাধ্য করেছিল এবং তারপরে তিনি সরাসরি সেই তলায় থাকা একটি গাড়িতে উঠেছিলেন।

প্রথম বন্দির মতো তার সেলটিতেও শোয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না এবং তিনি কয়েক মাস ধরে বসে ছিলেন।

ভুক্তভোগী ২ জনই জানান, খাবার দেওয়ার সময় প্লেট ও দরজার আওয়াজ শুনে তারা বন্দিদের সংখ্যা গণনা করেছেন।

প্রথম বন্দি বলেন, তার মনে আছে ১২টি সেল গুনেছিলেন, যেগুলো ছিল মুখোমুখি। 'একজন দয়ালু প্রহরীর সহযোগিতার কারণে যখন প্রথমবারে মতো চোখ খুলতে পেরেছিলাম তখন আমার বিপরীত পাশের সেলটি দেখেছিলাম। যখন তারা আমাদেরকে খাবার দিতো তখন আমি সেলের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ থেকেও গুনেছি।'

দ্বিতীয় বন্দি বলেন, 'ওই দীর্ঘ হলটিতে আমরা প্রায় ১৪ জন ছিলাম। খাবারের সময় মেঝেতে ধাতব প্লেটের আওয়াজ শুনে আমি এটা গুনেছি।'

একইভাবে, তাদেরকে আটকের সময়কালে ৫ বছরের ব্যবধান থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ২ জনকেই নির্যাতন করা হয়েছিল।

একজন বলেন, 'আমাকে ৬ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমার শরীরের প্রতিটি অংশে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের নির্যাতনের পদ্ধতি সিনেমার মতো। তারা উপরে থেকে তীব্র তাপ দেওয়ার জন্য কিছু একটা ব্যবহার করেছিল। তাদের নির্যাতনে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে। আমি সেলে ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।'

অপরজন দাবি করেন, 'আমাকে গোড়ালি ও কব্জি বেঁধে একটি কাঠের চেয়ারে বসানো হয়েছিল। তারা আমার কানের লতিতে ২টি ক্লিপ সংযুক্ত করে, যেগুলো ২টি ব্যাটারির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারা একটি করে প্রশ্ন করে আর আমার কানে শক দেয়। তারা হুমকি দিতে থাকে যে আমি তাদেরকে সহযোগিতা না করলে আমার যৌনাঙ্গে ক্লিপ লাগিয়ে দেবে। তাদের নির্যাতনে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি প্রার্থনা করার চেষ্টা করলে আমাকে মারধর করা হবে বলে তারা বলতেন। তারা বলতেন যে আমার মতো পাপীর প্রার্থনা করার দরকার নেই।'

তিনি অপর একটি কেন্দ্রে নির্যাতনের আরেকটি পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন। রাজধানী থেকে তুলে নেওয়ার পর তাকে রাজধানীর বাইরে দক্ষিণ দিকে অন্য একটি কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

দ্য ডেইলি স্টার আটক ব্যক্তির নিরাপত্তার স্বার্থে জেলার নাম প্রকাশ করছে না।

তিনি বলেন, 'সেই জায়গায় পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। সেই জেলায় যাওয়ার পথে বাসের কন্ডাক্টররা যখন যাত্রীর জন্য চিৎকার করে এলাকার নাম বলছিল, সেটা শুনেছিলাম। তাই জানি যে আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জায়গাটির খুব কাছেই একটি লঞ্চ জেটি ছিল, কারণ আমি সেখানে থাকার সময় জাহাজের হুইসেল শুনতে পেয়েছি।'

তিনি বলেন, ওই কেন্দ্রে নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল জোর করে খাওয়ানো। 'তারা ৭-৮ কেজি গরুর মাংসের বালতি নিয়ে আসত। আমাকে বলত, আপনাকে এর অর্ধেক খেতে হবে। প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য ৬টি ডিম দিত।'



'আপনার কোনো ধারণাই নেই যে তারা প্রত্যেক বন্দির পিছনে কত টাকা খরচ করে', যোগ করেন তিনি।

ওই নির্দিষ্ট কেন্দ্রে দেয়ালগুলো ছিল ঢেউতোলা টিনের এবং বন্দিদের যেখানে রাখা হতো সেগুলো বড় বড় পশুর খাঁচার মতো। 'আমি সেগুলোর ভেতরে পা ছড়াতে পারতাম। সেখানে, আমার হাত সামনের দিকে আটকে রাখার পরিবর্তে, একটি হাত একটি হ্যাণ্ডকাফের সঙ্গে আটকে সেটিকে খাঁচার বাইরে একটি হুকের সঙ্গে সংযুক্ত লম্বা দড়িতে বাঁধা ছিল।'

