প্রায় দেড় যুগ আগের ১/১১-এর পটপরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটি ক্ষত, যে ক্ষত সময়ের প্রবহমানতায় জন্ম দিয়েছিল এক স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার।
বিশ্বের ইতিহাসে এমন দেশপ্রেমহীন স্বৈরাচারের নজির আর একটিও বোধ করি আর নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি এবং পরিতাপের বিষয় হলো— যারা ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই ওয়ান ইলেভেনের জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা সবচেয়ে ঘৃণিত। যাদের মধ্যে রিটায়ার্ড জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও রিটায়ার্ড লে. জে. মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা প্রায়শই ভুলে যান, বৃটিশদের শত ষড়যন্ত্রের পরেও নবাব সিরাজ-উদ দৌল্লাকে এখনো জাতির কাছে বীরতুল্য আর অপরদিকে মীর জাফর একটি ঘৃণ্য নাম।
বিগত ১/১১-এর কুশীলব কে বা কারা, এদের সহযোগী মিডিয়া পার্টনার এবং প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নতুন করে তেমন কিছু বলবার নেই। কেননা সচেতনজন মাত্রই এই বিষয়ে কমবেশি ওয়াকিবহাল। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো— অনুমান করা যায় বিএনপি’র কিছু নেতৃত্বও জড়িত ছিলো যেটি প্রমাণিত হয় ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং শমসের মবিন চৌধুরীর মতন সুবিধাভোগীদের লজ্জাহীন কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে।
এছাড়া আরো অনেকেই এই জঘন্য ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন বলে সুস্পষ্ট অনুমান করা যায়।
মোটাদাগে বললে, ২০০১ পরবর্তী জোট সরকারের সময়ে দেশের দু’টি প্রধান পত্রিকা ও পত্রিকা দু’টির আলোচিত সম্পাদকেরা যোগসাজশে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় মূলত তারেক রহমান বিরোধী অপপ্রচার শুরু হতে থাকে।
এই অপপ্রচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ার এবং প্রতিবেশী দেশের হাইকমিশন।
বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিএনপি’র চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কখনোই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর খড়গহস্ত হননি। শুধু তাই নয় কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে যেসকল কার্টুনচিত্র আঁকতেন! সেগুলোকেও ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেন। কেননা তারেক রহমান পূর্বেও মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন— সমালোচনা হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
অদ্ভুত বিষয় হলো— আওয়ামী সফ্ট পাওয়ারের অংশ কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য কিন্তু ২০০৮ পরবর্তী সময়ে আর কার্টুন বা ব্যাঙ্গচিত্র খুব একটা আঁকতে পারেননি; চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তার সন্তান সন্ততি তো দূরের বিষয়।
২০০১ সালে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকে খুব একটা স্বস্তির ভেতর ছিলো না। দিল্লির ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয় এদেশের প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। এই অস্বস্তিকে বাড়িয়ে তোলে বিএনপি’র কোনো কোনো সিনিয়র নেতার তারেক রহমান বিরোধী অবস্থান। এই বিরোধিতাকে অধিকতর স্পর্শকাতর করে তোলে কল্পিত হাওয়া ভবন ন্যারেটিভ।
মিডিয়ার সহায়তায় অনেকেই এই হাওয়া ভবন ন্যারেটিভকে সত্যি বলে ভাবতে শুরু করে আর বিপত্তির শুরু হয় সেখানেই।
অথচ ওয়ান ইলেভেনের পর দেশনেত্রী বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি গ্রহণযোগ্য দুর্নীতির মামলা দিতে পারেনি ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী অনির্বাচিত সরকার। কিন্তু তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় বচন তারা জারি রেখেছে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে পতনের পূর্ব মুহুর্ত অব্দি।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু বাস্তবতা হলো বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নামে দেশের বাইরে নামে বেনামে কোনো সম্পত্তি নেই। এমনকি টাকা পাচার কিংবা ব্যাংক লুটের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতাও কেউ প্রমাণ তো দূরের কথা খুঁজে বের করতেও পারেননি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য প্রমাণহীন বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত কথিত দুর্নীতি মামলার রায়ে সাজা না দেয়ায় বিচারক মোতাহার হোসেনকে হতে হয় দেশান্তরী।
প্রকৃত জাতীয়তাবাদীদের কাছে দেশ হলো মা ও মাটি। দেশ হলো জন্ম ও জন্মান্তরে তাদের শেষ গন্তব্য। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য পূর্বোক্ত কথাটি এক অমোঘ সত্য বলে বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টেমস নদীর তীরে নির্বাসনে থেকেও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ন্যায় বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাঁর দেড় দশকের নিরলস সংগ্রাম গত ৫ আগস্টের সফল বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইতোমধ্যেই আলোর মুখ দেখেছে।
শুধু তাই নয় তারেক রহমানের বক্তব্য দিকদর্শী এবং সুস্পস্ট বক্তব্য দিনকে দিন যে বিষয়টিকে আলোয় এনেছে। সেটি হলো— তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রোপাগাণ্ডা ছিল, সেটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা এবং ওয়ান ইলেভেন ছিল— বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডার বাই প্রোডাক্টই শুধু নয় বরং ওয়ান ইলেভেন ছিলো দেশের স্বার্বভৌমত্ব হরণের সূচনা।
অতি সম্প্রতি তারেক রহমান ৩১ দফার ওপর যে আলোকপাত করেছেন, সেটি ইতোমধ্যেই সুধীজনের সুদৃষ্টি কেড়েছে।
যারা একসময় তাঁর বৈরী সমালোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই আজ বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে শুভাকাঙ্ক্ষী সুলভ প্রশংসা করছেন।
এই বিষয়টি তারেক রহমান, বিএনপি ও বাংলাদেশ সকলের জন্যই ইতিবাচক ও ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগানিয়া বলেই বিবেচনা করি আমরা।
পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত দেড়যুগে বাংলাদেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক তারেক রহমানের মতো সৎ ও যোগ্য দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব।▫️
▪️ লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামসুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অবঃ); সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
No comments:
Post a Comment