সাক্ষাৎকার : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
———
লোটন একরাম
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে শতভাগ আস্থাশীল এবং আনুগত্য নিয়ে কাজ করি। যে মহলটি বিএনপিতে ভাঙন, বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টি করতে চায় — তারাই নানা গল্প তৈরি করে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিকে সোজাপথে যেতে দেওয়া হয় না। এখানে একটি শক্তি আছে, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে এ কাজ করে থাকে।
এক মাস কারাভোগের পর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।
আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে গত ৯ জানুয়ারি মুক্তিলাভের পর প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা আলমগীর বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে অতীতেও সফল হয়েছি এবং ভবিষ্যতেও সফল হবো — ইনশাআল্লাহ। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে দাবি করে তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগের আগে কোনো আলোচনা হবে না। সব সময় বেগম খালেদা জিয়া যে কথাটি বলেন, জনগণ অবশ্যই নিজ অধিকার আদায় করবে।
ভিডিয়ো লিঙ্ক —
সমকাল: এক মাস কারাভোগের দিনগুলো কেমন ছিল?
মির্জা আলমগীর: এবার কারাগারের অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর ছিল না। বাংলাদেশে রাজনীতি করলে কারাগারে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
অনেকবার কারাগারে গেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার লক্ষ্য করলাম, সাবেক মন্ত্রী-এমপি হিসেবে আমি ও মির্জা আব্বাস ডিভিশন প্রাপ্য হয়েও প্রথম পাঁচ দিন ডিভিশন দেয়নি। কর্তৃপক্ষ সঠিক কোনো উত্তরও দিতে পারেনি। আমাদের পরিবারের সদস্যরা যখন আদালতে রিট করতে যাচ্ছিল, তখন ডিভিশন দিয়েছে।
সমকাল: সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারসহ ১০ দফা ও রাষ্ট্র সংস্কারের ২৭ দফা দাবিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
মির্জা আলমগীর: প্রতিটি আন্দোলনের গতিতে উত্থান-পতন থাকে। কখনও উপরে উঠে, আবার কখনও নিচে নামে। দলের এত নেতাকর্মী কারাগারে ছিল— স্বাভাবিকভাবে আন্দোলন কিছুটা ছন্দপতন ঘটতে পারে। তার মানে একেবারে স্থিমিত হয়ে পড়েছে- তা নয়। আন্দোলন চলছে এবং আরও বেগবান হচ্ছে।
সমকাল: সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরকালে বিএনপিসহ বিরোধী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের আরও একজন ক্ষমতাবান সিনিয়র কর্মকর্তা সফরে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কি আপনাদের সাক্ষাৎ হবে?
মির্জা আলমগীর: যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী বা কর্মকর্তা সফরকালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন মনে করলে তাঁদের পক্ষ থেকেই আমন্ত্রণ করা হয়। এবার ডোনাল্ড লু রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেননি। তা ছাড়া সাক্ষাৎ করাটা আমাদের দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়।
সমকাল: সামনে পবিত্র রমজান মাস। সাধারণত ওই সময়ে রাজপথের আন্দোলন সম্ভব নয়। কবে নাগাদ আপনাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করতে চান?
মির্জা আলমগীর: রমজান মাস এখনও অনেক দেরি আছে। আগামীকাল থেকে কী ঘটবে, না ঘটবে- সেটাই তো আজ বলা যায় না। নির্ভর করবে আমরা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, আন্দোলনটা কোথায় নিয়ে যেতে চাই — তার ওপর। রমজান মাস কোনো ফ্যাক্টর নয়।
সমকাল: বিরোধী দলের প্রতিটি কর্মসূচির দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থাকছে। কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
মির্জা আলমগীর: আওয়ামী লীগের চরিত্র সন্ত্রাসী চরিত্র। যখনই ক্ষমতায় এসেছে তারা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে বাধা দেওয়া তাদের স্বভাবজাত। আমরা অত্যন্ত গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। তারপরও সরকার কতটা ভয় পেয়েছে- এতেই তা বোঝা যাচ্ছে। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্ন ও অনির্বাচিত সরকারকে সরানোর চেষ্টা করছি।
সমকাল: বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপ ডাকার আহ্বান জানাবেন কি? এ ছাড়া অতীতের মতো দূতিয়ালি করতে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ বা বন্ধুপ্রতিম প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি ও কূটনীতিকরা কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন?
