Search

Monday, April 10, 2017

ছাত্রনেতা নূরু হত্যা, কারো দায় নিরূপিত হয়নি


মহিউদ্দিন খান মোহন / নয়া দিগন্ত

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নূরুর হত্যাকাণ্ড এখন দেশের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। রাতে পুলিশের পরিচয়ে হাতকড়া পরিয়ে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পরদিন সকালে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ফলে জনমনে এখন প্রশ্ন জোরালোভাবেই দেখা দিয়েছে যে, দেশে কারো কোনো নিরাপত্তা আছে কি না। একটি দেশের যেকোনো নাগরিকের যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রহণ এবং তদনুযায়ী কর্মতৎপরতা চালানোর অধিকার রয়েছে। আমাদের সংবিধান সে অধিকার প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে। পাশাপাশি একজন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তাদের। এটাও সংবিধান নির্দেশিত বিষয়। ফলে একজন নাগরিককে রাষ্ট্রের একটি বাহিনীর পরিচয়ে রাতের অন্ধকারে তুলে নেয়া হবে, আর কয়েক ঘণ্টা পরে তার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যাবে এটা কারো পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গত ২৯ মার্চ বুধবার রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের চন্দনপুরা পশ্চিম গলির বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক নিজেদেরকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নূরুল আলম নূরুকে তুলে নিয়ে যায়। অভিযানকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রাউজান থানার নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জাবেদ মিয়া ছিল বলে জানিয়েছেন নিহত নূরুর ভাগ্নে। পরদিন সকালে নূরুর লাশ পাওয়া যায় তার গ্রামের বাড়ি থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে রাউজানের কোয়াপাড়া গ্রামের খেলারঘাটের পশ্চিম পাশে সওদাগরপাড়া এলাকায়। স্থানীয় লোকজন হাত-পা মুখ বাঁধা লাশটি দেখে পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ আসতে দেরি করে। বিকেল ৪টার পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে যায়।
দিকে নোয়াপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ জাবেদ মিয়া পত্রিকাকে বলেছেন - ‘আমি রাতে শহরে কোনো অভিযানে ছিলাম না। রাউজান থানার ওসির সঙ্গে থানার কাগতিয়া এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছিলাম।অন্য দিকে রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ বলেছেন- ‘রাউজান থানার টিম নগরীতে বুধবার রাতে অভিযান চালায়নি। ওই রাতে কাগতিয়া এলাকায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছিলাম আমরা।’ (কালের কণ্ঠ ৩১, মার্চ ২০১৭) দিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, রাউজান থানা পুলিশ ওই রাতে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে, এমন কোনো বার্তা জেলা পুলিশের কার্যালয়ে নেই

নুরুল আলম নূরুর দাফন সম্পন্ন হওয়ার আগেই আরেকটি নৃশংস ঘটনার খবর আসে সিলেট থেকে। সেখানে একদল দুর্বৃত্ত কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রদল নেতা হাসান ডনকে। তাকে শাসক দলের ক্যাডাররা হত্যা করেছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। দুটি ঘটনা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সংঘটিত হওয়ার কারণে দেশব্যাপী এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের দুজন নেতার এক দিনের ব্যবধানে নিহত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে কারণে যে, একটি হত্যাকাণ্ডের হোতারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর পরিচয় দিয়েছে। অন্যটি সরকারি দলের ছাত্রকর্মীরা সংঘটিত করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষমতাসীন সরকার এভাবে বিরোধী দল নির্মূলের বিশেষ কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কি না। অবশ্য হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি জোরালো অভিযোগ ওঠার পরও পুলিশ নূরু হত্যার বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি। বরং পুলিশের আচরণে একরকমঢাক গুড়, গুড়ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। নূরুল আলম নূরুর লাশ পাওয়ার খবর সকালেই রাউজান পুলিশকে জানানো হলেও তারা সঙ্গে সঙ্গে কেন অকুস্থলে গেল না প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সারা দিন পার করে বিকেল ৪টার পরে কেন তারা ঘটনাস্থলে গেল? তাহলে কি ওই দীর্ঘ সময়েনূরুল আলম নূরু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো গল্পের প্লট বানানোর পরিকল্পনা চলেছিল? জনমনে উত্থিত প্রশ্নের জবাব হয়তো পাওয়া যাবে না ; তবে ক্ষেত্রে পুলিশ যে একটা কিছু লুকাতে চাচ্ছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নূরুল আলম নূরুকে হত্যা করা হয়েছে। আর তা করা হয়েছে অত্যন্ত নির্মম উপায়ে। হাত-পা মুখ বেঁধে তাকে মারা হয়েছে। তার শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ বাসা থেকে তুলে নেয়ার পর নূরুর ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তারপর তাকে হত্যা করা হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নূরুকে যখন ওরা তুলে নিয়ে যায়, তখন তার স্ত্রী তাদের সঙ্গে থানায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে সঙ্গে নেয়া হয়নি। কেন তাকে থানায় যেতে দেয়া হলো না? সাধারণ আসামিকে ধরে নিয়ে গেলে স্বজনেরা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সঙ্গে থানায় যায়। কিন্তু ক্ষেত্রে কেন নূরুর স্ত্রীকে থানায় যেতে নিষেধ করা হলো এটা একটা রহস্য। পরদিন সকালে স্বজনেরা রাউজান থানায় গিয়ে নূরুর সন্ধান করলে থানা থেকে জানানো হয় সে থানায় নেই।
 
দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না - এটা বলা বোধ করি অসঙ্গত হবে না। অস্থিরতা বিরাজ করছে সর্বত্র। এক দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী আস্তানার সন্ধান লাভ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারেশন চলছে। নিহত হচ্ছে পুরুষ, নারী শিশু। অন্য দিকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে কোনোভাবেই স্বীকার করা যাবে না। সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপির পক্ষ থেকে নূরু হত্যার বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। প্রেস ব্রিফিং করা হয়েছে। তাতে সরকারের দমননীতির নিন্দা জানানো হয়েছে এবং সরকার বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকাতে চায় এমন অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি বিরাজমান বাস্তবতায় অসঙ্গত বলা যাবে না, বরং পেশিশক্তির ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে দমন করে রাজনীতির একচ্ছত্রাধিপতি হওয়ার একটা উদগ্র বাসনা সরকারকে পেয়ে বসেছে বলেই মনে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন যে, এখন যেমন ঝোপঝাড়, জঙ্গল, সড়ক-মহাসড়কের ধারে কিংবা খাল-নদীর তীরে বিরোধীদলীয় কর্মীদের লাশ মাঝে মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে, তেমন অবস্থা ছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও। তখন বিশেষ বাহিনী যদি কাউকে ধরে নিয়ে যেত, তাহলে তার অক্ষত দেহে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা ছিল অবসম্ভব ব্যাপার। সে সময় সারা দেশে কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীর খুনের অভিযোগ রয়েছে। আর সে অভিযোগ উত্থাপনকারী দলটির নেতা এখন বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী!

রাউজান থানা পুলিশ বলেছে, নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নূরুর বিরুদ্ধে ওই থানায় দুটি হত্যা একটি বিস্ফোরকসহ চারটি মামলা রয়েছে। নূরু যেহেতু রাজনীতি করত, সেহেতু তার বিরুদ্ধে মামলা থাকা স্বাভাবিক। তবে, ধরনের মামলা থাকাটা একজন মানুষকে হত্যা করার যৌক্তিক কারণ বা কৈফিয়ত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সে যদি হত্যা মামলার আসামি হয়েই থাকে, তাহলে আরো আগেই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে বিচারের সম্মুখীন করা হলো না কেন? পুলিশ অবশ্য এখনো নূরু হত্যার কথা স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করেনি। যদি পুলিশ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে না থাকে, তাহলে তো তাদের দায়িত্ব খুনিচক্রকে দ্রুত খুঁজে বের করা। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কর্মকর্তারা এমন কি স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলে থাকেন - ‘খুনিদের দ্রুত খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে কিন্তু ছাত্রনেতা নূরু হত্যার পর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তেমন কোনো হুঙ্কার দেননি। কেন, নূরু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন বলে? রাজনীতি করা, কোনো একটি সরকারের বিরোধিতা করা একজন নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার। আর বেঁচে থাকাও তার অধিকার। তাহলে নূরু কেন বাঁচতে পারলেন না? রাষ্ট্র কি এর দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে?


  • লেখক : মিডিয়া কর্মী

Tuesday, April 4, 2017

এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে

উবায়দুল্লাহ বাদল /   যুগান্তর

সরকার একের পর এক স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছে। গত সাড়ে তিন বছরে এ ধরনের পৌনে চারশ’ প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। গত এক সপ্তাহেই রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ বিভিন্ন স্থানে এক ডজন জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন। আরও শতাধিক প্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তারা শত শত মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। এদের প্রায় সবাই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। রাজনৈতিকভাবে এদের ঘায়েল করার জন্যই এসব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, সিলেট ও সুনামগঞ্জের মেয়রকে দ্বিতীয় দফায় বরখাস্তের পর সরকারের মনোভাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, সরকার বড় ধরনের ভুল করছে। এটা এখন বন্ধ করা উচিত বলে তারা মনে করছেন।

রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনটি নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছে। তারা এটিকে কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। তাদের মতে, চূড়ান্ত সাজার আগেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এ আইনের সুযোগ নিয়ে বরখাস্ত করা হচ্ছে। আইনের অজুহাত দেয়া হলেও সরকারের অগোচরে কিছু হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে পদচ্যুত করার মতো কাজ করে সরকার ভুল করছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওপর এ ভুলের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন।

রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, আইন অনুযায়ীই বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রোববার বিদেশ যাওয়ার আগে তিনি বলেন, বেআইনিভাবে কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি। আইন মেনেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর তীব্র সমালোচনা করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, আইনের ধারাগুলো সরকার খড়গ হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি হাতে থাকলে যে কোনো জনপ্রতিনিধি সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য। এ ধরনের আইনের সুযোগে রাজনৈতিক সরকারগুলোও সামরিক শাসকদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা সম্ভব নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় সরকার আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রতিপক্ষ এ কাজটি করছে। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা বা কাল্পনিক অভিযোগ আনা হচ্ছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে তড়িঘড়ি চার্জশিট দেয়া হচ্ছে। এভাবে আইনের ফাঁকগুলো কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিচ্ছে নির্বাচিত মেয়র বা চেয়ারম্যানের প্রতিপক্ষ। আদালত চার্জশিট আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করলেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে সাময়িকভাব বরখাস্ত করছে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ছে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ সরকার এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার কথা বলে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। তাদের মতে, এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ক্ষমতাচ্যুত করা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ, গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। তারা বলেন, একজন যে কোনো দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে সেই ব্যক্তি আর দলের থাকে না। সে জনগণের হয়ে যায়। কিন্তু আইন নিজেদের মতো ব্যবহার করে সেই প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। তারা বলেন ভোটাররা ৫ বছরের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করছেন। কিন্তু সেই প্রতিনিধির কোনো অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণের আগেই তাকে বহিষ্কার করা হয়। অনেক সময় দেখা গেছে চূড়ান্ত বিচারে তাকে নির্দোষ হিসেবে খালাস দেয়া হয়। বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দেখা যায় ৫ বছরের মেয়াদ শেষ। সে ক্ষেত্রে তাকে ওই ৫ বছরের মেয়াদ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরও পদ দখল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এসব করা হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে আইনের অজুহাতে এসব করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেটকে ভণ্ডুল করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সরকার এগুলো থেকে বিরত না হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে এবং এর পরিণতি ভালো হবে না। বিষয়গুলো বুমেরাং হয়ে এক সময় সরকারের দিকেই ফিরে আসতে পারে। তিনি বলেন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে এগুলো বন্ধ করতে হবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চারজন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ৩৫ পৌর মেয়র, ৫৬ কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯, ভাইস চেয়ারম্যান ৬৬, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৯১ ও মেম্বার ৭৪ সহ ৩৭৫ জন বরখাস্ত হয়েছেন গত সাড়ে ৩ বছরে। এদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ভোট কেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রুল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি তারা। এরা পদে বসতে না পারায় সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন ওই এলাকার জনগণ। ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য।

বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা দেশেই আমাদের সমর্থিত সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় অভিযোগপত্র দিয়ে এরই মধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। আরও কয়েকশ’ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে এর দাঁতভাঙা জবাব দেবে জনগণ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, কোনো অপরাধে মামলা হলে তার শাস্তি হতেই পারে। কিন্তু বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে ও রাজনৈতিক ময়দান থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলা দেয়া ঠিক নয়। রাজনীতির এ চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটি গণতন্ত্রচর্চার জন্য সুখকর নয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইলে বিদ্যমান আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার সুবিধা-অসুবিধাগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

রোববার রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়রকে দ্বিতীয় দফায় বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। উচ্চ আদালতের আদেশে রোববার মেয়রের দায়িত্ব নেয়ামাত্র আবারও বরখাস্ত হন রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন ও সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তবে সোমবার সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া শনিবার দ্বিতীয় দফায় বরখাস্ত হন হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জিকে গউছ।

এছাড়া একই দিনে বরখাস্ত হন মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আমিরুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান জার্জিস হোসেন। সোমবারও বরখাস্ত হয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ির মেয়র মুরতুজা সরকার মনিক ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতাহার আলী। ৩০ মার্চ বরখাস্ত হন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ও ফরিদপুরের সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াহিদুজ্জামান। এর আগে ২৩ মার্চ গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান আবু কাউছার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান আবু তালেব সরকার ও কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য দাবি করেছেন, বিএনপির দুই সিটি মেয়র ও এক পৌর মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে। সোমবার ঢাকার ডেমরায় একটি সড়ক উদ্বোধনে গেলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মেয়র বরখাস্তের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এ সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়েছে। এর পেছনে যুক্তি কী, কারণ কী- এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে আমি যতটুকু জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানেন না।’