Search

Monday, September 1, 2025

বিএনপির ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা

শায়রুল কবির খান

একটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস নয়; এটি জাতির আকাক্সক্ষা, সংকট ও সম্ভাবনারও দলিল। সেই দলিলের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। যে দিনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্বাসন ও একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনার সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির প্রতিষ্ঠা শুধু একটি দলের জন্ম নয়, এটি ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার ফসল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর, একদলীয় শাসনামল শেষে দেশ যখন একটি রাজনৈতিক ভ্যাকুয়ামে নিপতিত, তখন গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত বিকল্পের অনুপস্থিতি তখন স্পষ্ট। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীসহ অনেক প্রবীণ নেতা তখনো সক্রিয় থাকলেও সেই শূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুসংগঠিত, সুস্পষ্ট আদর্শভিত্তিক এবং সর্বজনীন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের। এ শূন্যতা পূরণ করতেই আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি। এর প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের’ যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, তা ছিল একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে একটি যুগোপযোগী দার্শনিক ভিত্তি। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা।

এ প্রেক্ষাপটেই আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু একটি দলই গড়ে তোলেননি, বরং ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রদর্শন দাঁড় করান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে বিএনপি জন্ম নেয়

স্বাধীনতার ঘোষক থেকে রাষ্ট্রনায়ক : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা শুরু হলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা তাকে জনমানসে প্রথম পরিচিতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অফিসার হিসাবে তাকে স্বীকৃতি এনে দেয়। নয় মাসের যুদ্ধে তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার। স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষ সামরিক অফিসার হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহি-জনতার বিপ্লব তাকে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সামনে নিয়ে আসে। ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া... আপনারা ধৈর্য ধরুন’-এ বার্তা তখনকার সংকটকালে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনে।

রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা : রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান প্রথমেই সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক পুনর্গঠন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। সামরিক বাজেট বৃদ্ধি, নতুন ডিভিশন গঠন, পুলিশগোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার পদক্ষেপ ছিল তার রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল। কিন্তু এর চেয়েও বড় পদক্ষেপ ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনএকদলীয় শাসনের সংকট থেকে বেরিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের বৈধতা দেন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধি জারি হলে আওয়ামী লীগ, বাম ও ডানপন্থি শক্তিগুলো আবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়

গণতান্ত্রিক ভিত্তি : এ সময়েই জন্ম নেয় বিএনপিবহুদলীয় রাজনীতির একটি প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে জিয়া ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশজুড়ে গণসংযোগে বের হয়ে ৭০টিরও বেশি জনসভায় ভাষণ দেন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করেন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন জনগণের ভোটাধিকারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ নির্বাচনকে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনের অন্যতম মাইলফলক ধরা হয়

পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান : জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল বাস্তববাদী। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন, চীন ও পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেন। বিশেষত মুসলিম বিশ্বের সংহতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ়

অর্থনীতি ও সমাজ সংস্কার : অর্থনীতিতে বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার আমলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য আসে।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী : ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী পাশ হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সব আইন-ঘোষণা সাংবিধানিক বৈধতা পায়। এ সংশোধনীতে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিতেও পরিবর্তন আসে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে যুক্ত হয়সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। জাতীয়তাবাদ নতুন সংজ্ঞা পায় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। বহুত্ববাদী সমাজে জাতীয় পরিচয়কে নতুন মাত্রা দেয় এ ধারণা। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়

ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক ও উত্তরাধিকার : ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন জিয়াউর রহমান। মাত্র সাড়ে চার বছরে তিনি যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারে বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশকে মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন।

বর্তমান সংকট ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : তবে বিএনপির যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দলটি বড় আঘাত সহ্য করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জটিলতা, নেতৃত্বের ওপর দমননীতি, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস, সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে। তারপরও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ধারাবাহিক আন্দোলন প্রমাণ করেছে, বিকল্প শক্তি হিসাবে বিএনপি এখনো জনগণের প্রত্যাশার জায়গায় রয়েছে। বিশেষত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে তারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে পেরেছে।

ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সংগঠনকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযুক্ত করা, গণআন্দোলনকে ভোটে রূপান্তর করা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ লক্ষ্যগুলোতে সফল হয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিএনপি আবারও জাতীয় রাজনীতির প্রধান স্থায়ী শক্তি হয়ে উঠতে পারবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি শুধু একটি দলের নাম নয়, বরং রাষ্ট্রের বিকল্প দর্শন ও গণতন্ত্রের প্রতীক। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে ৯০-এর গণআন্দোলন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কিংবা সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান সব ক্ষেত্রেই বিএনপি নেতৃত্ব দিয়েছেদেশমাতৃকায় গড়ে ওঠা বিএনপি তাই শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে রচিত ভিত্তি ও তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আজও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অপরিহার্য।

শায়রুল কবির খান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

Sunday, August 31, 2025

বিএনপি: রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান



জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলনের কথা সবার নিশ্চয়ই জানা। ইঁদুরের উৎপাত থেকে শহরটির মানুষকে মুক্তি দিতে যেখানে একজন বাঁশিওয়ালার আবির্ভাব ঘটেছিল।

যিনি তার বাঁশির মোহিনী শক্তিতে সকল ইঁদুর সাগরে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার বাঁশির সুর এতোটাই যাদুকরী ছিল। কখনো কখনো রাজনৈতিক দলকেও মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কেননা রাজনৈতিক দল গণমানুষের মুখপাত্র। আর কোনো দল যখন গণমানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে, একই নীতি ও আদর্শে মোহমুগ্ধ করতে সক্ষম হয় তখন সে দলটি হয়ে ওঠে অনেক দেহের একটি প্রাণ। সে হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে রাজনীতির হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বললে অত্যুক্তি হয় না।

চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের দীর্ঘ লড়াই আর সীমাহীন ত্যাগ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করেছে। জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে গেছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। কেবল বাংলাদেশই নয় পৃথিবীর ইতিহাসে তার সরকারের এমন পলায়ন বিরল। আওয়ামী লীগের এই পলায়ন তাদের কৃতকর্মকে জনতার সামনে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছে। দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের।

অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে রাখা হাসিনা সরকার চেয়েছিল এ দেশ থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু পারেনি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের সাধারণ কর্মী তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে তাদের প্রাণপ্রিয় দলকে। যেই বিএনপির যাত্রা শুরু হয়েছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সেনা ব্যারাকে সৃষ্টি হলেও দলটি শুরু থেকেই ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকায়। এখানে সকল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্নিবেশ ঘটেছিল খুব অল্প সময়েই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সুদীর্ঘ সময় অতিক্রম করেছে। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনীতি গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় গ্রন্থের ফ্ল্যাপের অংশেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। তার মতে, “বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন সেনানায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে । এ ধরনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায়। বিএনপি এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি শুধু টিকেই যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায়। কিন্তু দলটি দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। ”

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমায় শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত করে ১৯৫৩ সালে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তার ভূমিকা সব সময়ই ছিল বীরোচিত, যা তাকে তার পেশাগত পরিমণ্ডলে শ্রেষ্ঠতর মর্যাদায় ভূষিত করে। সাহসী রণকৌশল ও অসীম বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ হিলাল-ই-জুরাত এবং তামঘা-ই-জুরাত পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে মেজর হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব প্রদান করেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকার বিষয়টি সর্বজন এবং আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ঘোষণা, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ, দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথ দেখানো এবং সশস্ত্র নেতৃত্বের কারণে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ খেতাব বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রেখে গেছেন।

