সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনার
দিকে নজর দেয়া যাক৷ রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন অনেকে৷ তাদের
মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন
পরিবেশবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট, এমনকি বামদলের সমর্থকসহ অনেকে৷ আবার রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের
পক্ষে সোচ্চারদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় সমর্থকসহ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত
নন এমন মানুষও৷ এই দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্কটা কি গঠনমূলক হচ্ছে?
ক্ষমতাসীনদলের সমর্থকরা
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারীদের ফেলছেন ‘ভারত বিরোধীদের' তালিকায়৷ তাদের
যুক্তি হচ্ছে ভারতের বিরোধীতা করা উদ্দেশ্যে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের
বিরোধিতা করছেন অনেকে৷ অথচ যারা বিরোধিতা করছেন, তারা সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন কারণ দেখাচ্ছেন
, সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করছেন, যেগুলোর সঠিক উত্তর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দিচ্ছে না৷
উল্টো সরকারের সমর্থকরা নানাভাবে বিরোধিতাকারীদের দেশের উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দিয়ে
‘জঙ্গিবাদ ইস্যু' থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করা হচ্ছে বলেও দাবি করছেন৷ আর এ সব দাবি, বিতর্ককে নিয়ে
যাচ্ছে অসুস্থ পর্যায়ে৷ কেননা ‘ভারত বিরোধিতা' বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বড় ইস্যু৷
ফলে সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলনটাকে পুরোপুরি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের চেষ্টা
হিসেবে প্রমাণ করতেই বলা হচ্ছে ভারত বিরোধীরা এটা করছেন৷
কল্যাণপুরে পুলিশের রেইডে
নয় সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহতের ঘটনার পরও একইরকম অবস্থা দেখা গেছে৷ যারা এই রেইডের বিভিন্ন
দিক নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, তাদের সেসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়ার বদলে পুরো ব্যাপারটি
নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেশপ্রেম, আবেগের দিকে৷ বলা হয়েছে, ‘কোনো পুলিশ মারা যায়নি' বলে
রেইড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যারা প্রশ্ন তুলছেন তারা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি,
এমনকি জঙ্গিদের সমর্থক! অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতার
ব্যাপার রয়েছে৷ সুতরাং সেখানে কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটার উত্তর দেয়াটা তাদের
দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে৷ সেটা না করে, যারা প্রশ্ন তুলছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন
তোলাটা বিতর্ককে অসুস্থ পর্যায়ে নিয়ে যায়৷
গত পহেলা জুলাই গুলশান
হামলার পর দু'জন জিম্মিকে নিয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন তোলা হয়৷ বাকি জিম্মিরা মুক্ত জীবনযাপন
করলেও সেই দু'জন কোথায় আছে, তা এখনো তাদের পরিবার জানে না৷ পুলিশ ঘটনার সপ্তাহখানেক
পরে জানিয়েছিল, জিম্মি দু'জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷ তারপর জানিয়েছে, তাদের ছেড়ে
দেয়া হয়েছে৷ সর্বশেষ সোমবার জানিয়েছে, তারা কোথায় আছে পুলিশ তা জানে এবং যে কোনো
সময় চাইলে তাদের আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে৷ এখন কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, এই দু'জনকে
নিয়ে এত নাটক না করে পুলিশ তাদের অপরাধী মনে করলে গ্রেপ্তার করে আদালতে তুলছে না কেন?
আর নিরাপরাধ মনে করলে মুক্ত ঘোষণা করছে না কেন? সমস্যা হচ্ছে, এই প্রশ্ন যিনি করবেন,
তিনি হয় ‘দেশবিরোধী' অথবা ‘জঙ্গিদের সমর্থকদের' তালিকায় পড়বেন৷ অথচ সচেতন পাঠকমাত্রই
বুঝবেন প্রশ্নটা মোটেই অবান্তর নয়৷ কেননা অপরাধীর বিচার করার দায়িত্ব আদালতের, পুলিশের
নয়৷
আসলে স্বাধীনতার ‘সপক্ষের'
বা ‘বিপক্ষের' শক্তি আখ্যা দিয়ে সব মানুষকে বিচার করা যেমন যায় না, তেমনি ‘আওয়ামী লীগ'
বা ‘বিএনপি-জামায়াত' দিয়েও সবাইকে বিবেচনা করা সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশের অনেক মানুষ কোন
রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন না৷ তারা যে কোনো ইস্যুতে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করার
চেষ্টা করেন৷ আর সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই কেউ ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের
শক্তি' বা ‘বিরোধী দলের প্রতিনিধি' হয়ে যান না৷ বরং সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয়ে
পরিচিত করার চেয়ে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিলেই মঙ্গল, অন্তত আমি সেটাই মনে করি
No comments:
Post a Comment