Search

Wednesday, November 20, 2024

ফ্যাসিবাদের অপপ্রচারে আরো মহিমান্বিত তারেক রহমান



প্রায় দেড় যুগ আগের ১/১১-এর পটপরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটি ক্ষত, যে ক্ষত সময়ের প্রবহমানতায় জন্ম দিয়েছিল এক স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার।

বিশ্বের ইতিহাসে এমন দেশপ্রেমহীন স্বৈরাচারের নজির আর একটিও বোধ করি আর নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি এবং পরিতাপের বিষয় হলো— যারা ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই ওয়ান ইলেভেনের জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা সবচেয়ে ঘৃণিত। যাদের মধ্যে রিটায়ার্ড জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও রিটায়ার্ড লে. জে. মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা প্রায়শই ভুলে যান, বৃটিশদের শত ষড়যন্ত্রের পরেও নবাব সিরাজ-উদ দৌল্লাকে এখনো জাতির কাছে বীরতুল্য আর অপরদিকে মীর জাফর একটি ঘৃণ্য নাম।

বিগত ১/১১-এর কুশীলব কে বা কারা, এদের সহযোগী মিডিয়া পার্টনার এবং প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন করে তেমন কিছু বলবার নেই। কেননা সচেতনজন মাত্রই এই বিষয়ে কমবেশি ওয়াকিবহাল। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো— অনুমান করা যায় বিএনপি’র কিছু নেতৃত্বও জড়িত ছিলো যেটি প্রমাণিত হয় ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং শমসের মবিন চৌধুরীর মতন সুবিধাভোগীদের লজ্জাহীন কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে।

এছাড়া আরো অনেকেই এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন বলে সুস্পষ্ট অনুমান করা যায়। 

মোটাদাগে বললে, ২০০১ পরবর্তী জোট সরকারের সময়ে দেশের দু’টি প্রধান পত্রিকা ও পত্রিকা দু’টির আলোচিত সম্পাদকেরা যোগসাজশে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় মূলত তারেক রহমান বিরোধী অপপ্রচার শুরু হতে থাকে।

এই অপপ্রচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ার এবং প্রতিবেশী দেশের হাইকমিশন। 

বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিএনপি’র চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কখনোই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর খড়গহস্ত হননি। শুধু তাই নয় কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে যেসকল কার্টুনচিত্র আঁকতেন! সেগুলোকেও ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেন। কেননা তারেক রহমান পূর্বেও মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন— সমালোচনা হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। 

অদ্ভুত বিষয় হলো— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ারের অংশ কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী সময়ে আর কার্টুন বা ব্যাঙ্গচিত্র খুব একটা আঁকতে পারেননি; চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তার সন্তান সন্ততি তো দূরের বিষয়। 


২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে খুব একটা স্বস্তির ভেতর ছিলো না। দিল্লির ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয় এদেশের প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এই অস্বস্তিকে বাড়িয়ে তোলে বিএনপি’র কোনো কোনো সিনিয়র নেতার তারেক রহমান বিরোধী অবস্থান। এই বিরোধিতাকে অধিকতর স্পর্শকাতর করে তোলে কল্পিত হাওয়া ভবন ন্যারেটিভ।

মিডিয়ার সহায়তায় অনেকেই এই হাওয়া ভবন ন্যারেটিভকে সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে আর বিপত্তির শুরু হয় সেখানেই। 

অথচ ওয়ান ইলেভেনের পর দেশনেত্রী বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি গ্রহণযোগ্য দুর্নীতির মামলা দিতে পারেনি ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী অনির্বাচিত সরকার। কিন্তু তারেক রহমানের বিরুদ্ধে  গোয়েবলসীয় বচন তারা জারি রেখেছে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পতনের পূর্ব মুহুর্ত অব্দি।

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু বাস্তবতা হলো বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নামে দেশের বাইরে নামে বেনামে কোনো সম্পত্তি নেই। এমনকি টাকা পাচার কিংবা ব্যাংক লুটের সাথে তাদের  সংশ্লিষ্টতাও কেউ প্রমাণ তো দূরের কথা খুঁজে বের করতেও পারেননি। 

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য প্রমাণহীন বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত কথিত দুর্নীতি মামলার রায়ে সাজা না দেয়ায় বিচারক মোতাহার হোসেনকে হতে হয় দেশান্তরী।

প্রকৃত জাতীয়তাবাদীদের কাছে দেশ হলো মা ও মাটি। দেশ হলো জন্ম ও জন্মান্তরে তাদের শেষ গন্তব্য। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য পূর্বোক্ত কথাটি এক অমোঘ সত্য বলে বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টেমস নদীর তীরে নির্বাসনে থেকেও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ন্যায় বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাঁর দেড় দশকের নিরলস সংগ্রাম গত ৫ আগস্টের সফল বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইতোমধ্যেই আলোর মুখ দেখেছে। 

শুধু তাই নয় তারেক রহমানের বক্তব্য দিকদর্শী এবং সুস্পস্ট বক্তব্য দিনকে দিন যে বিষয়টিকে আলোয় এনেছে। সেটি হলো— তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রোপাগাণ্ডা ছিল, সেটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা এবং ওয়ান ইলেভেন ছিল— বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডার বাই প্রোডাক্টই শুধু নয় বরং ওয়ান ইলেভেন ছিলো দেশের স্বার্বভৌমত্ব হরণের সূচনা। 

অতি সম্প্রতি তারেক রহমান ৩১ দফার ওপর যে আলোকপাত করেছেন, সেটি ইতোমধ্যেই সুধীজনের সুদৃষ্টি কেড়েছে। 

যারা একসময় তাঁর বৈরী সমালোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই আজ বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে শুভাকাঙ্ক্ষী সুলভ প্রশংসা করছেন। 

এই বিষয়টি তারেক রহমান, বিএনপি ও বাংলাদেশ সকলের জন্যই ইতিবাচক ও ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগানিয়া বলেই বিবেচনা করি আমরা।

পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত দেড়যুগে বাংলাদেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক তারেক রহমানের মতো সৎ ও যোগ্য দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব।▫️


▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Wednesday, November 13, 2024

“পঁচিশ-মার্চ ১৯৭১ সাত-নভেম্বর ১৯৭৫ ত্রিশ-মে ১৯৮১”



১৯৭০ সাল সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন হবে কিন্তু হলো না। যা হয়েছিল তা কল্পনার অতীত ভোটের অধিকারকে দমন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তার স্বাধীন দেশের পূর্ব পাকিস্তানে নাগরিকদের ওপর রাতের অন্ধকারে নির্মম গণহত্যা শুরু করে। 

১৯৭১ সাল ২৫ মার্চ সেদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারে তারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসে।

ঢাকার ইপিআর সদরদপ্তর পিলখানায় থাকা ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার কয়েকটি স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা সদর দপ্তর। রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নীলক্ষেত ও দৈনিক ইত্তেফাকসহ প্রায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমণ করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়।

সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময় যা পরিনত হয় গণহত্যায়। 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজির জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থে তার বিশদভাবে বিবরণ পাওয়া যায়। 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান। 

মধ্য রাতে সেনা অভিযানের শুরুর আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাসায় তখনকার গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দীন আহমদ ডক্টর কামাল হোসেনসহ কয়েকজন গিয়েছেন স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো লিখিত বক্তব্য কিংবা অডিও বক্তব্য তৈরি করে নিতে কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি তিনি তা দেননি।

১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ মধ্য রাত পর্যন্ত সারাদেশে স্বাধীনতার আন্দোলন চুড়ান্ত দিকে ধাবিত হতে থাকে। বিশেষ করে ১ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রীকেট খেলা বন্ধ হয়ে যায়। শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। 

৩ মার্চ রঙিন “স্বাধীনতা পতাকা” উত্তলন করেন পল্টন ময়দান থেকে ছাত্র নেতা আ স ম রব। ৪ মার্চ স্বাধীনতা ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্র নেতা শাহজাহান সিরাজ।

৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে দেবেন। 

চারদিকে প্রচার হতে থাকলো তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। লাখ জনতা তার ভাষণ শুনতে চুটে আসেন সমাবেশ স্থলে। জনতা নেতার ভাষণ থেকে ৪ টি শর্তের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পাননি উৎসুক জনতা। এমন কি ঐ ভাষণ পরদিন পাকিস্তান বেতারে সম্পূর্ণ প্রচার করা হয়।

১৪ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টাে ঢাকায় আসেন। ১৫ মার্চ পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের ইয়াহিয়া খান আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টােসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বৈঠক শুরু। ২৪ মার্চ পর্য়ন্ত ধারাবাহিক বৈঠক চলে।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই বৈঠকের আড়ালে তারা তাদের লক্ষ্য স্থির রেখে অপারেশন সার্চ লাইট চুড়ান্ত করে।

২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকবাহিনীর গণহত্যা। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সকল আওয়ামী লীগ নেতারা পলায়ন পর। সাধারণ মানুষ দিকবিদিকশুন্য দিশেহারা। শহরে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে।

এরকম পরিস্থিতিতে নিজ কর্তব্য বোধ থেকে শির উঁচু করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে জাতি আকাঙ্খা পূর্ণে জীবন ও পরিবারবে উৎস্বর্গ করে প্রথমে “উই রিভল্ট” এরপর চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান “স্বাধীনতা” ঘোষণা করেন। “আমি মেজর জিয়া বলছি বাংলাদেশ স্বাধীনতা” ঘোষণা করছি।

মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তা জানজুয়ারসহ তার নিয়ন্ত্রণে সকালকে গ্রেপ্তার করেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার “জেড ফোর্স” এবং ১ নম্বর ও ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

