— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
বিগত কয়েক দিন ধরে সকল গণমাধ্যম জুড়ে ছিলেন কিশোর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শুধুমাত্র কার্টুন আঁকার অপরাধে ৬৯ ঘণ্টা তার নিখোঁজ থাকা, সেই সময়ে তার ওপর হওয়া নির্যাতন, মুশতাকের মৃত্যু, দফায় দফায় জামিন বাতিল, এ সবকিছুই কিশোরকে খবরের শিরোনাম করে রেখেছিল। তাকে নিয়ে লিখেছি আমিও। বলেছি বিভিন্ন টক শো, সেমিনার, মিটিং এ। কিশোর ‘ভাগ্যবান’ কারণ সে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। গণমাধ্যম তার পাশে দাঁড়িয়েছে।বর্তমান বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যে বীভৎস নির্যাতন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে, কিশোরের ওপরে চলা ৬৯ ঘণ্টার নির্যাতন তার আশপাশেও না। এখানে উল্লেখ করে রাখি, হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন দূরেই থাকুক, ন্যুনতম মানসিক নির্যাতনও আইন বিরোধী।
একজন স্বনামধন্য সাংবাদিকের নেয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি ‘অজ্ঞাতস্থানে’ নেবার পর কিশোরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল,
‘তোর পরিবারে কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে?’।
‘করে’ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল কিশোর।
‘কে?’
‘পিতা…এবং বোন…’
এরপর কিশোরের ওপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর নির্যাতন। দুই হাত দিয়ে একসঙ্গে কানে তীব্রভাবে আঘাত করে, মূলত কানের পর্দা ফাটানোর জন্য এটা করা হয়। খুব লক্ষণীয় বিষয় হল, কিশোরের দৃঢ় উচ্চারণ তার পিতা এবং বোনের আওয়ামী লীগ করা দেখাই যাচ্ছে তাকে বাঁচাতে পারেনি।
কিশোরের বিরুদ্ধে আনা বেশ কিছু অভিযোগের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযোগ ছিল সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে নিয়ে কার্টুন আঁকা।তিনি ওই ব্যবসায়ীকে কীভাবে চেনেন, কেন ওই ব্যক্তির কার্টুন এঁকেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কিশোর যে কার্টুনটি এঁকেছিলেন সেটি পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শরাফত এর, যা মুশতাকের মৃত্যুর পর ফেইসবুকে ভেসে বেড়িয়েছে।কিশোরের পরিবার যতই আওয়ামী লীগ করুক, তার চেয়ে প্রভাবশালি আওয়ামী লীগ এই দেশে আছে, যাদের সাথে ঠোকাঠুকি করলে বরদাশত করবে না সরকার, লেলিয়ে দেয়া হবে সরকারি বাহিনী।
মজার বিষয় হল, কিছুদিন আগেই আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা, ‘জনতার মঞ্চ’ এর উদ্যক্তা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়ে এই শরাফতের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। বসে নেই শরাফতও – একই দিনে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চিঠি পাঠান মইউদ্দিন খান আলমগীরের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে। এখানে দুর্নীতির অভিযোগ আর শত কোটি টাকায় আটকে নেই, গড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার ঘরে। শুধু তাইই নয়, দু’জনেই মিডিয়ায় একে অপরকে মিথ্যেবাদি বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, যদিও তাদের অতি প্রিয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেউ কারো বিরুদ্ধে সন্মানহানির মামলা করছেন না। দু’জনেই জানেন তারা কেউ কাউকে সহজে হজম করে ফেলতে পারবেন না, যতটা সহজে হজম করা যায় কিশোর কিংবা কাজলকে।
জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর প্রসঙ্গে মনে পড়ল তার গুণধর ভাগ্নের কথা। বেশ কয়েক বছর ধরে ভিসিদের কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে মোটামুটি শীর্ষে অবস্থান করছেন বেগম রকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাজমুল হাসান কলিমুল্লাহ। দুই দিন আগেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জনাব কলিমুল্লাহ এর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন। ৭৯০ পৃষ্ঠার সেই শ্বেতপত্রে অভিযোগের সংখ্যা ১১১ টি। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, জনাব কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ।
নিজে চরম বিপদে পড়ার অল্প কিছুদিন আগেই জনাব কলিমুল্লাহ মাঠে নেমেছিলেন আরেক জনের বিপদে সাহস যোগাতে।গবেষণা জালিয়াতির দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিয়া রহমান তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সাফাই গাওয়ার সংবাদ সন্মেলনটি করেছিলেন জনাব কলিমুল্লাহ এবং ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে পাশে বসিয়ে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক এই আইনজীবীকে কিছু দিন আগেই দুর্নীতির অভিযোগে মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইবুনাল থেকে অপসারণ করেছিল প্রসেকিউশন টিমের সরকার সমর্থক অন্য আইনজীবীরা।
সংবাদ সন্মেলনে সামিয়া রহমান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বিকার করেন এবং বলেন সবকিছুই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তার বয়ানমতে এই ষড়যন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন এবং একজন প্রতিশোধপরায়ন অতি ক্ষমতাধর উচ্চপদস্থ নারী শিক্ষক জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সব পদে আসীন শিক্ষকরা সবাই যে কেবল ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক তাই নয়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটাই তাদের একমাত্র যোগ্যতা। সুতরাং সমস্যাটা যে ঘরের মধ্যে ঘরে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
পৌর নির্বাচনের শুরু থেকেই পত্রিকা আলো করে আছেন, জনাব কাদের মির্জা। তিনি বসুরহাট পৌরসভার মেয়র, তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরের আপন ভাই। পুরো সময়টাই দেখা গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত সবার বিরুদ্ধে ‘সত্যবচন’ চালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগে তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ দেশে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে নাই, এবং সুষ্ঠু নির্বচন হলে আওয়ামী লীগের এমপিরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। যাদের বিরুদ্ধে মির্জা সাহেবের এত রাগ, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফেনীর সাংসদ নিজাম হাজারি, নোয়াখালীর সাংসদ একরামুল হক, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিক্সন, চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়র এবং সর্বোপরি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।দুই ভাইয়ের রেষারেষি এমন পর্যায়ের যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুকে বুকের কষ্ট চেপে লিখেছেন, নোবডি নোজ দ্য রিজন বিহাইন্ড মাই সাইলেন্স। আর দুই ভাইয়ের সংকটের জন্য প্রকাশ্যে ভাবীকে দায়ী করা কাদের মির্জা ফেইসবুকে তাদের পারিবারিক ছবির পাশে লিখেছেন - ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ।
দীর্ঘ সময় জনগণের কাছে জবাবদিহিতাহীনভাবে ক্ষমতায় থাকলে, বিরোধী সকল দল মতকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালালে একটা দলের কী পরিণতি হয়, আওয়ামী লীগ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দীর্ঘ ১২ বছরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং সুবিধাভোগীদের ভেতর অনেকগুলো ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে যেটা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় ঘরের ভেতরে ঘর, মশারির ভেতরে মশারি। এখানে প্রত্যেকেই প্রতি মুহূর্তে নিজের স্বার্থরক্ষা করতে এবং সুবিধার নিত্য নতুন পথ খুলতে এতটাই মরিয়া যে ন্যুনতম বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনা, বিবেক কারো মধ্যে নেই।
এই কলামে বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করলাম, কারণ সেগুলো খুব সাম্প্রতিক এবং আলোচিত। কিন্তু এমন ঘটনা গত কয়েক বছরে ঘটেছে অসংখ্য। এক বড় মশারির ভেতরে কতগুলো মশারি আরও টানানো হবে, টানালে কারা টানাবেন, পাশাপাশি থাকা মশারিগুলোর মধ্যে কোনটি গুরুত্ব বেশী পাবে, একই মশারির মধ্যে থাকা মানুষদের মধ্যে কে বা কারা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেসব নিয়েই চলছে এখন আওয়ামী লীগের সংকট। এর ফল সুদূর প্রসারী।এই ধরণের সংকট দলকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে নিশ্চিহ্নতার পথে নিয়ে যায়।
- লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী।
No comments:
Post a Comment