Search

Thursday, August 22, 2019

আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির যত দায়

সায়ন্থ সাখাওয়াৎ

‘চামড়ার দাম নেই। মানুষ রাগে ক্ষোভে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ পুঁতে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। কেউ ফেলে দিয়েছেন রাস্তায়। আশ্চর্যের বিষয়, এখনো সরকারের বিশিষ্টজনেরা বলে দেননি যে, এটা গুজব বা এটা বিএনপির ষড়যন্ত্র! তবে এখনো বলেননি বলেই যে বলবেন না তেমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। এখনো সে সময় ফুরিয়ে যায়নি। এই সরকারে ক্রিয়েটিভ ব্রেইনের যে পরিমাণ কালেকশন! তারা যে কোনো সময় এই চামড়া কেলেঙ্কারির দায়ও বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেই পারেন।
এই কথাগুলো লিখেছিলাম ১৮ আগস্ট দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত কলামে। যদিও লেখাটা পাঠিয়েছিলাম আরও চারদিন আগেই, ১৪ আগস্ট। শোক দিবস ও শুক্রবারের আয়োজনের নিচে চাপা পড়েছিল লেখাটা। লেখা প্রকাশিত হওয়ার দিনই দেখা গেল, মুখ খুলেছেন তারা। যা ভেবেছিলাম তাই বলেছেন। তবে প্রায় একটা সপ্তাহ যে অপেক্ষা করেছেন এই থিওরি দিতে সেটাও কম ধৈর্যের ব্যাপার নয়!


কোরবানির চামড়া নিয়ে একজন মন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন, কোরবানির চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া ও পুঁতে ফেলার পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র ছিল। তবে তাতেও বরাবরের মতোই বিএনপি ফেল করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, চামড়াশিল্প নিয়ে বিএনপির অপরাজনীতি সফল হয়নি। ব্যাপারটা আরও খোলাসা করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেছেন, বিএনপির লোকজন চামড়া কিনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। তিনি আরও বলেছেন, এক কোটির মধ্যে মাত্র ১০ হাজার চামড়া অবিক্রীত থেকেছে এবং চামড়া বিষয়ক সংকট নাকি কেটেও গেছে।

এটা কী বললেন তিনি! মাত্র ১০ হাজার চামড়া অবিক্রীত? তাহলে পত্রিকাগুলো কি ভুল লিখল? ভুল তথ্য প্রচার করল টিভি চ্যানেলগুলো? সংবাদমাধ্যমেই তো এসেছে, বিক্রি করতে না পেরে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় লাখখানেক কোরবানির পশুর চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা  সড়কে ফেলে দিয়েছেন। সিলেটেও কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন সিলেট নগরীর কোরবানিদাতারা ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। পরে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২০ ট্রাক চামড়া ময়লার সঙ্গে সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্পটে পুঁতে ফেলেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। ন্যায্য দাম না পেয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে কোরবানির পশুর ৯০০টি চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর হোসাইনিয়া হাফিজিয়া আরাবিয়া দারুল হাদিস মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষও।

এমন ঘটনা ঘটেছে দেশের প্রায় সব এলাকায়ই। অথচ মন্ত্রী বলে দিলেন, মাত্র ১০ হাজার চামড়া থেকেছে অবিক্রীত। আর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০-২০ টাকা বা ৫০-১০০ টাকায় যে লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে তাকে কি বিক্রি হওয়া বলা যায়? গত সোয়া দশক ধরে দেশে যা কিছু অনাচার ঘটছে তার সব কিছুর দায়ই সরকারের ক্রিয়েটিভ ব্রেইনের পলিটিশিয়ানরা বিএনপি বা জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো ঢাকা। মানুষ মরছে। মহামারীর আতঙ্ক বিরাজ করছে। সিটি কর্তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার সমালোচনা শুরু হলো। অমনি সরকারের কর্তারা বলে দিলেন, এটাও নাকি বিএনপির ষড়যন্ত্র। যদিও সরকারের একজন মন্ত্রী ডেঙ্গু আমদানির কৃতিত্বটা বিএনপিকে দিতে রাজি হননি। নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘যে দেশ যত বেশি উন্নত হচ্ছে, সে দেশে তত বেশি রোগ-বালাইয়ের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গু এলিট শ্রেণির একটি মশা। এ মশা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন এ দেশে ডেঙ্গু এসেছে।’