রংপুর অঞ্চলে প্রথম ৫০০ বর্গ মাইল স্বাধীন ভূখন্ড ঘোষণা ও বেসরকারি প্রশাসনিক কাঠামো শুরু করেন করেন জিয়াউর রহমান।

দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

১৯৭১ সাল ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে বৃটেন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল।

১১ জানুয়ারি বাদ দিয়ে ১২ জানুয়ারি প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-কে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হোন।

এরপরে ইতিহাস অনেকই জানেন। দ্রুতই নাগরিকদের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ক্রমাগত দুঃস্বপ্নে পরিনত হতে থাকলো। 

দূর্নীতি, লুটপাট, হত্যা হামলা মামলা গ্রেপ্তার, ভোট কারচুপি, চারদিকে সীমাহীন অরাজকতা চলতে।

১৯৭৪ দুর্ভিক্ষে ভয়াবহ অবস্থা। একদলীয় শাসন বাকশাল শুরু। মানুষ দিশেহারা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পটপরিবর্তন।

৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি পূর্বে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ পটপরিবর্তন কিছুটা আলোকপাত দরকার।  বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থানে বিশাল পরিবর্তন আসে। বছরটি ছিল ১৯৭৫ সাল। এই বছরের আগস্টের ১৫ তারিখ এক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।

আগস্টের ১৫ তারিখে পটপরিবর্তনে বাংলাদেশের রেডিও থেকে মেজর ডালিম ঘোষণা করেছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন।

৭৫’-এর পটপরিবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তন ঘটেছে।

এই উপ-ভারতবর্ষে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে বান ডাকে। যখন নদীর বান ডাকা স্তিমিত হয়ে আসে, তখন নদীর এক পাড় ভাঙে অন্য পাড়ে পলি জমা হয়ে নতুন ভূমি সৃষ্টি হয়।

এ কারণেই হয়তো ভাবুক কবি গান রচনা করেছিলেন, নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের রাজনীতিও নদীর মতোই।

৭৫’-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন ঘটে, তা কি নিছক নদী ভাঙনের সঙ্গে তুলনীয়?  এ পরিবর্তনটি ঐতিহাসিক ভাবে উপমায় অনেকটাই ব্রহ্মপুত্র নদীর খাত পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনীয়।

১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদের পুরোনো খাতটি ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। ব্রহ্মপুত্রের খাত পরিবর্তনের ফলে ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের অংশটি মৃত্যুবরণ করে।

এতে পানির প্রবাহ শূন্যের কোঠায় চলে যায় এবং নদীটির নামকরণ করা হয় পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। নিঃসন্দেহে ব্রহ্মপুত্র নদের খাত পরিবর্তন শক্তিশালী ভূমিকম্প না হলে হতো না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের মতোই বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।

১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ফলে ‘এক নেতা এক দেশ’ স্লোগানের মৃত্যু ঘটে।  

প্রায় তিন মাসের মাথায় ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ সামরিক ক্যু’র ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগতদের নিয়ে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান-কে বন্দি করা হয়।


ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজে নিজেই মেজর জেনারেলে উন্নীত হন এবং সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব মেজর জেনারেলের র‌্যাংকব্যাজ পরিয়ে দেন।

প্রায় একই সময়ে বঙ্গভবনে বসে খালেদ মোশাররফ প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের কাছ থেকে টেলিফোনে জানতে পারেন, তার মা ও ভাই আওয়ামী লীগের মিছিলে যোগ দিয়েছেন। এতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বলতে থাকেন, আমার মা ও ভাই আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। সেই সময় জনগণের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল দেশদ্রোহীর দল। 

সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। তিনি দেশবাসীকে জানান, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এতেও খালেদ মোশাররফের শেষ রক্ষা হয়নি।

৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টে জওয়ানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা দলে দলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে।

রাজপথে ট্যাংক ও কামানসজ্জিত হয়ে বিদ্রোহী সিপাহিরা বিপ্লবের স্লোগান দিতে থাকে।

তারা স্লোগান দিচ্ছিল, "সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ-জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ-বাংলাদেশ জিন্দাবাদ"। রাজপথে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সিপাহি বিপ্লবের সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করে। এ অভ্যুত্থানকে চিহ্নিত করা হলো! সিপাহি-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি" রূপে।

জিয়াউর রহমান-কে খালেদ মোশাররফ-এর বন্দিশালা থেকে সৈনিকরা মুক্ত করে আনল।

সূচিত হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়। 

জিয়াউর রহমান বন্দি হয়েছেন জেনে সাধারণ মানুষ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

অনেকে দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। আসলে উৎকণ্ঠায় ভোগার ফলে সাধারণ মানুষ খাবার গিলতে পারছিল না। সর্বোপরি ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো রকমের সরকার আছে কিনা, তা নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠায় পড়ে গেল সাধারণ মানুষ। 

এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন। দেশকে তারা কত ভালোবাসেন।

সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে জাতির উদ্দেশে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তিনি জনগণের প্রতি শান্ত থাকার আহবান জানালেন। সেনাবাহিনী আপনাদের পাশে আছে। আপনারা নিজ নিজ কাজে যোগদান করুন আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

জিয়াউর রহমান সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে সিপাহিদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হলেন। সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে এলো। জিয়াউর রহমান যদি সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা উদ্ধারে সফল না হতেন, তাহলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যেত।

৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এই দিন বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র শপথ গ্রহণ করে। জিয়াউর রহমান-এর মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বের ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। 

বিশ্ব দরবারে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়।

"১৯-দফা" কর্মসূচী'র মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।

জিয়াউর রহমান দেশের নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক, শিশু ও প্রৌঢ়সহ সব মানুষকে নিয়ে জাতি গঠনের মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। তলাবিহীন ঝুড়ি রাষ্ট্রের বদনাম গুছিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশ নির্মাণ করেন। তার নিখুঁত দেশপ্রেম ও জাতি গঠনে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য জিয়াউর রহমান যুগ-যুগান্তরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই নিয়ে আছেন ও থাকবেন।

জিয়াউর রহমান-এর দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রয়াস আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র গোষ্ঠী মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, ফলে তাদের চক্রান্তের মধ্যে দিয়ে জিয়াউর রহমান ১৯৮১-এর ৩০ মে একদল বিপদগামী সামরিক অফিসারের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তিনি শহীদ হোন। 

থমকে দাঁড়ায় স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয়। এই গৌরবোজ্জ্বল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক দল ও শক্তি  বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যার প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। 

তার রাজনৈতিক ও আর্দশিক উত্তরসূরী আমরা কোটি কোটি জনতা। রক্তের ও রাজনৈতিক এবং আর্দশিক উত্তরসূরী বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২০২৪ আগস্ট পট-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তার নেতৃত্বে "উন্নত ও কল্যাণ বাংলাদেশ" গড়ে উঠবে। 


লেখক: শায়রুল কবির খান

সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, সদস্য বিএনপি চেয়ারপার্সন প্রেস উইং ও বিএনপি মিডিয়া।


দিনকাল/ ১৩ নভেম্বর ২০২৪

A new dawn for Bangladesh's agriculture




Agriculture, the bedrock of Bangladesh's economy, has historically supported millions of households, shaped rural communities, and nourished the population. Yet, despite its foundational role, the agricultural sector has long been plagued by neglect, climate vulnerability, and economic challenges. Against this backdrop, Tarique Rahman and the Bangladesh Nationalist Party (BNP) have introduced a bold vision to reinvigorate Bangladesh's agricultural landscape. As we examine this ambitious plan, we must consider both its transformative potential and the practical challenges it may face.

One of the foundations of Tarique Rahman's vision is a nationwide agricultural insurance program. Crop insurance is a timely intervention given the growing impact of climate change on Bangladesh's predominantly rural communities. In a country frequently struck by floods, cyclones, and other natural disasters, insurance could offer a safety net, shielding farmers from debt and poverty cycles. Similar initiatives have proven effective elsewhere; for instance, India's Pradhan Mantri Fasal Bima Yojana (PMFBY) offers coverage to over 50 million farmers, cushioning them against crop losses and motivating them to reinvest in their fields.

Rahman's vision would similarly provide insurance for small and medium-sized farmers in Bangladesh, helping them withstand crop failures due to floods, droughts, and storms. As Norman Borlaug, the renowned agriculturist and "father of the Green Revolution," famously said, "Food is the moral right of all who are born into this world." Rahman's proposal to protect farmers with insurance aligns with this idea, recognizing that agriculture should be a source of stability, not volatility. 

Equally significant in Rahman's vision is the revival of Bangladesh's canal-digging initiative, which had been previously undertaken during Shaheed Zia's tenure. Revitalizing this program addresses a fundamental need: water. In recent decades, Bangladesh's water table has dropped alarmingly, threatening agricultural productivity. Rahman's canal program aims to harness monsoon rains, channeling them into reservoirs and providing much-needed irrigation during dry seasons. This idea reverberates with China's water management practices, where advanced irrigation and water recycling have transformed arid land into productive farmland. China's agriculture is a powerful case of doing more with less; Rahman's canal-digging plan, if executed effectively, could turn Bangladesh's water scarcity into a managed resource, maximizing yield and potentially allowing for multiple crop cycles each year.

A related and essential aspect of this vision is efficient water management. Agriculture accounts for 90% of Bangladesh's freshwater use, yet most farmers lack knowledge of optimal irrigation techniques. Rahman's vision emphasizes educating farmers on the importance of controlled water usage to prevent wastage and enhance crop resilience. Dr. M.S. Swaminathan, one of India's foremost agricultural scientists, has observed, "In an era of climate change, water conservation in agriculture is no longer an option but a necessity." Rahman's approach advocates for sensible water management practices, but the challenge lies in execution. Effective farmer education programs, perhaps modeled after the Agricultural Extension programs in the United States, could help spread knowledge and ensure these techniques are adopted on a wide scale.