লম্বা ঘরের ভেতরে ৪টি খাঁচা ছিল বলে জানান তিনি।

'একটা সময় আসে, যখন অন্য ৩ জনকে একদিন নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ফিরে এসে বলেন, ওই ৩ জনের একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য ২ জনকে "ক্রসফায়ারে" গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আতঙ্কে ছিলাম যে, এই ভাবেই আমাকেও হত্যা করা হবে', যোগ করেন তিনি।

'ক্রসফায়ারে'র হুমকি জিজ্ঞাসাবাদের একটি হাতিয়ার এবং নির্যাতনের পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 'আমাকে শহরের একটি বড় হাইওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হ্যাণ্ডকাফ লাগিয়ে। আমি জানি না সেটা কোন হাইওয়ে। যখন আমরা সেখানে পৌঁছলাম, সবাই আমাকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে একজন লোক ঢুকছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চান, আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কি কি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে দৌড়াতে বলা হয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে পেছন থেকে গুলি করা হবে, তাই আমি দৌড় না দিয়ে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম', বলেন তিনি।

আটককৃতরা উভয়েই বলেন, বন্দিশালাগুলোর ভেতর থেকে যেন শব্দ বাইরে না যায় সেজন্য বড় মেশিনের শব্দ ব্যবহার করা হতো।

একজন বন্দি বলেন, একটি বড় জেনারেটর সব সময় চলত। আওয়াজের কারণে আমার নাক-গলা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।

অপর বন্দি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে খুব জোরে গান বাজানো হতে। 'এতে আমার মাথা ব্যথা শুরু হতো।'

তিনি আরও বলেছিলেন যে তাকে মাঝরাতে গোসল করতে হতো। 'আমি খালি গায়ে থাকতাম এবং একটাই লুঙ্গি ছিল। প্রতিবার লুঙ্গি ভিজালে না শুকানো পর্যন্ত ভেজা লুঙ্গিটিই পড়ে থাকতে হতো। আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এবং এভাবে ভেজা লুঙ্গি পড়ে থাকা ছিল আমার জন্য নির্যাতন।'

৫ বছর পরে কেন্দ্রে লন্ড্রি সিস্টেমের কিছুটা উন্নত হয়। অপর বন্দি বর্ণনা করেন, 'তাদের কাছে লুঙ্গি ও টি-শার্ট ছিল। বন্দিদের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দেওয়া হতো। আমরা টি-শার্ট ও লুঙ্গি ধুয়ে শুকাতে পারতাম এবং বদলে নিতে পারতাম।'

বন্দি উভয়েরই চুল-দাড়ি কাটা হয়েছিল মুক্তির ঠিক আগে, একবারই।

কেন্দ্র 'ক'

কেন্দ্র 'ক' এর ৩ বন্দি তাদের বর্ণনায় কেন্দ্র 'উ' এর থেকে তুলনামূলক ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বলেছেন এবং নির্যাতনের কথা বলেননি।

সব বন্দি কেন্দ্রটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারাগার বলে বর্ণনা করেছেন। যেখানে নিজস্ব রান্নাঘর, সেলুন, ডাক্তারের কক্ষ, বাথরুম, বিছানা ও কম্বলসহ কক্ষ, হাই কমোড টয়লেট এবং এমনকি বন্দিদের পড়ার জন্য বইও রয়েছে।

বন্দিদেরকে অনেকে সম্মানের সঙ্গে 'স্যার' বা 'চাচা' বলে ডাকতেন।

কিন্তু এর কোনোটিই এই সত্যকে অস্বীকার করে না যে, ওই বন্দিদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২ বছর পর্যন্ত নির্জন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল এবং তাদের পরিবার জানত না যে তারা মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন।

এক বন্দি বলেন, 'আমার ঘরে একটি লোহার খাট ছিল এবং গদি তৈরি করার জন্য ৪টি কম্বল দেওয়া হয়েছিল। একটি লাইট সব সময় জ্বলত এবং একটি দরজার কোণে এক্সজস্ট ফ্যান চলত।'

সাধারণ পেশাদার ওই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রমের জন্য।

বন্দি হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি পড়ার জন্য একটি বই চেয়েছিলেন। 'তারা আমারকে একটি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড দেন এবং যখন আমি প্রথম খণ্ড চাইলাম, তারা জানান যে সেটি অন্য একজন বন্দি পড়ছেন। পরে, যখন আমি একটি বইয়ের নাম বলে চাইলাম, তখন তারা সেটি দোকান থেকে কিনে আনেন। তবে বইয়ে দোকানের নাম লেখা প্রথম পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।'

