Search

Monday, July 25, 2016

বিবিসি’র রিপোর্ট: সরাসরি সম্প্রচারে বিধিনিষেধ নিয়ে



মানবজমিন: বাংলাদেশের সরকার সরাসরি সম্প্রচারে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার পর টিভি কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একটি টেলিভিশনের শীর্ষ বার্তা কর্মকর্তা একে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করেছেন। গত সপ্তাহেই দেশের ২৬টি টেলিভিশন চ্যানেলকে তথ্য মন্ত্রণালয় এ চিঠি পাঠায়, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কার্যক্রমের ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি সমপ্রচার না করার অনুরোধ জানানো হয়। গতকাল রাতে প্রচারিত বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের সই করা এ চিঠির একটি কপি বিবিসির হাতে এসেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিটিভিসহ মোট ২৬টি টিভি চ্যানেলকে অনুরোধ জানানো হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় উদ্ধার এবং কোথাও কোনো অপরাধ সংগঠনের সময় অপরাধী বা জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কার্যক্রমের ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি সমপ্রচার না করতে। এ চিঠি প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘তারা যে সমপ্রচার করছেন, সেখানে আমরা কিছু ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সেটা হচ্ছে, আমাদের সমপ্রচার নীতিমালা আছে, সেখানে যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটা বহুক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে না। এজন্য আমরা অনুরোধপত্র দিয়েছি সতর্ক করার জন্য।’
 
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম দেখাতে বাধা কোথায়? বিবিসির এ প্রশ্নে তথ্যমন্ত্রী কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করন। বিশেষ করে তিনি ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ধ্বংসস্তূপের নিচে কয়েক দিন ধরে আটকে থাকা রেশমাকে উদ্ধার, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় একটি পানির পাইপে দীর্ঘসময় ধরে আটকে পড়া একটি শিশুকে উদ্ধার অভিযান এবং কয়েকটি নৌদুর্ঘটনার উদ্ধার তৎপরতা সরাসরি সমপ্রচারের ঘটনা উল্লেখ করেন। এগুলোকে সঠিক নয় বলে বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, ‘উদ্ধারকার্যে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করার কোনো গণমাধ্যমের অধিকার নেই। ঘটনার আগেই আমি সতর্ক করে দিয়েছি, আপনারা বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন না। না হলে প্রশাসন ওখানে শক্ত অবস্থান নেবে, তখন আরো বিব্রত হবেন। মৃতদেহের ছবি দেখানো কোনো নৈতিকতার মাপকাঠিতে আসে না। শিশুর মৃতদেহ, এটা কোন মানবিক ব্যাপার?’ তিনি আরো বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ভেতর থেকে উদ্ধার করছে, তখন উদ্ধারকাজটা সমাপ্ত করতেও দেবেন না। এটা তো ঠিক না। একটা শকে ছিল, তিন দিন ওখানে অভুক্ত অবস্থায় আছে, এ অবস্থায় তার মুখে বুম ধরা, জিজ্ঞেস করা যে আপনার কেমন লাগছে - এটা কোনো কথা হলো নাকি?’

রিপোর্টে বলা হয়, মূলত এ ধরনের সরাসরি সমপ্রচার যে সরকার পছন্দ করছে না, তা সপষ্ট হয় গুলশান হামলার সময়কালে। হামলা পরবর্তী জিম্মিদশা চলাকালে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলো দীর্ঘসময় ধরে ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছিল। একপর্যায়ে তারা সরাসরি সমপ্রচার বন্ধ করে দেয়। কারণ, হিসেবে সরকারের অনুরোধের কথা উল্লেখ করে।

এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের বার্তা প্রধান মোস্তফা ফিরোজ বলেন, সরকার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপত্তা বেষ্টনী, গণমাধ্যম ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। আর সে ব্যর্থতার দায় গণমাধ্যমের ওপর চাপাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সরকার বলছে তারা কোনোভাবেই গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করবে না এবং তারা অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকেই আবার যখন এ চিঠি দেয়া হয়, সেটা এমন দুর্ভাগ্যজনক যে, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তো নিষেধাজ্ঞা আছেই; এমনকি বলা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরও সরাসরি দেখানো যাবে না। যদি সরাসরি দেখানো না যায়, তাহলে কী দেখানো হবে? আমার মনে হয়, এটা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপের নানা ধরনের উপাদান। সরকার প্রমাণ করছে তারা যা বলে আসছে তারা তা বিশ্বাস করে না। এ চিঠিটা সেটাই প্রমাণ করে।

এদিকে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, এ বছরের মধ্যেই সমপ্রচার আইন ও তথ্য কমিশন গঠনের কাজ শেষ হবে। এরপর থেকে সরকার এসব ব্যাপারে আর হস্তক্ষেপ করবে না। তথ্য কমিশনই আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবে।

Friday, July 22, 2016

রেমিট্যান্সে ধস: এক বছরে কমেছে ৫ হাজার কোটি টাকা

শীর্ষ নিউজ ডেস্ক: দেশের বেশির ভাগ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ থেকে। গত অর্থবছরে আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য মতে সৌদি আরব থেকে হাজার ৮০ কোটি টাকা এবং আরব আমিরাত থেকে ৮৭২ কোটি টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা কমে গেছে। সব মিলিয়ে ছয় দেশ থেকে এক বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা।