Another innovative proposal is Rahman's idea to establish crop-specific cold storage facilities in key agricultural zones. Every year, significant portions of Bangladesh's perishable crops-especially vegetables like onions, potatoes, and tomatoes-are lost due to inadequate storage facilities. This loss not only reduces farmers' incomes but also destabilizes market prices. By creating a cold storage network, Bangladesh could follow in the footsteps of countries like the Netherlands, where robust storage infrastructure supports food security and enables exports. The Netherlands' agro-processing capabilities allow it to be a leading exporter of vegetables despite limited land area. If Bangladesh could harness its own cold storage infrastructure, it might stabilize prices, reduce imports, and even consider exporting select produce, contributing to economic resilience.

Yet, cold storage facilities are only one part of Rahman's broader vision to diversify Bangladeshi agriculture. While rice and jute remain dominant, Rahman envisions an agricultural sector that includes vegetables, fish, livestock, and poultry production. He notes that agriculture is more than traditional crop cultivation-it is the backbone of food security and rural income. A diversified agricultural system could strengthen Bangladesh's food self-sufficiency, reducing reliance on imports and building resilience against market fluctuations. The United States' "Farm to Fork" strategy is an example of agricultural diversity bolstering food security, enabling the U.S. to be a net food exporter. If Rahman's plan for agricultural diversification takes hold, Bangladesh might similarly boost both food security and economic opportunity for rural communities.

Perhaps the most revolutionary element in Rahman's plan is his proposal for fair crop pricing. He envisions government procurement centers at the union level, designed to eliminate middlemen and ensure farmers receive fair value for their produce. This model echoes India's Minimum Support Price (MSP) system, which safeguards farmers against price volatility. Rahman's pricing model would need to be carefully managed to avoid unintended consequences. Ensuring fair pricing across diverse crops could help farmers achieve a stable income and incentivize them to expand their cultivation beyond rice and jute.

Finally, Rahman's ambition to increase the national agricultural budget to 8% of GDP demonstrates a commitment to long-term investment. This funding would be directed toward improving access to fertilizers, farm machinery, and training programs, especially for small and medium-sized farmers. In contrast to Bangladesh, countries like South Korea have heavily invested in agricultural mechanization, which has increased efficiency and reduced labor costs. If Bangladesh were to adopt similar practices, the 8% budget allocation could modernize its agricultural infrastructure, attracting the next generation of farmers and fostering a more sustainable, productive industry.

Yet, while Rahman's vision presents a promising framework, it also raises critical questions about execution. Agricultural reform is complex, requiring not only well-crafted policies but also strong administrative capacity. Implementing these ambitious changes would require close collaboration between government agencies, local communities, and private partners. Without an effective implementation plan, even the most visionary proposals risk falling short. Corruption, inefficiency, and bureaucratic delays remain significant obstacles in Bangladesh's public sector, and unless these are addressed, farmers may not see the promised benefits. Rahman's approach, though innovative, will need to account for these administrative realities.

Tarique Rahman's vision for Bangladesh's agricultural sector is a thoughtful and ambitious plan, one that addresses key challenges while proposing novel solutions.  As John F. Kennedy said, "The farmer is the only man in our economy who buys everything at retail, sells everything at wholesale, and pays the freight both ways." For Bangladesh's farmers, Rahman's vision could be the shift they have long awaited-if implemented with the dedication it deserves.

---

HM Nazmul Alam 

The writer is Lecturer, Department of English and Modern Languages, International University of Business, Agriculture and Technology. 


source - https://www.observerbd.com/news/498963

13 November, 2024. 

Sunday, November 3, 2024

তরুন প্রজস্ম এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব


বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৫ বয়সী কিশোর-কিশোরী এবং তরুন-তরুনীর সংখ্যা  তিন কোটির ঘরে, যা জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। ছাত্র-জনতার জুলাই ‘২৪ বিপ্লবের মাধ্যদিয়ে এরা আমাদের সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অর্জন করছে। অকুতোভয় আন্দোলনকারীরা বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছে; হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি, নির্যাতন-গুম তাদেরকে লক্ষ্যথেকে বিচ্যুত করতে পরেনি। পকেটে নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম লেখা কাগজ নিয়ে রাস্তায় নেমেছে - এদের  অনেকে ঘরে ফিরে আসেনি। তদের সংকল্প এবং আত্নত্যাগ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলন শেখ হাসিনার রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনটি দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন, গনতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র গঠনের ধারায় ফিরিয়ে এনেছে। দিবস তিনটি হলো ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯০ এবং ৫ই আগষ্ট ২০২৪। ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য  আমরা প্রবীনরা যেভাবে উপলব্ধি করতে পরি, আজকের তরুন প্রজন্মের জন্য তা সহজ নয়। তাদের জন্ম ২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যে এবং ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর দূর অতীতের কথা।  আশার কথা আমাদের কিশোর এবং তরুনেরা অনেক তথ্য, উপাত্ত নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারের চেষ্টা করে।  তা না হলে মুজিবময় পাঠ্যপুস্তক, শপথ বাক্য আর আওয়ামী লীগ সরকারের মুজিব বন্দনার বিপরীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠত না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রতিনিয়ত তারুন্যে সংস্পর্শে আসতে হয়।  তাদের সচেতনতা, চিন্তার গভীরতা এবং নতুন কিছু গড়ার আকাক্ষা প্রতিনিয়ত চমকিত করে।  এদের মাঝেই বেঁচে থাকবে আমাদের ইতিহাস, অর্জন এবং গৌরব। তাদের কথা বিবেচনায় ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এর অপরিহার্যতা নিয়ে আমার আজকের উপস্থাপনা।  আমার আশা এ লোখাটি তরুনদের ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব নিয়ে আরও জানার আগ্রহ তৈরি করবে এবং তাদের মাঝে এই বিপ্লবের ভাবাদর্শ জীবিত থাকবে। 

৭ই নভেম্বরের পটভূমি রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে।  ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই ক্রান্তিকালে ২৬শে মার্চ বিহ্বল জাতী মেজর জিয়াউর রহমানের চট্রগ্রাম রেডিও ষ্টেশন থেকে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনায় সম্বিত খুজে পায়।  অথচ ফ্যাসিন্ট শেখ হাসিনার সরকার যেকোনো ছুতায় জিয়াউর রহমানের মর্যাদাহানিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি, চক্ষু লজ্জারও ধার ধারেনি। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আদালতের রায়ের আড়ালে মেজর জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে।

অথচ ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী পীড়াপীড়ি করেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আদায় করতে পারেননি। সে সময়কার যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করবেন তারা জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছেন এবং সেটাই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা  স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে প্রথম কে কখন পাঠ করেছে, তার বিতর্কে যদি না-ও যাই, আমাদের মানতে হবে জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব ছিল। এটা কেবল আহ্বান নয়, ইতোমধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দেওয়া বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার ঘোষণা। জনগণ নিশ্চিত হয় প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনায়। আর জিয়াউর রহমান ২৫ থেকে ২৬ মাঝরাতে বিদ্রোহ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার ও সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার না করলে ভাষণ দেওয়ার জন্য রেডিও স্টেশন থাকত না।

জিয়াউর রহমানের এই ভাষণের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। একজন অপরিচিত সামরিক কর্মকর্তা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সবার পরিচিত ও সম্মানিত। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে ঈর্ষণীয়। ঠিক একই কারণে এবং কাছাকাছি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের জিয়ার ভাষণ দেশকে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনে।

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সরকার এমন কী করেছিল যে স্বাধীতার চার বছরের মাথায় দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়? স্বল্প পরিসরে স্বাধীনতা-উত্তর ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী দুঃশাসন বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য কাজ। এর কদর্যতা ব্যাপক বিস্তৃত ও ভয়ংকর। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হলেও তিনি ছিলেন প্রথমত তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের রক্ষক এবং দলের প্রতিপালক ও প্রশ্রয়দাতা। তিনি জনগণের বন্ধু হতে পারেননি অথবা হতে চাননি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে খাদ্যশস্য ও আর্থিক সাহায্য এসেছিল, ৭২ থেকে ৭৫ সালের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশের অসহায়-অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ আত্মসাৎ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় চোরাকারবারি, কালোবাজারি ও মজুতকারীতে দেশ ছেয়ে যায়। চালের সংকট এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে দুবেলা ভাত খাওয়া বিলাসিতায় পরিণত হয়। ’৭২ থেকে ৭৪ সালের খরা ও বন্যা আমলে নিলেও আমাদের দুবেলা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য ছিল, তবু ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে সারা দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মারা যায় এক লাখের বেশি মানুষ। যারা এখনও ওই দুর্ভিক্ষের জন্য শেখ মুজিবের ব্যর্থতা মানতে চান না, তাদের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের গবেষণা পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে উপসংহার টেনেছেন যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।

দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে তিনবার মাঠে নামান। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে অপরাধীদের ধরলেও আওয়ামী নেতা এবং সর্বোপরি শেখ মুজিবের সুপারিশে চিহ্নিত অপরাধীরাও ছাড়া পেয়ে যায়। খুনের মামলার আসামিরাও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতো। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার বদলে তিনি তৈরি করেন লাল বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মতো মিলিশিয়া বাহিনী, যাদের কাজ ছিল প্রতিবাদী, সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গুম-খুনের মাধ্যমে নিস্তব্ধ করা। রক্ষীবাহিনী ছিল মুজিব বাহিনীর উত্তরসূরি এবং তৈরি করা হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দাদের তত্ত্বাবধানে। বিতর্কিত মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তৈরি করা হয়, যা বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডের বাইরে ছিল।

