মা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আরাফাত রহমান কোকো |
সময়টা ১৯৮৮ অথবা ৮৯ সাল হবে। কোকো ভাই যখন মেলবোর্ন এসেছিল লেখাপড়ার জন্য, বেগম খালেদা জিয়া তখন বিরোধী দলের নেত্রী। এরশাদ ক্ষমতায়। তখনও বোধহয় পল কিটিং অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টার হন নাই। সে বছর বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য আমরা অস্ট্রেলিয়ায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানের মহড়ায় তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়।
সেই স্মরণীয় দিনে মোনাশ ইউনিভার্সিটির একটি হলরুমে আমাদের মহড়া চলছিলো। সিঁড়িতে উঠে একটা টানা বারান্দা পার হয়ে যেতে হতো সেই হল রুমে। এখান থেকে গানবাজনার শব্দ শোনা যেত, মানুষের কথাবার্তা, হাসাহাসিও। আমি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে দেখলাম উপরে রেলিংয়ের উপরে একজন তরুণ বসে আছেন। তাকে ঘিরে ফয়সল ভাই, মিকি ভাই, বাবু ভাই আরো অনেকে বসা। রেলিংয়ে বসা লোকটিই ছিলেন কোকো ভাই। কালো রঙের একটা লেদার জ্যাকেট গায়ে ছিল আর নীল জিন্স।
আমাদের একটা গ্রুপ ছিল, প্রতি মহড়ার পরেই আমরা একসাথে ঘুরতাম। কোকো ভাই, ফয়সল ভাই আর আরো কয়েকজন একটা বাসা শেয়ার করে থাকতেন। এই বিষয়টি নিয়ে ফয়সল ভাই বেশ গর্বিত ছিল, মনে আছে। আমাকে একবার সে বলেছিল, ‘কোকোকে আমি প্রথম দেখছিলাম টিভিতে!’ বলার সময় উনার গলা খুশীতে কাঁপছিল। প্রথম যখন ওই বাসায় উঠেছে, কোকো ভাই নাকি মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাতেন। এটি ছিলো ওনার বড় গুণ। আমার সারাজীবনের স্বভাব সবচেয়ে অপ্রিয় প্রশ্ন করা। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি জিয়াউর রহমানের ছেলে?’ মানে আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল ছোটবেলায় টিভির খবরে দেখা জিয়াউর রহমানের মুখ, একটা কোদাল হাতে, গেঞ্জি পরা ছবি ছিল না উনার? তারপরে যেবার আশুফুপুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম কুমিল্লায়, আমার তখন বোধহয় পাঁচ-ছয় বছর বয়স। আমিসহ সবার চোখে অসুখ হয়েছিলো সে বছর। ওই চোখ নিয়েই ফুফু একদিন কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন খবর পেলাম জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খবরটা শুনে কেমন অস্থির লাগছিল।
তাই কোকো ভাইকে করা আমার প্রশ্নটা যতই বেমানান হোক, এইটা আসলে একটা অস্বাভাবিকভাবেই করেছিলাম। উনি হাসা শুরু করেছিলেন। তারপরে বলল, ‘হুম, লোকে তো সেইরকমই সন্দেহ করে’। তারপরে স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে আমার সাথে ঠাট্টা করল, গণ্ডার ডাকল। কারণ উনার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার এতদিন পরে এই প্রশ্ন আমার মনে আসছে। অনুষ্ঠানের দিন কোকো ভাই মঞ্চে উঠে কিছুক্ষণ কথা বলছিল। কী বলছিল মনে নাই, তবে মঞ্চে উনারে দেখতে অন্যরকম লাগছিল, এমনিতে আমাদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় উনাকে কোকো ভাই ছাড়া আর কিছু মনে হত না, মজার মজার কথা বলত, সবাইকে হাসাত, দাঁত উঁচু ছিল কিন্তু চোখ অনেক সুন্দর থাকায় উঁচু দাঁত খেয়াল করতাম না।
মঞ্চে তাকে একটু একটু জিয়াউর রহমানের মতন লাগছিল। ওইরকম সানগ্লাস ছিল উনার। মঞ্চে কি সানগ্লাস পরা ছিল? না বোধহয়। ও রকম হলে তো হাসি আসত নিশ্চয়ই। তবে প্রথমেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলছিল মনে আছে। এটা মনে আছে কারণ, উনি নেমে আসার পরে অনেক মহিলারা উনাকে বলছিল উনি নাকি ঠিক উনার আব্বার মতন করে বক্তৃতা শুরু করেছেন, এতে সবাই খুশি হয়েছিল। কোকো ভাই লাজুক লাজুক হাসতে হাসতে সবার প্রশংসা শুনতেছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল।