দিকে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে না, কমে গেছে দেশের ২৮ সরকারি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণ।ব্যাংকগুলোর সমাপ্ত অর্থবছরের রেমিট্যান্স আহরণ আগের অর্থবছর (২০১৪-১৫) থেকে কমে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, বেসিক কৃষি ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, ইউসিবিএল, উত্তরা, এবি, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, আএফআইসি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তার দু-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ থেকে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বেশির ভাগ আসে সৌদি আরব, আরব আমিরাত কুয়েত থেকে। কিন্তু সমাপ্ত অর্থবছরে দেশভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রেমিট্যান্সের প্রধান বাজার তিন দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে কম এসেছে অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে সমাপ্ত অর্থবছরে দেশ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ কমেছে রেমিট্যান্স। আরব আমিরাত থেকে ৮৭২ কোটি টাকা এবং কুয়েত থেকে ৩২০ কোটি টাকা সমমূল্যের রেমিট্যান্স কম এসেছে আগের বছরের চেয়ে। এর বাইরে বাহরাইন থেকে ৫৯২ কোটি টাকা, লিবিয়া থেকে ২৬৪ কোটি টাকা এবং ওমান থেকে ৩২ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা কম এসেছে।

আট দেশের মধ্যে প্রধান ছয়টি দেশ থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯০৭ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা সমাপ্ত অর্থবছরে কমে নেমেছে ৮৫৫ কোটি ডলারে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, মূলত দুটি কারণে মাধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তেলের দাম কমে যাওয়া। জ্বালানি তেলনির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় ওই সব দেশে উন্নয়ন ব্যয় ব্যাপক হারে কমে গেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটে উন্নয়নমূলক কাজকর্মও কমে গেছে। উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়ায় তাদের শ্রমিকের চাহিদা কমে গেছে। যেহেতু বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রবাসীই অদক্ষ, ফলে মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমাদের রেমিট্যান্সের ওপর। তারা আগের মতো আর শ্রমিক নিচ্ছে না; বরং যারা আছে তাদেরকেও অনেক ক্ষেত্রে ফেরত আসতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, ডলারের দাম কমে যাওয়া। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ডলারের দাম কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী রপ্তানিকারকদের কথা ভেবে বাজার থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কিনছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অনেক ক্ষেত্রেই স্থিতিশীল রয়েছে। অর্থাৎ ডলারের দাম না কমলেও বাড়েনি। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে প্রকৃতপক্ষে ডলারের মূল্য কমে গেছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সের ওপর। এর বাইরে কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে হারে শ্রমিক ফিরে আসছে সে তুলনায় যাচ্ছে না, বরং ক্ষেত্র বেশির ভাগ দেশে বৈধভাবে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সব মিলে রেমিট্যান্সের ওপর প্রভাব পড়েছে।


পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে হবে। একই সাথে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো বাড়াতে হবে। জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে; অন্যথায় রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বেড়ে যাবে।

Larger Pattern of Terrorism in Bangladesh

BangladeshAlexandra Stark / The Diplomat


Casual readers of news stories about the recent horrific attack at a Dhaka cafe, which left 28 dead, would be forgiven for thinking that this attack represents a sudden shift in the presence of terrorist organizations in Bangladesh. The New York Times suggested that the attack provided “new evidence that ISIS has shifted its focus beyond the Middle East,” while the BBC asserted that the “sense of security” has fundamentally changed in Dhaka.
The July 1 attack undoubtedly represents an escalation in terrorism in Bangladesh, and the relative coordination of this attack, with seven gunman storming a café frequented by expats, is a worrisome development (although it should be noted that the assailants were not heavily armed, indicating that they may not have had the sophistication or the direct links to ISIS that some have claimed). However, those who have followed recent events in Bangladesh will recognize that this attack does not come out of nowhere; rather, it represents the next step in the steady escalation in terrorist attacks over the past couple of years.

Evidence about who is behind the attack is still being uncovered, and it is too soon to make confident assertions about whether the attackers are directly linked to ISIS. Experts continue to debate whether the gunmen had ties to ISIS, or al-Qaeda in the Indian Subcontinent, or perhaps to Jama’at ul Mujahideen Bangladesh (JMB), a homegrown terrorist outfit. Prime Minster Sheikh Hasina has claimed that the attackers had no links to ISIS, but this is not surprising given that her government has long denied that ISIS has any operational presence in Bangladesh, seeing claims to the contrary as attempts to undermine her administration’s counterterrorism efforts.

What is clear, though, is that this assault follows a steadily rising tide of terrorist attacks in Bangladesh in recent years: extremist groups have killed more than 30 individuals in Bangladesh since 2013. Since September of last year, when an Italian aid worker was shot and killed by two assailants, several foreigners, LGTB activists, and religious minorities have been targeted, including a Shi’ia cleric and a Hindu priest. JMB, an organization that is affiliated with ISIS, is alleged to be behind these attacks. ISIS has indeed claimed responsibility for many of these attacks, including the recent one in Dhaka. In the same time period, several prominent atheist bloggers have been killed by machete-yielding assailants. These murders have been claimed by Ansarullah Bangla Team (ABT), which is linked to al-Qaeda. ABT also circulated a “hit list“ of 84 bloggers in 2013; nine of these bloggers have since been killed. These attacks have had a chilling effect on moderate political voices, leading some to stop posting or even leave the country.

These groups likely operate on separate tracks, and are actually probably tacitly competing with one another for influence and recruits in the region. Up until now, their attacks have been relatively unsophisticated, typically involving one or a couple of attackers armed with machetes. The Dhaka attack on the Holey Artisan Bakery may signal that terrorism in Bangladesh is entering a new phase, where attacks may become more sophisticated and highly coordinated than in the past. This is of course worrisome, and all the more reason for the international community to work with the Bangladeshi government on counterterrorism measures, an area where the government has conspicuously fallen short in recent years, often politicizing its efforts by using terrorism as an excuse to pursue its political adversaries.

But the attack must also be understood in its context, where homegrown terrorist groups, notably JMB and ABT, with affiliations with the likes of ISIS and al-Qaeda, have carried out a series of attacks against foreigners, bloggers, and religious minorities. In order to understand the roots of this violence, it is important to understand that the July 1 attack represents an escalation in an ongoing pattern of terrorism rather than an aberration or a sudden shift in the efforts of international terrorist outfits like ISIS and al-Qaeda.

Alexandra Stark is a PhD candidate in International Relations at Georgetown University, and a Research Assistant with the World Faiths Development Dialogue in Washington, D.C. She holds and MSc in IR from the London School of Economics.

Tuesday, July 19, 2016

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬ : একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন


নির্বাহী সার-সংক্ষেপ



ভূমিকাঃ

গুলি, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নিহত, হতাহত সহ নানা অনিয়ম ও ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের পরিচয় প্রতীকে সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে নির্বাচন কমিশন দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২২শে মার্চ শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে জুন পর্যন্ত মোট ছয় ধাপে হাজার ২৭৫টি ইউপিতে ভোট গ্রহণ করা হয়

এবারের ইউপি নির্বাচন ছিল প্রহসনের নির্বাচনএটি ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস নির্বাচনউৎসবের বদলে দেশজুড়ে ছিল আতঙ্ক। নির্বাচনের নামে কেবল হাঙ্গামা, মারামারি ও কাটাকাটি হয়েছে। সারা দেশে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনের নামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ধানের শীষের প্রার্থীদের নিশ্চিত বিজয় ছিনতাই করেছে। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া কোথাও ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। জনগণ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। বিশেষ করে চেয়ারম্যান পদে সুষ্ঠু ভোট করতে দেয়নি ক্ষমতাসীনরা।

প্রথম থেকে ষষ্ঠ ধাপ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনের একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যানঃ

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবার ছয় ধাপে ভোটের আয়োজন করা হয় হাজার ১০৩টি ইউপির এর মধ্যে ফল প্রকাশ হয়েছে হাজার ২টি ইউপির বাকি ১০১টি ইউপিতে বন্ধ ঘোষিত কেন্দ্রগুলোতে আবারও ভোট গ্রহণ করা হবেএ নির্বাচনের ফলাফলের পরিসংখ্যান একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। এই প্রহসন স্বত্বেও নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে ছয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন হাজার ৬৬১ টি ইউপিতে এই ছয় ধাপে বিএনপি জয় পেয়েছে ৩৬৭টিতে ছাড়া অন্যান্য দলের প্রার্থীরা (জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাকের পার্টি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ) ৬০টি ইউপিতে জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৮৯৮টি ইউপিতে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (সংযুক্ত সারণিতে দেখুন)

নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রদত্ত মোট ভোটের ৩১.২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে দলীয় প্রতীকের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে বাংলাদেশের দলভিত্তিক নির্বাচনের ইতিহাসে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে এত ভোট আর কখনো পড়েনি ইসির তথ্য অনুসারে, এবারের ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়েছেন ৮৯৮ ইউপিতে এঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের এবং অল্পসংখ্যক বিএনপির বিদ্রোহী এ ছাড়া রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় কিছু ইউপিতে তাদের প্রার্থীরাও স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন সব মিলিয়ে এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের পরই নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে পড়েছে ১৮.৯৮ শতাংশ এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে পড়েছে মাত্র ২.২৪ শতাংশ ভোট আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে ৪৫.৪৬ শতাংশ বাকি ২.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টিসহ (জেপি) ১৪টি দল (সংযুক্ত সারণিতে দেখুন)

নির্বাচিত চার হাজার চেয়ারম্যানের মধ্যে নারী মাত্র ২৯ জন তাঁদের মধ্যে ২৪ জনই আওয়ামী লীগের ওই ২৪ জনের মধ্যে আবার ছয়জনই জিতেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন চারজন আর জাতীয় পার্টি থেকে জিতেছেন একজন

ফেব্রুয়ারিতে ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সংঘর্ষের শুরু হয় তফসিল ঘোষণার পর থেকে ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনের ভোট গ্রহন পর্যন্ত পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৮ জন, আর আহত হয় ৬০০০ এর অধিক বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এত হতাহতের ঘটনা আর আগে কখনও ঘটেনি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী সহিংসতায় জুন ১৪, ২০১৬ পর্যন্ত ১১৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় ৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছে উল্লেখ্য যে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা এখনও চলছে। (সংযুক্ত সারণিতে দেখুন)