মুজিব বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করা। রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা ভারতের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে সাভারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেজর রেড্ডি নামক একজন ভারতীয়র তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ পেত। ভারত বাংলাদেশে বারবার একই ভুল করেছে, দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা আমলে না নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। রক্ষীবাহিনী ছিল জনমনে আতঙ্কের প্রতীক এবং সেনাবাহিনীর অসন্তোষের কারণ। রক্ষীবাহিনীর অপকর্ম এত ব্যাপক হয়েছিল যে তাদের দায়মুক্তি দিয়ে শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে আইন পাস করেন। ৩৪ বছর পর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন র‌্যাব দিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মতো গৌরবজনক ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তাও শপথ ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার জনবিরোধী কাজে শরিক হয়েছিলেন।

ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বোত সাহায্য করেছে, এটি অনস্বীকার্য। ১২ হজারের মতো ভারতীয় সেনাসদস্য আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ মূলত ভারতের খাদ্য সহায়তায় বেঁচে ছিল। এ সত্ত্বেও ভারতের অভিপ্রায় ও আচরণ দেখে প্রবাসী সরকার ও মুক্তি বাহিনীর মাঝে অস্বস্তি শুরু হয় ১৯৭১ সাল থেকেই, যা দূর হওয়ার বদলে আরও ঘনীভূত হয়। তখন মওলানা ভাসানী এক বিখ্যাত উক্তি বলেছিলেন, ‘পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়’। ১৬ ডিসেম্বর পকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী ও প্রবাসী সরকারকে দূরে রাখা হয়। আত্মসমর্পণকারি পাকিস্তানি বাহিনীর সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যায়। কিছু লুটতরাজেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তিকে জনগণ সন্দেহের চোখে দেখে। এই চুক্তির একটি ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোলোযোগে ভারতকে হস্তক্ষেপের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি শেখ মুজিবের দুঃশাসন যত দীর্ঘায়িত হতে থাকে, জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ তত দানা বাঁধতে থাকে।

শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে এবং চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। জনগণকে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখানো শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেন। সব সমালোচনা ঝেড়ে ফেলে পুরোদস্তুর ফ্যাসিস্ট শাসক বনে যান। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এরপর বুলেট ছাড়া আপনাকে সরানোর কোনো উপায় থাকল না।’

মুজিব শাসনের ব্যর্থতা এতটা প্রকট হতে থাকে যে দেশের মানুষের স্বাধীনতার আনন্দ ফিকে হতে হতে বিলীন হয়ে যায়। অভাব, দুঃশাসন, দুর্নীতি, অরাজকতা ও জুলুমে জর্জরিত জনগণ মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। এমন পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় ক্ষুব্ধ মেজর শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে। শেখ মুজিবকে হত্যা ছিল একটি coup d’état (ক্যু দেঁতা), যার কাছাকাছি পরিশব্দ অভ্যুত্থান। এর অর্থ হঠাৎ বল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি ছোট গোষ্ঠী দ্বারা কোনো সরকারপ্রধানকে উৎখাত করা। বিপ্লব হয় তখন, যখন আপামর জনসাধারণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ধরনে পরিবর্তন আনে। যেমন ছাত্র-জনতার জুলাই ২০২৪ আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন একটা সফল বিপ্লব। একইভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা দেশকে অরাজকতার হাত থেকে উদ্ধার করা সফল বিপ্লব।

শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে একটা অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান থাকলেও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজররা খন্দকার মোশতাকের হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করে। সব বাহিনীর প্রধানরা খন্দকার মোশতাকের আনুগত্য স্বীকার করেন, সংসদ বলবৎ থাকে এবং নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। নতুন মন্ত্রীদের অধিকাংশই শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক ও মেজর রশীদ সব সিদ্ধান্ত দিতেন। বঙ্গভবন পাহারায় ফারুকের ট্যাংক বাহিনী নিয়োজিত থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আগস্টের শেষে জাতীয় চার নেতাকে কারান্তরীণ করা হয়। 

সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করা হয়। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ বীর উত্তমের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। সফিউল্লাহ কোনো দিনই যোগ্য অথবা বলিষ্ঠ সেনাপ্রধান ছিলেন না। জিয়াউর রহমানের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও শুধু শেখ মুজিবের আনুগত্যের কারণে এবং জেনারেল ওসমানীর প্রিয়ভাজন হওয়ায় সফিউল্লাহ সেনাপ্রধান হন। একটি বিতর্কিত পদায়ন হয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে দিল্লিতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তিন জন সিনিয়র অফিসার ডিঙিয়ে উপ-সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয় এবং মেজর জেনারেলে উন্নীত করা হয়। মাত্র এক বছর আগেই সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তাকে এভাবেই প্রশিক্ষণে থাকা আবস্থায় কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলে পদোন্নতি দেন। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের সঙ্গে এরশাদের সক্ষ্য এবং তাদের প্রতি আসকারা সেনাবাহিনীতে সর্বজনবিদিত।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশারফ বীর উত্তমের পদপদবি অপরিবর্তিত থাকে। সফিউল্লাহ ও খালেদ মোশারফের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগ সর্বাধিক ছিল। সফিউল্লাহর পরবর্তীতে সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন লালন করছিলেন খালেদ মোশাররফ। শেখ মুজিব জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে খালেদ মোশাররফ মনক্ষুণ্ন ছিলেন।

সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জিয়াউর রহমানের মতো যোগ্য অফিসার সে মুহূর্তে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। কিন্তু তার যোগ্যতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও জনপ্রিয়তা অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের উদ্বেগের বিষয় ছিল। এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে সেনাপ্রধানের ওপর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদ তৈরি করা হয় এবং মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তারও ওপরে জেনারেল ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা সীমিত করে দেওয়া হয়। প্রকারান্তরে অভ্যুত্থানে জড়িত ওসমানী ও খলিলুর রহমান গং সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতে থাকে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার জিয়াউর রহমানের সম্মানহানি এবং তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে এতটাই মনোযোগী ছিল যে অনেক সত্য ঘটনা জনগণের কাছে অজানা থেকে গেছে। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড মেজর ফারুক সম্পর্কে খালেদ মোশাররফের ভাগ্নে এবং তার ছত্রচ্ছায়ায় ঢাকা সেনানিবাসে দম্ভের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। তার চেয়েও ভয়ংকর কথা হলো, ১৯৭৩ সালে তিনি অভ্যুত্থানচেষ্টা করে ব্যর্থ হন, যা সেনাবাহিনী জ্ঞাত ছিল। তবু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং মিসর থেকে উপহার পাওয়া নতুন ৩২টি ট্যাংক তার হাতেই ন্যাস্ত করা হয়। মেজর ফারুকের ট্যাংক বাহিনী সরাসরি সেনাপ্রধানের কমান্ডে ছিল। অপরদিকে অভ্যুত্থানে মেজর ফারুকের প্রধান সহযোগী মেজর রশীদ সম্পর্কে ফারুকের ভায়রা ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে তার পোস্টিং নিয়মিতভাবে যশোরে হয়েছিল। কিন্তু ফারুক খালেদ মোশাররফকে ধরে রশীদের পোস্টিং বাতিল করে ঢাকায় রাখার বন্দোবস্ত করেন। 

শেখ মুজিব নিহত হওয়ার ঘটনা জনগণ একরকম মেনে নেয়। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ অথবা প্রতিরোধ করতে বের হননি। মজলুমের ওপর জুলুমবাজ রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, যুবলীগ, ছাত্রলীগ–এদের কাউকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি, ভোজবাজির মতো উধাও হয়েছিল। অথচ তখনো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। অত্যাচারী-জালেমদের হম্বীতম্বী সব সময়  অসহায়, দুর্বল মানুষের সঙ্গে হয়। শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলে পলায়নপরতা তাদের একমাত্র গত্যন্তর। গত ৫ আগস্ট আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন গণপলায়ন দুবারই হয়েছে, শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উৎপাটিত হওয়ার পর। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর অবস্থা এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে পরবর্তী দিনগুলোতে ১৪৪ ধারা জারি করারও প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়নি। উল্টো জনগণের মাঝে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। এক দিনের ব্যবধানে চাল কেজিপ্রতি ৭ টাকা থেকে ৪ টাকায় নেমে আসে। অধিকাংশ চোরাকারবারি, মজুতদার ও অপরাধীরা গা ঢাকা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে চলতে থাকে চাপা অস্বস্তি।

জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একমাত্র ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম প্রকাশ্যে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ এবং অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিরোধিতা করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে সোচ্চার ছিলেন। শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন এবং তার অধীনে মেজর রশীদের অভ্যুত্থানে জড়িত হওয়া তার জন্য গ্লানিকর ছিল। শাফায়াত জামিল বেশ কয়েকবার জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের বঙ্গভবন থেকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনতে উদ্বুদ্ধ করেন। জিয়াউর রহমান এ বিষয়ে তাড়াহুড়োর পক্ষপাতী ছিলেন না। উপরন্তু জিয়াউর রহমানের ওপর দুটি পদ তৈরি করে তাকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে অবশিষ্ট শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এখানে মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনীতে কেউই চেইন অব কমান্ডের বাইরে নয়, স্বয়ং সেনাপ্রধানসহ। সেনাপ্রধানকেও দেশের গঠন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী হয় রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আদেশ মানতে হয়। স্বউদ্যোগে কোনো কিছু করার স্বাধীনতা থাকে না। খন্দকার মোশতাকের সময়কালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ খলিলুর রহমানের নির্দেশ মেনে চলতে হতো। জিয়ারউর রহমান শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে নিজেকে জড়াবেন না বুঝতে পেরে শাফায়াত জামিল খালেদ মোশাররফের মতামত জানার চেষ্টা করেন। খালেদ মোশাররফ তার সম্মতি জানিয়ে দেন।

