Search

Monday, October 17, 2022

ভোট ডাকাতদের ঠেকাতে পারলো না ইসি দায় কার?

— আমিরুল ইসলাম কাগজী

ভোট ডাকাতদের ঠেকাতো পারলো না নখ-দন্তহীন অসহায় নির্বাচন কমিশন।

আওয়ামী পেটোয়া বাহীনিকে নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হয়ে  কমিশন জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবার, অক্টোবর ১২, ২০২২,  দুপুর দুইটার দিকে উপনির্বাচন বাতিলের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। সে সময় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেকটা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনারাও দেখতে পাচ্ছেন। গোপন কক্ষে অন্যরা ঢুকছে, ভোট সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না। তবে কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তা আমরা এখনো বলতে পারব না।

সিইসি আরও বলেছেন, নির্বাচনে তিনি ব্যাপক অনিয়ম দেখেছেন। যেখানে অনিয়ম বেশি, সেখানে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে তিনটি, এরপর ৪৪টি-এভাবে ক্রমাগতভাবে ৫৫টি, ১০০টি এরপর সব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।

ইভিএম নিয়ে অভিযোগ এসেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেন, ‘ইভিএমের  কোনো দোষত্রুটি দেখতে পাচ্ছি না। মানবিক আচরণের ত্রুটির কারণে এমনটা হচ্ছে।’ একই ধরনের প্রতীক দেওয়া গেঞ্জি পরে অনেককে ভোট দিতে দেখেছেন বলে জানান সিইসি। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এসব কাজ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তাঁরাই ভোটকেন্দ্রের ডাকাত কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেন, ‘এরাই ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যাঁরা আইন মানেন না, তাঁদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি।’

গাইবান্ধা-৫, সাঘাটা-ফুলছড়ি,  আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান, জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত এ এইচ এম গোলাম শহীদসহ উপনির্বাচনে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।  ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোট গ্রহণ করা হয়।

একটিমাত্র আসনে উপনির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী ডাকাত বাহিনীর নিকট নির্বাচন কমিশনকে কেমন   হেনস্থা হতে হলো সেটাতো দেশবাসী দেখলো। সিইসি ঢাকায় বসে দেখলেন একই রঙের গেঞ্জি পরে ওই ডাকাত বাহিনী বুথে ঢুকে ইভিএম মেশিনের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ভোট দিচ্ছে। অথচ কেন্দ্রে বসে পোলিং অফিসার কিংবা প্রিজাইডিং অফিসার কেউ সেটা দেখতে পেলো না। এমনকি রিটার্নিং অফিসার/জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার কিংবা ওসি কারও নজরে এলো না। একটি মাত্র আসনে উপনির্বাচন হওয়ার কারণে সিইসি স্বয়ং নিজেই ঢাকায় বসে মনিটরিং করে অনিয়মটা ধরতে সক্ষম হলেন। কিন্তু যখন জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট গ্রহণ হবে তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? সে সময় এই গুরু দায়িত্ব থাকবে কাদের ওপর?  নিশ্চিত ভাবে বলতে হবে ডিসি ও এসপিদের ওপর।

তাদের ব্যাপারে সিইসির মন্তব্য হচ্ছে, "আপনারা দলীয় কর্মী হয়ে যাবেন না।"এ কথা তিনি কেন বলেছেন? তাহলে শুনুন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র জমাদানকালে ডিসির মোনাজাতঃ ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে যদি থাকে, তাহলে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জামায়াত বলি—সবাই নিরাপদ থাকবে। আমি মনে করি, বিএনপি-জামায়াতেরও এখন দোয়া করা উচিত শেখ হাসিনা যেন আবার ক্ষমতায় আসেন।’ এই মোনাজাত করার পর যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাকে দলীয় কর্মী না হওয়ার নসিয়ত করেন তাহলে সেটা কি কোনো গরহিত কাজ হবে?

কিন্তু হ্যাঁ, ডিসি এসপিরা ওই এসপির পক্ষ নিয়ে গত শনিবার নির্বাচন কমিশন অফিসে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে। মারমুখী আচরণ করে তারা নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমানকে বক্তৃতা মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছে। ডিসি এসপিদের এমন আচরণে হতভম্ব নির্বাচন কমিশন, বিব্রত নির্বাচন কমিশন। যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে তারা কীনা ডিসি এসপিদের তোপের মুখে আলোচনা বৈঠক বন্ধ করে দিয়ে নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। বলছে তারা ডিসি এসপিদের আচরণে বিব্রত তবে ক্ষুব্ধ নয়।.বাহ! কি চমৎকার কথা। যে নির্বাচন কমিশন এসব ডিসি এসপিদের কিছু করার ক্ষমতা রাখে না,  তাদের দিয়ে পরিচালনা করবে জাতীয় নির্বাচন? নির্বাচন কমিশনে গত শনিবার ডিসি এসপিরা যে আচরণ করেছে  সেটা কার্পেটের নিচে ঢেকে রাখার ফল ভালো হতে পারে না। তারা যে নির্বাচন কমিশনকে থোড়াই কেয়ার করে তার একটা নমুনা তারা সেদিন দেখিয়ে দিয়েছে।... কমিশন যে, এসব ডিসি এসপিকে যে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবে না  তার একটা মহড়া হয়ে গেল গাইবান্ধা উপনির্বাচনে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেটাও এদেশের জনগণকে মেনে নিতে হবে। ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে এমন নখদন্তহীন নির্বাচন কমিশন করেছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে করেছিল আগের রাতে ভোট গ্রহন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় আগের রাতে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো সে সময়কার ডিসি এসপিরা। তাদের প্রত্যক্ষ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রনে সেই রাতে ভোটের বাক্স ভরা হয়েছিলো। তারা সে সময় আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ কর্মীদের কাজে না লাগিয়ে নিজেরাই কর্ম সম্পাদন করেছিলো। যে কারণে তারা বিভিন্ন সময় দম্ভভরে বলে বেড়াতো "আমরাই আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় এনেছি, আমরাই সরকারকে টিকিয়ে রাখবো।"

এমন মাইন্ডসেট প্রশাসন বজায় রেখে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু আশা করা যায় সেটা ভেবে দেখতে হবে।



  • লেখক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


Thursday, September 29, 2022

আঁধার কেটে নতুন আলো আসবেই — মির্জা আলমগীর



সমকাল 'দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে যৌক্তিক ও মৌলিক পরিবর্তন দরকার' বিষয়ে লিখতে বলেছে। লেখালেখির অভ্যাস আজকাল নেই। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সব সুকুমারবৃত্তির মৃত্যু হয়েছে। মৌলিক কথাটিই আপেক্ষিক। ধর্মকে অনেকে মৌলিক মনে করেন। আবার অনেকে মার্ক্সবাদকে মৌলিক মনে করেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক এবং লেখকেরা বিতর্ক করবেন। আমি দার্শনিক নই, লেখকও নই। মাঠে কাজ করা রাজনৈতিক কর্মী। এটুকু বুঝি, দেশের মৌলিক পরিবর্তনে যুক্তিনির্ভর সংবিধান প্রয়োজন।


সকলের অংশগ্রহণের নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ সবচেয়ে জরুরি। সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণে সকল নীতি, আইন এবং নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্যের ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হবে, এটি প্রচলিত নিয়ম। যুক্তরাজ্যে সেই কারণেই সংসদীয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারেও সিনেট কমিটি ও কংগ্রেস কমিটি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব প্রতিষ্ঠান সংসদীয় ব্যবস্থার কাছে জবাবদিহি করে। তাই সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মার্কিন প্রেসিডেন্টও স্বেচ্ছাচারী হতে পারেন না। ইচ্ছে করলেই নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি, সেনাপ্রধান, পুলিশপ্রধানসহ কেউ সংবিধানের বাইরে যেতে পারেন না।


উদার গণতন্ত্রে এটিই মৌলিক ও যৌক্তিক ব্যবস্থা। সে কারণেই যুক্তরাজ্যে রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের অভাবনীয় ভারসাম্য রয়েছে। সেই উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল- সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নির্মিত হবে বাংলাদেশ। আমাদের আত্মা সেই সৌরভে ঘেরা অমরাবতী। দুর্ভাগ্য জাতির আত্মা নিহত হয়েছে।


মোটা ভাত, মোটা কাপড়, মাথার ওপরে ছাদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও বেঁচে থাকাই মৌলিক অধিকার। তা থেকে সিংহভাগ মানুষ বঞ্চিত। শতকরা ৪২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনসহ সর্বত্র দুর্নীতি ও দলীয়করণ দেশকে অকার্যকর করেছে। শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনা ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ভীতি ও ত্রাস মানুষের প্রতিবাদের সাহস কেড়ে নিয়েছে।


স্বাধীনতার পর থেকেই শুরু হয়েছিল বিভাজন ও ভিন্নমত নির্মূলের রাজনীতি। যুক্তিহীন ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে, মৌলিক অধিকার হরণ করে বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রের কবর দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনে এবং মিশ্র ও ক্ষুদ্র বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যৌক্তিক ও মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। তাঁর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন ঐক্য, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির যৌক্তিক ও মৌলিক ধারা সৃষ্টি করে। তিনি বাম-ডান সব মতকে নিয়ে সত্যিকারের বাস্তব রাজনীতির জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। যৌক্তিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত তৈরি করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই অগ্রযাত্রাকে রুখে দিয়েছিল দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাঁকে হত্যা করে।


দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গণভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন চিন্তাকে ভিত্তি করে দেশকে এগিয়ে নেন। সংসদীয় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মতো যৌক্তিক পরিবর্তন তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল। অর্থনীতির আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশকে উদীয়মান ব্যাঘ্র হিসেবে অভিহিত করেছিল। তবে বাংলাদেশ যেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে সত্যিকারের অগ্রগতি করতে না পারে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারে, সেই চক্রান্ত সবসময়েই ছিল। যার ফল এক-এগারো।


বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া এক-এগারো। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আধিপত্যবাদী শক্তির প্রাধান্য বিস্তার। সত্যিকারের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, বাংলাদেশকে তেমন একটি নতজানু রাষ্ট্রে পরিণত করতে পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছরে সেই ধারাই অব্যাহত রেখে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসহ রাজনীতি ও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেছে। একটা গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের দুর্নীতি, লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়ায় মানুষের উন্নয়ন হয়নি।


তথাকথিত মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে। সেখানে গুটি কয়েক লোকের হাতে টাকা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না। যে সংকট তৈরি হয়েছে, এর একদিকে জ্বালানি তেল, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতি সমস্যায় আছে। সেখানে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে অবৈধ সরকারের মদদপুষ্ট লুটপাটকারীদের লুণ্ঠন।


বহুমাত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে আবারও একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে গণমাধ্যমকে।


আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ করা হয়েছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংসদ নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে একই কাজ হয়েছে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলায় সারাদেশে ভয়-ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মিথ্যা মামলায় গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাদন্ড দিয়ে গৃহ অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে।


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। নিরপেক্ষ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারবে না বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। অথচ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারাই বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশের ভবিষ্যতের ও গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছেন। সেজন্যই বিএনপি এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে।


২০১৮ সালে কোনো নির্বাচনই হয়নি। আগের রাতে ভোটে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। সত্যিকারের যুক্তিভিত্তিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে, যখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে। গণতান্ত্রিক চর্চা হয়। দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ সেই ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। গণতান্ত্রিক পরিসর নেই। বিরোধী দল কথা বলতে পারে না। সংবাদপত্র লিখতে পারে না। নির্যাতন, দমন-পীড়ন, গুম-খুন, হত্যা, মিথ্যা মামলায় ভয়ংকর পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।


ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশ। এরকম পরিস্থিতিতে যুক্তিবোধ কাজ করে না। একজন ব্যক্তিকে খুশি করতে গোটা ব্যবস্থা চালানো হয়েছে। এক ব্যক্তির তোষণ শুরু হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ এবং সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। তা আজ পুরোপুরি চলে গেছে। এখন সংসদে বিতর্ক হয় না। বিতর্ক না হলে সেখানে থেকে কীভাবে ভালো সমাধান আশা করতে পারি। আইন পাস হয় বিতর্ক আলোচনা ছাড়াই। আওয়ামী লীগ যেভাবে চায়, সেভাবেই আইন হয়। রাজনৈতিক যুক্তিবোধ কাজ করে না। আমরা বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর কথা বলছি না। আমরা বলছি, জনগণের প্রতিনিধিত্বের সংসদ। তা না হলে, জনগণের চাওয়া, দাবিদাওয়ার সমাধান হবে না। জবাবদিহিতা না থাকলে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসবে না।


বর্তমানে কিছু ধনী মানুষ আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। বৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। যারা অনেক টাকায় ইংলিশ মিডিয়ামে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদেশে পড়তে পারে তারাই শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের কারণে শিক্ষা নেই। দুর্নীতিতে স্বাস্থ্য খাত অসুস্থ। যার টাকা আছে, তার জন্য চিকিৎসা আছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিবছর ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যান চিকিৎসার জন্য।


বিদ্যুৎ খাতেরও অভিন্ন অবস্থা। আওয়ামী লীগ দায়মুক্তি আইন করে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছে। যা খুশি তাই চলছে দায়মুক্তির কারণে। সেদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বললেন, 'যেসব প্রকল্প বিদেশি ঋণে হয়, সেগুলো এমনভাবে করা হয় যে, সেখানে দুর্নীতি হবেই। সেগুলো সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা হয় না।' এ কথার পর সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। অন্তত পরিকল্পনামন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।


আইনশৃঙ্খলা কথা আর কী বলব। প্রতিদিনই হত্যা হচ্ছে। ধর্ষণ হচ্ছে। মাদক সমস্যা ভয়াবহ। তৃণমূলে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মাদক প্রতিহতের উদ্যোগ নেই। এসবের মূল কারণ, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ নেই। জবাবদিহিতা নেই। সব চলে এক ব্যক্তির ইচ্ছায়। যাঁরা তাঁর সঙ্গে থাকেন তাঁরা তোষামোদি করেন। একটি এলিট শ্রেণি তৈরি হয়েছে। যাদের আমি বর্গী বলি। এরা বর্গীর মতো লুট করছে। বিদেশে টাকা পাচার করছে। পুলিশের সিআইডি বলছে- গত এক বছরে ৮৭ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। তার মানে সরকার সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ। এটি যুক্তির কথা।

ইলেকট্রনিক বা খবরের কাগজ সব সংবাদমাধ্যম আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন এজেন্সি সাংবাদিকদের ফোন বলে দেয়, কোন খবর যাবে, কোনটা লিড হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করেছে। আওয়ামী লীগ বনাম অন্যান্য। বিএনপির লোক হলে সে বিচার পাবে না, আইনের আশ্রয় পাবে না, মৌলিক অধিকার পাবে না, চাকরি পাবে না। এই বিভক্তির ফলে মেধার বিকাশ হচ্ছে না।


যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায়, তারা যুক্তির সঙ্গে কাজ করছে না। তারা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে - সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরোধী দলকে কাজ করতে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক স্পেস দিতে হবে। ক্যাসিনো মামলা, দুর্নীতির মামলার আসামিদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মিথ্যা মামলা হলেও খালেদা জিয়ার প্রাপ্য জামিনটা দেওয়া হচ্ছে না। ২১ আগস্টের মামলায় তিনটি প্রাথমিক রিপোর্টে তারেক রহমানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলা সাজিয়ে তাঁকে সাজা দিয়েছে। প্রধান আসামিকে মামলা চলাকালে ফাঁসি দিয়েছে।

আজ গণতন্ত্র নেই বলেই যুক্তি কখনও প্রাধান্য পায় না। বিতর্ক, জবাবদিহিতা নেই বলে সবকিছুতে ব্যর্থ হচ্ছে।


এখানে মূল লক্ষ্য 'আমাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে থাকতে হবে, লুটপাট করতে হবে।' তাহলে যুক্তি খাটবে না। পরামর্শ একটাই, গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। যতই অন্ধকার থাক, কাল নতুন দিনে নতুন সূর্যের আলো সব আঁধার কেটে নতুন বাংলাদেশে আলো ছড়াবেই। সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিভিত্তিক একটি মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে।


লেখক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

সমকাল/ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২

Monday, September 5, 2022

৮ হাজার কোটি টাকার ইভিএম কার স্বার্থে?

  • ভারতের চেয়ে ১২ গুণ বেশি দামে ইভিএম
  • বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম পড়ছে আড়াই লাখ টাকা
  • ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা
  • ইসির মোট ব্যয় হবে ৮ হাজার,আরো বাড়তে পারে 
  • ইভিএম তৈরির জন্য  কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি
  • কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিত



আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য আরও ২ লাখ নতুন ইভিএম ক্রয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রকল্পের আওতায় কেনা হবে নতুন ২ লাখ ইভিএম। প্রতিটি ইভিএম মেশিনের দাম হবে প্রায় আড়াই লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া ইভিএম সংরক্ষণে প্রকল্পের অধীনে ১০ অঞ্চলে ৬০-৬৫ হাজার স্কয়ার ফিটের ওয়্যারহাউস নির্মাণ; ১০০০ থেকে ১২০০ জন জনবল নিয়োগ; গাড়ি ক্রয়, ইভিএম পরিচালনায় ২ থেকে আড়াই লাখ দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ ও দেশব্যাপী ইভিএমের ব্যাপক প্রচারণার জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এ প্রকল্পে। ৮ সেপ্টেম্বর এ প্রকল্পের খসড়া নির্বাচন কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন অনুমোদন করলে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

  

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সময়ে প্রতিটি ইভিএম কেনা হয়েছিল ২ হাজার ৩৮৭ ডলারে। তখন ডলারের মূল্য ৮৪ টাকা হিসেবে একটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা (ভ্যাট-ট্যাক্সসহ)। 


এ ছাড়া একটি ইভিএম ইউনিটের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছিল আরও ২৫ হাজার টাকার। সব মিলে তখন একটি ইভিএমের মূল্য ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার টাকার বেশি। এবারও প্রতিটি ইউনিটের সম্ভাব্য মূল্য ধরা হচ্ছে ২ হাজার ৩৮৭ ডলার। এক্ষেত্রে ডলারের মূল্য ৯৫-৯৬ টাকা হিসাবে প্রতি ইউনিটের মূল্য হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৫ টাকা অথবা ২ লাখ ২৯ হাজার ১৫২ টাকা। আর প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে অন্যান্য জিনিস প্রয়োজন হবে আরও প্রায় ২৫ হাজার টাকার। এর বাইরে প্রতি ইউনিটের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাট-ট্যাক্স। সব মিলে একটি ইভিএম মেশিন তথা প্রতিটি ইভিএম ইউনিটের মূল্য আড়াই লাখ টাকার বেশি হতে পারে। 


ইভিএমের নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ইভিএম ক্রয়ে খরচ হবে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ-ভবন নির্মাণ, জনবল নিয়োগ, গাড়ি ক্রয় ও দেশব্যাপী ইভিএমের ক্যাম্পেইন, ইভিএম পরিচালনায় দক্ষ জনবল তৈরির প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ হবে আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সব মিলে এ প্রকল্পের চূড়ান্ত ব্যয় কমতে ও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 


ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন, ইসি সচিবালয় থেকে একটি ডিপিপি প্রস্তুত করতে বলেছে। আমরা প্রস্তুত করছি। ইভিএমের ইউনিট মূল্য আগেরটাই থাকছে। তবে তার সঙ্গে ডলারের মূল্য বেড়েছে সেটা এবং ভ্যাট-ট্যাক্স অ্যাড হবে। সব মিলে অল্প কিছু মূল্য বাড়বে।  


প্রকল্পে কী কী থাকছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ইসি সচিবালয় যাতে নিজস্ব জনবল ও ক্যাপাসিটিতে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ, ইভিএম সংরক্ষণ করতে পারে সে বিষয়গুলো থাকছে। এ জন্য জনবল প্রয়োজন, ওয়্যারহাউস প্রয়োজন হবে। 


তিনি বলেন, আগের দেড় লাখ এবং নতুন প্রকল্পে কেনা হবে ২ লাখ, সব মিলে সাড়ে ৩ লাখ ইভিএম হবে ইসির হাতে, তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য ১০ অঞ্চলে ১০টি ওয়্যারহাউস নির্মাণের প্রাথমিক চিন্তা রয়েছে। একটি ওয়্যারহাউসে ৪০-৪৫ হাজার ইভিএম সংরক্ষণ করা যাবে, সেরকম নকশা করা হচ্ছে। এ জন্য গাড়িও প্রয়োজন হবে। তবে কত গাড়ি প্রয়োজন হবে তা পরে নির্ধারণ হবে। 


সম্ভাব্য ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার তার চেয়ে কিছু টাকা বাড়বে। ইউনিট মূল্য নির্ধারণে বাজার কমিটি কাজ করছে। বিগত প্রকল্পে ইউনিট (প্রতিটি ইভিএম) মূল্য ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। এটাকে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও ২ লাখ ইভিএম কিনতে হবে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদে মোট সাধারণ আসন রয়েছে ৩০০টি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়েছিল। 


বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে, যা দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে। তবে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলেও আরও ২ লাখ ইভিএম ক্রয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। আগামী বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে আগামী বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তফসিল ঘোষণা হতে পারে। 


ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে দেশে ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। এ প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ করতে প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একটি ইভিএম প্রয়োজন হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বিবেচনায় রেখে প্রতি কেন্দ্রের জন্য মোট কক্ষের অর্ধেকসংখ্যক ইভিএম অতিরিক্ত সংরক্ষণ করা হয়। তবে প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দেশে ভোটার বাড়ছে এবং পাঁচ বছরে প্রায় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোটার বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যাও বাড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে। 


ইসির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের জন্য সাড়ে ৩ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রথম সংসদ অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ প্রথম অধিবেশন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। সে হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সংসদের মেয়াদ রয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের নব্বই দিনের কথা বলা হয়েছে। সেই হিসেবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।


কেনা সম্ভব না হলে ইভিএমে ভোট ৭০-৮০ আসনে : নতুন প্রকল্পের অধীনে যথাসময়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা সম্ভব্য না হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেছেন, সচিবালয় যথাসময়ে ইভিএম দিতে পারলে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হবে। না হলে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট হবে। গতকাল নির্বাচন ভবনের নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।


বাংলাদেশ প্রতিদিনের  আজকের(৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)  পত্রিকায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।  


.....এর আগে ২০১৮ সালে ৮ নভেম্বর প্রথম আলো প্রথম দফায় ইভিএম কেনার সময় এর অযৌক্তিক মুল্য নির্ধারণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল "ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম"।


ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।অথচ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা।


ইভিএম তৈরির জন্য কারিগরি–পরামর্শক কমিটি করেছিল ইসি। সেই কমিটিরই সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নেওয়া হয়নি।


প্রতিবেদনে বলা হয়,ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনছে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি ইভিএম কিনতে খরচ করবে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য যে ইভিএম তৈরি করেছিল, তার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০-২২ হাজার টাকা। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকলেও দামের বিশাল পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।


ভারতের নির্বাচন কমিশন ওই দেশের লোকসভা, রাজ্যসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য নতুন মডেলের ইভিএমের দাম নির্ধারণ করেছে ১৭ হাজার রুপি। প্রতি রুপি ১ টাকা ২৫ পয়সা হিসেবে ধরে বাংলাদেশি টাকায় ভারতের ইভিএমের দাম পড়ে ২১ হাজার ২৫০ টাকা। সেই হিসাবে ১১ গুণ বেশি খরচ করে ইভিএম কিনছে বাংলাদেশ। তবে ইসি দাবি করছে, গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের ইভিএমের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম পড়ছে।


এদিকে এই ইভিএম তৈরির ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটির সুপারিশও পুরোপুরি আমলে নেয়নি ইসি। ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য কমিটি ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) সুবিধা রাখার পরামর্শ দিলেও তা রাখা হয়নি। এতে ভোট পুনর্গণনার বিষয় এলে ইসিকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।


২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ইসি। সংসদে আরপিও সংশোধনী পাস হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় ইসি।


নতুন ইভিএম কেনার জন্য ইসির ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাস করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ওই প্রকল্পে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট প্রকল্পে ব্যয়ের ৯২ শতাংশ। আগামী ছয় বছরে তিন পর্যায়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার ঘোষণা দেওয়া হলেও প্রকল্পের দলিল বলছে ভিন্ন কথা। শুধু চলতি অর্থবছরেই ১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্ধেকের বেশি টাকা চলতি অর্থবছরে খরচ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্প দলিলে আন্তর্জাতিক বাজারে ইভিএমের দাম ২ থেকে ৩ হাজার ডলার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।


ভারত ও বাংলাদেশের ইভিএম

ইভিএম নির্মাণ করে এমন কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সাধারণত ভোটার ও প্রার্থীসংখ্যা, ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভোট গণনা, সার্ভার-সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের স্পেসিফিকেশনের ওপর ইভিএমের দাম নির্ভর করে।


ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রপ্রতি ভোটারের সংখ্যা প্রায় একই রকম। ভোটারদের শিক্ষার হার ও সচেতনতা প্রায় একই পর্যায়ের। দামের এত পার্থক্য থাকলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ইভিএমের পার্থক্য খুব বেশি নয়। বাংলাদেশের ইভিএমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বা হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। ভারতের ইভিএমে এই সুবিধা নেই। তবে ভারতের ইভিএমে ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে সেই সুবিধা নেই।


বাংলাদেশের ইভিএমে তিনটি অংশ আছে। এগুলো হলো কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যালট ইউনিট ও ডিসপ্লে ইউনিট। ভোটারের নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে আঙুলের ছাপ দেওয়া সঙ্গে সঙ্গে ডিসপ্লেতে ওই ভোটার ছবিসহ যাবতীয় তথ্য চলে আসবে। ব্যাটারির মাধ্যমে ইভিএম চলবে। চার্জ থাকবে ৪৮ ঘণ্টা। ইভিএমের সঙ্গে বাইরের কোনো ইন্টারনেট বা এ ধরনের কোনো সংযোগ থাকবে না। ফলে এটি হ্যাক করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্প দলিলে বলা হয়েছে, ইভিএমের ওয়ারেন্টি ১০ বছর নিশ্চিত করতে হবে।


ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, আগামী নভেম্বর মাস থেকে ১৬ লাখ ইভিএম কেনা শুরু করবে ভারতের নির্বাচন কমিশন। নতুন মডেলের ওই ইভিএমে কন্ট্রোল ইউনিট ও ব্যালট ইউনিট—এই দুটি ইউনিট আছে। সর্বোচ্চ ৩৮৪ জন প্রার্থী থাকলেও এই ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে। একটি ইভিএমে সর্বোচ্চ দুই হাজার ভোট নেওয়া যাবে। এই ইভিএম ব্যাটারিতে চলবে। ভারতের ইভিএমে ভোট দেওয়ার কক্ষেই একটি স্বচ্ছ বাক্স থাকে। ভোটার ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইভিএম থেকে একটি কাগজে ছাপা হয়ে স্বচ্ছ বাক্সে পড়বে। মূলত ভোটাধিকারের দলিল বা ব্যালট হিসেবে এটি কাজ করবে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ হিসেবে এটি রাখা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে যেসব ইভিএম ব্যবহার করেছিল, সেগুলোর দাম ছিল ৮ হাজার ৬৭০ রুপি করে।


ইভিএম প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম নির্ভর করে যন্ত্রাংশের মান ও ‘কনফিগারেশনের’ ওপর। তাঁরা সবচেয়ে মানসম্পন্ন ইভিএম তৈরি করছেন, যাতে ১০-১৫ বছর ব্যবহার করা যায়। ইভিএমের দাম বেশি পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএমের দাম প্রায় চার হাজার ডলার। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাঁরা তুলনা করে দেখেছেন, বাংলাদেশের ইভিএমের দাম তুলনামূলক কম পড়ছে।


বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে নতুন ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। ইতিমধ্যে চীন ও হংকং থেকে ইভিএমের মূল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আনার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিএমটিএফ। সাধারণ ঋণপত্র খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। তবে আমদানির প্রক্রিয়া ভিন্ন বলে ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ইভিএম আমদানির জন্য এ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিতে হয়েছে।


এর আগে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বাংলাদেশে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে। ওই ইভিএম তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েটের তৈরি ইভিএমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি ইভিএমে হয়েছিল। ওই ইভিএমে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করার ব্যবস্থা ছিল না। ভিভিপিএটি সুবিধাও ছিল না।


ওই ইভিএম তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের জন্য বুয়েট ১ হাজার ১০০টি ইভিএম তৈরি করেছিল। প্রতিটি ইভিএমের খরচ পড়েছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। বৃহৎ আকারে উৎপাদনে গেলে খরচ আরও কমে যেত। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভিভিপিএটি সুবিধা যুক্ত করে ৪০-৫০ হাজার টাকার মধ্যে ইভিএম তৈরি করা সম্ভব। তিনি বলেন, বৈশিষ্ট্যের কারণে ইভিএমের দামের তুলনা করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ধরা হলে তা একটু অস্বাভাবিকই।


কমিটির সুপারিশ মানা হয়নি

ইভিএম কেনার প্রকল্প প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, ইভিএম তৈরির জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) নমুনা ইভিএম তৈরি করেছে। তবে ইসির এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়।


নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নতুন ইভিএম পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে ইসি। ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর তাদের প্রথম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে নতুন ইভিএমের নমুনা দেখানো হয়। বৈঠকে জানানো হয়, নতুন ইভিএম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুজন অধ্যাপকের পরামর্শে পোল্যান্ডের একদল কারিগরি সদস্যের সহায়তায় তৈরি করা হয়। ওই বৈঠকে নতুন যন্ত্রে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি কমিটির আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আবারও পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে বলা হয়, ভোটারদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইভিএমের সঙ্গে পেপার অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে ভোট দেওয়াসংক্রান্ত তথ্যের হার্ড কপি ভোট প্রদান শেষে সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু নতুন যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোতে এই সুবিধা নেই।


এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটি পেপার ট্রেইলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু উপকমিটি দেখেছে, পেপার ট্রেইল যুক্ত করে অনেকে ঝামেলায় পড়েছে। ভারতে ১৫-১৮ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করতে হয়েছে পেপার ট্রেইলে সমস্যার কারণে। পেপার ট্রেইল মূলত ভোটারের মানসিক শান্তির জন্য যুক্ত করা হয়। এই ইভিএমে ভোটার যে মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য ঠিক করবেন, সে মার্কা স্ক্রিনজুড়ে বড় হয়ে ভেসে উঠবে। এটি ইলেকট্রনিক্যালি করা হয়েছে পেপারে না যাওয়ার জন্য।


জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে—এই বক্তব্য আংশিক সত্য। তিনি কমিটির দুটি বৈঠকে অংশ নেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, মেশিন ঠিক আছে। কিন্তু মেশিনের সঙ্গে ভিভিপিএটি যুক্ত করতে হবে। ভিভিপিএটি ছাড়া মেশিন গ্রহণযোগ্য হবে না।


জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কারিগরি কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করে ইসি সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। একটি সাব-কমিটি বৈঠক করে কারগরি কমিটির ওই সুপারিশ বাদ দিয়েছে। সুতরাং এখানে আমার নাম ব্যবহার করা ইসির ঠিক হচ্ছে না।

Saturday, September 3, 2022

বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি — ৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ


কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটি ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া নামে পরিচিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।


এই অর্থ দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে।

এই বোঝা হালকা করতে সরকারকে যেমন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তেমনি বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত টাকাটা গ্রাহকদের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।


বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি কেন্দ্রকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।


এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতেও থাকছে ক্যাপাসিটি চার্জ।    


বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের করা ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী, সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন বা কেনা না হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট হারে অর্থ (ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধ করতে হবে। এই ৯০ হাজার কোটি টাকা সেই অর্থ, যা কম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই পেয়েছে।


জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ধারণা ছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোবে, তাতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেভাবে বিদ্যুিভত্তিক উৎপাদন বা শিল্প-কারখানা হয়নি। তাই এখন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তা না হলে, অতিরিক্ত দামের বিদ্যুতের কারণে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।   


জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, তেলভিত্তিক কিছু কেন্দ্র আছে, যেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না, অথবা সারা বছরে অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সেগুলোকে শতকোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এমন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।


ম. তামিম বলেন, মূলত বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রিজার্ভ রাখতে হয়। এই কেন্দ্রগুলো যখন বসে থাকবে, তখন শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে। তবে রিজার্ভে রাখার বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করে রাখতে হবে, যাতে কোনোভাবেই অতিরিক্ত না হয়।


গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া। যদি কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে না রাখা হয়, তাহলে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উঠে গেলে সেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কে দেবে? পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য বাকি সময় অলস বসে থাকার জন্য যে চার্জ দেওয়া হয় তা-ই ক্যাপাসিটি চার্জ।


এলএনজিভিত্তিক তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রও ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে

বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে টাকা ব্যয়ের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের এক হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) আরো তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটি নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে।


চলতি বছরের অক্টোবরে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা। বাকিটির উৎপাদনের সময় আগামী বছরের মার্চ নাগাদ শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে।


খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ব্যাপক বেড়েছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে পিডিবিকে।


এই বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলএনজি কোথা থেকে আসবে, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এলএনজির অভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘এটা একটা মারাত্মক ভয়ের ব্যাপার। সামনে এই কেন্দ্রগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এলএনজি না দিতে পারলে একসময় এমন হতে পারে, দেশের বিভিন্ন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে এগুলোকে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ করতে হতে পারে। গ্যাসসংকটে এখনই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ’


পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনও কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলএনজিভিত্তিক এই তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে গ্যাসসংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমন সংকট যে চলে আসবে, তা তো আগে জানার উপায় ছিল না। তবে এই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে আসতে দেশীয় কূপগুলো থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়তে পারে। ’


পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র : দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ৪,৫০০ কোটি টাকা

এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় এখন কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। উৎপাদন শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। কেন্দ্রটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলেও গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।


পিডিবি সূত্রে জানা যায়, পায়রা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ চলতি বছরের ডিসেম্বরেও শেষ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এই কেন্দ্র থেকে পুরো বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াই আরো ছয় মাসের বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে।


জানতে চাইলে ম. তামিম বলেন, সঞ্চালন লাইনের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ আনা যাচ্ছে না। কয়েক মাস পর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও উৎপাদনে আসবে। রামপালের বিদ্যুৎও একই সঞ্চালন লাইন দিয়ে আসবে। তাই এই সঞ্চালন লাইন যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে করা না যায় তাহলে পায়রার মতো রামপালকেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।


রেন্টাল, কুইক রেন্টালের ‘স্বল্প মেয়াদ’ দীর্ঘ হচ্ছে

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় অতি দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের তাত্ক্ষণিক পরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুরু করে। এরপর পেরিয়ে গেছে এক যুগ। সেই আপৎকালীন ‘স্বল্প মেয়াদ’ আজও শেষ হয়নি। অর্থনীতির ওপর বোঝা তৈরি করার পরও বারবার বাড়ানো হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ।


বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। বাকি আটটিকে আগের নিয়মে ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে।


জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের। এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো তা আমি বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরো কয়েকটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে বলে মনে হয়। ’


তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দাবি করেন, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল এখন আর নেই। এখন যেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে না।


বিদ্যুৎ আমদানিতেও ক্যাপাসিটি চার্জ

ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।


বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপের নির্মাণ করা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী মাসের শেষ দিকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ইউনিটের ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা থাকলেও সাবস্টেশন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে ৪০০ মেগাওয়াট দেশে আনা হতে পারে। চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে আদানি গ্রুপকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা দিতে হবে।


জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে।


শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের চাহিদাই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এগুলো বিদ্যুতের জন্য করা হয়নি। ব্যবসা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে সরকারের টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।


  • সূত্র - কালের কণ্ঠ / সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ 

Tuesday, August 30, 2022

তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান

দ্যা ডেইলি স্টার/ আগস্ট ৩০, ২০২২



'আমাদের প্রিয় মানুষটি কেমন আছেন? তিনি কি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন? তাকে কি নির্যাতন করা হয়? তিনি কি... বেঁচে আছেন?'

এসব প্রশ্ন 'গুম'র শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের তাড়া করে। কারণ, তারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আশা নিয়ে সপ্তাহ, মাস ও বছর কাটান।

বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫২২ জন 'গুম' হয়েছেন বলে জানিয়েছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।

'গুম' থেকে মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি ফেরার পর জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে থাকেন। তারা কোথায় ছিলেন বা কে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রকাশ করেন না।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) গত মার্চের সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া 'গুমের' ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, 'গুম' হওয়া ৩০ শতাংশ ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের কেউই এ বিষয়ে কথা বলেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে 'গুম' থেকে ফিরে আসা ৫ জন তাদের প্রিয়জনদের প্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

যদিও পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে প্রতিটি অলি-গলিতে খুঁজেছিলেন, তবুও সেই ব্যক্তিদের দাবি, তারা রাজধানীর ভেতরেই ছিলেন।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের ভাষ্য, ঢাকায় কমপক্ষে ২টি কেন্দ্র আছে যেখানে 'গুম' হওয়া ব্যক্তিদের রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এর একটি নিরাপত্তা বাহিনী ও অন্যটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিচালনা করে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলাতে আরও একটি কেন্দ্র আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের দাবি, কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি অবৈধ এক কারাগার। জনগণের টাকায় আইনশৃঙ্খলা ও দেশকে রক্ষার নামে এসব কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।

সূত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে দ্য ডেইলি স্টারে ইউনিটগুলোর নাম প্রকাশ করা হলো না।

বেঁচে থাকা ২ জনের বর্ণনা একটি অপরটির সঙ্গে মিলে যায় এবং একটি কেন্দ্রের দিকে নির্দেশ করে। ধরি কেন্দ্রটি 'উ'।

বেঁচে থাকা অপর ৩ জনের বর্ণনা দ্বিতীয় একটি কেন্দ্রের নির্দেশ করে। ধরি সেটি হচ্ছে 'ক'।

তাদেরকে ২ মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। তাদের আটকে রাখা হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে।

বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ৪ জনকে রাজনৈতিক কারণে এবং তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল। অপর একজন, যাকে 'ক' কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল, তুলে নেওয়া হয়েছিল ভুল পরিচয়ে।

তাদের সবাইকে ঢাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যা সিজিএসের গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়—যেখানে দেখা গেছে যে এক-তৃতীয়াংশ গুমের ঘটনা ঘটেছে শুধু রাজধানীতে।

বর্ণনায় 'উ' কেন্দ্রে ভুক্তভোগীরা কঠোর ও অমানবিক জীবনযাপন এবং নির্যাতনমূলক জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলেছেন। 'ক' কেন্দ্রের ভুক্তভোগীরা বন্দিদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে এমন একটি কারাগারের বর্ণনা দিয়েছেন।

উভয়ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্জন কারাবাসে, নির্বিচারে ও বেআইনিভাবে অন্তহীন সময়ের জন্য আটকে রাখার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বন্দি জানেন না যে তিনি মুক্তি পাবেন, নাকি এখানেই তার জীবন শেষ হবে।

কেন্দ্র 'উ' এ বন্দিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তাদেরকে প্রায় আড়াই ফুট প্রস্থ, ৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৫ ফুট উচ্চতার কক্ষে বন্দি রাখা হয়েছিল। 'এমনভাবে কেউ শুয়েও থাকতে পারবে না বা দাঁড়ায়েও থাকতে পারবে না। সেখানে সব সময় আধা বসা ও আধা শোয়া অবস্থায় থাকতে হবে।' কক্ষের ৩ দিকে কংক্রিটের দেয়াল এবং ১ দিকে কারাগারের দরজা ছিল।



বন্দিদের মধ্যে ১ জনকে দক্ষিণের একটি জেলায় স্থানান্তরের আগে ৪ মাস সেখানে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে একই কেন্দ্রের মধ্যে একটি বড় সেলে স্থানান্তরের আগে আরেক বন্দিকে সেখানে এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে রাখা হয়েছিল।

উভয় বন্দিই 'উ' কেন্দ্রে থাকাকালীন পুরো সময় চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিলেন বলে জানান।

একজন বন্দি বলেন, 'খুব অন্ধকার ছিল, কিন্তু তারপরও আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকেরই চোখ বাঁধা ছিল। সেলটি ২ তলা মাটির নিচে ছিল। তারা সেখানে অন্তর্বাস ছাড়া বাকি সব জামা-কাপড় খুলে ফেলে। একটি লুঙ্গি দেয়। লুঙ্গিটি অনেক পরে, বিবস্ত্র করার অনেক ঘণ্টা পরে দিয়েছিল।'

গুম: ‘নিখোঁজ’র পর ‘আটক’ ও জীবন থেকে হারানো কয়েকটি দিন

Read more

সেখানে একজন প্রহরী তাদের অবস্থা দেখে দয়া করে গোপনে রাতে তাদের হাতকড়া খুলে দিতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের বন্দিত্বের পুরো সময়কালে হাত পিছনে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা ছিল। শুধুমাত্র খাওয়া ও টয়লেটে যাওয়ার সময় খুলে দেওয়া হতো।'