মির্জা আলমগীর: আমরা কেন সংলাপের আহ্বান জানাতে যাব? আমরা বলছি, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে না নিলে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। পর্দার আড়ালে কোনো দূতিয়ালি জানা নেই।
সমকাল: আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। বিশেষ করে প্রবীণ নেতা উকিল আবদুস সাত্তার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ায় গুঞ্জনটি আরও ডালপালা মেলেছে?
মির্জা আলমগীর: উকিল আবদুস সাত্তারের ঘটনাটি আমাদের কাছে কোনো ঘটনাই নয়। তাঁকে মোকাবিলা করার মতো সেখানে কমপক্ষে ১০ জন নেতা আছেন। বিএনপির মধ্যে কোনো মতভেদ ও মতদ্বৈধতা নেই। সন্দেহ ও সংশয় নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধ।
সমকাল: ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার নামসর্বস্ব ৫৪টি দল ও সংগঠনকে নিয়ে দাবি আদায় বা আপনাদের ভাষায় গণঅভ্যুত্থান ঘটানো কি সম্ভব হবে?
মির্জা আলমগীর: বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে। বিএনপি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে। জোটের রাজনীতিরও ইতিহাস আছে। সমমনারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে। আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে, বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে কতটা সফল হয়।
সমকাল: এরই মধ্যে বিএনপির সমমনা জোট গণতন্ত্র মঞ্চের অভ্যন্তরে টানাপোড়েন চলছে বলে খবর বেরিয়েছে। আপনিও অভিযোগ করছেন।
মির্জা আলমগীর: এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার। কিছুটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কোনো সমস্যা বা সন্দেহ ও সংশয় দেখিনি। তারা আগের চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে।
সমকাল: জোট শরিক গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর অভিযোগ করেছেন, বিরোধী ৫৪ দল ও সংগঠনের অনেকে সরকারের কাছ থেকে টাকা ও প্লট নিচ্ছে এবং আসন ভাগাভাগিতে ঐকমত্যে পৌঁছে যাচ্ছে। কারা নিচ্ছে- বিএনপিকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মির্জা আলমগীর: উনি যেহেতু বলেছেন, এটার দায়-দায়িত্ব উনি নেবেন। তবে আমি মনে করি, এটা কোনো সমস্যা নয়।
সমকাল: ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের মতো এবার আবারও 'কিংস পার্টি'র তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে?
মির্জা আলমগীর: দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ে একটা রহস্যময়তা থাকে। কারণ, গণতন্ত্র চর্চা সঠিকভাবে হয়নি। এখানে একটি শক্তি আছে, তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে রাজনীতিকে সঠিক এবং সোজাপথে যেতে দেয় না। নানা গল্প ও বিভিন্ন ঘটনা তৈরি করে রাজনীতিকে বিপথে পরিচালনার চেষ্টা করা হয়।
সমকাল: বিএনপিতে শীর্ষ নেতৃত্বের সংকট রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। যেমন ভিপি নুর বলেছেন, 'খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে শীর্ষ নেতা এবং ক্ষমতায় গেলে সরকারপ্রধান হিসেবে আপনার নাম এখনই ঘোষণা দেওয়া উচিত। পরে দল সিদ্ধান্ত নেবে।' আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মির্জা আলমগীর: এ ধরনের বক্তব্য চক্রান্তমূলক। বিএনপিতে শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। বিএনপি অত্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব শতভাগ প্রতিষ্ঠিত। সেই জায়গায় যে মহল বিএনপিতে ভাঙন, বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টি করতে চায়- তারাই এ সমস্ত গল্প তৈরি করে।
সমকাল: 'ফিরোজা' বাসভবনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কোনো পরামর্শ চান?
মির্জা আলমগীর: উনার কাছে কোনো রাজনৈতিক পরামর্শের জন্য আমরা যাই না। তিনি খুব অসুস্থ। আমরা তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়ে থাকি। তিনি একজন রাজনৈতিক নেত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। উনি সব সময় যে কথাটি বলেন, জনগণ অবশ্যই নিজ অধিকার আদায় করবে।
সমকাল: দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের জন্য ধন্যবাদ।
মির্জা আলমগীর : সমকালকেও ধন্যবাদ।
সৌজন্যে — সমকাল/ ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩।