Search

Sunday, June 6, 2021

রণাঙ্গনের জিয়া থেকে রাষ্ট্রনায়ক জিয়া: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনের সুরতহাল

-----------------------------------------------------------------                           

—  অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান  

----------------------------------------------------------------


অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, অতি আবেগের কারণে আমাদের জাতি ইতিহাসমনষ্ক নয়। চরিত্র বিনির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। আবেগের ভেলায় ভেসে 'প্রশংসাকে পূজায় এবং সমালোচনাকে কুৎসায়' পরিণত করার মধ্যে দিয়ে কল্পকাহিনী তৈরি করি। এর কারণ হলো, গোড়ায় গলদ। সোনাভানের পুঁথির বয়ান: 'লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার, গণিয়া দেখিলো মর্দ চল্লিশ হাজার।' 

বাঙালির মন মায়াজালে আবদ্ধ। এরা প্রভু কীর্তনে কিংবা ভিন্নমত দমনে ভেদাভেদ করে না; হোক রাষ্ট্রীয় কিংবা বিশ্বজগতের মালিক; অতি দুর্বল ভিন্নমত পোষণকারী কিংবা স্বয়ং ইবলিশ শয়তান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঝি-মাল্লা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী- সবাই এই কর্মযজ্ঞে মিলে-মিশে একাকার। আহমেদ ছফার ভাষায়, "এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক প্রোপাগান্ডা লিটারেচারের সংগে পুঁথিসাহিত্যের একটি সমধর্মিতা আবিষ্কার করা খুব দুরুহ কর্ম নয় (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)। সংগত কারণে আমার পক্ষে এই জাতির  ইতিহাস চর্চার পরিচিত মসৃণ পথের বিপরীতে গিয়ে হঠাৎ করে ইতিহাসমনষ্ক হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। এই অক্ষমতা মাথায় রেখেই যা কিছু দলিল-দস্তাবেজ দ্বারা সমর্থিত, অথচ কম আলোচিত কিংবা উপেক্ষিত এমন কয়েকটি বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে রণাঙ্গণের জিয়া ও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রবর্তনে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান-এর সাফল্য মূল্যায়নের চেষ্টা করবো। 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধ হিসেবে বীরত্বগাঁথা ও রাজনীতিবিদ হিসেবে চরিত্র বিনির্মাণ করতে হলে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা ও থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ ও স্বরূপ, পঁচাত্তরের পরের দিশেহারা রাজনীতির প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান ও এর সঠিক উপলব্ধি ও সবিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলো, এই কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। রাজনৈতিক বিভাজন তখনও ছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ফেরত এসে যুদ্ধে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়হীনতার ছিলো। অন্যদিকে থিয়েটার রোডের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব ছিলো প্রায় দৃশ্যমান। (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০০৭ পৃ: ১৫)।  

ধীরে ধীরে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই ভিন্নতা রাজনৈতিক মোড় নেয়, জন্ম ও বিকাশ লাভ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি গঠনে বলতে গেলে জিয়াউর রহমান এককভাবেই কৃতিত্বের দাবিদার। সাধারণত এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের মাঠে, গোলটেবিল আলোচনায় কিংবা ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। সেই বিবেচনায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি'র জন্ম এবং জনপ্রিয়তা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক দল গঠন ও প্রতিষ্ঠা লাভের বিবেচনায় ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এর পেছনে যে বিষয়গুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা মূলতঃ ব্যক্তি জিয়া'র ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। 

পেশাদারিত্ব তাঁর চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান একটি দিক। সৈনিক জিয়া'র ১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন 'আলফা কোম্পানির' কমান্ডার হিসেবে 'খেমকারান' রণাঙ্গনের বেদীয়ান-এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পেশাদারিত্বের কৃতিত্ব হিসেবে তাঁর কোম্পানির সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে মেজর জিয়া ঢাকায় পোস্টিংয়ের সুবাদে দেশে ফিরে এলেন।  ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পার না হতেই পরিস্থিতি বিষ্ফোরোন্মুখ হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হয় ২৫ মার্চের কালো রাত। বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশু সন্তানকে চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই মেজর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।  

শ্বাসরুদ্ধকর এই অবস্থার অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে; লাখো মা-বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মেজর জিয়ার সংগে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিলেও বেগম জিয়া দুই অবুঝ শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে বুকে আগলে রেখে আত্মগোপন ও বন্দিদশায় যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ও আতংকে দিন অতিবাহিত করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন তাঁর মূল্য রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় কেনো অংশে কম নয়।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়া'র ভূমিকা নিয়ে তাঁর কঠোর সমালোচকরাও নিন্দার কোনো আলামত বা উপকরণ খুঁজে পাননি। জিয়া'র স্বাধীনতার ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি  উজ্জীবীত ও উদ্দীপ্ত হয়ে তাঁদের লেখায় জিয়া'র প্রশংসা করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- তাজউদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি), এইচ টি ইমাম (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১), অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (আমার একাত্তর), ভারতীয় কূটনীতিক জে. এন. দীক্ষিত, ট্রেভর ফিসলক ও ডেভিড লুডেন (মাহফুজউল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ, এডর্ন পাবলিকেশন; ২০১৬)। জিয়াই হলেন বাংলাদেশের একমাত্র মুক্তিযুাদ্ধা রণাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যার ছবি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম মিউজিয়ামে অমর কীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা আছে।

এর ব্যতিক্রমও আছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থে (রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ১৯৭৪, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা) স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং জিয়া'র অবদানের তেমন কোনো উল্লেখ নেই। এতে অবাক হবারও তেমন কিছু নেই। কারণে চরিত্র বিনির্মাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হই। 

অতি সম্প্রতি বাংলা ইনসাইডার  অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সৈয়দ বোরহান কবীরের 'জিয়ার' ওপর  একটি লেখা আমার নজরে এসেছে। লেখাটা পড়ে একই রকম অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম হল। তিনি লিখেছেন,"উগ্রবাম ও উগ্র ডানকে  তিনি (জিয়া) ক্ষমতার ঘাটে জল খাইয়েছিল। ফলে তার উগ্রবাদী একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাযায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ (সৈয়দ বোরহান কবীর, জিয়ার রাজনীতির পাপ ও পরিণতি, বাংলা ইনসাইডার, ২৯ মে,২০২১) । দৃষ্টিগোচর হলে সাধারনত তার লেখা পড়ি। তিনি অনলাইন পোর্টালটির প্রধান সম্পাদক ও 'পরিপ্রেক্ষিত' এর নির্বাহী পরিচালক ।একটি  দায়িত্বশীল পদে আছেন, ভালো লিখেন। আমরা পাঠকরা এই ধরনের লেখকদের প্রবন্ধ পাঠ করে দোষারোপের সস্তা কুতর্কের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাসের সঠিক পাঠ গ্রহণ করতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় থাকি। সৈয়দ বোরহান কবীরের সঙ্গে আমি একমত যে, প্রশংসাকে পূজায় পর্যবসিত করা আকাঙ্ক্ষিত, তাই পরিত্যাজ্য। বিভিন্ন গ্রন্থ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত  তথ্যেরভিত্তিতে জেনেছি জিয়ার জানাযায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছিল। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মনিষীদের অন্যতম প্রধান অন্য দুজন হলেন মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গণমাধ্যম সূত্রেই আমরা অবগত হয়েছি, তাদের শেষকৃত্যে ধারণাতীত সংখ্যক  মানুষের জমায়েত হয়েছিল। জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের  পরিচয় কি ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিনা। তবে ভারতবর্ষের জনগণ তথা  বাঙালির মনস্তত্ত্বের বিচারে বলা যায়, জীবিত অবস্থায় যত বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কই থাকুক না কেন, মৃত ব্যক্তির জন্য চোখে আবেগের অশ্রু বিসর্জন দেয়া আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। তাই আমজনতার মত আমার বিশ্বাস,  জিয়ার জানাযা কিংবা গান্ধীজী ও কবিগুরুর  শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীরা  মৃত ব্যক্তিদের কল্যাণ কামনার জন্য সমবেত হয়েছিলেন।  কিন্তু সৈয়দ বোরহান কবিরের দাবি জিয়ার ক্ষেত্রে এদের অধিকাংশই  হলেন জিয়ার মাধ্যমে সুবিধাভোগী উগ্র বামপন্থী ও উগ্র ডানপন্থীদের সমাবেশ।  জানাযায় তারা জিয়ার পরজাগতিক কল্যাণ কামনার জন্য অংশগ্রহণ করেননি, বরং সমবেত হয়েছেন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম  করার নীলনকশা বাস্তবায়নে অংশ হিসেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাধারণত সুবিধাবাদীরা কায়েমি স্বার্থ হাসিল করার জন্য রাজা বাদশাদের জীবদ্দশায় প্রাসাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে, তাদের জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে শামিল হয় না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর  বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ঘুরঘুর করা সুবিধাবাদী মানুষগুলো কিভাবে কেটে পড়েছিল গোটা জাতি তা লক্ষ্য করেছে। ৩২ নাম্বার বাড়িতে ৩২ ঘণ্টা তার ক্ষত বিক্ষত দেহ পড়েছিল। সুবিধাভোগীরা জানাজায় অংশগ্রহণ করা দূরে থাক , নেতার লাশটি পর্যন্ত  দেখতে যায়নি।  বরং তারা কি করেছে সৈয়দ বোরহানসহ গোটা জাতি অবগত আছেন।জনাব বোরহান, আমার ধারণা জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে যারা যায়, তারা দুধের মাছি নন, দুঃখের সাথী। তাই জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের উগ্রপন্থি কিংবা বিশেষ কোন পন্থী হিসেবে  মূল্যায়ন করা কতটা অনুমাননির্ভর আর কতটা যুক্তিনির্ভর তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। হতে পারে  জানাজা কিংবা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ব্যক্তির অংশগ্রহণ ছিল মঙ্গল কামনার জন্য  নয়, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা পালন মাত্র। তাই জিয়ার জানাযায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ  মানুষের অভিপ্রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য স্বজ্ঞাপ্রসূত নয় (counterintuitive) বলেই প্রতীয়মান হয়।  যাইহোক, প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক জনাব  বোরহানের এই দাবির যথার্থতা মূল্যায়ন এর উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই, ইতিহাসমনস্ক গবেষকরা এই দাবির যথার্থতা হয়তো একদিন মূল্যায়ন করবেন। সেদিন আমজনতা পাঠকের মত  সৈয়দ বোরহান নিজেই হয়তো  ইতিহাস মনস্ক কোন লেখকের উক্ত বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখা কোন প্রবন্ধ পাঠ করে অনুধাবন করবেন যে, 'জিয়া-সমালোচনাকে'  তিনি  কিভাবে 'কুৎসায়' পরিণত করেছেন। হয়তো কোন একদিন  তিনি নিজেই তার রচিত এই প্রবন্ধের পরিমার্জিত বয়ান জনপ্রিয় কোন একটি দৈনিকে ছাপবেন। অন্য পাঠকদের মত আমিও সেদিন আশা করি বিভ্রান্তি মুক্ত হব।]

যাই হোক, প্রসংগে ফেরা যাক। পরাজিত হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা তাঁকে অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। তিনি হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাননি। ১৯৭৪ সালে তাঁর নিজের লেখা 'একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে এর আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসারদের আনুগত্য ছিলো প্রশ্নাতীত। অবশ্য গুটিকয়েক দালাল ছাড়া আমাদের ওরা দাবিয়ে রাখত, অবহেলা করত, অসম্মান করত। দক্ষ ও যোগ্য বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের ভাগ্যে জুটত না কোনো স্বীকৃতি বা পারিতোষিক। জুটত শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা ... ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগনাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মধ্যেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল ..." (রহমান, মেজর জেনারেল জিয়াউর (১৯৭৪), 'একটি জাতির জন্ম', বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যা, ২৬ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা)।

অন্তরে পুষে রাখা স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৬ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার আব্দুর রশিদ জাঞ্জুয়াকে প্রতিহত করেন। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যের রাতে জিয়া চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামীলীগ নেতাদের জানাতে বলেন যে, ইস্ট বেঙ্গলের অষ্টম ব্যটেলিয়ান বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করবে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া যে তাঁর সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন, সেটা তাঁর সহকর্মীরা সমর্থন করেন এবং পরে ২৭ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-৪৬)। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জিয়া'র রণকৌশল প্রয়োগের বিষয়টি খুব একটা বাধামুক্ত ছিলো না। চিহ্নিত শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা জিয়াসহ রণাঙ্গনের অনেক যোদ্ধার উৎসাহ উদ্দীপনাকে স্তীমিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। পদ ও বয়সের কারণে তাঁর নিযুক্তি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিলো। কিন্তু তিনি সবার সংগে মানিয়ে নিতে পারেননি। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান তাঁর শুভ দৃষ্টিবঞ্চিত ছিলেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে  জিয়াউর রহমানের অধীনে যুদ্ধ করা কর্মকর্তাদের উপর। বীরত্বসূচক পদক বিতরণের সময় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পদকবঞ্চিত হন জিয়া'র অধীনে যুদ্ধ করা অধিকাংশ কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেই এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় 'খয়রাতি বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন (কর্নেল শাফায়াত জামিল, ২০০৯, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ৫৪)। 

প্রসংগত উল্লেখ্য, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে 'জেড ফোর্স' নামক বিগ্রেড তৈরি করা হয়েছে। জুন ৭১-এ তৈরি এই 'জেড ফোর্স'ই হলো সর্বপ্রথম ব্রিগেড। পরে কে এম সফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফ তাঁদের অধীনে আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার জন্য এম এ জি ওসমানী'র ওপর চাপ  অব্যাহত রাখেন। আরও দু'টি ব্রিগেড তৈরি করার মতো নিয়মিত সেনা তখন না থাকলেও এম এ জি ওসমানী'র সংগে সু-সম্পর্ক থাকায় তিনি ৩০ আগস্ট সফিউল্লাহর অধীনে 'এস ফোর্স' এবং ২৪ সেপ্টেম্বর খালেদ মোশাররফের অধীনে 'কে ফোর্স' নামে আলাদা দু'টি ব্রিগেড তৈরি করেন (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ- ৪৮)।  

রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জিয়াকেও ১৯৭২ সালে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। এটি সন্দেহাতীতভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের উদ্রেক ঘটে তখনই, যখন দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে জিয়া ও সফিউল্লাহ একই ব্যাচে কমিশন পেলেও ক্রম অনুযায়ী জিয়া'র নাম উপরে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সফিউল্লাহকে ৩ বছরের জন্য সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ নিয়োগ করা হয়। বৈষম্যের বঞ্চনার দহন এখানেই শেষ নয়।  সফিউল্লাহকে প্রথম তিন বছরের মেয়াদ শেষে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো তিন বছর মেয়াদে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় (নূরুল ইসলাম চৌধুরী, '১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে', ভোরের কাগজ, ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট, ১৯৯৪)।

ইতিহাসের এই বিবরণ পাঠে একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়: কর্মজীবনের শুরু থেকেই রণাঙ্গনে ভূমিকা রাখার জন্য পেশাদারিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পুরষ্কারে ভূষিত জিয়াউর রহমানের সংগে এম এ জি ওসমানী'র এই শীতল সম্পর্কের কারণ কী? কেনই বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রচলিত জ্যেষ্ঠতার নিয়ম লঙ্ঘন কওে, মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় অবদান রাখার জন্য খেতাবপ্রাপ্ত বীর উত্তম জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার পদবঞ্চিত করা হলো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার যথাযথ ব্যক্তিরা হলেন ইতিহাসের গবেষকগণ। সেই কারণে আমি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে অতি সাধারণীকরণের ঝুঁকি অনুভব করে, তা থেকে বিরত থাকাই সংগত মনে করছি। 

পেশাদার একজন সামরিক কর্মকর্তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদে যাওয়ার বিষয়টি তাঁর অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এটি মোহ বা লোভের বিষয় নয়। অধিকার বঞ্চিত হয়েও প্রতিশোধের পথ বেছে না নিয়ে তিনি বছরের পর বছর (অন্তত সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে সফিউল্লাহ'র ৩+৩=৬ বছর মেয়াদে) ধৈর্য্য ধারণ করেছিলেন, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা (ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্যু পাল্টা ক্যু-তে বিশেষভাবে খ্যাত একটি বাহিনী)।  লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠিয়ে দিতে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়। পেশার প্রতি একনিষ্ঠ জিয়া বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার প্রস্তাব বিনয়ের সংগে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত খুরশিদ উদ্দিন আহম্মেদ-এর সহায়তায় দেশ থেকে বিতাড়িত হবার দুর্ভাগ্যবরণ করা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন (হামিদ, লে. কর্নেল (অব.) এম এ (২০১৩), তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ- ১২-১৩)।

১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পেছনে জিয়াউর রহমানকে অনেকেই অনুমান-নির্ভর মূল্যায়ন করে থাকেন। দু'টি ঘটনা উল্লেখ করে বলা যায়, পটপরিবর্তনের কর্মকান্ডে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলো না মর্মে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

(১) প্রথম ঘটনাটি হলো, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পরে ঐ বিষয়ে অবহিত করার পরও জিয়া'র মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার কোনো ধরনের লক্ষণ কিংবা আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি বরং অতি সংক্ষেপে বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষেই তিনি মত প্রকাশ করেন (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, পৃ- ১০৩)।

(২) দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হবার পর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, সাফায়াত জামিল জিয়া'র কক্ষে বসে আছেন। এমন সময় সদ্য পদোন্নতি পাওয়া এবং সরকারি আদেশে দিল্লিতে অবস্থানরত মেজর জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের কক্ষে প্রবেশ করেন। এরশাদকে দেখে জিয়াউর রহমান রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বলেন,'আপনি অনুমতি ছাড়া কেন দেশে ফিরে এসেছেন?' জবাবে এরশাদ বলেন, 'আমার স্ত্রীর জন্য গৃহভৃত্য নিতে এসেছি। ততোধিক রেগে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, 'আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এ ধরনের লাগামহীন আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে' (কর্নেল শাফায়াত জামিল (২০০৯), পৃ- ১২০-১২১)'। একইসংগে তিনি এরশাদকে বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেন এবং পরের ফ্লাইটেই দিল্লি যেতে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অমান্য করে ঐ রাতে এরশাদ বঙ্গভবনে যান এবং অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সংগে বৈঠক করেন (প্রাগুপ্ত)। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশংকাজনকভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই আদেশে বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সংগে জড়িত কারও বিচার করা যাবে না (মহিউদ্দিন আহমদ, ২০১৭, পৃ-৬৪)। অধিকন্তু কর্নেল সাফায়াত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী, তার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও খোন্দকার মোশতাক অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত মেজর রশীদ, ফারুক ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন (সাফায়াত জামিল, ২০০৯, পৃ-৭)। এই ঘটনা প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সংগে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অভ্যুত্থানকারীরা ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে সংঘটিত করলো? অনেকেই মনে করেন, এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো তৎকালীন সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক মনস্তত্ত্ব। স্পষ্ট ভাষায় বললে, তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রতি অবহেলা ও ভারতীয় আধিপত্যের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য তারা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯৭৪ সালে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করার বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না' (মাসক্যারেনহাস, অ্যান্থনি, ২০০২), বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, A Legacy of Blood-এর ভাষান্তর, অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ-৩৮-৩৯)। এর বিপরীতে তিনি রক্ষীবাহিনী নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেন; প্রথমে পুলিশের এটি সহায়ক বাহিনী হলেও পরে এই বাহিনীকে ক্ষমতা দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারতো এবং অনেকেই মনে করেন তাদের ব্যবহার করা হতো আওয়ামী লীগের সমালোচকদের বিরুদ্ধে (প্রাগুক্ত)। এর সংগে যুক্ত হয় বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যা ব্যপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানের আস্থাভাজন তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ এ ধরনের পদক্ষেপ সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে বিধায় তাঁকে অবহিত করার তাগিদ বোধ করেন। এ ব্যাপারে ভোরের কাগজের (তৎকালীন) সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সফিউল্লাহ বলেছেন,

স্যার, 'সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। হঠাৎ করে এক পার্টিতে কেন যাচ্ছেন?' তিনি বললেন, 'সফিউল্লাহ, তুমি বুঝবে না ... আমার ওপর বিশ্বাস রাখো' ( ভোরের কাগজ, ১৫ ও ১৬ আগস্ট, ১৯৯৩)। 

