আগস্ট ১২, ১৯৬৯ — জানুয়ারি ২৫, ২০১৫ |
আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা খুব মনে রাখার মতো কিছু ছিল না। ক্রিকেট বোর্ড অফিসে নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আমি অমুক’। হাত মিলিয়েছিলেন কিন্তু তাতে এমন কোনো আন্তরিকতার ছাপ নেই। হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার। আমাদের দেশে রাজনীতিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান কিন্তু তাদের অনেক দোষ থাকলেও প্রকাশ্যে তারা ভীষণ আন্তরিক। সেদিন বুঝলাম, রাজনীতিক এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। রাজনীতিকদের মনে যাই থাকুক, মুখে থাকে হাসি। সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সেরকম নয়। তারা দেখানোর জন্যও কাউকে খুব পাত্তা দিতে রাজি নন। এরপর আর তার কাছ ঘেঁষার প্রশ্ন নেই। যথাসাধ্য দূরত্ব রক্ষা করেই চলেছি।
কয়েক মাস পর অস্ট্রেলিয়া সফর। ডেভ হোয়াটমোরের বাংলাদেশ দলের সঙ্গে সেই সফরে গিয়ে শুনলাম আরাফাত রহমানও এসেছেন। নিজে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন বলে সেই জায়গাটা নিয়ে বাড়তি আগ্রহও আছে। ডারউইন বা কেয়ার্নসে একদিন মাঠেও এলেন। সঙ্গীদের নিয়ে ছবি-টবি তুললেন। এটাও অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। আমাদের কর্তারা বিদেশে গেলে ব্যক্তিগত অ্যালবামের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করে থাকেন। ম্যাচ শেষে প্রেসবক্সে লিখছি, এই সময় তার একজন সঙ্গী এসে জানালেন, ‘কোকো ভাই আজ রাতে দলের জন্য একটা ডিনার দিচ্ছেন। তিনি চান, সাংবাদিকরাও সেখানে থাকুন। আপনাদের সবার আমন্ত্রণ।’
অস্ট্রেলিয়া পত্রিকার সাংবাদিকদের জন্য খুব সুবিধাজনক একটা জায়গা। খেলাটা বাংলাদেশ সময় দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায় বলে লেখার অনেক সময়। সুযোগ থাকে লেখা শেষ করে দাওয়াত রক্ষার। আমরা প্রেসবক্সে আলোচনা করে ঠিক করে ফেললাম, যেহেতু দাওয়াত দিয়েছেন তাই যাওয়া উচিত। আর তাছাড়া খেলোয়াড়দেরও একসঙ্গে পাওয়া যাবে। পরদিনের স্টোরির জন্যও রাতের খাবার আদর্শ জায়গা।
যেতে আমাদের দেরি হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধ ঘণ্টা পর। আর গিয়ে যা দেখলাম তাতে চমকে উঠলাম। প্রথম পরিচয়ে উন্নাসিক মনে হওয়া, ক্ষমতাবানসুলভ অহমিকা দেখানো মানুষটা তখনও না খেয়ে বসে আছেন। আমরা যেতেই উঠে এগিয়ে এলেন। সবার সঙ্গে এমনভাবে হাত মেলালেন যেন আমরা না যাওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠান পূর্ণতা পাচ্ছিল না। আর তাতে দূরত্বের দেয়ালটা ভেঙ্গে গেল যেন। ঢাকায় যা হয়নি সেই দূর অস্ট্রেলিয়ায় সেটা হলো। তার সঙ্গে বেশ লম্বা সময়ের আড্ডা। সেখানে পারিবারিক পরিচয়ের আবহ ছেড়ে যে কোকো বেরিয়ে এলেন তার চোখে ক্রিকেট নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন। আর চোখে ঝলমল করা সেই স্বপ্নে তাকে আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল শুধুই একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠক। রাজনীতি বা ক্ষমতার শক্তি নয়, ক্রিকেট ভালোবাসাই তার একমাত্র শক্তি।
এটা ঠিক যে রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদেই তিনি ক্রিকেট বোর্ডে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা কে আসে না! এখনও যে বা যারা ক্রিকেট বোর্ডে আছেন তাদের পরিচয়ও তো রাজনৈতিক। কিংবা ব্যবসায়ী। কাজেই সেই জায়গা দিয়ে বিবেচনা করলে প্রায় সবাইকে বাদ দিতে হয়। বিবেচনার পরিবর্তিত মানদণ্ড তাই তিনি কীভাবে এসেছেন সেটা বড় কথা নয়, এসে কী করলেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জায়গাটাতে আরাফাত রহমান অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি পদে মনোনয়ন দিতে পারত। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত চর্চা করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন। হননি। দায়িত্ব পালন করেছেন ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে, সেটা বোর্ডেরই অধীন একটা কমিটি। পরে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনেছি বটে কিন্তু সেই সময় মাঠে-ঘাটে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেও তার বলয়ের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপের কথা শুনিনি। এমন কিছু দেখিনি যাতে মনে হয়, তিনি শক্তি খাটানোর চেষ্টা করছেন। বরং দেখা গেছে, দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে অন্য অনেক লোভনীয় জায়গা বাদ দিয়ে তিনি ডেভেলপমেন্ট কমিটির মতো একটা প্রায় থ্যাংকসলেস কমিটিকে বেছে নিয়েছেন। আর তাতে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যতের ক্রিকেটার তৈরির দারুণ একটা পথ তৈরি করেছেন। অস্বীকারের উপায় নেই, আজকের সাকিব-মুশফিকরা সেই দূরদর্শী হাই পারফরম্যান্সেরই ফল। মোটের উপর পরের কয়েক বছরের সাপ্লাই লাইনটা তৈরিই হয়েছিল এই কমিটির মাধ্যমে। কমিটির প্রধান হিসাবে মূল কৃতিত্বটা তারই পাওনা।
কেউ কেউ তবু বলবেন, ঐ তো হলো! প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলেই তো...। তাদের জন্য একটা উত্তর আছে। বোর্ডে যারা ক্ষমতার জোরে আসেন তাদের মধ্যে কতজন পাওয়া যাবে যারা মাঠে ক্রিকেট খেলেছেন! হ্যাঁ, তিনি ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেছেন। দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট আর এমন কী ক্রিকেট! এই প্রশ্নও আসবে জানি। কিন্তু মা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলাটা তো একইসঙ্গে পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মানসিকতারও প্রকাশ। ১৯৯১-৯২ সালে খেলেছেন ক্রিকেট, যখন রাজ্যপাঠ পুরো তার পরিবার এবং দলের দখলে। এসবই প্রমান করে, অন্য ক্ষেত্রে যত কথা বা আলোচনাই থাক খেলার মাঠের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল পুরনো। ভালোবাসাটা ছিল খাঁটি।
বুঝতে পারি এখন যারা তার কীর্তিকে স্মরণীয় করতে এই বই প্রকাশের চেষ্টা করছেন তাদের খুব ঝামেলা হচ্ছে। লেখা দিতেও সম্ভবত চেনা অনেকেই রাজি হচ্ছেন না। কিন্তু আবার দেখবেন, সময় বদলে গেলে এরাই তার নামে ঢোল বাজাতে বাজাতে ফাটিয়ে ফেলবেন। আরাফাত রহমান বা রাজনৈতিক পরিবারের মানুষের এই একটা সমস্যা তারা না চাইলেও অনেক অঙ্কের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি তো ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করবে, সঙ্গে নিজেদের মানুষদের বেশি বড় করার চেষ্টাও তাদের অর্জন প্রশ্নের মুখে ফেলে। অথচ কী জানেন আরাফাত রহমানের মোটেও সেটা প্রাপ্য নয়। তিনি তো আমাদের খেলার জগতে রাজনৈতিক হিসাব ভেঙ্গে দেয়ার নায়ক। কীভাবে?
কাছের মানুষদের তথ্য অনুযায়ী তিনি ছিলেন আবাহনীর সমর্থক। আবাহনীর প্র্যাকটিস দেখতে ধানমণ্ডি ছুটে যেতেন বলে জানা গেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। সেই আবাহনী, যার প্রতিষ্ঠাতার নাম শেখ কামাল। যে ক্লাবের সঙ্গে তার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে সেই ক্লাবকে নিজের ক্লাব করতে একটুও অসুবিধা হয়নি। খেলা তার কাছে এত বড় ছিল যে রাজনীতির অঙ্ক পাত্তাই পায়নি।
তাই যদি হয় তাহলে তো হাইপারফরম্যান্স-ডেভেলপমেন্ট কমিটি এসবের চেয়েও এটা বড় ব্যাপার। খেলায় রাজনৈতিক বিভক্তি আর শক্তি ব্যবহারের কালো ছায়ার বিপরীতে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বিভেদমুক্তি আর ভালোবাসার সৌন্দর্য নিয়ে।
- লেখক উপ সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি, ২০১৬-২০১৯ । বর্তমানে তিনি দৈনিক দেশরূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
No comments:
Post a Comment