বন্দিদের হাতকড়া পড়ানো হয়নি, এমনকি কক্ষে থাকা অবস্থায় চোখও বেঁধে রাখা হয়নি। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে তাদের কক্ষে ২টি দরজা ছিল। একটি জেল সেলের মতো দণ্ডযুক্ত এবং আরেকটি শক্ত দরজা। তাই তারা বাইরে কিছুই দেখতে পাননি।

তিনি বলেন, 'দরজার নিচে দিয়ে একটি ছোট ফাঁক বানানো ছিল, সেখান দিয়ে খাবার কক্ষের ভেতরে দিত। আমি ঘরের ভেতরেই হাত ধুতাম।'

প্রতিবার কক্ষের বাইরে নেওয়ার সময় তাদের পুরো মাথা কালো একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতো এবং হাতকড়া পড়ানো হতো। টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একই কাজ করা হতো।

তিনি বলেন, 'একবার কালো কাপড়টি সড়ে গেলে আমাকে যে প্রহরী নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি আবার সেটি পড়ানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। আমি আমার ডানদিকে একটি রান্নাঘর এবং সেখানে একজন নারীকে রান্না করতে দেখলাম।'

সব খাবার গরম গরম পরিবেশন হতো এবং বন্দিরা খাবার বেছে নিতে পারতেন। একজন বন্দি বলেন, 'দুপুরের খাবারের সময় আমাকে শাক, তেলাপিয়া মাছ, ২টি ডিম ও ডাল দেওয়া হয়। আমি যখন তাদের বলি যে আমি চাষ করা মাছ ও ডিম খেতে চাই না, তখন তারা আমার জন্য গরুর মাংস নিয়ে আসেন।'

তিনি আরও বলেন, 'রোজায় সেহরিতে আমাকে গরম দুধ, একটি বড় কলা, ভাত, শাকসবজি ও প্রোটিন এবং ইফতারের জন্য ফল, জুস, ভাজা খাবার, ছোলা ও মিষ্টি দেওয়া হতো।'

বেশ কয়েকজন বন্দি বর্ণনা করেছেন যে বিশেষ দিনগুলো তারা বিশেষ খাবার পেতেন। সকালে পরাটা, সেমাই, ভাত ও বাদামের মিষ্টি এবং দুপুর ও রাতে তেহারি, ভাত, গরুর মাংস ও মুরগির মাংস দিয়েছে।

এক বন্দি বলেন, 'যতবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, প্রতিবারই জানতে চাওয়া হয়েছে যে, আমাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা এবং ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার সঙ্গে যতই ভালো আচরণ করা হোক না কেন, এটি কোনো জীবন না। আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম এবং তারা আমার জীবনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল।'



একজন প্রহরী একবার একজন বন্দিকে বলেছিলেন, 'আমি দিতে পারব না এমন কিছু না চাইলে, এখানে যা চাইবেন তাই পাবেন।' এই দিতে না পারার মতো চাওয়া হচ্ছে, তাদের পরিবার বা বন্ধুদেরকে তাদের সম্পর্কে খবর দেওয়া।

বন্দিরা ২ ধরনের কক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন। একটি দেয়ালের মুখোমুখি এবং অন্যটি বারান্দার দিকে।

দেয়ালের মুখোমুখি সেলে ছিলেন এমন একজন বন্দি জানান, তার সেলের শক্ত দরজা বেশিরভাগ সময় খোলা রাখা হতো। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকে বাথরুমে নেওয়ার জন্য বন্ধ করা হতো, যাতে তিনি তাদেরকে দেখতে না পারেন। এই আটক ব্যক্তিকে ভুল পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

বারান্দার মুখোমুখি সেলে থাকা অপর একজন বন্দি জানান, তার কক্ষে একটি ছোট ভেন্টিলেটর ছিল। সেখান দিয়ে তিনি বাইরে দেখতে পেতেন। তার সেল ছিল নিচতলায়।

তিনি বলেন, 'ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে আমি একটি কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ধরতে এবং সেগুলো বড় হতে দেখেছি। আমি বৃষ্টি দেখেছি, পাখির শব্দ শুনেছি। আমি একটি ছেলেকে গিটার বাজাতে শুনেছি এবং তার বোন তার মায়ের কাছে তাকে নিয়ে অভিযোগ করছে সেটাও শুনেছি।'

এই স্বাভাবিক, সুন্দর পৃথিবীর ঠিক পাশেই তিনি নির্জন কারাবাসে বন্দি ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি একবার পাশের সেলমেটের সঙ্গে কথা বলার জন্য দেয়ালে টোকা দিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। দেয়ালগুলো প্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু এবং অনেক উঁচু ছিল।'