১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ দিনের মাথায় একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯ দফা ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, জনগণ, আইনের শাসন, পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, ধর্মব্যবস্থা, মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতি সকল কিছুর সমন্বয়ে একটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উন্নত মডেল তত্ত্ব।

১৯ দফা ছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেওয়া রাষ্ট্রের মুক্তির দিক-নির্দেশনাবলী। এক কথায় বলা যেতে পারে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগ ফিরিয়ে আনেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ১৯ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। তিনি ১৯ দফাতে যেমন শাসনতন্ত্রের মূলনীতি গণতন্ত্রের পথ দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি সমাজতন্ত্রের ভালো যে দিক সমাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথাও বলেছেন। তিনি সমাজব্যবস্থার সকল উত্তম দিকের সমন্বয়ে একটা স্বাধীন, অখণ্ড ও স্বার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। এই ১৯ দফায় রাষ্ট্রকে তিনি যেমন সমসাময়িক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ঠিক তেমনই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্রের পথ দেখিয়েছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ওই তত্ত্বে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য নিরক্ষতা মুক্ত শিক্ষিত জাতির কথা বলেছেন। একটি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ ছিল তার সেই ১৯ দফায়।

বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এই রাষ্ট্রনায়ক।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে দল, দেশ ও গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রয়োজনে দলের হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সাধারণ গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। সে সময় বিএনপি অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকটা বেসামাল ছিল। তবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীন নেতৃত্ব ও সীমাহীন ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান প্রবাহমান নদীর মতো। সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘আপোসহীন নেত্রী’ হিসেবে।
এ বিষয়ে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার সময়-অসময় বইয়ের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে বিএনপি তৈরি করলেও পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দল হিসাবে সেটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠা এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময়, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান, কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া। ”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ওয়ান-ইলেভেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একদিকে বিএনপিকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র অন্যদিকে দেশে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক আয়োজন শুরু হয়। নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয় আপসহীন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির আশ্রয়স্থল বেগম খালেদা জিয়াকে। আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানকে করা হয় নির্বাসিত। সেই থেকে একের পর এক ষড়যন্ত্র বিএনপিকে ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা করেছে।

বিএনপিকে নেতৃত্বহীন করতে দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফরমায়েশি রায়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে আটক রাখে বহু বছর। দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মীকে অসংখ্য মামলায় ফাঁসানো হয়। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে পড়েন দলটির শীর্ষ নেতারাও। স্বৈরশাসক হাসিনা মনে করেছিল এভাবে হামলা-মামলা আর গুম-খুনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটি হয়নি বরং দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল আঘাতে আঘাতে হয়েছে আরও পরিণত, জনপ্রিয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সব ষড়যন্ত্র-কূটকৌশল মোকাবিলা করে বিএনপিকে রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।

তারেক রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে বিএনপিতে। গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে যেই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই দলটি আজ পৌঁছে গেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি কানায় কানায়। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাই এই দলটির দায় ও দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কারণে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক গবেষণা করছেন। দলীয় কর্মী থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসার এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বিএনপির সুচিন্তিত প্রতিশ্রুতি এদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। সেদিন খুবই সন্নিকটে যেদিন বাংলাদেশ ফিরে যাবে তার গণতান্ত্রিক আবহে। যার নেতৃত্ব দেবে শহীদ জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে দলটির জন্য থাকল অফুরন্ত শুভকামনা।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি
সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল

বিএনপি’র প্রতিষ্ঠা ও আজকের রাজনীতি

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল





১৯৭১ সালে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে আমাদের। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে পারেনি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। মেজর জিয়া যখন স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন নিজেকে এবং তাঁর পরিবারকে চরম বিপদের ঝুঁকিতে ফেলে; তখন আওয়ামী নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ আর পলায়নে ব্যস্ত। কেউবা বিমানে পাকিস্তানের পথে, কেউবা মেহেরপুরের গন্তব্যে আর তরুণ নেতৃত্ব বুড়িগঙ্গার ওপারে মোস্তফা মহসিন মন্টু’র বাসায় বেতারে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা শুনছেন। অন্য দিকে সারাদেশে নিরস্ত্র মানুষের লাশের স্তূপ জমছে- দেশের সকল প্রান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে। সংগঠিত হয়ে এদেশের মুক্তিকামী তরুণেরা গেরিলা যুদ্ধের পাল্টা চোরাগোপ্তা আক্রমণ নিয়ে মাঠে আসতে আসতে মে-জুন অব্দি গড়িয়েছে, যদিও সেই তরুণদের মাঝে আওয়ামী বা ছাত্রলীগ-যুবলীগ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা ছিল নিছকই অপচেষ্টা। তারা তখন জেনারেল উবান-এর ‘ডিম তত্ত্ব’ বাস্তবায়নে নৈনিতাল- দেরাদুনের নাতিশীতোষ্ণ পাহাড়ে মুজিব বাহিনীতে প্রশিক্ষণরত। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে যুদ্ধ করেছে দেশের সাধারণ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এরাই। তারপরেও সবকিছু ভুলে শুধুমাত্র স্বাধীনতার আকর্ষণে দেশের মানুষের অবিশ্বাস্য ঐক্য সম্ভব করেছে ডিসেম্বরের বিজয়। যদিও এ দেশের মাটিতে জন্ম নেয়া একদল সকল সুযোগ থাকার পরেও মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে স্বাধীনতা বিরোধী আর রাজাকার-আলবদর হওয়ার কালিমা মেনে নিয়েছে স্বেচ্ছায়।

ডিসেম্বরে বিজয়ের মুহূর্তে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঐক্যকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলো আওয়ামী নেতৃত্ব। তারা উড়ে এসে হঠাৎই স্বাধীনতার একমাত্র দাবীদার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালেন। বিজয়ের শুরুতেই এলো বিভক্তি। এমন স্বাধীনতা চাইনি বলে আওয়ামী লীগেরই একাংশ বিভক্তিতে গড়লো ‘জাসদ’। আব্দুর রব আর শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে- আওয়ামী লীগের তথাকথিত ‘মাস্টার মাইন্ড’ সিরাজুল আলম খান নতুনভাবে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হয়ে আবির্ভূত হলেন এই বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহীদের পক্ষে। 

অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা হবার দূর্লভ  সুযোগ হারালেন শেখ মুজিব। একবার রাষ্ট্রপতি, আরেকবার প্রধানমন্ত্রী, তারপর আবারও রাষ্ট্রপতি পদের সাথে যুক্ত হতে থাকলো তার নাম। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন এক চরম নৈরাজ্যের অভয়ারণ্য, দেশের মানুষ পাকিস্তানিদের ফুটন্ত কড়াই থেকে আওয়ামী লীগের জ্বলন্ত আগুনে পতিত হলো। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, অভাব আর দুর্ভিক্ষ, রাস্তায় রাস্তায় অনাহারে মৃতদের লাশের স্তূপ। জনতাকে স্তব্ধ করতে মাঠে নামলো কুখ্যাত ‘রক্ষী বাহিনী’ নামের এক আতঙ্ক। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অসহিষ্ণু সরকার কোনো প্রতিবাদই সহ্য করতে পারছিল না, ভিয়েতনামে যুদ্ধ অবসানের দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলিতে নিহত হলো দু’জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে জাসদের মিছিল পরিণত হলো লাশের মিছিলে। অরাজকতার কফিনে শেষ পেরেক হয়ে এলো ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে এক দলীয় ‘বাকশাল’। নিষিদ্ধ হলো সকল রাজনৈতিক দল, কন্ঠরোধ হলো সংবাদপত্রের, বিনা জবাবদিহিতায় সংসদের মেয়াদ বেড়ে গেল পাঁচ বছর। অবশ্য এর আগে ’৭৩-এ সংসদ নির্বাচনে ব্যালট চুরির মহোৎসব দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দেশবাসীর। 