সফিউল্লাহ এক্ষেত্রে আরও মন্তব্য করেন, 'মনে হয় এসব কিছুর পরও যদি রক্ষিবাহিনী সামনে না আসতো, সেনাবাহিনী সেগুলো মেনে নিতো (প্রাগুক্ত)। সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব অগ্রহণযোগ্য ছিলো মর্মে মন্তব্য করেছিলো আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত মিত্র বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। তাদের মূল্যায়নে বলা হয়- 'আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর জন্ম ও ভিত্তি তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার মতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে... পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো, স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি আমাদের পক্ষ থেকে তেমন বৈরীসুলভ দৃষ্টি গ্রহণ করা খুবই ক্ষতিকর হবে (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৭৯, 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আমাদের পার্টির ভূমিকা ও করণীয়', কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত, পৃ-১৪-১৫)'।

১৫ আগস্টে অভ্যুত্থানকারী ও আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের নিজস্ব বয়ানের (জনগণ এ বিষয়ের উপর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্টই অবগত হয়েছেন) পাশাপাশি উপরোল্লিখিত ঘটনাবলী বিশ্লেষণের আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ৭৫-এর পট পরিবর্তনের সংগে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁকে দায়ী করা বক্তব্য কিংবা লেখনি ভ্রান্ত অনুমাননির্ভর, অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

৩) ৭৫-এর নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ছিলো একটি সময়ের দাবি। সংকট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, ক্যু ও পাল্টা ক্যু-এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহী-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কীভাবে দেশ পরিচালনা গুরুদায়িত্ব প্রদান করেছেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।

জিয়া'র দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কী হবে, এর একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গেছে। জিয়া প্রতিশোধ পরায়ন ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও শত্রু চিহ্নিত করে নির্মূল করার পথে না হেঁটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে জিয়া সর্বস্তরের জ্ঞানী-গুনী মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায়ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।

১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট এই দল গঠন করা হয়। সাধারণত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে এ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ এটি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জিয়াউর রহমানের মস্তিষ্কজাত রাজনৈতিক মতাদর্শ। সংগত কারণে অনেকের মধ্যে সংসয় ছিলো, এটি কি রাজনৈতিক দল নাকি একটি 'প্রবণতা'। কিন্তু সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবেই স্থায়িত্ব অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহণযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে দেশ শাসন করেছে। 

এই দলের গ্রহণযোগ্যতা তথা জনপ্রিয়তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি কারণ হলো- ১) জাতীয়তাবাদী দলের দার্শনিক ভিত্তি, ২) জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ৩) কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। 

বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় 'বাঙালি' হিসেবে ধার্য করা হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারণায় পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কী তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে 'বাঙালি' পরিভাষাটি ব্যবহার করি, তাহলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ (যেমন-আদিবাসীগণ) জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। এটি আমাদের জাতিসত্বার একটি খন্ডিত পরিচয় তুলে ধরে। জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে 'বাঙালির' স্থলে 'বাংলাদেশী' পরিভাষা ব্যবহার করা প্রস্তাব করেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের তাত্ত্বিক বিচ্যুতি দূর করার লক্ষ্যে কালক্ষেপণ না করে তিনি ফরমান জারি করে একে আইনি কাঠামোর মধ্যে স্থিত করেন। এর পক্ষে তার যুক্তি হলো-

'বিশেষ করে ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটেছে। 'রেজিয়াল' বা জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসংগে সর্বপ্রথমেই এসে যায়। আরব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।...এর পর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান এই ধ্যান-ধারনা থেকেই উৎসারিত। এ কারণেই আওয়ামী লীগাররা বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলিম লীগ, আইডিএল এবং জামায়াতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা।...সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে 'পলিটিক্স অব এক্সপ্লয়টেশন' পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে একটি নতুন জাতীয়তাবাদ।... তাই আমরা বলি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।... বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয় তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। ...প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটি স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্নই হলো [সেই জাতির] দর্শন। এই দর্শন দিয়েই [চর্চার মাধ্যমেই] বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে' ('বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ', জিয়াউর রহমান, www.bnpbangladesh.org)।  

জিয়াউর রহমানের মতে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সার্বজনীন ও অবৈষম্যমূলক। এটি কেবল ধারণাগত বিষয় নয় বরং দেশপ্রেমের চেতনাস্নাত একটি প্রণোদনা; যা সকল নাগরিককে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সমান গুরুত্বের সংগে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮১ সালে মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের বক্তব্যে তা-ই ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন,

"এটা আমাদের দেশ, আমাদের ভূমি, ... এখন সুযোগ এসেছে ... চাষাবাদ করি এবং এর উৎপাদনশীলতা বাড়াই, শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যfদার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। ... আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে ... কোনো বিদেশীবাদ নয় (Franda, Marcus (1981) Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism, Economic and political weakly, Vol. XVI, No-10-11-12, 1981; quoted in Hossain) p-63।

জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ এই রাষ্ট্র দর্শনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে প্রান্তিক আদিবাসীরাও গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতি পায়, জিম্মি থাকে না আহমদ শরীফের ডায়েরি, ভাব-বুব্দুদ, পৃ-৬৪)। তবে তিনি জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করেননি। তাঁর মতে এর ফলে পূর্ণ নাগরিক হিসেবে মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকগণ বৈষম্যের শিকার হবেন (প্রাগুক্ত)।

আমার মতে, দু'টি কারণে আহমদ শরীফের শেষের মন্তব্যটি পূনঃবিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, জিয়া প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী দলের নীতিমালা অনুযায়ী জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রতি আস্থা রেখে দলের সমর্থক, কর্মী, কিংবা নেতৃত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের জন্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। বরং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত এই দল অমুসলিম বাংলাদেশী নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের আইনগত ভিত্তি রচনা করেছেন। যার রূপকার জিয়াউর রহমান নিজেই। দ্বিতীয়ত,'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্ম-বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ আবার প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। জিয়া সাংবিধানিকভাবে দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেননি। যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উদারনৈতিক চেতনা দ্বারা সুরক্ষিত। জিয়াউর রহমান সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' সংযুক্ত করার মাধ্যমে মূলতঃ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন অমুসলিম নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় সমুন্নত রেখেছেন, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মানসিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার প্রতি আন্তরিক সমর্থনের নিদর্শন হিসেবে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত করেছেন।

তাঁর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও নির্মোহ অকপট ভাবনার অতুলনীয় পন্ডিত আহমদ ছফা'র একটি উক্তিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছফা বলেন 'ইসলামের সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের সংগে যোগহীন রাজনীতির কোনো ভবিষ্যত এ দেশে নেই (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)'। নিরোধ বরণ চৌধুরী ১৯৬৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় পাঁচ পর্বে মুদ্রিত 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' নামক প্রবন্ধে এ ধরনের একটি সমন্বয় ধর্মী অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রদর্শনের উন্মেষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সংগত কারণে বলা যায়, এই জাতির জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে আওয়ামী লীগের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনার তুলনায় জিয়া'র রাষ্ট্রদর্শন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রায়োগিক। এ প্রসংগে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-

আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ওই ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতার সংগে কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ-উত্তর সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নি¤œবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার সংগে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। এর ফলে জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক প্রবণতার জন্ম হয়। বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিলো নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে 'জয় বাংলা' স্লোগান তার কার্যকারিতা সম্পন্ন করেছিলো। আওয়ামী লীগ এরপর পুরনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মনে করতে শুরু করে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশদ্রোহ। একাত্তরের পর আওয়ামী লীগও বিরোধীদের সমালোচনার মধ্যে সবসময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে থাকে। সরকার-বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহ একাকার করে ফেলে। এখান থেকেই শুরু রাজনৈতিক সংকটের। এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয়তাবাদী দলের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্য কারণ হলো- জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। এই ভাবমূর্তি তৈরির পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যতীক্রমহীনভাবে সদগুণাবলীর চর্চা। এ বিষয়ে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটি শেষ করতে চাই। কাফি খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর প্রেস সচিব। যিনি এক সময় 'ভয়েস অব আমেরিকার' সংবাদ পাঠক ছিলেন। খুব কাছ থেকে তিনি জিয়াউর রহমানকে দেখেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী,

'আত্মীয় স্বজনদের কেউ কোনো তদবিরের জন্য বঙ্গভবনে বা তাঁর বাসায় আসার সাহস পায়নি। তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একমাত্র দেখা যেত রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে গেলে সফরসংগী হিসেবে। তা-ও সব সফরে নয়।... তিন-চার হাজার টাকার মতো বেতন পেতেন। সেখান থেকে ১৫০ টাকা রাষ্ট্রপতির রিলিফ ফান্ডে জমা দিতেন। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতেন (সৈয়দ আবদাল আহমেদ-এর নেওয়া কাফি খানের সাক্ষাৎকার, www.bnpbangladesh.org)।

একই ধরনের মূল্যায়ন করেছেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তনি বলেন 'রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর মতো স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিমুক্ত এতো কঠোর রাষ্ট্রনায়ক আমি আগে কখনও দেখিনি (ভাসানীমঞ্চ, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন)'।

এই দলের গ্রহণযোগ্যতার পেছনে তৃতীয় কারণ হলো- কার্যকর সাংগঠনিক পদক্ষেপ এবং উন্নয়নমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ। বিষয়টি যথাযথভাবে ব্যাখ্যার জন্য বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। যা একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার দাবি রাখে (এ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনার কাজ এগিয়ে চলেছে)। 

যে কথা বলে শেষ করতে চাই, তাহলো- জিয়া'র জাতীয়তাবাদী দর্শনের মর্মকথা হলো, কেবল ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের মতাদর্শের সঠিক উপলব্ধি ও এর বাস্তবায়ন। এই লক্ষ্য অর্জনে জিয়া'র উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূমিকা রাখবে, তাতে সন্দেহ নেই। 