তিনি বন্দি থাকা প্রতিটি দিন গুনেছেন। কাঠের একটি ছোট টুকরা ব্যবহার করে দেয়ালের নীচে তারিখ লিখতেন। জাতীয় দিবসগুলো হিসাব করে তিনি সঠিক হিসাব লিখে রাখতে পারতেন। বাইরে দেশাত্মবোধক গান শুনে তিনি বুঝতে পারতেন, এটি কোন তারিখ।

তিনি বলেন, 'আগে যারা এই কক্ষে বন্দি ছিলেন তারা অনেক কিছু লিখেছিলেন। সেখানে কবিতা থেকে শুরু করে আরবি লেখা, হিন্দু ধর্মীয় চিহ্ন পর্যন্ত ছিল। একদিন কয়েকজন লোক এসে দেয়াল পেইন্ট করে দিয়ে যায়।'

একবার তিনি পা পিছলে বাথরুমে পড়ে যান এবং এক্স-রে করার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেন, 'তারা আমার মাথা ঢেকে একটি গাড়িতে নিয়ে যায়। এই প্রথম আমি আমার মুখে সূর্য অনুভব করলাম। আমি শুনলাম রিকশাওয়ালারা ঝগড়া করছে। আমি একবার ভাবলাম, পালাই। কিন্তু পরেই মনে হলো, তারা গুলি করবে বা ধরে ফেলবে। এমন কিছু হলে আর এখন যেমন আরামে রেখেছে সেটা আর করবে না। তখন নির্যাতন করতে পারে। আমি কর্মকর্তাদের দেওয়া আশ্বাসে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলাম যে, সময় হলে আবার বাড়ি ফিরব।'

আরেকজন বন্দি বর্ণনা করেন, কিভাবে তিনি পাশের সেল থেকে প্রচুর কান্নার শব্দ শুনতে পান। তিনি বলেন, 'যদি তিনি খুব কান্নাকাটি করতেন, তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর ফিরে অনেকক্ষণ ঘুমাতেন।'

সবকিছু ছাড়িয়ে নির্জন কারাবাসটিই তাদের জীবনে সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল। বিষয়টি এতটাই দুর্বিষহ ছিল যে, তারা সেই সময়ের একমাত্র ভালো অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেই প্রহরীদের সঙ্গে আলাপচারিতা। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাদের একমাত্র যোগাযোগ ছিল সেটিই।

অনেক বন্দি তাদের সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন, অনেকটা স্নেহের সঙ্গে, যারা তাদের তদারকি করেছেন। যদিও তারা জানতেন যে, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারাও জড়িত।

তাদের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা খুবই সহজ। কারণ তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিন্তু তাদের বর্ণনা শুনে প্রশ্ন জাগে, পরিচয় প্রকাশ করে কে আবার সেই নির্যাতিত জীবনে ফিরে যেতে চাইবে?

জাতিসংঘের তালিকায় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জন

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাঁদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন। এ সময় নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিবা ইসলাম। ২০ আগস্ট বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা গত বছর বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে আলোচনা হয়। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।


মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ। অবশ্য সরকার শুরু থেকেই গুমের ঘটনাগুলো অস্বীকার করে আসছে।


মিশেল ব্যাশেলেত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান।


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ সরকারের কাছে গুমের শিকার হওয়া যে ৭৬ জনের তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:


১. মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম। তাঁকে ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশাল থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২. মো. হাসান খান। গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের ২৫ মে তাঁকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩. মোহাম্মদ চৌধুরী আলম। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১০ সালের ২৫ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায়।


৪. সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন। জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। তাঁকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাদাপোশাকের কিছু ব্যক্তি ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় পোশাকধারী পুলিশও ছিল।


৫. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। র‌্যাব পরিচয়ে ২০১১ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৬. তপন দাস। ২০১১ সালের ৩ আগস্ট তাঁকে কিছু ব্যক্তি ডিবির সদস্য পরিচয় দিয়ে ঢাকা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৭. হাবিবুর রহমান হাওলাদার। তাঁকে ২০১২ সালের বাগেরহাট থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৮. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৯. আল মোকাদ্দাস হোসেন। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি।


১০. মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে তাঁকে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১১. কে এম শামীম আখতার। ২০১২ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


১২. মোহাম্মদ ইমাম হাসান। ২০১২ সালে ঢাকা থেকে অপহৃত হন।


১৩. পারভেজ হুমায়ুন কবির ও ১৪. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (হিরো)। দুজনকে ২০১৩ সালে কুমিল্লা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৫. মোহাম্মদ তৈয়ব প্রামাণিক। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৬. মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারী। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৭. মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল। নাটোর থেকে তাঁকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৮. কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র (শিলহেইবা)। জন্মসূত্রে ভারতীয়। তাঁকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায়।


১৯. মো. সেলিম রেজা (পিন্টু)। তাঁকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


