Search

Monday, January 20, 2020

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ


নভেম্বর ৭, ১৯৭৫ থেকে মে ৩০, ১৯৮১ পর্যন্ত মাত্র প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তিটি ঐ অল্প সময়েই গ্রথিত হয়। তাঁর নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান বাংলাদেশ। তাঁর স্বল্প সময়ের কাজের বিস্তৃতি ও ফলাফল বিস্ময়কর।

বাংলাদেশের জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বড় অবদান —


১। মহান স্বাধীনতার ঘোষণা

২। রণাঙ্গনে স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়াই

৩। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয়ঐক্য প্রতিষ্ঠা

৪। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

৫। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

৬। পেশাদার সশস্ত্রবাহিনী গড়া

৭। দেশের উন্নয়ন ও জাতি গঠনে নারীর ক্ষমতায়ন

৮| খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি

৯। খালখনন কর্মসূচী

১০। উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী নীতি প্রণয়ন

১১। আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা

১২। বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান

শহীদ জিয়া এক মহান নেতা

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান

বাংলাদেশের জননন্দিত মহান নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রণক্ষেত্রের বীর সেনানী, সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে বর্বরোচিত আক্রমণ পর বাঙালি জাতির জীবনে এক চরম ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়। সেই ক্রান্তিলগ্নে সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ‘We revolt’ বলে বিদ্রোহ এবং পকিস্তান বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্থাপিত অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাব অর্জন করেছিলেন।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ মাটির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল জিয়ার তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্ফূরণ ঘটে ১৯৭৫ সালে। এ বছরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান যুগপৎভাবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দলীয় ভিত্তিতে ও প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়া। এভাবেই একজন সমর নেতা থেকে জিয়াউর রহমান একজন রাজনীতিবিদ জননেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন পথনির্দেশ লাভ করে।

জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে তার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১ খ্রি.) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাফল্য ছিল বহুবিধ। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনি নানা সঙ্কটে বিধ্বস্ত, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে দেশের ইতিহাসে একজন সফল ও মহান রাষ্ট্রনায়কের খ্যাতি লাভ করেছেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। শহীদ জিয়ার উদ্যোগে দেশে পুনরায় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়।

১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাষ্ট্রপতির জারিকৃত ‘রাজনৈতিক দল-বিধি’ (Political Parties Regulations- PPR)-এর আওতায় ২১টি রাজনৈতিক দল সরকারি নিবন্ধন লাভ করেছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি নিজে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত দলটি বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। জিয়া শুধু বহুদলীয় রাজনীতির পুনপ্রর্বতন করেননি, তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের হরণ করে নেয়া স্বাধীনতাও পুনপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালু ছিল, তার শাসনামলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক শ’তে। সাংবাদিকদের জন্য নতুন ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষণের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রেস কাউন্সিল গঠন জিয়ারই অবদান।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নকল্পে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সমস্যা জর্জরিত এ দেশে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পল্লী উন্নয়ন, দ্রুততর প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে জিয়া বিখ্যাত ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশে আর্থসামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে তিনি দেশের রাজনীতিকে উৎপাদনমুখী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করেন। এ লক্ষ্যে তিনি যে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে তিনি ঘোষণা করেন ‘বিপ্লব’ হিসেবে। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়া এক ভাষণে এ বিপ্লবের কথা বলেন। তিনি তার ঘোষিত ১৯ দফাকে এ বিপ্লবের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঐকান্তিকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৌশল হিসেবে বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করেন। বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধকরণে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন।

জিয়া সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে ঘোষণা এবং এর নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ‘জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ (NIPORT) এবং পরে ‘পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন এবং জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুক্ত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে মহিলা বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন একাডেমির তত্ত্বাবধানে নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নারীদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ, যুবসমাজকে দেশপ্রেম, জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি ও দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাদের জন্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় যুবসংস্থা ও গ্রামে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়।

দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা শহীদ জিয়ার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিপূরক হিসেবে গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের প্রায় ৪০ লাখ নিরক্ষর লোককে স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়।

একটি বিভাজিত, স্থবির ও হতাশাগ্রস্ত জাতিকে অভিন্ন পরিচয়ে আবদ্ধ করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মমতের জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরন বিভিন্ন। তাই শুধু ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-জেন্ডার-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জাতীয়তাবাদের এ ধারণা বাংলাদেশে তৎকালে বিরাজমান কৃত্রিম রাজনৈতিক বিভেদের অবসান ঘটিয়েছিল।

একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে শান্তি ও অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস নেন। বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা, দেশের স্বার্থ সুরক্ষা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে নতুন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। কোনো বিশেষ পথ-মতের রাষ্ট্রশক্তি নয়, বরং সব পথ-মতের অর্থাৎ দক্ষিণ, মধ্য ও বামপন্থী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই ছিল জিয়া সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিশেষ দিক। তার সময়ে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও বিদ্যমান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ আল কুদসের শীর্ষ কমিটি, ইসলামিক সলিডারিটি কমিটি, ইরাক-ইরান শান্তি কমিটিসহ মুসলিম ও আরব বিশ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করে। তখন বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রমের সাথেও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ‘দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা’-সার্ক তার চিন্তা ও প্রয়াসের ফসল।

জিয়াউর রহমান ছিলেন সৎ, আদর্শবান ও নিরহঙ্কারী মানুষ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার সাদাসিধে জীবন-যাপন মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। জিয়ার প্রতি মানুষের অপার ভালোবাসা, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠা অনেকেরই সহ্য হয়নি। তাই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় সুগভীর ষড়যন্ত্র। এর শেষ পরিণতি ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে তার মর্মান্তিক শাহাদাতবরণ।

জিয়া একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। জাতীয় ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে একজন পরিত্রাণকারী হিসেবে রাজনীতিতে জিয়ার আবির্ভাব। তিনি শতধা বিভক্ত জাতিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জিয়া দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক অনুভূতির নাম। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’- ছিল জিয়ার বিশ্বাস ও ধ্যান। তিনি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। সাময়িকভাবে আজ জিয়াকে হেয় করা, তার সোনালি অবদানকে অস্বীকার করার অপতৎপরতা আমরা দেখছি। কিন্তু এ অপপ্রয়াস সফল হবে না। জিয়াকে ভুলিয়ে দেয়া, তার অবদানকে মুছে ফেলার সাধ্য এ দেশে কারো হবে না। জিয়া থাকবেন দেশপ্রেমিক বিবেকবান প্রতিটি মানুষের অন্তরে এক জীবন্ত প্রত্যয় হিসেবে।

  • লেখক অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
  • কার্টসি — নয়া দিগন্ত

সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে শহীদ জিয়ার অবদান

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম

জিয়াউর রহমান বীর উত্তম জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাংলাদেশের ইতিহাসে তার শাসনামল (১৯৭৫-১৯৮১) এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান বহুবিধ সাফল্যের অধিকারী। স্বল্প সময়ের শাসনামলে নানা সঙ্কটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে জিয়া ইতিহাসে নিজের অক্ষয় স্থান নিশ্চিত করেন। বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, সময়োপযোগী গতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান ও গতিপথ নির্ধারণ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতার পথনির্দেশ শহীদ জিয়ার অন্যতম অবদান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের এসব বহুমাত্রিক সাফল্য বা কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা নয়, বরং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ও বিকাশে তার অবদান সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। আজ ১৯ জানুয়ারি শহীদ জিয়ার শুভ জন্মদিন। জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

আভিধানিক অর্থে সংস্কৃতি বলতে চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধনকে বোঝানো হয়। ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতি বলতে মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত সুকুমার বৃত্তি ও কীর্তিকর্মকে বুঝায়। একটি জাতির জীবনে তার সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। সংস্কৃতি হলো একটি জাতির টিকে থাকার কৌশল এবং সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একটি জাতির মনন ও রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সুরুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান মানুষ। বই পড়া ও গান শুনা ছিল তার প্রিয় ও পছন্দের কাজ। তিনি একজন চৌকস ক্রীড়াবিদ ছিলেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয় জীবনে সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং এর উন্নয়ন বিকাশে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন।

জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শহীদ জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চেতনার অনুক‚লে এবং এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ নামে জিয়াউর রহমানের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয়ের কথা বলেন এর মধ্যে অন্যতম হলো- আমাদের সংস্কৃতি। এ প্রসঙ্গে বলা হয়- ‘আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা, উদ্দীপনা, আন্তরিকভাবে ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।’ জিয়া মনে করতেন, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের দেশজ কৃষ্টির ধারক ও বাহক। এ সংস্কৃতির রয়েছে বিকাশ ও সমৃদ্ধিপ্রাপ্তির এক অনন্য সাধারণ ঐতিহ্য- যা বলিষ্ঠ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। নিবন্ধে জিয়াউর রহমান উল্লেখ করেন যে, ‘আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ এ দেশের সংস্কৃতিকে দিয়েছে দুর্বার শক্তি।’ সেই চেতনার আলোকে আমাদের সংস্কৃতির নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্যকে আরো মহিমান্বিত করার ব্যাপারে জিয়াউর রহমান তার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন পূর্বোক্ত নিবন্ধে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রে ২৮ নম্বর ধারায় বাংলাদেশী সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশে বিএনপির কর্মপ্রয়াসের কথা বলা হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘জাতির স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনশীল প্রতিভার সুষ্ঠু সার্বিক বিকাশের উদ্দেশ্যে আমাদের দল সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়ার সংগঠিত ও বিস্তৃততর উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেবে।’ এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য- (ক) দেশের প্রতিটি এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংস্কৃতি ও ক্রীড়া কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে ও সুবিন্যস্তভাবে গড়ে তোলা হবে; (খ) সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সব জননির্ভর এবং জীবনমুখী লোক প্রচেষ্টাকে প্রয়োজনীয় ও বাস্তব সহায়তা দেয়া হবে; এবং (গ) দেশের আনাচে-কানাচে সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে যেসব প্রতিভাশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী রয়েছে তাদের চর্চা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিয়ে তাদের সাধনালব্ধ কৃতিত্বকে জাতীয় সম্মান ও সম্পদে রূপান্তরিত করার সুসংগঠিত চেষ্টা চালানো হবে।

বিশ্বের ইতিহাসে আমরা ব্যতিক্রমী জাতি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ ধরে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নিজেদের সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালি ঠিক করে নেয় তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। তাই একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির চর্চা এবং এর বিকাশ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’ (জাসাস) প্রতিষ্ঠা করেন।

শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ও আত্মোপলব্ধির অনস্বীকার্য উপাদান। তাই বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাতে জাতীয় জীবনে পূর্ণ ও ব্যাপক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য বিএনপি ও তার সরকার নিরলসভাবে চেষ্টা করবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কার্যক্রম সুসংহত ও বলিষ্ঠ করার ব্যাপারে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক সর্ববৃহৎ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। এ বাংলা একাডেমির উন্নয়নে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শহীদ জিয়া তার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে তার অঙ্গীকার ও প্রত্যয় বাস্তব রূপ দেন। বাংলা একাডেমির সার্বিক উন্নয়ন ও এর কাঠামোগত বিকাশ সাধনে শহীদ জিয়া ১৯৭৮ সালের ৬ জুন ‘দি বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮’ জারি করেন। বাংলা একাডেমির পরিচালনায় এ অধ্যাদেশটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাই এ দেশের শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের সাংস্কৃতিক-মানসিক ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ বলে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি বছরব্যাপী যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে এ প্রতিযোগিতার দ্বার উদ্ঘাটন করেন।

শহীদ জিয়া কোমলমতি শিশুদের বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ১৯৭৯ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে একটি শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই সর্বপ্রথম শিশু-কিশোরদের প্রতিভা ও মানসিক বিকাশের কথা চিন্তা করেছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে চালু করেছিলেন ‘নতুন কুঁড়ি’ নামক এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এমন অনেক প্রতিভা বেরিয়ে এসেছেন, যারা আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রতœতাত্তি¡ক, নৃ-তাত্তি¡ক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। শহীদ জিয়া এ জাদুঘরের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি যেন বিলীয়মান না হয়ে পড়ে জিয়াউর রহমান এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাই এ সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ (বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ক্ষদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’) এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন।

শহীদ জিয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে একটি চলচ্চিত্র নগরী, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা, সৃজনশীল ও উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অব্যাহত রাখেন। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের বিকাশের জন্য ‘প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন করেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন ট্রান্সমিশন চালু করেন।

একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এ সত্য উপলব্ধি করে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য নানামুখী কর্মতৎপরতা চালান। তাই বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের যে দিকেই তাকানো হোক না কেনো, সে দিকেই দেখা যাবে জিয়ার হাতের স্পর্শ, মানসপটে ভেসে উঠবে শহীদ জিয়ার প্রতিকৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে শহীদ জিয়ার এসব অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না। ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে।

  • লেখক অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • কার্টসি — নয়াদিগন্ত

রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বীরউত্তম

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সাথে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় যেদিন ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, সেদিনই অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ড অস্তিত্ব ধ্বংসের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। ফলে বিবর্তনের পথে এই ঢাকায়ই খণ্ডিত রয়ে গেল পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই বিবর্তন জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম একটি প্রাসঙ্গিক অধ্যায়।

স্বাধীনতারযুদ্ধের ‘WE REVOLT’ এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিক প্রথম ঘোষণার ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ‘জেড ফোর্স’। এই স্বর্ণালি অধ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টিতে জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রখ্যাত দার্শনিক হেনরি বিয়েনের মতে, ‘সামরিক শাসন’ শব্দটি এক ধরনের অপপ্রয়োগ। কারণ যেকোনো সামরিক অভ্যুত্থানের পরেই যে মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় সেখানে অনেক অসামরিক ব্যক্তি বা সিভিলিয়ান থাকেন। ১৯৭৫-পরবর্তী একটি অধ্যায়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় তাতে ১২ জনের মধ্যে ৯ জন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি এবং প্রথমবারের মতো এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের একজন চাকমা রাজার পত্নীও ছিলেন। জিয়ার দূরদর্শিতার চেতনায় দেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার স্বীকৃতি এখানে প্রমাণিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকাবহ পরিবর্তন এবং পরবর্তী তিনটি সেনা অভ্যুত্থানের ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষত বিবদমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটাই চাওয়া ছিল, রাষ্ট্র ও সমাজ যেন স্থিতিশীল থাকে। তখন শক্ত হাতে জিয়াউর রহমানের হাল ধরায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। মুদ্রাস্ফীতি কমে আসে। পরবর্তী সময়ে কয়েক বছর কৃষক গোলায় ভালো ফসল পায়। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপক ঘোষণা এবং একটি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতার মতো স্থিতি বজায় রাখার সামর্থ্যে জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি দাঁড়ানোর মতো উর্বর জমি পেয়ে যায়।

সে সময় এই অনুকূল উত্থান এবং মোটা দাগে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য -

১. আওয়ামী লীগের শাসনামলের দুর্নীতি, দুঃশাসন থেকে দেশকে বাঁচানো।

২. দুর্বল ও ভঙ্গুর রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণ।

৩. সামরিক (প্রতিরক্ষা) বাহিনীর গোষ্ঠীগত স্বার্থ দেখভাল করা।

ধর্মীয় অনুশাসন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের প্রতীক জিয়া ছিলেন বিনয়ী এবং আল্লাহ অনুগত। পবিত্র কাবাঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের দুর্লভ সুযোগে তিনি ইবাদতে এতটা গভীর নিমগ্ন ছিলেন যে তাঁর সফরসঙ্গীরা তাঁকে বেরোতে না দেখে পুনঃপ্রবেশ করে দেখলেন কাবা শরিফের মূল মেঝে পরিষ্কার করার ঝাড়ন বুকে রেখে অশ্রুভরা চোখে দুই হাত তুলে আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করছেন।

পরিশ্রমী, দূরদর্শী দেশপ্রেমিক সৈনিক জিয়া শুধু ছবিতে নয়, ঠাঁই পেয়েছেন আপামর সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। চারণ কবির মতো হেঁটে বেড়িয়েছেন শত শত মাইলের গ্রামবাংলার পথ-প্রান্তর, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, কৃষকের সুখ-দুঃখের বর্ণনা শুনেছেন, গৃহস্থকে উঠানের পাশে গাছ লাগানো, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু পালন করতে, পুকুর-জলাশয়ে মাছ চাষ করতে, নিজেদের স্বনির্ভরতার পরামর্শ দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কৃষি উৎপাদনে উন্নয়নের মূল সমস্যা হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন শুকনো মৌসুমে পানির অভাব আর বর্ষার মৌসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ। শুরু করেন খাল খনন। পল্লী অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হাট-বাজারের উন্নয়নকল্পে বিভাগীয় উন্নয়ন বোর্ডগুলোর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান পাঁচসালা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কৃষকের সারের বিলিবণ্টন, কৃষিব্যবস্থা সহজতর করার জন্য তিনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কিছু নতুন উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে পাটের গুরুত্ব অনুধাবন করে গবেষণাক্ষেত্রে পাট অগ্রাধিকার পায়। বেসরকারি খাতে পাট রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় তখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাট রপ্তানি হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি থানায় একটি গ্রাম স্বনির্ভর করার কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৯৭৭ সালে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি গ্রাম স্বনির্ভর করার কর্মসূচি হাতে নেন তিনি। গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়ন এবং বেকারত্ব দূরীকরণে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনে ব্যাপক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম অর্থনীতির অবকাঠামো অপরিহার্য বিদ্যুতে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড তাঁর অমর সৃষ্টি। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, হাওর এলাকা, উপকূলীয় অঞ্চলের দ্রুত উন্নয়নে আরো তিনটি বিশেষ বোর্ড গঠন করেন তিনি। শহীদ জিয়ার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কার্যক্রম এখনো মডেল হিসেবে আফ্রিকাসহ অনেক দেশে চলমান।

