Search

Sunday, December 29, 2019

সংকটকালে পাশে দাঁড়ায়নি পরীক্ষিত বন্ধুরা

মো. তৌহিদ হোসেন

বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। পররাষ্ট্র ও কূটনীতির ক্ষেত্রে কেমন গেল বছরটি? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো কী কী ছিল? এসব নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতের চাওয়ার জায়গাগুলো অনেকটাই পূরণ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের চাহিদাসমূহ পূরণে ভারতের প্রতিশ্রুতি কোনোটাই বাস্তব রূপ লাভ করেনি। তবু বছর শুরু হয়েছিল দুই দেশেরই সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এই উচ্চারণে যে বাংলাদেশ এবং ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’।

অনেকে আশা করছিলেন যে এপ্রিল-মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের পর এ ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি সম্ভব হবে। অন্তত তিস্তার বিষয়ে বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি হয়তো পালন করবে ভারত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। শোনা যাচ্ছে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখলের আশা করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সুবিধা দিয়ে উত্তরবঙ্গের ভোট হারানোর ঝুঁকি নেবে না দলটি। বরাবরের মতোই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বলি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ।

এর মধ্যে জুলাই মাসে আসামের নাগরিক তালিকার দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশিত হলো, যাতে ৪০ লাখ মানুষকে সম্ভাব্য বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। ৩১ আগস্ট বের হলো চূড়ান্ত তালিকা, যাতে ১৯ লাখ মানুষকে বলা হলো বিদেশি। ভারত আশ্বস্ত করল যে এটা নিতান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের এতে উদ্বেগের কিছু নেই। আমাদের সরকারও তাদের এই আশ্বাসে বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে। বাংলাভাষী এই মানুষগুলো যদি ভারতে বিদেশি বলে গণ্য হয়, তবে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে, ভারতের আশ্বাস বা আমাদের বিশ্বাসে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ৩ থেকে ৬ অক্টোবর চার দিনের ভারত সফরে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তখনো তাঁকে একই আশ্বাস দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ সফরকালে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের মধ্যে। তার একটির সুবাদে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের খাবার পানির সমস্যা মেটাতে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে ভারত। এ পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়, তবে তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে ভারতের বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে এই ছোট সুবিধাও ক্ষোভের কারণ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে।

সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সপ্তমটির শিরোনাম ‘এমওইউ অন প্রভাইডিং কোস্টাল সার্ভিলেন্স সিস্টেম’ (উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম প্রদানসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক)। এ স্মারকের শর্তাবলি বিষয়ে সরকারিভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে ভারতীয় পত্রিকার খবরে জানা যায়, এই সমঝোতা স্মারকের ফলে দিল্লি বাংলাদেশে একটি উপকূলীয় নজরদারি সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ পাবে এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লির রণকৌশলগত অবস্থান এতে শক্তিশালী হবে। সাগরপথে সন্ত্রাসী হুমকি এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এটা হবে (ভারতের জন্য) খুবই উপকারী।

এই চুক্তি বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসবে এমন কোনো কথা কোনো পক্ষ থেকেই শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুসম্পর্কের আলোকে এ নিয়ে চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় এই স্মারক কোনো বিনিময় ছাড়াই ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারের একজন উপদেষ্টা অবশ্য এর পক্ষে একটি খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন যে এরূপ একটি নজরদারি ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এটা করা হতো সময়সাপেক্ষ, তাই ভারতকে তা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে কেন এটা এত জরুরি হয়ে পড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। উদ্ভূত তথ্যের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ছাড়াও আমাদের বিদেশনীতিতে যে একধরনের ভারত-চীন ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা আছে, এই স্মারক তাতে আরও জটিলতাই সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে সর্বশেষ প্রভাবক ঘটনাটি ঘটেছে এই ডিসেম্বর মাসেই। অনেক হই–হট্টগোল আর তুমুল বিতর্কের পর ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল,২০১৯ পাস হয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী মুসলমানদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে নির্যাতিত হয়ে ভারতে চলে আসা হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে। বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোসহ সারা ভারতেই। বিক্ষোভ-সহিংসতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানিও ঘটেছে।

ভারতের পার্লামেন্টে পাস করা একটি আইন আপাতদৃষ্টিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দুটো কারণে এটিকে পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, আইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে একই ব্রাকেটভুক্ত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, আইনে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে (পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও) নির্যাতনের শিকার হয়ে সংখ্যালঘুরা ভারতে প্রবেশ করছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দুটি দেশ সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, তার একটি অপরটিকে আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, এটা একদিকে যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি অন্যদিকে বেদনাদায়ক। সাম্প্রতিক কালে ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের পুশ ইন তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগত কারণেই বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার ভারতের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, আর বহুদিন পর, সংযতভাবে যদিও সরকার সেই ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্ধারিত সরকারি সফর বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ককে তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করব? ভারতের কিছু অর্জন আছে, কিন্তু এক বছরে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো অর্জন দৃশ্যমান নয়। তিস্তা, সীমান্ত হত্যা রয়ে গেছে যথারীতি। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থানও হতাশার কারণ। উদ্বেগের তালিকায় বরং যুক্ত হলো আসামের নাগরিক তালিকা আর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে ভারতের অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। আর বছর শেষ হলো বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর সফর বাতিলের মধ্য দিয়ে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রোল মডেল’, ২০১৯-এর শেষে এসে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে এই কথাগুলো বলতে থাকা মনে হয় বেশ কঠিন হয়ে গেছে। গত কিছুদিন এই বহুল ব্যবহৃত শব্দাবলি শোনাও যায়নি কোনো নেতা-মন্ত্রীর মুখে।

চীন সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন

১৯৭৫–পরবর্তী প্রতিটি সরকারের সঙ্গেই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। (ব্যতিক্রম ২০০৭-০৮-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এ সময়ে খানিকটা আড়ষ্টতা ছিল সম্পর্কে।) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুসমূহে বা বহুপক্ষীয় নির্বাচনে দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। যেসব বিষয়ে চীন স্পর্শকাতর, বাংলাদেশ সেসব ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে চীনকে। উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া মৈত্রী সেতু এবং সম্মেলন কেন্দ্র দৃশ্যমান করেছে সুসম্পর্ককে।

তবে সে সময়টা পেরিয়ে এসেছি আমরা বেশ আগেই। এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চীন। এর সবকিছুই অবশ্য নিরেট আশীর্বাদ নয়। চীন থেকে প্রকল্প অর্থায়ন আসে বাণিজ্যিক সুদে, জাপান বা ইইউর মতো স্বল্প সুদে নয়। চীনা কোম্পানিগুলো কাজ পাওয়ার পর দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়। এক প্রকল্পের কাজ আটকে রেখে চাপ দিয়ে আরেক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। দুর্নীতি, অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি এসব তো আছেই। কোম্পানিগুলো তাদের এসব কাজে চীন সরকারের পরোক্ষ মদদও লাভ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তবু ‘সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু’ এই শব্দগুচ্ছে নন্দিত হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক।

বাংলাদেশ–চীন সম্পর্কে প্রথম বড় ধাক্কা ২০১৭ সালে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারকে চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন। দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্কের সুবাদে চীনের সুযোগ ছিল এ ক্ষেত্রে ‘অনেস্ট ব্রোকার’-এর ভূমিকা নেওয়া। তা না করে চীন ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারকে বেছে নিয়ে মিয়ানমার সৃষ্ট সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে। বাংলাদেশের প্রতি চীনের অসন্তোষের একটি সম্ভাব্য কারণ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের চাপে সরে আসা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সফর–পরবর্তী চার বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি ছিল। তিন বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রতিশ্রুতির শতকরা ৫-৭ ভাগের বেশি নয়। এ বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সই হয়েছে কিছু সমঝোতা স্মারক। কিন্তু সম্পর্কের মেঘ কেটে গেছে, তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা বিষয়ে নতুন উপলব্ধি

দুই বছর ধরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা না করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের নিন্দা করছে বা জাতিসংঘের মহাসচিব যখন জাতিগত নিধন বলেছেন, তখনো বাংলাদেশ অনেকটাই নীরব থেকেছে।

২০১৯ সালে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। দেরিতে হলেও সম্ভবত এ উপলব্ধিটা এসেছে যে শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা জাতিসংঘে স্পষ্টভাবে বলেছেন। পাশাপাশি এর পুনরাবৃত্তি রোধে মিয়ানমারে যারা জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি ২০১৯ সালে। তবে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি মামলা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে, তবে রোম চুক্তির পক্ষভুক্ত না হওয়ায় মিয়ানমারের ওপর এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর্জেন্টিনার আদালতেও চালু হয়েছে একটি মামলা। তৃতীয় মামলাটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে, গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে মামলাটি করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।

নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এই গণহত্যা মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ১০-১২ ডিসেম্বর ২০১৯। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন সে দেশের আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তাম্বাদু। মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন সে দেশের প্রকৃত সরকারপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি।

প্রত্যাশিতভাবেই অং সান সু চি তাঁর বক্তব্যে গণহত্যার সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উত্তর রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ সময় কিছু সেনাসদস্য ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছিলেন বলে তিনি স্বীকার করেন। যুক্তিতর্ক চলাকালে মিয়ানমার পক্ষের আইনজীবী এমনকি এ কথাও বলেন যে সেখানে হয়তো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তবে গণহত্যা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে মামলায় চলমান গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারের প্রতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা জারির আরজি আছে। এ আরজিটির নিষ্পত্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। এরূপ নির্দেশনা যদি আসে, তবে সেটা হবে গাম্বিয়া এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটা নৈতিক বিজয়। আর চূড়ান্ত রায়ে মিয়ানমার যদি একটি গণহত্যাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে যেসব দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন করছে, তাদের ওপরও নৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের। শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অপরাধের স্বীকৃতিও একটি অর্জন।

বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণের জন্য হেগে উপস্থিত ছিল। মামলা পরিচালনায় বাংলাদেশ তথ্য–উপাত্ত দিয়েও সহযোগিতা করবে গাম্বিয়াকে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমাধানের ইলিউশন থেকে বের হয়ে আসছে।

আলোচিত তিনটি বিষয় ছাড়াও বৈদেশিক সম্পর্কের ইস্যু আছে আরও অনেক। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক, শ্রমবাজার, মানবাধিকার, বাণিজ্য সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। ২০১৯ সালে এর কোনোটিতেই বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বছরটি পার হয়েছে গতানুগতিক ধারায়।

আসন্ন বছরের চিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট এবং ২০১৯ সালের ঘটনাপ্রবাহ পুরোনো প্রবাদকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে রাষ্ট্রের জন্য কেবল স্বার্থই হচ্ছে স্থায়ী, বন্ধু বা শত্রু নয়। সংকটকালে ‘পরীক্ষিত বন্ধুরা’ পাশে দাঁড়ায়নি, এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী সময়ের রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে আমাদের। কাউকে শত্রু না বানিয়ে খুঁজতে হবে নতুন বন্ধু, নতুন সমীকরণ, যা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে। নতুন বছরে এটাই হবে বৈদেশিক সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
  • কার্টসি - প্রথম আলো/২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ 