এলো আগস্ট ১৯৭৫, সপরিবারে নিহত হলেন শেখ মুজিব, ক্ষমতায় এলো তারই বিশ্বস্ত সহযোগী খন্দকার মুশতাক, সংসদের স্পিকার মালেক উকিল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন- “দেশ ফেরাউন মুক্ত হয়েছে”। ইতিহাস আসলেই বড় নির্মম। 

আগস্ট পরবর্তীতে বিশৃংখল সেনাবাহিনীতে তখন অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল নিত্য সঙ্গী। দেশপ্রেমিক সাধারণ সৈনিক এমন অরাজকতার মাঝে ঘটালো এক অভাবনীয়  বিপ্লব। ৭ নভেম্বরে সংঘটিত হলো- ঐতিহাসিক সিপাহী জনতার বিপ্লব। রাষ্ট্রের পাদ-প্রদীপে আবারও এলেন জিয়াউর রহমান জাতির মুক্তির দূত হয়ে। দায়িত্ব পালনের সংক্ষিপ্ত সময়ের মাঝেই ঘটালেন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। দুর্ভিক্ষের বাংলাদেশ পরিণত হলো- খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে, মুক্ত হল অবরুদ্ধ সংবাদপত্র, অবারিত হলো রাজনৈতিক চর্চা। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল- এমন একটি রাজনৈতিক দলের যাঁরা যার আদর্শে হবে উদার মধ্যপন্থী, দৃঢ় থাকবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, মর্যাদা দেবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে, ঐক্যবদ্ধ করবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সকল মানুষকে, মর্যাদা দেবে নারীদের, কর্মসংস্থান করবে যুবকদের, সমমর্যাদার সম্পর্ক থাকবে সকল রাষ্ট্রের সাথে, অগ্রাধিকার পাবে যোগ্যতা আর দেশপ্রেম, শূন্য সহনশীলতা থাকবে অনিয়ম আর দুর্নীতির প্রশ্নে। জিয়া জণ-প্রত্যাশাকে অসম্মান করেননি, গড়েছেন তাদেরই প্রত্যাশার রাজনৈতিক দল “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি”। ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরায় ঐতিহাসিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী দল হিসেবে। যে দল সকল মতাদর্শের মানুষকে ধারণ করতে পারে। তিনি শুধু বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেননি, একই সাথে শেখ মুজিবের হাতে মৃত আওয়ামী লীগেরও পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তারপর ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বিএনপি’র নেতৃত্বে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, সকল ক্ষেত্রেই এসেছে অপ্রত্যাশিত সাফল্য, প্রবর্তিত হয়েছে স্বাধীনতা-একুশে পদক। নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, তারপরেও মুক্তিযোদ্ধার দল বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র দাবীদার হয়ে ওঠেনি। যেমনভাবে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করেও বিএনপি এ দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে ব্লাক মেইলিং-এর সস্তা পথে হাঁটেনি। জিয়া শহীদের মর্যাদায় প্রয়াত হয়েছেন, জনগণ তাকে অন্তিম বিদায় জানিয়েছে সর্ববৃহৎ জানাযার মাধ্যমে ।

পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া দলের দায়িত্ব নিয়েছেন এক কঠিন সময়ে- দলকে করেছেন সুসংহত, স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন সম্মুখ নেতৃত্বে, আপোষহীন ইমেজে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, সকল আসনেই বিজয়ী হবার এক অনন্য রেকর্ড গড়েছেন, শিকার হয়েছেন এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের, কারাবরণ করেছেন মিথ্যা মামলায়, নির্জন কারাগারে আক্রান্ত হয়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। তারপরেও পরম সহিষ্ণুতা আর সংযম তাকে আজ দেশনেত্রীর চাইতেও উচ্চতর আসনে বসিয়েছে। আজ তিনি কোন দলের নন, আজ তিনি এই দেশের সবচাইতে সম্মানিত ব্যক্তি। সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে দেশের মানুষের বিশ্বাস আর আস্থার অভিভাবক।

কারারুদ্ধ হবার পর বিএনপি’র শীর্ষ দায়িত্বে আসেন জনাব তারেক রহমান, এক-এগারোর ষড়যন্ত্রকারীদের রোষানলে নির্যাতনের তীব্রতায় প্রায় পঙ্গুত্বকে জয় করে আট হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও দলকে পরিচালিত করেছেন পরম দক্ষতায়। যার ফলশ্রুতিতে গত সতের বছরের নির্যাতন, হত্যা, গুম, জেল-জুলুম, মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়েও লক্ষ কোটি নেতা-কর্মী সমর্থকেরা পরিচয় দিয়েছেন এক অবিশ্বাস্য ঐক্য আর আনুগত্যের। শত নির্যাতনেও তারা ছিলেন- অনড়, একজনও আদর্শচ্যুত হয়ে দলত্যাগ করেননি, সতের বছর ধরে উত্তপ্ত প্রতিবাদের লাভা মহা-বিস্ফোরণে উদগিরিত হয়েছে চব্বিশের আগস্টে, এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ।

আজ আমরা এক নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে দেশের মালিকানা দেশের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেবার অপার সম্ভাবনার অপেক্ষায়, ফেব্রুয়ারি ২০২৬ অপেক্ষমান জাতির সামনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই প্রত্যাশার মেঘমুক্ত নীল আকাশে ভীতির মেঘের ইতস্তত আনাগোনা শংকিত করছে দেশের মানুষকে। অর্থহীন পি.আর পদ্ধতির অবাস্তব দাবী তুলে জামায়াতে ইসলামী যেমন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ করছে, ঠিক তেমনি আরেক পক্ষ অপ্রয়োজনীয় গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলে গণতন্ত্রের পথযাত্রাকে অনিশ্চিত করার প্রেক্ষাপট রচনা করছে। সাধারণ মানুষ এসবের কোনটাই পছন্দ করছে না। 

গত কয়েক মাস ধরে ঐক্যমত কমিশনের এতো দীর্ঘ আলোচনার পর এমন বিভক্তি সাধারণ মানুষকে শুধু বিরক্তই করছে মাত্র। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে এমন বিভক্তি কেনো মেনে নেবে সাধারণ মানুষ? তাদের চাওয়া একটাই, দেশের মালিকানা সাধারণ মানুষের কাছে ফেরত দিতে হবে, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচিত করতে চায়, কারণ তারা জানে দীর্ঘ মেয়াদের অনির্বাচিত সরকার যে-কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সম্মানজনক নয়, তারা এটাও জানে আগামী ফেব্রুয়ারিতে গণতন্ত্রে উত্তরণ কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে আবারও অনিশ্চিত সময়ের জন্য এদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদের বন্দীতে অবরুদ্ধ  হবে।

এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর বোধোদয় অপরিহার্য। গুটিকয়েক উচ্চাভিলাসী প্রজ্ঞাহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হঠকারিতায় দেশের ১৮ কোটি মানুষ আবারো কারারুদ্ধ আর বাকরুদ্ধ হবেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি কেনো মেনে নেবে সাধারণ মানুষ?

তারা কি এই সরল সত্যটা বোঝেন না যে, পলাতক স্বৈরাচার এখনো পরাজয় মেনে নেয়নি, এখনো অনুতপ্ত নয় তারা, দেশের মধ্যে থাকা তাদের অবিবেচক আর অন্ধ অনুসারীরা এখনো সুযোগের সন্ধানে। তারা কি বোঝেন না যে- পি.আর পদ্ধতির নামের এই বিভক্তি আর গণ-পরিষদের দাবিতে বিপরীত অবস্থানের অনৈক্যের সুরে পাশের দেশে লুকিয়ে থাকা স্বৈরাচারের মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে!  তারা কি বোঝেন না ভিপি নূর রক্তাক্ত হলে কিংবা যমুনামুখী ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রদের মিছিল অবরুদ্ধ হলে সেই হাসি অকর্ন বিস্তৃত হয়। তারা কি বোঝেন না এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন আস্ফালন করে বলে, ফেব্রুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করা হবে, তারা যখন নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান- তখন স্বৈরাচারের হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হয়? 