জিয়াউর রহমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে আরো তৃণমূলে নিয়ে যেতে গঠন করেন গ্রাম সরকার। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণে ন্যূনতম পর্যায়ে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন-প্রশাসন ও উন্নয়ন সুবিধা ছড়িয়ে দিতে গঠন করেন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি। আনুমানিক ৬৫ হাজার গ্রাম সরকার গঠিত হয় ডিসেম্বর ১৯৮০ সালের দিকে। নিম্ন পরিবারগুলো থেকে আসা ভিডিপি সদস্যরা জনজীবনে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার পাশপাশি সারা মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়ার প্রচেষ্টায় খাল খনন, পল্লী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ বহুবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। কেন্দ্র থেকে প্রশাসনের দেওয়া নাগরিক সেবা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে জিয়াউর রহমান মন্ত্রিসভা বৈঠকগুলো অঞ্চল ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নেন। কখনো বরিশাল, কখনো বগুড়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অনেক স্থানে এসব বৈঠক করে প্রশাসনিক আওতাধীন এলাকাগুলোতে পরিবেশ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য—ফসল উৎপাদন নিরাপত্তাবেষ্টনী, বনায়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ব্যাপক জমি সেচ ব্যবস্থাসহ টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ শুরু করেন। পর্যটনশিল্পকে বিস্তৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনভিত্তিক করার বিশেষ উদ্যোগ নেন। ঢাকাকে মেট্রোপলিটন নগর ঘোষণা করাসহ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ফোর্স গঠন করেন। মহিলা আনসার ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। নাটোরে উত্তরা গণভবন প্রতিষ্ঠা করেন, বরিশালসহ আরো কয়েকটি জেলা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে প্রশাসনিক বিভাগ গঠন করার সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নে অগ্রগতিও তাঁর দূরদৃষ্টি নেতৃত্বের প্রকাশ।

চট্টগ্রামে শিপিং করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়, বরিশালে আইডাব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রামে ড্রাই ডক প্রতিষ্ঠা—এসব প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের শহর-নগরভিত্তিক ছোট ছোট উদাহরণ মাত্র। জিয়াউর রহমানের মনন ও মস্তিষ্কে ছিল গোটা বাংলাদেশের মানচিত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, উপকূলীয় অঞ্চল উন্নয়ন বোর্ড, হাওর উন্নয়ন বোর্ড এর গুটিকয়েক নমুনা মাত্র।

জাতীয়কৃত লোকসানী শিল্প-কলকারখানাগুলো বেসরকারি মালিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে একটি উদ্যম তৈরি করে দেন জিয়া। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তখন এক শিফটের স্থলে তিন শিফটে উৎপাদন শুরু হয়। ভারী ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন উদ্দীপনায় কাজ শুরু করে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে আয় ক্রমেই বাড়তে থাকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো গতিশীল হয়। গার্মেন্টশিল্পে বিশেষ প্রণোদনার উদ্দেশ্যে আমলাদের আপত্তি সত্ত্বেও শহীদ জিয়া ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস’ এবং ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির বিশেষ ব্যবস্থা করেন। দ্রুত বিকশিত হতে থাকে গার্মেন্টশিল্প। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, কম শিক্ষিত পরিবারের নারী সদস্যরা পরিবারের বোঝার পরিবর্তে পরিবারের স্বস্তিতে পরিণত হয়। দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ প্রণোদনার ফলে পাটশিল্প বহুমুখী উৎপাদনে যায়, বাড়ে শিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থান। রপ্তানিতে আসে বর্ধিত বৈশিক মুদ্রা।
উদার নীতিমালা তৈরি করার কারণে ডকইয়ার্ড নির্মাণে জমি বরাদ্দ সহজ হয়। বেসরকারি উদ্যোগে বহু ছোটবড় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যা আজ দেশে তৈরি জাহাজ বিদেশি ওয়ার্ক অর্ডারে নির্মাণ করে দিয়ে খ্যাতি অর্জন করছে। জেলা এবং তৎকালীন মহকুমাভিত্তিক বিসিকের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রচেষ্টায় শত শত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। হস্তশিল্প, নকশিকাঁথা, জামদানিশিল্প পুনর্জীবন পায়। অর্থনীতির চাকা সচল ও গতিপ্রাপ্ত হয়। শিল্পকারখানায় বিশেষ ব্যবস্থায় স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তার জন্য ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ এবং আইসিবি (ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ সেল গঠন করে শিল্প উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। উদ্যোক্তাদের মেইনটেন্যান্স খরচ সাশ্রয়ে বড় বড় জেলা শহরে শিল্প ব্যাংকের শাখা খোলা হয়। ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের শাখা বৃদ্ধি করে প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়িয়ে যুবক-তরুণদের স্বনির্ভর ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহিত করে আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক কারিগরি শিক্ষক ও উদ্যোক্তা গোষ্ঠী তৈরি করা হয় জিয়ার উদ্যমী প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতায়।

শহীদ জিয়াউর রহমানই প্রথম বাংলাদেশ থেকে আধা দক্ষ, অদক্ষ ছয় হাজার শ্রমশক্তি রপ্তানি করেন ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ আরো কিছু দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন তিনি ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলোতে ‘লেবার অ্যাটাশে পদ সৃষ্টি করে প্রশিক্ষিত কর্মসংস্থান এবং তাদের মাধ্যমে শ্রমশক্তি রপ্তানি করে জনসংখ্যার সমস্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান।

ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে অগ্রগতি সাধিত হয় জগজীবন রামের সঙ্গে বন্ধুসুলভ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায়। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা পেতেও যা সহায়ক হয়। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনস্রোত ফেরত পাঠানো জিয়ার সফল পররাষ্ট্রনীতির মাইলফলক। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগী তথা কানেকটিভিটি বাড়াতে আঞ্চলিক সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর ঐকান্তিক পরিশ্রমে গঠিত হয় ‘দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা’ (সার্ক)।

মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে দেশের ট্রেড ব্যালান্স পক্ষে আনেন জিয়াউর রহমান। ইরান-ইরাক যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি মধ্যস্থতাকারী হওয়ার সম্মান পান। আল কুদস কমিটির সদস্য হয় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীর করে দেশের বিশাল উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পাশে আনতে সক্ষম হন তাদের। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বৃহৎ উন্নত দেশ জাপানকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সালে প্রথমবার এই সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্য পদ লাভ করে ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮-এ এবং ১৯৮১-তে।

একটি দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার শ্রমকে পুঁজি করা হচ্ছে আসল মুনিশয়ানার পরিচয়ে। এই মুনিশয়ানার প্রমাণ হচ্ছে দেশে প্রথম মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, যা নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় উন্নয়নে তাদের অবদান রাখার রাষ্ট্রের সুযোগ তৈরি করে দেয়। আজ দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে অবদানের ক্ষেত্রে তারাও বিশাল অংশীদার।
সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে শিশু-কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। সরকারি টেলিভিশনে যখন রঙিন সম্প্রচার শুরু হয় তখন কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও সাদাকালো টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠান চালু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশু-কিশোর প্রতিভা ও জাতীয় পর্যায়ে বিকাশের সুযোগ তৈরি করেন জিয়া। বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘হিযবুল বহর’-এ বঙ্গোপসাগরবক্ষে ভ্রমণ তথা দেশরত্ন হওয়ার মানসিক বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। রেডিও স্টেশনের অনুষ্ঠানে মেধাবী শিশুদের এবং রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাসিমুখে পরস্পর ফুল ছড়াছড়ির দীর্ঘ আনন্দঘন সময় এ দেশের শিশুরা আর পেয়েছে কি?

বীর-উত্তম জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং রেমিট্যান্স উন্নয়নের রোল মডেলের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে খালেদা জিয়ার মাধ্যমে। বীর-উত্তম জিয়াউর রহমান আজও প্রতিচ্ছবি হয়ে জেগে আছেন

‘বাংলাদেশের ধানের শীষে জিয়া তুমি আছ মিশে’— এই পঙক্তিতে।

— লেখক যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি এবং সাবেক এমপি

Thursday, January 16, 2020

আমার ভোট আমি দিতে পারবো তো?