প্রয়োজন জিয়া'র গুণাবলীতে অনুপ্রাণিত ও আলোকিত নেতা-কর্মী ও সমর্থক। গ্রিক দার্শনিক ও মানবজাতির একজন শিক্ষক হিসেবে খ্যাত মনীষী অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, নৈতিকভাবে আলোকিত সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য প্রয়োজন সদগুণচর্চা, যা নৈতিকভাবে অনুকরণযোগ্য নেতৃস্থানীয় পূর্বসূরীদের অনুসরণ করে করতে হয়। যেমন- সততা, মহত্ব, সাহস, বন্ধুত্ব ইত্যাদি সদগুণচর্চার ক্ষেত্রে সেসব আলোকিত পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতে হবে, যারা শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ চর্চায় অটল ছিলেন। ইতিহাস ও সাহিত্য এই উদাহরণ সৃষ্টিকারী আলোকিত মানুষদের কর্মকাণ্ড ধারণ করে; সংগতকারণেই সদগুণচর্চার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাস ও সাহিত্য নির্ভরশীলতা রয়েছে। ইতিহাস ও সাহিত্য মানবজাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতির আধার (Store House of Cultural Memory)। তাই এই জাতির ইতিহাস মনষ্ক হওয়া অতি জরুরি। তাহলেই কেবল অনুকরণযোগ্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী রাজনৈতিক অভিভাবকের সঠিক সন্ধান পাওয়া যাবে। পেলেই চলবে না, প্রয়োজন সবাই সেই অনুযায়ী জীবন আচরণে অভ্যস্ত হওয়া। দল-মত নির্বিশেষে সকলের জন্যই আত্মজিজ্ঞাসার এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সময় এসেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে চাইলে সবাইকে এই আত্মজিজ্ঞাসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে এবং এক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শন উপলব্ধি, চর্চা ও বাস্তবায়নের সংগে যেসব নেতা-কর্মী ও সমর্থক জড়িত, তাদের জন্য আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান স্বয়ং এক্ষেত্রে অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

  • লেখক শিক্ষক দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

‘ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব’

-------------------------------------- 
আবিদ হাসান/বাংলাট্রিবিউন
 -------------------------------------- 
ইকবাল হোসেন শ্যামল
সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল

দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের চর্চা ও ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে ছাত্র সংগঠনের কী ভূমিকা ছিল? ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ছাত্র সংগঠনগুলো জোরালো ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার যখন স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়েছে বা দেখাতে চেয়েছে, অগণতান্ত্রিকভাবে জনমতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্র সংগঠনগুলো ওই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১/১১-এ ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও ছাত্র সংগঠনগুলো কথা বলছে। 

 বাংলা ট্রিবিউন: আগামীর ৫০ বছর কেমন আশা করেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের যে মূল আকাঙ্ক্ষা তথা গণতন্ত্র- তা আমরা পাইনি। গণতন্ত্রের যে মূল উপকরণ-জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, জনগণের ভোটাধিকার, সেই অধিকার এই সরকার খর্ব করেছে। ৫০ বছরেও আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পাইনি। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রত্যক্ষ ভোট, তা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা আশা করি, দেশের জনগণের ভোটের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করবো, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবো। 

বাংলা ট্রিবিউন: ক্যাম্পাসে রাজনীতির সংস্কৃতির পরিবর্তন আসছে কি? কী পরিবর্তন দেখছেন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: ছাত্র রাজনীতিকে আমি সহশিক্ষা বলব। আমি মনে করি শুধু ক্লাসরুমে শিক্ষকের লেকচারে শিক্ষাটা সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। ছাত্র রাজনীতিকে আমি সামাজিক কার্যক্রম বলতে চাই। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান যতটা আশা করি তার সিংহভাগই অনুপস্থিত। ক্যাম্পাস মুক্তচিন্তার জায়গা হবে, স্বাধীনভাবে আমি আমার মত প্রকাশ করবো। বর্তমানে ক্যাম্পাসে সেই পরিবেশ নেই। রাজনীতি সংস্কৃতির পরিবর্তন আসেনি। আশির দশকেও ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সহাবস্থানের রাজনীতি করেছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিন্নমতের কোনও সংগঠনকে আমরা লালন করতে পারি না, ধারণ করতে পারি না। 

বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কেমন? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন একটা 'খয়ের খা' প্রশাসন। এই প্রশাসন সরকারের অনুগত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের কাছ থেকে নিরপেক্ষ আচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। আমাদের সুন্দর ক্যাম্পাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই আস্থা রাখতে হবে। সেই আস্থার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেই। রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ
বিনির্মাণ করতে পারছে না। 



বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দিলো, এতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি কোন দিকে? ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তির জন্যই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। শত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্দেশ্যের অনেকটাই পূরণ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই রচিত। তবে বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমরা হতাশ। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক নিচে। রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও নামছে। যখন সকল মতের জন্য ক্যাম্পাস হবে তখন শিক্ষার পরিবেশেরও উন্নতি হবে। 

বাংলা ট্রিবিউন : এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? সহাবস্থান আছে? 
ইকবাল হোসেন শ্যামল: সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাড়া সকল সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম খুবই সীমিত। ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্বাচন দীর্ঘদিন হচ্ছে না। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যদের কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে সহাবস্থান আছে। এটাকে সহাবস্থান বলা যাবে না। কারণ প্রতিনিয়তই তারা আমাদের ওপর হামলা করছে। আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

বাংলা ট্রিবিউন : হলগুলোতে ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্য রয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ, এ বিষয়ে কী বলবেন? 
 ইকবাল হোসেন শ্যামল : এর সঙ্গে আমিও একমত। ভিন্নমতের কাউকেই স্থান দেওয়া হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের বাইরে গেলে কাউকেই হলে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলা ট্রিবিউন : ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা আছে? ইকবাল হোসেন শ্যামল: ভিন্নমত থাকবেই। আমরা ভিন্নমতকে সম্মান করি। আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। বর্তমানে কিছু কিছু সংগঠনের মধ্যে ভিন্নমত গ্রহণের প্রবণতা কমেছে। তারা অন্য মত কিছুতেই সহ্য করছে না। এটা আশঙ্কার জায়গা। এটা অবশ্যই শিক্ষার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।


Wednesday, June 2, 2021

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-এর অর্থনীতি

------------------------------------------

—  ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

------------------------------------------

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম

একমূখী রাষ্ট্রীয়করণ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ভারসাম্যপূর্ণ বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেন।

জিয়াউর রহমান সরকার সমাজতান্ত্রিক মেরুকরণকৃত একমুখী নীতি কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনীতি, শিল্পনীতিতে  গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতিপদ্ধতির মাঝামাঝি একটা মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করে। এসময় গুরুত্বপূর্ন প্রায়  সকল নাগরিক সেবাকে সরকারি খাতে রেখেই বেসরকারি শিল্প বিকাশের পথে হাঁটা হয়। 

দ্রুত দেশের আর্থ-সামাজিকউন্নয়নের জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় করেছেন তিনটি উৎপাদন মূখী অর্থনৈতিক ধারা। এক — কৃষির সবুজ বিপ্লব। দুই — গণশিক্ষা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযান। তিন — শিল্প উৎপাদন। এসময় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দুটি শ্রমবাজার তৈরি হয় বাংলাদেশে। এক — তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার। দুই —  মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমবাজার। এর বাইরেও আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ  উদ্যোগ ছিল যা হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা। তিনটি অর্থনৈতিক ধারা এবং দুটি শ্রম বাজার পরবর্তিকালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু বংলাদেশ একটি বাজারমুখি রাষ্ট্র এবং যার সূচনা জিয়াউর রহমানের শাসনকালেই, তাই অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, মূলত এই সময়কালে সূচিত পরিবর্তন গুলোর ভিত্তিতেই পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ ও গতিপথ আবর্তিত হয়েছে।  বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তিনটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ হচ্ছে কৃষি, প্রবাসী শ্রমবাজার এবং তৈরি পোশাক শিল্প। এই তিনটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এই সময়েই সূচিত হয়েছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকালে ক্ষুধার তাড়নায় নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত স্রোতের মত নগরে বিশেষ করে ঢাকায় ছুটেছেন,যাঁদের অনেকেই পরে গ্রামে ফিরে যাননি। অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষিতে সেচের সমস্যা ও অযান্ত্রিক শ্রমের প্রাচুর্য ছিল বলে সেখানে কৃষির কাজে অধিকতর সংখ্যায় শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, ফলে বাংলদেশের গ্রামে গ্রামে ছদ্মবেকারত্বের প্রাচুর্যছিল। শ্রমঘনীভবনের দুর্ভিক্ষকালীন ধারা এবং আগে থেকেই বিরাজমান কৃষির ছদ্মবেকারত্ব —  এই দুটি ধারা জিয়াউর রহমানের আমলে শ্রমবাজারে রূপান্তর ঘটে। এসময় গণচীন পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন সহায়তায় তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ নতুন এক শ্রমবাজারের পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক প্রবাসী শ্রমের আরেকটি নতুন বাজার গড়ে উঠে। পাশাপাশি অলস ভাতার পরিবর্তে কাজের বিনিময়ে অলস শ্রমকে উৎপাদনমুখী কাজে জড়িত করায়, খাল খনন করে সেচের সুবিধা তৈরির ফলে কৃষিতে ও সবুজবিল্পব আসে। ফলে দেশে প্রায়োগিক পূঁজি ও মানবপূঁজি উভয়ের বহুবিধবিকাশ শুরু হয়। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত বিকশের পথ ও তৈরিহয়।

ফলস্বরূপ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের মাঝের ও শেষ এই দুটি অর্থবছরে (১৯৭৭-৭৮ এবং ১৯৮০-৮১) বাংলাদেশ সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ও আব্দুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  বাংলাদেশের মাথাপিছু স্থূল দেশজ উৎপাদন গড়ে ৪.৫২% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, যা নব্বই দশকের আগের সময়ে গড় হিসেবে সর্বোচ্চ।















ছক —  জিয়াউর রহমান ও আবদুস সাত্তার দুই রাষ্ট্রপতির সময়ে  মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার। তথ্যসূত্র —  বিশ্বব্যাংক।   

বিবিধ কারণে জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শুরুর সময়কাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত অবকাঠামোগত পুরোপুরি পুনর্ঘটিত হতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ,  ১৯৭৫ সালের বাকশাল ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সার্বিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন জনিত বড় বড় দুর্ভাগ্যজনক অস্থিরতাগুলো বাংলাদেশের অর্থনিতিকে ভুগিয়েছে। দেশে সার্বিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

বহুমুখী বাস্তবধর্মী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। এ সময়ে খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে, গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক  কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়া সরকারের। জিয়াউর রহমান সরাসরিই কৃষি সমবায় এবং সমবায় বাঁধের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মসূচী দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এসবের পাশাপাশি মৌলিক সেবা খাতকে সরকারি আয়ত্বে রেখে পশ্চিম ইউরোপীয় ধারার এক ধরণের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতের উৎসাহিত করা হয়েছে, এই বিকাশ সাধনে ব্যাংক ঋণ কর্মসুচীও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষিতে খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

নিন্মে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য দিক গুলোর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে। 