সিপাহী-জনতার বিপ্লব-সংহতির মূলধারা

মারুফ কামাল খান

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি ছিলো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এই তারিখটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল ও ভাস্মর হয়ে আছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের জবাব নতুন প্রজন্মের জানা দরকার। কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে বিকৃত করে এবং সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে তুলে ধরছে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহল। সেই মিথ্যা, বিকৃতি ও বিভ্রান্তির পর্দা সরিয়ে ৭ নভেম্বরের প্রকৃত উজ্জ্বল ইতিহাস তুলে না ধরলে দেশপ্রেমের শাণিত চেতনায় নতুন প্রজন্মের তরুণরা উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হতে পারবে না। বিভ্রান্তির মেঘ এসে ঢেকে দেবে সত্যের প্রখর সূর্যকে।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময় রাজপথে সূচিত সৈনিক-জনতার সংহতির মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল তাতে পরাস্ত হয়েছিলো একদল কুচক্রী। সেদিন শুধু নয়, ওই ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাবার সাহস এ দেশের কোনো রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ছিলো না। সময়ের বিবর্তনে অনেক পরে এসে বিশেষ গোষ্ঠীটি ৭ নভেম্বরের ইতিহাস বিকৃতভাবে প্রচার শুরু করে। আরো পরে শুরু হয় সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৭ নভেম্বরের বৈরী গোষ্ঠীটি দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারের সমর্থক এই চক্রটি সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ‘সৈনিক হত্যা দিবস’ নামে অভিহিত করতে থাকে। অবশ্য ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম বছরে এই সরকার ৭ নভেম্বর জাতীয় ছুটি বাতিল করার সাহস পায়নি। পরে তারা কেবল ওই ছুটিই বাতিল করেনি, সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস উদযাপনে বাঁধা দেয়ার পাশাপাশি তারা এখন সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসের প্রতিপক্ষে প্রকাশ্যেই অবস্থান নিয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান সরকার তাদের দালাল আরেকটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে ৭ নভেম্বরের ইতিহাস ও ঘটনাবলীকে বিকৃত করেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জাসদের এককালীন সশস্ত্র শাখা গণবাহিণীর নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল আবু তাহেরকে ৭ নভেম্বরের হিরো এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করাই ওই প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য। এ ধরণের বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার ও ইতিহাস বিকৃতি যখন চলছে এবং সিপাহী জনতার বিপ্লবে পরাজিত শক্তির সমর্থকরা আজ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে ৭ নভেম্বরের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চাইছে, সেই মুহূর্তে এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা এবং বিপ্লব-সংহতির শিক্ষা ও চেতনাকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

সংক্ষিপ্ত পটভূমি

৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতির স্বরূপ ও অনিবার্যতা বুঝতে হলে এর সংক্ষিপ্ত পটভূমি জানা দরকার। এ জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে সংঘটিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো এক সুদীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সামনে এগিয়েছে।ইতিহাসের নানা বাঁকে সেই প্রক্রিয়া থেকে অনেকে ছিটকে পড়েছেন, কেউ কেউ করেছেন বিশ্বাসভঙ্গ। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও অবসানের সময়েও এর সঙ্গে জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। ফলে সূচনায় মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। আবার শেষ মুহূর্তে এসেও নেতৃত্বের পর্যায়ে কোন্দলের কারণে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তাই আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে থমকে দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয় বিজয়ের গৌরব। 

রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘ভারতের দয়ার দান’ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। অথচ এই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ জীবন দিয়েছে, যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ সহ্য করেছে অবর্ণনীয় নির্যাতন, অসংখ্য নারী হারিয়েছে সম্ভ্রম। তাদের সীমাহীন ত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে ভারত সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। ভারতের সঙ্গে গোপন এক অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে সই করে সেদিনের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথাকথিত যৌথকমান্ডের নামে মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের আওতায় ন্যস্ত করে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় বাহিনীর কাছে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ভারতের কর্তৃত্বে চলে যায়। তারপর প্রবাসী সরকারকে ঢাকায় এনে ক্ষমতায় বসানো হলেও তাদের কার্যকলাপ তদারকির জন্য মাথার ওপর বসিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় উপদেষ্টাদের। মোট কথা, নয় মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের শেষ প্রান্তে বিশ্বের মানচিত্রের বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এই রাষ্ট্রটির সত্যিকার অর্থেই কোনো সার্বভৌমত্ব ছিলো না। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ্যেই ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, জাতীয় স্বার্থ তথা সবকিছুই হবে ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ লড়েছিলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েমের জন্য, ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক কোনো দেশ গড়ার জন্য নয়

মুজিবের প্রত্যাবর্তন : বিশ্বাসভঙ্গ

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে রুশ-ভারত অক্ষবলয়ে প্রবেশ করেছিলো। তবে মার্কিনীরা বিশ্বাস করতো, শেখ মুজিব আমেরিকার স্বার্থ পরিপন্থী কিছু করবেন না। পাকিস্তানীরাও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আশা করতে থাকে যে, যা-হবার হয়ে গেছে, এখন দুটি স্বাধীন রাষ্টের মধ্যে কনফেডারেশন ধরনের একটা বন্ধন গড়ে তোলার ব্যাপারে শেখ সাহেবেই পালন করতে পারবেন উপযুক্ত ভূমিকা। এসব প্রস্তাবে রাজি হয়েই মুজিব স্বদেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকেই মুজিব তার স্বভাবসুলভ কায়দায় স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফল্যের সব কৃতিত্ব একাই আত্মস্থ করার চেষ্টা করেন। তবে রুশ-ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে তিনি চাতুর্যের সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিতে থাকেন। রুশ-ভারতঘেঁষা বলে পরিচিত তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সরকারপদ্ধতি বদল করে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাজউদ্দিনকে তিনি মন্ত্রিসভা থেকেও ড্রপ করে দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও অন্যান্য মার্কিনপন্থীদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্যও তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন এবং সফল হন। কারন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং জাতিসংঘ তখন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাউপস্থিতির বিরোধিতা করছিল।মুজিব পাকিস্তান সফরে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এবং পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকেও তিনি ঢাকায় স্বাগত জানান। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি গোপনে লবি শুরু করেন। পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের বিচারের দাবিও তিনি ত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। এগুলো সবই ছিলো পাকিস্তান ও মার্কিন প্রশাসনকে দেয়া তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ। কিন্তু বেশি দূর এগুনো সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে। কেননা সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ তখন রুশ-ভারত প্রভাব বলয়ে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বাঁধা। 

ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং অবস্থানগুলো তখন ভারতপন্থীদের কব্জায়। ফলে শেখ মুজিবকেই তাদের কাছে আত্মসমর্পিত হতে হলো। ওয়াদা ভাঙলেন শেখ মুজিব। ভোল পাল্টালেন। নিজের আজন্মলালিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সাজলেন সমাজতন্ত্রী। ভারতীয়রা কখনোই তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত না। ভারতে না গিয়ে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানী আর্মির হাতে গ্রেফতারবরণসহ তার কিছু কর্মকান্ডে তারা ইতোমধ্যেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলো। এবার তিনি বিশ্বাস হারালেন মার্কিন প্রশাসনের। জনতার আস্থা তিনি আগেই হারিয়েছিলেন। শাসকদলের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, লুণ্ঠন, শোষণ, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের কারণে মুজিবের পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন সমর্থন হারিয়ে মুজিব আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়লেন তদানীন্তন সোভিয়েত বলয়ের দিকে। ইতিহাসের পাতা এরপর দ্রুত উল্টে যেতে থাকে। সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে গণতন্ত্র এবং মৌলিক মানবিক অধিকারকে হরণ করে মুজিব একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম করেন। হরণ করেন বাক-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। চারটি দৈনিক সংবাদপত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চালু রেখে বাকি সকল দৈনিক ও অসংখ্য সাপ্তাহিক এবং সাময়িক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থাথানীয় কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। সংসদ ও সরকারের মেয়াদ নির্বাচন ছাড়াই তিন বছরের জন্য বাড়িয়ে নেয়া হয়। গণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় রদবদলের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের ধাঁচে একটি স্বেচ্ছাচারী প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

মার্কিনী প্রতিশোধ : অস্থিতির জন্ম

ইতোপূর্বে সশস্ত্র বাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে প্রভূত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী। এ কারণে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের উপেক্ষিত ভাবতে শুরু করেছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায়ও সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তারা যখন দেখলেন যে, সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার সব আয়োজন শেখ সাহেব সম্পন্ন করেছেন, তখন তারা ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর এই উত্তেজিত অংশটিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের মার্কিনপন্থী অংশটি এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। মুজিব এবং তার দু’জন নিকটআত্মীয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ অভ্যুত্থানে নিহত হন। 

মুজিবের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ট বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর খন্দকার মোশতাক আহমাদ রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। আচমকা ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাওয়া এই পটপরিবর্তনকে দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছিলেন। কেননা আওয়ামী বাকশালী স্বৈরশাসনে তারা ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু এই অভ্যুত্থান শাসনব্যবস্থায় স্থিতি আনার বদলে আরো বেশী সংঘাত ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিলো। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বাকশালের রুশ-ভারতপন্থী অংশটি এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুজিব বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর সিভিল পলিটিশিয়ান মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকার বাকশালও বাতিল করে। ফলে দেশ থেকে রাজনৈতিক দলতো বটেই, রাজনীতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই রাজনীতিহীন সময়ে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল সশস্ত্রবাহিনীকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক প্রতিরক্ষা বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগত কতিপয় অফিসারের সমর্থনে খন্দকার মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেন। ৩ নভেম্বর সংঘঠিত ওই বিদ্রোহের হোতারা সেনাবাহিনীপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে অধস্তন কর্মকর্তা খালেদ সেনাপ্রধান পদ থেকে জিয়াকে অপসারিত করেন এবং নিজেকে নয়া সেনাপ্রধান ঘোষনা করেন।