মিথুন রায়

নির্বাচন নিয়ে সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টালিনের একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। স্টালিন বলেছিলেন- “দেশের জনগণের জন্য এটা জানাটাই যথেষ্ট যে দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যারা ভোট দেয় তারা কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় না। যারা ভোট গণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে তারাই সিদ্ধান্ত নেয় ফলাফল কী হবে।”

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচনগুলো ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্থান পেয়েছিল। এর পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের শেষ দুটি জাতীয় নির্বাচনে তৈরি হয় ভিন্ন প্রেক্ষাপট। ২০১১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পক্ষে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়কে ভিত্তি ধরেই সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে মহাজোট সরকার। শুরু হয় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। 

ঘনিয়ে আসছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বহুল আলোচিত এ নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। বেশ কয়েকটি দলের প্রার্থী ভোটে অংশ নিলেও ভোটের যুদ্ধটা হবে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে। দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী এ দুদলের মেয়র প্রার্থীরা দিনরাত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। নৌকা ও ধানের শীষে ভোট চাইতে নেতাকর্মীদের নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। সব মিলিয়ে ঢাকা সিটি নির্বাচন ঘিরে রাজধানীতে এখন জমজমাট ভোটের রাজনীতি। 

এরই ফাঁকে উঁকি মারছে সন্দেহ, প্রশ্ন আর আশঙ্কা। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, ভোট এলেই ভোটারদের মর্যাদা বাড়ে, মূল্যায়ন বাড়ে। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলানো আর কোলাকুলির মহোৎসব শুরু হয়। কিন্তু ব্যালটে সিল মারার পর ভোটার তথৈবচ! প্রার্থী কিংবা বিজয়ীর সঙ্গে মুহূর্তেই যোজন যোজন দূরত্ব বেড়ে যায় সাধারণ ভোটারদের। তারপরও স্থানীয় কিংবা জাতীয় যেকোনও নির্বাচন এলেই ভোটারদের মাঝেও উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ে। প্রত্যেকেই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে চায়। 

কিন্তু বাংলাদেশে সবশেষ কয়েক বছর বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনী যে হালচাল তা থেকে নেয়া শিক্ষা ভাবিয়ে তুলেছে ঢাকা সিটির ভোটারদেরও। ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগছে- ‘আমার ভোট আমি দিতে পারবো তো?’ আর এই সন্দেহের বড় কারণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিতর্ক। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে প্রায় সব বিরোধী শিবির থেকেই একটি অভিযোগ প্রবলভাবে উঠে এসেছিল একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ভোট পরবর্তী ফলাফল নিয়ে। আর সেটি হচ্ছে ‘আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা’।  

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে একতরফা জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সেই নির্বাচনকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ‘কলঙ্কজনক’ নির্বাচন বলে আখ্যা দেয়। নির্বাচন পরবর্তী ভোট বাতিলের দাবি উঠে। নতুন নির্বাচনের দাবি উঠে। কিন্তু এর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। উল্টো দেখতে দেখতে বর্তমান মেয়াদের আরও একটি বছর দাপদের সঙ্গেই পার করে দিলো আওয়ামী লীগ। 

একাদশ নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়েও বেশি হতাশ হয়েছিল দেশের সাধারণ ভোটাররা। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রেই ছিল ভোট ডাকাতির মহড়া। ভোটাররা সকালে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখে তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কারা দিলো তাদের ভোট? কার পক্ষে পড়লো কার ভোট? এসব প্রশ্ন যতোই বড় হয়ে সামনে আসলো কিছুতেই কিছু হলো না। হলো যেটা তা হলো- আড়াইশোরও বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠন করলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার। 

আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা এখন গণসংযোগে ব্যস্তিব্যস্ত। তারপরও প্রতিদিনই শঙ্কার কালো মেঘ উড়ছে বিশেষত বিএনপিপন্থিদের শিবিরে। আর সেটির বড় কারণ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। যেটাকে সংক্ষেপে বলা হয় ই-ভোটিং। ব্যালট-বাক্স বাদ দিয়ে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তকে ‘ভোট চুরির নীলনকশা’ বলে অভিযোগ উঠেছে। এটাকে সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি বলা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে বেশ কিছু সংসদীয় আসনের কিছু কিছু কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। কিন্তু ইভিএম নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো আপত্তি তুললেও নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ একমত। সরকার ও কমিশন বলছে, ইভিএম ভোটগ্রহণের সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় লাগে মাত্র ১৪ সেকেন্ড। একটি মেশিনে প্রায় ৪ হাজার ভোট দেয়া যায়। থাকতে পারে সর্বোচ্চ ৬৪ জন প্রার্থীর তালিকা। একইসঙ্গে একজন ভোটারের কোনোভাবেই একটি বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না এ পদ্ধতিতে। আর ভোটগণনাও হয়ে যায় যখন-তখন। 

নির্বাচন কমিশন বলছে, ইভিএমে ভোটগ্রহণের সঠিক কৌশল জানানোর জন্য পোলিং এজেন্ট ও রিটার্নিং অফিসারদের প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এটা ঠিক যে এই ইভিএম ও এর প্রশিক্ষণ খাতে ইসি কাড়ি কাড়ি টাকা ইতোমধ্যে খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ কি এই ইভিএম সিস্টেম রপ্ত করতে পেরেছে? ‘শর্ষের ভেতর ভুত’ থাকার মতো ইভিএমে ভেজাল হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? বরং সাম্প্রতিক দু-একটি উপনির্বাচনে এই ইভিএমই হয়েছে ভোটারদের মূল বিড়ম্বনা। 

নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। গোটা বিশ্বে গত আড়াইশো কি তিনশো বছর যাবত আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গন্ত্রতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক ও সর্বোত্তম প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন আসতেই পারে। কিন্তু সেই পরিবর্তন বা সংস্কার যদি হয় প্রশ্নবিদ্ধ, যদি সেটি না হয় সবজনস্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্য তবে তা অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে নির্বাচনী সংস্কারে নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপের বিকল্প কিছু হতে পারে না। অন্যথায় ভোট নিয়ে ভোটারের বিপত্তি, বিড়ম্বনা আর অনীহা উত্তরোত্তর বাড়বেই। আর তাতে শক্তি, সামর্থ্য আর আস্থা হারাবে নির্বাচনী সংস্কৃতি।  

  • লেখক: সংবাদকর্মী
  • কার্টসি -  ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি /১৬ জানুয়ারি ২০২০

অবশেষে বৈধতা পেলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড!

রুমিন ফারহানা

গতকাল সংসদে বসে এক পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল আমি কি সংসদে আছি,  নাকি গলির মোড়ের কোনো চা দোকানে? সংসদে তখন পয়েন্ট অব অর্ডারে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জনাব মুজিবুল হক চুন্নু। প্রকাশ্যে তিনি কোনোরকম রাখঢাক ছাড়া ধর্ষণে অভিযুক্তদের বিনা বিচারে হত্যা করার দাবি জানান। এরপর তাতে অংশ নেন একই পার্টির জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি আরো খোলামেলা, আরো দৃঢ়ভাবে এই দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে এনকাউন্টার মাস্ট। ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে। একমাত্র ওষুধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা।’ জনাব ফিরোজ রশীদ এর আগেও ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তদের গুলি করে মেরে ফেলার দাওয়াই দিয়েছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ তার বক্তৃতায় এই দুইজনকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন।

সবকিছুর পর বাকি ছিল এটার একটা ধর্মীয় দ্যোতনা যুক্ত করা। সরকারি জোটের সঙ্গী তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী সেটা পূর্ণ করেছেন। ‘ফতোয়া’ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে কোনো অসুবিধা নাই।’

এই দেশের আইনপ্রণেতারা সংসদে দাঁড়িয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্ররোচনা দেন। জানি, সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের কারণে এমন বক্তব্য নিয়ে তাদের আইনের মুখোমুখি করা যাবে না, কিন্তু সেটা করা না গেলেই কি সংসদে বলা যাবে যা ইচ্ছে তাই? সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার সময় তো আমরা বলেছিলাম, ‘আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিবো’। তাহলে এত ভয়ঙ্কর বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বক্তব্য কীভাবে দেন তারা?
রুমিন ফারহানা

আমি জানি এই রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনো বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের পক্ষে। জনগণের চিন্তার সঙ্গে মিল রেখে কথা বলা রাজনীতিবিদদের এক ধরনের চর্চাও আছে। কিন্তু যে বিষয়ে জনগণের চিন্তার মতো করে কথা বলা মানুষের প্রাণ সংহার করে বেআইনিভাবে, যে বিষয়ে কথা বলা মানুষের সর্বজনীন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, সে বিষয়ে কথা বলা সংসদ সদস্যদের জন্য চরম গর্হিত অপরাধ। পপুলিজম এভাবেই রাষ্ট্রের জন্য চরম ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনো হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য সফল করেনি। ১৯৭৬-১৯৮৩ সময়কালে আর্জেন্টিনার কয়েকজন সামরিক শাসক বিরোধী মতকে দমন করার নামে অন্তত ১৫ হাজার মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল। যাদের মধ্যে ছিল বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, এমনকি ধর্মগুরু। একই কারণে চিলির কুখ্যাত শাসক অগাস্ট পিনোশে হত্যা করে পাঁচ হাজারের মতো বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে। কিন্তু কেউই বিরোধী মত বা দলকে নিঃশেষ করে ফেলতে সমর্থ হয়নি।