স্থিতিশীলতা — 

১। গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন। 

২। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৩।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান চরম বিশৃঙ্খল দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।‍ সশস্ত্র বাহিনীতে মোটামুটি একটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।  সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উষ্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সম্পন্ন হয়েছিলেন। 

৪। বাংলাদেশ মহিলা পুলিশ প্রতিষ্ঠা। 

কৃষি — 

পানির পাম্প চালিয়ে কৃষকদের উৎসাহ
দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
১। আবাদী জমি তিন গুণ করার উদ্যোগ নিয়ে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন ছিল এই সময়ের একটা বড় উদ্যোগ।

২। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানির পর্যায়ে উন্নীতকরণের উদ্যোগ।

৩। দারিদ্র্য বিমোচনে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডলকে এগিয়ে নেয়া। 

৪। কাজের বিনিময়ে খাদ্য/কাবিখা, কাজের বিনিময়ে নগদ মজুরীর মত মেধাবী ধারনা দিয়ে সারফেইসে স্বাদু পানির রিজার্ভ বৃদ্ধি করে আবাদী জমি বাড়াতে খাল খননকে একটি সফল কৃষি বিপ্লবে রূপ দেয়া।  

শিল্প — 


১। নতুন ধারার বেসরকারি শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ। কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিকাশ করে দেশে টেলিফোন সেট উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে পাকশি কাগজ কলে দৈনিক ৩০ টন করে কাগজ উৎপাদন শুরু হয়, যা দেশে পাটখড়ি থেকে কাগজ উৎপাদনের প্রথম উদাহরণ।

২। যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।

৩। তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মত নব ধারার বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।

৪। জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানির দ্বার উন্মোচন।

৫। ১৯৭৬ সালে প্রথম ৬০০০ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাঠানোর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু। হয়

৬। শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।

৭। ১৯৭৯ তে বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানীযোগ্য তৈরি পোশাক শিল্প (বস্ত্র শিল্প) প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা। এর আগে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ১৩০ জন কর্মী-উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়দক্ষিণ কোরিয়াতে ট্রেনিং পাঠানো হয়।আশির দশকের শেষ দিকের একটি জরীপে দেখা যায়, এই ১৩০ জন্যের অধিকাংশেরই নিজস্ব তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা ছিল। তবে অভিযোগ আছে, শিল্প ঋণ প্রণোদনা পাওয়া একটা ক্ষুদ্র অংশ ঋণ খেলাপি হয়েছেন এবং শিল্প ঋণের খেলাপি সংস্কৃতি তৈরি করেছেন, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে  পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অপধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।  

৮। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণকার্যক্রম শুরু করে (অধ্যাদেশ পাশহয় ১৯৮৩ সালে)।

৯। ১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামী অর্থনীতি গবেষণা ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা হয়, ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

শিক্ষা — 

১। গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দানেরউদ্যোগ।

২। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়তৈরি।

৩। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ইংরেজী, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা। 

৪। শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা, শিশু মনোবিকাশে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়। 

৫। টেক্সটাইলকলেজপ্রতিষ্ঠাযাবর্তমানেবাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)। 

৬। সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সরকারি কর্ম কমিশন সংস্কার করে বিসিএস এ ১৪ টি বিশেষায়িত ক্যাডার সার্ভিস চালু করেন যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

স্বাস্থ্য — 

১। ২৭, ৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।

২। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৩। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এর পুনঃ সূচনা। (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (স্যাটো) কলেরা গবেষণা পরীক্ষাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার (সিআরএল) খুব দ্রুত ডায়রিয়া রোগ গবেষণায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও ফান্ড জনিত কারণে উল্লেখযোগ্য এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে কলেরা গবেষণা গবেষণাগার (সিআরএল) কে আইসিডিডিআর’বি নামে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসময় বক্ষব্যাধী/টিবি হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালের পরিসর বড় করা হয়,হার্টফাউন্ডেশান, ক্যান্সার হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। জাতীয় শিশু টিকাদান কর্মসূচী চালু করেন।   

৪। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ন। বাংলাদেশের জরূরী ভিত্ততে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া নিয়ে মার্কিন তারবার্তায় (জানুয়ারী ১৯ ১৯৭৬, সিআইএ টেলিগ্রাম নাম্বার ০৩২৫/০৯৫০Z) সিনেটর ম্যাক গভার্নের সাথে আলাপের প্রসঙ্গে বলা হয় যে- “তারা (জিয়া) এটি বুঝতে পারছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আটকাতে না পারলে অন্য সেক্টর গুলোতেও তারা সফল হবেনা। তিনি (জিয়া) আরো জানিয়েছেন যে তারা তাদের সেরা এবং সবচেয়ে কার্যক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন সাত্তার’কে জনসংখ্যা বিষয়ক কার্যক্রমের সচিব নিযুক্ত করেছেন এবং আশা করছেন যে এটা ফলপ্রসু হবে। তারা আরো বেশী সংখ্যক এবং বেশী দক্ষ লোকবল নিয়োগ করবে এবং আরো বেশী সংখ্যক নারীকে এটার সাথে জড়িত করবে।”   

জিয়াউর রহমান সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম বড় একটা কারণ সেসময়ের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে বিশেষ কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশি ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতার জেরে অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক দুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার তিনটি মূল দিক ছিল। এক —  একচেটিয়া সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের সাম্যাবস্থা তৈরি। দুই —  মুসলিম বিশ্বের কাছ থেক স্বীকৃতি আদায় করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক শ্রমবাজার তৈরি হয়। তিন— চীনের সাথে সুস্পম্পর্ক স্থাপন যার মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাণিজ্য বিভাগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগ নামে দু’টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়।  

জিয়াউর রহমান প্রাচ্যের পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্ক গুলোতে সমাজতান্ত্রিক বাঁকজনিত কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৈত্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা এই আমলে রচিত হয়, এক্ষেত্রে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সত্তরদশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ তেল উৎপাদনকারী দেশ সমূহের অবরোধের প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানীতেল প্রাপ্তির দাবী করেন যা বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পু্নর্গঠনের কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশি ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তার উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। তাই গঙ্গার পানি চুক্তি বিষয়ে জাতিসংঘে যাবার প্রেক্ষিতে কিছুটা টেনশন তৈরি হলেও জিয়াউর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।‍

জিয়াউর রহমানের কর্মসুচী গুলোর একটা ভিন্ন মাত্রা হচ্ছে, এখানে অলস ভাতা এবং অলস সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দকে কর্ম নির্ভর বা উৎপাদনমুখী করা হয়েছে (কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাল কাটার বিনিময়ে মজুরি, উপবৃত্তি)। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভাতা ও বরাদ্দের কৌশলে উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপনা করা হয়েছে। এতে যুদ্ধ পরবর্তি দেশের কর্মচাঞ্চল্য ফরে এসেছে। অভ্যন্তীণ উৎপাদন কৌশলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য মূখী পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগীতার ফ্রেইমোয়ার্ক তৈরি করে জিয়াউর রহমান দেশের অর্থনীতি সংহতকরণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।


  • লেখক ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা। 'বাংলাদেশঃ অর্থনীতির ৫০ বছর' এবং 'চতুর্থ
    শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখক। পরিবেশ, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। 


Tuesday, June 1, 2021

সততার এক কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান

--------------------------------------

ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান

--------------------------------------




বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লিখিত ‘পিতা ও শিক্ষক’ শিরোনামে একটি লেখায় তিনি লিখেছেন- ১৯৭৬ সালের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আমরা দুই ভাই স্কুলে যাচ্ছিলাম। আমরা বের হয়েছি সাতটায়। বাবাও বের হয়েছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি যাচ্ছেন অফিসে। আমরা দু’ভাই গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাবা তাঁর গাড়িতে উঠলেন। তাঁর গাড়ি আমাদের গাড়ির আগে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনের গাড়িটির ব্রেকলাইট জ্বলে উঠল। বাসার গেইট দিয়ে বেরোবার আগেই জোর গলায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিলেন বাবা। সে দৌঁড়ে গেল বাবার গাড়ির দিকে। আমরা দু’ভাই গাড়িতেই বসে রইলাম। ড্রাইভার যখন ফিরে এলো চেহারা দেখে মনে হলো যেন বাঘের খাঁচা থেকে বের হয়েছে সে। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? উত্তরে ড্রাইভার বলল, “স্যার বলেছেন আপনাদের এই বেলা স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গিয়ে পিএসের কাছে রিপোর্ট করতে। এখন থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হবে। কারণ, ছোট গাড়িতে তেল কম খরচ হয়। আর এই গাড়ির চাকা খুলে রেখে দিতে হবে। যাতে করে কেউ এ গাড়ি চালাতে না পারে।” উল্লেখ্য, ওই গাড়িটি ছিল সরকারি বড় গাড়ি। গাড়িটি চালাতে তুলনামূলক তেলও খরচ হতো একটু বেশি। এই হলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এ ধরনের হাজারো ঘটনা আছে তাঁকে নিয়ে।

বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সচরাচর যে ধরনের জীবন-যাপন করেন সেই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের সহজ-সরল জীবন ছিল কিংবদন্তিতুল্য। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। জিয়াউর রহমানের সততা নিয়ে তাঁর বিরোধি মহলের অনেকে বক্রোক্তি করেন। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সার্কিটহাউজে তাঁর ব্যক্তিগত যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় সে সম্পর্কে সেসময়ের বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা লিখেছেন- “জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নি¤œলিখিত জিনিসগুলি পাওয়া যায়: একটি পুরাতন চামড়ার সুটকেস। তাহা এত পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ‘ইকোলাক’ জাতীয় ব্রীফকেস, গায়ের আধছেঁড়া গেঞ্জি, ২/৩টি সাফারী শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়িয়াছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাঁহার বিছানার পার্শ্বেই পড়িয়াছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।” (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)। আমার একটি প্রশ্ন? দৈনিক ইত্তেফাক কি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা?

জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আজকের এই লেখার অবতারনা এজন্য যে, আকাশ সমান জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে তাঁর বিরোধমহল কিছু কিছু বিরূপ মন্তব্য করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে যারা ভালোবাসেন তাদের মধ্যে অনেকেই সেসব নিন্দা মন্দের সঠিক উত্তর দিতে পারেন না। বিশেষ করে টকশোগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় বিএনপি পন্থি বক্তাগণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন তাঁর প্রতিপক্ষের দিকে। তখন আমার ভীষণ কষ্ট হয়। শুধুমাত্র ইতিহাস না জানার কারণে তাঁরা সেসবের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। যেমন একটি অভিযোগ এরকম- জিয়াউর রহমান একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- “আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট”। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাঁর বিরোধিপক্ষ এই উক্তিটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেন। এই কথাটির পুর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত “একজন জিয়া” বইটিতে। সেখানে লেখক লিখেছেন- কথায় কথায় আমি জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করলাম- যদ্দুর মনে পড়ে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন-“আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট”। এর পর প্রায়ই আপনি কথাটা বলছেন। আপনার এই কথা নিয়ে নানা মহলে নানা গুঞ্জন ও প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। কিন্তু দেশের লোকজনকে আপনি যদ্দুর মনে হয় এই কথাটির তেমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেন নি। কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকলেন জিয়াউর রহমান। তারপর বললেন- ‘দু’এক কথায় যদি ব্যাখ্যা চান, তাহলে এভাবে মোটামুটি বলা যায়. -আমি বলেছি গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। এদেশে অনেক সাইনবোর্ডসর্বস্ব, বিবৃতিসর্বস্ব, শহরকেন্দ্রিক পেশাদার রাজনীতিবিদ রয়েছেন। এদের চেহারা আর চালচলন কাজকারবার আমি বুঝে ফেলেছি। রাজনীতি করতে অসুবিধা হবে তাঁদের। তাঁদের মতো সবার জন্যেই-আই হ্যাভ মেড পলিটিক্স ডিফিকাল্ট। তারপর বললেন-‘দুঃখ কি জানেন, নেতারা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনাদের ‘বিচিত্রা’-র এক সাংবাদিককে আমি একবার এসব কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম-আমাদের বাংলাদেশের কোনো নেতাই ‘ইন টোটো’ নেতা নন। অর্থাৎ কোনো নেতাই সম্পূর্ণ নন। তাঁরা কথা জানেন, সে সব কথা বলেন এবং সাজিয়েগুছিয়ে বেশী করেই বলেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, এসব কথা তাঁরা বেশী বলেন ড্রইং রুমে বসে সন্ধ্যার পর। তাঁদের লোকজন বিবৃতি নিয়ে আপনাদের পত্রিকার অফিসে অফিসে ধাওয়া করেন। এঁরা আসলে কাজ করেন না। আবার এমন অনেকে আছেন যাঁদের কাজ করার আগ্রহ আছে। কিন্তু সংগঠন নেই বলে তাঁরা পারেন না। আমি এই কাজ-পাগল অথচ অচেনা নেতাদের কাজে লাগাতে চাই।”

তিনি যে শুধু কাজ পাগল অচেনা নেতাদের-ই কাজে লাগাতে চেয়েছেন তা-ই শুধু নয়। তিনি সবসময় চাইতেন জ্ঞানীগুণী, মেধাবী তরুন ও যোগ্য নেতারা দেশের জন্য কাজ করুক। জিয়াউর রহমান তাঁর উপদেষ্টা মন্ডলীতে যোগ্যতার দিকদিয়ে তৎকালিন দেশের কিছু তারকাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ অন্যতম। অন্যদিকে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ ও ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা প্রমুখগণ তো ছিলই। ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদাকে তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য করেছিলেন। তখন নাজমুল হুদার বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর। এতো অল্প বয়সে বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দলের এমন নীতিনির্ধারনি পর্যায়ে গিয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে গিয়েছিলেন। তিঁনি লন্ডনে বেশ ক’জন বাংলাদেশি তরুণ পেশাজীবীকেও সাক্ষাৎ দেন। তাদের দেশে ফিরে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিঁনি তাদের কাছে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কথা এবং একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য তুলে ধরেন। তাদের কয়েকজনকে দেশে ফিরে বিএনপিতে যোগ দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন।

দ্বিতীয় আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে জিয়াউর রহমান একবার হিজবুল বাহার নামক একটি জাহাজে করে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের নিয়েগিয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরে নৌবিহারে। সে বিষয়টি নিয়েও অনেকে তীর্ষক মন্তব্য করেন। কিন্তু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেন তাদের নৌবিহারে নিয়েগিয়েছিলেন বিরোধি মহল কিন্তু সেটা বিস্তারিত কখনো বলেনা। কারণ সেটা খুলে বললে তাদের নিজেদের দুর্বলতার থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, বছর দু’য়েক আগে প্রয়াত কবি আল মাহমুদ। তিনি ‘তৃষিত জলধি’ নামক তার একটি লেখায় তুলে ধরেছেন সেদিনের সেই ঘটনা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মুল বক্তব্যটি অনেক বড় সেজন্য শুধু বক্তব্যের চুম্বক অংশটুকু এখানে তুলে ধরা হল। এই বক্তব্যটি শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন কেন জিয়াউর রহমান সেইসব মেধাবী ছাত্রদের সেদিন নৌবিহারে নিয়েগিয়েছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে সেদিন জিয়াউর রহমান মেধাবী সে সব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙ্গা থেকে উত্তাল বে অফ বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র  হলো অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। এখানে এলে মানুষের হৃদয় একই সঙ্গে উদার ও উদ্দাম সাহসী হয়ে ওঠো অন্তত উঠতে বাধ্য। আমি কি ঠিক বলিনি? তোমার, আমার, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সংকীর্ণতা ও কূপমন্ডুকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মতো উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে। আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলবো তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। হঠাৎ বঙ্গোপসাগরের কথা মনে পড়ল। এই উপসাগরেই রয়েছে দশ কোটি মানুষের উদর পূর্তির জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভূমি ভেঙে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ-যা আগামী দু’তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই ভেসে উঠবে; যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দেবে। আমাদের ভিটাভাঙা পলি যেখানেই জমুক-তা তালপট্টি কিংবা নিঝুম দ্বীপ, এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্র-তরঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না। মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ যথেষ্ট সাহসী নই বলে শত্রুরা, পররাজ্য-লোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতামাতার সর্বশেষ আশার প্রাণকণা, যাদের ওপর ভরসা করে আছে সারা দেশ, সারা জাতি। তোমরাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ-নিঃশ্বাস।’ তাহলে এবার নিশ্চয়ই পাঠকবৃন্দ বুঝতে পেরেছেন বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা সেদিনকার সেই তালপট্টি কিংবা নিঝুমদ্বিপ রক্ষার জন্যই জিয়াউর রহমান সেই নৌবিহারের আয়োজন করেছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় এ সময়ের একজন প্রখ্যাত লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ২০১৬ সালে ‘বিএনপি সময় অসময়’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে লেখক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি সুবিচার করেননি। আরেকটু সচেতন ও নিষ্ঠাবান হলে আমার ধারণা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ বিষয়গুলো তুলে আনতে পারতেন তিনি। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকারকে উদ্ধৃত করে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন- “জিয়া বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। তারপর সেটি দেখে বক্তৃতা দিতেন। তিনি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুঁড়তেন। মোখলেসুর রহমানের সাক্ষাৎকার গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বইতে এভাবে তুলে ধরেছেন- এসব দেখেটেখে যাদু একদিন আমাকে (মোখলেসুর রহমান) বললো যে, এ রকম হলে কী করে তাঁকে আমি চালিয়ে নেব? আমি বললাম- দেখো জিয়া বক্তব্য দিতে পারেন না ঠিক আছে। তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে কী করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করো। জবাবে যাদু বললেন, হাঁটতে পারেন এক নাগাড়ে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। আমি বললাম এইতো পাওয়া গেল সবচেয়ে ভালো একটা উপায়, তুমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পাড়াগাঁয়ে হাঁটাও। ... গাঁও গেরামের রাস্তা দিয়ে যাবে আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? প্রেসিডেন্ট দেশের মিলিটারী লিডার, তিনি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কানাকানচি দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন আর লোকজনের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর করছেন, তাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।

লেখকের এই কথাগুলো যে কতটা সত্যের অপলাপ তা কিন্তু জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে কোন একটি ভালো বই পড়লেই জানা যায়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা জিয়াউর রহমান ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর এক মামীর কাছে ঐ সময়ে লেখা একটি চিঠিতে। জিয়াউর রহমানের মামা রুহুল আমিনের সৌজন্যে প্রাপ্ত বাংলায় লেখা ঐ চিঠির একটি ফটোকপি হুবহু দেয়া আছে হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত ‘একজন জিয়া’ নামক গ্রন্থটির ৮৫ নম্বর পৃষ্ঠায়। যে কেউ চাইলে সেটা দেখে নিতে পারেন। চিঠিটি জিয়াউর রহমান তাঁর মামীকে লিখেছিলেন ১/৪৯ জেকব লাইন, করাচী থেকে। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানে বসেও কখনো উর্দুতে কথা বলতেন না। কেউ তাঁর সঙ্গে উর্দুতে কথা বললে তিঁনি ইংরেজিতে জবাব দিতেন। আমরা যে বাঙালি এ ব্যাপারে তিঁনি ছিলেন খুবই সচেতন। আমরা যে বাঙালি এ ব্যাপারে তিঁনি খুবই সচেতন ছিলেন। (প্রেসিডেন্ট জিয়া, মাহফুজ উল্লাহ, পৃষ্ঠা-২৪)। তাছাড়া এসময় ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিঁনি। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২১)। আর এই যে হাঁটার অভ্যাস, এটা জিয়াউর রহমান রপ্ত করেছিলেন সেনাবাহিনীতে থাকাকালিন। অন্যদিকে ভাষানী গ্রামগঞ্জে হেঁটে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান নিশ্চয়ই ভাষানীর সেই কর্মকান্ড দ্বারা প্রানিত হয়েছিলেন। লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলেন বলেও খেদোক্তি করেছেন অথচ লেখক একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতেন পৃথিবীর বহুদেশের বহু জগৎবিখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। নেপলিয়ন বোনাপার্ট, উইনেষ্টন চার্চিল, চার্লস দ্য গল এঁরা সবাই আর্মি থেকে আগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসী দেশের ত্রাণকর্তা চার্লস দ্য গল একসময় ব্রীগেডিয়ার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে থিওডর রুজভেল্ট, আইজেন আওয়ার এরকম প্রায় আমেরিকার অর্ধেক রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় লেগেছি হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের আপামর মানুষের মনজয় করে নিয়েছিলেন। অনেকের হয়তো সে কারণে গাত্রদাহ হয় কিন্তু তাতে করার কিছু নেই। 