খালেদের উদ্দেশ্য ফাঁস

উচ্চাভিলাষী খালেদ বিভিন্ন মতাবলম্বী পক্ষকে তাদের মনমতো কথাবার্তা বলে তার দলে ভেড়াবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অচিরেই তার কার্যকলাপে অনেকেই বুঝতে পারে যে, ক্ষমতা দখলই তার আসল উদ্দেশ্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পেছনে খালেদের সক্রিয় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ৩ নভেম্বর তিনি মুজিব ভক্তদের বুঝিয়েছিলেন যে, মোশতাকের সরকার অবৈধ। এই সরকারকে আঘাত করে মুজিব হত্যার বদলা নিতে চান তিনি। তার কথায় মুজিবভক্তরা বলেছিলেন, মোশতাককে অপসারণের পর মুজিবের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুলকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। কিন্তু মোশতাককে অপসারণের সঙ্গে যুগপৎভাবে ঘটে যায় রহস্যঘেরা জেলহত্যাকান্ড। একদল সৈন্য জেলে ঢুকে নজরুলসহ বিলুপ্ত বাকশালের চার শীর্ষনেতাকে খুন করে। এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে খালেদ অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও অনেকেই তাকে সন্দেহ করতে থাকে।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সামরিক অফিসারদের সঙ্গে এই মর্মে সমঝোতায় পৌঁছান যে, তাদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং পরে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে চাকরির বন্দোবস্ত করা হবে। এদের মধ্যে কর্নেল ফারুক তার আত্মীয় ছিলেন। সেই সমঝোতা অনুযায়ী ওই অফিসারদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে খালেদের স্ত্রীকে তাদের সঙ্গে বিমানে তুলে দেয়া হয়। বেগম খালেদ তাদেরকে নিরাপদে ব্যাংককে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

কিন্তু এতসব কৌশল ও চাতুরির আশ্রয় নিয়েও খালেদ সবখানে তার নিজের কর্তৃত্বকে সংহত করতে পারেনি। তিন দিন ধরে রেডিও-টেলিভিশন স্টেশন চালু করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সামরিক শাসন বলবৎ করা সত্ত্বেও ক্ষমতার শীর্ষপদে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বসতে পারেননি। বঙ্গভবন দখল করতে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টেই তার কর্তৃত্ব আলগা হয়ে যায়। সাধারণ সৈনিক ও অফিসাররা খালেদের রহস্যজনক কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ, সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয় ও সংঘাত এড়াতে জেনারেল ওসমানীর হস্তক্ষেপে একটি মাঝামাঝি পদক্ষেপ নেন খালেদ। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে বসানো হয়। সীমাহীন চাপের মধ্যে তড়িঘড়ি করে করে এই সিন্ধান্ত নেয়া ছিলো সেনাপ্রধান পদে খালেদের বসার মতই অবৈধ। মোশতাক সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে খালেদ নিজেও একই ধরনের অবৈধ কাজ করেন। তাকে সিএমএলএ হিসেবে মেনে নিতে সেনা কমান্ডারদের আপত্তি বুঝতে পেরে তিনি একজন সিভিলিয়ান বিচারপতিকে সিএমএলএ বানান। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। 

রুশ-ভারতপন্থীরা পুনরুত্থানের পথ খুঁজছিল। খালেদের বিদ্রোহে উল্লসিত হয়ে ওঠে তারা। মুজিব ভক্তরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে সভা করে। সেখান থেকে মুজিবের ফটো নিয়ে মিছিল করে তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিহত নেতার বাসভবনে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ওই সমাবেশ থেকে খালেদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। মিছিলে খালেদের মা এবং ভাই (আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী মরহুম রাশেদ মোশাররফ) শরিক হন। এই খবর প্রচারিত হলে সেনাবাহিনীসহ সবখানে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সৈনিক ও অফিসাররা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন ও মতবিনিময় করে খালেদের ক্ষমতার স্বপ্নকে গুঁডিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেন।

বিপ্লব ও সংহতি

৭ নভেম্বর প্রথম প্রহর থেকে সারা দেশের সেনা ছাউনিগুলোর চেহারা বদলে যায়। সৈনিকেরা অস্ত্রহাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে আসেন রাজপথে। প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল করে সশস্ত্র সৈন্যকে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানীর দিকে। রাত্রির শেষপর্বে তারা ঢাকায় এসে পৌঁছে। মধ্যরাত্রির পর ঢাকা সেনানিবাসেও শুরু হয়ে যায় সৈনিকদের অভ্যুত্থান। ব্যারাক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা বেরিয়ে আসেন। বন্দী সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে কাঁধে তুলে সাধারণ সৈনিকরা বেরিয়ে আসেন রাজপথে। অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পালাতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে সৈনিকদের হাতে ধরা পড়েন খালেদ তার কয়েকজন দোসরসহ। ক্রুব্ধ সৈনিকেরা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করেন। এর অল্প কিছু আগে খালেদের সমর্থক কর্নেল মালেক, শাফায়াত জামিল, জাফর ইমাম, মেজর হাফিজ প্রমুখ কয়েকজন অফিসার পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাকে ছেড়ে নিরাপদে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

“বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, কুচক্রিরা নিপাত যাক, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিয়ে সৈনিকেরা ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময়ে রাজপথে নেমে এলে তাদের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাতে সারা দেশের জনগণ রাজপথে নেমে আসেন। শ্রেণীপেশা নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দেশরক্ষার সৈনিকদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলেন।সেনাদলগুলিকে বিপুল করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করতে থাকে রাজপথের দু’পাশে অপেক্ষমাণ লাখো মানুষ। জনসমুদ্র থেকে বর্ষিত পুষ্পবৃষ্টিতে ছেয়ে যায় ট্যাংক, সাজোয়া যান। কামানের নলে সাধারণ মানুষেরা মালা পরিয়ে দেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর আর এমন দৃশ্যের অবতারণা কখনো হয়নি।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিল

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনার মধ্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এক. জাতীয় ইতিহাসের এই দুটি ক্রান্তিকালেই সৈনিক এবং সাধারণ জনতা মিলিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে বিপ্লবে নেমেছে।

দুই. উভয় সময়েই সাধারণ সৈনিক ও জনগণ এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন দায়িত্বশীল নেতারা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে। একাত্তরে দোদুল্যমান শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা ও নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন। পঁচাত্তরে বঙ্গভবনে থেকে খন্দকার মোশতাক ব্যর্থ হন জাতিদ্রোহী চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে।

তিন. উভয় ঘটনাতেই জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিলো অনন্যসাধারণ। ’৭১-এ ২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনায় জনগণের নির্বাচিত নেতারা আত্মসমর্পণ ও পালানোর পথ বেছে নিলে নেতৃত্বশূণ্য ও আক্রান্ত জনগণ মারাত্মক অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘোর দুঃসময়ে ইথারে ভেসে এসেছিলো একটি কণ্ঠ : ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…।’ চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও স্টেশন মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে জিয়া জাতিকে দিয়েছিলেন বরাভয় আর পথনির্দেশ। শুধু মৌখিক ঘোষণা নয়, শুরু করে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। একইভাবে ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর প্রত্যুষেও জনগণ আবার বেতার তরঙ্গে শুনলো সেই একই কণ্ঠ : ‘আমি জিয়া বলছি’। জাতীয় দুর্যোগের কান্ডারী জিয়ার নির্দেশনা কান পেতে শুনলো সবাই। এর আগে কুচক্রীদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে গুটিকয়েক উচ্চাভিলাষী এবং বিভ্রান্ত সামরিক অফিসার ক্ষণস্থায়ী এক ক্যুদেতায় সেনাপ্রধান জিয়াকে বেআইনীভাবে অপসারণ ও বন্দী করলে সাধারণ সৈনিকেরা ওই চক্রান্তের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। সেনা ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে রাজপথে নেমে এসে তারা জনসাধারণের সঙ্গে সংহতি রচনা করেন। তারাই বন্দী জিয়াকে মুক্ত করে তার হাতে তুলে দেন দেশ পরিচালনার ভার। অবশ্য দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ না করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্রবাহিনীকে চক্রান্ত ও সংঘাতমুক্ত করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাকেই আশু কর্তব্য বলে নির্ধারণ করেছিলেন। দৃঢ়তা ও কঠোরতার সঙ্গে তিনি সেই জাতীয় কর্তব্য পালনে সফল হয়েছিলেন বলেই আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী আজ এতোটা শক্তিশালী হতে পেরেছে। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। মূলকথা হচ্ছে, একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ’৭৫-এ সিপাহী, জনতার বিপ্লব- এই উভয় ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন একজনই। তার নাম জিয়াউর রহমান।

ছদ্মবেশী চক্রান্ত

১৯৭৫ সালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘাত সৃষ্টির পেছনে দেশের ভেতর থেকে মহলবিশেষের উস্কানি ছাড়াও সীমান্তের বাইরে থেকে ইন্ধন যোগানো হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্যুদেতার সাফল্য নিয়ে সংশয় দেখা দিলে সীমান্তের বাইরের চক্রান্তকারীরা তাদের সেকেন্ড ফ্রন্টকে সক্রিয় করে তোলে। খালেদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে জাসদের গণবাহিনী এবং তথাকথিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গুটিকয়েক লোক তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দলে ভিড়ে যায়। তাদের নেতা ছিল সেনাবাহিনী থেকে বহু আগে শেখ মুজিব কর্তৃক অপসারিত কর্ণেল তাহের। এই চক্রের উদ্দেশ্য ছিল অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করা। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মিত্র সেজে এরাই চক্রান্তমূলকভাবে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্বহীন করার জন্য অফিসার হত্যা শুরু করে। ৭ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে এদের কয়েকজন রেডিও থেকে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার শুরু করে যে, কর্ণেল তাহের হলেন সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নেতা। কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ সৈনিকরা গিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিলে বিপ্লবের বাণী সঠিকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল তাহের এরপর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক তৎক্ষণাৎ বাধা দেন এবং কর্ণেল তাহেরকে ভারতের এজেন্ট ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে চলে যেতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার হকের আশঙ্কা ছিলো, তাহেরচক্র রেডিও স্টেশনে নেয়ার কথা বলে পথিমধ্যে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিলো। কয়েক বছর আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত স্মৃতিচারণে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মঈনুল ইসলাম চৌধুরী (বর্তমানে মরহুম) এসব তথ্য তুলে ধরেছেন।

মোট কথা, ৭ নভেম্বরের রাতেই তাহের চক্রের অসৎ উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। চক্রান্তের দায়ে পরে তাদের বিচার ও সাজা হয়েছিলো।

এক সাপ দুই মাথা

বহুদিন প্রতিপক্ষ হিসেবে ‘মক ফাইট’ করার পর আওয়ামী লীগ ও জাসদ আজ এক হয়েছে। সাম্প্রতিককালে তাদের উভয় পক্ষের ভূমিকা ও কথাবার্তায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তাদের আসল গোড়া এক জায়গায়। ঠিক তেমনই খালেদ ও তাহেরও ছিলেন একটি দুমুখো সাপের দুটি মাথা। তাই আওয়ামী লীগ ও জাসদ মিলে আজ খালেদ ও তাহের উভয়ের স্তুতি করছে আর নিন্দাবাদ করছে জিয়াউর রহমানের । এতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে ৭ নভেম্বরে তাহের যদি খালেদের বিরুদ্ধে সত্যিই বিপ্লব সংঘটিত করে থাকেন তা হলে দুজনকেই সমর্থন করা যায় কি করে? তাদের দাবি অনুযায়ী তাহের যদি ৭ নভেম্বরের হিরো হয়ে থাকেন, তাহলে খালেদ ছিলেন ভিলেন। এই পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষকেই সমর্থন করার মাজেজাটা আসলে কি?