সামপ্রতিককালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে। সরকারের ৫টি সংস্থার রিপোর্টে নাম আসা বদি পরিবার থাকবেন সংসদে আর সরকার বলবে জিরো টলারেন্স। নিরাপদে থাকবেন রাঘববোয়াল আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে কিছু চুনোপুঁটি। কিন্তু ফিলিপিন্সে সেটা হচ্ছে না। রদ্রিগো দুতার্তের সরকার মাদকের সঙ্গে যুক্ত সব রকম মানুষকে ধরতে পারলেই হত্যা করছে। ২০১৬-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে ২০১৯-এর শুরুর মধ্যেই মাত্র আড়াই বছরে বিনা বিচারে হত্যার সংখ্যা বেসরকারি হিসাবে ২০ হাজারের বেশি। এই ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞও ফিলিপিন্সের মাদক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

ধর্ষণ নিঃসন্দেহে এক বীভৎস ফৌজদারি অপরাধ। শুধু ভিকটিম না, তার পরিবার এবং সমাজকেও ধ্বংস করে এই অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি বিনা প্রতিবাদে মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু সেই দণ্ড হতে হবে দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা মেনে। আইন প্রণয়ন সংসদ সদস্যদের মূল কাজ। তারা চাইলে যেকোনো সময় আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়ায় যদি কোনো ত্রুটি থাকে সেটা নিয়েও সংসদে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। সংশোধনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ সদস্য যখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেন তখন দেশে আইনের শাসন বা বিচার ব্যবস্থা বলে আর কিছু থাকে না।

এই দেশে ইদানীং এক ব্যাধি শুরু হয়েছে- যাই ঘটুক না কেন অনেকেই মনে করতে শুরু করেছে কয়েকজন মানুষকে ধরে খুন করে ফেললে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। গত অধিবেশনেই পিয়াজের উচ্চমূল্য নিয়ে যখন সংসদে কথা হচ্ছিল, তখনো জনাব মুজিবুল হক চুন্নু পিয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে বিনা বিচারে হত্যার দাওয়াই দিয়েছিলেন। সমাজের একেবারে অর্ধশিক্ষিত মানুষের এই ধরনের প্রবণতা তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু একটা দেশের সংসদের ভেতরে যখন এই ধরনের দাবি তোলা হয় তখন সেটা এই রাষ্ট্রের একটা মূলস্তম্ভ আইনসভা সম্পর্কেই গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়।

গতকালের সংসদের আলোচনায় বিনা বিচারে হত্যার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বিচার ব্যবস্থার নানা ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন জনাব ফিরোজ রশীদ। এমন এক সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এই কথা বলেছেন, যেখানে ক্ষমতাসীন দলটি গত ১১ বছর ধরে নিরঙ্কুশভাবে টানা ক্ষমতায়। আইনের বা পদ্ধতিগত কোনো সমস্যা থাকলে সেটা সংশোধন করার জন্য আইন তো বটেই, সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতাও এই সরকারের হাতে ছিল, আছে। কিন্তু সেসবের জন্য সরকারকে দায়ী না করে তথাকথিত বিরোধী দলের সদস্যরা বরং সরকারকে দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের পর থেকে এটাই সংসদের এক ধরনের প্রবণতা।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যদি কোনো সমস্যা সত্যি সত্যি স্থায়ী সমাধান করতো তবুও কি এটা সমর্থনযোগ্য? কোনোভাবেই না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটা রাষ্ট্রের একেবারে মৌলিক চেতনার পরিপন্থি। এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি বলে ন্যায়বিচার পাবার অধিকারী। সেই ন্যায়বিচারে তার এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র কোনো মানুষকে বিনা বিচারে খুন করার অধিকার রাখে না। কথাগুলোকে কেউ কেউ কেতাবি কথা বলতে পারেন, কিন্তু একটা রাষ্ট্র গড়ার ন্যূনতম পদক্ষেপের মধ্যে এটা একটা।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমাজের অনেকেই মেনে নেন। ২০১৮ সালে এবং এ বছর এখন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে একজনের বেশি মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু কেউ উচ্চবাচ্য করছে না তেমন। কিন্তু ভয়ঙ্কর আশঙ্কার ব্যাপার, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং নাগরিক সমাজের কিছু সদস্য এক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে খুব জোর গলায় কথা বলতেন, এখন তারা আর কথা বলেন না ম্রিয়মাণ গলাতেও চুপ থাকেন।

রাষ্ট্র অন্তর্গতভাবেই নিপীড়ক বলপ্রয়োগকারী সত্তা। নাগরিকদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে সেই সত্তাকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে তাকে সংবিধান এবং আইনের চৌহদ্দির মধ্যে রাখা। এমনকি কোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকরা যদি রাষ্ট্রকে আরো নিপীড়ক হতে প্ররোচনাও দেয় তাহলেও রাজনীতিবিদ এবং আইনপ্রণেতাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সেটায় বাধা দেয়া। পরিহাসের ব্যাপার হলো বিচারবহির্ভূত হত্যার এই মহামারিতে সেটা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংসদে প্রস্তাব এনে সরকারকে চাপ দেয়া দূরেই থাকুক, সংসদ সদস্যরা সেটার প্ররোচনা দেন। এভাবেই একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে যায় পুরোপুরি, হয়ে ওঠে সম্রাট শাসিত মধ্যযুগীয় রাজ্য। 

  • লেখক: সংসদ সদস্য
  • কার্টসি- মানবজমিন/১৬ জানুয়ারি ২০২০

Wednesday, January 15, 2020

ব্যাংক, টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাত - অনিশ্চয়তা থেকেই শেয়ারবাজারে পতন


পাহাড়সম খেলাপি ঋণ, নানা অনিয়ম ও তারল্য সংকটের কারণে নাজুক অবস্থায় আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। নিরীক্ষা দাবির বকেয়া অর্থ নিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে চলছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) টানাপড়েন। এদিকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মেয়াদ শেষ হচ্ছে তালিকাভুক্ত ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। সব মিলিয়ে ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে শেয়ারবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৪৬ শতাংশ দখলে রাখা এই তিন খাতের কোম্পানিগুলো। ফলে এসব খাতে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিনিয়োগকারীরা। আর বিনিয়োগকারীদের এই উদ্বেগই শেয়ারবাজার পতনে প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজারের মন্দা সময়ে ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে মিউচুয়াল ফান্ড খাত। ফলে ব্যাংক, টেলিকম, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি এ খাতের শেয়ারদরেও ধারাবাহিক পতন অব্যাহত আছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মন্দ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), সুশাসনের অভাব এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতি আস্থাহীনতা। আর এসব কারণেই গত এক বছরে প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট পতন হয়েছে পুঁজিবাজারে।


দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২০ খাতের ৩২০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। প্রায় সব খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ক্রমাগত দরপতনে প্রাইস আর্নিং রেশিও (পিই রেশিও) বা মূল্য-আয় অনুপাত সর্বনিম্ন অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাপক হারে কমেছে ব্যাংক, টেলিকম, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পিই রেশিও। তার পরও এসব খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দিকে বিনিয়োগকারীদের কোনো আগ্রহ নেই। উল্টো আতঙ্কিত হয়ে তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। পিই রেশিও হচ্ছে শেয়ারের ভ্যালুয়েশন পরিমাপের একটি নির্দেশক। কোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি দরকে শেয়ারপ্রতি আয় দিয়ে ভাগ করলে পিই রেশিও পাওয়া যায়। যে শেয়ারের পিই রেশিও যত কম সে কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ তত বেশি আকর্ষণীয় ও নিরাপদ।

গতকালের শেয়ারদর বিবেচনায় ব্যাংক খাতের পিই রেশিও ছিল ৬ দশমিক ৯৮, টেলিযোগাযোগ খাতের পিই রেশিও ছিল ৯ দশমিক ২২ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ছিল ১০ দশমিক ৪৪। যদিও গতকাল ডিএসইর সার্বিক পিই রেশিও ছিল ১০ দশমিক ৭১। সে হিসাবে এ তিন খাতের পিই রেশিও ডিএসইর সার্বিক পিই রেশিওর চেয়ে কম ছিল। অথচ গত বছরের জানুয়ারি শেষে ডিএসইর সার্বিক পিই রেশিও ছিল ১৬ দশমিক ৩৮। এ সময় ব্যাংক খাতের পিই রেশিও ছিল ১০ দশমিক শূন্য ২, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ছিল ১৬ দশমিক ৫৯ ও টেলিযোগাযোগ খাতের ছিল ২০ দশমিক ৪১।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ব্যাংক খাতের বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোনের সঙ্গে বকেয়া রাজস্ব আদায় নিয়ে বিটিআরসির দ্বন্দ্ব চলছে। এ বিষয়গুলো সার্বিকভাবে এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর এর প্রভাবে শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজারকে ভালো করতে হলে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে বর্তমানে যেসব খাতে পিই রেশিও তুলনামূলক কম রয়েছে, সেসব খাতের ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে যেন তারা বিনিয়োগ করেন। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের বেশকিছু ভালো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।