কিছুদিন আগে দেশে গুজব ও গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যা করার হিড়িক পড়ে গেল। সরকার তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে দায় চাপিয়ে দিল বিএনপির ওপর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর মধ্যে আবিষ্কার করলেন বিএনপির হাত। বলে দিলেন, ‘গুজব ছড়িয়ে মানুষ পিটিয়ে মারায় বিএনপি নেতাদের হাত আছে’।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকও কম যান না। তিনি বললেন, ‘সাম্প্রতিক খুন-ধর্ষণের ঘটনা বিএনপি-জামায়াতের নিখুঁত ষড়যন্ত্র। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটলে তারপর কিছুদিন ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যেমন পুরান ঢাকায় অগ্নিকা-ের পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে পর পর কয়েকটি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। আবার পর পর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটল। এখন আবার গণপিটুনি দিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়, এগুলো আসলে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নিখুঁত ষড়যন্ত্র।’

গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় বিনা ভোটের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার দায়ে বর্তমানে জেলে আছেন আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন শরিক জাতীয় পার্টির এক সাবেক এমপি। কিন্তু হত্যাকা-ের পর পরই এখনকার এক মন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন, লিটনকে হত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে।

ছাত্ররা কোটা সংস্কার আন্দোলন করে। সেখানেও বিএনপির ষড়যন্ত্র আছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। স্পষ্ট বলে দেন, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলা কোনো ছাত্র আন্দোলনের অংশ হতে পারে না। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের অপকৌশল। এই অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনও। সেখানেও সরকারের লোকজন বিএনপির হাত আবিষ্কারেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।

দেশে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার লুটপাটের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশে অপারগতা জানিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, এর সঙ্গে এমন সব নাম যুক্ত আছে যে তা প্রকাশ করা যাবে না। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য জানার পর আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না শেয়ার মার্কেটের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটে কত বড় শক্তি জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ডাকাতি হয়, সে দায়ও নিতে হয় বিএনপিকেই। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলেছেন, এটিএম বুথ জালিয়াতি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে বিএনপি-জামায়াতের হাত আছে। খাদ্যে ভেজাল। সেটার জন্যও নাকি বিএনপি দায়ী। তাও যেনতেন নেতার কথা নয়। আওয়ামী লীগের তুখোড় ও সিনিয়র নেতা সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দিয়েছিলেন এই বাণী।  ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর গড়িমসি করে এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই আদালতের নির্দেশে সে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। অমনি আওয়ামী লীগের নেতারা বলে দেন, ডিএনসিসি নির্বাচন বন্ধের জন্য বিএনপি দায়ী। রানা প্লাজা ধসেও যে বিএনপি দায়ী সে বহুল আলোচিত পুরনো কথা। বিএনপির কর্মীরা যে ওই ভবনের পিলার ধরে নাড়াচাড়া করে রানা প্লাজা ধসিয়ে দিয়েছিল তার রাজসাক্ষী তো তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই।

এই যে ঈদে-পার্বণে তো বটেই সাধারণ সময়েও রেলের শিডিউল বিপর্যয় হয় তাও বিএনপির হাত ছাড়া হয় না। ‘পুরনো ইঞ্জিনে নতুন বগি’খ্যাত সাবেক রেলমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়ে একাধিকবার বিখ্যাত হয়েছেন। নতুন রেলমন্ত্রীও কম যান না।   মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচালে বড়ছড়া ব্রিজের ওপর ট্রেন দুর্ঘটনা হয়। আর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এক যুগেরও বেশি আগে ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়া দলটির ঘাড়ে সব দোষ দিয়ে বলে দেন, বিএনপি রেল সেক্টর একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরেও যা কিছু ঘটে তার জন্যও কিন্তু বিএনপি-জামায়াতই দায়ী। বিশ্বাস না হলে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সাহায্য নিতে পারেন। তিনি জানেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা যে নালিশ দিয়েছেন সেটাও জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্র।

আওয়ামী লীগ সরকারের যা কিছু ব্যর্থতা তার সব দায় যদি বিএনপিরই হয় এবং সে ষড়যন্ত্র ধরতে ও রোধ করতেও যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে ক্ষমতায় থেকে তারা করছেনটা কী! আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে যত সব অনাচার, অবিচার, গুম-খুন, শেয়ারবাজারসহ আর্থিক খাতে লুটপাট, ভোটের অধিকার হরণ, দুর্নীতি-দুঃশাসন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ধানের দামে ধস, বন্যা-দুর্বিপাক, ঝড়-বৃষ্টি-খরা সব কিছুর জন্য তারা বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপালেও একটা গুরুত্বপূর্ণ জেনুইন দায় এখনো চাপায়নি। এখনো তারা কেউ বলেননি, আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে যে একদলীয় বাকশাল সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখান থেকে আবার আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তনেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দায় আছে।

লেখক —  চিকিৎসক ও কলামনিস্ট। 
কার্টসি —  দেশরূপান্তর/ আগস্ট ২২, ২০১৯।  
লিঙ্ক —  http://bit.ly/2zdrbzr 

No comments:

Post a Comment