প্রবাদ আছে ‘নিজের নাক কেটেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার’। আপনারা নিজেদের নাক কাটুন সমস্যা নেই, কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার গণতন্ত্রে উত্তরণের সুবর্ণ সুযোগ আগামীর নির্বাচনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করুন, দয়া করে গনতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রা ভঙ্গ করবেন না। একজন চিকিৎসকের ভুলে একজন রোগীর মৃত্যু হতে পারে, একজন প্রকৌশলীর ভুলে একাধিক মানুষের প্রাণ যেতে পারে, একজন পাইলটের ভুলে শত মানুষের মৃত্যু হতে পারে কিন্তু  একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভুলে ১৮ কোটি মানুষের অধিকারের মৃত্যু হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রের ভবিষ্যৎ কতো দীর্ঘ সময় মহাকাশের কালো গহ্বরের আড়ালে অন্তরীণ হয়ে থাকবে, সেটা হঠকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেটা দূর্বোধ্য নয়। আর তেমন হলে ইতিহাস তাদের কি পরিনতি নির্ধারণ করবে সেটা ইতিহাসের জন্য তোলা থাক কিন্তু জনগনের শিক্ষা কেমন হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য দিকে রাজনৈতিক দল গুলোর সামনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে এক মহিমান্বিত গনতান্ত্রিক উত্তরণে মহানায়ক হবার দূর্লভ সুযোগ। এখন  সিদ্ধান্ত আপনাদেরই নিতে হবে,  আগামীতে তারা মহানায়ক হিসাবে নন্দিত হবেন, নাকি আস্তাকুঁড়ের আবর্জনায় নিন্দিত হবেন।

লেখক : অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল

Monday, August 11, 2025

আরাফাত রহমান কোকো: এক নিভৃতচারী অমর ক্রীড়াশিল্পী

 



আরাফাত রহমান কোকো। পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। বাবার কর্মস্থল কুমিল্লায়। জন্মের পরপরই আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধে চলে যান বাবা। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। একটি স্বাধীন দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধকালে মা ও বড়ভাই তারেক রহমানের সাথে পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তার শৈশবের আখ্যান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তার জীবনের অন্যতম বড় ট্রাজেডি হলেও সেগুলো বিস্মৃতি হয়ে যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি বন্দিত্ব কিংবা মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ ও দেশের মানুষ তার একান্তই আপন। একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন আর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তাইতো নিভৃতচারী কোকো বেছে নিয়েছিলেন ক্রিড়া জগতকে। একজন রাজপুত্র, যিনি কিনা চাইলেই ক্ষমতার ভেতর থেকে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাষ্ট্র সংস্কারের পথ। দেশের ক্রিড়াঙ্গণকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রীড়াশিল্পীর মতো। 

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জীবনটা ছিলো বৈচিত্রময়। তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে যখন মুক্তি পান তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের সময় তার বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন এবং আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখনো তিনি মাত্র ছয় বছরের শিশু! এমনকী ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন তখন আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ১১ বছরের কিশোর! এই অল্প সময়ের মধ্যে কোকোর জীবনে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই বিয়োগান্তক। যার তার মনোজগতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। যদিও তিনি এসবের কিছুই সেভাবে কখনোই প্রকাশ করেনি। 

অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাক-হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয় বার ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ই জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়াতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান ঘটে।

আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচার বিমুখ। কোকো ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালীন ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে কাজ করে স্থাপন করেন অনন্য নজির।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কোকো ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মতো বিনয়! এ ধরনের বিনয় তার পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ্য করা যায়।

যেমন ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারতো। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন তিনি। কিন্তু কোকো তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমুলে বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। তিনি কখনো তার অধিকারের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাই পারফরমেন্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির পাইপলাইনের সূচনা হয় তার হাত দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপ লাইন তৈরি হয়েছিল এই ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। যার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।

আবহাওয়াজনিত কারনে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এইসময় অলস বসে থাকতেন। এই সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নেন কোকো। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এছাড়া ক্ষমতা থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন। 

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকেরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।

২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর ক্যারিশম্যাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও একদিনে পনেরটি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন, নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক। 

এক এগারোর পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তার ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায়-কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। 


গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহ’র মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন। একজন প্রচার বিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিলো। পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিলো বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সকল ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এই অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান 


Wednesday, June 11, 2025

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাজেট (২০২৫-২৬) বিষয়ক বক্তব্য


 
 
 
উপস্থাপনায়ঃ আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি।
তারিখঃ ৪ জুন ২০২৫
                                                               
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি বড় নীতিনির্ধারণী উপলক্ষ। পতিত স্বৈরাচারী সরকার অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ন্যায্য ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। জনগণের জীবনযাত্রার অগ্রাধিকার। একারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করে।
 
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সনের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রাম। বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। বাজেট রাজনৈতিক সরকারের জনগণ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়ন কাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ম্যাগনা কার্টা’ কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। যুক্তরাজ্যে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ কর ও ব্যয়ের উপর সংসদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। "প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়" - এই স্লোগান আমেরিকান বিপ্লবের ভিত্তি।
 
আমরা এক যুগান্তকারী নজির তৈরি করতে পারতাম।বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সর্বক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে।আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল সাথে আলোচনা করে নূন্যতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ করতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত এই বাজেট। কিন্তু সে সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হত না।নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।
 
বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংলাপ আরও জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ বাজেটীয় বছরের মধ্যেই নির্বাচিত সরকার আসবে। ওয়েস্টমিনস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী অনেক দেশেই "অন্তর্বর্তীকালীন শাসন সংক্রান্ত রীতিনীতি" আছে, যা বাংলাদেশে নাই। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হলে বা নতুন সরকারের সম্ভাবনা থাকলে বাজেট অনুমোদনের ভিন্ন পন্থা থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতি-কাঠামোর বড় ধরণের পরিবর্তন করে না। উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতিও দেয় না।
 
রাজনৈতিক সংলাপ হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দে বাস্তবসম্মত পুনর্বিন্যাস হত। স্বৈরাচারী সরকারের সীমাহীন জন-বান্ধবহীন নীতি-কাঠামো উদ্ভূত দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহের সংকট থেকে মুক্তির দিক নির্দেশনা থাকত। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ডবল ডিজিট, তা কমিয়ে ৬ দশমিক ৫% করার কথা বলা হচ্ছে যা বাস্তবসম্মত মনে হয়না। দারিদ্র বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ২৭ লাখের বেশি মানুষ আগের চেয়ে বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১৮ লক্ষ নারী। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এসময়ে দেশে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ্য হ্রাস পেয়েছে। বিবিএস এর হিসাব মতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৭%। সেটা এবারের বাজেটে ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬% যা পূর্বের সরকারের মতোই অবাস্তব এবং কাগুজে প্রবৃদ্ধি।  খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হল না।
 