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ারও রেকর্ড গড়েছে প্রাণঘাতী এ নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ২১৭টি ইউপিতে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ারও রেকর্ড গড়েছেন।

নির্বাচনে মোট ৫৫৪টি ইউপিতে বিএনপির প্রার্থী ছিল না। এর মধ্যে ১০২টি ইউপিতে আগে থেকে ভয় ভীতি দেখানোর কারনে বিএনপি প্রার্থীরা প্রাণের ভয়ে নির্বাচন থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হয়এর বাইরে ১৮৮টি ইউপিতে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। আর ৫৯টি ইউপিতে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা চাপ দিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। অনেক জায়গায় মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। দল হিসেবে বিএনপি ইউপি নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি প্রার্থীরা আওয়ামী সহিংসতার মুখে কত অসহায় ছিলেন এসব ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে।

নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতি, ব্যলট বাক্স ছিনতাই ও সহিংসতাঃ

অকার্যকর নির্বাচন কমিশনঃ এবারের ইউপি নির্বাচনে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা। ক্ষমতাসীন দলের দাপটে প্রায় একতরফা নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। তবে ভোট জালিয়াতি ও সহিংসতা বন্ধে কমিশনকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের নির্বাচন দেশের সার্বিক নির্বাচনব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই, প্রকাশ্যে প্রার্থীর পক্ষে সিল মারা এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে হত্যা, হতাহত করা এবং এলাকাছাড়া করার সংস্কৃতি গেড়ে বসেছে

নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অনেক অভিযোগ আসতে থাকলেও কমিশনের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশব্যাপী ৪ হাজারের বেশি ইউপির ৩৬ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু কমিশন মাত্র ৩৪৬ কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে দায়িত্ব সেরেছে। সারা দেশে অনেক জায়গায় কেন্দ্র দখলের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কমিশন ওই সব কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেনি। ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে বিভিন্ন ধাপে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়লেও কমিশন হাতে গোনা কয়েকটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে। অন্যদের আদালতে নালিশ করার পরামর্শ দিয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা গুরুতর অভিযোগগুলো আমলে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল এবং কমিশনের এ সব আমলে নেবার ক্ষমতা ও এখতিয়ার ছিল।

শেষ পর্যন্ত খোদ কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিন দফায় চিঠি দিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি। সাধারণত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার বৈধ অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের তাদের অস্ত্র নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এবার তা করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে প্রতিটি এলাকায় ভোটের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো অভিযান হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিশনের এই অসহায় আত্মসমর্পণ মাঠের সন্ত্রাসীদের উৎসাহ যুগিয়েছে। সকল বিষয়ে নির্বাচন কমিশন একটি সাক্ষী গোপাল সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

তাৎক্ষণিকভাবে কোন সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহন না করে বরং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাফাই গেয়েছেন। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভার পর সাংবাদিকদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনে প্রচুর সহিংসতা হয়েছে। নির্বাচনে সহিংসতা যেন উপমহাদেশের সংস্কৃতি। বিদেশে নির্বাচন কেন্দ্র দেখিয়ে দেওয়ার জন্য একজন হয়তো ট্রাফিক পুলিশ আছে। কিন্তু আর্মস (অস্ত্রধারী) পুলিশ ব্যাটালিয়ন থাকে না। নির্বাচন করার জন্য এখন মনে হচ্ছে ট্যাংক আনা লাগবে......... রাতে ভোটকেন্দ্র দখলের মতো বিশ্রী ব্যাপার কমে এসেছে।............অবশ্যই বেশ কিছু কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা, বেআইনি কাজ ঘটেছে। এই দু-চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বারবার দেখানোর ফলে সবার মনে ধারণা হয় সব জায়গাতেই খারাপ নির্বাচন হচ্ছে *

* নির্বাচনের বিভিন্ন ধাপ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনাররাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন যা মূল রিপোর্ট থেকে দেখে নেয়া যেতে পারে।



সহিংসতা ও কারচুপির নির্বাচনঃ

এবারের নির্বাচনে শুরু থেকেই অস্ত্র ও পেশিশক্তির ব্যবহার শুরু হয়। নির্বাচনের প্রথম ধাপেই সরকারি দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকেরা দলের বিদ্রোহী ও বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা দিতে শুরু করেন। কমিশন দ্বিতীয় ধাপ থেকে জেলা প্রশাসনের দপ্তরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করলেও তাতে কাজ হয়নি। ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার ঘটনা শেষ ধাপ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যার ফলে বিএনপি ৫৫৪টি ইউপিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেনি।

যেসব ইউপিতে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পেরেছিল, সেখানেও প্রার্থী ও তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেননি। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মানুষ দেখেছেন, অস্ত্র ও পেশিশক্তি কীভাবে তাঁদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, সরকারি দলসবাই মিলে ভোট ডাকাতি করেছে। নির্বাচনের এই অবস্থা নিয়ে খোদ সরকারের সমমনা দলগুলোও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনে বেশির ভাগ জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে। অনেক জায়গায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে গিয়ে ব্যালটে সিল মেরে পরে তা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ব্যালট পেপারে সিল মারার যজ্ঞে লিপ্ত হন