কোকো ভাই পার্টটাইম চাকরি করত হান্টিংডেল-এর পিৎজাহাটে। আমাদের বাসার খুব কাছে। মাঝে মাঝে বাসায় আসত। পিৎজাহাটের লাল টিশার্ট আর কালো টুপিতে উনারে দেখা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমাদের। গরমের দিনে উনার ডিউটি শেষে বাসায় আসলে মাঝে মাঝে সবাই একসাথে মুভি দেখতাম। মাঝেমাঝে বেশ কয়েকজন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম। দৌড়াতে না পারলে বলত, ‘কীরে দুর্বল লাগে? সাগু খাবি?’ ভালো ড্রাইভ করত। উনি খুব স্বাভাবিক থাকত সবসময়, যে কোনো জায়গাতেই কমফোর্টেবল মনে হত। নার্ভাস ছিল না আবার অ্যারোগেন্টও না। তাই যে কোনো গ্রুপ সিচুয়েশনে উনি চুপচাপ থাকলেও লিডারশিপ উনার কাছেই আসত। আর উনিও এভাবে চালিয়ে নিত যে সহজে তা বুঝা যেত না। মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘তোরা এত ইনোসেন্ট ক্যান?’ উনার বলার ভঙ্গিতে মনে হত ইনোসেন্ট হওয়াটা বেশ দোষের একটা কাজ।
এরপর বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসলেন। তখন বুঝি নাই, এখন মনে হয় সেইটা বিশাল ঘটনা ছিল আসলে। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার দশ বছর পরে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসল। কোকোভাইও নিশ্চয়ই এই পরিবর্তন টের পেয়েছিল। অথচ উনার চলাফেরায় বা আমাদের সাথে মেলামেশায় সেইরকম কিছু বুঝতে পারা যায় নাই। আমরা তখনও আগের মতনই ব্যাডমিন্টন খেলতাম, মুভি দেখতাম, বিচে বেড়াতে যেতাম। শুধু বাংলাদেশীদের মধ্যে তার খাতির বেড়ে গিয়েছিল। অনেক দাওয়াত পেত। আর সেইসময় মেলবোর্নে বাংলাদেশি কমিউনিটি এত বড় ছিল না। সবাই প্রায় সবাইকে চিনত। দেখা যেত আমাদের দাওয়াতগুলো কমন পড়ছে। দাওয়াতেও আমরাই আড্ডা দিতাম। আর কোকো ভাইয়ের জনপ্রিয়তা নিয়ে তাকে ক্ষেপাতাম। ততদিনে তিনি পিৎজাহাটের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, প্লেন চালানোর লেসন নিতে শুরু করছিল। মাঝে মাঝে যখন ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম, তিনি গিয়ে একদম অপরিচিত সাদা লোকেদের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলায় কথা বলতে থাকতেন, ওরা কিছুই না বুঝে হাসত, এমনটা যে কতবার করছে! একবার মনে আছে, খেলার ব্রেকে বাইরের পাবলিক ফোন বুথ থেকে ফোন করছিল। আমিও সাথে আসছিলাম। পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। কাকে যেন বলছিল তার এক বন্ধুর কথা। যে কোনো একটা ব্যবসায়ের বিষয়ে দেখা করতে চায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কোকোভাই বলেছিল ‘আম্মাকে বলবেন, আমার বন্ধু বলে কোনো স্পেশাল ফেভার করার দরকার নাই।’ আমার মজা লাগছিল দেখতে। একটা মানুষরে দুই রকম দেখছিলাম। সেই সময়টা মনে আছে, আমরা মোনাশের স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন সেন্টারের সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, আর তিনি তখনও ফোনবুথে, কত মানুষজন আসছিল-যাচ্ছিল, কেউ উনারে চিনে না।
দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আমাদের বাসায় যখন বিদায় নিতে আসল কোকো ভাই, আমি জানতাম তাকে বিদায় দেয়া অন্য বন্ধুদেরকে বিদায় দেয়ার মতন না। দেশে গেলে তিনি তো আর কোকোভাই থাকবেন না, আরাফাত রহমান কোকো হয়ে যাবেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের সাথে কি আর বন্ধুত্ব হয়? পেপারে খবর পড়তে হয় তাদের নিয়ে। যেমন আজকে পড়ছি তার মারা যাওয়ার খবর। এই মানুষটাকে শুধু এমন একজন মানুষ হিসেবেই চিনতাম তো আমি, তার জন্য ব্যক্তিগত শোকের স্পেস আছে কীনা কে জানে।
- লেখিকা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি, অসওয়াইড ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং এ কর্মরত।