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক। কৃষিতে দেয়া হয়েছে বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৯%, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৩% এবং শিক্ষায় ১৪%। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ ও স্কুলগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা যেত। আমাদের সময় ইনশাআল্লাহ্‌ শিক্ষার এ সকল ক্ষেত্রকে পুর্নাংগ কর মওকুফের আওতায় আনা হবে। এতে তরুণ সমাজের শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হত। সামাজিক সমতা ও মেধাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক হত। শিক্ষার দুর্বল ফলাফল ও তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ না থাকার বিশাল হার ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক। এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সম্ভব নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ আসে ৯৬% আভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। সেটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ না থাকায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছে না। তাই DFI নাই বললেই চলে। বাজেটও এ ব্যাপারে একেবারেই নিরব।
 
অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাগুলোর সমাধানে সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রয়োজন ছিল। প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল - বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ-নকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্প কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সাথে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।
 
ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমানো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস এবং ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ কমানোরও কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চিত ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হবেন।
 
অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বাড়ানোয় ডিজিটাল উদ্যোক্তারা চাপে পড়বেন। এই খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডিজিটাল রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তরুণ উদ্যোক্তাদের হতাশা বাড়বে। উদ্ভাবনও নিরুৎসাহিত হবে।
 
আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি। পুজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হত। সরকার ব্যাংক খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে। আয়কর স্লাবে কর হারের পরিবর্তন অধিকাংশ করদাতাদের উপর আরও অভিঘাত ফেলবে। কর ফাঁকি ও জালিয়াতি রোধ এবং কর জাল সম্প্রসারণ না করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরাবররের মত করের বোঝা সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জীবনযাত্রার মান কমছে।
 
অপ্রয়োজনীয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ বা সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফলাফল পর্যালোচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে রিভিউ বা রিনেগোসিয়েট করা যেতে পারে। এতে ব্যয় কমিয়ে জনকল্যাণে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে।
 
বিএনপি’র ১৮০ দিনের পরিকল্পনা
 
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মানুষের আস্থা অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি গড়তে প্রয়োজন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। গতানুগতিকতা ছেড়ে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। তাহলেই জাতির জন্য আশা, আস্থা ও পুনর্গঠনের দিগন্ত উন্মোচন হবে।
 
বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ১০০ দিনে কী কী কাজ করবে, তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে থাকে। জনগণের ক্ষমতায়নের দল হিসেবে বিএনপি বাংলাদেশে এমন একটি বাস্তবসম্মত সংস্কৃতি প্রবর্তন করতে চায়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথম ১৮০ দিনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করা হবে।
 
এই ৬ মাসের পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে বিএনপি কী-কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, আমরা সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। এখানে সার-সংক্ষেপ দেওয়া হল:
 
শিক্ষা ব্যবস্থা:
·         প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।
·         দেশের ও প্রবাসী শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। মূল লক্ষ্য হবে - প্রাথমিক পর্যায় থেকে বহু ভাষা, ক্রীড়া, কৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়নসহ বাস্তবানুগ বিষয়সমূহ শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।
·         সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্লাম্বিং, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্স, ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ইত্যাদির স্বল্পমেয়াদি ‘ট্রেড কোর্স’ চালু করা হবে।
·         শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করতে এপ্রেন্টিসশিপ, ইন্টার্নশিপ এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক স্থাপন করে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। ফলে শিক্ষার্থীগণ হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করবে এবং কর্মজীবনে ব্যপক হারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
·         জেলা পর্যায়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেটিভ বিজনেস আইডিয়া বাণিজ্যিকিকরণ করতে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় সিড ফান্ডিং বা ইনোভেশন গ্র্যান্ট প্রদান করা হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো - ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা তৈরি করা। তাঁরা নতুন এবং সৃজনশীল ব্যবসায়িক ধারণা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।
 
স্বাস্থ্য সেবা:
·         রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টিকাদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরির একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
·         স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্যানিটেশন এবং পুষ্টির উপর জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে।
·         চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্পেশালাইজড ট্রেনিং স্কিম শুরু করা হবে। তাঁরা রোগের দ্রুত সনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধে দক্ষ হয়ে উঠবেন।
·         নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী রিসার্ভার তৈরী করা হবে। জনগণ নিরাপদ পানি পাবে।
 
নারীর ক্ষমতায়ন:
·         প্রায় প্রান্তিক চার কোটি পরিবারের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ লক্ষ দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালু করা হবে। এই কার্ড মূলত পরিবারের নারী প্রধানের নামে ইস্যু করা হবে। তাদের প্রতিমাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা অথবা প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। এর মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে এবং পরিবারগুলো ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।
·         নারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধর্ষক-নিপীড়কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
·         নারীদের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে যেকোনো লাঞ্চিত নারীর জন্য প্রয়োজন মোতাবেক নারী ডাক্তার, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সর্বাঙ্গীন সহায়তা নিশ্চিত করবে।
·         নারীদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ডেভেলপমেন্ট ও মার্কেটিং সাপোর্ট প্রদান করা হবে।
 
শহীদদের স্বীকৃতি:
·         জুলাই গঅভ্যূত্থানে এবং ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সকল শহীদের তালিকা প্রস্তুত করে নিজ-নিজ এলাকায় তাঁদের নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা হবে। শহীদ পরিবারগুলোসমূহকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
·         গণঅভ্যুত্থানে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যেসব গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন তাঁদেরকেও স্বীকৃতি ও চাকুরীর সহায়তা প্রদান করা হবে।
 
কৃষি খাত ও গ্রামীণ উন্নয়ন:
·         কৃষকের নামে জমির পরিমাণ ও খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ‘ফার্মার্স কার্ড’ চালু করা হবে। বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য কমপক্ষে একটি মৌসুমি ফসলের জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদন খরচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষিজমি অনাবাদি থাকবে না। ভূমিহীনদের জন্যও কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
·         কৃষকের কাছ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে রাষ্ট্র ন্যায্যমূল্যের ভিত্তিতে সরাসরি উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং দেশব্যাপী কোল্ড স্টোরেজ তৈরির কাজ শুরু হবে।
·         কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে কৃষি খাতকে রপ্তানিমুখীন গড়ে তোলা হবে।
·         এলাকাভিত্তিক ডাটাবেস তৈরীর করা হবে। কৃষকের জমির ও উৎপাদিত ফসলের পরিমানের তথ্য-উপাত্ত নির্ণয় করে টার্গেটেড পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হবে।
·         বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। 
·         দেশব্যাপী খাল খননের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করা হবে। বন্যা ও খরা থেকে কৃষকদের সুরক্ষিত রাখার কর্মসূচি নেওয়া হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হবে।
·         ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
 
শিল্প খাত:
·         ১ ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনোমির রোড ম্যাপে FDI-GDP লক্ষ্যমাত্রা দশমিক ৪৫% থেকে ২ দশমিক ৫% নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপি। 
·         বিএনপি ২০৩৪ সালের মধ্যে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ১ ট্রিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করতে চায়।
·         জনগণের ঘাড় থেকে বাড়তি ট্যাক্সের লাগাম টেনে ধরা।
·         শিল্প খাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে। যেসব বিনিয়োগে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেই ধরণের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
·         বিনিয়োগ সহজ করতে, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সাপোর্ট নিশ্চিতের লক্ষ্যে "ওয়ান স্টপ সার্ভিস" বাস্তবায়ন করা হবে। 
·         নতুন শিল্প সৃষ্টির জন্য কৃষি, মৎস্য ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
·         পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল সহ আওয়ামী দুঃশাসনে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পসমূহের তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো পুনরায় চালুর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হবে।
 
তথ্যপ্রযুক্তি খাত:
·         ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী প্রোডাকশন ফেসিলিটি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনিং প্রোগ্র্যাম হাতে নেয়া হবে। তাঁরা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি করতে সক্ষম হবেন।
·         বাংলাদেশে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইত্যাদি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের অফিস খোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
·         ফ্রিল্যান্সার তরুণ-যুবকদের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে পেপাল এবং অন্যান্য পেমেন্ট মেথডসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
·         ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং ডাটা প্রসেসিংকে উৎসাহিত করার জন্য জেলা পর্যায়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নেয়া হবে।
 