সম্প্রতিকালে ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিক রোজিনার উপর নীপিড়ন নির্যাতনের কারণেই একটি বিষয় মাথায় এলো যা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। জিয়াউর রহমান ছিলেন অসম্ভব পত্রিকা ও সাংবাদিক বান্ধব একজন মানুষ। তিঁনি ইনভেষ্টিগেটিভ রিপোর্টকে সবসময় উৎসাহিত করতেন। সে বিষয়টি জানাযায় জিয়ার আমলের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন যিনি পরবর্তীকালে দৈনিক ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন তার একটি লেখায়। ‘বিশ্ব নেতাদের চোখে জিয়া’ শিরোনামে আলমগীর মহিউদ্দিন লিখেছেন- “টাইমসে তখন অনেক ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ছাপা হতো। চাল সিন্ডিকেটসহ নানান খবর। এর মধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক একটি বড় ফাইল নিয়ে এসে হাজির। তিনি পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, সাফদার সাহেবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু একটি কমিটি করেছিলেন ঢাকা-আরিচা রোডের বিশাল দুর্নীতি তদন্তের জন্য। কিন্তু তার ইন্তেকাল হওয়ায় বোধহয় এ তদন্তের ভাটা পড়েছে। আপনাদের লেখায় দেখি কাজ হচ্ছে। এ রিপোর্টটা যদি করতেন। সে কাজের ভার দেয়া হলো আমাদের আর এক রিপোর্টার খন্দকার মুনিরুল আলমকে। তিনি বহু পরিশ্রম করে সম্ভবত পাঁচ পার্টে একটি রিপোর্ট তৈরি করলেন। প্রথা অনুযায়ী আমরা সম্পাদকের নেতৃত্বে রিপোর্টটা আলোচনা করার সময় সম্পাদক বললেন, আগামীকাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আছে। দিন রিপোর্টগুলো নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করবো। আমরা খুশিই হলাম। প্রায় দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরও সম্পাদক রিপোর্টটা নিয়ে কোনো কথা বলছেন না বলে জিজ্ঞাসা করলাম এর ভাগ্যটা জানতে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া রিপোর্টটা ছাপতে মানা করে দিয়েছেন। কষ্ট লাগলো। কারণ এক সাক্ষাতে জিয়া তাঁর চোখ-কান হিসেবে সাংবাদিকদের আখ্যায়িত করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ পর আমার এক পার্টিতে দেখা। আমি সুযোগ নিয়ে বললাম, স্যার, আপনি আমাদের আপনার চোখ-কান বলে আখ্যা দিয়েছেন; অথচ ঢাকা-আরিচা রাস্তার দুর্নীতির খবর ছাপতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনাদের সম্পাদক বলেছিলেন এমন একটা রিপোর্টের কথা। তাকে তো ছাপতে বলেছি এবং কথা দিয়েছিলাম অ্যাকশন নেবো। কই আপনারাই তো ছাপলেন না। ছাপুন না।

রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেন অনুসন্ধান করতে। আমাদের রিপোর্টের উল্লিখিত নথি দেখে সম্ভবত ১৮ জন সম্পর্কে কাগজপত্র পাওয়া যায়। তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করেন জিয়া। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৮৬-৮৭)। এই ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় কী ধরনের মানুষ ছিলেন জিয়া। এছাড়া বর্তমান জাতীয় প্রেস ক্লাবও জিয়াউর রহমানেরই অবদান। প্রিন্স করিম আগা খান জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণে ব্যয় বহন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রেস ক্লাবের নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। 


 ফেব্রুয়ারি ১৭, ১৯৭৯, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রেসক্লাব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন 


তিনি বলেছিলেন, নিজেই প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করবেন। সে হিসেবে ১৯৭৭ সালে তিনি ১৮ তোপখানা রোডে বর্তমান জায়গাটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অনুকূলে বরাদ্দ দেন। সেই সঙ্গে জমি দাম পরিশোধের জন্য ২৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা প্রেস ক্লাবকে অনুমোদন দেন। জমির দলিলে খরচাদিও মওকুফ করে দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং নতুন ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবকে দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা অনুদান। (প্রাগুক্ত-১৩১)।  শুধু প্রেসক্লাব নয় এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান গড়তে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিঁনি শিশু হাসপাতালটি তৈরির সময় ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৫০ লক্ষ টাকা। ১৯৭৮ সালে ৫০ লক্ষ টাকা মানে এসময়ের কম করে হলেও ১০০ কোটি টাকার সমান। জিয়াউর রহমানের ৫০ লক্ষ টাকা প্রদানের ঘটনাটি আমি ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের সামনে বসে শুনেছিলাম বলে সেটা পাঠকবৃন্দের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার লোভটা সংবরণ করতে পারছি না। সেটা ওয়ান এলিভেনের কথা। দু’নেত্রিই তখন জেলে। তাদের পক্ষে লড়বার মতো কোন আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে এগিয়ে এলেন ব্যারিষ্টার রফিকুল হক। তিনি প্রথমে শেখ হাসিনার মামলা হাতে নিলেন। আশার আলো জ্বলে উঠল আমাদের মনেও। একদিন আমার চাচা (আব্বার বন্ধু) এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে ব্যারিষ্টার নাসিরুদ্দিন অসীম, ব্যারিষ্টার কায়সার কামাল ও আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ফাইলপত্র নিয়ে হাজির হলাম ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের দরবারে। উনারা আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন মূলত বেগম জিয়ার ফাইলপত্রগুলো ক্যারি করার জন্য। যা হোক, ব্যারিষ্টার রফিকুল হক জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার ভূয়সি প্রশংসা করলেন এবং বেগম জিয়ার পক্ষে মামলা লড়ার জন্য সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন উপরে, দোতলায়। আমরা তো বসেই আছি। উনি আর দোতলা থেকে নামেন না। কিছু সময় পরে ক্লার্ক মারফত খবর পাঠালেন উনি টাকা ছাড়া মামলা লড়বেন না। আমরা কেউ-ই সঙ্গে করে টাকা নিয়ে যাইনি। শিমুল বিশ্বাস দ্রুত ছুটে বেড়িয়ে গেলেন। আমাদের বললেন- তোমরা বস। আধাঘণ্টা পরে শিমুল বিশ্বাস ফিরে এলেন সঙ্গে দু’লক্ষ টাকা নিয়ে। সেই টাকা পাঠানো হলো তারপর তিনি দোতলা থেকে নামলেন। আমার প্রাণপ্রতিম বন্ধু ও চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ব্যারিষ্টার মীর হেলালও তখন জেলে। হেলালের জন্যও আমাকে যেতে হতো ব্যারিষ্টার রফিকুল হকের চেম্বারে। সবমিলিয়ে আমি ৭/৮ বার গিয়েছিলাম রফিকুল হকের চেম্বারে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে একদিন জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন- অনেক ভালোমানুষ ও রাষ্ট্রনয়াক ছিলেন জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়ানের পর জিয়াউর রহমান একদিন ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন- আপনি তো শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমার সঙ্গে কি কাজ করবেন? রফিকুল হক বললেন- আমি তো আসলে একজন দর্জি। আমাকে যে যা বলবে আমি সেটাই তৈরি করে দেব। বঙ্গবন্ধু মুজিব কোর্ট চেয়েছিলেন তাকে মুজিব কোর্ট বানিয়ে দিয়েছি। আপনি যদি সাফারি চান আমি সাফারি বানিয়ে দেব। পকেট যদি দুটোর বদলে চারটা চান চারটা পকেট বানিয়ে দেব। জিয়াউর রহমান বললেন- আপনাকে ফি কত দিতে হবে। রফিকুল হক বললেন- দেশের কাজে আমি কোন ফি নেব না। জিয়াউর রহমান বললেন- ফি ছাড়া কাউকে দিয়ে আমি কোন কাজ করাই না। রফিকুল হক বললেন- আচ্ছা সে দেখা যাবে। ব্যাংকিং খাতের বহুকাজ জিয়াউর রহমান করালেন রফিকুল হককে দিয়ে। কাজ শেষে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন বলুন কত দিতে হবে আপনাকে। রফিকুল হক বললেন- আমাকে কিছু দিতে হবে না। তবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আমার শিশু হাসপাতালের জন্য কিছু অনুদান দিন। জিয়াউর রহমান তাকে ৫০ লক্ষ টাকা দিলেন। বেগম জিয়া ও আমার বন্ধু হেলালের মামলার জন্য আমি রফিকুল হকের চেম্বারে মোট ৭/৮ বার গিয়েছিলাম। শেখ হাসিনার মামলার জন্য তখন শুধু আমি বর্তমানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসকে শুধু ওনার চেম্বারে বসে থাকতে দেখেছি। আজ হয়তো আকাশ বাতাস সবই আওয়ামীলীগ। কিন্তু তখন শেখ হাসিনার মামলার জন্য তাপস ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। 

সবশেষে বলব জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি রাজনৈতিক দর্শন তিঁনি একটি বৈপ্লবিক চেতনা। তিঁনি একটি প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি ইতিহাস। তিঁনি যে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর জাজ্বল্যমান প্রমান তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আপামর জনসাধারণের যে ঢল নেমেছিল ১৯৮১ সালের ২ জুন। ২০ লক্ষ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন তাঁর শবানুগমনে। এটা একটি ইতিহাস। এই উপমহাদেশে কারো মৃত্যুতেই এমন মানুষের ঢল নামেনি। শুধু মহাত্মাগান্ধির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে হয়েছিল ২০ লক্ষ মানুষ। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ৫০ কোটি আর বাংলাদেশে মাত্র ১০ কোটি। নেহেরু যখন ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন তার শেষকৃত্যে মানুষ হয়েছিল ১৫ লক্ষ। আর রবীন্দ্রনাথের ৫ লক্ষ। এতেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষের কি পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। লেখাটি শেষ করবো ‘নয়াদিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের একটি স্মৃতিচারণ দিয়ে। তিঁনি লিখেছেন- জিয়াউর রহমান সিকিউরিটির নির্দেশিত পথে না চলে, সোজা গ্রামের মধ্যে চলে যেতেন। সাধারণ মানুষকে তাদের সুখ-দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। তাঁর কুষ্টিয়ার হাটার প্রোগ্রামের বছর দুই পর ওই এলাকায় আমাকে আবার একবার যেতে হয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো যে বাড়িটির ওপর দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন, তারা তাকে মনে রেখেছে কি না! সে বিষয়টা একটু জানা দরকার। গিয়ে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। সে বাড়ির যতোটুকু এলাকার ওপর তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন এবং যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন, তা বাশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে স্মৃতি হিসেবে। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৮৫)। এই হচ্ছে জিয়াউর রহমানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, যা কেউ কোনদিন কেড়ে নিতে পারবে না। 