প্রায় সব ইউপিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করেছে। সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের অস্ত্র প্রদর্শন করে। প্রতিপক্ষকে কেন্দ্রছাড়া করতে এলোপাতাড়ি গুলিও ছোড়া হয়। এসব ক্ষেত্রে দু-একটা কেন্দ্র ছাড়া অবশিষ্ট সকল জায়গায় পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়।

৬ দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনুসৃত অনিয়ম ও কারচুপির কিছু নতুন কৌশল / পদ্ধতিঃ

·         মনোনয়ন বাণিজ্যঃ সরকারদলীয় মার্কায় অর্থাৎ নৌকায় মনোনয়ন পেলেই নিশ্চিত বিজয় জেনে মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা। মনোনয়ন বাণিজ্য এমন মহামারি আকার ধারন করে যে নির্বাচনের খরচ নেই মনোনয়নের খরচ বেশী এমন উক্তি শোনা গেছে সরকারদলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছে থেকেই।  পত্রিকায় দেখা যায় যে বিএনপি সম্পর্কেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
·         অনেক স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দেবার পরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রস্তাবক ও সমর্থকদেরকে আওয়ামী লীগ প্রার্থিরা জোরপূর্বক তাঁদের প্রস্তাব বা সমর্থনকে অস্বীকার করতে বাধ্য করেএর ফলে এইসব প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। নির্বাচনে প্রার্থীর সমর্থক ও প্রস্তাবকদের এভাবে সমর্থন অস্বীকার করানোর জন্য চাপ প্রয়োগের কুৎসিত ঘটনা অতীতে আর কখনও ঘটেনি
·         প্রার্থীরা গ্রেফতার ও খুন জখম এড়াতে এলাকা ছেড়ে চলে যাবার পর তাঁদের স্ত্রী সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর সহিংসতা চালানো হয়। এইরকম ঘটনাও নির্বাচনী ইতিহাসে নজিরবিহীন।
·         নির্বাচনের আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ব্যালট ঢুকানো হয়প্রধান নির্বাচন কমিশনার তৃতীয় দফা নির্বাচনের পরে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ব্যালট ঢুকানোর প্রবনতা কমেছে বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেন। প্রকারন্তরে তিনি স্বীকার করেন যে নির্বাচনের আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ব্যালট ঢুকানো হয়েছে।
·         স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় ভোটের লাইনে দাড় করিয়ে রাখা এবং তাদের দিয়ে জাল ভোট প্রদান।
·         আনসার ও পুলিশের ইউনিফর্ম পরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে দাপিয়ে বেড়ানো।
·         চেয়ারম্যানের ভোট ওপেনে / অন্যদের ভোট গোপনেঅর্থাৎ চেয়ারম্যান পদের ব্যালট এ সকলের সামনে সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে বাক্সে ঢুকাতে বাধ্য করা। অনেক ক্ষেত্রে ভোটারকে চেয়ারম্যানের ব্যালটটি না দিয়ে নিজেরাই সিল মেরে বাক্সে ঢুকানো
·         আগে কখনও এত নগ্ন ও ব্যাপক হারে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট কারচুপিতে সরাসরি অংশ নেয়নি এবার যেমনটি ঘটেছে।
·         অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি নির্বাচনী কারচুপিতে অংশগ্রহণ। 
·         মনোনয়নপত্র জমা না দিতে হুমকি দেয়া, জমা দিতে বাধা দেয়া, কৌশলে জমা দিয়েছে এমন অনেকের ক্ষেত্রে জবরদস্তি করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা।
·         অনেক কেন্দ্রে মৃত ব্যাক্তি দের ভোটও কাস্ট করা হয়েছে।
·         সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বা মামলা দেবার হুমকি দিয়ে বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া।
·         কোন কোন ভোট কেন্দ্রে ১০০% এর অধিক ভোট পড়েছে
·         অনেক ক্ষেত্রে প্রিজাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দেয়া হয়েছে।
·         নির্বাচন কমিশনের নজিরবিহীন নির্লিপ্ততা।
·         রাঙামাটির চারটি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ ছাড়া ভয়ভীতির কারণে তিনটি ইউপিতে প্রার্থী হওয়ার মতো আগ্রহী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকির কারণে দলের অনেক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এলাকা ছেড়ে রাঙামাটি শহরে ও চট্টগ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে এই এলাকায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া আদৌ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

৬ দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষে পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের কিছু মন্তব্যঃ

এবারে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে প্রকাশ্যে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, কারচুপির যে ট্রেন্ড চালু হয়ে গেল, সেটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সরকারের কোনো দপ্তর থেকে সহযোগিতা পায়নি। কমিশন ও সরকার ১৪৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেছে। আমরা বলতে চাই, এখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে
-সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে না পেরে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এখন অন্যের ওপর দায় চাপাতে চাচ্ছে। কোনো অজুহাতই হালে পানি পায় না। তারা সাংবিধানিক পদে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ নির্বাচন কখনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, সহিংসতা ও মনোনয়নবাণিজ্য হয়েছে। এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তাই এসবের দায় নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে
-সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার

এই নির্বাচন-প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কমিশনকে কখনো নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি

এই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যদি মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায় তবে সত্যি সত্যি আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। ভেঙে পড়বে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও যা কারোর জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই কাল বিলম্ব না করে জাতীয় স্বার্থে এই নির্বাচনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনার জন্য একটি জাতীয় সংলাপ একান্ত জরুরি
-সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার

সরকার না চাইলে দেশে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না জন্য সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে এখন যে অবস্থা, তাতে এই নির্বাচনকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ বললে কম বলা হবে এটা গুলিবিদ্ধ বা বুলেটবিদ্ধ নির্বাচন ইউপি নির্বাচন নিয়ে এখন আর কেউ ভাবছেন না ভবিষ্যতে কি দেশে নির্বাচন হবে - এটাই বড় প্রশ্ন
-স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ডঃ তোফায়েল আহমেদ

 আমাদের তো নির্বাচন নেই। নির্বাচনকে আমরা কোথায় নিয়ে গেছি, নাউজুবিল্লাহ! এই যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে, কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে তা বুঝতে সময় লাগবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এ জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কীভাবে নিজ হাতে তিনি নির্বাচন ব্যবস্থাকে শেষ করে দিলেন
-অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক ডঃ মইনুল ইসলাম

ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন সব ধরনের সহিংসতাই উদ্বেগজনক ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অ্যাপোক্যালিপ্স (মহা বিপর্যয় ) ডেকে এনেছে।
-ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকার্ট **

** নির্বাচনের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে অন্যান্য পর্যবেক্ষকরাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন যা মূল রিপোর্ট থেকে দেখে নেয়া যেতে পারে।



