একের পর এক
হত্যাকাণ্ড ঘটলেও হত্যাকারীদের বিচার করতে না পারায় সরকারের লজ্জিত ও দুঃখিত হওয়া
উচিত বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন,
সরকার চাইছে না বলেই এসব
হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না এবং হত্যাকারীদের ধরার চেষ্টা করছে বলেও মনে হয় না।
দেশে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটলে দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বিএনপি-জামায়াতের
কাজ। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটি একটি বিছিন্ন
ঘটনা। তখন বুঝা যায় যে, তাদের নিজেদের
মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। আর হত্যাকারীরা যদি বিএনপি-জামায়াতের বাইরের হয় তাহলে তারা
এ ধরনের কথায় আরো উৎসাহিত হয়। দেশে যে দোষারোপের রাজনীতি চলছে এটি একটি নিকৃষ্ট
রাজনৈতিক চরিত্রের পরিচয়। ছেলে দীপন হত্যার বিচার এখনও চান না বলে জানান আবুল
কাসেম ফজলুল হক।
তিনি মানবজমিনকে
দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিচার হয় না বলেই
আমরা বিচার চাই না। শুধু আমি নই, কিছুদিন আগে
আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়া জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমউদ্দিনের পরিবার এবং অভিজিতের পরিবারও বলেছে তারাও
বিচার চান না। যে রাজনীতি এসব হত্যকাণ্ডের জন্য দায়ী আমি তার অবসান চাই। আমাদের
প্রতিটি পরিবারের দুঃখ আছে কান্না আছে। বিচার চাওয়া কোন পরিবারের দায়িত্ব নয়। এটি
রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অনেক পরিবারই আছে যাদের কর্মক্ষম সন্তানটিকে হত্যার কারণে এখন
তারা আর্থিক কষ্টের মধ্যে আছে। প্রতিটি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া
উচিত। তারপরও যদি বিচারের জন্য
পরিবারগুলোকেই কান্নাকাটি করতে হয় এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর বিষয়ে আবুল কাসেম বলেন, আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবেই পালন করছে। কারণ পুলিশ এখন সরকারের পক্ষে আছে। তারা সরকারের এতটাই অনুগত যে, জীবন দিয়ে কাজ করছে । পুলিশ এখন যেভাবে আহত এবং
নিহত হচ্ছে এর আগে কোনো সরকারের আমলেই
পুলিশ এভাবে মারা যায়নি। পুলিশ যে জীবন দিয়ে সরকারের জন্য কাজ করছে এ বিষয়টি
আলোচিত হচ্ছে না। কাজেই হত্যাকারীদের না ধরার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করা
যাবে না। মূলত বিষয়টি রাজনৈতিক। এ সকল হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা লাভবান হচ্ছে এখন সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। মত প্রকাশে
স্বাধীনতা থাকবে। তবে ধর্ম নিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই সংযত হতে হবে । এ
কথা প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন। কিন্তু আমি তো এ কথা আশির দশক থেকে বলে আসছি।
নারীবাদী আন্দোলন, মৌলবাদী বিরোধী
এসব আন্দোলন দিয়ে আওয়ামীলীগ খুব লাভবান হয়েছে। আওয়ামী লীগ যে ২১ বছর পর ক্ষমতায়
আসতে পেরেছে। এবং এখনও ক্ষমতায় টিকে আছে এসব আন্দোলনের কারণেই। জামায়াতে ইসলাম
দলটিকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে আওয়ামীলীঘ
সামনে রাখতে চেয়েছে। তারা দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করেনি। তাজউদ্দীন সরকার ১৯৭১ সালের
১১ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগসহ
চারটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়নি। এখন আমরা দেখতে
পাই যে, জামায়াতে ইসলাম বিএনপি’র সঙ্গে থাকলে আওয়ামী লীগ খুব লাভবান হয়। তারা
জনগণকে দেখাতে পারে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীর দল। দেশ এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সমাজে গোপন হিংসা বাসা
বাঁধছে। এক পক্ষ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ বলে উগ্রবাদীর প্রচারণা। আর আরেকপক্ষ আছে
যারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নামে প্রচারণা চালাচ্ছে। দুই পক্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার
মধ্যে যে রাজনীতি সেই রাজনীতিই এসবের জন্য দায়ী। ধর্ম নিরপেক্ষ আর রাষ্ট্র ধর্ম
ইসলাম নিয়ে যে বির্তক চলছে এর সবটাই রাজনীতির বিকার বিকৃতি। যার ফলে ঘটছে
হত্যাকাণ্ড।
আমাদের দেশে কখনই গণতন্ত্র ছিল না। কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য
প্রয়োজন গণতান্ত্রিক দল। আমাদের দেশে কোনো গণতান্ত্রিক দল নেই। কাজেই অগণতান্ত্রিক
দল দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ দেশে গণতন্ত্র হচ্ছে ভোটের রাজনীতি।
টাকা যার ভোট তার। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে
গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। মানুষ এখন ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। ভালো কাজের জন্য
মানুষের তাগিদ নাই। সমাজে এত ভয় এত লোভের মধ্যে যেখানে সবাই আত্মসমর্পণ করে চলছে
সেখানে তো অবস্থার পরিবর্তন হবে না। দরকার কিছু বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ। যারা সমস্ত
বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করতে পারবে। এখনও সমাজে ভালো মানুষ আছে। যতদিন পর্যন্ত মানুষ
না জাগবে ততদিন পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন হবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম
ফজলুল হক।