প্রবাসী কল্যাণ:
·         প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিমানবন্দর সহ সকল ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।
·         প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সুযোগ ও প্রণোদনা দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে বিদেশের বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে গতিশীল করা হবে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ‘ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ার’ আয়োজনের মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছে বিনিয়োগ নীতিমালা, বিশেষ সুবিধাসমূহ ও ইকোনমিক ক্লাইমেট তুলে ধরা হবে। 
·         যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হয় সেসব দেশের কর্মসংস্থান চাহিদা বিশ্লেষণ করে স্কিল এবং ক্যাপাবিলিটির প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
 
নগর ব্যবস্থাপনা:
·         নারীদের সার্বক্ষণিক নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন রুটে ‘শুধুমাত্র নারী যাত্রী’ বাস চালু করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে ড্রাইভার ও সহকারী হিসেবেও নারীরা থাকবেন।
·         ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ট্রাফিক লাইটে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের পাশাপাশি ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, লেইন-ভিত্তিক যানবাহন প্ল্যান ইত্যাদি উদ্ভাবনী সমাধান বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে নগরীতে ট্রাফিকজ্যাম কমানো হবে।
 
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা:
·         ৫ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি বৃক্ষ রোপনের কর্মসূচি ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। তৃনমূল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি ও বৃক্ষমেলা আয়োজন করা হবে।
·         দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন এবং মহানগরের প্রতিটি থানায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা বাড়িয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নতি নিশ্চিত করতে গাছপালা রোপণ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি ‘গ্রিন এন্ড ক্লিন’ বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
·         পলিথিন নিষিদ্ধ করে পাটজাত ব্যাগকে উৎসাহিত করা হবে। সকল ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ ও ‘সাস্টেইনেবল প্রোডাক্ট’কে উৎসাহিত করা হবে। 
 
আইন-শৃঙ্খলা:
·         ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি সহ সকল নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। 
·         মাঠপর্যায়ে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং, কনসালটেশন, মোটিভেশন এবং মনিটরিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সেবামূলক মনোভাব বৃদ্ধি করা হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
 
কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
 
বিএনপি’র প্রধান অঙ্গীকার -  কর্মসংস্থান সৃষ্টি।সরকার গঠন করলে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে।
 
বিএনপির অতীতে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।  বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকাকালীন উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল - শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জনমানুষ এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। এর সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।
 
সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ৬-৭ শতাংশ ছিল।
 
সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, বিদেশে শ্রম রপ্তানি, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং,  সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।
 
বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ
 
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বিএনপি সরকার বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করবে। এই কৌশল কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে। নিম্নের ক্ষেত্রগুলিতে মনোনিবেশ প্রদান করবে:
 
নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো সহজীকরণ ও আমলাতান্ত্রিক বাধা কমানো: ব্যবসায় নিবন্ধন, কর আনুগত্য এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সিং চালু করা হবে। এসব পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের সময় ও খরচ কমাবে। এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং নারী নেতৃত্বাধীন ব্যবসার জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
 
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং স্টার্টআপগুলির জন্য অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি: বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা প্রসারিত করা হবে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হবে। ঋণদাতাদের ঝুঁকি কমাবে। অতিরিক্ত জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর ঋণ পাওয়া সহজ হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং ক্রাউডফান্ডিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করা হবে। স্টার্টআপ এবং উচ্চ-প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন ফার্মগুলিকে সাহায্য করবে।
 
অবকাঠামো ও শিল্প অঞ্চলে বিনিয়োগ: পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি সরবরাহ সহ দক্ষ অবকাঠামো গড়ে তোলা শিল্প বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এবং শিল্প পার্ক স্থাপন ও সম্প্রসারণ করবে। ফলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়বে। স্থানীয় শিল্পকে বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলায় সংযুক্ত হবে।
 
বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবন: পোশাক শিল্প রপ্তানিতে প্রধান ভূমিকা রাখলেও রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে মনোযোগ দেওয়া হবে। এতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমবে। উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করা হবে। গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা হবে। উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোড় দেওয়া হবে।
 
আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা শক্তিশালীকরণ: আর্থিক খাতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সাহসী সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন উন্নত করা হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো হবে। অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারের বিকশিত করা হবে।
 
ব্যাংকিং খাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজিকরনঃ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাড়ানোর মাধ্যমে ছোট ব্যবসার জন্য জামানতের ওপর নির্ভরতা কমানো হবে। নগদ প্রবাহ-ভিত্তিক ঋণকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পদ-ভিত্তিক ঋণের পরিবর্তে ব্যবসার পারফরম্যান্স এবং ডিজিটাল লেনদেনের ইতিহাস দেখে ঋণ দেওয়া হবে। বিশেষ করে খুচরা ও পরিষেবা খাতে এটি কার্যকর হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ খুলতে উৎসাহিত করা হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসার হয়রানি বন্ধ করতে ঋণ শ্রেণিকরণ ও আদায় পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। একই সাথে ব্যাংকের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং নারী পরিচালিত উদ্যোগগুলোতে পৌঁছাতে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাড়ানো হবে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হালকা প্রকৌশল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি  এবং নারী উদ্যোক্তাদের মতো উৎপাদনশীল বেসরকারি খাতে বাধ্যতামূলক ঋণ কোটা চালু করা হবে।
 
পুঁজিবাজার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ: তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে কঠোর স্বছতার নিয়ম এবং স্বাধীন নিরীক্ষা নিশ্চিত করা হবে। বিনিয়োগকারীর ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ শিক্ষা প্রচার, লেনদেন খরচ কমানো এবং হিসাব খোলা সহজ করা হবে। ডিজিটাল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে আধুনিকীকরণ, অনলাইন আইপিও সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফিনটেক প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কর্পোরেট বন্ডের জন্য একটি তারল্য বাজার তৈরি করতে পেনশন তহবিল, বীমা কোম্পানি এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।
 
আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণঃ  আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে: লিজ ও ফ্যাক্টরিংয়ের প্রসার ঘটানো, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগের জন্য আইনি ও আর্থিক কাঠামো তৈরি, প্রাইভেট ইক্যুইটি তহবিল সহায়তা, ইসলামিক আর্থিক পণ্য যেমন মুদারাবা ও ইজারা বিকল্পগুলো বাড়ানো, সবুজ বন্ড এবং ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স উপকরণ চালু, মোবাইল অপারেটর এবং ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে ডিজিটাল ঋণ প্রদান, ইত্যাদি।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কৌশল প্রণয়ন: প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর, জলবিদ্যুৎ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশের আদর্শ মিশ্রণ নির্ধারণ ও সিস্টেম-ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে। এই পরিকল্পনা কাঠামো হবে তথ্য-ভিত্তিক, আয়-ব্যয়-মডেলিং সমৃদ্ধ এবং জলবায়ু লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। চুক্তি এবং ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ জনসাধারণের কাছে প্রকাশে সচেষ্ট থাকবে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং সর্বসাধারণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ট্রান্সমিশন আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাইজেশনে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হবে। গ্রিড স্থিতিস্থাপকতা, স্মার্ট মিটারিং এবং আঞ্চলিক আন্তঃসংযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাপেক্সকে শক্তিশালী করে গ্যাস, খনিজ অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়া হবে। নবায়নযোগ্য ও সাশ্রয় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া হবে।
নীল অর্থনীতি: বঙ্গোপসাগরের বিশাল সামুদ্রিক সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে টেকসই সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রভিত্তিক শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন গবেষণা এবং উদ্ভাবন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। প্রধান খাতসমূহ: মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য, নৌপরিবহন ও বন্দর, অফশোর গ্যাস ও খনিজ সম্পদ, নবায়নযোগ্য শক্তি (সমুদ্র-বায়ু ও জোয়ার শক্তি), সমুদ্র পর্যটন ও বিনোদন এবং সমুদ্র গবেষণা ও প্রযুক্তি। কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত “ম্যারিটাইম জোন” ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হবে। সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ, মানচিত্রায়ন এবং সম্পদের প্রকৃত মজুদ নির্ধারণ করা হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পদ্ধতিতে সম্পদ আহরণ ও অর্থনৈতিক ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
সৃজনশীল শিল্প অর্থনীতি: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। ডিজিটাল অবকাঠামোও বাড়ছে। কিন্তু সৃজনশীল অর্থনীতি জিডিপিতে ০.৫ শতাংশেরও কম অবদান। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে এই খাত ৩-৫ শতাংশ অবদান রাখে। এই খাতের মধ্যে রয়েছে: চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নির্মাণ, সঙ্গীত ও মঞ্চ শিল্পকলা, অ্যানিমেশন, ভিএফএক্স ও গেমিং, মেকআপ, পোশাক এবং নকশা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিষয়বস্তু তৈরি, সিজিআই এবং ক্রিয়েটিভ মিডিয়া সেবাদাতা সফটওয়্যার কোম্পানি, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনফ্লুয়েন্সার অর্থনীতি ইত্যাদি।
বাণিজ্য সহজীকরণ ও শুল্ক পদ্ধতি উন্নয়ন: শুল্ক পদ্ধতি সহজ হলে এবং বাণিজ্য বাধা কমলে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াবে। শুল্ক শ্রেণিবিন্যাস ডিজিটাইজ করা হবে। আমদানি প্রক্রিয়া, বিশেষ করে মূল কাঁচামালের জন্য ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর করবে। ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে।
 
ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি: ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রসার অর্থায়নের সুযোগ বাড়াবে। এটি বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ লেনদেনসীমাসহ মার্চেন্ট ওয়ালেটের জন্য মোবাইল আর্থিক সেবা সক্রিয় করতে প্রোটোকল স্থাপন করা হবে। এটি পাইকারি লেনদেন সহজ করবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল পেমেন্টও সহজলভ্য করবে।
 
কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও সামাজিক দায়বদ্ধতা উন্নতকরণ: শক্তিশালী কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুশীলনে জোড় দেওয়া হবে। ফলে বেসরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে উৎসাহিত করা হবে। ফলে সমন্বিত প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এগুবে।
 
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শক্তিশালীকরণ: কার্যকর পিপিপি নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি। অবকাঠামো ও সরকারি সেবায় বেসরকারি বিনিয়োগ জোগাড়ের উদ্যোগ নেয়া হবে। এই সহযোগিতামূলক পদ্ধতি সেবা প্রদান উন্নত করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল হবে।
 
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও সবুজ প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জলবায়ু সহনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম (বিসিডিপি) এর মতো প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা হবে। জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা নেয়া হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাত একত্রে কাজ করবে।
 
ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি
 
রাজস্ব চাপ, মুদ্রানীতি কঠোরীকরণ এবং আর্থিক ভঙ্গুরতার কারণে সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি বিদ্যমান। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন, কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতা-ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নের পথে গ্রহণ করা হবে। বিএনপি ঋণের বোঝা কমাতে ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির কৌশলও নির্ধারণ করেছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলঃ
 
ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল: সরকারি ঋণের গঠনগত উন্নয়ন ও ঋণ সংগ্রহের ব্যয় হ্রাস বিষয়ক ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল (এমটিডিএস)’ প্রণয়ন করবে। সুদ পরিশোধের বোঝা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রোলওভার ঝুঁকি কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করবে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে সরকারি ঋণ সংগ্রহকে অনুকূলিত করে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ সংকোচন বন্ধ করবে।
 
ব্যয় অগ্রাধিকরণ ও দক্ষতাবৃদ্ধির কৌশল: অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ভর্তুকি যুক্তিসঙ্গতকরণ করা হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কাঠামো গঠন, নতুন প্রকল্পের জন্য কঠোর ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ নির্দেশিকা এবং কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক বাজেটিং পদ্ধতি প্রণয়ন করা হবে।
 
স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাসঃ স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে সরকারের দায়ের পরিমাণ কমানো হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারি খাতের ঋণগ্রহণের হার কমিয়ে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করা হবে।
 
ঋণ-উন্নয়ন-বিনিময় কৌশলঃ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে বৈদেশিক ঋণকে স্থানীয় বিনিয়োগে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। রূপান্তরিত অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিযোজন বৃদ্ধি, শিক্ষা অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরির মত জনহিতকর কাজে ব্যবহার করা হবে। এতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে সৃষ্ট বৈদেশিক সাহায্যের হ্রাসজনিত ফারাকও কমাবে। একদিকে বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমবে, অন্যদিকে সম্পদ সরাসরি টেকসই ও সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি তৈরির চালিকাশক্তিতে নিয়োজিত হবে।
 
অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়াঃ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে গৃহীত সকল ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের অনুরোধ জানানো হবে।
 
রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ: এনবিআরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হবে। নীতি প্রণয়নের কাজ করতে বর্তমানের শুল্ক ও বাণিজ্য কমিশনকে আওতাভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ কর ও শুল্ক কমিশন’ নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়া হবে।
 
কর কোড আধুনিকায়নঃ প্রত্যক্ষ করকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘কর কোড’ আধুনিকায়ন করা হবে। সহজীকরণ এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন করে করের আওতা বাড়ানো হবে।
 
প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা: প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা তথা বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক লেনদেন, ভূমি রেকর্ড ইত্যাদি একীভূত করে কর সনাক্তকরণ ড্যাশবোর্ড চালু, বন্ডেড গুদামের জন্য ব্লকচেইন-ভিত্তিক ট্র্যাকিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ঝুঁকি মূল্যায়ন জালিয়াতি রোধে সহায়ক হবে।
 
সবুজ কর কাঠামো: উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পের ওপর কার্বন কর আরোপ করা হবে। উক্ত রাজস্ব জলবায়ু অভিযোজন তহবিলে যাবে।
 
কার্যকর ট্রান্সফার প্রাইসিং আইনঃ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাস্টার ও স্থানীয় নথি জমা এবং দেশওয়ারি রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা হবে। মুনাফা স্থানান্তরের ওপর কঠোর জরিমানা আরোপ করা হবে।
 
বাজেট প্রক্রিয়ার সংস্কার
বাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। জবাবদিহিতা এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও করা হবে। সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, নির্বাচনপূর্ব কেয়ারটেকার সরকারের জন্য পরিষ্কার নির্দেশিকাসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

Friday, December 6, 2024

আওয়ামী লীগের আমলনামা: নিপীড়নেও অটুট অভীষ্ট লক্ষ্য



২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল আগের বছরের ২২ জানুয়ারি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেওয়ার দুদিন আগে আওয়ামী লীগ লগি-বইঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে। দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে দলীয় ক্ষমতার স্বার্থে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই যে ‘চক্রান্ত’ তা কীভাবে স্পষ্ট হলো?