কিছু মন্তব্যঃ উদ্ঘাটিত বিষয়াদি ও কিছু সুপারিশ

  • হঠাৎ করে দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করেন, দলীয় ভিত্তিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত সংঘাত ও সহিংসতাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও বাংলাদেশের জন্য এই ব্যবস্থা কতটুকু কল্যাণকর এবং যৌক্তিক তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সমাজের বিশিষ্ট জনেরা প্রশ্ন তুলেছেন।
  • দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক অভিসন্ধিপূর্ণ২০১৪র ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্লানি কিছুটা হলেও মুছে ফেলতে দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের আয়োজন করা হয় বলে অনেকে মনে করেন২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণহীনতায় দুষ্টএমনই একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করে সে সরকারের বৈধতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারুনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় মনে করা হয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন করা হয়েছেসরকারের ধারণা ছিল এই নির্বাচনে তাঁরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ইউপি চেয়ারম্যান পদে জয়ী হবে। হয়েছেও তাই। যেহেতু নির্বাচনটি ছিল খুবই ত্রুটিপূর্ণ এবং কলুষিত সেহেতু বিপুল সংখ্যক চেয়ারম্যান পদে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও সরকার এই জয় কাজে লাগাতে পারেনি বরং দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। এই নির্বাচন সরকারের বৈধতা বাড়াতে কোন কাজে আসেনি। বরং সরকারের বৈধতার সংকট বা Legitimacy Crisis অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • আওয়ামী লীগের অপর লক্ষ্যটি ছিল তৃনমূলে দলীয় অবস্থান আরও সুদৃঢ় করাকিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনেও তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। নিজ দলের ভিতরে হানাহানি, মারামারি, হত্যা ও রক্তপাত তাঁদের মধ্যে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী বিভেদ তৈরি করেছে। দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত একটি অনিচ্ছাকৃত (Unintended) পরিণতি ডেকে এনেছে। তৃণমূলের পরিস্থিতি যাচাই বাছাই না করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় ভিত্তিক নির্বাচন শাসকদল আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে বলেই প্রতীয়মান
  • ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের হাতে গোনা কিছু প্রার্থীও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের চাপ ও সন্ত্রাসের মুখে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি অথবা প্রার্থিতা দিলেও কার্যকর ভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারেনি ফলে ১৪ দলের ছোট ছোট শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
  • ইউপি নির্বাচনে শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক ব্যবহার এবং মেম্বার পদের জন্য দলীয় প্রতীক না দেয়ার সিদ্ধান্ত এই নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে দ্বান্দিক অবস্থার জন্ম দিয়েছে।
  • ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী সহিংসতায় জুন ১৪, ২০১৬ পর্যন্ত ১১৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় ৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছেএদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে বা যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অনেক ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন এসব সংঘাত সংঘর্ষ বন্ধ করতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা নীরব দর্শকের ভূমিকা অবলম্বন করেছে। 
  • ইউপি নির্বাচনে দুধরনের সহিংসতা হয়েছে। প্রথম ধরনের সহিংসতা চোখের আড়ালে ঘটেছে। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ভয় দেখানো এবং তাঁর সমর্থকদের ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে ভোট না দিতে বাধ্য করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধরনের সহিংসতা ছিল প্রকাশ্য এবং অত্যন্ত নগ্ন। এরকম প্রকাশ্য সহিংসতার ফল হিসেবে নিহত, আহত, এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার সিল মেরে ব্যালট বাক্সে পুরে দেয়া, নির্বাচনের দিন প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল দেয়া, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা সহ এমন কোন নির্বাচনী অপরাধ নেই যা করা হয়নি। জাল ভোটও পড়েছে ব্যাপক হারে। অনেক নির্বাচনী আসনে অবিশ্বাস্য রকমের ভোট পড়েছে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছাত্র ছাত্রীদের দিয়ে ভোট দেয়ানো হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যায় বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে আর কখনও পড়েনি। নির্বাচন ব্যাবস্থা এতই কলুষিত হয়ে পড়েছে যে জনগন নির্বাচনের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, রকিব মার্কা নির্বাচন কমিশন থাকলে কখনই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সেজন্য একটি নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবী তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে
  • ছয় ধাপের নির্বাচনে ২১৭ জন ইউপি চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আমাদের দেশে ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু যখন সাধারন নিয়মে এমন নগ্ন ব্যাতিক্রমের সৃষ্টি হয় তখন সহজেই বুঝে নেয়া যায় হুমকি এবং ভয় ভীতির চাপ কত প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল ছিল যে এত বিপুল সংখ্যক ইউপি চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
  • নির্বাচনী সহিংসতার বেশিরভাগই ঘটেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবং সেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। বৈরি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভীতিকর অবস্থা বিরাজমান থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বাড়িঘরে থাকতে পারেনি এর ফলে ইউপি নির্বাচনে বিএনপির মত একটি বিশাল দল স্বাধীন ও সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট হতে পারেনি। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য খুবই ক্ষতিকর।
  • ছয় ধাপে প্রায় চারশর বেশি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারেনি। কেন এটা সম্ভব হয়নি সেজন্য বিনপিকে সাংগঠনিকভাবে খোঁজ খবর নিতে হবে। সাধারণ মানুষের ধারণা, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এই রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিএনপিকে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে হবে
  • বিএনপির দুর্গ হিসেবে বিবেচিত এলাকাগুলো ছিল আওয়ামী লীগের মূল টার্গেট যেমন ফেনী, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী। বিএনপির দুর্গ বলে বিবেচিত ফেনী জেলায় মাত্র একটি ইউপিতে (ছাগলনাইয়ার রাধানগর) ধানের শীষের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। আর কোথাও ধানের শীষের প্রার্থীকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে দেয়া হয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ফেনী-৬ আসনে (ফুলগাজী-পরশুরাম-ছাগলনাইয়া) বরাবর নির্বাচন করে থাকেন।  লক্ষ্মীপুর জেলাও বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের চরম ভরাডুবির মধ্যেও লক্ষ্মীপুরের চারটি আসনই পেয়েছিল বিএনপি। এখানকার রায়পুর ও সদরের একাংশ নিয়ে গঠিত লক্ষ্মীপুর-২ আসনে বেগম খালেদা জিয়াও দুইবার নির্বাচন করেছেন। এবারের ইউপি নির্বাচনে পুরো জেলায় একটি ইউপিতেও বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী হতে দেয়া হয়নি। নোয়াখালীতেও একই অবস্থা। শুধু সেনবাগ ছাড়া অন্য কোথাও বিএনপির প্রার্থী জিততে পারেনি। চট্টগ্রামেও নির্বাচনী চিত্র একই। কুমিল্লাও বিএনপির দুর্গ বলে বিবেচিত। কুমিল্লার কোনো কোনো উপজেলায় একটি-দুটি ইউপিতে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হলেও মুরাদনগর উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের একটিতেও বিএনপির প্রার্থীকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচনের আগের রাত থেকেই সব কেন্দ্র দখল করে নেয়া হয়েছিল। বগুড়া বিএনপির জেলা হিসেবে বিবেচিতবগুড়া-৬ সদর আসন ও ৭ আসনে (গাবতলী-শাহজাহানপুর) নির্বাচন করেন বেগম খালেদা জিয়া। এই দুটো আসনের অধীন ইউপিগুলোতেও ক্ষমতাসীনদের প্রতাপ ছিলহাতেগোনা কয়েকটিতে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। বগুড়ার অন্য উপজেলাগুলোরও একই চিত্র। রাজশাহীসহ পুরো উত্তরবঙ্গে বিএনপির সমর্থন বেশি হলেও ইউপিতে এর ছিত্র ছিল উল্টো। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতেই সরকার এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দিয়েছে। সব জোর করে দখলও করেছে তারা।
  • এই নির্বাচনের ফলাফলের পরিসংখ্যান একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তবুও ৬ ধাপের ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে বিএনপি জয় পেয়েছে ৩৬৭টিতে। সন্দেহ নেই এই সংখ্যা মোট চেয়ারম্যান পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। শতকরা হিসেবে এটি ১০-১২ শতাংশের বেশী হবে না। ভয়ানক প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে যেসব বিএনপি প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে তা কিভাবে সম্ভব হয়েছে এবং এ থেকে দলের কি শিক্ষণীয় রয়েছে সে সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো উচিত।
  • ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ৬ ধাপে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যখন ধাপে ধাপে নির্বাচন করা হয় তখন সব ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাবার পরেই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করাই নিয়মপ্রতিবেশি দেশ ভারতে এই নিয়মই চালু আছে। এভাবে সকল ধাপের নির্বাচন হয়ে যাবার পর ভোট গননা ও প্রকাশ করা হলে এক ধাপের নির্বাচনের ফলাফল অন্য ধাপের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারেনা। কিন্তু ইউপি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন প্রতিটি ধাপের নির্বাচন শেষে ফলফল প্রকাশ করতে দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যে অবিশ্যম্ভাবী পক্ষপাতিত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে।
  • বিএনপিতে মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে পত্র পত্রিকায় নানা ধরনের কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি অতীব বিব্রতকর। এটি নিঃসন্দেহে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। বিষয়টি তদন্ত করে দলের দায়ী ব্যাক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
  • ভবিষ্যতে যে কোন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার প্রাক্কালে তৃণমূলের অভিমতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
  • এবারের ইউপি নির্বাচন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমান করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি ব্যর্থ, অযোগ্য, অথর্ব কমিশন। এই কমিশন নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে সম্পূর্ণভাবে অনিচ্ছুক। এরা ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার প্রতি তাকিয়ে থাকতে অভ্যস্ত। এই কমিশনের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নাতীতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
  • ইউপি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, অদক্ষতা, ও তাঁবেদারি চরিত্র চরমভাবে ফুটে উঠেছে। এর ফলে নিরপেক্ষ শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে জনগন বিশেষ করে সুশীল সমাজ আরও সোচ্চার ও দৃঢ়চিত্ত হয়েছে। জনগনের এই মনোভাবকে কাজে লাগানোর সুযোগ নিতে হবেবর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। এখনই উপযুক্ত সময় সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবী তোলার।
  • নির্বাচন শেষে এ সকল উদ্ঘাটিত বিষয়াদি ও সুপারিশ এর  ভিত্তিতে প্রয়োজনে অংশীজনদের মধ্যে আলোচনার (Stakeholder Consultation) আয়োজন করা যেতে পারে।