  • লেখক গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী 

         barristershaifur@yahoo.com 


জিয়ার গণমাধ্যম নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি

---------------------------

এম আবদুল্লাহ

---------------------------


সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও স্বাধীনতা হরণের উপর্যুপরি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে তার গণমাধ্যম নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনার দাবি রাখে। জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ব্যক্তিগত আগ্রহেই তিনি এ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের শক্তি, ক্ষমতা ও গুরুত্ব তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নে গণমাধ্যম ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে প্রথমবারের মতো তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তখনই তিনি গণমাধ্যমের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সাম্যক ধারণা নেন। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুদূরপ্রসারি উন্নয়নের চিন্তা তার মাথায় আসে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার কারণে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য কী ভূমিকা রেখেছেন তা জানার আগে জানা দরকার তার দায়িত্বগ্রহণের আগে দেশে সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থা কেমন ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। আর বাকশালী শাসন নিষ্কণ্টক করার জন্য একই বছরের ১৬ জুন দেশে চারটি ছাড়া সব দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। সরকারি প্রচারপত্র হিসেবে রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় চারটি সংবাদপত্র রাখা হয়। দেশে তখন সব বেসরকারি সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সহস্রাধিক সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবী বেকারত্বের অভিশাপে নিমজ্জিত হন। জবরদস্তিমূলকভাবে তখন সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীকে বাকশালে যোগদানে বাধ্য করা হয়।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভাবনীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পাদপীঠে উঠে আসেন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পরই সাংবাদিকদের লেখার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করেন তিনি। জিয়াউর রহমান যখন বন্ধ করে দেয়া সব সংবাদপত্র চালুর ব্যবস্থা করেন তখন প্রবীণ সাংবাদিক ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘পাখা ভারী হয়ে গেছে, এত দিনের দলননীতির পর মুক্ত পাখা মেলে উড়তে কষ্ট হচ্ছে সাংবাদিকদের।’ নির্মল সেনের এ অনুভূতি প্রমাণ করে স্বাধীনতার পর কার্যত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ই প্রথম সাংবাদিকরা স্বাধীনতার স্বাদ পান।

দেশের উন্নয়নে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনুধাবন করেছিলেন বলেই শহীদ জিয়া সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে আপনারা জনমত গড়ে তুলুন, যা অবশ্যই সংগঠিত ও ব্যবহৃত হবে জাতীয় উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য। সবাইকে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, কেবল অনৈক্যের কারণে এ দেশ সুদীর্ঘ ২০০ বছর বিদেশী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষিত হয়েছে। কাজেই জাতীয় ঐক্যই কেবল আমাদের জীবনে আনতে পারে শক্তি, অগ্রগতি ও সুখ-শান্তি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এ আমাদের এক অবশ্য কর্তব্য। আমাদের বর্তমান উৎসর্গিত হোক ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য।’ (বিচিত্রা, ২৪ মার্চ ১৯৭৮ সংখ্যা)

প্রেসিডেন্ট জিয়া বিশ্বাস করতে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে তাতে দেশ, জাতি ও সরকার সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল-প্রশাসনযন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত ও গণমুখী করতে হলে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ১৯৮৭ সালের ৩০ নভেম্বর রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে জিয়াউর রহমান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে আমি দু-একটি কথা বলা দরকার মনে করছি। যারা বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের অনুরোধ করব তারা যেন দেশের অসংখ্য পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠাগুলোতে একবার চোখ বুলান। স্বাধীনতাকে প্রায় দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন কয়েকজন। তবু তারা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন বিনা বাধায়। শুধু তাই নয়, এদের অনেকেই পরোক্ষভাবে নানা রকম সরকারি সহায়তা দাবি করছেন এবং পাচ্ছেনও। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় সম্পূর্ণ বিশ্বাসী এবং সাংবাদিকদের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ আস্থাশীল। সাংবাদিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য এবং সাংবাদিকতার যথার্থ বিকাশ ও উন্নতির জন্য আমরা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’ (দৈনিক বাংলা, ১ ডিসেম্বর ১৯৭৮)

জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব কালাকানুন শিথিল করে দেশের সব জায়গা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা সরকারের দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি রাজশাহী থেকে ‘দৈনিক বার্তা’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকা ঘিরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। বহু সাংবাদিকের কর্মসংস্থান হয়।

শিশু-কিশোরদের নিয়ে গভীর ভাবনা ছিল শহীদ জিয়ার। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সমাজসচেতন করে গড়ে তুলতে ‘কিশোর বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন তিনি। পত্রিকাটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালের গোড়ায় তিনি ‘গণতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। পাশাপাশি দৈনিক জনপদও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জনপদ প্রকাশনায় আর্থিক অস্বচ্ছতা দেখা দিলে একই বছরের মধ্যভাগে রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক দেশ’। পত্রিকাটির নামকরণ করেন খোদ জিয়াউর রহমান। তিনি ইচ্ছা করলে নিজ মালিকানায় পত্রিকাটি প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি, ত্রুটি তুলে ধরার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। আবার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর ত্বরিত ব্যবস্থা নিতেন তিনি।

ডিক্লারেশনের শর্ত শিথিল করার কারণে সে সময় ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয়, জেলা এমনকি থানা পর্যায় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। এসব পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টননীতিও শিথিল করেন। বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বণ্টন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। একই সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বাকি ৪০ ভাগ মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সারা দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।

১৯৭২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) তৎকালীন সরকারের কাছে যে কয়েকটি মূল দাবি উত্থাপন করেছিল তার অন্যতম ছিল সাংবাদিকদের জন্য নতুন বেতন বোর্ড গঠন, প্রেস কমিশন গঠন এবং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল। পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে সাংবাদিকদের জন্য একটি বেতন বোর্ড গঠিত হয়। পরে আর কোনো সরকার নতুন বেতন বোর্ড গঠনের দাবিতে কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে একটি বেতন বোর্ড গঠিত হলেও তা ছিল অকার্যকর। রাষ্ট্রপতি জিয়া সংবাদপত্রসেবীদের বেতনভাতা নির্ধারণে ওয়েজ বোর্ড গঠন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বেতন বোর্ড পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ১৯৭৭ সালের পয়লা মে ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঘোষিত বেতন স্কেল বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইমপ্লিমেন্টেশন সেলও গঠন করে দেন। তিনি সাংবাদিক, মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করেন প্রেস কনসালটেটিভ কমিটি। এ কমিটির কাজ ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়গুলো দূর করা।

কথায় কথায় সাংবাদিকদের যাতে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে জেলে পুরতে না পারে সেজন্য জিয়াউর রহমান প্রেস কাউন্সিল গঠন করেন। সাংবাদিকদের আরেকটি দাবি ছিল প্রেস কমিশন গঠন। তিনি প্রেস কমিশন গঠনেরও উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে পদ্ধতিগত কার্যক্রম চলতে থাকে। বিভিন্ন জটিলতায় কমিশন গঠনের কাজ ধীরগতিতে চলছিল। সে কারণে জীবিত অবস্থায় প্রেস কমিশনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা তিনি দেখে যেতে পারেননি। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে একটি প্রেস কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট পেশ করার কথা ছিল। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আতাউর রহমান খান। সেই প্রেস কমিশনের রিপোর্ট আজো প্রকাশিত হয়নি।

রাষ্ট্রপতি জিয়া বুঝেছিলেন, মানসম্মত নির্মোহ সাংবাদিকতার জন্য সুশিক্ষিত সাংবাদিক প্রয়োজন। সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়ন ও তাদের সুষ্ঠুভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) প্রতিষ্ঠা করেন নিজে উদ্যোগী হয়ে। পেশায় বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মাধ্যমে এমনকি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে তিনি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালে ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নগরজীবনে আবাসন সঙ্কটে সাংবাদিকরা ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। স্বল্প আয়ের সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তিনি মিরপুরে ২২ বিঘা জমি সাংবাদিক সমবায় সমিতির নামে বরাদ্দ করেছিলেন। দেড় শতাধিক সাংবাদিকের সেখানে আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল।

সাংবাদিকদের মান মর্যাদার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া ছিলেন খুবই সচেতন। ১৯৭৬ সালে তোপখানা রোডে পুরনো লাল বিল্ডিংয়ে প্রেস ক্লাব ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের তোড়জোড় চলছিল। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ব্যবসায়ী প্রিন্স করিম আগা খান প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। ক্লাব ভবনের ভিত্তি স্থাপন করতে এসে জিয়াউর রহমান বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। সাংবাদিক নেতাদের ডেকে তিনি বলেন, প্রেস ক্লাব হচ্ছে একটি জাতীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এর উন্নয়ন মানে গণতন্ত্রের উন্নয়ন, সাংবাদিকতার প্রসার। অতএব, বিদেশী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অর্থানুকূল্যে এ প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মিত হওয়া উচিত নয়। তা হলে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা নির্মিত হবে আমাদের নিজস্ব টাকায়। তিনি জানালেন, প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের সব ব্যয়ভার গ্রহণ করবে সরকার। অচিরেই সরকারের খরচে নির্মিত হবে বর্তমান প্রেস ক্লাব ভবন। প্রেস ক্লাবে ঢুকতেই চোখে পড়বে জিয়ার নামাঙ্কিত ফলক। শুধু ভিত্তিস্থাপন ও অর্থানুকূল্য দিয়েই বসে থাকেননি। তিনি প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতিও পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ করেন। পরে বাস্তবে জিয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেস ক্লাব হয়ে ওঠে ‘গণতন্ত্র স্কোয়ার’।

প্রসঙ্গত, প্রেস ক্লাবের বর্তমান জায়গাটি ১৯৭৪ সালে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। প্রেস ক্লাবের জন্য শেখ মুজিব সরকার মাত্র এক বিঘা জায়গা বরাদ্দ করেছিলেন শিল্পকলা একাডেমির পাশে। এ সিদ্ধান্তে সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। কারণ বর্তমান প্রেস ক্লাবের স্থানটি ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন সরকার সাংবাদিকদের দিয়েছিল। বর্তমান জায়গাটি ফিরিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি জিয়া।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচার চালু করে টিভি মিডিয়ায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময়ই এ নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচারের সূচনা করেন। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দ্বিতীয় চ্যানেলটিও চালু হয়। তখন এই চ্যানেলে প্রভাতি অনুষ্ঠান চালু করেন। সার্বিক বিবেচনায় সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র শিল্পে অবদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

  • লেখক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।