২ অথবা ৩ নভেম্বর মাঝরাতে শাফায়াত জামিল তার অধীনে পদাতিক বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন। প্রথমেই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে তার ঘরে অন্তরীণ করা হয়। রেডিও-টিভি স্টেশন দখল করা হয়, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিছিন্ন করা হয়। বঙ্গভবন পাহারায় নিয়োজিত ইউনিটকে সেনানিবাসে ফেরত আনা হয়। এরপর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণ নেন। রাষ্ট্রপতি ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য সারা দিন যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার সশব্দে বঙ্গভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকে। খালেদ মোশাররফ মেজরদের সেনানিবাসে ফেরত আসার নির্দেশ দেন। সারা দিনের উত্তপ্ত বাদানুবাদ শেষে মেজর মহিউদ্দিন ছাড়া বাকি ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় পরিবারসহ থাইল্যান্ডে চলে যায়। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করা হয়। 

৪ নভেম্বর সকালে একটি মর্মান্তিক খবর খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল জানতে পারেন; ২ বা ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও মেজর রশীদের অনুমতিক্রমে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল উভয়ে খন্দকার মোশতাক ও অভ্যুত্থানে জড়িত মেজরদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু ততক্ষণে মেজররা থাইল্যান্ড পৌঁছে গেছে। পরে জানা যায়, অভ্যুত্থানে জড়িতরা আগেই ঠিক করে রেখেছিল সেনাবাহিনী থেকে পাল্টা অভ্যুত্থান হলে স্বংক্রীয়ভাবে চার নেতাকে হত্যা করা হবে। তাদের ভয় ছিল চার নেতার যেকোনো একজনের আহ্বানে ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বেলা বাড়তে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে তার দাবি নিয়ে উপস্থিত হন। জিয়াউর রহমানের পরিবর্তে নিজে সেনাপ্রধান হতে অভিপ্রায় প্রকাশ করেন এবং খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখে মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান। আলোচনা সারা দিন ধরে চলতে থাকে। এর মাঝে শাফায়াত জামিল টের পাওয়া শুরু করেন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ রেখে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়ার চেষ্টা সাধারণ সিপাহীরা ভলো চোখে দেখেছে না এবং তাদের মাঝে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। শাফায়াত জামিল অধৈর্য হয়ে সেনানিবাস থেকে বঙ্গভবনে গমন করেন এবং মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে সশস্ত্র প্রবেশ করেন। ভীত খন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি দেন এবং সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। খন্দকার মোশতাক পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিপরিষদের মিটিং থেকেই চার মন্ত্রীকে আটক করা হয়। ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি সংসদ ভেঙে দেন।

এত কিছুর পরও খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিল তাদের অভ্যুত্থান টিকিয়ে রাখতে পারেননি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে যে আলোচনা আসে, তা তাদের জন্য অসম্মানজনক। তারা দুজনেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা অনুচিত। রক্তপাত এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা তাদের মাঝে দেখা যায়। তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পারিপার্শ্বিক কারণগুলো আলোচনা করা উচিত, তাদের ব্যক্তিত্বে কালিমা লেপন না করে।

৩ নভেম্বর থেকে রেডিও-টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিল না। সেনানিবাস ও বঙ্গভবনে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সাধারণ জনগণ এমনকি সেনাবাহিনী অন্ধকারে ছিল। অনিশ্চয়তা ও ভারতীয় আগ্রাসনের ভীতির মাঝে জনতার দিন কাটছিল। তার ওপর সেনাবাহিনীর মধ্যে ধারণা তৈরি হয় খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি এবং তিনি ভারতের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনর্বাসিত করবেন। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ হিসেবে কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ব্যাপক প্রচারণাকে দায়ী করা হয়। কাকতালীয় অথবা নিয়তির পরিহাস হলেও এ সময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা খালেদ মোশাররফের উদ্দেশ্য নিয়ে সিপাহী-জনতার মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়। কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ সিপাহীদের নজরে পড়ে। তার ওপর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের একটি মিছিল বের হয় শেখ মুজিব ও চার নেতা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে। মিছিলটি পলাশী থেকে শুরু হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেষ হয়। তারা এই দাবিতে পরের দিন হরতাল ডাকে। এ মিছিলের সম্মুখে ছিলেন খালেদ মোশাররফের মা ও বড় ভাই রাশেদ মোশাররফ, তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। এমন নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মিছিল ও নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের পরিবারের সদস্য, এই ছবি ৫ নভেম্বর প্রতিটা পত্রিকার প্রথম পাতায় খালেদ মোশাররফের র‌্যাংক পরিধানের ছবির নিচে ছাপা হয়েছিল। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধানের পরিবারের সদস্যরা যদি পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর দাবিতে মিছিল করে, তাহলে জনমনে কী ধারণা তৈরি হবে?

আরেকটি ঘটনা ঘটে সেনানিবাসের প্রধান প্রবেশপথে। ৪ নভেম্বর ভারতীয় দুতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা এসে উপস্থিত হন এবং খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে চান। খালেদ মোশারফ সেনানিবাসে অনুপস্থিত থাকায় ব্রিগেডিয়ার ভোরা খালেদ মোশারফের জন্য একটি উপহার বাক্স রেখে যান। এমনিতেই সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তার ওপর এসব ঘটনা সিপাহী-জনতার মনে সন্দেহ ঘনীভূত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা সময়ের আলোচনা করছি, যখন জনগণ ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে এবং ভারতবিদ্বেষ স্মরণকলের মধ্যে তীব্র।

খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল দুজনেই সেনাবাহিনীতে তাদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে ছিলেন। শাফায়াত জামিলের ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ বিগ্রেডের মাত্র তিনটি ইউনিট তাদের সমর্থন করছিল। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল পরস্পরের মাঝে অবিশ্বাস দেখা দেয়। শাফায়াত জামিলকে না জানিয়ে খালেদ মোশাররফ ১০ম বেঙ্গলকে রংপুর থেকে ঢাকা আনেন এবং নিয়তির টানে আরও দুজন খালেদ মোশাররফের আস্থাভাজন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম ঢাকায় এসে তার পাশে অবস্থান নেন।

জিয়াউর রহমান গৃহ-অন্তরীণ হওয়ার পর থেকে সেনানিবাসে গোপনে সিপাহীদের মাঝে বিদ্রোহ তৈরিতে উদ্যোগী হন জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। জিয়াউর রহমান গৃহঅন্তরীণ অবস্থায় তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। তিনি উদ্ধারে সাহায্য চেয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাহের তার নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং নিজ অভিলাষ পূর্ণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পান। আবু তাহের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার এক পা অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে বেসামরিক পদে যোগ দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি গণচীনের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখতেন। তার আদর্শের সঙ্গে জাসদের মিল দেখতে পান। তাহের জাসদের উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। তিনি জাসদের সশস্ত্র ইউনিট গণবাহিনীর প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ’৭২ থেকে ৭৫ সালে শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পরাক্রমশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল জাসদ। জাসদের অসংখ্য তরুণ নেতা-কর্মী রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের হাতে নিহত হন অথবা কারাগারে নির্যাতিত হন। তবু উগ্রবাদিতা এবং অসহিষ্ণু হিংসাত্মক আচরণের কারণে জাসদ জনসমর্থনে পিছিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাসদ ও সর্বহারা পার্টিকে মেধা এবং তারুণ্যের অপচয় বলে মতামত দিয়েছেন।

আবু তাহের সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে গণবাহিনীতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যেখানে শুধু সৈনিক নিয়োগ হবে এবং সুবেদার পর্যন্ত সর্বোচ্চ পদ থাকবে। নিয়মিত সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে তারা দেশের বিভিন্ন কাজে অংশ নিবে। রাশিয়া এবং চীনের বিপ্লবের পটভূমি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী চিন্তাধারা সে সময় অনেক দেশে উদ্ভব হয়, সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের হুজুগ দেখা দেয়। দুঃখজনক ভাবে এসব স্বপ্নবিলাসের সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ফারাক থাকায় অধিকাংশই ব্যর্থ হয় এবং মাঝখানে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশেও তাহেরের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ফলশ্রুতিতে জাসদ বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যায়। আবু তাহেরের পরিবার এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবী তাকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। বিশেষ করে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তার পক্ষে জনগণের সহানুভূতি গড়ে তোলা সহজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়উর রহমানকে খলনায়কের ভূমিকায় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগ সবসময় একাজে উৎসাহ দিয়েছে। অথচ জিয়াউর রহমান সিপাহীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং তার ফলে সিপাহীদের মর্যাদা এবং জীবনমানের উন্নয়ন হয়। ৭ই নভেম্বরের ছুটিও সিপাহীদের দাবি ছিল যা ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাতিল করা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আবু তাহের সেনা বাহিনীতে যে অসন্তোষের বীজ বুনেছিলেন। তার রেশ ধরে ৭৫ থেকে ৭৭ তিন বছর সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য সিপাহি এবং অফিসারের রক্ত ঝরেছে। তাহেরের বিপ্লবী সিপাহীরা ৭ই নভেম্বর খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং কর্নেল এ টি এম হায়দারকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মত স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীতে ভাতৃহত্যার সূচনা হয়। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। 