সারণি

নিম্নের টেবিলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কিছু পরিসংখ্যানের একটি ম্যাট্রিক্স চিত্র উপস্থাপন করা হলঃ

টেবিলঃ ১

ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন ২০১৬ এর সর্বশেষ ফলাফল (আসন)

নির্বাচনের তারিখ
নির্বাচন হয়েছে
পুনরায় ভোট হবে
আওয়ামী লীগ
বিএনপি
অন্যান্য দল
স্বতন্ত্র
নির্বাচিত
(মোট)
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
নির্বাচিত
প্রার্থী ছিল না
প্রথম ধাপ
মার্চ ২২
৭২৫
৫৪০
৫৪
৪৭
১১৯
১০৩
দ্বিতীয় ধাপ
মার্চ ৩১
৬৪৪
১০
৪৫০
৩৪
৬১
৭৯
১১৫
তৃতীয় ধাপ
এপ্রিল ২৩
৬১৫
৩৯৫
২৯
৬০
৮১
১৬
১৬৩
চতুর্থ ধাপ
মে ৭
৭০৩
২০
৪৩৯
৩৪
৭০
১০৬
১৩
১৬১
পঞ্চম ধাপ
২৮ মে
৭১৭
৩৮
৪৩১
৩৯
৬৭
১০০
১১
১৭০
ষষ্ঠ ধাপ
৪ জুন
৬৯৯
২৭
৪০৬
২৭
৬২
৬৯
১৮৬
মোট
৪১০৩
১০১
২৬৬১
২১৭
৩৬৭
৫৫৪
৬০
৮৯৮

টেবিলঃ ২

ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন ২০১৬ এর দলীয় ভোটের শতকরা চিত্রঃ
দল
শতকরা ভোট
আওয়ামী লীগ (নৌকা প্রতীক)
৪৫.৪৬%
স্বতন্ত্র প্রার্থী
৩১.২৯%
বিএনপি (ধানের শীষ প্রতীক)
১৮.৯৮%
জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল প্রতীক)
.২৪%
অন্যান্য
(জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি জেপি)
.%

টেবিলঃ ৩
১১ ফেব্রুয়ারী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৮ই মে অনুষ্ঠিত চতুর্থ দফার নির্বাচনের দিন পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র



নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত নিহত
নির্বাচনের দিন নিহত
আহত
প্রথম ধাপ
মার্চ ২২
১০
১১
২০০০ এর বেশী
দ্বিতীয় ধাপ
মার্চ ৩১
১১০০ এর বেশী
তৃতীয় ধাপ
এপ্রিল ২৩
১১
৯০০ এর বেশী
চতুর্থ ধাপ
মে ৭
১৩
১০০০ এর বেশী
পঞ্চম ধাপ
২৮ মে
১৪
১৬
৬০০ এর বেশী
ষষ্ঠ ধাপ
৪ জুন
১১
৩৫০ এর বেশী

*১১ ফেব্রুয়ারী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৫ই জুন অনুষ্ঠিত ষষ্ট দফার নির্বাচনের দিন পর্যন্ত মোট নিহতঃ ১১৬ জনএই তথ্য দৈনিক প্রথম আলো থেকে সংগ্রহীত।
***সব পরিসংখ্যান সংবাদপত্র প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রনয়ন করে হয়েছে