২০. মো. আসাদুজ্জামান রানা (বাবু)। ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২১. করিম জাহিদুল ওরফে তানভীর, ২২. মো. মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল, ২৩. আল–আমিন, ২৪. ইসলাম সাজেদুল ওরফে সুমন ও ২৫. মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম। এই পাঁচজনকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ঘটনা বেশি

গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকা অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গুমের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


২৬. মো. কাওসার হোসেন। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৭. এ এম আদনান চৌধুরী। র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৮. মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ১১ মে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৯. নুরুল আমিন। লক্ষ্মীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩০. শামীম উদ্দিন প্রধান। বগুড়া থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩১. নুর আলম। গাজীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩২. সোহেল রানা। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৩. সাজ্জাদ হোসেন শেখ। গাজীপুর থেকে ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৪. মো. হোসেন চঞ্চল। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৫. পারভেজ হোসেন। ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৬. মাহফুজুর রহমান সোহেল। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৭. জহিরুল ইসলাম। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৮. মো. নিজাম উদ্দিন। র‌্যাব ও ডিবি পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যায়।


৩৯. মীর আহমদ বিন কাশেম। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৪০. মাহাবুব হাসান। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪১. কাজী ফরহাদ। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪২. সম্রাট মোল্লা। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৩. খালেদ হাসান। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৪. মোহাম্মদ তারিকুল আলম। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ তাঁকে যশোর থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৫. আবদুল্লাহিল আযমী। ডিবি পরিচয়ে ঢাকা থেকে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৬. মোহাম্মদ আখতার হোসেন। ডিবি পরিচয়ে রংপুর থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ৩ মে।


৪৭. এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনজন অস্ত্রধারী তুলে নিয়ে যায়।


৪৮. মো. আবদুল কুদ্দুস প্রামাণিক। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চার ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়।


৪৯. মোহাম্মদ জাকির হোসেন। ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫০. মো. মাহাবুবুর রহমান ওরফে রিপন। ২০১৪ সালের ২১ মার্চ ঢাকা থেকে তাঁকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়।


ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়ও ঘটনা অনেক

বিভিন্ন জেলায় ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বেশ কিছু গুমের ঘটনা ঘটেছে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


৫১. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান (নাহিদ)। নরসিংদী থেকে তাঁকে ২০১৭ সালের ৯ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন তুলে নিয়ে যায়।


৫২. মো. রেজাউন হোসেন। যশোর থেকে ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৩. শেখ মোকলেসুর রহমান। সাতক্ষীরা থেকে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাতক্ষীরা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৪. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফারুখ (রশিদ)। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই র‌্যাব পরিচয়ে পাঁচ ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৫. মো. হাসিনুর রহমান। ঢাকা থেকে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ১০ থেকে ১৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৬. মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার। যশোর থেকে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৭. রাজু ইসলাম। ২০১৫ সালের ২০ মার্চ ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৮. মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৯. মোহাম্মদ জায়েদুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬০. মাইকেল চাকমা। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি নিখোঁজ হন।


৬১. ইসমাইল হোসেন। ২০১৯ সালের ১৯ জুন তিনি ঢাকায় নিখোঁজ হন।


৬২. মো. তারা মিয়া। ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৩. মনির হোসেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে ২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৪. মোহাম্মদ নুর হোসেন (হিরু)। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০১১ সালের ২০ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৫. মোহন মিয়া। ২০১৮ সালের ১০ জুন ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৬. জাকির হোসেন। ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার গুলশান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৭. ইফতেখার আহমেদ দিনার। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৮. জুনায়েদ আহমেদ। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৬৯. এম ইলিয়াস আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭০. আনসার আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


তালিকায় কল্পনা চাকমার নাম

২৬ বছর আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় কল্পনা চাকমাসহ আরও যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা হলেন:


৭১. সাইদুর রহমান কাজী। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোর থেকে তাঁকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭২. মোহাম্মদ মোরশিদুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাজশাহীর তাহেরপুর থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৩. আবদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে রাজশাহী থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৭৪. ফরিদ আহমদ সৈয়দ। কুমিল্লা থেকে তাঁকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৫. আলমগীর হোসেন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি কুমিল্লা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৭৬. কল্পনা চাকমা। রাঙামাটি থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অস্ত্রধারীরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


  • সূত্র - প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০, ২০২২ 

Thursday, August 25, 2022

ভোট কারচুপি করতেই ইভিএম

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যানসহ তীব্র বিরোধিতা করছে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাসদ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলই ইভিএম-এর পক্ষে নয়।  আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বাধিক ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার, আগস্ট ২৩, ২০২২, দুপুরে ইসির এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর থেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুরু থেকেই এ কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। কারণ, এরা সবাই সরকারের আজ্ঞাবহ। এদের বসানোই হয়েছে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। অনেকেই আমাদের বলেছিল ইসির সঙ্গে একটু কথা বলে দেখেন না। ওদের আচরণ ইতিবাচক মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেন কথা বলছি না সেটা আজ প্রমাণিত। ওদের চাকরিটাই হলো আওয়ামী লীগকে পুনরায় পাশ করানো।

আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতদিন ইসি বলেছিল বেশিরভাগ দল ইভিএম চায় না। এখন উনারা নিজেরাই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। আসলে তাদের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। কারণ আগামী নির্বাচনে সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নেই এ সিদ্ধান্ত। ইভিএম দিয়ে চুরি করবে, বাকিটা অন্যভাবে নেবে। আমরা তো শুরু থেকেই বলছি-সরকার ভোট চুরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইভিএম হচ্ছে সেটার অংশ। কারণ, ভোটারদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের কোনো আস্থা নেই। সুষ্ঠু ভোট হলে পরিস্থিতি কি হবে তা তারা অনুমান করতে পারছে। তাই ভোট ডাকাতির মাধ্যমেই আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।


আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনকে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে ফেলবে। অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত করবে?। এটা গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। ইসির সিদ্ধান্ত আগামী সংসদ নির্বাচনে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর নীল নকশার অংশ।


বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমি মনে করি, এটা বর্তমান রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক ইসির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এ সিদ্ধান্ত নাকচ করার সুযোগ এমনকি আইনি সাহস ইসির নেই। এসব কারণে ইসির ওপর আমাদের আস্থা নেই।


জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনের ওপর সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছে কারচুপি করতেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে চাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।


বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ১৪ দলের শরিক সংসদ-সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার পূর্বসূরিদের পথেই হাঁটছে, যা শুভ লক্ষণ নয়। এতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিসের ভিত্তিতে ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে-তা স্পস্ট করেনি ইসি। এটা পরিষ্কার বা খোলাসা করে বলা উচিত। তা না হলে নির্বাচনে কারসাজি করার যে বিতর্ক, তা থেকেই যাবে। নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।


লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, সরকারের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার লক্ষ্যেই এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা জনগণের জন্য কিছু করবে সেটা আমরা মনে করি না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এমনকি সাধারণ মানুষেরও এ কমিশনের প্রতি আস্থা নেই। তারা সরকারের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।


ইভিএমে ভোট নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার আবারও ডাকাতি করে ক্ষমতায় যেতে চায়। এবার তারা ভোট চুরির বাক্স ইভিএমকে বেছে নিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের এ চাওয়াকেই বাস্তবায়ন করছে ইসি। তারা এখন পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কোনোটাই জনগণের পক্ষে নেয়নি। সবশেষ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতকে উপেক্ষা করে তারা ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসির কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন হিসাবে কাজ করছে।


নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না। তারা সরকারের দেখানো পথেই হাঁটবে। ইসিকে নিরপেক্ষভাবে হাঁটার সুযোগ তো সরকার দেয়নি। ইভিএম বাতিল করা হলো এটা বলার সাহস ইসির নেই। তাদের এটাই বলতে হবে। তারা করতে থাকুক তাদের কাজ আমরা করব আমাদের কাজ। সরকারের পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে ইসির কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারা সেটা করতেও পারবে না। সরকার যা চাইবে তারা সেটাই করবে।


  • সূত্র - দিনকাল/ আগস্ট ২৫, ২০২২

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের চরম ব্যর্থতা বাংলাদেশকে মহাসংকটে ফেলেছে

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে 

বাংলাদেশ সরকারের চরম ব্যর্থতা দেশের জন্য মহা-সংকটের সৃষ্টি করেছে



আগস্ট ২৫, ২০২২

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’র সংবাদ সম্মেলন


প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা, 

আসসালামু আলাইকুম।

পাঁচ পাঁচটি বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অবৈধ, অনির্বাচিত গণবিচ্ছিন্ন সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত শুরু থেকেই এ সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। 

 

২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা বহন করে চলেছে। ২২ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু যুক্ত হচ্ছে। সে হিসেবে গত ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এ সংখ্যা দিন-দিন বাড়তেই থাকবে। 

 

রোহিঙ্গা সমস্যা একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং সামাজিকভাবে জীবন-জীবিকায় চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসা, নারী পাচার ও নানাবিধ অসামাজিক ও আইন বিরোধী কার্যকলাপে সৃষ্ট অশান্ত ও অস্থির পরিস্থিতি, মাদক চোরাচালান ও মাদক পাচারে রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়া, রোহিঙ্গাদের অন্তদ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা নেতা হত্যা- ইত্যাদি বিষয় চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে ভালো ভবিষ্যতের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে যেমন সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে।  

