অনিল চট্টোপাধ্যায়, নতুন
দিল্লি / dw.com
বাংলাদেশের পরিবেশকামী
জনগণের বিরোধীতার মুখে রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারতের সরে আসা উচিত বলে মনে
করছে ভারতের পরিবেশবাদীরাও৷ এতে সুন্দরবনের সংবেদনশীল পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে,
অভিঘাত পড়বে জনজীবনেও৷
ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ
বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের যৌথ উদ্যোগে কয়লা-ভিত্তিক এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে এখন
দেখা দিয়েছে ঘোর বিতর্ক৷ ভারতের পরিবেশবিদ শায়ন চৌধুরির অভিমত, বাংলাদেশের সুন্দরবনের
মতো সংবেদনশীল এলাকায় প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে বিশ্ব
হারাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য৷ শুধু রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসভূমিই
নয়, সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির জৈব-চেন, যা পরস্পরের সঙ্গে শৃঙ্খলাবদ্ধ৷
সেই চেন বা শৃঙ্খল যদি একবার নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সব জৈববৈচিত্র্যই বিপন্ন হয়ে পড়বে৷
ইকো-সিস্টেম সুরক্ষিত রাখতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ আজ একটা আন্তর্জাতিক
ইস্যু৷ উন্নয়ন বা দেশের আর্থিক বিকাশের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা হলো জীবনের
প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বা সংবেদনশীলতার প্রশ্ন৷ মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ছে৷
শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভবিষ্যত জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারতেও চলছে কয়লা-ভিত্তিক
তাপবিদ্যুৎ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন৷ এর বিকল্প হিসেবে জোর দেওয়া উচিত সৌরবিদ্যুৎ,
বায়ুবিদ্যুৎ এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির ওপর৷
ভারতের মধ্যপ্রদেশের গজামারা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
স্থাপনে জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশনকে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরোধিতায় অনুমতি দেয়নি রাজ্য
সরকার৷ তাঁদের আশঙ্কা, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত উড়ন্ত ছাই, কয়লা
গুঁড়ো, বিষাক্ত গ্যাসে আশেপাশের কৃষিজমির একটা বড় অংশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷
একই বিতর্ক ছত্তিশগড় রাজ্যেও৷ ঝাড়শুকুদা জেলার লখনপুরে প্রস্তাবিত চার হাজার মেগাওয়াটের
অতিকায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার দাবি উঠেছে৷ তাঁদের আশঙ্কা, মহানদীর জল নেওয়া
হলে দেখা দেবে জলাভাব৷ স্থানীয় জনজীবনে দেখা দেবে বিপর্যয়৷
শুধু তাপবিদ্যুতের প্রল্পই
নয়, ভারতে পরামাণু বিদ্যুৎ নিয়েও একই সমস্যা৷ স্থানীয় বাসিন্দারা এবং পরিবেশ সংস্থাগুলির
আন্দোলন ক্রমশই জোরদার হয়ে উঠছে৷ বছর দুই আগে ফরাসি সহযোগিতায় মহারাষ্ট্রের জাইতাপুরে
প্রস্তাবিত প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ
বিক্ষোভ সহিংস হোয়ে উঠলে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে একই কারণ দেখিয়ে
রাজ্য সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে৷ জাপানের ফুকুশিমা
পরমাণু কেন্দ্রের বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে জনজীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অসামরিক পরমাণু
বিদ্যুৎ দপ্তরের বিরুদ্ধে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয় সুপ্রিম কোর্টে৷ তাপবিদ্যুৎ
বা পরমাণু বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সরকারের পরিবেশ রিপোর্টের নিরপেক্ষতার দিকেও আঙুল উঠেছে৷
বাংলাদেশের রামপাল যৌথ
বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো শ্রীলঙ্কাতেও ভারতীয় সহযোগিতায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের
পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয়েছে বিতর্ক৷ কারণটা একই, সেই পরিবেশ-দূষণ৷ এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কা
সরকার দ্বিধাবিভক্ত৷ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, পরিবেশগত দিক থেকে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প
বাঞ্ছনীয় না হলেও দেশের আশু প্রয়োজনে তা বাতিল করা যায় না৷ বিপক্ষবাদীদের বক্তব্য,
কয়লার বদলে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন? সরকারের যুক্তি,
সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে৷ ফলে সরকারকে দিতে হবে বিরাট ভরতুকি সেটা বহন করা
কঠিন হবে৷
ভারতের নাগরিক সমাজ কী বলছে? পরিবেশ সচেতন অনেকেই
মনে করছেন ঘরে-বাইরে যখন এই নিয়ে এত গণঅসন্তোষ, তখন বিদেশের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে
ভারত সরে আসছে না কেন? ভৌগলিক দিক থেকে সুন্দরবনের একটা অংশ ভারতের৷ বাংলাদেশের সুন্দরবনে
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে তার অভিঘাত অবধারিতভাবে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে এসে
পড়বে৷ তা সত্ত্বেও ভারত এই প্রকল্পে এত আগ্রহী কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে যে অন্য কোনো
স্ট্র্যাটিজিক কারণ আছে? বৈদেশিক সুসম্পর্কের ভিতটা তাহলে কি আলগা হয়ে যাবে? যদি তাই
হয়, তাহলে ইকো-সিস্টেমের নির্দেশিকা মেনে তা করা হচ্ছে না কেন? সুন্দরবন থেকে ২৫ কিলোমিটারের
বেশি দূরত্বে তা করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয় বলেই মনে করছে ভারতের পরিবেশবাদীরা৷
সুন্দরবনের গায়ে রামপাল
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে আরও অনেক ক্ষতিকর দিক আছে৷ ১০ লাখেরও বেশি গরিব পরিবারের
জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল সুন্দরবনের ওপর, যাঁদের একটা বড় অংশ মত্সজীবি এবং বনসম্পদ
আহরণকারী৷ যেমন মধু, ঘাস, পাতা ইত্যাদি৷ সুন্দরবনের বাদাবন, সামুদ্রিক তুফান এবং জলোচ্ছ্বাস
রোধে এক প্রাকৃতিক বর্মের কাজ করে৷ শুধু তাই নয়, সুন্দরবনের খাঁড়িগুলি বিভিন্ন প্রজাতির
মাছ এবং জলজ প্রাণীর আঁতুড় ঘর, যা বিলুপ্ত হবার আশংকা অমূলক নয়৷