'উ' কেন্দ্রে ৩ মাসের কম সময় বন্দি থাকা একজন বলেন, 'একজন চাচা ছিলেন, প্রবীণ প্রহরী; তিনি কয়েক ঘণ্টার জন্য মধ্যরাতের পর আমাদের হাত খুলে দিতেন। তখন আমরা চোখ খুলতে পারতাম। আমি বন্দি থাকাকালীন ৩ রাতে তাকে পেয়েছিলাম।'

তিনি জানান, 'উ' কেন্দ্রে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে একটি বড় সেলে স্থানান্তর করা হয়। 'আমি ধাতবের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় সেলে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি বড় ঘর ছিল, কিন্তু সেটি ছিল অত্যন্ত গরম এবং সেখানে প্রচুর মশা ছিল। সেখানে স্ট্যান্ডফ্যান ছিল, কিন্তু সেটা মাঝে মাঝে চালু করা হতো। তারা জানতো ঠিক কতক্ষণ সেটি চালালে আমরা বেঁচে থাকতে পারব।'

তিনি আরও বলেন, 'মেঝেটি ভাঙা সিমেন্টের ছিল এবং আমাদেরকে মেঝেতে বিছানা ছাড়াই ঘুমাতে হতো। আমাকে এক বোতল পানি দেওয়া হয়েছিল এবং সেটিকেই আমি বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম। রাতে মেঝে যে এত ঠাণ্ডা হতে পারে…'

৬ মাসের কম সময় কেন্দ্রে থাকা আরেক বন্দি বলেন, 'যতদিন আমি ওই কেন্দ্রে ছিলাম, আমাকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রটি সম্ভবত ৩ তলা মাটির নিচে ছিল।'

তিনি জানান, এটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কারণ যখন তাকে অন্য কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তখন তারা তাকে ৩ তলায় উঠতে বাধ্য করেছিল এবং তারপরে তিনি সরাসরি সেই তলায় থাকা একটি গাড়িতে উঠেছিলেন।

প্রথম বন্দির মতো তার সেলটিতেও শোয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না এবং তিনি কয়েক মাস ধরে বসে ছিলেন।

ভুক্তভোগী ২ জনই জানান, খাবার দেওয়ার সময় প্লেট ও দরজার আওয়াজ শুনে তারা বন্দিদের সংখ্যা গণনা করেছেন।

প্রথম বন্দি বলেন, তার মনে আছে ১২টি সেল গুনেছিলেন, যেগুলো ছিল মুখোমুখি। 'একজন দয়ালু প্রহরীর সহযোগিতার কারণে যখন প্রথমবারে মতো চোখ খুলতে পেরেছিলাম তখন আমার বিপরীত পাশের সেলটি দেখেছিলাম। যখন তারা আমাদেরকে খাবার দিতো তখন আমি সেলের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ থেকেও গুনেছি।'

দ্বিতীয় বন্দি বলেন, 'ওই দীর্ঘ হলটিতে আমরা প্রায় ১৪ জন ছিলাম। খাবারের সময় মেঝেতে ধাতব প্লেটের আওয়াজ শুনে আমি এটা গুনেছি।'

একইভাবে, তাদেরকে আটকের সময়কালে ৫ বছরের ব্যবধান থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ২ জনকেই নির্যাতন করা হয়েছিল।

একজন বলেন, 'আমাকে ৬ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমার শরীরের প্রতিটি অংশে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের নির্যাতনের পদ্ধতি সিনেমার মতো। তারা উপরে থেকে তীব্র তাপ দেওয়ার জন্য কিছু একটা ব্যবহার করেছিল। তাদের নির্যাতনে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে। আমি সেলে ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।'

অপরজন দাবি করেন, 'আমাকে গোড়ালি ও কব্জি বেঁধে একটি কাঠের চেয়ারে বসানো হয়েছিল। তারা আমার কানের লতিতে ২টি ক্লিপ সংযুক্ত করে, যেগুলো ২টি ব্যাটারির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারা একটি করে প্রশ্ন করে আর আমার কানে শক দেয়। তারা হুমকি দিতে থাকে যে আমি তাদেরকে সহযোগিতা না করলে আমার যৌনাঙ্গে ক্লিপ লাগিয়ে দেবে। তাদের নির্যাতনে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি প্রার্থনা করার চেষ্টা করলে আমাকে মারধর করা হবে বলে তারা বলতেন। তারা বলতেন যে আমার মতো পাপীর প্রার্থনা করার দরকার নেই।'

তিনি অপর একটি কেন্দ্রে নির্যাতনের আরেকটি পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন। রাজধানী থেকে তুলে নেওয়ার পর তাকে রাজধানীর বাইরে দক্ষিণ দিকে অন্য একটি কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

দ্য ডেইলি স্টার আটক ব্যক্তির নিরাপত্তার স্বার্থে জেলার নাম প্রকাশ করছে না।

তিনি বলেন, 'সেই জায়গায় পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। সেই জেলায় যাওয়ার পথে বাসের কন্ডাক্টররা যখন যাত্রীর জন্য চিৎকার করে এলাকার নাম বলছিল, সেটা শুনেছিলাম। তাই জানি যে আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জায়গাটির খুব কাছেই একটি লঞ্চ জেটি ছিল, কারণ আমি সেখানে থাকার সময় জাহাজের হুইসেল শুনতে পেয়েছি।'

তিনি বলেন, ওই কেন্দ্রে নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল জোর করে খাওয়ানো। 'তারা ৭-৮ কেজি গরুর মাংসের বালতি নিয়ে আসত। আমাকে বলত, আপনাকে এর অর্ধেক খেতে হবে। প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য ৬টি ডিম দিত।'



'আপনার কোনো ধারণাই নেই যে তারা প্রত্যেক বন্দির পিছনে কত টাকা খরচ করে', যোগ করেন তিনি।

ওই নির্দিষ্ট কেন্দ্রে দেয়ালগুলো ছিল ঢেউতোলা টিনের এবং বন্দিদের যেখানে রাখা হতো সেগুলো বড় বড় পশুর খাঁচার মতো। 'আমি সেগুলোর ভেতরে পা ছড়াতে পারতাম। সেখানে, আমার হাত সামনের দিকে আটকে রাখার পরিবর্তে, একটি হাত একটি হ্যাণ্ডকাফের সঙ্গে আটকে সেটিকে খাঁচার বাইরে একটি হুকের সঙ্গে সংযুক্ত লম্বা দড়িতে বাঁধা ছিল।'

লম্বা ঘরের ভেতরে ৪টি খাঁচা ছিল বলে জানান তিনি।

'একটা সময় আসে, যখন অন্য ৩ জনকে একদিন নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ফিরে এসে বলেন, ওই ৩ জনের একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য ২ জনকে "ক্রসফায়ারে" গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আতঙ্কে ছিলাম যে, এই ভাবেই আমাকেও হত্যা করা হবে', যোগ করেন তিনি।

'ক্রসফায়ারে'র হুমকি জিজ্ঞাসাবাদের একটি হাতিয়ার এবং নির্যাতনের পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 'আমাকে শহরের একটি বড় হাইওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হ্যাণ্ডকাফ লাগিয়ে। আমি জানি না সেটা কোন হাইওয়ে। যখন আমরা সেখানে পৌঁছলাম, সবাই আমাকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে একজন লোক ঢুকছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চান, আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কি কি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে দৌড়াতে বলা হয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে পেছন থেকে গুলি করা হবে, তাই আমি দৌড় না দিয়ে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম', বলেন তিনি।

আটককৃতরা উভয়েই বলেন, বন্দিশালাগুলোর ভেতর থেকে যেন শব্দ বাইরে না যায় সেজন্য বড় মেশিনের শব্দ ব্যবহার করা হতো।

একজন বন্দি বলেন, একটি বড় জেনারেটর সব সময় চলত। আওয়াজের কারণে আমার নাক-গলা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।

অপর বন্দি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে খুব জোরে গান বাজানো হতে। 'এতে আমার মাথা ব্যথা শুরু হতো।'

তিনি আরও বলেছিলেন যে তাকে মাঝরাতে গোসল করতে হতো। 'আমি খালি গায়ে থাকতাম এবং একটাই লুঙ্গি ছিল। প্রতিবার লুঙ্গি ভিজালে না শুকানো পর্যন্ত ভেজা লুঙ্গিটিই পড়ে থাকতে হতো। আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এবং এভাবে ভেজা লুঙ্গি পড়ে থাকা ছিল আমার জন্য নির্যাতন।'