আ. লীগ-জাসদের মিলিত ভাষা থেকে আজ খোলাসা হয়ে যাচ্ছে যে, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে তাহের গং অন্তর্ঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঢুকেছিলো। তাহের ও খালেদ উভয়চক্রই ছিলো একই সূত্রে বাঁধা। তাদের উভয়ের তৎপরতার পেছনে যে অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলো,সেটা হলো : বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে বন্ধক দেয়া।

অফিসার হত্যা দিবস

৭ নভেম্বর তাহেরের অনুসারী কতিপয় বিপথগামী সৈনিক ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান দিয়ে পিলখানার সামরিক অফিসারদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মতোই অফিসার হত্যায় মেতেছিলো। বিপ্লবের যে মূলধারা অর্থাৎ সাধারণ সৈনিকেরা কেউই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আত্মঘাতী তৎপরতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তার বীরোচিত ভূমিকায় সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয়ী তৎপরতা দ্রুত থেমে যায়। কাজেই ৭ নভেম্বরকে সৈনিক হত্যা দিবস বলাটা সত্যের বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ সৈনিক নয়, ৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর কিছু অফিসার নিহত হয়েছিলেন অর্ন্তঘাতকদের হাতে। এর জন্য দায়ী কর্ণেল তাহের ও তার অনুগতরা। সে কারণেই তাদের বিচার ও সাজা হয়েছে। তাই ৭ নভেম্বরকে অফিসার হত্যা দিবস বললেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আর এই অফিসারদের হত্যাকে সমর্থন না করলে কর্ণেল তাহের গংয়ের বিচার ও বিচারের প্রদত্ত সাজার প্রতি সমর্থন জানাতে হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বরের বিপ্লব-বিদ্বেষী মহল যুক্তির ধারেকাছে না গিয়ে প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বলে চলছে, তাহেরও ভালো,খালেদও ভালো এবং ৭ নভেম্বরের হত্যা মন্দ কিন্তু হত্যাকান্ড থামালেন যে জিয়া, তিনিও মন্দ। সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ! এ দেশেই এক মুখে এতো কথা বলা সম্ভব।

অপহরণের সাজানো নাটক

৭ নভেম্বর কর্ণেল তাহের ও গণবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হলে আরেকটি ঘটনার কথা মনে রাখা দরকার। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকের কোনো একদিনে জাসদের গণবাহিনীর একটি দল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। দূতাবাসে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই অভিযানে কর্ণেল তাহেরের দুই সহোদর ভাই অংশ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে জাসদের গণবাহিনীর ওই সশস্ত্র অ্যাডভেঞ্চারটি ছিলো সুপরিকল্পিত এবং গভীর ষড়যন্ত্রমূলক। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পটবদলের পর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভারত সামরিক অভিযান চালাতে পারেনি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারির কারণে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক অভিযানের অজুহাত সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরনের এই পাতানো খেলার আয়োজন করা হয়েছিলো। নিরাপত্তা বাহিনী সেটি ভন্ডুল করে দেয়। এ চক্রই সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করা, রক্তপাত ঘটানো ও দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের অনুগামী হয়েছিল বন্ধুবেশে। কিন্তু তাদের সে চক্রান্তও সফল হয়নি।

নয়া মহাসড়ক রচনা

৭ নভেম্বরের শিক্ষা হচ্ছে, জাতীয় দুর্যোগে-দুঃসময়ে ব্যবধানের দেয়াল ভেঙে দিয়ে সৈনিক-জনতাকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। গড়ে তুলতে হবে লৌহদৃঢ জাতীয় ঐক্য ও সংহতি।

ওই মহান বিপ্লবের আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ পদ করায়ত্ত্ব করেও জাতিদ্রোহী চক্রান্তে লিপ্ত হলে পার পাওয়া যায়না। এ দেশের সাধারণ সৈনিকেরা দেশপ্রেমের জ্বলন্ত বহ্নিশিখা বুকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জাগ্রত প্রহরায় নিয়োজিত। তারা প্রয়োজনে ছাউনী ছেড়ে রাজপথে নেমে জনতার সঙ্গে মিতালী গড়তেও জানেন।

সশস্ত্র বাহিনীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টির বিরুদ্ধেও ৭ নভেম্বর এক চরম হুঁশিয়ারী। হত্যা-কু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসারদের ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের বিরুদ্ধেও ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ছিলো এক মহাপ্রতিরোধ। ষড়যন্ত্র করে চেইন অব কমান্ড ও সেনাশৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে খালেদচক্র ক্ষমতা দখলের যে চক্রান্ত করেছিল সৈনিক-জনতার বিপ্লবে তা পরাজিত হয়। বিপ্লবী সৈনিক-জনতা সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে এনে এক অরাজক ও নেতৃত্বশূন্য পরিস্থিতিতে জিয়ার হাতে তুলে দেন দেশের শাসনভার। প্রকাশ্য রাজপথে লাখো সৈনিক-জনতার পুষ্পবর্ষণে অভিষিক্ত হয়ে ক্ষমতার অভিষেক ঘটে তার। বিপ্লবের তরঙ্গাভিঘাতে ভেসে যায় ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত।

৭ নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ফিরে আসে প্রকাশ্য রাজনীতি, গঠিত হয় রাজনৈতিক দল, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চক্রান্তমুক্ত হয়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লবের ধারায় ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক অবস্থান থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নামের যে জাতিরাষ্ট্র বা নেশনস্টেটটি জন্ম নিয়েছিল সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাষ্ট্রভিত্তিক, আধুনিক ও বাস্তবসম্মত এক জাতীয় পরিচয় অর্জন করে। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে নবউদ্দীপ্ত ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নবোত্থিত এই বাংলাদেশী জাতিসত্তার অভিষেকের দিন ৭ নভেম্বর। আর সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্যকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা, মর্যাদা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও গৌরব নিয়ে সামনের দিকে এই জাতিসত্তাকে এগিয়ে চলার প্রশস্ত নতুন মহাসড়ক গড়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান।

  • কার্টসি - নাগরিক সাংবাদিতার প্লাটফর্ম/ নভেম্বর ৭, ২০১৯

জাতিসংঘে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ


জাতিসংঘে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন পর্যন্ত কোন বইপত্র কিংবা কোন ম্যাগাজিনে আসেনি। অনেক ঘাটাঘাটির পর এটা তৎকালীন একটি পত্রিকা থেকে লেখাটি সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হল।

জনাব সভাপতি, জনাব মহাসচিব ও সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ,
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এই একাদশ বিশেষ অধিবেশন বাংলাদেশের দৃষ্টিতে যে কতটা গুরুত্বর্পূণ আজ এখানে আমার উপস্থিতি তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে, এজন্যে অনেক কষ্ট স্বীকারও করতে হয়েছে। সাধারণ পরিষদের ষষ্ঠ ও সপ্তম বিশেষ অধিবেশনের পরবর্তী বছরগুলোতে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থর্নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশেষ কোন অগ্রগতি হয়নি। ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেকার বৈষম্য হ্রাস পাবার বদলে দেখা যাচ্ছে তা বরং বৃদ্ধিই পেয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের আদর্শ এবং মানবাধিকার সংকান্ত্র ঘোষণার প্রতি আমরা সকলেই আনুগত্যশীল। মানুষের মৌলিক দুটি অধিকার: ক্ষুধা ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তিসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশের নিশ্চয়তা বিধান করতেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা সত্বেও আমরা এখন প‌র্যন্ত যে অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি তা খুবই সামান্য। এর কারণ কি?

ক্ষুধার্তের সংখ্যা বাড়ছে

এটাইবা কেমন কথা, জাতিসংঘের প্রথম ও দ্বিতীয় উন্নয়ন দশকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি আমাদের সর্বসম্মত আস্থা সত্বেও দুনিয়ার দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত লোকের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস না পেয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলছে। প্রতি বছর এই মহান সংস্থা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে অগণিত প্রস্তাব গ্রহণ করে আসছে, অথচ এই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি একক বৃহত্তম হুমকি যেটা সে ব্যাপারে তার কোন খেয়াল নেই। তারইবা কারণ কি?
সারা দুনিয়ায় প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ কেন বাড়তে বাড়তে এখন বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে অথচ সেই তুলনায় অর্থনৈতিক সহায়তার মাত্রা সত্যিকার অর্থে দিন দিন কমেই চলেছে কি কারণে, তারইবা জবাব কে দেবে?

বিশ্বের কোটি কোটি বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সহায়সম্বল ও আশ্রয়হীন মানুষ, যারা প্রতিদিন প্রতি ‍মুহূর্ত বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত, তাদের আমরা কি বাণী শোনাবো? আপনারা কি চান, আমরা তাদের বলি: এই পৃথিবীকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে চাই? যার একটিতে জীবনধারার ভিত্তি হবে অপচয়বহুল ভোগ-বিলাস, যার ফলে বিশ্বের মূল্যবান ক্ষয়িঞ্চু প্রাকৃতিক সম্পদরাজি দ্রুত নিঃশেষিত হবে, যা পরিবেশকে দূষিত করে তুলে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করবে। পক্ষান্তরে সেই একই গ্রহের ভেতরে থাকবে দুঃখ দুর্দশা ও বঞ্চণায় ভারাক্রান্ত অপর এক জগতে যেখানে প্রতিদিন শিশুরা অনাহারে প্রাণ হারায় কিংবা অপুষ্টির ফলে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে ¬- যেখানে

দারিদ্রতা, রোগ আর হতাশাজীর্ণ মানবেতার জীবন যাপনই হচ্ছে ভাগ্যলিপি?