আওয়ামী লীগের তথাকথিত সেই ‘আন্দোলনের উসিলা’য় সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ‘জাতিসংঘের এক চিঠির’ কথা বলে নির্বাচন বাতিলের সুযোগ তৈরি করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি। এই জরুরি আইনে সরকার সমাজে পরিচয় পায় ‘এক-এগারো’র সরকার নামে।


সেই কথিত ১/১১ সরকার তখন কী করেছে; কতটা দেশের কল্যাণে; আর নিজেদের প্রয়োজনে; এখনও জনগণের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আছে। এই ‘এক-এগারো’ সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সমঝোতা করেন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করেন তিনি।


এরপর থেকে ২০২৪ সাল ৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম, নিপীড়ন, গণহত্যা, গুম, হামলা-মামলা, ফরমায়েশি রায়ে সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন শেখ হাসিনা। আর মাঝে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ৪০ বছরের বাসভবন থেকে এক কাপড়ে জোরপূর্বক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বের করে আনা হয়। ব্যবহার করা হয় আদালতকে।


২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে প্রায় কয়েক যুগের ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো; যার থেকে উত্তরণের জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন গণমানুষের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।


আওয়ামী লীগের আমলনামা: গুম-খুন, ক্রসফায়ারের রাজত্ব


২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ফরমায়েশি রায়ে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। কোন কারাগার? পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের সেই পুরাতন, জংধরা, শ্যাওলাজমা বিচ্ছিন্ন এক পরিত্যক্ত কারাগার, যেখানে কয়েদি কেবল দেশনেত্রী একা। সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বেগম জিয়াকে জেলবন্দি করে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা মঞ্চায়ন করেন ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতারণাময় রাজনৈতিক চক্রান্ত।


এই প্রতারণায় উল্লেখযোগ্য ২০১৮ সালের ১ ও ৭ নভেম্বর গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের অনুষ্ঠিত সংলাপে সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা দেন শেখ হাসিনা। আর সংলাপের এক মাস না যেতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে (৩০ ডিসেম্বর) পুরো জাতি দেখলো রাতের অন্ধকারে কীভাবে মানুষের ভোটের অধিকার ডাকাতি করে নেওয়া হলো। শেখ হাসিনার এই চক্রান্তের রাজনীতি থেমে থাকলো না; পাশাপাশি চলছিল বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর অত্যাচারের নানামাত্রিক শোষণ।


রাজধানীসহ দেশের মানুষ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর সাক্ষী হয়ে গেলেন- কী নিখুঁত ও নির্মম পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে, মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে বিএনপির একটি জাতীয় মহাসমাবেশকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিনষ্ট করা হয়েছে। শত শত আহত, কয়েকজন শহীদ, রাতারাতি থানায়-থানায় মামলা।  রাতের মধ্যে মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার।  দুই দিনের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার।


ফ্যাসিজম নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা; ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ বানচাল করার পর টার্গেট করলেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের; ২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে নিরঙ্কুশ করতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল শক্তিশালী বিএনপি নেতাকে জেলে পুরে দেওয়া হলো।  


আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের অধিক সময়ে, ৫৮ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করে ১ লাখ ৫২ হাজার মামলা দেওয়া হয়।  প্রায় ২ হাজার নেতাকর্মীকে ফরমায়েশি রায়ে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এই হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্য থেকে নেওয়া।


দেশের এমন কোনও জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন সিরাজ শিকদার। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ওই ঘটনার বর্ণনা তখনকার একজন পুলিশ সদস্য দিয়েছিলেন।


এরপর পরবর্তী সময়ে ‘একই গল্প’ বলে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০০৪ সালে দেশে ক্রসফায়ারের বিষয়টিকে অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে আলোচনায় আনে ‘একটি গোষ্ঠী’।

 

রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল আলোচিত অপরাধী বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং প্রতিপক্ষকে দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।  


‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। এসব ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলেও গণমাধ্যমে এসেছে।


যার একটা বড় নজির ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা। র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ১১ জন র‌্যাব সদস্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব খুনে জড়ান।


ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমে পর্যালোচনা এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যারা ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন, তাদের ২৩ ধরনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত।


নিহতদের নামের পাশে পরিচয় হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নাম এসেছে।  তবে বেশির ভাগ নামের পাশে রয়েছে  ‘সন্ত্রাসী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বন্দুকধারী’ বা ‘অস্ত্রধারী’, ‘মাদক কারবারি’, ‘জলদস্যু’, ‘বনদস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘ছিনতাইকারী’, ‘মামলার আসামি’, ‘চরমপন্থি’ ইত্যাদি। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকেও এসব পরিচয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা হয় বলে অভিযোগ পারিবারিক ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে।  


ক্রসফায়ারের একটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছিল ২০১৮ সালে। ওই বছরের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করা তালিকায় তার পরিচয় লেখা হয় ‘মাদক ব্যবসায়ী'।


হত্যা করতে নেওয়ার সময় একরাম তার মেয়েকে ফোন করেছিলেন। সেই কল কাটার আগেই একরামকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করা হয় পুরো সময়টায় ফোন কল চালু ছিল। পরে সেই কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে একরাম ও তার মেয়ের শেষ কথা, কান্না, গাড়ি থেকে নামানোর শব্দ, তারপর গুলির শব্দ মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।


২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে যা আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, এখানে নিহত হন ২৯১ জন।


খুলনা, সেখানে নিহত হয় ২৬০ জন। রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচার ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হয়।  এই সময়ে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই কোনও না কোনও সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা কক্সবাজারে।


রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা আলোচিত কাউকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন নেওয়া হতো। নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারের ২৪১টি ঘটনায় ৩০৭ জন নিহত হন।


বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেড়ে যায়।


আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ১২৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়। যা আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু, এর আগে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৫ জন। মাঝের বছরগুলোতে ২০১০ সালে ৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২ জন, ২০১২ সালে ৫৮ জন ও ২০১৩ সালে ৪২ জন নিহত হন।


ক্রসফায়ার ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিপক্ষকে দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। এ জন্য নির্বাচনের আগে-পরে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্যে বলেছেন- ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারসহ নানা উপায়ে বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একদলীয় বাকশাল শাসন ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা।’


২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে নিষেধাজ্ঞা দিলে ক্রসফায়ার বন্ধ হয়। যদিও ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল জার্মান রেডিও ডয়চেভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চার মাস পর ১৮ এপ্রিল কুমিল্লায় ক্রসফায়ারে নিহত হন রাজু নামে একজন, যিনি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যার আসামি ছিলেন।


নিপীড়নেও অটুট অভীষ্ট লক্ষ্য


শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকারের ক্রমাগত নিপীড়নের মধ্যেও জীবন আর জীবিকার সংগ্রাম করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। কেবল শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পাড়ি দিয়েছে নদী, খাল; পুলিশের তাড়ায় কেউ হয়েছে হত। তবু লক্ষ্য ছিল অবিচল। কারাগার ও নিত্যনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য অটুট অবস্থানে দেখিয়েছেন মা, মাটি ও মানুষের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।


আর তাই ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পলায়নপর পতনের মধ্য দিয়ে তৈরি হলো বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন আর সম্ভাবনা।


যে স্বপ্ন আর সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই আট হাজার মাইল দূর থেকে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির রেখে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং দিয়েছেন। রাজপথে সরাসরি সক্রিয় থেকেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮৪ মামলার আসামি হয়ে চারশ’ দিনের বেশি সময় কারাগার ভোগ করেন। ৮ বারের বেশি গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের এসব ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আস্থার মধ্য দিয়েই ‘১-দফা’ যুগপৎ আন্দোলনে রূপলাভ করে। যা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।


এবার ‘৩১-দফা’ রাষ্ট্র সংস্কার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নাগরিকরা বিশ্বাস করেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন।


লেখক: শায়রুল কবির খান

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সদস্য- বিএনপি মিডিয়া সেল ও বিএনপি চেয়ারপারসন প্রেস উইং