৫ বছর পরে কেন্দ্রে লন্ড্রি সিস্টেমের কিছুটা উন্নত হয়। অপর বন্দি বর্ণনা করেন, 'তাদের কাছে লুঙ্গি ও টি-শার্ট ছিল। বন্দিদের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দেওয়া হতো। আমরা টি-শার্ট ও লুঙ্গি ধুয়ে শুকাতে পারতাম এবং বদলে নিতে পারতাম।'

বন্দি উভয়েরই চুল-দাড়ি কাটা হয়েছিল মুক্তির ঠিক আগে, একবারই।

কেন্দ্র 'ক'

কেন্দ্র 'ক' এর ৩ বন্দি তাদের বর্ণনায় কেন্দ্র 'উ' এর থেকে তুলনামূলক ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বলেছেন এবং নির্যাতনের কথা বলেননি।

সব বন্দি কেন্দ্রটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারাগার বলে বর্ণনা করেছেন। যেখানে নিজস্ব রান্নাঘর, সেলুন, ডাক্তারের কক্ষ, বাথরুম, বিছানা ও কম্বলসহ কক্ষ, হাই কমোড টয়লেট এবং এমনকি বন্দিদের পড়ার জন্য বইও রয়েছে।

বন্দিদেরকে অনেকে সম্মানের সঙ্গে 'স্যার' বা 'চাচা' বলে ডাকতেন।

কিন্তু এর কোনোটিই এই সত্যকে অস্বীকার করে না যে, ওই বন্দিদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২ বছর পর্যন্ত নির্জন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল এবং তাদের পরিবার জানত না যে তারা মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন।

এক বন্দি বলেন, 'আমার ঘরে একটি লোহার খাট ছিল এবং গদি তৈরি করার জন্য ৪টি কম্বল দেওয়া হয়েছিল। একটি লাইট সব সময় জ্বলত এবং একটি দরজার কোণে এক্সজস্ট ফ্যান চলত।'

সাধারণ পেশাদার ওই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রমের জন্য।

বন্দি হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি পড়ার জন্য একটি বই চেয়েছিলেন। 'তারা আমারকে একটি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড দেন এবং যখন আমি প্রথম খণ্ড চাইলাম, তারা জানান যে সেটি অন্য একজন বন্দি পড়ছেন। পরে, যখন আমি একটি বইয়ের নাম বলে চাইলাম, তখন তারা সেটি দোকান থেকে কিনে আনেন। তবে বইয়ে দোকানের নাম লেখা প্রথম পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।'

বন্দিদের হাতকড়া পড়ানো হয়নি, এমনকি কক্ষে থাকা অবস্থায় চোখও বেঁধে রাখা হয়নি। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে তাদের কক্ষে ২টি দরজা ছিল। একটি জেল সেলের মতো দণ্ডযুক্ত এবং আরেকটি শক্ত দরজা। তাই তারা বাইরে কিছুই দেখতে পাননি।

তিনি বলেন, 'দরজার নিচে দিয়ে একটি ছোট ফাঁক বানানো ছিল, সেখান দিয়ে খাবার কক্ষের ভেতরে দিত। আমি ঘরের ভেতরেই হাত ধুতাম।'

প্রতিবার কক্ষের বাইরে নেওয়ার সময় তাদের পুরো মাথা কালো একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতো এবং হাতকড়া পড়ানো হতো। টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একই কাজ করা হতো।

তিনি বলেন, 'একবার কালো কাপড়টি সড়ে গেলে আমাকে যে প্রহরী নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি আবার সেটি পড়ানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। আমি আমার ডানদিকে একটি রান্নাঘর এবং সেখানে একজন নারীকে রান্না করতে দেখলাম।'

সব খাবার গরম গরম পরিবেশন হতো এবং বন্দিরা খাবার বেছে নিতে পারতেন। একজন বন্দি বলেন, 'দুপুরের খাবারের সময় আমাকে শাক, তেলাপিয়া মাছ, ২টি ডিম ও ডাল দেওয়া হয়। আমি যখন তাদের বলি যে আমি চাষ করা মাছ ও ডিম খেতে চাই না, তখন তারা আমার জন্য গরুর মাংস নিয়ে আসেন।'

তিনি আরও বলেন, 'রোজায় সেহরিতে আমাকে গরম দুধ, একটি বড় কলা, ভাত, শাকসবজি ও প্রোটিন এবং ইফতারের জন্য ফল, জুস, ভাজা খাবার, ছোলা ও মিষ্টি দেওয়া হতো।'

বেশ কয়েকজন বন্দি বর্ণনা করেছেন যে বিশেষ দিনগুলো তারা বিশেষ খাবার পেতেন। সকালে পরাটা, সেমাই, ভাত ও বাদামের মিষ্টি এবং দুপুর ও রাতে তেহারি, ভাত, গরুর মাংস ও মুরগির মাংস দিয়েছে।

এক বন্দি বলেন, 'যতবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, প্রতিবারই জানতে চাওয়া হয়েছে যে, আমাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা এবং ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার সঙ্গে যতই ভালো আচরণ করা হোক না কেন, এটি কোনো জীবন না। আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম এবং তারা আমার জীবনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল।'



একজন প্রহরী একবার একজন বন্দিকে বলেছিলেন, 'আমি দিতে পারব না এমন কিছু না চাইলে, এখানে যা চাইবেন তাই পাবেন।' এই দিতে না পারার মতো চাওয়া হচ্ছে, তাদের পরিবার বা বন্ধুদেরকে তাদের সম্পর্কে খবর দেওয়া।

বন্দিরা ২ ধরনের কক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন। একটি দেয়ালের মুখোমুখি এবং অন্যটি বারান্দার দিকে।

দেয়ালের মুখোমুখি সেলে ছিলেন এমন একজন বন্দি জানান, তার সেলের শক্ত দরজা বেশিরভাগ সময় খোলা রাখা হতো। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকে বাথরুমে নেওয়ার জন্য বন্ধ করা হতো, যাতে তিনি তাদেরকে দেখতে না পারেন। এই আটক ব্যক্তিকে ভুল পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

বারান্দার মুখোমুখি সেলে থাকা অপর একজন বন্দি জানান, তার কক্ষে একটি ছোট ভেন্টিলেটর ছিল। সেখান দিয়ে তিনি বাইরে দেখতে পেতেন। তার সেল ছিল নিচতলায়।

তিনি বলেন, 'ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে আমি একটি কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ধরতে এবং সেগুলো বড় হতে দেখেছি। আমি বৃষ্টি দেখেছি, পাখির শব্দ শুনেছি। আমি একটি ছেলেকে গিটার বাজাতে শুনেছি এবং তার বোন তার মায়ের কাছে তাকে নিয়ে অভিযোগ করছে সেটাও শুনেছি।'

এই স্বাভাবিক, সুন্দর পৃথিবীর ঠিক পাশেই তিনি নির্জন কারাবাসে বন্দি ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি একবার পাশের সেলমেটের সঙ্গে কথা বলার জন্য দেয়ালে টোকা দিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। দেয়ালগুলো প্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু এবং অনেক উঁচু ছিল।'

তিনি বন্দি থাকা প্রতিটি দিন গুনেছেন। কাঠের একটি ছোট টুকরা ব্যবহার করে দেয়ালের নীচে তারিখ লিখতেন। জাতীয় দিবসগুলো হিসাব করে তিনি সঠিক হিসাব লিখে রাখতে পারতেন। বাইরে দেশাত্মবোধক গান শুনে তিনি বুঝতে পারতেন, এটি কোন তারিখ।

তিনি বলেন, 'আগে যারা এই কক্ষে বন্দি ছিলেন তারা অনেক কিছু লিখেছিলেন। সেখানে কবিতা থেকে শুরু করে আরবি লেখা, হিন্দু ধর্মীয় চিহ্ন পর্যন্ত ছিল। একদিন কয়েকজন লোক এসে দেয়াল পেইন্ট করে দিয়ে যায়।'

একবার তিনি পা পিছলে বাথরুমে পড়ে যান এবং এক্স-রে করার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেন, 'তারা আমার মাথা ঢেকে একটি গাড়িতে নিয়ে যায়। এই প্রথম আমি আমার মুখে সূর্য অনুভব করলাম। আমি শুনলাম রিকশাওয়ালারা ঝগড়া করছে। আমি একবার ভাবলাম, পালাই। কিন্তু পরেই মনে হলো, তারা গুলি করবে বা ধরে ফেলবে। এমন কিছু হলে আর এখন যেমন আরামে রেখেছে সেটা আর করবে না। তখন নির্যাতন করতে পারে। আমি কর্মকর্তাদের দেওয়া আশ্বাসে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলাম যে, সময় হলে আবার বাড়ি ফিরব।'

আরেকজন বন্দি বর্ণনা করেন, কিভাবে তিনি পাশের সেল থেকে প্রচুর কান্নার শব্দ শুনতে পান। তিনি বলেন, 'যদি তিনি খুব কান্নাকাটি করতেন, তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর ফিরে অনেকক্ষণ ঘুমাতেন।'

সবকিছু ছাড়িয়ে নির্জন কারাবাসটিই তাদের জীবনে সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল। বিষয়টি এতটাই দুর্বিষহ ছিল যে, তারা সেই সময়ের একমাত্র ভালো অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেই প্রহরীদের সঙ্গে আলাপচারিতা। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাদের একমাত্র যোগাযোগ ছিল সেটিই।

অনেক বন্দি তাদের সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন, অনেকটা স্নেহের সঙ্গে, যারা তাদের তদারকি করেছেন। যদিও তারা জানতেন যে, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারাও জড়িত।

তাদের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা খুবই সহজ। কারণ তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিন্তু তাদের বর্ণনা শুনে প্রশ্ন জাগে, পরিচয় প্রকাশ করে কে আবার সেই নির্যাতিত জীবনে ফিরে যেতে চাইবে?