চলতি শতাব্দিতে মানব জাতি বিস্ময়কর অগ্রগতি হাসিল করেছে। গত হয়েছে উপনিবেশবাদের দিন। গত পঁয়ত্রিশ বছরে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তার সত্যিই কোন তুলনা নেই। মানুষ মহাসাগরের অতলে আর মহাশূন্যে অভিযান চালিয়েছে। তবুও এ প্রসঙ্গে আজ থেকে দুই দশক আগে এই বিশ্বসংস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট উক্তির পুনরাবৃত্তি করে আমি বলবো, মহাশূন্যের রহস্য যেন আমাদের মানব সমাজের সম্মুখীন রূঢ় বাস্তবতা থেকে আমাদের দৃষ্টি অথবা উদ্যমকে বিক্ষিপ্ত না করে। দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা আর রোগশোকের মোকাবেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব একটা পরিহাস আর কিছু নয়। আশার আলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শুধুই শ্লোগান হয়ে থাকবে।

১৯৪৫ সনে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সাড়ে তিন দশক ধরে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্যে একটি উন্নত বিশ্ব এবং আরো সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রচনার জন্যে কাজ করে চলেছি। জাতিসংঘ সনদ এবং এই বিশ্বসংস্থার সম্পূর্ণ কাঠামোই গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী পরস্পর নির্ভরতা আর সহযোগিতার আর্দশের ভিত্তিতে। বিশ্বব্যাপী এই পরস্পর নির্ভরশীলতাকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম? এর পেছনে কোন যুক্তি ছিল? এই যুক্তি হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং মুক্তি, মানুষের মর্যাদা আর ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা বিধানকারী একটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছি। এর কারণ বর্তমান বিশ্ব সমাজের বিবর্তনের ধারাতে এই সত্যটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে, যে আজকের অধিকাংশ সমস্যারই প্রকৃতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক যেগুলোর একটা অন্যটার সংগে সম্পর্কযুক্ত, আলাদাভাবে যেসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। শান্তি যেমন অবিভাজ্য তেমনি শান্তিকে বিপন্ন না করে বিশ্বকে ধনী আর দরিদ্র এই দুই ভাগে ভাগ করা যায় না। আমরা যদি অবিভাজ্য মানব সমাজে বিশ্বাস করি তবে এই সমাজের প্রতি আমাদের পারস্পরিক কর্তব্য ও দায় দায়িত্বকেও স্বীকার করে নিতে হবে।

বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সপেক্ষে এর চাইতেও অনেক বেশি জোরালো যুক্তি পেশ করা যায়, যেমনটা করা হয়েছে ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টে। বিশ্ব সমস্যাসমূহের সম্যক উপলব্ধি ও এসবের মোকাবেলায় গঠনমূলক সুপারিশ প্রদানের জন্য আমরা জনাব ব্রান্ডট ও তার কমিশনের সদস্যদের প্রশংসা করছি। এই রিপোর্টের একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এতে দেখানো হয়েছে যে উত্তর ও দক্ষিণ উভয়েরই পারস্পরিক স্বার্থে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। এই রিপোর্টে ‘উত্তর‘ থেকে ‘দক্ষিণ‘কে বাণিজ্য বিনিয়োগ, সম্পদ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর ক্ষেত্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে বলা হয়েছে তা দক্ষিণের প্রতি কোন বদান্যতা বা ঔপনিবেশিক আমলের অন্যায় অবিচারের প্রতিকার হিসাবে নয় বরং ‘উত্তরের‘ স্বার্থে এটা দরকারী বলেই তা করা হয়েছে।

বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন দরকার 

আমি বলতে চাই যে এই পারস্পরিক স্বার্থের বিভিন্ন দিক রয়েছে ব্যাপারটা শুধু এই নয় যে এটা দক্ষিণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে- যার ফলে উত্তর আরও বেশি করে তাদের উপর উদ্বৃত্ত রফতানীযোগ্য পণ্য চাপিয়ে দিতে পারবে। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই জোরালো যুক্তি থাকলেও এর সুদূর-প্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্যকে যেন আমরা ঘুণাক্ষরেও অবহেলা না করি। বছর খানেকের কিছু কমই হবে হাভানা শীর্ষ সম্মেলনে পরলোকগত প্রেসিডেন্ট টিটো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন উন্নয়নকামী দেশগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা ছাড়া বিশ্বের নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধান প্রায় অসম্ভব। মানব সমাজের নিয়ন্ত্রণে যেসব বৈষয়িক সম্পদ রয়েছে সেগুলো সবার মঙ্গলের জন্যে কাজে না লাগিয়ে বরং তার বিপরীত উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন নতুন জটিলতা আর সংঘাতের এক বিপজ্জনক উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শান্তি অবিভাজ্য

শান্তির অবিভাজ্যতা সম্পর্কে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ আছে কি? উত্তর কি মনে যে সে দক্ষিণের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি ও আলোড়ন থেকে গাঁ বাঁচিয়ে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে? এই কি তার বিশ্বাস যে যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ, বঞ্চনা আর স্থবিরতা বিষিয়ে তুলবে আমাদের এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা, তখন তার এলাকাতে বিরাজ করবে অব্যাহত শান্তি, প্রগতি আর সমৃদ্ধি?

ব্রান্ডট কমিশনের রির্পোটে যে সুপারিশগুলো রয়েছে তা সুসম ও বাস্তবধর্মী। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির জন্য একটি বিশেষ সক্রিয় কর্মসূচী গ্রহণসহ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে একটি সন্তোষজনক ভারসাম্য অর্জন, অস্ত্রসজ্জার উপর করারোপ ও নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বর্ধিত প্রচেষ্টা, দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যেকার সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে তাদের পণ্য দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও বিতরণ ব্যবস্থায় অধিকতর অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসার, জ্বালানী শক্তি সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক কর্মকৌশল উদ্ভাবন, উন্নয়নকামী দেশসমূহের শিল্পোন্নয়, শুল্ক বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা গঠন, বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার এবং উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অর্থ সরবরাহে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের যে সুপারিশ এতে করা হয়েছে তা যেমন বলিষ্ঠ তেমনি যুক্তিপূর্ণ। অবশ্য প্রয়োজনবোধে কোন কোন ক্ষেত্রে একটু আধটু রদবদল করতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে আমাদের অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাণিজ্য ঘাটতি ছয় হাজার কোটি ডলার

আজ অমাদের কন্ঠে বিপুল উদ্বেগের এই যে অনুরণন ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেটা কি কারণে? কেন আজ আমরা এতটা মরিয়া হয়ে পড়েছি? আমাদের এই উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্রুত প্রসার। বর্তমানে সামরিক খাতে বিশ্বের বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচশত বিলিয়ন ডলার এবং প্রতি বছর তা চল্লিশ বিলিয়ন হারে বাড়ছে। পক্ষান্তরে সরকারী উন্নয়ন সহায়তার মাত্রা কমেই চলেছে এবং বর্তমানে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে অস্ত্রসজ্জা খাতে ব্যয়ের মাত্র পাঁচ শতাংশেরও কম। সামগ্রীকভাবে উন্নয়নকামী দেশগুলোর অর্থনৈতিক চিত্র, অজানা একটা শংকা আর হতাশায় আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তোলে। উন্নয়নকামী দেশগুলো সম্মিলিত বৈদেশিক দেনার পরিমাণ এখন তিনশো বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এসব বৈদেশিক দেনার দায় পরিশোধে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে চল্লিশ বিলিয়ন ডলার যা এসব দেশের মোট রফতানী আয়ের শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি। অংশত এই কারণে এবং অংশত শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য নীতি আর তাদের প্রস্তুত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ১৯৭৯ সালে উন্নয়নকামী দেশসমূহের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার। ১৯৮০ সালে এই অংক বেড়ে ৬০ বিলিয়ন ডলার হবে অনুমান করা হচ্ছে।

৪০ কোটি মানুষ অনাহারে কাটায়

পূর্ব-ইউরোপসহ উত্তর ভূখন্ডে রয়েছে বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ অথচ তাদের হাতেই রয়েছে বিশ্বের মোট আয়ের চার-পঞ্চমাংশ। বিশ্বের শিল্পোকারখানার ৯০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে উত্তরাঞ্চলে। উত্তরের বহু জাতিভিত্তিক কর্পোরেশনগুলি প্রযুক্তিগত সর্বাধুনিক উদ্ভাবনকে তাদের কুক্ষিগত করে রেখেছে।দক্ষিণের যে এক বিলিয়নেরও বেশি মানব সন্তান চরম দরিদ্রসীমার মধ্যে বাস করে তাদের মধ্যে চারশো মিলিয়নের বেশি প্রায় অনাহারে কাটায়। একমাত্র ১৯৭৮ সালেই ৫ বছরের কম বয়সী বারো মিলিয়ন শিশু অনাহারে মৃত্যু বরণ করেছে। আমূল পরিবর্তন সূচক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে দক্ষিণের বর্তমান নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে।

সবচেয়ে গরীব ৩০

এই নৈরাশ্য ও অনিশ্চয়তার পটভূমিতে রয়েছে জাতিসংঘ কর্তৃক এলডিসি অর্থাৎ সবচেয়ে অনুন্নত দেশ বলে চিহ্নিত ত্রিশটি দেশ। এসব দেশের অবস্থা খুব কম করে বললেও অত্যন্ত ভয়াবহ। সবচেয়ে অনুন্নত এই দেশগুলোতে বাস করছে আনুমানিক দুশো ষাট মিলিয়ন মানুষ অর্থাৎ উন্নয়নকামী সকল দেশের মোট জনসংখ্যার তের শতাংশ। ১৯৭০ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ের পরিসরে উন্নয়নকামী সকল দেশের মাথাপিছু আয়ের বার্ষিক গড় যেখানে চারশো ছয় মার্কিন ডলার থেকে পাঁচশো পাঁচ ডলারে উন্নীত হয়, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে অনুন্নত দেশ গুলিতে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ছ ডলার অর্থাৎ ১৯৭০ সালে ১শো ৩৩ ডলার থেকে ১৯৭৭ সালে ১শো ৩৯ ডলারে। এ সময়ে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বাজারদর অনুযায়ী সত্যিকার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা তিন ভাগ আর সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর বেলায় তা ছিল মাত্র শূন্যে দশমিক দুই ভাগ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত ১৯৭৯ সালের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি আমরা ধরেও নিই ১৯৮০‘র দশকে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিকাশের গতি হবে সবচেয়ে দ্রুত, তবুও এসব দেশের গড় আয় দাঁড়াবে শিল্পোন্নত দেশসমূহের আয়ের বারো ভাগের এক ভাগের মত আর সবচেয়ে অনুন্নত দেশে এই পরিমাণ হবে ৪০ ভাগের এক ভাগের কম। সবচেয়ে অনুন্নত দেশ গুলোতে মাথাপিছু শিল্প পণ্য উৎপাদনে ১৯৬০ সালের ৭ ডলার থেকে বেড়ে ১৯৯০ সালে ২০ ডলারে পৌছাবে- এর পাশাপাশি উন্নয়নকামী দেশসমূহে ১৯৬০ সালে এই অংক ছিল ৪৪ লাখ ডলার এবং ১৯৯০ সালে তা হবে ১শো ৭৪ ডলার। সবচেয়ে অনুন্নত দেশের কৃষি পণ্য উৎপাদন ১৯৬০ সালের ৬৯ ডলার ১৯৯০ সালে ৬২ ডলারে নেমে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ১৯৭০-৭৮ মেয়াদে উন্নয়নকামী দেশগুলিতে স্থিতিশীল মূল্যের হিসাবে রফতানী আয়ের পরিমাণ যেখানে ঊর্ধমুখী, সে তুলনায় সবচেয়ে অনুন্নত দেশে তার ক্রমাগত ঘাটতি হয়েছে।

অনতিবিলম্বে কিছু কিছু জরুরী ও বলিষ্ঠ কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আমাদের ভয় হয়, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির বেশির ভাগেরই পরিস্থিতি অতি দ্রুত আয়েত্তের বাইরে চলে যাবে। এই কারণেই ম্যালিনায় পঞ্চম আঙ্কটাড সম্মেলনে গৃহীত জরুরী কর্মপন্থা, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির অর্থনীতিকে অবিলম্বে চাংগা করে তোলা যার লক্ষে, তার দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যে আন্তর্জাতিক সমাজের উপর আমরা এতো চাপ দিচ্ছি। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশসমূহ তাদের সম্প্রতি ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির জন্যে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করুক। এ ধরনের সাহায্যের পরিমাণটাই শধু যথেষ্ট নয়, এর গুণগত উৎকর্ষতার প্রশ্নটাও সমান জরুরী। এই সাহায্য যতোটা সম্ভব শর্তহীন। অনুদানের আকারে হতে হবে। ১৯৭৮ সালে বাণিজ্য ও উন্নয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেশ কয়েকটি শিল্পোন্নত দেশ যদি সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে প্রদত্ত তাদের ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে কিংবা রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে তবু কিছু কিছু দেশ এখনও এ ব্যাপারে পিছিয়ে রয়েছে। আর বিলম্ব না করে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা এই দেশগুলির প্রতি জরুরী আবেদন জানাচ্ছি। সবরকম শুল্ক বাধা অপসারিত করে এসব দেশ থেকে রফতানীর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা। অপর দিকে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির রেয়াতি শর্ত ক্রুড অয়েল এবং পেট্রোলজাত সামগ্রীর পূর্ণ চাহিদা পূরণের দায়িত্ব নিতে হবে ওপেক দেশগুলিকে। এসব দেশের উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্যেও তাদের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

নিজস্ব সম্পদ আহরণ

সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলো কি চায়? আমরা চাইছি আমাদের জনগণের জন্যে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা আর চিকিৎসা – জীবনধারণের এই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে। আমাদের নিজেস্ব সম্পদের পূর্ণ আহরণের সামর্থ অর্জন আমাদের কাম্য। আমাদের মধ্যে অনেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ কিন্তু এসব সম্পদের যথাযথ আহরণের জন্যে আমাদের নেই কারিগরি জ্ঞান অথবা মূলধন, অথবা ক্ষেত্রবিশেষে দুটই। ব্রান্ডট কমিশনের মতে, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন খরচ মেটানোর জন্য বার্ষিক মোট যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা বিশ্বের বর্তমান অস্ত্রসজ্জা ব্যয়ের এক শতাংশেরও কম। একটি ট্যাংকের মূল্য দিয়ে আমরা এক লক্ষ টন চাল দারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম নির্মাণ করতে পারি আর একটি জেট জঙ্গী বিমানের অর্থ দিয়ে গড়ে তুলতে পারি চল্লিশ হাজার গ্রাম্য চিকিৎসা কেন্দ্র।

উত্তরের বন্ধুরা আমাদের বলে থাকেন যে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে তাদের বিশেষ আগ্রহ থাকলেও তাদের হাত পা বাঁধা। আমাদের জন্যে সুদূরপ্রসারী সুবিধা সুবিধা প্রদানের ক্ষমতা তাদের সরকারের নেই, তাদের পার্লামেন্ট এটা মেনে নেবে না, তাদের নির্বাচকমন্ডলীকে বোঝানো যাবে না এবং তাদের কোষাগার শূন্য। কাজেই আমরা যেন আমাদের দূরাবস্থার পরিত্রাণের জন্যে ওপেক দেশসমূহের শরণাপন্ন হই। এর জবাবে আমি বলবো, আপনাদের এসব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে আমরা আপনাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। জনাব ব্রান্ডটের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিশনের সদস্যরা সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপের মাধ্যমে যেমনটা করেছেন। আমরা সানন্দে আমাদের দেশের দূত, প্রতিনিধিদল, ছাত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সাংবাদিকও শিক্ষাবিদদের বক্তৃতা সফরে পাঠিয়ে জনমত সংগঠনে উদ্যোগী হতে রাজী আছি। আমার বিশ্বাস তারা উত্তরের তাদের সমগোত্রীয় অথচ অধিকতর সচ্ছল ব্যক্তিদের শেষ পর্যন্ত এটা বোঝাতে সক্ষম হবেন যে আমরা যদি বর্তমান অচলাবস্থার দ্রুত নিরসন না করতে পারি তাহলে বিশ্ব এমন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে যা থেকে ধনী, দরিদ্র কেউই রেহাই পাবে না।

শীর্ষ সম্মেলন চাই 

আত্মপ্রবঞ্চনার সময় আমাদের নেই। আপনারা আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিন, আপনাদের কোন সাহায্যে আসতে পারি কি না। যদি আমরা এটাই সাব্যস্ত করি যে, সমস্যাটি প্রকৃত পক্ষে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং এর মীমাংসার জন্যে যে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তমালার প্রয়োজন তা এই বিশেষ অধিবেশনের এখতিয়ারের বাইরে, তাহলে বেশতো একটা শীর্ষ সম্মেলনেরই ব্যবস্থা করা হোক। তবে আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, আমরা যেন আগে থেকেই সত্যকে এড়িয়ে যাবার চেষ্ঠা না করি, আমাদের নিষ্ক্রিয়তাকে ঢাকবার জন্যে মিথ্যে অজুহাত খাড়া না করি। আমরা বসে আছি একটি বিস্ফোরণ উন্মুখ জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উপর এবং নষ্ট করার মত বিন্দুমাত্র সময় আমাদের হাতে নেই।

সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর মতামতের যথাযথ বিবেচনা এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় সমমর্যাদায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের প্রশ্নটিও আমার বিবেচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশের সম্পদ উন্নয়নের জন্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ দরকার যাতে তারা বৈদেশিক চাপ ও শোষণের হাত থেকে নিজেদের ক্রমান্বয়ে মুক্ত করতে পারে। সর্বোপরি এসব দেশকে অবশ্যই বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও বাধা ছাড়াই তাদের নিজ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে।

আমরা আশা করছি যে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মকৌশলে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্যে ম্যানিলায় গৃহীত নির্দিষ্ট কর্মপন্থা কার্যক্রমটি অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হবে। আমরা এটাও আশা করি সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির ব্যাপারে আগামী বছরে জাতিসংঘের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা আছে, তাতে এই কার্যক্রমের বিস্তারিত লক্ষ্য নির্ধারণ এবং এর বাস্তবায়নের উপায় উদ্ভাবন সম্ভব হবে। এই সম্মেলনের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিস্তারিত সমীক্ষা এবং এমন একটি বিশেষ কার্যক্রম তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে যার ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের কাজ আরো ত্বরান্বিত হবে। ইতিমধ্যে জরুরী কর্মপন্থা কার্যক্রমের আওতায় অনতিবিলম্বে সুনিদিষ্ট বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণও অত্যাবশ্যক।

৮৫ নাগাদ জনসংখ্যা দু শতাংশ কমাবো

এবার আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করে এই ভূখন্ডে। জাপান ও নেদারল্যান্ডের তুলনায় দ্বিগুণ ঘন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বিশ্বের মধ্যে প্রায় সর্বনিম্ন। এর জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশের বেশি হয় বেকার অথবা ভূমিহীন চাষী যারা শুধু বছরের নির্দিষ্ট একটা মওসুমে কাজ পায়। প্রতিবছর আমাদের বিশ লাখের উপর অতিরিক্ত মুখের আহার জোগাতে হয় – জোগাতে হয় পরনের জন্যে আর কাপড়, শিক্ষার জন্যে আরো বিদ্যালয় এবং মাথা গোঁজার জন্যে আরো বাসগৃহ। তবু আমরা হার মানিনি এবং আমরা হার মানবো না। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ। দেশের জন্মহার দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে ১৯৮৫ নাগাদ দুই শতাংশে আমরা কমিয়ে আনবো। আমরা আরো বিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবো। দেশের কোন নারী, পুরুষ ও শিশুকে আমরা অভুক্ত, আশ্রয়হীন অথবা বস্ত্রহীন থাকতে দেবো না। কৃষি ও পল্লীর উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের প্রায় নয় কোটি জনগণের সবাইকে কর্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থাও অবিচল থাকবে। স্বনির্ভরতা অর্জন আমাদের মূলমন্ত্র। আমাদের সফল হতেই হবে কারণ বিফল হবার উপায় আমাদের নেই।

সম্প্রতি আমরা আমাদের দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছি এবং তার কাঠামোর মধ্যে এই লক্ষ্যসমূহের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আমাদের মিত্রদের কাছ থেকে যে ব্যাপক সমর্থন আমরা পেয়েছি সেজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ তবে আমাদের চাহিদার তুলনায় এ সাহায্য এখনও মোটেও পর্যাপ্ত নয়।

জ্বালানী সম্পদ উন্নয়নে কনসর্টিয়াম

বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এক দিকে তেল আমদানীর জন্য আমাদের ক্রমশঃ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, অপর দিকে আমদানীকৃত কলকব্জা এবং শিল্প কাঁচামালের জন্যেও আমাদের তা করতে হচ্ছে। বর্তমানে জ্বালানী তেল ও পেট্রোলিয়াম সামগ্রীর আমদানি বাবদ আমাদের খরচের পরিমাণ আমাদের মোট রফতানীর আয়ের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। ১৯৬০ সালে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তেল আমদানি খাতের ব্যয় ছিল ছশো মিলিয়ন ডলারের মত। আর চলতি বছর বাংলাদেশেকে তার অপরিশোধিত তেলের চাহিদা পূরণের জন্যে খরচ করতে হবে এর প্রায় সমপরিমাণ অর্থ। 

আমি এই প্রসঙ্গে প্রস্তাব করছি সামগ্রিকভাবে ওপেক দেশগুলিকে অনুন্নত দেশসমূহের তেল আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছি ভেনেজুয়েলা ও মেক্সিকো ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় এলাকার দরিদ্রতম দেশগুলোকে রেয়াতী মূল্যে তেল সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার আর একটা প্রস্তাব হল, সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জ্বালানী শক্তি সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত ও ওপেক উভয়ের সমর্থনে একটি আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হোক। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য ওপেক দেশসমূহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে এবং ওপেক তহবিল থেকে যে সাহায্য দিয়েছে সেজন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। ১৯৮০-র জানুয়ারী পযর্ন্ত ওপেক তহবিল থেকে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল দুশো তেষট্টি মিলিয়ন ডলার। আমরা এই সহায়তার জন্যে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ এই জন্যে যে, তেল হচ্ছে এমন একটি সম্পদ যা দিন দিন নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে আর উন্নয়নকামী দেশ হিসাবে ওপেক দেশসমূহেরও নিজ নিজ অর্থনীতিকে গড়ে তোলার জন্যে এই তেল রাজস্বের পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহর্য।

ওপেকভুক্ত কোন কোন দেশ উন্নয়নকামী দেশগুলোতে তাদের বিপুল আয়ের একটা অংশ বিনিয়োগে যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাচ্ছে তাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। তৃতীয় বিশ্বে পেট্রো ডলার পুনর্বিনিয়োগের ব্যাপারে ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্র সরকারের প্রস্তাব এবং এ ধরনের অর্থ বিনিয়োগে ওপেক দেশগুলি যে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে তা কমানোর জন্যে একটা আন্তর্জাতিক কার্যব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি সমর্থন দানের যে প্রতিশ্রুতি ঐ সরকার করেছে, তা খুবই গঠনমূলক এবং সতর্কতার সঙ্গে তা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।

সবচেয়ে অনুন্নত দেশসমূহের ব্যাপারে এবং তাদের জন্যে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমি এতক্ষণ যেসব কথা বললাম তার কারণ এই নয় যে উন্নয়নকামী বিশ্বের সামগ্রিক সমস্যাবলী থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য বরং বহুক্ষেত্রে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর চাহিদা ও প্রয়োজন যে আলাদা সেটাই প্রতিপন্ন করা। কাজেই আমাদের জন্যে প্রযোজ্য সমাধানও ভিন্ন হতে হবে- তবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনের প্রতি আমাদের আস্থা অবিচল রয়েছে। সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে সহায়তার লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন কর্যক্রম ও বিশেষ প্রচেষ্টায় উন্নয়নকামী বিশ্বের অধিকতর সৌভাগ্যবান দেশগুলি যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পূর্ব ও পশ্চিমের, উত্তর ও দক্ষিণের শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল সকল দেশের পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় এ ধরণের সাহায্য প্রদান অব্যাহত থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু নতুন নতুন ধারণা আমাদের সামনে এসেছে। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে যে বিশ্বের সীমিত সম্পদরাজির সংরক্ষণ অপরিহার্য। এ বিষয়েও আমরা সবাই একমত যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষুধা আর দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। দক্ষিণের উৎপন্ন পণ্যের ন্যায্য মূল্যের কথা ভিন্ন স্বর পরিলক্ষিত হয় না। এটা বাস্তবিকই আশার কথা যে বহু বছর ধরে দীর্ঘ ও কষ্টকর আলাপ-আলোচনার পর আমরা শেষ পর্যন্ত সাধারণ তহবিল গঠনে সমর্থ হয়েছি। আমাদের আশা-আকাংক্ষার তুলনায় এই তহবিল অনেক ছোট, তবু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কিছুটা বিলম্বিত হলেও একটি নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টের প্রতি সমর্থন

তবু এখানেই থেমে গেলে চলবে না। এখন আমাদের জন্যে যেটা অপরিহর্য তা হল জ্বালানি শক্তি, বাণিজ্য শিল্প, অর্থ প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তির হস্তান্তর, খাদ্য ও কৃষি এবং সম্পদ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যেসব বাধা বিপত্তি আমাদের সামনে রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার পন্থা উদ্ভাবনের কাজে আত্মনিয়োগ করা। সম্পদের ব্যাপক হস্তান্তর ছাড়া দক্ষিণের বহু দেশ, বিশেষ করে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির পক্ষে দারিদ্রতার অভিশপ্ত আবর্ত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি। 

উন্নত দেশসমূহের পক্ষ থেকে সরকারী উন্নয়ন সহায়তার মাত্রা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ছাড়াও আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অস্ত্র ব্যয়ের উপর কর আরোপের ব্যবস্থা করে অর্থ সংগ্রহের একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতির বিষয় বিবেচনা করে দেখতে পারি। উত্তর ও দক্ষিণ-উভয় অংশের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর উপর কর ধার্যের বিষয়টিও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। বিপুল সংখ্যক বিদেশী নাগরিক, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের লক্ষ লক্ষ লোক এখন বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত রয়েছে। সাধারণত তারা যে যেখানে কাজ করছেন শুধু সেই দেশের সরকারকেই আয়কর দিয়ে থাকেন। এই করের একটা অংশ এসব বিদেশী নাগরিকের নিজ নিজ দেশকে ফেরত দেয়া উচিত। বহু জাতি সংস্থাগুলোর উপরও বিশেষ কর ধার্যের ব্যবস্থা হতে পারে এবং সমুদ্রগর্ভ থেকে আহরিত খনিজ সম্পদের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও দক্ষিণের জন্যে দেয়া উচিত। ব্রান্ডট কমিশনের রিপোর্টে একটি বিশ্ব উন্নয়ন তহবিল গঠনের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা আমরা পুরোপুরি সমর্থন করি। একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ফলে কাঠামো ও পরিচালনার দিক দিয়ে যেসব পরিবর্তন সাধনের প্রয়োজন হবে তা উপযোগী করে জাতিসংঘ ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে ব্যাপকভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার কাজ হাতে নেয়াও সমীচীন হবে।

পরিশেষে, আমি সুনির্দিষ্ট কতগুলো ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুপারিশ করতে চাই। আমি মনে করি এগুলো দক্ষিণের বিশেষ করে এর দরিদ্রতম দেশগুলোর বর্তমান সমস্যাবলীর সমাধানে বিশেষ সহায়ক হবে। এগুলো হচ্ছে :

(১) একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উত্তরের জনমত সংগঠনের ব্যাপারে দক্ষিণ সম্ভাব্য সকল সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে।

(২) পরিকল্পিত অর্থনীতিভিত্তিক দেশগুলোসহ সকল শিল্পোন্নত…., সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি তাদের সরকারী উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ অবিলম্বে দ্বিগুণ করবে এবং এ ধরণের সব সহায়তা শর্তমুক্ত হবে।

(৩) ওপেক দেশসমূহ সবচেয়ে অনুন্নত দেশসমূহের জন্যে তেলের মূল্য শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হ্রাসের ব্যবস্থা করবে।

(৪) সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলো জ্বলানি শক্তি সম্পদ উন্নয়নের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম গঠন করতে হবে।

(৫) ওপেক দেশগুলো, উন্নত দেশগুলোর সম্ভাব্য সহযোগিতায়, তাদের সম্পদের একটা অংশ উন্নয়নকামী দেশগুলোতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করবে।

(৬) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অস্ত্র ব্যয়ের ওপর কর আরোপের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সম্পদের ব্যাপক হস্তান্তরে ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) উত্তরের অর্থনীতিতে দক্ষিণের জনশক্তি বর্তমানে যে বাস্তব অবদান রাখছে, সেজন্যে উত্তরের এ ব্যাপারে দক্ষিণকে যথাযথ প্রতিদানের ব্যবস্থা করা উচিত।

(৮) বহুজাতি সংস্থাসমূহের ওপর বিশেষ করে ধার্য করা উচিত এবং দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলোর সাহায্যের জন্যে অতি ধনী দেশগুলোরও উচিত একটি বিশেষ কর দেয়া।

(৯) উন্নয়নকামী দেশসমূহের স্বার্থেই জাতিসংঘ এর অধীনস্থ বিভিন্ন বিশেষ সংস্থা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব ব্যাংককে সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। একই সঙ্গে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য গৃহীত কর্মপন্থা কার্যক্রমের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গঠনেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।

(১০) সার্বজনীন সদস্য পদের ব্যবস্থাসহ একটি বিশ্ব উন্নয়ন তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশ্বব্যাপী কর আরোপের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ এই তহবিলে জমা হবে এবং এই অর্থের যথাযথ বরাদ্ধ ও ব্যবহার হবে এর দায়িত্ব।

আমাদের নিকট ও দূরবর্তী এলাকায় বিদেশী সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে উদ্ভূত অবনতিশীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আজকে জাতীয় উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্যে প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এর প্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির একটি শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা দেখছি যে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে যখন আঞ্চলিক সহযোগিতার বাস্তব রূপ নিয়ে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ের সহযোগিতা গড়ে তোলার কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে পরস্পর মিলিত হওয়া এবং এই অঞ্চলের সব দেশের পাস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ খুঁজে বের করা। আমরা দেখেছি, বিশ্বের অন্যান্য অংশে কেমন করে এই আঞ্চলিক সহযোগিতা উত্তেজনা প্রশমনে এবং অভিন্ন স্বার্থে তাদের বিরোধী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গী নমনীয় করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণের এইটাই হচ্ছে উপযুক্ত সময়।

আমার মনে হয়, আমি আমার হৃদয়ের বেদনা ও যন্ত্রণার অনুভূতি কিছুটা ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আমার বিশ্বাস, এখানে উপস্থিত সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দের অনেকেই অনুরূপ মর্মবেদনায় পীড়িত হচ্ছেন। আমি জনাব ব্রান্ডেটের কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলতে পারি, আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যত রচনার কাজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সেটা কেবল সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। কাজেই যুব ও নারী সমাজ. শ্রমিক আন্দোলন, রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবি ও ধর্মীয় নেতৃবর্গ, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ, কারিগর আর ব্যবস্থাপক এবং পল্লীসমাজ আর বণিক সম্প্রদায়ের সকলের প্রতি আমাদের আবেদন, তারা যেন এই নতুন চ্যালেঞ্জের আলোকে সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করতে এবং সেই অনুযায়ী কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হোন।

সমসাময়িক এই বিশ্বের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন তা হল বলিষ্ঠ এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ। আমরা যদি পুরনো দিনের ধ্যান-ধারণা আর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকি, তাহলে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্ব সমাজের সর্বস্তরের জনগণের উন্নততর ও মহত্তর জীবনের জন্যে কাজ করে যেতে হবে। বিশ্বের সকল জাতি মিলিতভাবে এই লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী যথেষ্ট সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের অধিকারী সহযোগিতার পথ ধরে অগ্রসর হতে পারলে, এই লক্ষ্য, অনেকের ধারণার চাইতে আরো দ্রুত অর্জন সম্ভব। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কারণেই আমাদের উচতি এই পথ অবলম্বন করা। আমাদের আন্তরিক কামনা ও প্রার্থনা, আমরা যেন উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হই।

জনাব সভাপতি, আপনাকে ধন্যবাদ। 

  • কার্টসি - নাগরিক সাংবাদিতার প্লাটফর্ম/ এপ্রিল ২৮, ২০১৯

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন!

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, বিরোধী দল দমন এবং বীভৎস দুর্নীতিকে সরিয়ে রাখলে যে বিষয়টি সবচেয়ে  বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো ‘নির্বাচন’। ২০১৪ সাল থেকে সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই মানুষের ভোটের আর কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না।

২০১৪ সালে অতিবিতর্কিত একতরফা একটি তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হওয়ার পর সকলেই ধারণা করেছিল এর মেয়াদ ৫ বছর দূরে থাকুক, কয়েক মাসও সম্ভবত হবে না। এমনকি সরকারের তরফ থেকে এমনও বলা হয়েছিল যে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, অচিরেই সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভবত সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি যে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় ক্যাডার, প্রভাবশালী বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় জনগণকে তুচ্ছ করে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করা যায়। সবারই নিশ্চয়ই স্মরণে আছে- সে সময়ে কীভাবে নানা নাটক করে জবরদস্তিমূলক বিরোধী দল গঠন করা হয়েছিল। যা অদ্যাবধি গৃহপালিত বিরোধী দল নামেই বেশি পরিচিত। তামাম বিশ্বেই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ এক নতুন কনসেপ্ট।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও একচেটিয়া একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনে রূপ নেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্ধারিত একাদশ সংসদ নির্বাচনটি যে কোনোভাবেই এর ব্যতিক্রম হবে না, তা যেকোনো বিবেচনাতেই বোঝা উচিত ছিল। এই ‘নির্বাচন’ যদি কাউকে বিস্মিত করে থাকে তাহলে সেটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৈন্যতা। দশম সংসদ নির্বাচনের পরে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হয়েছে তেমনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরেও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার স্বয়ং, গবেষণা সংস্থা টিআইবি, বিদেশি গণমাধ্যম, বিদেশি পর্যবেক্ষক, সুজন প্রত্যেকেই নির্বাচনটির কঠোর সমালোচনা করেছে। এই নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমি সাক্ষী দিয়ে বলছি, এই নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারেনি।’ যেই নির্বাচনে তথাকথিত নির্বাচিতরাই প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে স্পষ্ট বলেন, মানুষ ভোট দিতে পারেননি সেটা আর যাই হোক কোনোভাবেই নির্বাচনের সংজ্ঞায় পড়ে না।

অতি সম্প্রতি ঘোষিত হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ। নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ বা প্রত্যাশা তেমন না থাকলেও দলগুলো ইতিমধ্যেই তাদের প্রার্থী মনোনয়নের ইঙ্গিত দিয়েছে।

এই দেশের মানুষ এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটকেন্দ্র বিমুখ। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি সংসদে দাঁড়িয়ে রাশেদ খান মেননের উক্তি- ‘আজান দিয়েও আজকাল ভোটার আনা যায় না’। তাই খুব সম্ভব ভোটকেন্দ্র বিমুখ মানুষকে কেন্দ্রে আনার জন্যই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করলেন ‘আমি আশ্বস্ত করছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে’। নির্বাচন সুষ্ঠু করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নির্বাচন পরিচালনার সকল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের একক। এই বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক কী করে আশ্বস্ত করেন তা আমার বুঝে আসে না। ভোট সুষ্ঠু করবার দায়িত্ব যখন তিনি নিচ্ছেন তার অর্থ কি এই নয় যে, এতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র বাধা ছিল। তিনি তার বক্তৃতায় আরো বলেন, ‘আমি আশ্বস্ত করছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে সবধরনের সহায়তা করবে সরকার। আপনারা নির্বাচনে আসুন, ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হবে।’ 

অথচ বিষয়টি সরকারের জন্য ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়, এটা বাধ্যবাধকতা। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে আশ্বস্ত করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ভোট নিয়ে ভয়ের কারণ নেই’। ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না’ কথাটির মাঝেই লুকিয়ে আছে যে সত্য তা হলো মানুষ এটা জানে যে সরকার নির্বাচনে যাচ্ছেতাইভাবে হস্তক্ষেপ করে।

পরবর্তীতে অবশ্য সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের নির্বাচনে হাত না দেয়া সংক্রান্ত উদারতার কারণ তিনি নিজেই স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে- ‘সিটি ভোটে হেরে গেলে সরকারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না’। এর সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেলে যেহেতু মাথায় আকাশ ভাঙার বিষয় থাকে, তাই সেখানে যেনতেনভাবে নির্বাচনে জেতা যেতেই পারে। আর হারলে আকাশ ভেঙে পড়বে না এমন দুই একটি নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দিয়ে সরকারি দল হেরে গেলেও দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে এমন কথা বলা যাবে বৈকি বুক ফুলিয়ে।

গত ২৫শে ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ, শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণে আমাকে খুঁজতে হয়েছে। 

আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি’। বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়া যে সরকারের একেবারে কব্জায় আছে যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটি নিরপেক্ষ, শুদ্ধ, ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেটি জনাব তালুকদারের এই বক্তব্যে খুব স্পষ্ট। এমনকি নির্বাচন কমিশন চাইলেও নির্বাচন আদৌ অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সেটার জন্য কমিশনকে সরকারের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অবশ্য জনাব তালুকদার ছাড়া সিইসিসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন, তাই নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য কমিশনকে সরকারের সঙ্গে কোনোরকম লড়াইয়ে নামতে হয়নি।

সেই সভায় জনাব তালুকদার আরো বলেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে’। বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসন্ন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না’। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বাধীন থাকা নির্বাচন কমিশন যতই ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করুক না কেন, সরকার না চাইলে আমাদের মতো দেশে যে নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় তা একজন শিশুও বোঝে। যে কারণে জনাব তালুকদার বারবারই নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন।

মাহবুব তালুকদার খুব গুরুত্বপূর্ণ আর একটি কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অবৈধভাবে নির্বাচিতদের জনগণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি কোন কমিটমেন্ট থাকে না’। কথাগুলো নতুন নয়, কিন্তু তথাকথিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে একজন নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব রাখে তো বটেই। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট না থাকা সরকার কেমন হতে পারে। এ ধরনের একটি রেজিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ কোনো একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, একমাত্র জাতীয় ঐক্যই পারে এর থেকে আমাদের মুক্ত করতে।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ 

বাড়ছে শিক্ষিত বেকার

চাহিদামাফিক জনশক্তি গড়ে তুলুন


সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদের নেতৃত্বে একটি দল ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার বলে জানানো হয়েছিল। বিবিএসের জরিপের তুলনায় বিআইডিএসের অনলাইন জরিপে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বাংলাদেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দেখলেই সেটি অনুমান করা যায়।

বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা এই জরিপ করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো অসত্য বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই জরিপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কেবল বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ নয়, দেশি-বিদেশি প্রায় সব জরিপ ও পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ।

দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, এটি আনন্দের খবর। কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যখন আমরা তাদের বড় একটি অংশকে কাজে লাগাতে পারি না। শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। শিক্ষিত তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ যদি বেকার থাকে, তাহলে আমরা ওই শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত বা যুগোপযোগী বলব?

জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চলেছি, যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার কেউ নেই। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
  • কার্টসি- প্রথম আলো/ ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯

নির্বাচন কমিশন আঁতাতে লিপ্ত — বদিউল আলম মজুমদার


নির্বাচন কমিশনের জনগনের আস্থা নেই বলে মন্তব্য করেছেন  সুশানের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার৷ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন তিনি৷

ডয়চে ভেলে: ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? সুষ্ঠ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান আছে কিনা?


বদিউল আলম মজুমদার: এ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের কারণ রয়েছে৷ কেননা, এ নির্বাচন কমিশনের নিরেপক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে৷  গত জাতীয় নির্বাচনে তারা নিজেদের বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পারেনি, অনেক কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে ৷ বস্তুত জাতীয় নির্বাচনে যা হয়েছে তা মূলত এক ধরনের অশুভ আঁতাত৷ নির্বাচন কমিশন, এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী  ও সরকারি দলের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা মিলে এ আঁতাত তৈরি করেছিল৷ যে কারণে এই নির্বাচনের কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে জনমনে ব্যপক সন্দেহ রয়েছে৷ তাদের কাছ থেকে একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের আশা করা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই না৷

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে৷ এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?


ইভিএম একটি বড় অংশের ভোটরদের ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত করছে৷  আমরা যদি গত জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায় ২৯৪ টি কেন্দ্রে সাধারণ ব্যলট আর বাকীগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে৷ ইভিএমে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ আর পেপার ব্যালটে ৮০ দশমিক ৮০৷ তাহলে ৩০ শতাংশের ফারাক কেন৷ সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে৷ হয় ইভিএমের ত্রুটি অথবা জটিলতা, কিংবা ইভিএমের প্রতি মানুষের অনীহা থেকেই ৩০ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷৷ এ দায়ভার কে নেবে৷ এ পদ্ধতির যৌক্তিকতা কোথায়? সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম-এর ব্যবহার তাই একটি মস্ত বড় ভুল হবে৷ কেননা ভোটররা যদি ভোট দিতে না পারেন, আপনার পদ্ধতি যদি ভোটরদের মাঝে অনীহা তৈরি করা, তাহলে সেটি কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য কোন ব্যবস্থা নয়৷

বিএনপি একদিকে সরকারকে অবৈধ বলছে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করছে আবার এই সরকার ও একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷  বিএনপির এ অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?


রাজনৈতিকভাবে বিএনপির নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে, তারা অনেক দুর্বল অবস্থানে চলে এসেছে৷  যদিও তাদের অনেক জনসমর্থন আছে বলে অনেকে মনে করে৷  তবে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে৷ একটি রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতায় আসতে চায় তাহলে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে৷ এদিকে তারা যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনেরা যে সকল অভিযোগ করছে, সে অভিযোগলো আরো  শক্তিশালী হবে৷৷ আমার মনে হয় না নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় আছে৷  তবে বিএনপি রাজপথে সরব হতে না পারার কারণ হলো যে, রাজপথ যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ও সরকারি দলের অংগসংগঠনের দখলে থাকে তাহলে সেখানে সরব হওয়া অসম্ভব৷

গত জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ভোটরদের উপস্থিতি কম ছিল ৷ সিটি কর্পোরেশনের এ  নির্বাচনটিকে ভোটারদের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?


ভোটারদের কম উপস্থিতির কারণ অনেক৷ যেমন অনেকের ধারণা আমি ভোট দিলেও কিছুই যায় আসে না আবার অনেকে ভাবছেন আমি ভোট দিতে গেলে ভোট দিতে যে পারবো তার নিশ্চয়তা নেই৷ নির্বাচন বিষয়ে মানুষের মধ্যে ব্যপক অনাস্থা ও অনীহা সৃষ্টি হয়েছে৷  যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলেছে৷ এটি একটি অশনি সংকেত, কারণ নির্বাচনই একমাত্র সুষ্ঠ, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মকান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের পন্থা৷  এটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না৷

আপনি বলছে নির্বাচন কমিশন ‘আঁতাত‘ করছে তাই নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে৷ কিন্তু আসছে নির্বাচন নিয়ে তো নাগরিক সমাজকে সরব হতে দেখা যাচ্ছে না৷ এটি কেন হচ্ছে?


সিভিল সোসাইটি ধ্বংস করে দিয়েছে৷ দুয়েকজন ছাড়া সিভিল সোসাইটির অধিকাংশই অনুগত ও সুবিধাপ্রাপ্ত৷ দুর্ভাগ্যবশত দুয়েকটি গণমাধ্যম ছাড়া কেউ দায়িত্বও পালন করছে না৷ সেলফসেন্সরশিপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে৷

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী বলে আপনি মনে করেন?


এ নির্বাচন কমিশন আমাদের মহা অনিষ্ট করে ফেলেছে৷ তাদের স্বউদ্যোগে পদত্যাগ করা উচিত৷  তা না হলে  সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত৷  বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে৷

  • কার্টসি - ডয়চে ভেলে/ 27.12.2019