শেয়ারবাজারে খাতভিত্তিক বাজার মূলধনে সবচেয়ে বেশি অবদান ব্যাংকিং খাতের, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও এ খাতটিই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে বর্তমানে। দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাগামহীনভাবে। ২০১০ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ে বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশই নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়। পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবে ধরলে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশই বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত।

বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট মূলধনেরও বেশি অর্থ খেলাপি হয়ে গেছে। ২০১০ সালে এ খাতের মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা ১০১ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

শুধু খেলাপি ঋণই নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে অবনমন হয়েছে ব্যাংকের অন্যান্য মৌলিক সূচকেও। যেকোনো দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণে গ্রহণযোগ্য সূচক হলো সম্পদের বিপরীতে আয়, নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়। পাশাপাশি ইকুইটির বিপরীতে আয়, মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের হারও বিবেচনায় নেয়া হয় এক্ষেত্রে। গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতের এসব সূচকেরই ধারাবাহিক অবনমন হয়েছে।

বাজার মূলধনে টেলিযোগাযোগ খাতের অবদান ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ খাতের সবচেয়ে বড় মূলধনি কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেড। গতকাল ডিএসইর বাজার মূলধনের ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ ছিল কোম্পানিটির দখলে। গত বছর টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে। এ অর্থ আদায় নিয়ে চিঠি চালাচালি, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এমনকি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় গ্রামীণফোন। গত নভেম্বরে নিরীক্ষা দাবির পাওনা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা তিন মাসের মধ্যে পরিশোধে গ্রামীণফোনকে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। অবশ্য এ সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন জমা দিয়েছে টেলিকম অপারেটরটি। তাছাড়া সম্প্রতি গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা আপত্তির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বিষয়টি নিষ্পত্তিতে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়েছে টেলিনর। সরকারের সঙ্গে পাওয়া নিয়ে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হলে টেলিনর বাংলাদেশে ব্যবসা অব্যাহত রাখবে কিনা, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। আর এসব অনিশ্চয়তার কারণে কোম্পানিটির শেয়ারদরে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। গত এক বছরে গ্রামীণফোনের শেয়ারদর ৩৮৭ টাকা ১০ পয়সা থেকে কমে গতকাল সর্বশেষ ২৩৪ টাকা ২০ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে। গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমেছে। এর ফলে গতকাল টেলিযোগাযোগ খাতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণাত্মক রিটার্ন এসেছে। এমনকি গ্রামীণফোনের কারণে গত এক বছরেও টেলিযোগাযোগ খাতে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণাত্মক রিটার্ন এসেছে।

দেশে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে একসময় ছোট আকারের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। কিন্তু স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা এরই মধ্যে চাহিদাকে ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে বড় ও মাঝারি একাধিক কোম্পানি। নির্মাণাধীনও আছে বেশ কয়েকটি। এ অবস্থায় ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা যদি বাড়ানো হয়ও সেক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ পাবে না এসব কেন্দ্র।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগামী পাঁচ বছর বা ২০২৪ সালের মধ্যে মেয়াদ শেষ হচ্ছে সাত কোম্পানির ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এর মধ্যে আছে সামিট পাওয়ারের আটটি, ডরিন পাওয়ারের তিন এবং ওরিয়ন ও খুলনা পাওয়ারের দুটি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই সময়ের মধ্যে মেয়াদ শেষ হবে বারাকা পাওয়ার, জিবিবি পাওয়ার ও শাহজিবাজার পাওয়ারের একটি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর আকর্ষণীয় রাজস্ব আয় ও মুনাফার কারণে একসময় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল খাতটি। কিন্তু ছোট আকারের কেন্দ্রের মেয়াদ না বাড়ানোর বিষয়টি সামনে আসার কারণে এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। গতকাল ডিএসইতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ১ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণাত্মক রিটার্ন এসেছে। আর গত বছর এ খাতে বিনিয়োগের বিপরীতে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণাত্মক রিটার্ন এসেছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, দেশের ব্যাংক খাত ও টেলিযোগাযোগসহ যেসব খাতের সমস্যার কারণে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। এ মাসের ২০ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের শেয়ারবাজার সংক্রান্ত তদারকি কমিটিতে আমরা সব সমস্যা তুলে ধরব। শেয়ারবাজারের অবস্থা উন্নয়নে সরকার আন্তরিক। তাই সবকিছুরই সমাধান হবে বলে আমি আশাবাদী।

সারা বিশ্বেই বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ বিনিয়োগের আশ্রয়স্থল হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড। যখন শেয়ারবাজার নিম্নমুখী থাকে তখন মিউচুয়াল ফান্ডগুলো বাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনে থাকে। এর ফলে পড়তি বাজারে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সাপোর্ট হিসেবেও কাজ করে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশকিছু মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপকরা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থবিরোধী অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ফান্ডের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। এতে ফান্ডগুলোর বিনিয়োগকারীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাননি।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সবগুলো মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে গত তিন বছরে ঋণাত্মক রিটার্ন এসেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের শেষের দিকে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ আরো এক মেয়াদে ১০ বছর বাড়ানোর সুযোগ করে দেয় বিএসইসি। এর ফলে কার্যত মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে ইউনিটহোল্ডারদের বিনিয়োগ আরো ১০ বছরের জন্য আটকে যায়। কারণ প্রায় সবগুলো মিউচুয়াল ফান্ডই তাদের এনএভির তুলনায় ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। এর ফলে বাজারদরে ইউনিট বিক্রি করলে ইউনিটহোল্ডারদের লোকসান গুনতে হবে। আর ফান্ডের মেয়াদ শেষে অবসায়ন হলে তারা এর চেয়ে বেশি অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকত। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণে এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিটও দায়ের করেছেন মিউচুয়াল ফান্ডে এক বিদেশী বিনিয়োগকারী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর অ্যাকাউন্টিং ফর ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান অবশ্য শেয়ারবাজারের পতনের পেছনে বড় মূলধনি খাতের শেয়ারের দরপতনের পাশাপাশি আরো বেশকিছু বিষয়কে দায়ী করেছেন। তার মতে, দেশের আর্থিক খাতের ব্যাপক আকারের তারল্য সংকটের পাশাপাশি সম্পদের মানে অবনমন হয়েছে, যা শেয়ারবাজারকেও প্রভাবিত করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি ও ডিএসইতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বাজে আইপিওর অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং এসব কোম্পানির কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়েই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ে চরম আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আর এ কারণে শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।

  • কার্টসি - বণিক বার্তা /জানুয়ারি ১৫, ২০২০ 

উন্নয়নের ভূষণ কি বায়ুদূষণ!

খলিলউল্লাহ্


আশা করি বায়ুদূষণের খবর মানুষের গা সওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। খারাপ খবর শুনতে শুনতে সেগুলো হজমের ক্ষমতাও মানুষের বাড়ে। বায়ুর মান খারাপের খবরে আমাদের কারও মান যায় না। আমাদের হৃদয়ও বিষাদে ভরে ওঠে না। কিন্তু ফুসফুস ও মস্তিষ্ক যে আক্রান্ত হয়, তা কীভাবে ভুলে থাকা চলে! হৃদয় আক্রান্ত না হলেই যে হৃদ্‌রোগ হবে না, সে গ্যারান্টি তো আর দেওয়া যায় না। বায়ুদূষণ নিয়ে উদাসীন থাকার বিলাসিতায় বেশি দিন গা ভাসানোর সুযোগ হয়তো আমাদের নেই। কারণ, তত দিন পর্যন্ত আমাদের শ্বাসযন্ত্র আর ক্যানসার প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সতর্কবার্তাও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ভিজ্যুয়াল নামের একটি সংস্থা সারা বিশ্বেরই বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করে। তাদের পর্যবেক্ষণে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকায় থাকছে শীর্ষে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোও বায়ুদূষণের মধ্যেই ডুবে থাকে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল না।

পরিবেশের ব্যাপারে উদাসীনতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেটা বৈশ্বিক পরিসর থেকে জাতীয় পর্যায় সবখানেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পৃথিবীর ব্যবসা–বাণিজ্য তদারকির দায়িত্বে আছে। তার পূর্বসূরি ছিল শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক সাধারণ চুক্তি (গ্যাট)। আশ্চর্য হতে হয় যে সেই চুক্তির দলিল ঘেঁটে কোথাও ‘পরিবেশ’ শব্দটি পেলাম না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিভিন্ন ধাপে পরিবেশের ক্ষতি হয়। তা কমিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিলে কিছু মুনাফা কমবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ক্ষতিটুকুও মেনে নিতে নীতিনির্ধারকেরা রাজি ছিলেন না। যাহোক, বর্তমানের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আলোর মুখ দেখেছে ১৯৯৫ সালে। সেখানে অবশ্য টেকসই উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে পরিবেশের কথা বলা আছে। যদিও পরিবেশের চেয়ে বাণিজ্য উদারীকরণ আর মুনাফাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে আসছে।

এগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপীই পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিস্থিতি খারাপ। এ বিষয়ে শুরুতে মনোযোগ ছিল না বলেই সংকট ঘনীভূত হয়েছে। তাই উন্নত দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এখন বলছে যে বিনিয়োগ হ্রাস ও বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য। আর তা হলো জলবায়ু আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। পরিবেশ বাদ দিয়ে শুধু জিডিপি বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই মডেল কাজ করছে না। ওইসিডির সতর্কবাণী থেকে তা–ই প্রমাণিত হয়।

মোটা দাগে বায়ুদূষণের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া, আর যথেচ্চার নির্মাণ প্রকল্প। এর বাইরে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ তো রয়েছেই। এই উৎসগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সমস্যার প্রতিকার হবে না, সে কথা কারও অজানা নয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান জোরদার করেছে। তবে নতুন অবৈধ ইটভাটা স্থাপনের খবরও থেমে নেই। এমনকি বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়েও ইটভাটার খবর পাওয়া যায়। আবার উচ্ছেদের পরও অনেক ভাটায় ইট পোড়ানো বন্ধ হয়নি।

সড়ক পরিবহনে নতুন আইন হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরিবহন শ্রমিকনেতারা এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে লাইসেন্স ও ফিটনেস বিষয়ে কোনো শাস্তি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।

বায়ুদূষণে প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে শুধু বায়ুদূষণজনিত কারণে। তবে শুধু ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার নির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া কঠিন। কিন্তু এই ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দায় রয়েছে। সেটা প্রমাণিত। তার মানে এ বছরও সেই দায় জনগণকে বহন করতে হবে।

এদিকে যথেচ্চার নির্মাণ প্রকল্প বন্ধে ইমারত বিধিমালার বাস্তবায়ন না হওয়ার নজির তো প্রতিদিনই চলতে–ফিরতে দেখছি আমরা। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র পড়ে থাকা, সেগুলো ঢেকে না রাখা, ঠিকমতো পানি না দেওয়া ইত্যাদি সাদা চোখেও দেখা যায়। আর সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িও থেমে নেই। একেক সেবা সংস্থা একেকবার রাস্তা খুঁড়ছে। আজ সিটি করপোরেশন রাস্তা খুঁড়লে কাল খুঁড়বে ওয়াসা, এরপর দিন হয়তো তিতাস গ্যাস বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা টিঅ্যান্ডটি। এই খোঁড়াখুঁড়ি যদি সমন্বয় করে করা হতো, তাহলে জনভোগান্তি যেমন কমত, বায়ুদূষণও কমিয়ে আনা যেত। এই সমন্বয়হীনতার প্রভাব নাগরিক জীবনকে কীভাবে বিষিয়ে তুলছে, সে খবর রাখার দায় যেন কারও নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলে তাদের দায়িত্ব করণীয় ঠিক করে দেওয়া। আর সিটি করপোরাশন ও রাজউকের দায়িত্ব হলো এগুলো তদারকি করা। কিন্তু ঠেলাধাক্কায় এসব কাজ যখন আর এগোয় না, তখন আদালতও বাধ্য হয়ে রুল জারি করেন। ব্যবস্থা হিসেবে ইটভাটা ও নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে সুরাহা যে হচ্ছে না, সেই প্রমাণ পাওয়া যায় কিছুদিন পরপর বায়ুদূষণে ঢাকার শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসায়।

দিল্লিতে বায়ুদূষণের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেখানে মুখোশ ও অক্সিজেনের ব্যবসা বেড়েছে। নির্দিষ্ট স্থানে বসে টাকার বিনিময়ে অক্সিজেন নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যদি এ দেশেও অক্সিজেনের ব্যবসা নিয়ে হাজির হন একদল ব্যবসায়ী। কিন্তু সেই সওদা করার ক্ষমতা এ দেশের কতজন মানুষের আছে? যে দেশে এখন পেঁয়াজ কিনতে দরিদ্র মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, স্বল্প আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে পেয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে, সেখানে অক্সিজেন কিনে নিশ্বাস নেওয়ার কথা ভাবা যায়! সামর্থ্যবানেরা না হয় সেই বন্দোবস্ত করলেন, কিন্তু আমজনতার কী হবে?

বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণে বনায়ন করার কথা বলা হয়। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি বনায়ন করার বদলে হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানচিত্র থেকে। বনভূমি ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশ। অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের দুঃখ আমাদের আরও আছে। শহরে যেসব গাছপালা আছে, সেগুলোও বায়ুদূষণের কারণে হারাচ্ছে টিকে থাকার ক্ষমতা। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশের গাছপালার টিকে থাকার ক্ষমতা কমে গেছে। আর এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি হারে কমছে।

বায়ুর মান ঠিক রাখতে জলাশয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের জলাশয়গুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হলো প্রভাবশালীদের এই জলাশয় দখল। এখান থেকেই বোঝা যায় এই পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

সরকারি হিসাবে যেসব খালের কথা উল্লেখ আছে, সেগুলোর ছিটেফোঁটাও বাস্তবে পাওয়া যায় না। এর ফলে মানুষের দুর্দশা আর ভোগান্তি হয়েছে অন্তহীন। বর্ষাকালে অল্প বৃষ্টিতেই শহরগুলো উপচে সৃষ্টি হয় নোংরা, দুর্গন্ধ পানির বন্যা। বর্ষায় রাস্তায় বের হলে মানুষ সাঁতরায় নোংরা পানিতে আর শুকনা মৌসুমে ধুলার সমুদ্রে। এই হলো আমাদের নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। এমন এক জীবনযাপন যেকোনো বিচারেই সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়। সামাজিক অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতার লাগামহীন চিত্রের খবর তো আর কারও অজানা নয়।

২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পেয়েছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের ভূমিকা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। কিছু মানুষের স্বার্থের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনমান বিষিয়ে তোলা বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

  • খলিলউল্লাহ্ প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
  • কার্টসি - প্রথম আলো/১৫ জানুয়ারি ২০২০ 

Monday, January 13, 2020

এত ধর্ষণ!

শুভ্র দেব

উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এ ছাড়া ওই সপ্তাহে শুধুমাত্র ঢাকাতেই তিন শিশু, দুই তরুণী ও দুই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একটি মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে বিদায়ী বছরেই সারা দেশে ১৪১৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এটি বিগত দিনের সর্বোচ্চ রেকর্ড। 

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এছাড়া নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে মামলার গুরুত্ব দেয়া আর সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনভাবে কাজের জন্য এ ধরণের ঘটনা বাড়ছে।

আর বরাবরের মত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ধর্ষণ নয় সব ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা। যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন অপরাধীকে ধরে তারা শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৯ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৩৭৪টি। এরমধ্যে একক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৮৬টি, গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৮টি ও ধর্ষণের উল্লেখ নেই এমন ঘটনা ঘটেছে আরও ১১০টি। সংস্থাটির তথ্যমতে ২০১৫ সালে সারা দেশে ৪৮৪টি একক ধর্ষণ, ২৪৫টি গণধর্ষণ ও ধরণ উল্লেখ নেই এমন আরও ২৩টি ধর্ষণ নিয়ে ওই বছরে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৫২টি। একইভাবে ২০১৬ সালে ৪৪৪টি একক ধর্ষণ, ১৯৭টি গণধর্ষণ ও ধরণ উল্লেখ নাই এমন আরও ১৮টি ধর্ষণ নিয়ে মোট ৬৫৯ টি ধর্ষণকাণ্ড ঘটেছে। ২০১৭ সালে সারা দেশে ৮১৮টি ধর্ষণকাণ্ড হয়েছে। এরমধ্যে ৫৯০টি একক ধর্ষণ, ২০৬টি গণধর্ষণ ও ধরণ জানা যায়নি এমন ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে মোট ৭৩২টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে একক ধর্ষণ হয়েছে ৫০২টি, গণধর্ষণ হয়েছে ২০৩টি আর অজানা ধরণের আরও ২৭টি। আসকের পরিসংখ্যান মতে গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটেছে। ওই বছর সারা দেশে ১৪১৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে শুধু একক ধর্ষণ হয়েছে ১ হাজার ৬৬টি, গণধর্ষণ ৩২৭টি ও ধরণ সম্পর্কে জানতে পারে নাই এমন আরও ২০টি ঘটনা রয়েছে।

আসকের তথ্য মতে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪৬ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৪৮জন। এরমধ্যে ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। ২০১৬ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন। ২০১৭ সালে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন আর আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ২০১৯ সালে ৭৬ জনকে হত্যা আর আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন।

এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী গত আট বছরে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ৭৮টি। এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬২৬ জনকে। ২০১৯ সালেই সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ১ হাজার ৬০৭টি। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে। পুলিশ সদরদপ্তরের গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলা বিশ্লেষন করে দেখা গেছে এই আইনে করা মোট মামলার ৫১ দশমিক ৬০ শতাংশই ধর্ষণ মামলা। আর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মামলার ৫২ দশমিক ১০ শতাংশই ধর্ষণ মামলা। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলায় সাজার হারও কম। পরিসংখ্যান বলছে মাত্র ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতার একটি সময় চলছে আর সেটি ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে নারী নির্যাতন নীপিড়ন দ্বিগুন হয়েছে। চলতি বছরে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। সামাজিক অস্থিরতার মূল কারণ হলো, অন্যান্য মামলাগুলোর মত সমান গুরুত্ব পায় না। সামাজিক ঐতিহ্য বা সামাজিক শিষ্ঠাচার তৈরি করতে গেলে রাষ্ট্র বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সম্পর্ক, ব্যক্তিত্ব ও অবস্থানকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার  সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বিচারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। 

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসন এটিকে যত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে তার কয়েকদিন পরে একটি বাসে এক নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়টি এত বেশি আলোচিত হয়নি। কারণ যে ধর্ষণের শিকার হয় তার সামাজিক মর্যাদা অনুসারে তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের নারীকে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা সমানতালে সব নারীকে মূল্যায়ন করতে পারছি না। আর না পারার কারণেই ধর্ষকরা এই সংকটের সুযোগটা নিচ্ছে। এছাড়া আমাদের বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি রয়েছে। যে ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয় সেটির বিচার খুব দ্রত হতে দেখি। না হলে এক ঘটনার পেছনে অন্যটি হারিয়ে যায়। তাই এখানে বিচারহনীতার পাশপাশি প্রত্যেকটি ঘটনাকে সমানভাবে গুরুত্ব না দেয়ার বিষয় রয়েছে।

সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষক নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, ছোট বাচ্চাদের ধর্ষণ যারা করে তাদের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাব রয়েছে। এরা বিকৃত রুচির মানুষ। সমাজে যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা থাকত তবে এ ধরণের ঘটনা ঘটতো না। স্কুল কলেজের ছাত্রীদের বখাটেরা নোংরাভাবে টিজ করে। যারা এসব করে তারা কখনওই মেয়েদের সংস্পর্শে আসে নাই। তাদের মধ্যে নারীদের প্রতি সম্মান দেখানোর নিম্নতম শিক্ষাটুকু নাই। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা কাজ করছে। 

এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠেনি। কোনো দেশের সরকারই ধর্ষণের মত ঘটনা কমাতে পারবে না। সমাজে যারা আমরা আছি তারাই এগুলো প্রতিহত ও সচেতনতা বৃদ্ধি করলে এগুলো কমে যাবে।

পুলিশের সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ মানবজমিন বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবী, সমাজতথ্যবিদরা একসঙ্গে বসা উচিত।  সবাই একসঙ্গে বসলে তারা একটি ব্যাখ্যা দিবেন ধর্ষণের ঘটনা কেন হচ্ছে বা কেন বাড়ছে। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। একেকজন একেকরকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আমাদের নারী সমাজ বাহিরে কাজ কর্ম করে এজন্য ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নাকি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে ও আইনের দীর্ঘসুত্রিতারও বিষয় আছে।  মামলা হলে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। সেটি নিষ্পত্তি হতে অনেক লম্বা সময় লাগে। এই বিষয়গুলো দেখার বিষয় আছে। এছাড়া মামলা তদন্তের পর যখন কোর্টে যাবে তখন তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসক ডেকে পাওয়া যায় না। সাক্ষীদের ম্যানেজ করে উপস্থিত করা যায় না।  তিনি বলেন, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বলে।  দেশে অপরাধ প্রবণতা থাকবেই কিন্তু কেউ যদি মনে করে অপরাধ করলে পার পেয়ে যাবে এমন চিন্তা আসাটা ঠিক না। আমাদের নৈতিকতার জায়গায় চিন্তা করতে হবে। 

  • কার্টসি - মানবজমিন /১৩ জানুয়ারি ২০২০

নারী কোথায় নিরাপদ?

মরিয়ম চম্পা

রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, বাস-ট্রেন, ঘরে-বাইরে- কোথায় নিরাপদ নারী? সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোচিত ক’টি ঘটনায়- এ প্রশ্ন সর্বত্র। রাজধানীর কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে  ধর্ষণ এবং ধামরাইয়ে বাসে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে এক তরুণীকে। ওদিকে রাজধানীর ভাটারায় এক কিশোরীকে বাসার সামনে থেকে ডেকে নিয়ে গণধর্ষন করা হয়েছে। দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণ, নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে। এ থেকে মুক্তি কীভাবে? আর কেনইবা মানুষ এভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে ঘরে এবং বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি দিন দিন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই নারীদের পদচারণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীন বিচরণে নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও প্রশ্নের মুখোমুখি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন। অর্থাৎ, গত ২০১৮ সালের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকে দায়ী করেন। তবে রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার আরো অনেক উপাদান আছে বলে মনে করেন তিনি। 

তার মতে, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার একটি অংশ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো মামলা হয় না। আর যেগুলোর মামলা হয় বিশেষ করে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সেখানে শতকরা মাত্র তিন ভাগ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত অপরাধী শাস্তি পায়। আর ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় শাস্তি হয় মাত্র শূন্য দশমিক তিন ভাগ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের কোনো ঘটনায় বিচার হয় না। তবে এর বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে বলে মনে করেন তিনি। 

তিনি বলেন, যারা ধর্ষক তারা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে শক্তিশালী। অন্যদিক বাদ দিলেও লৈঙ্গিকভাবে পুরুষ শক্তিশালী। তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী। নারীদের সামাজিকভাবে সুরক্ষা দেয়ার রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্র তা পালন করছে না। আর নারীদের বাইরে বের হওয়া কিংবা কাজে যাওয়ার বিষয়গুলোকে সমাজে এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না। নারীর বাইরে বের হওয়াকে পুরুষের ক্ষমতা খর্ব হওয়া হিসেবে দেখা হয়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গণপরিবহনে ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সম্প্রতি নারীদের একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। বাসে যাত্রী কম হলে সতর্ক থাকা। অধিক যাত্রীসংবলিত গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা। গাড়িতে না ঘুমানো। বাসে বসে পরিবারের কাউকে ফোন করে উচ্চ স্বরে নিজের অবস্থান জানিয়ে রাখা। গন্তব্যে যাওয়ার আগেই যাত্রীরা নেমে গেলে সেখানেই নেমে গিয়ে পরিবারের কাউকে ফোন করে নিয়ে যেতে বলা। গাড়ির ভেতরে অনিরাপদ বোধ করলে জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মনে করেন, নারী এখন ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তার মধ্যে নেই। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি বাইরে যা ঘটছে তেমনি ঘরের মধ্যে একই ঘটনা ঘটছে। সুতারং নারীর নিরাপত্তার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। বরং নারীরা এখন ২৪ ঘণ্টাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পার করছে। বাস, ট্রেন, স্কুল, কলেজ সর্বত্রই নারীরা এখন অনিরাপদ অবস্থায় আছে। এটার জন্য আমি মনে করি রাষ্ট্রের অবকাঠামো দায়ী। এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতাও এ জন্য দায়ী।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, নারী শুধু বাংলাদেশে কেন সারা পৃথিবীতে কোথাও নিরাপত্তার ভেতরে নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার একটি প্রচণ্ডরকম সংস্কৃতি দেখা গেছে। রাস্তায়, গাড়িতে, অফিসে, বাসায় কোথাও তারা নিরাপদ না। যার প্রমান অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। এদেরকে দমনের ক্ষেত্রে যে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা আমরা কতটুকু নিতে পারছি সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নারী পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ না এখন। এর কয়েকটি কারণ এবং ধরণ আছে। একটি গ্লোবাল অপরটি ন্যাশনাল। গ্লোবালি নারীদের পুঁজিবাদের অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে নারী সেখানে পণ্যের চেয়ে বেশি কিছু না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু আছে এটা তারই অংশ। অপরাধী যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায় তখন মানুষের মনে সমাজ, আইনি কাঠামো ইত্যাদিতে খুব বেশি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারীকে পুঁজিবাদের অংশ এবং ভোগপণ্য হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। একইসঙ্গে বিচাহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়গুলোকে কোনোভাবে যেন পলিটিক্যালি জাস্টিফাই না করা যায় তা মাথায় রাখতে হবে।       
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তিনিও প্রশ্ন রাখেন- দেশে নারীরা কোথায় নিরাপদ। সেটি ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র বা সমাজ কাঠামোর কোথাও তারা নিরাপদ না।

  • কার্টসি - মানবজমিন/ ১৩ জানুয়ারি ২০২০