৩রা নভেম্বর খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল বিদ্রোহ করলে আবু তাহের তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যান। এমনকি জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতামত উপেক্ষা করে জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক কষেন। তাহেরের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ঢাকা সেনানিবাসে ৪ঠা নভেম্বর থেকে ১২ দফা দাবি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ শুরু করে। সিপাহীদের ন্যায্য কিছু দাবির সাথে সুকৌশলে তার সমাজতান্ত্রীক দাবি ঢুকিয়ে দেন। সাথে রং চড়িয়ে খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের আওয়ামী লীগ এবং ভারত প্রীতির গুজব ছড়ানো হয়। সিপাহিরা উত্তেজিত হতে থাকে। তারা প্রথম থেকেই জিয়াউর রহমানের আটক এবং পদত্যাগ ভালোভাবে নেয়নি। ৬/৭ ই নভেম্বর মাঝরাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপাহীরা ফাঁকা গুলি করে বিদ্রোহ জানান দেয়। এর পর ঘটনা দ্রুত ঘটতে শুরু করে। ৪৬ ব্রিগেডের যে তিনটি পদাতিক ইউনিট খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিল পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল তরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দিন (১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িত-দেশে থেকে যাওয়া একমাত্র অফিসার) এবং সুবেদার মেজর আনিসুল হক তাদের অনুগত কিছু সৈনিক সহ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে তাদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন। অনেকে প্রচার করেন তাহেরের সৈনিকরা জিয়াউর রহমনকে উদ্ধার করে–যা সত্য নয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিদ্রোহ অনুঘটন হিসাবে কাজ করলেও, জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেন এই দুই জন সেনা কর্মকর্তা। সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে অবস্থানকালে এই রেজিমেন্ট এবং চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসার, নন কমিশন্ড অফিসার এবং সিপাহীরা জিয়াকে আগলে রাখে। এখানে উল্লেখ্য ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানে ফারুকের ট্যাংক ইউনিটের সাথে রশীদের সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট অংশগ্রহণ করেছিল। এবং চতুর্থ বেঙ্গল শাফায়াত জমিলের সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। ৭ই নভেম্বর তারা সকলে জিয়ার চারিদিকে প্রতিরক্ষা তৈরি করে।


সেকেন্ড ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসে নিজের অবস্থান সংহত করার পর জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে অবস্থানরত সকল সিনিয়র অফিসারদের তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সৈনিকরা নিজ উদ্যোগে সেনানিবাসের সকল অফিসারকে খুঁজে জিয়ার সামনে হাজির করে। এদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী বীর উত্তম। তিনি সেসময় যশোর সেনানিবাসের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং ৬ই নভেম্বর ঢাকার মিটিংয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। এ সকল অফিসার এবং অনুগত সৈনিকরা জিয়ার চারিদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে এবং তাকে সুরক্ষিত রাখে উচ্ছৃঙ্খল সিপাহি এবং সেনানিবাসে অনুপ্রবেশকারী তাহেরের সন্ত্রাসীদের থেকে।

জিয়াউর রহমান খালেদ মোশারফ এবং শাফায়াত জামিলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি শাফায়াত জামিলের সাথে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন এবং তাকে নিশ্চিন্তে সেনানিবাসে ফেরার আহ্বান জানান। শাফায়াত জামিলের বিপ্লবের মাত্রা এবং ব্যাপকতা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তিনি জিয়াউর রহমানের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। যখন উপলব্ধি করেন তার পদাতিক বাহিনী বঙ্গভবন অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গেছে এবং বিপ্লবী সিপাহিরা বঙ্গভবনে প্রবেশের চেষ্টা করছে তখন তিনি দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন এবং শেষপর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় আশ্রয় নেন। মির শওকত আলী কর্নেল আমিনুল হককে পাঠিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে চিকিৎসার জন্য সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করান। দুঃখজনক পরিণতি হয় খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের। তারা বঙ্গভবন ছেড়ে শেরেবাংলা নগরে অবস্থানরত রংপুর থেকে আগত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাওনিতে আশ্রয় নেন। এটা তাদের অনুগত বাহিনী হওয়ায় তারা সেখানে নিরাপদ বোধ করেছিলেন। এ ইউনিটের কমান্ডে তখন ছিলেন মেজর নওয়াজিশ। তিনি জিয়াউর রহমানকে ফোন করে খালেদ মোশারফ, নাজমুল হুদা এবং এম হায়দারের উপস্থিতির কথা জানান। জিয়াউর রহমান তাদের সর্বত নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংঘের সিপাহীরা এসে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের উত্তেজিত করে তুলে এবং এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে। 

তাহের ৭ই নভেম্বর ভোর রাতে সেনানিবাসে এসে জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে আহ্বান করেন এবং সাথে করে নিয়ে যেতে চান। তাহেরের অভিসন্ধি উপলব্ধি করে এবং জিয়াউর রহমানের প্রাণহানির আশঙ্কায় উপস্থিত সেনাকর্মকর্তারা জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাইরে যেতে বাধা দেন এবং রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। তাহেরের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাহের বিফল হয়ে ফেরত যান। তৎকালীন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জেষ্ঠ্য অফিসার পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন তাহেরের সাথে জিয়াউর রহমানের সেনানিবাস থেকে বের না হওয়া সঠিক ছিল, এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। জিয়াউর রহমান তাহেরের আয়ত্তে চলে গেলে তাকে জিম্মি করে নিজের মতন ভাষণ আদায় করে নিতেন এবং জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় সওয়ার হয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিতেন। এমন ধারণা অবাস্তব শোনালেও সমাজতন্ত্রীরা যেকোনো উপায়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনকে বৈধ মনে করে। উপরন্তু তাহের উগ্রপন্থি রাজনীতিতে ইতোমধ্যে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তাহের তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন অফিসার হত্যায় সিপাহীদের উৎসাহ দিয়ে যার ফলাফল ছিল মর্মান্তিক।

১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় জনতা যেমন সম্বিত ফিরে পেয়েছিল তেমনি ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জিয়ার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার ভাষণ শুনে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, চলমান অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তিপায়। একজন জনপ্রিয়, দৃঢ়চেতা মুক্তিযোদ্ধার দেশ শাসনের দায়িত্ব নেওয়ায় জনগণের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়। সাধারণ সিপাহীরা ট্রাক নিয়ে, ট্যাংক নিয়ে জনতার সাথে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে ৭ই নভেম্বর সকালেই সেনানিবাস থেকে বের হয়ে আসে। এর পর জনতা সামরিক ট্রাক এবং ট্যাংকের উপর উঠে আনন্দ করতে থাকে। এই আনন্দ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার আনন্দ- মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার আনন্দ-অপশক্তি প্রতিরোধের আনন্দ। এ আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল রাজপথে। এই সফল বিপ্লব সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়েছিল যার ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী, যা আমরা আজও অনুভব করি। 


৭ই নভেম্বর না হলে বাংলাদেশ উদার গণতন্ত্র এবং সুশাসনের ধারায় ফিরত না। অভাব, দারিদ্র, দুর্নীতি এবং অরাজকতায় জর্জরিত হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করে আমাদের তরুণদের ৫ই আগস্ট ’২৪ বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হবে। কাজ মাত্র শুরু। হাজার শহীদের রক্ত বৃথা যাবে যদি আমরা সফল হতে না পারি। আমরা সবাই বিপ্লব সফল করতে বদ্ধপরিকর।


  • লেখক: প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান, মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব

জাতীয়তাবাদের আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’




কখনো কখনো বহমান সময় ব্যক্তিকে নির্মাণ করে, আবার কখনো ব্যক্তিই তৈরি করে ইতিহাস। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম যেমন সময়ের নির্মাণ, তেমনি শহীদ জিয়া তৈরি করে গেছেন ইতিহাস। আজকের বাংলাদেশ সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা মাত্র, যেখানে সময়ের সাথে গড়ে উঠেছে ব্যক্তির এক অনস্বীকার্য মিথোজীবীতা।

সেনাবাহিনীর একজন মেজর যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে নিঃশঙ্ক চিত্তে নিজের এবং পরিবারের জীবনকে বিপদাপন্ন করে ঘোষণা করেন, “উই রিভোল্ট” তখন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ। যখন একজন দেশপ্রেমিক মহান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন স্বাধীনতা ও ব্যক্তি হয়ে ওঠেন একে অপরের পরিপূরক। কালের স্রোতে, সময়ের প্রবহমানতায় যিনি তাঁর সত্তাকে বিলীন করে দেন জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে, তখন তিনি হয়ে ওঠেন জাতিসত্তার এক মূর্ত প্রতীক। জাতির সেই আরাধ্য অবয়বের নাম ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান’।

মেজর জিয়াকে নিয়ে সম্পূর্ণ পাঠ এখনো হয়ে ওঠেনি কিংবা বলা যায়- প্রচারবিমুখ বীরমুক্তিযোদ্ধা জিয়ার পাঠোদ্ধার দুরূহ এবং অনতিক্রম্য তার ভাবনার পরিধি। তবুও যেটুকু আমরা জেনে যায় পরম্পরায়, আমরা এমন একজন সামরিক কর্মকর্তাকে দেখি। যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেও ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারক এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে উঠেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বাহক।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে জেনারেল এমেজি ওসমানীর পদত্যাগের পর সেনাবাহিনীর প্রচলিত মান ও প্রথা ভেঙ্গে সর্বোচ্চ পেশাদারি, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ, সামরিক নেতৃত্বের সকল গুণাবলিতে মহিমান্বিত, প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমিক ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে বঞ্চিত করে, ব্রিগেডিয়ার কে এম শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান মনোনীত করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র বাহিনীতে রাজনীতিকরণ প্রথা চালু করেন। সেই বেদনা জারিত করে শতসহস্র সৈনিক ও অফিসারের হৃদয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান রাজনৈতিক নেতা থেকে ক্রমশ হয়ে ওঠেন স্বৈরশাসক, যার বিপরীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনা কর্মকর্তা হতে উত্তীর্ণ হন এক মহান নেতায়। যেন বহমান সময় এই বীরমুক্তিযোদ্ধাকে জায়গা করে দিতে উদ্ধত হয়। 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না বরং এটি ছিল ঘটনার পরম্পরা ও পরিণতি। এই পরিণতি হলো একটি তিমির রাত্রির বিনাশ ঘটিয়ে একটি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের জীবনে আরেকটি সম্ভাবনাময় ঊষার উন্মেষ।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর বিপ্লবের পর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রতিবিপ্লবের সূচনা হয়, তার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ কারান্তরীণ হন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩ নভেম্বর শুধু জিয়াউর রহমান কারান্তরীণ হননি, শৃঙ্খলিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।

৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাক বদলের উপাখ্যান। কেননা ৩ নভেম্বর যেমন ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরনের দিন। তেমনি ৭ নভেম্বর ছিল শৃঙ্খল মুক্তির এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এই মহান দিনে আধুনিক ও জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের জনক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তির ভেতর দিয়ে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আর এই মুক্তির নেপথ্য কারিগর ছিল বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের অন্তর্গত স্পৃহা ও বীর সেনানীদের এক অভূতপূর্ব মিথস্ক্রিয়া। যার দরুন ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেদীপ্যমান হয়ে আছে সিপাহি-জনতার বিপ্লব নামে।

সূচনাতেই বলেছি, ইতিহাস হলো এক পরম্পরা। সেই পরম্পরায় ৭ নভেম্বর যুগস্রষ্টা জিয়াউর রহমানের শুরু করে যাওয়া কর্মযজ্ঞের পরম্পরা হলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যদিও এই পরম্পরায় যতি চিহ্ন ছিলেন জেনারেল এরশাদ, সেমিকোলন ছিল পলাতক স্বৈরাচারী হাসিনা। তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রবল সংঘবদ্ধ প্রয়াস ১৯৯১ সালে ম্যান্ডেট দেয় আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। বেগম খালেদা জিয়া দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যান ৭ নভেম্বরের স্পৃহার এক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ।

সময়ের প্রবহমানতায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ার প্রবাহ করেছে বাঁক বদল। বাংলাদেশের রাজনীতি ঘোর অমানিশায় আবর্তিত হয়েছে ১/১১-এর ভেতর দিয়ে। 

তবুও গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্খা নির্বাপিত হয়নি কখনো। কারান্তরীণ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তির মশাল তুলে দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি সেনা সন্তান তারেক রহমানের কাছে। একদা নির্যাতিত ও কারান্তরীণ পরবর্তীতে নির্বাসিত তারেক রহমান নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জনগণ, দেশ ও গণতন্ত্রের মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়েছে স্বৈরাচারী হাসিনা। কিন্ত তারেক রহমানের যাত্রা চলমান। বন্ধুর পথে তিমির রাত্রিতে যে যাত্রা তিনি চলমান রেখেছেন, সেই যাত্রার কোন যতিচিহ্ন নেই। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার যে বিপ্লবী স্পৃহা ধারণ করেছিলেন তাঁর প্রয়াত পিতা, যা লালন করেছেন তাঁর বর্ষীয়ান মাতা, সেই অদম্য স্পৃহা লেলিহান অগ্নিশিখা হয়ে দেদীপ্যমান হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক বাংলাদেশে। যে বাংলা দুর্ভেদ্য, অজেয় ও অদৃষ্টপূর্ব।


  • ▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।


Thursday, October 17, 2024

তারেক রহমানের রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা

 

গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিণত হয়েছেন দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশ এখন তাঁর দিকেই তাকিয়ে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি যে ক্ষমতায় আসবে, তা সবাই বুঝতে পারছে। তারেক রহমান হবেন রাষ্ট্র নায়ক। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিএনপি এখন রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে রয়েছে। মানুষের মাথার উপর ছায়া হয়ে রয়েছে। আর এই ছায়ার উৎস হচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হতে পারে। তাঁর বক্তব্যগুলো নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে, কলাম লেখা হচ্ছে। মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তাঁর প্রত্যেকটি কথায়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির প্রচার স¤পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেছেন, তারেক রহমানের নির্দেশনায় ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ আমরা সবাই মানুষের পাশে থাকার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর মাধ্যমে বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তন এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে। তারেক রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বে, বিএনপি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির নেতাকর্মীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, মানুষকে অভয় দিচ্ছেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে যাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের মনের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপরেখা মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাচ্ছেন। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচি শেষে এখন রাস্তাঘাট, সমাবেশের স্থল পরিষ্কার করা হয়। এই পরিবর্তনের কারিগর তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, আমরা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। এখন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেনেন, বিএনপির প্রত্যাশা রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। তারেক রহমানের উক্তিটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি ¯পষ্ট সংকল্প ব্যক্ত করে, যেখানে তিনি জনগণের প্রত্যাশা ও ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। এ কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম চলমান, তা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং একটি জাতীয় দায়িত্ব। এই দৃঢ় অবস্থান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের জন্য তাঁর অঙ্গীকারকে প্রমাণ করে। তারেক রহমানের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, দলের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সততার জোরালো আহ্বান। তিনি ¯পষ্ট করেছেন, যদি কেউ বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তাহলে তার বিরুদ্ধ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থান দলের শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রতীক। ইতিমধ্যেই বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মী শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে, বিএনপি শুধু রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়, বরং জনগণের আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে চায়। এই প্রক্রিয়ায়, তিনি একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং বৈষম্যহীন ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও উদ্বেগজনক। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশনা সমগ্র জাতির জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে উঠেছে। তিনি সবসময় বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে সাহস ও মানসিকতা বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন, যা সংগ্রামের এই সময়ে একান্ত প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর যে হামলা, মামলা এবং শারীরিক নির্যাতন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তারেক রহমানের সাহসিকতা নেতাকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন এবং তাঁর নেতৃত্বে দলটি কেবল রাজনৈতিক লড়াই নয়, বরং মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য একটি সংগ্রামী অবস্থান গ্রহণ করছে। সংকটময় সময়ে, তারেক রহমানের নেতৃত্ব জাতির জন্য আশার প্রদীপ হয়ে রয়েছে, যা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি বলেছেন, স্বৈরাচারের দোসররা ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাঁর এই বক্তব্য বাস্তবসম্মত। কারণ, ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এ প্রেক্ষিতে, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে, তা সাধুবাদযোগ্য।

শুধু কথায় নয়, কাজেও তারেক রহমান প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন প্রকৃত নেতা। তিনি যে পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরছেন, সেগুলো বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক। তার ফ্যামিলি কার্ডের ধারণা, রপ্তানিমুখী কৃষির উন্নয়ন এবং জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর। তারেক রহমান যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের বিরুদ্ধে করা কার্টুন শেয়ার করেন, তখন তিনি যে সমালোচনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন, তার নজির। একজন নেতা হিসাবে, তিনি নিজের প্রতি উঁচু মানসিকতা বজায় রাখছেন এবং সমালোচনাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই সহিষ্ণু মনোভাব বাংলাদেশের জনগণ ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করছে। জনগণ যখন দেখে, তাদের নেতা সমালোচনা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভয় পান না, তখন তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংহতি সৃষ্টি হয়।

অনেকেই বলেন, একটি দেশ একবারই স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতা বেহাত হয়ে যাওয়ার পরে সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য গণবিপ্লবের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা কি দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়? অবশ্যই দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মানুষ এখন নতুন এক রাজনীতির স্বাদ পাচ্ছে। তারা ভোটাধিকার ফিরে পেতে চাচ্ছে। স্বৈরাচার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনের একটিতেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়নি। মানুষ এখন ভোট দিতে চায়, সেই ভোটের মাধ্যমে মানুষ ক্ষমতায় আনবে তাদের সরকার, যারা দেশের মানুষের কথা বলবে। তাদের এই আশার প্রতীক তারেক রহমান। মানুষ যেমন আশা করে, সে হয়তো পুরোপুরি জানে না। কিন্তু মানুষ যা চায়, তা তারেক রহমান জানেন। তিনি কতদূর ভেবেছেন, তা হয়ত আমরা ভাবতে পারছি না। তিনি শুধু তাঁর দলের নেতাকর্মীকে বলেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন নতুন উদ্দীপনা। সারাদেশে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়ে মানুষের আস্থা ধরে রেখেছেন। তিনি যে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলছেন, সেই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরছেন।


আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সফল্য আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই সরকার ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ, এটা অনুভব করেছেন তারেক রহমান। এই সরকার ব্যর্থ হলে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরন্তর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তারেক রহমান বলেছেন, ধর্ম যার যার নিরাপত্তা পাবার অধিকার সবার। স্বাধীন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর এই চিন্তা সার্বজনীন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। বিভিন্ন এলাকার মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা কাজ করছেন। এমনভাবে তিনি কাজগুলো করেছেন, যা দলের অনেক নেতাকর্মীও জানে না।

তারেক রহমানের রাষ্ট্রচিন্তা অতুলনীয়। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, জাতীয় সরকার গঠন, এক ব্যক্তির দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া আমাদের দেশের জন্য নতুন ভাবনা। এই ভাবনা নিয়ে তিনি নিরন্তর কাজ করছেন। মানুষের কাছে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার চিন্তা তিনিই করছেন। তিনি একটি বিখ্যাত শ্লোগান দিয়েছিলেন, ‘টেইক ব্যাক বাংলাদেশ’, যা জনগণকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কবল থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। ফলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠছেন তিনি, যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং সমৃদ্ধির পথ সুরক্ষিত থাকবে।


লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

বিএনপি কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা





১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান কর্তৃক জাতির সামনে উপস্থাপিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা —

১. জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন।

২. সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্রসত্ত্বা (Rainbow-Nation) ও 'জাতীয় সমন্বয় কমিশন ('National Reconciliation commission') গঠন।

৩. অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন।

8. আইনসভা, মন্ত্রীসভা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিচার বিভাগের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা।

৫.  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা অনুর্ধ্ব পরপর দুই মেয়াদ নির্ধারন।

৬. বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন।

৭. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন।

৮. নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধন।

৯. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরনে সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করন।

১০. বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন।

১১. গণমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১২. মিডিয়া কমিশন গঠন করে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।

১৩. দূর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ।

১৪. সর্বস্তরে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।

১৫. আত্মত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন।

১৬. ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ও কার্যকর নিশ্চয়তা প্রদান।

১৭. মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির আলোকে শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত করা।

১৮. প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং নবায়নযোগ্য ও মিশ্র জ্বালানী ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ খাত আধুনিকায়ন।

১৯. জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন।

২০. প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধিকতর আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা।

২১. প্রশাসন ও সেবা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি স্বশাসিত ও ক্ষমতাবান করা।

২২. শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান। 

২৩. কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বেকার ভাতা প্রবর্তন।

২৪. নারীর মর্যাদা সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।

২৫. চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।

২৬. "সবার জন্য স্বাস্থ্য" এবং "সার্বজনীন চিকিৎসা"ব্যবস্থা

কার্যকর করা। প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করা এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা।

২৭. কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

২৮. সড়ক, রেল, নৌ পথের আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন ও খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩০. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তির উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৩১. যুগোপযোগী, পরিকল্পিত, পরিবেশ বান্ধব আবাসন এবং নগরায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। 

বিচার বিভাগে দুর্নীতির দানব - পরিত্রাণের পথ শহীদ জিয়ার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’

 


১৯৭৮ সালে অধ্যাদেশ বলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতি অপসারণে গঠন করেছিলেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’। দূরদর্শী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করতে সংবিধানের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে কৌশলে অচল করে রাখে। দেড় দশকের মাফিয়াতন্ত্রে বিচার বিভাগকে পদানত রাখতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখে এই কাউন্সিল। এ জন্য বন্দুকটিও রাখে আদালতের ঘাড়েই। হাসিনার দলীয় আনুগত্য স্বীকার করা বিচারাঙ্গনকে দুর্নীতির দানবে পরিণত হয়। সেই দানবকে বশে রাখার কোনো হাতিয়ারই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ বিচার বিভাগ সংস্কারের অনিবার্যতায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রণীত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’।


এ কাউন্সিল পুনঃজীবীতকরণের মধ্যেই বিশ্লেষকরা খুঁজছেন বিচার বিভাগকে দুর্নীতির রাহুমুক্তকরণের পথরেখা। জাতির এই সন্ধিক্ষণে তারা এখন বিচার বিভাগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানকে স্মরণ করছেন অকুণ্ঠভাবে। একইসঙ্গে ঘৃণাভরে স্মরণ করছে সদ্য উৎখাত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কথিত ‘বিচার-ব্যবস্থা’কে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে বাতিল করে দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এ আদেশ দেন শেখ হাসিনার অনুগত তৎকালীন বিচারপতিগণ। এ রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্য আপিলও করেন শেখ হাসিনা। ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ মঞ্চস্থ করার জন্য হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগে। এতে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ‘নন-ফাংশানাল’ হয়ে পড়ে। পরে ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে সরকারপক্ষ। এতে গত ৭ বছর ধরে দেশে বিচারপতিদের অপসারণ করার মতো কোনো আইনি পদ্ধতিই বহাল নেই।


বিদ্যমান পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে গত ১৫ আগস্ট রিটকারী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আবেদন করেন। আদালতে তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে রয়েছে। এটির শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পরে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগীয় বেঞ্চ শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়।


এর আগে গতবছর ২৩ নভেম্বর বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানি ৬ জন বিচারপতি গ্রহণ করতে পারবেন সিদ্ধান্ত দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। তবে রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য একাধিকবার কার্যতালিকায় এলেও শুনানিতে আগ্রহ দেখায়নি শেখ হাসিনার সরকার।


২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়। সরকারপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চায়।


এর আগে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)র নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন। ওই বছর ৮ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। এতে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন দশ সিনিয়র আইনজীবী। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অন্যদের মধ্যে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম. কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মতামত দেন।


এর আগে ২০১৬ সালের ৫মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ’ বলে রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এই বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে এমপিগণ ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে এমপিদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও বিভিন্ন উন্নত দেশে এমপিদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।


হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারকের অপসারণের ক্ষমতা এমপিদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হয়। যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছর ৫ নভেম্বর রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

১৯৭৫সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার। ১৯৭৮ সালে তিনি এক সামরিক ফরমানে গঠন করেন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’কে এই ক্ষমতা দেন। তার সময়ই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।


সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারে বহাল থাকে। ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা চলে যায় জাতীয় সংসদের হাতে। ওই বছর ৫ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ১০ আইনজীবীর পক্ষে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।


যে প্রক্রিয়ায় বিচারপতি অপসারণ করে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ : কি প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিকে অপসারণ করে-জানতে চাইলে রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কানো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতিকে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ গঠন করতে বলবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে। শুনানি নেবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে কমিশন। এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবেন যে, অভিযোগটি সঠিক কি না। পরে প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার আমলে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে অভিশংসন করেছিলো। এসএম শাহিদুর রহমান সুপ্রিমকোর্ট বারের নেতৃত্বে ছিলেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে বারের তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালের এপ্রিলে তাকে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। তার নিয়োগের বিরোধিতা করেন সুপ্রিমকোর্ট বারের আওয়ামীলীগপন্থি আইনজীবীরা। তার নিয়োগের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে আ’লীগ। বিচার বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এ সময় সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ তখন এসএম শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে জামিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনেন। অভিযোগ তদন্তে গঠিত হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খন্দকার মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি কাউন্সিল প্রতিবেদন জমা দেয়। কাউন্সিলের সুপারিশ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সৈয়দ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমানকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তিনি রিট করেন। হাইকোর্ট তার অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে সৈয়দ জে.আর. মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পরবর্তীতে আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির প্যানেল ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শাহিদুর রহমানের অপসারণ অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এভাবেই ইতি ঘটে বিচারপতি এসএম শাহিদুর রহমানের ‘বিচারপতি’ পরিচয়।


স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতিসত্তা বিনির্মাণে শহীদ জিয়ার ঐতিহাসিক অবদান

প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান



শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রাম, গর্ব-অহঙ্কার আর স্বাধীকার আন্দোলনের মাস মার্চ। এই মাসেই সূচনা হয় আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের। যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের ৭ কোটি মানুষের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। পৃথিবীর বুকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি নতুন ভূখন্ড স্বীকৃতি পায় প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নামে।


স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদানের বিষয়ে বিষদ আলোচনার আগে স্বল্প পরিসরে হলেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়। ১৯৫২ সালে তিনি করাচি একাডেমি স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচিতে ডি. জে কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারী একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সামরিক বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। করাচিতে দু’বছর চাকরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন।


১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।


তিনি বলেন — This is Shadhin Bangla Betar Kendro. I, Major Ziaur Rahman, here by declared that the independent People’s Republic of Bangladesh has been established. I have taken command as the temporary Head of the Republic. I call upon all Bengalis to rise against the attack by the West Pakistani Army. We shall fight to the last to free our Motherland. By the grace of Allah, victory is ours.


দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলে লাল সবুজের পতাকায় শোভিত স্বাধীন দেশে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তৎকালীন সরকার জিয়াউর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে।


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ যখন চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিপতিত তখন জিয়াউর রহমান আবার দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।


১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির মধ্যদিয়ে তিনি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতা তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাদপিঠে আসীন করে। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন সরকার সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। বাকশাল প্রবর্তনে রুষ্ঠ সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ব্যাকুল ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিয়াউর রহমান জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রথা বাতিল করে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গণমাধ্যমের উপর থেকে সকল কালাকানুন প্রত্যাহার করে মুক্ত স্বাধীন গণমাধ্যম চালু করেন।


একটি রাজনৈতিক সরকার যেখানে সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছিল তখন জাতির প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী থেকে আসা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈনিক স্বাধীনতার অন্যতম মূলস্তম্ভ বহুদলীয় গণতন্ত্র জাতিকে উপহার দিয়ে মুক্ত গনতান্ত্রিক চর্চার পথকে সুগম করেছিলেন। শাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান এ কারণেই সবার থেকে আলাদা ছিলেন।


জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তিনি তার যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, সততা ও ন্যায় পরায়ণতা দিয়ে সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার জীবদ্দশায় দেশের প্রায় প্রতিটি ক্রান্তিকালে অসামন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে দেশ গঠনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃতজ্ঞজাতি আজও তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সততার মাপকাঠিতে তিনি আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই দেশের চলমান অবনতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করেন। শক্তহাতে চুরি, ডাকাতি ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসে।


স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ—অফ—স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ মোশারফ এর নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে । তারপর গোটা জাতি আবার আতংকিত হয়ে পড়ে তৎ পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান কে বন্দি করলে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেইনি এবং জনগণ আবারো দুঃশাসনের আশঙ্কা করেন তাই সিপাহী এবং জনতা মিলে বন্দীদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে দেশের দায়িত্বভার তুলে দেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ—প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।


জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও সহনশীল অবস্থানের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন “ I will make politics difficult for the politicians”.


১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ—সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।


লেখক:

প্রফেসর ড: মোর্শেদ হাসান খান

মহাসচিব, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ-ইউট্যাব