জাতিসংঘের তালিকায় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জন

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাঁদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন। এ সময় নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিবা ইসলাম। ২০ আগস্ট বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের একটি তালিকা গত বছর বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপে আলোচনা হয়। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।


মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাঁদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ। অবশ্য সরকার শুরু থেকেই গুমের ঘটনাগুলো অস্বীকার করে আসছে।


মিশেল ব্যাশেলেত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান।


জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ সরকারের কাছে গুমের শিকার হওয়া যে ৭৬ জনের তালিকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:


১. মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম। তাঁকে ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর বরিশাল থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২. মো. হাসান খান। গাজীপুর থেকে ২০০৮ সালের ২৫ মে তাঁকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩. মোহাম্মদ চৌধুরী আলম। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১০ সালের ২৫ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায়।


৪. সানায়াইমা রাজকুমার ওরফে মেঘেন। জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। তাঁকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাদাপোশাকের কিছু ব্যক্তি ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় পোশাকধারী পুলিশও ছিল।


৫. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। র‌্যাব পরিচয়ে ২০১১ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৬. তপন দাস। ২০১১ সালের ৩ আগস্ট তাঁকে কিছু ব্যক্তি ডিবির সদস্য পরিচয় দিয়ে ঢাকা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৭. হাবিবুর রহমান হাওলাদার। তাঁকে ২০১২ সালের বাগেরহাট থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৮. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৯. আল মোকাদ্দাস হোসেন। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে দিয়ে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন ব্যক্তি।


১০. মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। ঢাকার সাভার থেকে ২০১২ সালে তাঁকে ডিবি ও র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১১. কে এম শামীম আখতার। ২০১২ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


১২. মোহাম্মদ ইমাম হাসান। ২০১২ সালে ঢাকা থেকে অপহৃত হন।


১৩. পারভেজ হুমায়ুন কবির ও ১৪. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (হিরো)। দুজনকে ২০১৩ সালে কুমিল্লা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৫. মোহাম্মদ তৈয়ব প্রামাণিক। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৬. মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটোয়ারী। নাটোর থেকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৭. মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল। নাটোর থেকে তাঁকে ২০১৪ সালে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


১৮. কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র (শিলহেইবা)। জন্মসূত্রে ভারতীয়। তাঁকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায়।


১৯. মো. সেলিম রেজা (পিন্টু)। তাঁকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


২০. মো. আসাদুজ্জামান রানা (বাবু)। ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২১. করিম জাহিদুল ওরফে তানভীর, ২২. মো. মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল, ২৩. আল–আমিন, ২৪. ইসলাম সাজেদুল ওরফে সুমন ও ২৫. মোহাম্মদ আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম। এই পাঁচজনকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ঘটনা বেশি

গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকা অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গুমের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


২৬. মো. কাওসার হোসেন। তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৭. এ এম আদনান চৌধুরী। র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৮. মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ১১ মে ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


২৯. নুরুল আমিন। লক্ষ্মীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩০. শামীম উদ্দিন প্রধান। বগুড়া থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩১. নুর আলম। গাজীপুর থেকে তাঁকে ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩২. সোহেল রানা। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৩. সাজ্জাদ হোসেন শেখ। গাজীপুর থেকে ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৩৪. মো. হোসেন চঞ্চল। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৫. পারভেজ হোসেন। ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৬. মাহফুজুর রহমান সোহেল। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৭. জহিরুল ইসলাম। ২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৩৮. মো. নিজাম উদ্দিন। র‌্যাব ও ডিবি পরিচয়ে তাঁকে ঢাকা থেকে ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যায়।


৩৯. মীর আহমদ বিন কাশেম। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট ঢাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৪০. মাহাবুব হাসান। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪১. কাজী ফরহাদ। ২০১৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪২. সম্রাট মোল্লা। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা থেকে তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৩. খালেদ হাসান। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকা তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৪. মোহাম্মদ তারিকুল আলম। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ তাঁকে যশোর থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়।


৪৫. আবদুল্লাহিল আযমী। ডিবি পরিচয়ে ঢাকা থেকে ২০১৬ সালের ২ আগস্ট তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।


৪৬. মোহাম্মদ আখতার হোসেন। ডিবি পরিচয়ে রংপুর থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয় ২০১৬ সালের ৩ মে।


৪৭. এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন। ঢাকা থেকে তাঁকে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনজন অস্ত্রধারী তুলে নিয়ে যায়।


৪৮. মো. আবদুল কুদ্দুস প্রামাণিক। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে চার ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়।


৪৯. মোহাম্মদ জাকির হোসেন। ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫০. মো. মাহাবুবুর রহমান ওরফে রিপন। ২০১৪ সালের ২১ মার্চ ঢাকা থেকে তাঁকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়।


ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়ও ঘটনা অনেক

বিভিন্ন জেলায় ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বেশ কিছু গুমের ঘটনা ঘটেছে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেন:


৫১. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান (নাহিদ)। নরসিংদী থেকে তাঁকে ২০১৭ সালের ৯ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন তুলে নিয়ে যায়।


৫২. মো. রেজাউন হোসেন। যশোর থেকে ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৩. শেখ মোকলেসুর রহমান। সাতক্ষীরা থেকে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট সাতক্ষীরা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৪. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফারুখ (রশিদ)। রাজশাহী থেকে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই র‌্যাব পরিচয়ে পাঁচ ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৫. মো. হাসিনুর রহমান। ঢাকা থেকে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ১০ থেকে ১৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৫৬. মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার। যশোর থেকে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৭. রাজু ইসলাম। ২০১৫ সালের ২০ মার্চ ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৮. মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৫৯. মোহাম্মদ জায়েদুর রহমান। নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬০. মাইকেল চাকমা। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনি নিখোঁজ হন।


৬১. ইসমাইল হোসেন। ২০১৯ সালের ১৯ জুন তিনি ঢাকায় নিখোঁজ হন।


৬২. মো. তারা মিয়া। ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৩. মনির হোসেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে ২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর র‌্যাব পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৪. মোহাম্মদ নুর হোসেন (হিরু)। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ২০১১ সালের ২০ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৫. মোহন মিয়া। ২০১৮ সালের ১০ জুন ঢাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৬৬. জাকির হোসেন। ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার গুলশান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৭. ইফতেখার আহমেদ দিনার। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


৬৮. জুনায়েদ আহমেদ। ২০১২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৬৯. এম ইলিয়াস আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭০. আনসার আলী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


তালিকায় কল্পনা চাকমার নাম

২৬ বছর আগে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে। গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের তালিকায় কল্পনা চাকমাসহ আরও যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা হলেন:


৭১. সাইদুর রহমান কাজী। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল যশোর থেকে তাঁকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭২. মোহাম্মদ মোরশিদুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাজশাহীর তাহেরপুর থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৩. আবদুল কুদ্দুস মোহাম্মদ। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে রাজশাহী থেকে তুলে নিয়ে যায়।


৭৪. ফরিদ আহমদ সৈয়দ। কুমিল্লা থেকে তাঁকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।


৭৫. আলমগীর হোসেন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি কুমিল্লা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়।


৭৬. কল্পনা চাকমা। রাঙামাটি থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অস্ত্রধারীরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।


  • সূত্র - প্রথম আলো/ আগস্ট ৩০, ২০২২