 

অপরদিকে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগণের আবাসন ও খাদ্যের যোগান দেয়া, স্যানিটারি ব্যবস্থাসহ পরিচ্ছন্নতা বিধান, স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদান, ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা রোহিঙ্গা সন্তানদের শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থা, বিনোদন, জীবনাচার ইত্যাকার বিষয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা নির্ভর এক মহাকর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে কোভিড পরবর্তী সংকটকালে ইতোমধ্যে ১৭ কোটি মানুষের ভারে ভারক্রান্ত বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের এ অতিরিক্ত বোঝা বহন করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে UNHR এর মুখপাত্র রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির এর জন্য আরও আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। এদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য দরকার পুষ্টি, আশ্রয় সামগ্রী, পয়ঃনিস্কাশন ও জীবিকায়ন সুবিধা। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একা’র সংকট নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সংকট যে একটি বৈশ্বিক সংকট, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সে বিষয়ে যথাযথভাবে উদ্ভুদ্ধ কিংবা convince করতে পারেনি।  

 

বিশ্বের অন্যান্য মানবিক সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে সাড়া দেয় বা তৎপর হয়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তারা সেভাবে এগিয়ে আসেনি। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই না। যদিও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে রায় দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনের হত্যাকা-কে জেনোসাইড আখ্যায়িত করেছে, এবং ICC রোহিঙ্গাপীড়নের হোতা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে, তথাপি রোহিঙ্গা সমস্যার মূল চ্যালেঞ্জ তথা নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটকে এখন আর গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না বিশ্ব। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্ব দরবারে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই বোনেরা, 

এই সরকার ব্যার্থ হয়েছে বন্ধু রাষ্ট্রদের এবিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য রাখাইনে মুসলিম জনপদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা যখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়, তখন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে এবং মিয়ানমার সরকারের সাথে এক ধরনের সহমর্মিতা  প্রকাশ করে, এবং অন্যদিকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সাহায্য প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে। এদিকে চীন সরকার একদিকে বরাবরের মতো মিয়ানমারের সাথে তাদের বন্ধুত্বের ঘোষণা অব্যাহত রাখে, এবং অপরদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে অদ্যাবধি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি সাধিত হয়নি। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় পদক্ষেপ চলমান রয়েছে বলে বলা হয়। বাস্তবতা হলো গত ৫ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও সেদেশে ফেরত পাঠান সম্ভব হয়নি। এদিকে গত ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে। সেদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বরং আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।  

 

এই পটভূমিকায় বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি এখন আগের চেয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক মহল আরও কার্যকরী ও ফলপ্রসূ চাপ না দিলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠান সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আরও জোরালো রাজনৈতিক তৎপরতার চালাতে হবে। 

 

মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের ওপর প্রচণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দুঃখজনক হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ করলেও আবার তাদের অনেকের সাথেই মিয়ানমারের বড় ধরনের ব্যবসায়ীক সম্পর্কও রয়েছে। 

 

এই দ্বৈত অবস্থান চিহ্নিত করে বাংলাদেশ সরকারের উচিত focused কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে তা বন্ধ করা। কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে স্পষ্ট, কার্যকরী ও সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

২০২০ সালে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় না করে সরকারের একক সিদ্ধান্তে বঙ্গোপসাগরের মুখে দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কিয়দংশ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নাখোশ করেছিল। ঐ সময় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংগি লি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ''--এই স্থানান্তরে মিয়ানমার এমন বার্তা পেতে পারে যে বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তাদের ফেরত না নিলেও চলবে''। সাংবাদিক সম্মেলন করে তখন বিএনপিও ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছিল এ জন্য যে এতে মিয়ানমারের স্বার্থই রক্ষিত হবে, প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ কমবে এবং প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সেদেশে বাস্তুচ্যুত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্দি করে রেখেছে এবং নানা অজুহাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে virtually কোল্ড স্টোরেজে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফলে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গার বোঝা এখন জগদ্দল পাথরের মতো এ দেশের মানুষের ঘাড়ে চেপে আছে।  

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার শুরু থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বিতর্কিত কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয় আসছে। শুরুতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ, মিয়ানমার বাহিনীর সাথে যৌথ সেনা মহড়ার প্রস্তাব এবং সবশেষে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর এসবই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে। সে সময় প্রাথমিকভাবে হাসিনা সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দেয়। 

 

এমনকি মিয়ানমারের ভাষায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ তদন্তে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে তুরস্কের ফার্স্ট লেডী এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয় মন্ত্রীদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও আভ্যন্তরীণ চাপে সরকার সে বাধা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেনঃ ''এই ঘটনার সূত্রপাতটা আমরা যেটা দেখি– ওখানে কোনো একটা গোষ্ঠী আছে, তারা মিলিটারির উপর হামলা করেছে। মিয়ানমারের যে বর্ডার ফোর্স– তাদের উপর হামলা করে বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করে। ২০১২ সালে একবার এই ঘটনা ঘটায়। তখনই সাধারণ নাগরিকের উপর অত্যাচার শুরু হয়। আবার ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে ঠিক একই ঘটনা ঘটানো হল। সেখানে অনেকগুলি বর্ডার ফোর্সের সদস্যদের, বর্ডার পুলিশকে হত্যা করেছে। আর্মির উপরে তারা আক্রমণ করেছে। যার ফলাফলটা হল যে, সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হল...''।

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

অপরদিকে ২০১৭ সালে আগস্টে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা আরম্ভ হলে শুরুতেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি চেয়ারপার্সন মানবতার নেত্রী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ সরকারকে অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে উদাত্ত আহবান জানান। রোহিঙ্গাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি নিজে কক্সবাজারে স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এরপরে লাগাতারভাবে আমাদের দলের পক্ষ থেকে দেশে-বিদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, লেখালেখি, প্রকাশনা, প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া হয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ইস্যুতে গোলটেবিল আয়োজন করে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানায়। কিন্ত এ সরকার তাদের স্বভাবসুলভ স্টাইলে সে ডাকে সাড়া দেয়নি।  

এ প্রসঙ্গে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এবং ১৯৯২ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সময় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিলে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও স্টেটসম্যানসুলভ ধীশক্তি গুণে সে সময় মিয়ানমার সরকারকে প্রায় সকল রোহিঙ্গা শরনার্থীদের দেশে ফেরত নিতে বাধ্য করেছিলেন। সে সময় স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আইনানুগ অধিবাসী (legal residents) এবং মিয়ানমার সমাজের সদস্য (member of Myanmar society) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।  

 

২০১৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এই সমঝোতা চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে স্বীকার করেন যে উক্ত সমঝোতা চুক্তিবলে ১৯৭৮ সাল, ১৯৮১-৮২ সাল এমনকি ১৯৯১-৯১ সালে যে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছিল তাদের ফেরত নেয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো সে সময় সম্ভব হলে এখন কেন সম্ভব হচ্ছে না ?

আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে কেবলমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছেন। তারা অতিশীঘ্র তাদের নিজ নিজ বাড়ি ঘরে নিরাপদে ফিরে যাবেন। আমরা চাই, প্রত্যাবাসন হোক স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই। রোহিঙ্গারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরে পাক। নিশ্চিত করা হোক বাড়ীঘর, কর্মস্থলে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা। বিশ্ব জনমত এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও তা'ই চায়।

 

উপস্থিত সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই জনবিচ্ছিন্ন এই অনির্বাচিত সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। বারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও সরকার রাখাইনে ফেরত পাঠাতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। দীর্ঘদিনের এই সমস্যাকে কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে না পারা নিঃসন্দেহে সরকারের চরম ব্যর্থতা। 

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, 

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই উপায়ে মিয়ানমারের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে চান। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার কক্সবাজার ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে তাঁকেও তারা একই দাবী জানায়। রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধানের জন্য ‘নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ নিশ্চিত করতে হবে। আর এই প্রত্যাবর্তনকে শুধুমাত্র কাগুজে চুক্তিতে বন্দি না রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির কার্যকর প্রয়োগের পথে এগুতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর স্ব স্ব ভূমিকা সুনিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা উপলদ্ধি করাতে হবে। 

 

কিন্তু তার আগে মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া হতে হবে স্বেচ্ছায়, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়ে নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই। কোন ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পাতানো খেলার অপকৌশল হিসেবে নয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে হবে।  

 

প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

দেশবাসীকে আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন সে সময় উদ্ভুত রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু ও সম্মানজনক সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল তাদের রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব¡ এবং দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন থাকার কারণে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল এবং স্বৈর সরকার হিসেবে পরিচিত একটি জনমেন্ডেটহীন সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি জটিল ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র একটি জনবান্ধব গণতান্ত্রিক সরকারের দ্বারাই এটা সম্ভব। যা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে অনুপস্থিত। তাই বাংলাদেশের জনগণ, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। একটি অগণতান্ত্রিক ও গণবিচ্ছিন্ন সরকারের সার্বিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিক পরিণতিই হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও স্থবিরতার প্রধান কারণ। এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষেই সম্ভব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা। 

সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ্ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 

 

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

মহাসচিব 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি